#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩৪
মৌমো তিতলী
❤️
নিয়ন আলো আর ইট-কংক্রিটের শহরেও এক ধরনের স্নিগ্ধ সকাল নামে, যদিও তার রঙটা গ্রাম্য ভোরের মতো নরম সবুজ নয়, বরং একধরনের ধূসর নীরবতা মিশে থাকা আলোতে মোড়ানো।
সকাল ছ’টার দিকে শহরের আকাশটা একটু ধোঁয়াটে। কুয়াশা নয়, ধোঁয়া আর দূষণের মিশ্র রূপ যেন। তারপরও সূর্য ওঠে—আলোর রেখা ফাঁকা বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে এক চিলতে উঁকি দেয়। বাতাসে কাঁচা রোদের গন্ধ নেই ঠিক, তবে রাস্তার ধারে ফুটে থাকা এক-আধটু নাম না-জানা গাছের পাতায় শিশির জমে থাকে এখনও।
সকালের শহর কিন্তু অলস নয়, জেগে ওঠে ধীরে ধীরে, যেন এক ঘুমকাতুরে দৈত্য। প্রথমে জেগে ওঠে পত্রিকা বিক্রেতা আর দুধওয়ালা। সাইকেলের টুংটাং শব্দে নীরব রাস্তায় এক ধরনের ছন্দ তৈরি হয়। তারপর ফ্ল্যাটবাড়ির জানালা খুলে দেয় কেউ কেউ—মুখে তন্দ্রা, হাতে চায়ের কাপ। নিচে রাস্তায় ঝাঁটা দিতে দিতে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী ভাঁজে ভাঁজে জাগিয়ে দেয় নগরটাকে।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখে ঘুম আর ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু তাতেও একটা দৃঢ়তা—দিনটাকে জয় করার, জীবনের দৌড়ে টিকে থাকার। অফিসগামী মানুষেরা ব্যস্ত পায়ে ছুটতে ছুটতে মোবাইলে কল ধরেন, মাথা নাড়েন, কখনো বিরক্তি, কখনো বিষণ্নতা চোখে।
একই শহরে, পাশের কফিশপে কেউ একজন জানালার পাশে বসে কফি চুমুক দিচ্ছে—হয়তো বই পড়ছে, বা ল্যাপটপে কিছু লিখছে। পাশের রোডে ট্র্যাফিক জ্যামের হালকা সুর, মাঝে মাঝে ভেঁপু বাজে, কিন্তু সেটাই যেন শহরের পরিচিত ছন্দ।
শহুরে সকালের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে—এখানে ব্যস্ততা আছে, ক্লান্তি আছে, কিন্তু একধরনের স্বপ্নও আছে। আকাশ ঢাকা থাকলেও মানুষ নতুন করে জেগে ওঠে, নতুন করে দিন শুরু করে—এই ঘাম, এই লড়াই, এই ব্যস্ততা, সব মিলিয়ে এক নিঃশব্দ জীবনের গন্ধ ছড়ায়।
এমনই এক চিলতে সূর্যের নরম আলো শিকদার হাউসের সবচেয়ে রুচিসম্পন্ন পরিপাটি ঘরটার জানালার থায় গলে ঝকঝকে সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝেতে এসে হুটোপুটি খাচ্ছে। তারই প্রতিফলনে গাঢ় ঘুম হালকা হয়ে এলো সারার। চোখের পাতা কুঁচকে এলো। অনাড়ম্বর অলসতায় চোখের পাতা টেনে খুললো সারা। চোখে এখনো ঘুম জড়িয়ে।
সারার একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে, সকালে ঘুম থেকে উঠলে তার মাথা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে থাকে। কয়েকমিনিট ঝিম মেরে বসে থেকে তবেই ব্রেইনে সবটা রিস্টোর করে।
সারা চোখ মেলে তাকালো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ঝকঝকে সাদা সিলিং। সাথে অসাধারণ কারুকার্য খচিত সিলিংফ্যান। তবে সেটা বন্ধ। এক্টিভ এসির কারনে রুমে বেশ শীতলতা বিরাজ করছে।
কপাল কুঁচকে এলো সারার। এটা তো তার রুম নয়! কোথায় এলো সে! মুহুর্তেই পাশ ফিরতে নিলে আচমকা বাধাপ্রাপ্ত হয়। নিজেকে আবিষ্কার করে এক মোহময় দৃঢ় বাহুবন্ধনে।
এক অদ্ভুত মোহময় অথচ চিরপরিচিত সুগন্ধে বেকাবু হলো হৃদয়। সারার কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের উপরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তৈমুর…যেন ঘুমের মাঝেও ভালোবাসায় তাঁকে আগলে রেখেছে।
এই উষ্ণতা,এই ঘ্রাণ,এই স্পর্শ… সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ।
সারা ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে তাকালো—
তৈমুরের মুখের পানে।
অবচেতনেই আঁকড়ে আছে তাকে। মুখখানা শান্ত, নিষ্পাপ ঘুমে আচ্ছন্ন। সারার মনে পড়ে গেলো গতরাতের প্রতিটি মুহূর্ত…
সেই নিঃশব্দ কাঁপন, ধীর অলিন্দে গলানো ভালোবাসার চুড়ান্ত মুহূর্ত , আর সেই একান্ত মিষ্টি মন মাতানো উক্তির পাগলামি—যেখানে তৈমুর বারবার বলেছিলো,
“আজ এই এখন থেকে আমি শুধু তোর। আমার সর্বস্বই তোর কাছে বাঁধা। তুই আমার, আমার হৃদয়ের ‘সারা জাহান।”ভালোবাসি জান -বেইবি!!
লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো সারার। চোখ নামিয়ে নিজের গালে হাত রাখলো—এতো উষ্ণ কেন মনে হচ্ছে?
আলতো করে তৈমুরের চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে দিলো সারা। মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। হুট করে কপালে একটা স্নিগ্ধ চুমু আঁকলো সে—
সেই চুমুতে ছিল কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর এক অদৃশ্য অঙ্গীকার।
মুহুর্তেই ফট তৈমুর চোখ মেলে তাকালো। তার চোখে দুষ্টুমির ঝলক, কিন্তু ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
“
তৈমুর কে এভাবে তাকাতে দেখে সারার হৃদস্পন্দন যেন গলা পর্যন্ত উঠে এলো।
থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললো,,,
:-আপনি,,,, আপনি জেগে ছিলেন?
তৈমুর ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“তুই আমায় চুরি করে চুমু দিচ্ছিলি? আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে ইজ্জত লুটে নিচ্ছিলি?
সারা মুখ ফিরিয়ে নিল লজ্জায়, চাদরের ভেতর মুখ লুকোতে চাইলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো তৈমুর। সারাকে নিজের কাছে একটু টেনে নিয়ে বললো,,,
:-ইশশ “এতো লাজ কেনোএখন? কাল রাতে তো বেশ সাহসী ছিলি…!! আই’ম ইমপ্রেস!
:-“আপনি একটা নিষ্ঠুর পুরুষ” মুখ নিচু করে গাল ফুলিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে ফেললো সারা।
:-তাই? তাহলে আজ রাতে আরও একটু বেশি নিষ্ঠুর হবো তাহলে মনে করে রেখিস।” বলেই গা দুলিয়ে হাসলো তৈমুর।
সারাকে টেনে বুকের উপর নিলো। গলায় তার দেয়া ভালোবাসার চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে।
সেথায় আঙ্গুল বুলিয়ে পরখ করে তৈমুর। অস্ফুট স্বরে কঁকিয়ে ওঠে সারা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে ব্যাথা উপশম করার চেষ্টায়।
সেই মিষ্টি ব্যাথায় জর্জরিত সারার মুখের দিকে নিরব চোখে তাকিয়ে থাকে তৈমুর। ঝুঁকে এসে সারার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিলো ক্ষতস্থানে। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো সারার। সেই হাসির মাঝে গড়িয়ে পড়লো নীরব প্রেম, চোখের মাঝে ফুটে উঠলো এক চিরন্তন প্রতিশ্রুতি।
রুমের এক কোণে সূর্যটা একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে।
তাদের দুজনের মাঝখানে আর কিছুই নেই—শুধু ভালোবাসা, আর এক নতুন জীবনের শুরু।
************
রোদ্দুরটা জানালার পর্দা গলে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকছে। তুলির চোখে আলো পড়তেই সে নড়েচড়ে উঠে বসলো। চোখ কচলে আশেপাশে তাকালো। তখনই টের পেলো – তার পাশে কেউ একজন ঘুমোচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, সায়ান! গভীর ঘুমে ডুবে আছে।
তুলি থমকে গেলো। মনে পড়ে গেল আগের রাতের কথা।
রাতটা ছিলো তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাত—বাসর রাত! কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সায়ান তখনো আসেনি রুমে। সে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই চিন্তায় কুঁচকে গেলো তুলির ওর মুখটা।
:-ও আমার উপর রেগে যায়নি তো? আমাকে তো একবার ডেকে উঠাতেও পারতো।
হালকা ভয়, অস্বস্তি আর অপরাধবোধে তুলির মুখটা মলিন হয়ে এলো। ঠিক তখনই পাশ থেকে একজোড়া হাত এসে পড়লো তুলির কোলে।
চমকে উঠলো তুলি। নড়াচড়া করতেই সায়ান চোখ মেলে তাকালো ওর দিকে।
তুলিকে ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উঠে বসলো। ঠোঁটে হালকা দুষ্টু হাসি টেনে বললো,,,
:-আমায় দেখছিলে বউ?
সায়ানের মুখে “বউ” শব্দটা শুনতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল তুলির শরীর জুড়ে।
তুলি মুখ নামিয়ে বললো, –
:-রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম… তো তুমি রাগ করোনি?”
সায়ান ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, –
:-রাগ করলে কি হতো? আমার তুলা ঘুমিয়ে ছিলো পরীর মতো। তাই আর ঘুম ভাঙানোর সাহস হয়নি! আর যাই হোক, তুলা তো এখন আমার। এমন বাসর রাত চাইলে আমি রোজ আনতে পারবো!! বলেই তুলির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো।
তুলিও হেসে ফেললো। মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব, কিন্তু চোখে ঝিকিমিকি আনন্দ।
সায়ান আবার বললো,
:-“তুমি ঘুমাচ্ছিলে আর আমি তোমাকে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম—এই মিষ্টি ঘুমভাঙা পরীর মুখটা দেখেই শুরু হোক আমার সারাটা জীবন।”
তুলি এবার সত্যি সত্যি লজ্জায় মুখ গুঁজে ফেললো সায়ানের বুকে। সায়ান ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,,
:-তবে আজ রাতে কিন্তু আমি ঘুমাতে দেবো না… কথা দিলাম!” – সায়ানের চোখে ঝিলিক দেয় একরাশ দুষ্টু হাসি।
তুলি থপ করে মৃদু ঘুষি মারে সায়ানের বুকে।
– অসভ্য! এমন বেহায়া জামাই আমার চায় না”
সায়ান হেসে বললো, – “
:-তাহলে? আমি তোমায় রিটার্ন করে দিচ্ছি আমার শ্বশুরবাড়িতে!”
তুলি এবার ঠোঁট এলিয়ে কেঁদে ফেললো। সায়ান অবাক বনে হতভম্ব হয়ে গেলো।
:-এই “কাঁদছো কেন? আমি তো মজা করছিলাম!”
তুলি হিচকি তুলে বলে, –
:-আমি আর কখনো এমন করবো না। কিন্তু তুমি এমন কথা বলবে না আর কোনদিন।
সায়ান ওর চোখে চুমু খেয়ে বললো,,,
:-আচ্ছা আচ্ছা। দেখি কাঁদে না।ইশশ আমার ধানি লঙ্কার চোখে কি জল মানায়? এখন কান্না বন্ধ করো। সায়ান আলতো হাতে চোখ মুছে দেয়। সায়ান বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বলে,,,
:-এখান উঠে পড়ো। ফ্রেস হয়ে নিচে এসো। ভার্সিটিতে যেতে চাও?
তুলি চোখ মুছে সায়ানের দিকে তাকায়। মলিন মুখে বলে,,,
:-যাওয়ার তো প্রয়োজন ছিলো কিন্তু কাল বিয়ে হলো আজই গেলে যদি কেউ কিছু বলে!!
:-এ বাড়িতে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না ডোন্ট ওয়ারি! তুমি চাইলে যেতে পারো। আমি তৈমুর কে বলে দেবো । রোশ তোমার বইগুলো নিয়ে আসবে।
তুলি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়ায়।
_________
শিকদার হাউসের সকলেই ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছে। সিমা শিকদার পাশেই সোফায় পা মেলে বসে আছে। হাতে ফ্রুট জুসের গ্লাস! আজকাল কেমন পা ফুলে তার। এভাবে পা মেলে ছাড়া বসতে অসুবিধা হয় তাই তাকে চেয়ারে বসতে সাফ মানা করেছে রিনা শিকদার। বড় জায়ের কড়া শাসন আর যত্ন ভালোবাসায় আছেন তিনি এখন।
সারা আর তৈমুর এখনো অনুপস্থিত! কিছুক্ষণ পর সারা ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। খালি চেয়ার থেকে ধুপ করে বসে হাঁক ছাড়লো,,,,
:-খালামণি খেতে দাও!!
রিনা শিকদার কিচেন থেকেই জবাব দিলেন,,,
:-অপেক্ষা কর একটু। এখনি দিচ্ছি! জাহান ওঠেনি এখনো?
গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে খালামনির প্রশ্নের বেশ জোরেই জবাব দেয় সারা!!
:-জাহান ভাইয়া তো সেই কখন উঠেছে।
সেই মুহূর্তেই তৈমুরকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে উচ্ছাসিত সারা বলে,,,
:-এইতো জাহান ভাইয়াও চলে এসেছে খালামনি!! বলেই চোখ তুলে তাকায় সারা।
সকলে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে সারার দিকে। শুধু মাত্র তৈমুর ব্যাথিত সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয় সারা। তৈমুর এসবের দিকে তোয়াক্কা করছে না নিজের মতো গ্লাসে জুস ঢেলে চুমুক দিচ্ছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। সারা সবাইকে পরখ করে মিন মিন করে বলে,,,
:-কি হলো! সবাই এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? আমি কি করেছি?
মুহুর্তেই হু হা করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো সবাই!!
সিমা শিকদার হাসতে হাসতে বললেন,,
:-সে কি যে সারা!! জামায় কে কেউ ভাইয়া বলে ডাকে?
রেশমী হাসতে হাসতে শেষ।
সাইফ শিকদার,আলিফ শিকদার বেশ অপ্রস্তুত হয়েছেন। তবুও ওনাদের মুখে হাসি।
সারা বেশ লজ্জা পেলো। ওর তো মাথায়ই আসেনি ব্যপারটা। ইশশশ কি একটা ব্লান্ডার করে ফেললো সে!! মনে মনে মাথায় চাটি মারে সারা!!
উউউফফ সারা এতো বোকা কেন তুই!
তৈমুর রেশমীর দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-বোনু ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় তুলির বইগুলো সাথে নিস। ও ভার্সিটি যাবে বললো।
রেশমী মাথা নেড়ে সায় দিলো। সারা তাদের কথা শুনে বললো,,
:-আমিও আজ ভার্সিটিতে যাবো। (সারা,সামিরা দুজনেরই স্থানীয় পাবলিক ভার্সিটিতেই চান্স হয়েছে)
সামিরা ফোন করেছিলো আজ যাবে বললো।
রিনা শিকদার সারার প্লেটে ডিম পরোটা তুলে দিতে দিতে বলেন,,,
:-আজকের দিনটা থাক! কাল থেকে যাস!
সারা ঠোঁট উল্টে বলে,,
:-কেনো খালামনি! আমি বাড়িতে একা বসে কি করবো! রেশমী আপুও তো চলে যাবে ভার্সিটিতে।
:-যাক!! কাল বিয়ে হলো আজ আর যেতে হবে না ্
সারা ঘোর বিরোধিতা করে বললো,,,
:-খালামণি প্লিজ তুমি অন্তত এসব কুসংস্কারের কথা বলো না। আর তুলি আপুর ও তো কাল বিয়ে হলো। সেও তো যাবে বললো ভার্সিটিতে।
তৈমুর এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার সারার দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,,
:-বাহঃ বউ তুমি তো দেখছি খুউব অ্যানার্জেটিক! কাল সারা রাত এতো ধকল নিয়েও আজ ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে ভার্সিটিতে যেতে চাইছো!! ইম্প্রেসিভ! আই প্রাউড অফ ইউ বউ!
তৈমুরের কথায় আচমকা বিষম লেগে হিচকি উঠে গেলো সারার। রিনা শিকদার তড়িঘড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন সারার দিকে।
:-আস্তে আস্তে খা!! সবসময় এতো তাড়াহুড়ো করিস কেন?
:-সারা গ্লাসের পানি পুরোটা শেষ করে আড়চোখে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে,,,
:-অসভ্য!
দাঁতে ঠোঁট চেপে দুষ্টু হাসে তৈমুর।
***********
গরমের দুপুর। ক্যাম্পাসের পাকা রাস্তাগুলো রোদের ঝলকানিতে ঝিম ধরেছে, তবুও ভরা দুপুরে ভার্সিটির প্রাণচাঞ্চল্য একটুও কমেনি।
রেশমী বেরিয়ে এলো ইকোনমিক্স বিল্ডিং থেকে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতেই সূর্যে তিক্ষ্ণ রশ্মি এসে ধাক্কা খায় রেশমীর চোখে। পাশে পাশে হাঁটছে সালমা, নিশি, নিরব আর রাতুল—
বন্ধুত্বে ভরা ওদের চিরচেনা হাসির জগৎ। কেউ কেউ ঠাট্টায় মশগুল, দুষ্টু সালমা রেশমীর কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই ওর মুখ লাল হয়ে ওঠে।
:-আহা! কি লাজুক হাসি রে রেশু?”
রেশমী মুখ ঘুরিয়ে ফেলে, কিন্তু ওর গালে লেগে থাকা হাসিটা আড়াল হয় না।
ওরা জানে।
তালহা স্যার আর রেশমীর মাঝে লুকোনো এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
শুধু সম্পর্ক নয়, এক চুপচাপ ভালবাসার গভীরতা।
তা জানে শুধু ওরা দুজন আর এই চারজন বন্ধু। বাইরে কাউকে জানার অনুমতি নেই।
শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কে প্রেম? এই সমাজ কাঁধ ঝাঁকাবে, আঙুল তুলবে, সন্দেহের ধোঁয়া উড়াবে। তাই সবকিছু থেকে কৌশলে আড়াল করে রেখেছে তারা চার বন্ধু।
এতো হাসাহাসির মাঝেও রেশমীর কপালে এক চিলতে চিন্তার ছাপ। তালহা আজ ক্লাসে একটু বেশিই রুক্ষ ছিলো। যেন তালহার চোখে-মুখে একটা চাপা উদ্বেগ ছিলো।
আবারও কোন সমস্যা হলো কিনা কে জানে!
দোতলার বারান্দা থেকে এদিকেই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালহা। মেয়েটার হাসিমুখ তার সবথেকে প্রিয়। দুনিয়ার যতো বড় ঝড় আসুক,সব ঝড়ঝাপটা হাসিমুখে সয়ে নেবে তালহা, তবুও যে এই স্নিগ্ধ পরীটাকে তার চায়। একান্ত নিজের করে চায়। আর সে সেটা করবেই যে কোন মূল্যে!
আর ওদিকে…
উল্টো দিকের পুরনো বিল্ডিংয়ের ছায়া ঢাকা করিডোরে দাঁড়িয়ে এক আগন্তুক — গা ঢাকা কালো পোশাকে, চোখে মোটা গ্লাস, হাতে একটা ক্যামেরার মতো কিছু।
সোজা তাকিয়ে আছে রেশমী আর তালহার দিকেই।
চোখে বিদ্বেষের ছায়া। সে যেন কিছু জানার চেষ্টা করছে…অথবা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে।
ক্যাম্পাসের এই নির্মল প্রেমের গল্পে তার আগমন যেন অশুভ এক ছায়ার মতো।
বন্ধুরা হৈ-হৈ করে হাঁটছে সামনের দিকে।
রেশমী হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছনে বারান্দায় তাকালো…তালহা নেই।
কিন্তু রেশমীর ধারণাও নেই ছায়ায় ঢেকে থাকা এক বিষদৃষ্টি কাঁটার মতো বিঁধে আছে তার দিকে।
অজানা আগন্তুক ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো আড়াল থেকে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লাগালো কোথাও। ফোন রিসিভ হতেই বলে,,,
:-স্যার পাক্কা খবর আছে! মাইয়াডার সন্ধান পাইয়া গেছি! ছবিও তুলছি কয়েকটা।
:-___________
ওপাশ থেকে কি বললো শোনা গেলো না। তবে জবাবে লোকটা বিশ্রী দাঁত বের করে হেসে বললো,,,
:-কি যে কন স্যার! এই ফরহাদ পাক্কা লোক আছে স্যার। ফরহাদ কখনো ভুল তথ্য দেয় না। আমি ওগো ফলো কইরা যেটুকু বুঝছি,মাইয়াডা ওই পোলার ডিফারমেন্টেরই ছাত্রী।
:-_________!
:-আরে হ স্যার! আমি আইসা পরোমান সহ আফনের ছবি দেহামু।
:-___________!
:-ওকে স্যার। সালাম স্যার।
ফোন কাটে ফরহাদ। রেশমীদের দিকে আরেকবার দৃষ্টি বুলিয়ে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে সেখান থেকে।
চলবে,,,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,,,৩৫
মৌমো তিতলী
❤️
( ঢাকা সেনানিবাসের সাথে গল্পের কোন সাদৃশ্য নেই। গল্পের বর্ননা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।)
ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা সবুজে ঘেরা সুপরিসর ক্যাম্প। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই ক্যাম্পের পাথরে বাঁধানো প্রশিক্ষণ মাঠে সেনারা ঘাম ঝরাচ্ছে। দু’পাশে সারিবদ্ধ আধুনিক বিল্ডিংগুলো, অস্ত্রাগার, গোয়েন্দা বিভাগ, হেলিপ্যাড আর স্ট্র্যাটেজিক অপারেশন সেন্টারের কাঁচের দেওয়ালের ভেতর চলছে নিঃশব্দ গতিবিধি। সবকিছুই নিঁখুত নিয়মে বাঁধা — যতটুকু দেখা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি লুকোনো থাকে এই কাঠামোর গভীরে।
সেই কাঠামোরই একটি বিশেষ শাখায় ঢুকলেন মেজর জেনারেল আলভী এহমাদ। সুগঠিত শরীরে আঁটসাঁট সেনাবাহিনী মেজর জেনারেলের ইউনিফর্ম। কাঁধে তিনটি তারা, চোখ তার শান্ত নদীর মতো থাকলেও হৃদয়ে চাপা উত্তেজনা।
সেদিনের তৈমুরের সাথে বৈঠকের পরদিনই আলভী পরিবার নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরেছিলো। তখন থেকেই গত একমাস ধরেই তিনি অনুসরণ করছেন এক ভয়ঙ্কর অদৃশ্য চক্রকে — যার মূল কেন্দ্রে রয়েছে তারই শ্বশুর, সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অফ আর্মি স্টাফ, জেনারেল এরশাদ হামিদ (অব.)।
লোকে তার নাম নেয় শ্রদ্ধায়, ইতিহাস বইয়ে তাকে বলা হয় ‘স্বচ্ছ নেতৃত্বের প্রতীক’। কিন্তু আলভীর জানা আছে, এই প্রতীকের ভেতর ছিল অন্ধকারে মোড়ানো এক সাম্রাজ্য, যেখানে কালো টাকার পাহাড় জমেছে নিরবে, আর বহু নিরীহ মানুষের জীবন গিলে খেয়েছে ক্ষমতার লোভে।
তৈমুরের সন্দেহের ব্যাপারে জানতে পারার পর থেকে অদ্ভুত এক অস্থিরতায় ভুগছে আলভী। কেনো যেনো তারও এখন মনে হচ্ছে এরশাদ হামিদ মেয়ের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই কোনভাবে মায়াকে সরিয়ে দিয়েছেন পথ থেকে। আট বছর আগে সেই ‘আত্মহত্যা’র সংবাদ পেয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিলো আলভী। যদিও তার একবার মনে হয়েছিল মায়া আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল মনের নয়, কিন্তু তখন এগুলো নিয়ে তদন্ত করার মতো অবস্থা বা মনমাসিকতায় ছিলো না সে। তবুও মনে মনে নিজেকে বুঝিয়েছে ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা কতখানি সে নিজেই অনুভব করেছে তার শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায়। হয়তো মায়া তা সহজে সহ্য করতে পারেনি। কিন্তু এখন আর নয়। সে অতীত টেনে সামনে নিয়ে আসবে। অন্তত নিজের সহোদরের চোখে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য হলেও।
আজ আলভী যাচ্ছেন আর্কাইভ ডিপার্টমেন্টে, যেখানে পুরনো অপারেশন ফাইল, ডকুমেন্টে হয়তো কোন প্রমাণ লুকিয়ে আছে। তার সাথেই আছেন তার একমাত্র বিশ্বাসভাজন — লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহিন ইকবাল। চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ঠোঁটে কম কথা, আর মাথায় ঠান্ডা।
তিনি সাবেক মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসার — বর্তমানে ক্যাম্পের স্পেশাল এক্সটারনাল ইনভেস্টিগেশন সেলের ইনচার্জ।
—
আর্কাইড ডিপার্টমেন্টের এক বহু বছরের তালা লাগানো রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো আলভী আর শাহীন ইকবাল। শাহীন প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে দেয়। বহুদিন কেউ দরজাটা না খোলার কারণে মরিচা পড়ে গেছে কব্জায়। দরজায় হাত দিয়ে ঠেলে দিতেই ক্যাটক্যাট শব্দ তুলে খুলে দেয় দরজা।
নিঃশব্দে দুজন ঢুকে পড়ে সেখানে। অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরে। অসংখ্য মাকড়সার জাল বিস্তার লাভ করেছে ঘরটায়। শাহীন দরজার পাশ থেকে একটা পরিত্যক্ত ঝাড়ু হাতে নিয়ে সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জালগুলো পরিষ্কার করে।
পূর্ব পাশে বড় একটা সেল্ফ জুড়ে রয়েছে হাজারো ফাইলপত্র । লেগে পড়ে দুজন। এক এক করে চেইক করতে থাকে ফাইল গুলো।
একটা ফাইল নেড়েচেড়ে দেখে শাহীন বলে ওঠে,,,
:-“স্যার, এই ফাইলটা আট বছর আগের। হেল্থ হার্ট হসপিটাল থেকে পাঠানো মায়া রহমানের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহিন ফাইলটা খুলে রাখলেন ডেস্কের ওপর।
আলভীর চোখ স্থির হয়ে এলো রিপোর্টের ওপর।
:-No internal injuries. The case of complete suicide.
শাহীন আলভির থমথমে মুখ পর্যবেক্ষণ করে বলে,,
:-তবে মনে হচ্ছে আপনার সন্দেহ সঠিক স্যার!
এখানে একটা anomaly আছে। মূলকপি মনে হচ্ছে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া ভাবুন সেনানিবাসে হসপিটালের এই পোস্টমাটাম রিপোর্ট কেন থাকবে? তাও শুধুমাত্র মায়া ম্যাডামের। নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে স্যার।
আলভীর গলা হিম হয়ে এলো কাঁপা হাতে ফাইল উল্টে পাল্টে দেখলো। একটা পিন আলগা রয়েছে। দেখেই বোঝা যায় ওপর থেকে কোন কিছু টেনে খুলে নেয়া হয়েছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো আলভী। মায়ার হাসিমাখা মুখটা মনে পড়ে গেল চোখ বুজলেই।
মুহূর্তের চোখ খুলে ফেললো আলভী। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,,,
:- হাত চালাও শাহীন। কোনা কোনো খুঁজে দেখো।কিছু না কিছুতো প্রমাণ মিলবেই!!
—
গরমের বিকেল। ক্যাম্পাস ছুটির আমেজে কিছুটা ফাঁকা। সারা আর সামিরা হাঁটছিলো, হাতে বইয়ের ব্যাগ, ক্লাস শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। সামিরা চুপচাপ, আর সারা কিছুটা গরমের কারণে হাঁসফাঁস করছে—
ভার্সিটির গেট দিয়ে বের হতেই থমকে দাঁড়ায় সারা। তাদের সামনেই রাস্তার ধারে দাঁড়ানো আব্র। —স্মার্ট, কিন্তু চোখেমুখে একরাশ গ্লানি।
সারা,সামিরা কে দেখতেই এগিয়ে এলো আব্র। সারা সামিরার হাত খানা শক্ত করে ধরে আছে। সেদিনের পর আব্রকে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগছে সারার।
“:-সারা, একটু কথা বলা যাবে?” —আব্র এগিয়ে এসে অনুরোধ করলো।
সারা মুখ ফিরিয়ে নিলো। “
:-আমি দুঃখিত আব্র ভাইয়া, আমার এখন তাড়া আছে। বাসায় ফিরতে হবে।
:-দয়া করে সারা,একবার… একটাবার শুধু বসো আমার সাথে,” আব্রর কণ্ঠে চাপা ব্যথা।
সামিরা চেয়ে চেয়ে দেখলো, কিছু বললো না। সারা তার দিকে তাকিয়ে একটু অসহায়ভাবে মাথা নাড়লো। শেষমেশ, অগত্যা সম্মত হলো—
:-আচ্ছা, পাঁচ মিনিট।”
তারা কাছের একটা ছোট রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। তিনজনে একটি কোণের টেবিলে বসলো। আব্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারার দিকে—যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, যে মেয়েটিকে সে এতো ভালোবাসে, সে এখন অন্য কারো স্ত্রী।
:-তুমি… অনেকটা পাল্টে গেছো সারা…” —আব্র মলিন চোখে বললো।
সারা চুপ। তার ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে, প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলছে না। সে চোখ নামিয়ে রাখলো।
:-জানো, সেদিন যখন শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে … সেটা মেনে নিতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো।” —আব্র বললো হঠাৎ, গলার স্বর ভারী।
সামিরা তখন মুখ তুলে ঠান্ডা স্বরে বললো,
:-আপনার এখন এগুলো বলা ঠিক হচ্ছে না ভাইয়া। সারা বিবাহিত। তাছাড়া সে আগেও আপনাকে কখনো এভাবে দেখেনি।”
আব্রর মুখের ভাব পাল্টে গেলো। সে আনমনে বললো,
:-কিন্তু কেন বুঝলে না আমার ভালোবাসা?”
সামিরা একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
:-সে তো অনেকেই বোঝেনা, ভাইয়া।”
তার কণ্ঠে যেন চাপা কিছু তীব্রতা লুকানো—যা কেউ বোঝে না। সেও কি ভেতরে ভেতরে আব্রর প্রতি দুর্বল ছিলো? সেটা সে নিজেও ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারেনি।
সামিরার কথায় কিছুটা চিন্তিত ভাব ফুটে উঠলো আব্রর মুখ জুড়ে।
এই পুরো দৃশ্যে অজান্তেই রেস্টুরেন্টের এক কোণ থেকে কেউ কিছু ছবি তুলছিলো। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করায় কেউ কিছু টের পায়নি। ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ছে—সারার মুখের চাপা অস্বস্তি, আব্রর কষ্টে গলে যাওয়া চোখ।
ছবিগুলো তোলা হচ্ছে এমনভাবে যাতে বোঝানো যায়, সারা যেনো আব্রর খুব কাছেই রয়েছে… যেনো তাদের মাঝখানে এক অদ্ভুত “ক্লোজনেস” আছে।
ছবিগুলোর দিকে একবার দেখে নিয়ে কপোট ভঙ্গিতে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো অজ্ঞাত ব্যক্তিটি। কি জানি,, হয়তো কোন নতুন ঝড় আসতে চলেছে সারা-তৈমুরের সুখের জীবনে।
*******
রাত প্রায় বারোটা পেরিয়ে গেছে। তালহার রুমটায় একরাশ নীরবতা। ঘরের কোণে রাখা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ল্যাপটপের স্ক্রিনে ঝলসে উঠছে পরবর্তী সেমিস্টার পরীক্ষার সিট প্ল্যান। চোখে ক্লান্তির ছাপ, তবুও দায়িত্বের চাপের কাছে মাথা নোয়ানো নয়। ভার্সিটির প্রফেসর হওয়ার মানে তো শুধু ক্লাসরুম নয়,অনেক দায়িত্ব চলে আসে কাঁধে।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটা অপরিচিত নাম্বার।
তালহার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। এ সময় কে কল করতে পারে! ফোন ধরতে না চাইলেও, বারবার কল আসাতে বাধ্য হয়ে ধরলো
:-Hello! Professor Talha Ahmad speaking..
ওপাশ থেকে রিনরিনে স্বরে কিছু গানের কলি ভেসে এলো,,,
:-চাতক প্রায় আহরণিসি,
চেয়ে আছে কালো শশি,
আমি হব বলে চরণ দাসি…
ও তা হয় না কপাল গুণে,
আমার মনের মানুষেরও সনে,
মিলন হবে কত দিনে প্রায়…
…
যখন ওই রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোকো লজ্জারও ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই—
**“ওই প্রেম যে করে সে জানে,
আমার মনের মানুষেরও সনে”**
মিলন হবে কত দিনে,,,,,,
তালহা ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। গলার স্বর সে ঠিকই চিনতে পেরেছে। কিন্তু এর নাম্বার তো সে ব্ল্যাকলিস্টে রেখেছিলো! এই জন্যই আননোন নাম্বার থেকে কল করেছে। বেশ বিরক্ত হলো তালহা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,,
:-রাত বিরাতে কল করে এসব কি ধরনের অসভ্যের মতো আচরণ সাবিকা??
ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ এলো।
:-অসভ্যতা হতে যাবে কেনো? ভালোবাসার মানুষটাকে ফোন করা কি অসভ্যতার মধ্যে পড়ে?
তালহার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল এবার।
:-লিসেন! তোমার এই নাটকীয় প্রেমের ভঙ্গি শুনে আমি ক্লান্ত, সাবিকা। এসব বন্ধ করো। আমি তোমাকে ভালোবাসি না। কখনোই না। হাজার চেষ্টা করো, আমি তোমায় বিয়ে করবো না। বরং এখন থেকে আমাকে ফোন দেওয়া বন্ধ করো। আমাকে আরো কঠোর হতে বাধ্য করোনা।”
সাবিকা কিছু বলতে গিয়েও সুযোগ পেল না। তালহা ফোনটা কেটে দিল।
অন্যদিকে, সাবিকার মুখ আগুনের মতো লাল। এক রাশ অপমান গিলতে না পেরে রাগে ছুড়ে মারল ফোনটা বিছানায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
:-যার জন্য আজ তুমি আমাকে এভাবে অপমান করলে,আমার ভালোবাসা কে প্রত্যাখ্যান করলে, তাকে আমি ছেড়ে দেবো না। শেষ করে দেবো তাকে!”
—
তালহার রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে। নিজেকে শান্ত করা দরকার। বেশ কিছু কাজ এখনো পেইন্ডিং পড়ে আছে। তালহা জানে এখন নিজেকে শান্ত করতে তার কি করা প্রয়োজন।
সে ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার ঘোরালো—Rope of love…।
রিং হতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নরম ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর,,,
:- “হ্যালো? কে বলছেন!
প্রেয়সীর ঘুম জড়ানো কন্ঠে তালহার অশান্ত হৃদয়খানা এক নিমিষেই নরম হয়ে গেলো।
:-ঘুমিয়ে পড়েছিলে? আমি… একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম।”
তালহার কন্ঠস্বর টের পেতেই ঘুম ছুটে গেলো রেশমীর। ভালো করে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফের কানে ধরে।
:-না পড়ছিলাম । হুট করে চোখ লেগে গেছে। এই সময় কল করলেন যে। সব ঠিক আছে তো?”
:-নাহ, সব ঠিক আছে জান। Don’t worry….
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,,
:-সাবিকা ফোন করেছিলো। এমনভাবে কথা বলেছিলো যা সহ্য করতে পারছিলাম না। মেজাজ গরম হচ্ছিলো। তোমার কণ্ঠ শুনে মনটা একটু হালকা লাগছে।”
রেশমি মলিন হেসে বলল,
:-আপনি জানেন তো আমি আছি আপনার পাশে? আপনি আমার শিক্ষক ঠিকই, কিন্তু আপনি আমার হৃদয়ের মানুষও। কে কি বলুক, তাতে কি যায় আসে?”
তালহার মুখে হাসি ফুটলো। অন্তরে প্রশান্তি,,
,
:-তোমার এই কথাগুলোই বাঁচিয়ে রাখে আমায় রোশি। আমি বাঁচতে চাই তোমার সাথে,তোমার হাত ধরে, সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে।”
রেশমী মুখটা নামিয়ে মৃদু হাসে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে দুজনে।
রাত গভীর, বাইরে ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। শহরের কোলাহল থেমে গেছে, কিন্তু তালহার হৃদয়ে রেশমির কণ্ঠে একটুকরো শান্তির গান বয়ে যাচ্ছে। ফোনের অপর প্রান্তে দুই মানুষ, যাদের ভালোবাসা গোপন—তবুও সবচেয়ে সত্য।
________
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সকাল সকাল সায়ান তুলিকে নিয়ে শিকদার হাউসে হাজির। প্রথমবার মেয়ে জামাই এসেছে। দারুন খুশিতে ভরে উঠেছে শিকদার হাউস।
সারা আর রেশমী দুপাশ থেকে তুলিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।সারা মুখ ফুলিয়ে বলে,,
—:-আপু তুমি এখন সায়ান ভাইয়ার বউ হয়ে কেমন পাল্টে গেছো! একবার ফোনটাও করো নি।
রেশমী কাঁধে হাত রেখে বললো,,,,
:-বউ হবি তুই ওই বাড়ির। কিন্তু এই বাড়িতে তুই আমাদের তুলি-ই থাকবি, বুঝেছিস?”
তুলির গাল লজ্জায় লাল। বোনেদের দিকে তাকিয়ে হাসে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ান তার চিরচেনা ঢংয়ে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে হালকা হাঁসি দিলো,,,
:-কি! শালী সাহেবারা,থুড়ি! একজন শালী সাহেবরা,আরেজন ছোট্ট ভাবি!!
সায়ানের কথায় আচমকা ঘুরে তাকালো সারা। চোখ ছোট ছোট করে সায়ানের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সারাকে ওভাবে তাকাতে দেখে বোকা বোকা হাসি দিলো সায়ান।
:-আপনি তার মানে এতো দিন ছোট্ট ভা..আপু এইজন্যই বলতেন! আপনি আগে থেকেই সব জানতেন তাইনা?
সায়ান হেসে ফেলে।
:-ঠিক ধরেছো ইন্টেলিজেন্ট ছোট্ট ভাবি!
মুখ ফুলায় সারা।
রিনা শিকদার নিজ হাতে জামাইকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত।
সায়ান রিনা শিকদারের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,,
:-আন্টি আর যায় হোক! আল্লাহ তোমার হাতের রান্না খাওয়ার একটা পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি ধন্য!”
রিনা শিকদার সায়ানের বাহুতে স্নেহের চাপর মেরে হেসে উঠলেন,,,
:-দুষ্টু ছেলে!!
এই সময় ড্রইং রুমের মধ্যে ঢুকলো তৈমুর। মুখে আলাদা প্রশান্তির ছাপ, সায়ান আর ছোটবোন কে একসাথে দেখে চোখে আলাদা উচ্ছ্বাস।সায়ান আর রিনা শিকদারের শেষ কথাটুকু কানে এসেছে তৈমুরের। সায়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তৈমুর। বললো,,
— :- মাথামোটা সায়ানাইড ! এখন তুই শিকদার হাউসের জামাই হয়েছিস।একটু তো সিরিয়াস হ।
সায়ান দাঁত বের করে হেসে বলে,,,
— সিরিয়াস হবার সুযোগই নেই!”
ওদের দুজনের এই খুনসুটি দেখে আলিফ শিকদার আর সাইফ শিকদারও হেসে উঠলেন। সাইফ শিকদার বললেন,
:-আমি আর আলিফ বাজারে যাচ্ছি। আজ খাবারের জম্পেশ আয়োজন হতে হবে। কাচ্চি, রোস্ট, জর্দা, পায়েস—সব হবে।”
আলিফ শিকদার তার বাহুতে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে বললো,
:-তবে শর্ত একটাই—মাছ,মোরগ, আমার ফার্ম থেকে আসবে। কি বলো ভাইজান!!
সাইফ শিকদার সহোদরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,,,
:-হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হবে চল!
চারপাশে হাসি, খুশি, ভালবাসায় ভরে উঠলো শিকদার হাউস। রান্নাঘরে রিনা শিকদার রান্নায় ব্যস্ত, সারা আর রেশমী হাত লাগিয়ে দিচ্ছে রান্নায়,
সিমা শিকদার নিজের রুমে আছেন।তুলি ছোট কাকির কাছে বসে আছে। নানা রকম গল্পে মেতে উঠেছে দুজন। প্রেগন্যান্সির শেষ সময় চলছে এখন সিমার। রিনা শিকদার ছোট জায়ের প্রতি বেশ সাবধানতা অবলম্বন করছেন। এতো কিছুর মাঝেও বার বার গিয়ে দেখে আসছেন। সায়ানও গিয়ে দেখা করে এসেছে।
আর এই সব কিছুর মাঝেই তৈমুর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে। নজর তার হাতে বিদ্যামান ফোনের দিকে। সায়ান তার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে। আশপাশ টা ভালো করে দেখে এগিয়ে গেলো তৈমুরের দিকে,,,
:-What happened তৈমুর?
সায়ানের কথায় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তাকালো তৈমুর। ফোনটা সায়ানের দিকে তাক করে কিছু একটা দেখিয়ে বলে,,,
:-There’s going to be another special operation tomorrow.!!
ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তৈমুরের দিকে তাকালো সায়ান। মুহুর্তেই দুইজনের ঠোঁটে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাসি!!
#চলবে
#সারা_জাহান
বোনাস পর্ব,,,,
মৌমো তিতলী
❤️
ঢাকার শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দুরে বিশাল এক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সুনসান নীরবতায় ঘেরা সরু পথ। পথটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে জঙ্গলের অভ্যন্তে। মানুষের চলাচল সেখানে নেই বললেই ঠিক হবে। রাতের বেলা তো দুর, দিনের বেলাতেও কেউ ভুল করেও এই জঙ্গলের পথে আসবে না। সেই গভীর জঙ্গলের গভীরে একটা পরিত্যক্ত ভাঙ্গা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ঠিক নিচেই, বিশাল এক বেসমেন্টের মতো জায়গা, বহির্বিশ্বের দৃষ্টি থেকে একেবারে দূরে গড়ে উঠেছে এক রহস্যময় গোপন ল্যাবরেটরি — “নেমেসিস সেল”।
এই Nemesis শব্দটা এসেছে প্রাচীন গ্রীক পুরাণ থেকে।নেমেসিস ছিলেন প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচারের দেবী। তাঁর কাজ ছিলো যারা অহংকারী, দুষ্ট, বা অন্যায়কারী, তাদের শাস্তি দেওয়া।
অনেকটা “ফেইট” বা “কার্মিক প্রতিশোধ”-এর মতো — তুমি যেমন কর্ম করবে, নেমেসিস ঠিক তেমন শাস্তি দেবে।
আর Cell শব্দটা এখানে ব্যবহার করা হয়েছে গোপন ঘাঁটি, গভীর ল্যাব, বা কৌশলগত ইউনিটের জন্য।
ঠিক যেমন গোপন মিশনের “Sleeper Cell” বা “Spy Cell” থাকে, ঠিক তেমনই এই Nemesis Cell হলো একটা গোপন দল, যারা সমাজের অন্ধকারে বসে অন্যায়ের জবাব দিচ্ছে ন্যায়ের অস্ত্রে।
অর্থাৎ এটা একটা গোপন ইউনিট যারা সমাজে অন্যায়কারীদের অদৃশ্যভাবে বিচার করে —এটা প্রতিশোধ নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের রূপে।”
এই ল্যাবটি পরিচালনা করে স্বয়ং ডঃ তৈমুর জাহান শিকদার, যে সমাজের চোখে একজন খ্যাতিমান কার্ডিওলজিস্ট। যে বাইরে থেকে একজন দয়ালু চিকিৎসক হলেও ভেতরে সে একজন এক নির্মম বিচারক।
তাঁর সঙ্গে আছে ডঃ সায়ান মাহমুদ, বিশ্বস্ত বন্ধু রাফি,এক দুর্ধর্ষ কেমিক্যাল এক্সপার্ট, সাইন্টিস্ট আবির হাসান। যার পরিচয় খোদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু শীর্ষ ব্যক্তির কাছেও অজানা। শুধুমাত্র একজনই তার পরিচয় জানে সে হলো তাদের বন্ধু আলভী। আবিরের আরও একটা পরিচয় আছে তা হলো তৈমুর,সায়ান, রাফির কমন ফ্রেন্ড তিশার ফিয়ন্সে, যদিও তিশা আবিরকে শুধুমাত্র একজন সাইন্টিস্ট বলেই জানে। এর বেশি কিছু জানা তার অগোচরেই রয়ে গেছে।
ভাঙ্গা মন্দিরের ভেতরে এনোমিলিয়ামের শক্ত পাটাতন যা টান দিলে ঢাকনার মতো খুলে যায়। তবে যে কেউ সেই ঢাকনা টান দিলেই খুলবে না। তাতে অতি শক্তিশালী সেন্সর লাগানো আছে। বিশেষ কয়েকজনের হাতের ছোঁয়া ছাড়া সেই পাটাতন টেনে খোলার সাধ্য কারো নেই। উপর থেকে দেখলে এটা স্বাভাবিক একটা ফ্লোর বলে মনে হবে।
পাটাতনের ঢাকনা খুলতেই সরু একটা সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। প্রায় ১৫ ফুট নিচে নামলে বেসমেন্টের ফ্লোর পাওয়া যায়। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে একটা সরু গলি। গলির দুপাশের দেয়ালে ভয়ংকর লেজার সিট লাগানো। এখানেও বিশেষ কয়েকজনের বডি ক্যানিং সেন্সর লাগানো। বাইরের কেউ এইগলি পার হতে গেলেই ভয়ংকর লেজার শীটের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
গলি পার হতেই পুরোনো স্টোরেজের ভেতর দিয়ে দশ ধাপের একটা সিঁড়ি বেয়ে নামলেই সামনে আসে সেই সিক্রেট ল্যাবের দরজা।সেখানেও কৌশলে অত্যন্ত শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ডিভাইস সেট করা। একটা আই রেটিনা ডিসপ্লে সেখানে চোখের স্ক্যান নেয়া হয়। ল্যাবে ঢুকেই প্রথমে এক সংকীর্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোর — যার শেষ মাথায় আবারো রেটিনা স্ক্যান আর ভয়েস প্রিন্ট সুরক্ষা সিস্টেম। স্ক্যান শেষ হলে দরজা খুলে যায় এক বিশাল হাই-টেক স্পেসে।
ডান দিকের দেয়ালজুড়ে বিশাল কাঁচের কিউব। প্রতিটা কিউবের মধ্যে বিভিন্ন রঙের, রকমের রাসায়নিক:
হাইড্রোফ্লুরিক অ্যাসিড,ডিমিথাইল মারকিউরি,রাইসিন এক্সট্র্যাক্ট,সারিন গ্যাস ইন ক্যানিস্টার,ক্যাপসেইসিন ওভারডোজ সিরাম,ভিসেরা-ফ্রিজ-৯ (এক ধরনের নিউরোফ্রিজ মেডিক্যাল সাবস্ট্যান্স যা ব্যথা দূর করে টার্গেট অর্গান নিস্তেজ করে),ক্লোরোফর্ম কনডেন্সেট ও
‘জিগস’ নামের বিশেষভাবে তৈরি একটি পয়জন যা ক্রমশ নার্ভ সিস্টেম গলিয়ে ফেলে।
বাম পাশে একদম অপারেশন থিয়েটারের মত আলাদা কাচঘেরা পার্টিশন রুম। রুমের ঠিক মাঝখানে একটি হাইড্রোলিক অপারেশন টেবিল, মেডিক্যাল রোবোটিক আর্ম, অটোমেটেড সাকশন ইউনিট, এবং ব্লাড ফিল্টারিং মেশিন।
সেখানেও এক পাশে দেয়ালে থরে থরে সাজানো বড় বড় কাঁচের জার।
তাতে বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক কেমিক্যালে ভর্তি।. Formalin (Formaldehyde Solution)টিস্যু বা অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত।
প্রিজারভেশন এবং ফরেনসিক অটপসি দুটোতেই ব্যবহৃত হয়।সেলুলার ক্ষয় রোধ করে।
Glutaraldehyde এটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফিক্সেটিভ।
অর্গান প্রিজারভেশনে আরও কার্যকর ফর্মালিনের তুলনায়।
RNAlater মলিকিউলার টিস্যু বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়।
RNA/Protein বিশ্লেষণ করার জন্য অর্গান ভালো রাখে।
HTK Solution(Histidine-Tryptophan-Ketoglutarate)
কিডনি, লিভার, হার্ট ট্রান্সপ্লান্টে সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
ট্রান্সপ্লান্ট পর্যন্ত অর্গানকে জীবিত রাখে।
UW Solution (University of Wisconsin Solution)
এটি লিভার-কিডনি-হার্ট প্রিজারভেশনে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’। এটা হিউম্যান অর্গানকে 12–24 ঘন্টা কার্যকর রাখে।
Cryoprotectants যেমন: DMSO – Dimethyl Sulfoxide)টিস্যুকে ফ্রিজিং করার সময় সেল ড্যামেজ আটকাতে ব্যবহৃত হয়। টিস্যু ভাঙা বা বিস্ফোরণ প্রতিরোধে কার্যকর।
এ ছাড়াও CryoHex-7শীতল তাপমাত্রায় অর্গান ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যক্ষম রাখে। এগুলো শুধুমাত্র ‘Nemesis Cell’-এর গবেষণাগারে প্রস্তুত করা হয়েছে। VitalHold-9 হৃদপিণ্ড ও কিডনির জন্য ব্যবহৃত জৈব-রক্ষাকারী তরল।ফ্লুয়িড ইনফিউশনের মাধ্যমে ইনজেক্ট করা হয়। NeuroFreeze-C মস্তিষ্কের কোষ অক্ষত রাখে, স্মৃতি ও ডিএনএ বিশ্লেষণে সহায়ক।
OrganStabil™অর্গান ডেলিভারির সময় ব্যাগে ব্যবহার করা হয়।এটি রক্তপ্রবাহ এবং পিএইচ ব্যালেন্স ধরে রাখে। BioHalt-X মৃতদেহ থেকে বের করা অর্গান দ্রুত সংরক্ষণের জন্য বিশেষ কেমিক্যাল।
চেহারা ও গঠন ঠিক রাখে, forensic reproduction-এ সাহায্য করে। এই সবকিছু দিয়ে সাজানো এক হাই স্ট্যান্ডার্ড অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার।
অপারেশন থিয়েটারের ডান পাশে ল্যাবের সার্ভেইলেন্স রুম, যেখানে শত শত মিনি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়। এসব ক্যামেরা ছড়ানো আছে রাজধানীর অন্ধকার গলি, স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট,রেলস্টেশন, পতিতালয়, ও বাস টার্মিনালে। এইসব জায়গা থেকে চিহ্নিত করা হয় সেইসব নরপিশাচদের যারা শিশু পাচার, কিডন্যাপিংয়ের সাথে সরাসরি যুক্ত। এ ছাড়াও যারা পথ শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে অঙ্গ বিক্রি, ও বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষা করায়। এইসকল সমাজের কিট দেরকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে এই সব সিক্রেট ক্যামেরাগুলো।
এবং শুধুমাত্র তাদেরকে আইডেন্টিফাই করেই ছেড়ে দেয়া হয় না। বরং তাদেরকে অতি কৌশলে তুলে নেয়া হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে এই নেমেসিস সেলে। তারপর তাদের এই অপারেশন থিয়েটারে ফেলেই অস্ত্রোপচার চালানো হয়। তাদের থেকে এমন কিছু অর্গান ছিনিয়ে নেয়া হয় যেগুলো পরবর্তীতে গরিব অসহায় শিশুদের,যারা চোখে দেখতে পায় না,কিডনী ড্যামেজ, ক্যান্সার, হার্টের প্রবলেম এই ধরনের শিশুদের কে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়।
সভ্য সমাজের সামনে এগুলো বিভিন্ন ডোনারদের দান করা অর্গান। যা ডঃ তৈমুর জাহান শিকদার,সায়ান মাহমুদের মতো কিছু দয়ালু ডক্টরদের দ্বারা পরিচালিত।
ঠিক দুপুরের আগেভাগেই জঙ্গলের কিনারে হাইওয়েতে ছুটে চলেছে কালো মার্সিডিজ। গাড়ির শব্দ অত্যন্ত ধীমে। জঙ্গলের সরু রাস্তা থেকে এক কিলোমিটার দূরে গাড়ি দাঁড় করায় তৈমুর। বাকিটা পথ হেঁটেই জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করে দুজনে। তৈমুরের পরনে ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট। মাথায় ব্ল্যাক ক্যাপ। মুখে মাস্ক। কালো প্যান্ট পায়ে রেসিং কেটস। সায়ানের সাজও সেইম শুধুমাত্র রঙ্গের তফাৎ। সায়ান সম্পূর্ণ নেভীব্লু গেটআপে।
নির্দিষ্ট জায়গায় এসে তীব্র প্রহরার মাঝে ভিতরে ঢোকে তৈমুর ও সায়ান। দরজা খুলতেই ভেসে আসে এন্টিসেপটিক আর কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ। দেয়ালজুড়ে হালকা কমলা আলোর ছটা, যা একপ্রকার শীতলতা এনে দেয়, কিন্তু আতঙ্কও ছড়ায়।
আবির তখন অপরেশন রুমে কাজ করছিলো।সে গভীর মনোযোগ দিয়ে টেবিলের উপর উল্টো ঝুঁকে আছে এক অচেতন অপারেটিং বডির ওপরে।
লোকটা সদ্য ধরা পড়েছে — রিকশাচালকের ছদ্মবেশে থেকে তিনজন পথশিশুকে অজ্ঞান করে বিক্রি করছিলো। এখন,তার কিডনি বের করে রাখা হচ্ছে। আর সেই কিডনি যাবে একজন পথশিশু মুনার শরীরে।যার পিতা কোনোদিন এই অপারেশনের খরচ চালাতে পারতো না। মুনা তার গরিব বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। দুর্ভাগ্যবশত মুনার দুটো কিডনি ড্যামেজ। অন্তত একটা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারলে নতুন জীবন ফিরে পাবে মুনা।
তৈমুর কে দেখে হালকা হাসে আবির।
:-তৈমুর,এটার কাজ শেষ। কামলা এখন নিঃস্ব। চোখ দুটোও বের করবো নাকি?”
তৈমুর অচেতন লোকটার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,,
:-না, একটা রেখে দে… যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কুৎসিত দানবীয় মুখটা দেখতে পায় প্রতিদিন।”।তৈমুরের ঠান্ডা কণ্ঠ।
রাফি তখন পাশে একটা ওয়ালবোর্ডে কিছু তথ্য লিখছে। কোন শিশু কোন অঙ্গ পাবে তার একটা সাফ সুতরা তালিকা।
এই পুরো অপারেশন একরকম “জাজমেন্ট প্রোজেক্ট”। বাইরে থেকে কেউ কিছু জানে না। সবার চোখে তৈমুর জাহান ও সায়ান হচ্ছে ফেরেস্তাসম চিকিৎসক। কিন্তু ভেতরে তাদের হাতে তৈরি হয়েছে এক বিচারযজ্ঞ। সেখানে বিকলাঙ্গ শিশুদের মোহরা বানানো পিশাচদের শাস্তি দেয়, এবং সেইসব নরপিশাচদের শরীর থেকেই জীবন বাঁচিয়ে দেয় আরও হাজার হাজার অসহায় গরীব শিশুদের।
প্রায় আড়াই হাজার শিশু এখন দেখতে পায়, হাঁটতে পারে, বাঁচতে শিখেছে — এই নেমেসিস সেলের গোপন কর্মতৎপরতায়।
__________
সেনানিবাসের একটি নিঃসন্দেহে সুরক্ষিত ঘরে বসে আছেন মেজর জেনারেল আলভী। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ, চোখে চাপা উদ্বেগ। ডেস্কের ওপর ছড়ানো কিছু নথিপত্র— যার এক পাশে ঝুলে আছে পুরনো একটি প্যাথলজি রিপোর্ট, পাশে কিছু Classified ডকুমেন্ট। ধাতব ঘড়ির কাঁটা ২:১৩-এ আটকে আছে।
আলভী গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়, কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তৈমুর জাহান শিকদারের নাম্বারে কল করে।
ফোন রিসিভ হতেই অন্য প্রান্ত থেকে তৈমুরের শান্ত কণ্ঠ,
:-হ্যাঁ, বল আলভী। কী খবর?”
আলভী গম্ভীর গলায় বলে,,,
:-তৈমুর… ক্যাম্পে যা পেয়েছি তা খুবই সীমিত। অনেক তথ্য গায়েব করে ফেলা হয়েছে।”
:-তুই যা পেয়েছিস বল। তৈমুরের কণ্ঠে ধৈর্য।
আলভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,
:-মায়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছি… কিন্তু ওটা অসম্পূর্ণ। মাঝের একটা গুরুত্বপূর্ণ পাতা মিসিং। ঠিক যেন ইচ্ছে করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি যতদূর বুঝতে পারলাম সেটাতেই ছিলো মায়ার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ, অথবা এমন কিছু যা ধামাচাপা দিতে চাইছে কেউ।”
:-আর কিছু?তৈমুরের গলা একটু ভারী হয়ে ওঠে।
:-হ্যাঁ কিছু ফাইল পেয়েছি যেগুলোতে এরশাদ হামিদের নাম জড়ানো বেশ কিছু আর্থিক দুর্নীতির রেকর্ড আছে। ভুয়া মেডিকেল প্রকল্প, ফান্ড চুরি, কিছু অস্বাভাবিক অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট অ্যাপ্রুভাল… কিন্তু প্রত্যেকটা ফাইলে কিছু না কিছু কাগজ বাদ দেওয়া হয়েছে। যেন পাজলের টুকরোগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”
:-মানে মূল অপরাধের ছায়া আছে, কিন্তু প্রমাণ পুরোপুরি নেই। তৈমুর ঠান্ডা গলায় বলে।
:-ঠিক তাই। আমরা ছায়া দেখছি, অন্ধকারের উৎস এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তৈমুর তখন বললো,,,
:-তুই ওই রিপোর্টগুলোর স্ক্যান আমাকে পাঠা। আমি নিজের হাতে খুঁড়ে বের করবো বাকিটা।
আলভী সংক্ষেপে উত্তর দিল,,,
:-Copy preparing. Tonight you’ll have it.”
কল শেষ হলেও আলভীর হাতে ধরা ফোনটা থমকে থাকে কিছুক্ষণ।
কান্নার মতো নীরবতা ঘিরে ফেলে তাকে।
অভ্যন্তরে একটিই প্রতিজ্ঞা । “মায়ার মৃত্যুর হিসাব আমি বুঝে নেবো, যে করেই হোক।”
*****
রাতের নিস্তব্ধতায় যেন ঘুমিয়ে পড়েছে শহরের কোলাহল। কাজের ক্লান্তি চোখে মুখে নিয়ে তৈমুর ধীরপায়ে নিজের রুমে ঢুকলো। গলার টাইটা শিথিল করে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতেই চোখ পড়লো সামনে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সারা ব্যস্ত নিজের চুলে ক্লিপ আটতে।
সন্ধ্যার আলোয় ওর মুখটা যেন একেবারে স্নিগ্ধ লাগছে, যেন তৈমুরের ক্লান্তির পরম ওষুধ।
তৈমুর নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে সারাকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা সারার চোখে চমকে উঠলো। তবে অবাক হওয়ার আগেই তার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেলো,,,
:-আজ মনে হচ্ছে একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে আপনাকে। ফ্রেস হয়ে নিন
:-তুই তো আমার বিশ্রামের একমাত্র ঠিকানা। সারার কাঁধে মুখ গুঁজে বললো তৈমুর।
সারা আলতো করে তৈমুরের গালে হাত রাখে, চোখে মোহময় প্রেম মিশিয়ে বলল,,,
:-কফি আনবো?
:-না… তোর শরীরের এই মারাত্মক নেশা ধরানো ঘ্রাণটায় চাই এখন। সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে বিশ্বাস কর।
সারার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি।তৈমুর ওর কপালে একটা চুমু আঁকলো।
শীতল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সারার মুখের দিকে। মুহূর্তটা যেন স্বচ্ছ, নিঃশব্দ, এক নিঃশ্বাসে ভালোবাসা মেশানো। তৈমুর সারার গলায় মুখ ডুবিয়ে আবার বলল,,
:-চল না, এই মুহূর্তে একটু বেশিই ভালোবাসি তোকে!
সারা পিছন ফিরে তৈমুরের বুকে মাথা রাখে। তৈমুরের ঘামে ভেজা বক্ষে নাক ঘষে বলে ,,,
:-তাহলে আজ রাতে আমাকে আপনার বুকেই ঘুমাতে দিতে হবে…
তৈমুর মুহূর্তেই কোলে তুলে নিলো সারাকে। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে দিতে বললো,,,
:-ওকে বেইবি! ডান।
আর কিছু বলার হলো না সারার। বাতাসে তখন শুধু দু’জনের নিঃশ্বাস, আর অলিখিত ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা।
তৈমুরের সারাদিনের ক্লান্তি তখন রূপ নিয়েছে নিরব শীতল এক সমুদ্রে সারার প্রেমের কোমল স্পর্শে।
#চলবে