#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪০
মৌমো তিতলী
❤️
শিকদার হাউসে যেন হঠাৎ করেই নিঃশব্দ মৃত্যুর উপত্যকা নেমে এসেছে।
সারার এক্সিডেন্টের খবর কানে পৌঁছাতেই রিনার হাত থেকে গ্লাস পড়ে চুরমার হয়ে গেলো। কানে রেশমীর কান্নাজড়িত কন্ঠটা বাজছে,,,
সারার এক্সিডেন্ট হয়েছে বড়মা! আমি সারাকে ভাইয়ার হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি… অনেক রক্ত বড়মা…!!
রিনা শিকদার চিৎকার করে মুখে হাত চেপে বসে পড়লেন সোফায়।
সাইফ শিকদার দৌড়ে এলেন— ”
:-কি হইছে রিনা…?? কে ফোন করেছিলো? কার ফোন ছিলো?
সিমা শিকদার তন্ময় কে কোলে করেই তড়িঘড়ি ড্রইং রুমে আসলো। তখনও কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।
শোক আর বিষ্ময়ে হতভম্ব রিনা শিকদার। তাঁর মুখে যেন রক্ত নেই, ঠোঁট কাঁপছে, শরীর নিস্তেজ।
কোনমতে অস্ফুট স্বরে বললেন,,,
:-আমার সারার এক্সিডেন্ট হয়েছে জাহানের বাবা! আমার সারার এক্সিডেন্ট হয়েছে!!! এখুনি হসপিটালে যেতে হবে । আমার আব্বা – আমার জাহান মরে যাবে । আমার জাহান নিজেকে সামলাতে পারবে না জাহানের বাবা!! মরে যাবে আমাদের ছেলেটা। এখুনি চলো!! এক প্রকার পাগলের মতো সদর দরজার দিকে ছুটে বেরিয়ে আসলেন রিনা শিকদার। সাইফ শিকদার বাইরে এসে দ্রুত গাড়ি বের করলেন। মুহুর্তেই চড়ে বসলেন গাড়িতে। গাড়ি দ্রুত ছুটে চললো হসপিটালের অভিমুখে।
******
সায়ান হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে একজন ওয়ার্ড বয় কে ডাকে।
তারপর দুজনে ধরে তৈমুর কে সোফায় শুইয়ে দেয়। তৈমুরের ডেস্কের ওপর থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে তৈমুরের মুখে ছিটিয়ে দিলো সায়ান। আস্তে আস্তে তৈমুরের গালে চাপ্পড় মেরে ডাকতে থাকে,,,
মিনিট দুয়েক বাদে তৈমুর চোখ খুললো।
কিন্তু সে যেন অন্য জগতে চলে গেছে। ধম করে উঠে বসলো তৈমুর। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করছে সে…
:-“আমার সারা… আমি ওকে বকেছিলাম… আমি ভুল বুঝেছিলাম… সারা আমাকে ছেড়ে যাবে না… না না না… প্লিজ… সারা আমার থাকবে…”
সায়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একচুয়ালি কি ঘটেছে জানা নেই সায়ানের। তৈমুরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু ঘটেছে। সারার কি কিছু হয়েছে!!
সায়ান তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে,,
:-এইরকম একটা মানুষ… নেমেসিস সেলে যার নামেই অপরাধীরা কাঁপে… সে আজ হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে এভাবে কাঁপছে।
দুহাতে নিজের মাথা খামচে ধরেছে তৈমুর। বিড়বিড় করেই চলেছে,,
:-“আমি খুন করেছি… আমি ওকে মেরে ফেলেছি… আমি নিজে… আমি নিজে!!”
সায়ান চোখের জল লুকিয়ে ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। তৈমুরকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
:-ভাই কি হয়েছে? এমন করছিস কেনো?…ছোট্ট ভাবির কি হয়েছে?
তৈমুর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। চোখে টলটল করে জল। গলার স্বর ভেঙে গেছে,,
:-সায়ান… আমার সারা এক্সিডেন্ট করেছে সায়ান! আমি সারার চোখে চোখ রাখতে পারবো না…দুহাত উঁচু করে ধরে বলে,,,
:-আমার এই হাতে চড়ের দাগ লেগে আছে…আমি এই হাতে আমার আদর কে আঘাত করেছিলাম। অনেক জঘন্য ব্যবহার করেছিলাম আমার জান টার সাথে। তাই আমার সারা অভিমান করে চলে যেতে চাইছে!
:-তুই কিছু বলছিস তৈমুর। আর্তনাদ করে ওঠে সায়ান!!
তখনই বাইরে থেকে এম্বুলেন্সের আওয়াজ ভেসে আসে। তৈমুরের শরীর কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজে। তৈমুর,সায়ান দু’জনেই দ্রুত ছুটলো হসপিটালের রিসেপশনের দিকে।
********
সারাকে লাইফ কেয়ার হসপিটালে আনা হয়েছে। ইমার্জেন্সি ইউনিটে ঢোকার সময় সারার মুখটা চোখের সামনে আসে তৈমুরের। তালহা আর রেশমী সারাকে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলো তখনই।
সারার চোখ অর্ধখোলা, শরীর নিথর।
মাথার ডানদিকে গভীর কেটে যাওয়া, ভ্রু ফেটে গেছে।
রক্তে ভিজে গিয়েছে গলা, কাঁধ। বুকের ডান পাশে যেন থেঁতলে গেছে ট্রাকের ধাক্কার প্রচণ্ড আঘাতে। হাঁটু থেকে নিচে হাড় ভেঙে গেছে,
নার্সরা দ্রুত সারাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের দিকে ছুটে চলছে। তৈমুর এক পাও যেন এগোতে পারলো না আর!
রেশমী ভাইকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে তৈমুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। হিচকি তুলে কাঁদতে লাগলো ভাইকে আঁকড়ে ধরে। অথচ তৈমুর বিমুঢ়, নিস্তব্ধ হয়ে পাথরের মূর্তির মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো!! একটুও নড়লো না অব্দি। তালহা দুহাতে রেশমী আর সারার ব্যাগ নিয়ে অপলকে আছে তার ক্রন্দনরত প্রেয়সীর দিকে।
সায়ান আর আবির দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো।
সারা ভীষণ ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে,যেন মৃত্যুর দোরগোড়ায় কণ্ঠ শ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে তার।
সায়ান আর আবির দু’জনেই যেন তাদের ডক্টর সত্ত্বায় নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের একটিই মিশন,
সারাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে! তৈমুরের জন্য হলেও সারাকে ফিরিয়ে আনতে হবে!
অপারেশন থিয়েটারের লাইট টিমটিম করে জ্বলছে।
প্রতিটা সেকেন্ড যেন যুদ্ধ।
মেশিনের শব্দ হচ্ছে— পিপ… পিপ… পিপ…
সায়ান নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে একটা শব্দের জন্য—
“She’s stabilizing…”
*****
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে শিকদার হাউসের প্রত্যেকটা সদস্য।
রিনা শিকদারের আহাজারিতে হসপিটালের আবহাওয়া আরও ভারী হয়ে আসে।
সিমা শিকদার রিনার পাশে বসে আছে তার হাত ধরে।
কিছুটা দূরে তন্ময়কে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে আলিফ শিকদার। সাইফ শিকদারেরও একি অবস্থা। তিনি ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছে তৈমুরের দিকে।
রেশমী চেয়ারে বসে আছে মাথা নিচু করে। এখনো ফুলে ফুলে কেঁদে উঠছে মেয়েটা। তালহা পারছে না শিকদার পরিবারের সামনে রেশমী কে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে!! অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে রেশমীর দিকে।
তৈমুর এখনো অপারেশন থিয়েটারের দরজার কাছে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। তৈমুরের শরীরে যেন প্রাণ নেই।
তুলি ভাইয়ের অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,
:-“ভাইয়া প্লীজ তুমি এভাবে পাথরের মতো থেকো না। প্লীজ ভাইয়া কিছু তো রিয়্যাক্ট করো! এভাবে তো তুমি নিজেই ট্রমায় চলে যাবে!!
তুলির কোন হাহাকার যেন তৈমুরের কানে পৌঁছালো না। অসহায়ের মতো ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো তুলি!!
:-May Allah please bring Sarah back!!!
____________
পলপল করে সময় এগিয়ে যেতে লাগলো। একপর্যায়ে একজন নার্স তৈমুরের কাছে এসে রিপোর্টের কপি হ্যান্ডওভার করলো। তৈমুর কাঁপা হাতে রিপোর্ট টা মেলে ধরলো শুধু,,,
তাতে লেখা:
> Patient Name: Sara Jahan Shikdar
Condition:
Severe cranial trauma (subdural hematoma suspected)
Multiple fractures (right femur, 2nd-4th ribs)
Right lung contusion
1.5 litre blood loss
Possible brain swelling
GCS: 6 (Severe)
Observation: If consciousness doesn’t return within 48 hours, patient may enter coma.
Immediate surgery recommended.
তৈমুরের হাত অসম্ভব ভাবে কাঁপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতে রিপোর্টটা হাত থেকে পড়ে গেলো নিচে।
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তৈমুরের। বুকের ভেতর এক সমুদ্র হাহাকার তুলে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ে তৈমুর।
হাত জোড় করে ষআল্লাহর কাছে মাথা নত করে বলে,,
:-“হে আল্লাহ্, আমি নিজের হাতে ওকে ভেঙে দিয়েছি… আপনি শুধু ওকে ফিরিয়ে দিন…ও যা বলবে আমি সব করবো… শুধু একবার আমার প্রাণ টাকে ফেরত দিন…!
তৈমুর অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,,,
:-তুই হার মানিস না জান…ফিরে আয়। আমার বুকটা যে জ্বলে যাচ্ছে। অন্তরটা খালি লাগছে। আমার বুকে ফিরে আয় আদরিনী!
একটা সুযোগ দে আমাকে… শুধু একটা সুযোগ দে …
তোর চোখে চোখ রেখে বলতে চাই আমি।
“তুই আমার সব, আমার জীবন… তুইই আমার সারা জাহান…”
************
মহিদ কে স্কুল থেকে নিয়ে সৃষ্টি আজ বাবার বাসায় এসেছে। সেই যে তার ছোট বোনটা ও বাড়ি থেকে রাগ করে চলে আসলো তারপর সৃষ্টির আর এবাড়িতে আসার সময় হয়ে ওঠেনি। বাবা আর বোনটাকে দেখার জন্য মনটা খুব করে টানছিলো। তাই আজ মহিদের স্কুল ছুটির পর বাড়িতে না গিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে ।
এবং এখানে আসার পর আশ্চর্যজনক ভাবে সাবিকা কে বেশ হাসিখুশি দেখেছে। সৃষ্টির মন টা এখন বেশ ফুরফুরে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আর বোনটায় তার দুনিয়া ছিলো। মা যখন মারা যায় তখন সাবিকা অনেকটা ছোট। সেই থেকে সৃষ্টিই সাবিকার খেয়াল রেখেছে। বড় বোন হয়েও সেকেন্ড মাদারের মতো বড় করেছে সাবিকা কে। বোন কে সে ভালোবাসে, বোঝে। তাই তো সৃষ্টি সাবিকার জেদ সম্পর্কে জানে। ছোট বেলা থেকেই সাবিকার যদি কোন জিনিস পছন্দ হতো বা সে চায়তো, তাহলে যেকোনো মূল্যে সেটা সে নিয়েই ছাড়তো!
বাবাও সবসময় তাদের সব চাওয়া পূরণ করতেন। কখনো কোন চাওয়া অপূর্ণ রয়ে গেছে এমনটা সৃষ্টির মনে পড়ে না!
এই জন্যই সৃষ্টি একটু চিন্তিত ছিলো! ভেবেছিলো সাবিকা এতো সহজে তালহার পিছু ছাড়বে না। কিন্তু এখানে এসে তেমন কোন আভাস পেলো না সৃষ্টি। সাবিকা বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই মহিদ কে সাথে নিয়ে বাইরে বেড়াতে গেলো। কত হাসি মজায় খুনসুটি করলো আদরের ভাগ্নের সাথে।
এসব দেখে বুকটা কিছুটা হালকা হলো সৃষ্টির। নয়তো সাবিকার ব্যবহারের জন্য নিজেকে ভীষণ লজ্জিত লাগছিলো আলভীর সামনে।
হাতে কিছু শুকনো কাপড় ভাঁজ করছিলো সৃষ্টি। এমন সময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। হাতের কাপড় খানা পাশে রেখে এগিয়ে গেল সদর দরজার দিকে।
দরজা খুলতেই দেখলো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের একমাত্র ছোট চাচু জাহাঙ্গীর কবির। অনেকদিন পর চাচু কে দেখে ভীষণ খুশি হলো সৃষ্টি। জাহাঙ্গীর কবিরও ভাইজি কে দেখে একগাল হাসি দিয়ে বললেন,,
:-আরে সৃষ্টি মা যে! কবে এলে? শরীর ভালো আছে তো? তোমার ছেলে কেমন আছে?
:
সৃষ্টি হাসিমুখে বললো,,
:-ভালো আছি চাচু! আমার ছেলেও ভালো আছে। এইতো সাবিকা একটু বের হলো ওকে নিয়ে।
তুমি কেমন আছো চাচু?
:-এই যে দেখছো! একদম ফিট এন্ড ফাইন!
সৃষ্টি হাসলো চাচুর কথায়। জাহাঙ্গীর কবির ভেতরে ঢুকে বললেন,,,
:-ভাইজান কোথায়?
সৃষ্টি দোতলার কর্ণারে স্টাডি রুমের দিকে ইশারা করে বললো,,,
:-বাবা স্টাডি রুমে আছে চাচু! একটা ছেলে এসেছে ,হয়তো বাবার অফিস থেকে। মনে হয় কোন জরুরী প্রয়োজনে এসেছিলো নয়তো বাবা তো কোন স্টাফ কে বাসায় এলাও করেন না। তুমি যাও তারা স্টাডি রুমেই আছে। বলেই কিচেনের দিকে চলে গেলো সৃষ্টি।
এদিকে জাহাঙ্গীর কবিরের কপালে ভাঁজ পড়েছে। কে এসেছে বুঝতে পারলো না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন তিনি।
~~~~~~~
স্টাডি রুমের দরজাটা ভেজানো ছিল। জাহাঙ্গীর কবির ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো, ঘরের মাঝখানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুকুল, আর তার সামনে রাগে ফেটে পড়ছে এরশাদ হামিদ।
:-“তুই কি বালের প্রফেশনাল লোক? তোকে রেশমিকে এক্সিডেন্ট করাতে বলেছিলাম, আর তুই কাকে মেরে আসলি? এই মেয়ে মরলে কি বাল ফালাবো আমি? যত্তসব 😡
মুকুল গলাটা নামিয়ে বললো,,
:-“বস… আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি… কিন্তু ওই সারা মেয়েটাই রেশমী কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। এই জন্যই ট্রাকের ধাক্কা ওই মেয়েটার লেগেছে।
এরশাদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো। জাহাঙ্গীর কবির কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—
:-“কি হয়েছে ভাইজান?”
এরশাদ একটু চমকে ফিরে তাকালো। এরপর হালকা বিরক্ত মুখে বললো,,
:-“তুই কখন এলি?”
:-“এইতো, কিছুক্ষণ হলো। নিচে সৃষ্টি বললো তুমি স্টাডি রুমে আছো তাই এসেছি। এখন যা শুনলাম তাতে তো মাথা ঘুরে যাচ্ছে!” এসব কি করছো তুমি ভাইজান?
এরশাদ মাথা নেড়ে বললো,,,
:-তোর মাথা ঘুরানোর কিছু নেই। আমি যেটা বলেছিলাম সেটা ঠিক মতো হয়নি। তবে এবার আর ভুল হবে না। মুকুলের দিকে তাকিয়ে বললো,,
:-এবার ঠিকঠাক কাজ করবি! নয়তো গুলি করে তোর মাথার খুলিটাই উড়িয়ে দেবো।
মুকুল মাথা নেড়ে বললো—
:-“এইবার আর ভুল হবে না বস। রেশমিকেই উড়িয়ে দেবো। সব প্ল্যান করা আছে।”
এরশাদ চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লো, যেন অনুমতি দিয়ে দিলো।
ঠিক তখনই জাহাঙ্গীর কবির আঁতকে উঠলো—
:-ভুল করছো ভাইজান! তুমি তৈমুর জাহান কে চেনো না। একই পরিবারের পরপর দুজনের উপর অ্যাটাক হলে সে ঠিকই সন্দেহ করবে। এবং বিশ্বাস করো, তৈমুর যদি একবার সন্দেহ করে— তাহলে ওকে থামানো যাবে না!”
এরশাদ ঠাট্টার সুরে বললো—
:-“তুই এই তৈমুর জাহান কে এত ভয় পাস কেন রে? কি করবে তোর তৈমুর? মুকুল কে তো জেলে পাঠিয়ে ছিলো, ধরে রাখতে পেরেছে? ওইটুকু একটা ছুটকো ছোড়া কে আমি এরশাদ হামিদ ভয় পাবো?
তৈমুরের নাম শুনতেই আতঙ্কে ঢোক গিলে মুকুল। কর্মজীবনে হসপিটালে একজন দয়ালু সাদাসিদে ডাক্তার হিসেবেই তৈমুরকে চিনতো সে। কিন্তু আসাদের মার্ডার আর সারা কে পাচার করতে গিয়ে যে মাইরটা খাইছিলো সে তৈমুর জাহানের হাতে, ভাবতেই কালঘাম ছুটে গেলো মুকুলের। তখনই বুঝেছিল মালটা যেমন দেখায় মোটেও তেমন নয়।
ওখানে পুলিশ না থাকলে নির্ঘাত ওরে উপরে পাঠিয়ে দিতে দুবার ভাবতো না লোকটা! মাল টা আসলেই বেজায় সাঙ্ঘাতিক!
কিন্তু বস কে সেটা কে বোঝাবে! যেচে পড়ে ভিমরুলের পাছায় খোঁচা দিয়েছে যখন, তার তো কিছু করার নেই! তার আর কি! কাজ হয়ে গেলে নিজের পারিশ্রমিক বুঝে নিয়ে,সময় বুঝে সটকে পড়তে পারলেই হলো!
জাহাঙ্গীর নিচু গলায়, হিম শীতল কণ্ঠে বললো—
:-তুমি কখনো জমের সামনে পড়োনি ভাইজান… তাই বুঝতে পারছো না। কিন্তু একবার যদি পড়ো… তাহলে নিজের চোখেই দেখতে পাবে সে আদতে কতটা ভয়ানক।
এরশাদ চোখ সরিয়ে বললো—
:-আরে সেদিনের পোলা আমাদের মতো রাঘব বোয়ালদের কি করবে? চিন্তার কিছু নেই। একটা কাঁটা তুলতে গিয়ে ভুলবশত আরেকটা কাঁটায় পা পড়েছে এই যা। তো কি হয়েছে! আট বছর আগে যেমন বড় মেয়ের খুশির জন্য পথের কাঁটা সরিয়েছিলাম, এবারও ছোট মেয়ের পথের কাঁটাটাও সরিয়ে দেবো।”
জাহাঙ্গীর গম্ভীর হয়ে উঠে বললো—
:-ভুল করছো। অন্তত এই মামলাটা ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত কিছু করো না ভাইজান। একটু ধৈর্য ধরো।”
এরশাদ গলা নামিয়ে মুকুলের দিকে তাকালো—
:-“তুই গা ঢাকা দে কিছুদিন। দরকার পড়লে ডেকে নেবো। এখন যা।”
মুকুল মাথা নত করে সরে গেল।
জাহাঙ্গীর তখন নিজের কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা পুরনো নীল ফাইল বের করলো। ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে বললো—
:-এই ফাইলটা এখন আমার কাছে সেইফ না ভাইজান। হসপিটালের এক বিশ্বস্ত লোক জানিয়েছে, কিছু দিন আগে নাকি কেউ একজন মায়ার মৃত্যুর কেস আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সম্পর্কে খোঁজ নিতে আমাদের হসপিটালে এসেছিলো। আমার মনে হয় তোমার জামাই আলভী কিছু একটা সন্দেহ করছে।”
এরশাদ চোখ সংকুচিত করে তাকালো।
:-আলভী!!… ছ্যাঃ ওই ভেড়ার বাচ্চার এত সাহস আছে নাকি! সামান্য ব্ল্যাকমেইলে যে ভয় পেয়ে প্রেমিকা কে ছেড়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো,সে এতো বছর পর ইনভেস্টিগেশন করবে?? বিষয়টা নিতান্তই হাস্যকর। ওতো একটা ভেড়া। এর পেছনে অন্য কেউ আছে! যাক! সে দেখে নেবো!
জাহাঙ্গীর দম ফেলে বললো!
:-“এই ফাইলটায় আমাদের সব কালো কারনামার প্রমাণ আছে। এটা এখন তোমার কাছেই সেইফ থাকবে। সাবধানে রাখো।”
এরশাদ হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিয়ে বললো—
:-তুই সবকিছু নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করিস… আমি জানি কিভাবে খেলা খেলতে হয়। বলেই একটা দাম্ভিক হাসি দিলেন এরশাদ হামিদ।
—
ঠিক সেই সময় দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল সৃষ্টি।
হাতে ট্রে তে চায়ের কাপ। বাবার ও চাচুর জন্য বানিয়ে এনেছিলো।
রুমে ঢোকার আগেই ভেতরের কথাগুলো কানে আসতেই থেমে গিয়েছিলো সৃষ্টি।
রেশমীর অ্যাক্সিডেন্ট,আট বছর আগে আলভী কে ব্ল্যাকমেইল,মৃত্যু… মায়া… ছোট বোন… হত্যা…
তার পা দুটো কাঁপছে সৃষ্টির। শরীর অবশ হয়ে আসছে।
চোখের সামনে যেন সব ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।
সৃষ্টি বিশ্বাস করতে পারছে না। তার এত ভালোবাসার বাবা, আর এত শ্রদ্ধেয় চাচু… এমন কিছু করতে পারে!
সৃষ্টি দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো।
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। সৃষ্টি জানে না এখন তার কী করা উচিত।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে শুধু একটা কথাই ফিসফিস করে উঠে আসে…
:-আলভী কে বাবা বাধ্য করেছিলো আমাকে বিয়ে করতে! বাবা মেরে ফেলেছিলো মায়া কে!!
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪১
মৌমো তিতলী
ঘরটা নিস্তব্ধ। চারদিকটা মনে হলো অন্ধকারে ঢেকে গেছে, শুধু জানালা গলে ঢোকা একফালি চাঁদের আলো মেঝেতে ছিটিয়ে আছে।
সৃষ্টি নিজের রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো নিঃশব্দে।
দূরে কোথাও একটা কুকুর হুঁ হুঁ করে ডেকে উঠছে।
আর ভেতরে… সৃষ্টি হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে, দুই হাতে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছে।
বুকের ভেতরে যেন জ্বলছে একটা অদৃশ্য আগুন।
তার নিজের বাবা আর চাচুর কণ্ঠে আজ সে যে কথাগুলো শুনলো সেই কণ্ঠটায় যেন ছিলো মৃত্যু… ষড়যন্ত্র… এক নিষ্ঠুর শাসকের দম্ভ।
তার মনটা আজ ভেঙে গেছে।তার নিজের ভিতরে এখন এক ঝড় বইছে। সৃষ্টি ভাবতে লাগলো…
“আলভী এই জন্যই কখনও আমাকে ভালোবাসেনি। শুধু দায়িত্ব পালন করেছে। আমি ছিলাম তার প্রতি চাপিয়ে দেওয়া একটা বোঝা।আর সেটা চাপিয়েছে আমারই জন্মদাতা পিতা…আমার জন্য… আমার সুখের জন্য…কিন্তু বাবা যে সুখের বদলে আমার ভালোবাসা কে আরো বিষাক্ত করে দিয়েছে।”
সৃষ্টি চোখ বন্ধ করে হাটুতে মুখ গুজে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
মায়ার নামটা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠে সৃষ্টির। সেই মায়া, যার কোনো দোষ ছিল না।যে শুধু ভালোবেসেছিলো। যে আলভী কে ভালোবেসে শুধু একটা সত্যিকারের সম্পর্ক চেয়েছিলো। সৃষ্টির মনে পড়ে যেদিন তাদের বিয়ে হলো,ওই বাড়িতে যাওয়ার পর মায়া মেয়েটা আলভীর পা দুটো জড়িয়ে ধরে কি করুন সুরে কেঁদেছিলো। সেদিন নিজের ভালোবাসার মানুষটা কে পাওয়ার আনন্দে মায়ার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারেনি। কিন্তু আজ, আজ যেন মায়ার সেই কান্নাই গলার কাঁটা হয়ে কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
মায়া সেদিন আত্মহত্যা করেনি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আজ সৃষ্টির বুঝতে অসুবিধা হলো না
কেনো তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার বাবা যে,তার সংসার নিশ্চিত করতেই মায়াকে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বাবা কেনো বুঝলো না,কারো তাজা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে সুখের সংসার হয়না। সেই রক্তের গন্ধ লেগে থাকে সংসারের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে!!
সৃষ্টির মনে আরো একটা আশঙ্কা উদয় হলো,
“তখন বাবা আর চাচু কারো অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলছিলো,ভুল মানুষ কে মেরে দিয়েছে। এরপর ভুল হবে না” এমন কিছুই বলেছিলো। আতঙ্কে মুখ চেপে ধরে কাঁপতে লাগলো সৃষ্টি। তাহলে কি ধ্বংসলীলার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়ে গেছে? সাবিকার জেদ পূরণের জন্য কি বাবা এবার তালহার ভালোবাসার মানুষটা কে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে!!
সৃষ্টির মুখ থেকে নিঃশব্দে ফিসফিস করে একটা বাক্য বেরিয়ে আসে।
*আমাকে বাবাকে আটকাতে হবে ”
সৃষ্টির চোখে এখন জল নেই। দুহাতে গাল দুটো মুছে চোখের সামনে মেলে ধরলো সৃষ্টি। চোখের জলে একটা রঙ থাকে কিন্তু তার চোখের জল যেন ধূসর… ভারী… অবর্ণনীয়।
তার চোখ পড়ে দরজার পাশে অবহেলায় পড়ে থাকা চায়ের ট্রের ওপর। যেখানে ছিল দুইটা চায়ের কাপ…
যেটা সে বাবা আর চাচুর জন্য এনেছিলো ভালোবাসা নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে, এক ভালো মেয়ের পরিচয় নিয়ে…
এখন সৃষ্টির মনে সেই সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এক আকাশ সমান অপমান, গ্লানি আর এক পাপের প্রতীক হয়ে পড়ে আছে।
সৃষ্টির মনে পড়ে যায় ফাইলটার কথা! চাচু যে ফাইলটা বাবার হাতে তুলে দিয়েছে…
তার ভেতরেই আছে সত্য, সমস্ত পাপের প্রমাণ!
সৃষ্টি উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে। যার নিজেকে এখন যত্নে অথচ সোনালি খাঁচার বন্দি কোন সুখ পাখির মতো মনে হচ্ছে! আজ সেই খাঁচার মধ্যে থেকেই যেন তার হৃদয় হঠাৎ করে বিদ্রোহিণী হয়ে উঠলো।
সৃষ্টি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে—
“আমার প্রতি আলভীর ভালোবাসা হয়তো ছিল না…
কিন্তু আমার বাবার অন্যায় কাজগুলো মেনে নিয়ে যদি আমি চুপ থাকি,
তাহলে আলভীর সাথে অন্যায় করা হবে। তাহলে বাবা আর আমার মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়?
এই অন্যায় যদি থামাতে না পারি, তাহলে আমি সৃষ্টি এই হত্যাকাণ্ডের দায় মাথায় নিয়ে আর বেঁচে থাকবো না।
সৃষ্টি তখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
যেকোনোভাবে সে ফাইলটা খুঁজে বের করবে সে। তাকে আটকানো সহজ হবে না। আজ থেকে সে নিজেই আলোর দিকে যাত্রা শুরু করবে। আবারো কোন নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে যাওয়ার আগেই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাইলটা খুঁজে বের করতে হবে। আর তা পৌঁছে দিতে হবে তার যোগ্য জায়গায়। এতে যদি আলভীর প্রতি করা অন্যায়ের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়!!
************
ভোরের আলো ফুটে উঠলেও শিকদার পরিবারের অন্ধকার এখনো কাটেনি। সারার এক্সিডেন্টের পর ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, তবু এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার।
নিঃসাড়, নিথর সারাকে ঘিরে যেন হাসপাতালের এই আইসিইউ রুমটিও নিঃশব্দ। শুধু শোনা যাচ্ছে মনিটরিংয়ের টু…টু শব্দটি।
সারার বেডের একপাশে চেয়ারে বসে আছে তৈমুর জাহান শিকদার। চোখে রাজ্যের ক্লান্তি, মুখে জেগে আছে গভীর উৎকণ্ঠা। সারার এক হাতের আঙুল জড়িয়ে বসে আছে, সারা’র ধীরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনছে। চোখ দুটো লাল, মনে হচ্ছে বহুক্ষণ বছর ধরে কাঁদেনি-শুধু কেঁদেছে ভিতরটা।
হঠাৎই ঠোঁট নাড়ে তৈমুর। নিঃশব্দে বলে ওঠে ফিসফিসিয়ে,,,
:-তুই এমন করে শুয়ে আছিস বলেই বুঝি আজ আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সারা… তোর হাসিমুখ না দেখে, তোর আত্মা ভোলানো কথা না শুনে, তোর চোখের জ্বলজ্বলে সেই চাহনি না পেয়ে… আমি যেন আস্তে আস্তে দম বন্ধ হয়ে মরছি।”
এক হাত বাড়িয়ে দেয় সারার দিকে, কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না, ভয় করে, যদি আবার কিছু হয়ে যায়,যদি তার আদর ব্যাথা পায়!
তার মনে পড়ে সেদিনের সেই রাগ, অপমানের শব্দগুলো— যেগুলো সে সারাকে বলেছিলো।
তৈমুর নিজের গলায় ঘৃণা মিশিয়ে বিড়বিড় করে,,,
:-তোকে কত জঘন্য জঘন্য কথা শুনিয়েছি তাইনা সারা? একবারও ভাবিনি তোকে হারিয়ে ফেলার ভয়টা এতটা নিঃস্ব করে দেবে আমাকে। প্লিজ… ফিরে আয় জান। একটাবার চোখ খুলে বল না ‘আমি ঠিক আছি জাহান ভাইয়া’… আর কিছু চাই না আমি।” ক্ষমা করে দে আমাকে। তুই চোখ মেলে না তাকালে যে আমার হৃদস্পন্দন থেমে যাবে রে হার্টবিট!! আমি না হয় জঘন্য একটা মানুষ! কিন্তু তুই তো কোমল, তাহলে এভাবে নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করছিস কেন? তুই তো কারো কষ্ট সহ্য করতে পারিস না সারা, তাহলে আজ চুপচাপ শুয়ে আছিস কেন? দেখ আমার কষ্ট হচ্ছে! এই জান দেখ না একবার!
তৈমুর যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মাথা নিচু করে নিজের হাত দুটোতে মুখ লুকিয়ে ফেলে সে।
সেই মুহূর্তে বাইরের করিডোরে হঠাৎ দেখা যায় লুবানাকে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে সে।
কিন্তু আইসিইউর সামনে পা রাখার আগেই সামনে এসে দাঁড়ায় সায়ান।
সায়ান সরাসরি লুবানার দিকে তাকিয়ে, কঠোরভাবে বলে,,,
:-তুমি এখানে!! তুমি ভেতরে যেতে পারবে না লুবানা।”
লুবানার কান্নাভেজা কণ্ঠটা বুঁজে আসে,,,
:-আমি তো শুধু দেখতে এসেছি… জানি, আমার আসা উচিত হয়নি। কিন্তু সারার এমন অবস্থার কথা শুনে—”
সায়ান তাচ্ছিল্য হেসে কঠিন গলায় বলে,,,
:- সেদিন তোমার মিথ্যেগুলো যদি না বলতে, তাহলে হয়তো আজ তৈমুর ঠিক থাকতো। তুমি জানো তো, ভালোবাসা মানেই সবসময় পেতে হবে সেটা নয়। ভালোবাসা মানে তার সুখ চাওয়া। তৈমুরের সুখের পথে তুমি কাঁটা বিছিয়েছিলে লুবানা। সত্যিকারের ভালোবাসা কেউ এভাবে কলুষিত করে না।”
লুবানা চুপ করে যায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। সে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে—
:-তুমি ঠিক বলছ সায়ান… আমি সত্যিই তৈমুর কে ভালোবাসি। তৈমুরের সুখ চাই আমি। এই সত্যিটাই বুঝতে দেরি হয়ে গেছে আমার।
চিন্তা কোরো না, আমি আর ওর জীবনের পথে কাঁটা হবো না। দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। সেটাই বলতে এসেছিলাম।
দোয়া করি যেন সারা সুস্থ হয়ে যায়। আবার চোখ খুলে হাসে… ওর মুখের সেই হাসিটা তৈমুরের জীবনের আলো হয়ে থাকুক…”
সায়ান কিছু বলে না। শুধু নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লুবানার চলে যাওয়ার পথে।ওকে ইচ্ছে করেই তৈমুরের সামনে যেতে দিলো না সায়ান। যতোই হোক,লুবানা শত অন্যায় করলেও সে একসময় তাদের কাছের বন্ধু ছিলো! সায়ান খারাপ চাইনা লুবানার। কিন্তু এই মুহূর্তে তার তৈমুরের সামনে পড়া মানে নিজের মৃত্যু কে আলিঙ্গন করা! তার থেকে ভালো ওদের আর দেখাই না হোক!
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়ান, তারপর ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় হাসপাতালের কাঁচঘেরা কেবিনের দিকে। যেখানে ভিতরে বসে আছে তৈমুর… সারার হাত ধরে।
————
৪০ ঘণ্টা পার হয়েছে। তবুও সারার জ্ঞান ফেরেনি।
নিয়মিত ওষুধ চলছে, মনিটর চলতে থাকা শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে, তাতে প্রাণ আছে এখনো। তবে, সেই শব্দ টুকুর মাঝেই যেন তৈমুরের প্রাণভোমরা আটকে আছে। কেবিনের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকা তৈমুর জাহান শিকদার আজ যেন একটা মূর্তির মতো।
চোখের নিচে গভীর কালি, চুলগুলো এলোমেলো, দু’দিনে নিজের খেয়াল রাখা মানুষটা যেন হারিয়ে গেছে কোথাও।
হাতে ধরে রাখা সারার হাতটা নরম অথচ প্রাণহীন। সেই হাতেই যেন তৈমুর নিজের বুকের সবটুকু ব্যথা ঢেলে দিচ্ছে। সেথায় ঠোঁট লাগিয়ে বসে আছে ঠাঁই!
তৈমুরের মনে চলছে একের পর এক উক্তি,,
:-তুই কথা রাখিসনি সারা… বলেছিলি না তুই কখনও আমায় ছেড়ে যাবি না?” যখন তোর মুখের দিকে তাকাই, মনে হয়… দম বন্ধ হয়ে আসছে। তুই কথা বল না জান…! রাগ করেছিস? সেদিন রাগ করে বকেছিলাম বলে? প্লিজ সারা, চোখ খোল… একটাবার আমার কথা শুনে যা… এরপর যা খুশি করিস,,বকিস,তোর একটা চড়ের বদলে আমাকে ১০০ টা চড় মারিস, আমি সব সয়ে নেবো… কিন্তু প্লিজ, একটা বার… একটা বার আমার নামটা ধরে ডাক।”
আরো দুই ঘণ্টা পর,,,,
পুরো সিকদার পরিবার উৎকণ্ঠায় অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে আইসিইউ এর বাইরে। আর মাত্র ছয় ঘন্টা! এর মাঝে সারার জ্ঞান না ফিরলে, সারা কোমায় চলে যাবে। অধীর উৎকণ্ঠ নিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে চলেছে শিকদার পরিবারের সকলে।
তুলি হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে কড়া করে কফি নিয়ে আসে। সায়ান বাইরে করিডোরে একটা চেয়ারে বসে। টানা রাত জাগার কারণে মাথাটা ধক ধক করছে।
আর কেবিনের ভিতর তৈমুর সেই আগের মতোই বসে সারার পাশে। তৈমুরের অবস্থা আরো বেশি খারাপ। যতটা সময় এগিয়ে চলছে তৈমুর যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বন্ধুর মনের অবস্থা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হচ্ছে না সায়ানের,,,, মনে মনে উপরওয়ালাকে ডেকে চলেছে। সারার কিছু হলে যে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুটা এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।
তুলি ধীরে ধীরে এসে সায়ানের পাশে বসে। কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে,,,
:-কাল থেকে ভাইয়া কেমন গুম হয়ে আছে দেখছো? একবারও কাঁদেনি… যদি একটু কাঁদতো, তাহলে হয়তো হালকা হতে পারতো…
সায়ান মলিন মুখে একটু হাসে,,,
:-ডাক্তাররা কাঁদে না, তুলি।
তুলি আশ্চর্য হয়ে বলে,,,
:-মানে!? ডাক্তারদের কি মন নেই নাকি? তোমরা তো প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হও। কতো মানুষের মৃত্যু, তাদের পরিবারের কান্না… এসব দেখে তোমাদের কষ্ট হয় না?”
সায়ান চোখ মেলে উপরের দিকে তাকায়। চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলে,,,
:-হয়… খুব হয়। কিন্তু আমরা যদি সেই কষ্ট আঁকড়ে ধরি, তাহলে চিকিৎসা করবো কীভাবে?
জন্ম আর মৃত্যু— দুটোই আমাদের চোখের সামনে ঘটে। ধীরে ধীরে এই খেলা দেখতে দেখতে আমরা হয়ে যাই পাথর…!
তুলি চোখে জল,,,,
:-তাই বলে মন থাকবে না? ডাক্তারদের কি চোখে জল নেই? ডাক্তাররা কেন কাঁদে না?”
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে…তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে,,,
:-একজন ডক্টর কেন কাঁদে না জানো? কারণ মেডিকেলে এসে প্রথম দিনেই সে বড়সড় ধাক্কা খায়। এনাটমি ডিপার্টমেন্টে একটা ঘুমন্ত লাশ দেখে। দশ বিশ বা তারও অধিক পুরনো লাশ। ঘুমন্ত সেই লাশের গায়ে কাপড় নেই। বুকের চামড়া মাঝ বরাবর কেটে ফেলা। গাছের বাকলের মত চামড়া কেটে পেশী, রক্তনালি, নার্ভ গুলো বের করা। প্রথম দিন থেকেই তাকে ইচ্ছেই বা অনিচ্ছায় সেই কাটাকুটো অংশগুলো টানাটানি করে পড়তে হয়। সেই সময় ফরমালিনের ঝাঁঝ চোখের সব পানি ঝরিয়ে দেয়।
*দ্বিতীয় ধাক্কাটা সে খায় ফরেনসিকে। মর্গে গলায় রশি দিয়ে মরা, গলা কেটে মারা, পানিতে ডুবিয়ে মারা, ৮ টুকরো লাশের জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড দেখে সে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কান্নার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলে। তবে কান্না একদিন এসেছিলো!
যেদিন মৃত মায়ের জরায়ু কেটে মৃত মায়ামাখা সুন্দর একটা শিশুকে বের করে এনেছিল স্যার!! কান্না থেমে গিয়েছিলো। যখন স্যার গমগমে গলায় বললেন, যেই লোকটা এই মেয়েটার পরিণতির জন্য দায়ী, থাকে গলা কেটে হত্যা করা কি পাপের কাজ হবে?
আমরা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিলাম,,,,:-তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারলেও পাপ হবে না।
*এরপর তৃতীয় ধাক্কাটা খাই ইমারজেন্সিতে রোগী দেখে। হাত পা পুড়ে ঝলসে গেছে, কিন্তু এখনো হৃদপিন্ডটা ধক ধক করছে। বুকের পাঁজর ফেটে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু রোগী কোনমতে কষ্ট করে তার হৃদপিণ্ড টা বাঁচিয়ে রেখেছেন। সেদিন “আমার কোন সমস্যা নেই বাবা” শুধু বুকটা ভারী লাগছে বলার পর ইসিজি করতে করতেই গ্রাফ ফ্ল্যাট হয়ে থাকে, সেদিন থেকেই ডক্টরদের সব কান্না হারিয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্না দূর করতে কাউকে না কাউকে তো নিজের কান্না গোপন রাখতেই হবে!!
সায়ান থামতেই তুলির হিচকি তুলে কান্নার শব্দ কানে এসে ধাক্কা খায়। সায়ান নিঃশব্দে এক হাতে জড়িয়ে ধরে তুলির কাঁধ। চোখটা ভীষণ জ্বালা করছে!!
লাল হয়ে এসেছে কি!! গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা কান্নাটুকু গিলতেই প্রাণপণে ঢোক গিলে সায়ান!!
*********
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে… একেকটা সেকেন্ড যেন একটা একটা বছর হয়ে যাচ্ছে তৈমুরের জন্য।
ডাক্তাররা বলেছে—ক্রিটিক্যাল ৪৮ ঘণ্টা। ৪৭ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। মনিটরিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা তৈমুর যেন পাথর হয়ে গেছে। সারার নিথর দেহে সংযুক্ত মনিটরের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ওঠানামা,তৈমুরের হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে বাজছে।
আর একটিবার…আর একটিবার চোখটা খুলে তাকাক সারা…
তৈমুর সারার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচু হয়ে সারার মাথার দুপাশে হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে সারার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিষ্প্রভ গলায় বললো,,,
:-তুমি চাইলেই চলে যেতে পারিস না সারা… তুই চলে গেলে আমি কীভাবে বাঁচবো? প্লিজ আমাকে ফেলে যাস না রে প্রাণ! ফিরে আয় না জান , একবার আমার বুকের মাঝে ফিরে আয়!!
শব্দ করে কাঁদতে পারেনা তৈমুর,, অস্বাভাবিকভাবে হাঁপিয়ে ওঠে। যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে । কিন্তু তার চোখের কোণ বেয়ে নিরবধি গড়িয়ে পড়ে নোনা জল।
হঠাৎই মনিটর থেকে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ আসে। তৈমুরের সর্বসত্বায় যেন তরঙ্গ খেলে গেলো। আচমকা উঠে দাঁড়াই তৈমুর,,,
মনিটরের হার্ট রেট কখনো বেড়ে যাচ্ছে, কখনো থেমে যাচ্ছে।
চোখে অন্ধকার দেখছে তৈমুর, বুকের ভেতর একটা দম আটকে আসা কষ্ট। সারা যেন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে তার জীবন থেকে…
সেই মুহূর্তেই সায়ান আর আবির হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢোকে। আবির মনিটর চেক করতে শুরু করে। সায়ানে এসে ঝাপটে ধরে তৈমুরকে।
তৈমুর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, মাথা নিচু করে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকে।
:- আল্লাহ তুমি ওকে ফিরিয়ে দাও…আমার প্রাণটাকে ভিক্ষা দাও খোদা…আমি ওর ভুলের বিচার করতে চাই না… শুধু ওকে ফিরিয়ে দাও…আমার সারা!!!
শিকদার হাউজের সবাই এসে উপস্থিত হয় কেবিনের বাইরে। তুলি,রেশমি,সিমা শিকদার,সাইফ শিকদার, আলিফ শিকদার… সবার চোখে অশ্রু।
রিনা শিকদার নামাজের পর দোয়া পড়ছেন। বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু!
এ যেন এক নিঃশব্দ আহাজারি… এক হৃদয় বিদারক নীরব কান্না…
কেবিনে তখন নিস্তব্ধতা। হঠাৎ…একটা ছোট্ট নড়াচড়া। মুহুর্তেই মনিটর আবার স্বাভাবিক সিগনাল দিতে শুরু করে।
তৈমুর ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায়।
:-সারা!”
ধীরে ধীরে সারার চোখের পাতাগুলো কেঁপে ওঠে।
তারপর,এক জোড়া মায়াভরা চোখ খুলে তাকায়। খুবই অল্প… চোখের সামনে অস্পষ্ট কায়া ভেসে ওঠে, আবারও বন্ধ হয়ে যায় চোখজোড়া।
তৈমুর যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার কণ্ঠ ধরে আসে। কোনো শব্দ করতে পারে না।
অক্সিজেন মাস্কে ঢাকা সারার মুখে শতশত চুমু দিয়ে ভরিয়ে দেয় তৈমুর।
:-সারা…আমার সারা… তুই আমার কথা রেখেছিস… তুই ফিরে এসেছিস… তুমি ফিরে এসেছিস আমার কাছে…আমার জান রে!! তাকা আমার দিকে! এই হার্টবিট! থাকা না!
সারার ঠোঁট নড়ে… কিন্তু শব্দ আসে না।
তবে ততটুকুই যথেষ্ট তৈমুরের সুখের সাগরে ভাসতে।
সেখানেই ধপ করে বসে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে তৈমুর। নিরব কান্নার তোপে কেঁপে কেঁপে ওঠে তার সুঠামদেহ খানা।
শিকদার পরিবারের কাছে খবর পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। আবির বাইরে এসে হাসিমুখে সকলকে খবরটা দিলো।
সবাই মিলে আল্লাহর দরবারে সিজদা দেয় শুকরিয়ায়।
তুলি রেশমি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
:-ভাইয়া বেঁচে গেছে… সারার সাথে সাথে আমাদের ভাইয়ার জীবনটাও বেঁচে গেলো…
হাসপাতালের আলো তখনও কৃত্রিম, কিন্তু কেবিনটার ভেতরে যেন একটা শান্তির আলো এসে পড়েছে।
যেন মৃত্যু সরে দাঁড়িয়েছে, আর জীবন হালকা করে ছুঁয়ে দিয়ে গেছে সারার নিঃশ্বাসে।
সায়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেই অপার্থিব অনুভুতি ব্যাক্ত করতে থাকা তৈমুরের দিকে।
আইসিইউর কেবিনে দাঁড়িয়ে থেকেই সে এক অপুর্ব ভালোবাসার সাক্ষী হলো আজ!!
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব… ৪২
মৌমো তিতলী
❤️
হাসপাতালের সেই আইসিইউ কেবিনে এখনো নিস্তব্ধতা। তবে সেই নিস্তব্ধতার মাঝে আজ একটু আশার আলো ছড়িয়েছে।
ভোরের দিকে সারার চোখ আবারও খুলেছে। এবার কিছুটা স্থির… কিছুটা স্পষ্ট।
মনিটরের নিয়মিত বিটিং, সিসিটিভি মনিটরে ভেসে থাকা হার্ট রেট সবই এখন স্বাভাবিকের দিকে।
তৈমুর এবার নিজেই সারার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। তার চারপাশে এখন কেবল হাসপাতালের কর্মচঞ্চলতা নয়,বরং ভালোবাসা, উদ্বেগ আর গভীর মনোযোগের ছায়া পড়েছে।
শিকদার পরিবারের সবাই এবার খানিকটা স্বস্তিতে।
তাদের দীর্ঘ দুই দিনের নির্ঘুম ক্লান্ত চোখে প্রথমবারের মতো একটু আরাম ফুটে উঠেছে।
সিমা শিকদারের কোলে ঘুমিয়ে পড়া ছোট্ট তন্ময়কে কোলে নিয়ে তৈমুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। তৈমুর কাকিয়ার কোলে থাকা ছোট্ট তন্ময়ের কপালে আদুরে হাত বুলিয়ে বলে,,,
:- কাকিয়া তোমরা এবার বাসায় যাও, আমি আছি তো, তোমরারা বাড়িতে যাও। তোমাদের এখন একটু বিশ্রাম দরকার… তোমরাও তো দু’দিন ঠিকঠাক মতো কেউ ঘুমাওনি।
তৈমুরের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় সিমা। তৈমুর
সবার দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-সবাই বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমি আছি… সারার যখনই পুরোপুরি জ্ঞান আসবে, তখনই আমি জানাবো তোমাদের।
সবাই সহমত পোষণ করে । আসলেই সবার এবার একটু শান্তির বিশ্রামের দরকার।
রিনা শিকদার বেরিয়ে যাবার আগে ছেলের মুখের দিকে তাকায় চিন্তিত দৃষ্টিতে। সবাইকে বিশ্রামের কথা বলে বাড়িতে যেতে বলছে অথচ আজ চারটা দিন তৈমুর নির্ঘুম,প্রায় না খাওয়া অবস্থায় আছে। নিজের কথা একবারও ভাবছে না ছেলেটা। সারার অবস্থা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত যে তার ছেলেটা স্বস্তিতে ঘুমাতে পারবে না তিনি মা হয়ে ঠিকই বুঝতে পারেন। সারা কে যে বড্ড ভালোবাসে তার ছেলেটা । সবাই একে একে বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে।তবে রেশমী একদম নড়ে না।
তুলির কণ্ঠে ক্লান্তির ছাপ,,,
:- কিরে রেশমী, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই যাবি না?
রেশমী চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বলে,,
:-না রে। সারার মুখ থেকে কথা না শুনে আমি বাড়ি যাবো না। ওর জন্যই আজ আমি বেচে আছি… আমি থাকবো এখানে।আমাকে বাঁচাতে গিয়েই আজ সারার এই অবস্থা। ওকে সুস্থ না দেখা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।
তৈমুর কিছু বলে না। শুধু একবার স্নেহভরে বোনের দিকে তাকায়। তুলিকে চোখের ইশারায় জানায় “থাক ও”
_______
করিডোরে সকালের স্নিগ্ধ রোদ্দুর এসে পড়েছে!!
হাসপাতালের এক ফাঁকা করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছে তালহা। হাতে হালকা ব্রেকফাস্টের পার্সেল। সাথে ফ্লাক্সে কড়া লিকারের চা। রেশমীর ভীষণ পছন্দের এটা।
ভার্সিটিতে অনার্সের প্রথম বর্ষের সেমিস্টার এক্সাম চলছে,চাইলেও দুদিন হাসপাতালে আসতে পারেনি তালহা। রেশমীর সাথেও ঠিকঠাক যোগাযোগ করতে পারেনি।তাই আজ একটু জলদিই বেরিয়েছে সে। হসপিটাল থেকে সোজা ভার্সিটিতে যাবে। আইসিইউর করিডোরে পা রাখতেই রেশমী তার নজরে আসে। রেশমী কাঁচের জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেই তালহার দৃষ্টি যায় তার দিকে।
তালহার চোখে স্নেহ স্পষ্ট। মেয়েটার ক্লান্ত মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কিছুক্ষণ। সাবলীল ভঙ্গিতে রেশমীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
সকাল সকাল প্রিয় মানুষটাকে এখানে আশা করেনি রেশমী। তবে তালহা কে দেখে অদ্ভুত অনুভুতিতে ঝিলমিলিয়ে ওঠে রেশমীর চোখদুটো। মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকায় তালহার মুখের দিকে। ধীরে সুস্থে সালাম দেয় রেশমী।
সালামের জবাব দিয়ে খাবারের পার্সেল টা এগিয়ে দেয় রেশমীর দিকে। রেশমী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে জানায়,,,
:-এই দুদিনে ভালো করে তোমার মুখটাও দেখা হয়নি রোশী। সরি আসতে না পারার জন্য। আমি জানি তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করোনি। এতে হালকা ব্রেকফাস্ট আছে সাথে তোমার পছন্দের কড়া লিকারের চা। খেয়ে নাও, ফ্রেশ লাগবে।
সারার কন্ডিশন জানতে চাইলে, তা জানায় রেশমি।
কেমন অদ্ভুত মায়া ভরা দৃষ্টিতে রেশমি মুখের দিকে তাকাই তালহা।
রেশমী একটু হেসে মুখ নামিয়ে নেয়। চোখে ক্লান্তি, তবু সে হাসে।
তালহা একটু কাছে এসে মৃদু স্বরে বলে—
:- তুমি জানো… এই মুহূর্তে সূর্যের এক চিলতে স্নিগ্ধ রোদ্দুর এসে পড়েছে তোমার মায়াবী মুখের ওপর। কতটা সুন্দর লাগছে তোমাকে!!
রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় লালিমা দেখা দিলো রেশমীর গাল জুড়ে।
তালহা মুগ্ধ চোখে দেখে তা। হঠাৎই বলে,,,
:- জানো সেদিন যখন তুমি চিৎকার করে সাহায্য চাইছিলে সারাকে বাঁচাতে, তোমার মুখে যে আতঙ্ক দেখেছিলাম, তা কখনোও ভুলতে পারবো না আমি। তখন আমার মনে হয়েছিলো তোমার এই অবস্থা দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আমি বুঝেছিলাম… তুমি… তুমি আমার প্রাণ! সেদিন সারার জায়গায় যদি তুমি থাকতে,সারা যদি তোমাকে খেয়াল না করতো তাহলে আজ এই পরিস্থিতিতে তুমি থাকতে,,এটা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে যায়!
রেশমী মলিন মুখে চোখ সরিয়ে নেয়, তারপর ধীরে ধীরে মাথা রাখে তালহার বুকে। চোখ বন্ধ করে বলে,,,
:-আপনি জানেন না… আপনি না এলে আমি ভেঙে পড়তাম স্যার…আমি কত অসহায়ের মত সাহায্য চাইছিলাম,কেউ এগিয়ে আসেনি। অস্ফুট স্বরে ফুঁপিয়ে ওঠে রেশমি।
তালহা আলতো করে রেশমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,,
:-“তোমার পাশে আমি সব সময়ই আছি রোশী। জীবনের প্রতিটা করিডোরে, প্রতিটা কঠিন সময়ে তুমি আমাকে তোমার পাশে পাবে”
এই ভালোবাসায় ভেজা মুহূর্তে যেন করিডোরটা একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে। হাসপাতালের ধূসর দেয়ালে ছায়া ফেলে দুটি মানুষের নিঃশব্দ ভালোবাসা।
দুপুর ১২ টা।
সারার চোখ ধীরে ধীরে আরও স্থির হয়। এই প্রথমবার, সে ভালো করে তাকাতে পারছে চারপাশে। চোখের পাতায় যেনো একশো মন ওজন।
ধীরে ধীরে চোখ দুটো আধা খুললো সারা। চোখের সামনে ঝাপসা সাদা একটা সিলিং… অচেনা, ফাঁকা, ক্লান্ত দৃষ্টি। কোথায় সে?
চোখের পাতায় ব্যথা। পাপড়ি কাঁপছে। আলোটা সহ্য হচ্ছে না। সারা হাত ঠেকাতে চাইলো চোখে, কিন্তু হাত তোলার শক্তি নেই। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে কাঠ। গলাটা যেন ধুধু বালুচরের মরুভূমি পেরিয়ে এসেছে। পানি… একটু পানি দরকার।
এদিক-ওদিক তাকানোর চেষ্টা করতেই একটা কাঁটার মতো ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো মাথায়। কপালটা টনটন করে উঠলো। মাথাটা ভারী, শরীরটা যেন তার নিজের না। কেমন নিষ্প্রাণ, অসাড় লাগলো সারার কাছে।
চোখ খুলে সে আবার তাকালো সিলিংয়ের দিকে। যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। মাথার পাশে ঝুলে থাকা স্যালাইনের স্ট্যান্ড… মাথায় ব্যান্ডেজ… পাশেই বিপবিপ শব্দ করা একটা মনিটর।
চোখের পাপড়ি কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একটা আতঙ্ক… একটা ছায়া… তারপর একসাথে ভেসে উঠলো অস্পষ্ট কিছু চিত্র—রেশমী, দানবের মতো উড়ে আসা চলন্ত ট্রাক,রাস্তায় ধাক্কা, ব্রেক কষা আওয়াজ… তারপর অন্ধকার।
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কোণ বেয়ে। সেটা যন্ত্রণার? নাকি অপ্রিতিকর অনুভূতির? সারা নিজেও জানে না।
সারা অস্ফুট স্বরে ফ্যাসফেসে গলায় উচ্চারণ করার চেষ্টা করে ,,,,
:-“জা…হান…”
তৈমুর তখন একটা ওষুধের রিপোর্ট পড়ছিলো। আচমকা খুবই মৃদু… খুবই অস্পষ্ট শব্দের ডাকে—
তৈমুরের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।
ওই নাম… এই ডাক… সেই সুর…শোনার জন্যই তো তার চারটা দিন ধরে তার হৃদয়টা হাহাকার করছিলো!
তৈমুর তড়াক করে সামনে এসে সারার চোখের দিকে তাকায়।
:-এইতো জান… আমি এখানে… সারা… তাকা আমার দিকে…এই পাখি!
সারা ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করে। চোখে যেন একটা ঝাপসা জলরেখা, তার মাঝেই সে দেখতে পায় সেই চিরচেনা প্রিয় মুখটাকে।
তৈমুর আদরভরা হাত বুলিয়ে দেয় সারার কপালে।
:- কাঁদছিস কেনো প্রাণ? ব্যাথা করছে খুব? হ্যাঁ!
সারা কাঁপা ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠলো। কিছু বলতে পারে না। কিন্তু সারা কাঁদছে দেখে তৈমুর ব্যাকুল হয়—
:-না না… প্লিজ কাঁদে না জান… এই তো আমি আছি। হুশশশ! কাঁদে না। তৈমুর আঙ্গুলের আলতো ছোঁয়ায় সারার চোখের কোণের জলটুকু মুছে দেয়।
সারা বহু কষ্টে মৃদু স্বরে বিড়বিড় করে,,,
:-পা….নি।
তৈমুর বুঝতে পারলো সারার পিপাসা পেয়েছে। এটা স্বাভাবিক। তৈমুর কেবিনের ওয়াটার ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে আসে। ড্রপের সাহায্য অল্প অল্প করে সারার মুখে দিলে সারা অতি কষ্টে তা গলাধঃকরণ করে। গলা ভিজলে স্বস্তি পায়!
তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। তৈমুর আগ্রহী হয়ে তাকায় সারার মুখের দিকে। সারা কি বলতে চাই সেটাই জানার অদম্য ইচ্ছা,,,,
সারা ধীরে উচ্চারণ করে,,,
:-রেশ…মী!
তৈমুর বুঝলো সারার মনোভাব। সারার মুখটা দুহাতের তালুতে আলতো করে ধরে বলে,,,
:-রেশমী ঠিক আছে পাখি। চিন্তা নেই! বাইরেই আছে রেশমী । একটু পরেই তোকে দেখতে আসবে দেখিস!!
সারা আর কিছুই বলে না শুধু চোখ থেকে জল পড়তে থাকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
তৈমুর খুব আলতো করে চুমু দেয় সারার কপালে তারপর কপালে হাত রেখে সারার মুখের খুব কাছে কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,
:-এখন কিছু বলিস না জান। ব্যাথা হবে। আর কোন কথা বলিস না প্লিজ। তুই ভালো আছিস, এইটুকুই আমার শান্তি। বাকি সব আমি সামলাবো। তুই একটুও ভয় পাবি না। আমি আছি জান, আমি আছি।
সারা চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু হেলিয়ে দেয়। যেন একটুখানি আরাম পায় সেই কন্ঠ শুনে।
তৈমুর মাথা নিচু করে সারার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে থাকে অনেকক্ষণ…
এই ভালোবাসার মুহূর্তে কোনো শব্দ ছিল না, শুধু ছিলো স্বচ্ছ পবিত্রতায় মোড়ানো একটা মুহূর্ত, ভালোবাসার এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা।
**********
সারা চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাথা ভারী, শরীর দুর্বল, কিন্তু চোখে এখন আলো… জীবন ফিরে পাওয়ার আলো।
তখনই কেবিনের দরজায় ধীর পায়ে ঢুকলো রেশমি। সারার খোলা চোখ দেখে উৎফুল্ল আর উৎকণ্ঠায় যেন এক লাফে ছুটে এলো ওর পাশে।
:-সারা! তুই… তুই ঠিক আছিস? হায় আল্লাহ্…!!
রেশমি সারার হাত ধরে হিচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো,,,
:-কেন গেলি আমাকে বাঁচাতে? আমি মরলে মরে যেতাম, তাও তুই এভাবে নিজের জীবনটা ঝুঁকিতে ফেলতে গেলি কেনো… যদি তোর কিছু হয়ে যেতো সারা…আমি কি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম বল??
শব্দগুলো কাঁপছিল কান্নায়, কণ্ঠে আটকে যাচ্ছিলো রেশমীর।
সারা খুব আস্তে ঠোঁট নাড়লো,,,
:-তু..মি ঠিক.. আছো আ..পু…?
শব্দগুলো খুবই ক্ষীণ, কিন্তু তাতে চিন্তার সুর ছিলো।
রেশমী সারার দিকে ঝুঁকে কপালে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,
:-এই দেখ একদম ঠিক আছি আমি!!
তৈমুর এসে দাঁড়াল রেশমির পাশে। এক হাত বোনের কাঁধে হাত রাখলো, সান্ত্বনার মতো।
:-রেশমি, শান্ত হ। ওর সামনে এভাবে ভেঙে পড়তে মানা করেছি আমি।
রেশমি চোখ মুছলো। স্নেহে সারার কপালে একটা চুমু দিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে তালহা। নিঃশব্দে এতক্ষণ ধরে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
তালহা এগিয়ে এলো। সারার দিকে তাকিয়ে বলল,,
:-তুমি এখন কেমন অনুভব করছো, সারা?
সারা চোখের ইশারায় একটা অল্প হাসি দিল।
তালহা এবার তৈমুরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করে। তৈমুর হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
:- তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না ভাই…সঠিক সময়ে যদি তুমি ওদেরকে সাহায্য না করতে, তাহলে না জানি আজ কি হতো!! তোমার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে এই তৈমুর জাহান শিকদার।
তালহা মাথা ঝাঁকালো,,,
:- কি যে বলেন ভাইয়া। এটা তো আমার দায়িত্ব।
আরো কিছু সৌজন্যমূলক কথোপকথনের মাঝেই তালহা বেরিয়ে যেতে চাইলে তৈমুর বলে,,
:-রেশমি, এবার তুই বাড়ি যা। তোর বিশ্রাম দরকার। সন্ধ্যায় সকলের সাথে আবার আসিস না হয়।
তারপর তালহার দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-তুমি ওকে নিয়ে যাও। এখন থেকেই না হয় ওর দায়িত্বটা আমি তোমাকে দিলাম।
তালহার চোখে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি খেলে গেলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতিসূচক ভঙ্গি করলো সে। বড় ভাইয়ের কথায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো রেশমীর।
রেশমি একবার সারার দিকে ফিরে তাকালো। চোখে কান্না, তবুও মনে অফুরন্ত শান্তি। তৈমুরের কথামতো তালহার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
কেবিনে আবার নেমে এলো নিরবতা। শুধু মনিটরের নিয়মিত শব্দ। তৈমুর ঝুঁকে সারা কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ সেই নিরবতা ভেঙে দরজায় এসে দাঁড়ালো সায়ান।
সারাকে তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে দেখে দাঁত বের করে হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে ওঠে সায়ান,,,
:-কি অবস্থা ছোট ভাবি!”
সায়ানের চোখেমুখে পুরনো দুষ্টুমির ঝলক।
:-“আমার বন্ধুটাকে তো মেরেই ফেলেছিলে নিজের সাথে সাথে! সে তো তৈমুরের কপাল ভালো, আল্লাহর কাছ থেকে জেদ করে, কাঁদতে কাঁদতে, ঘ্যান ঘ্যান করে জোর করে তোমাকে ফিরিয়ে এনেছে! কী পরিমাণ পাগলামি করছিলো জানো? বেচারা তো প্রায় ICU-তে ভর্তির কাছাকাছি চলে গেছিলো…”
সারা দুর্বল শরীর নিয়ে একটু হেসে উঠলো। চিকচিক করে উঠলো মায়াবী চোখ দুটো। কষ্টের মাঝেও সায়ানের মুখভঙ্গি আর কান্ড দেখে হাসি চেপে রাখতে পারলো না।
তৈমুর বিরক্ত মুখে বললো,
:-তোর ফালতু কথা বন্ধ করবি সায়ানাইড? নাকি তোকে এখান থেকে লাথি মেরে বের করে দেবো?
সায়ান চোখ কুঁচকে নাটুকে ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বললো,,,
:-এই তো শুরু! ভালো কাজের দাম নেই আজকাল। সত্যি কথার কেউ দাম দেয় না। ইয়ামাবুদ! তুমি বিচার করো! কাজের সময় কাজি, আর কাজ ফুরালেই আমি এখন পাজি! হায় রে কপাল!
তৈমুর মুখ গম্ভীর রাখলেও চোখে হাসির ঝলক খেলে গেল। সারার দিকে তাকিয়ে আরেকটু হাসলো—এবার একটু স্বাভাবিক, একটু প্রাণখোলা।
সায়ান তখনো ঢং করেই যাচ্ছে।
:-আমি আর কিছু বলবো না। আমি আজ থেকে চুপ। আজ থেকে আমি ব্রত নিলাম। মৌনব্রত!
তৈমুর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,,
:-সত্যিই যদি করিস, আমি হাসপাতালে মিষ্টি বিলাবো।
সায়ান অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তৈমুরের দিকে!! এটা তার বন্ধু নাকি অন্য কিছু!! সব কপাল!!
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব… ৪৩
মৌমো তিতলী
❤️
এক সপ্তাহ পর…
সারা এখন কিছুটা সুস্থ। বেডে হেলান দিয়ে বসতে পারে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও তার ভেতরের প্রাণ আবার ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে। মুখের লাবণ্যতা ফিরে এসেছে তৈমুরের অগাধ যত্নের ফলে।
এই সময়েই কেবিনে ঢুকলেন সাইফ শিকদার আর রিনা শিকদার।
সারার মুখে হাসি ফুটে ওঠে দু’জনকে দেখে।
রিনা শিকদার এগিয়ে এসে বিছানার পাশে বসেন। কপালে আদুরে চুমু দিয়ে বলেন,,
:- আমার সোনা মেয়েটা! এখন কেমন আছিস বলতো?
তৈমুরের মুখে শুনলাম তুই নাকি ঠিকমতো খেতে চাইছিস না! একদম বকা খাওয়ার মতো আচরণ করবি না এখন! ওষুধ খাবি ঠিকমতো।
সারা মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। রিনা শিকদার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ভালোবাসায়।
সাইফ শিকদার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,,,
:-মামণি এখন কেমন লাগছে?
সারা হেসে বলে,,
:-ভালো আছি আঙ্কেল!
:-গুড! এখন ঠিকমতো খাবার খেতে হবে, ওষুধ খেতে হবে কেমন! তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে তো নাকি!!! তোমাদের কে ছাড়া শিকদার হাউস একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগে যে!
সারা হেসে মাথা দোলায়। সাইফ শিকদার তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বলেন,,,
:- জাহান, মেয়েটার দিকে খেয়াল রেখো ঠিকঠাক। এখনো একেবারে সুস্থ হয়নি। ডিউটিতে যাওয়ার আগে কাউকে রেখে যেও ওর কাছে।
তৈমুর মাথা নাড়ে সম্মতিতে। হালকা হাসে।
কিছুক্ষণ থেকে তারা বিদায় নেয়। রিনা শিকদার সারার হাতটা ধরে বলেন,,,
:- ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করবি কিন্তু মা। আর কিছু লাগলে তৈমুরকে বলবি…যদিও ও তোকে চোখের তারার মতো আগলে রাখবে জানি। সারার কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে দু’জনেই বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর কেবিনে ঢোকে তুলি আর সায়ান।
তুলি সারার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে,,,
:- কিরে কেমন আছিস সোনা?
সারা তুলিকে দেখে বিগলিত হয়ে মাথা নুইয়ে বলে,,,
:- ভালো আছি আপু। তোমাকে দেখে তো আরও ভালো লাগছে।
তুলি উঠে এসে পাশে বসে সারা’র হাত ধরে। স্বস্নেহে বলে,,,
:- নিজের খেয়াল রাখবি শুনেছিস? সায়ানের বাবা মা তো ইতালি ফিরে গেছে তাই একা সবকিছু বুঝে উঠতে সময় লাগছে, এইজন্যই চাইলেও বেশি আসতে পারছি না। তাই আজ সকাল সকাল ভার্সিটি যাওয়ার পথে এখন আসলাম তোর কাছে,,
সারা হেসে বলে,,,
:- ঠিক আছে আপু,, দেখো আমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবো , তারপর তোমার সাথে তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকবো!
সারার কথায় তৈমুর ভ্রু কুঁচকে তাকায় সারার দিকে। তা দেখে সায়ান খিক খিক করে দুষ্টু হেসে বলে,,,
:-একদম ঠিক বলেছো ছোট ভাবি! তুমি বরং তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমাদের বাসায় গিয়ে থেকো! আমার বউটা একা থাকতে চায় না বুঝলে!
তুমি থাকলে আমার বউটার একটা সঙ্গি হবে!
সায়ানের ইঙ্গিত ঠিক বুঝলো তৈমুর!! সারা তো এমনিতেই বোকা! সবাই মিলে আরো বোকা বানাচ্ছে। মাঝখান থেকে তাকে বউছাড়া করার পাঁয়তারা করছে!
তৈমুর কটমট করে তাকালো সায়ানের দিকে!!
তৈমুরের চোখ রাঙানো দেখে সায়ান ভ্রু নাচিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।
তুলি কিছুক্ষণ থেকে সারাকে আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নেয় ভার্সিটির ক্লাস ধরার জন্য।
সায়ান কেবিনের সোফায় বসে সেন্টার টেবিলে পা তুলে দিয়ে বলে ওঠে,,,
:- ছোট ভাবি! তুমি তো দেখছি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠতেছো,এসব কিন্তু আমার বন্ধুর যত্নাদ্দির ফল! বেচারা তৈমুর তো এখন একেবারে তোমার পার্সোনাল নার্সে পরিণত হয়েছে! সকাল-সন্ধ্যা তোমাকে নিয়েই ব্যস্ত। আহা কি প্রেম!! দেখলেই কইলজাখান জুড়াইয়া যায়!!
সারা সায়ানের কথায় ফিক করে হেসে ফেলে,একটু লাজুক হয়ে মুখ নামিয়ে ফেলে।
তৈমুর ভ্রু কুঁচকে বলে—
:- শালা সায়ানাইড, তোর মুখে কোনো ব্রেক নাই না?
সায়ান মুখ বাকা করে বলে—
:- সত্য কথার ভাত নাই ভাই!!
তৈমুর মুখ গম্ভীর চোখে তাকালো সায়ানের দিকে।
সায়ান এবার দৃষ্টি ফেরায় সারার দিকে,,
:-ছোট ভাবি,তোমার এই অ্যারোগেন্ট ফায়ার হাসব্যান্ডের জ্বালায় আমরা কবে ভষ্ম হয়ে যাবো দেখো!! এক্কেরে রসকষহীন অ্যান্টিবায়োটিকের মতো! কি করে যে তোমার মতো একটা বাচ্চা এটাকে ম্যানেজ করে কে যানে!!
তৈমুর সায়ানের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,,,
:-কি করে ম্যানেজ করে জানতে চাস? তাহলে চল দেখাচ্ছি!
সায়ান তড়াক করে দাঁড়িয়ে তার হাত দুরে ছিটকে গিয়ে বলে,,,
:- একদম নাআ!!তুই তো এক্কেরে রসে ডুবানো ছানা জিলাপি,,তুই না থাকলে তো হসপিটালটাই পানশে হয়ে যেতো!! মাইরি বলছি দোস্ত!
তৈমুর বিরক্ত হয়ে বলে,,
:- অনেক হয়েছে, তোর ফালতু কথা শেষ হলে এবার ডিউটিতে যা।
সায়ান বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে,,,
:- আজ্ঞে মহারাজ, আমি চলিলাম। যেতে যেতে সারার দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-তুমি ভালো থেকো ছোট ভাবি। আর তৈরি থেকো, তোমার সুস্থতার সেলিব্রেশন করতে কিন্তু একজন মুখিয়ে আছে!! সুযোগ পেলেই কিন্তু খটখটে শুকনো মরুভূমি জলে ভরে ফেলবে!
তৈমুর কে আবারো তেড়ে আসতে দেখে হুড়মুড়িয়ে দৌড় লাগায় সায়ান। তৈমুর সায়ানের পিছনে যেতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।
সায়ানের কান্ডে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সারা।
কিছুক্ষণ পর…
তৈমুর কেবিনে ফিরে আসে। সারা তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে। তৈমুর সারার পাশে বসে এক হাতে সারার মুখটা আগলে ধরে বলে,,,
:- আজ আমার একটা ইম্পরটেন্ট সার্জারি আছে পাখি। তাই কিছুক্ষণ বাইরে থাকবো।
তুই এখন একটু স্যুপ খেয়ে, ওষুধ খেয়ে ঘুমাস প্লিজ।
সারা মুখ ছোট করে বলে—
:- আবার স্যুপ! আমার স্যুপ খেতে ইচ্ছে করে না। ভালো খাবার কবে খেতে দেবেন ?
তৈমুর মলিন হাসে। এগিয়ে এসে সারা’র পাশ ঘেঁষে বসে। আলতো করে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে বলে,,
:- আর একটু সুস্থ হয়ে উঠ, তারপর চাইনিজ থেকে শুরু করে বিরিয়ানি সব খেতে দিবো। আপাতত এইটা খা, না হলে ওষুধ খাবি কি করে জান? তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো! তোকে এভাবে হসপিটালের বেডে দেখতে আমার যে কলিজা টা ছিঁড়ে যায় প্রাণ! বুঝিস না কেন!
সারা মুখ ফুলিয়ে বলে,,
:- সেদিন আমাকে বকেছিলেন, আমি কিন্তু ভুলিনি!
তৈমুর মুচড়ে পড়ে। অনুশোচনায় দগ্ধ হয় হৃদয়। দুহাতে সারার মুখটা চেপে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে কাঁপা গলায় বলে,,,
:- সরি জান! আমি জানতাম না তো, আমার জানটা এমন পাগলামি করে ফেলবে… কেউ তোর দিকে আঙ্গুল তুললে আমার বুকে আগুন জ্বলে ওঠে রে জান! সহ্য করতে পারি না। তুই তো আমাকে জানাতে পারতিস ওই স্কাউনড্রেল টা তোকে ডিস্টার্ব করছে! বলিসনি কেন বল?
সারা লজ্জিত হয়। সত্যিই তো। সে তো তৈমুর কে জানাতে পারতো। ভুল তো সেই করেছে। উত্তর দিতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেলে সারা।
তৈমুর স্নেহে সারার কপালে চুমু এঁকে দেয়। স্যুপের বোল হাতে নিয়ে অল্প অল্প করে চামচে ফুঁ দিয়ে যত্নের সাথে খাইয়ে দেয় সারা কে। খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। আদুরে স্পর্শে গালে হাত বুলিয়ে দেয়।
হঠাৎ মুখটা এগিয়ে নিয়ে আসে একটু… তারপর সারার চোখে চোখ রাখে তৈমুর। তৈমুরের দৃষ্টি আটকে যায় সারার ঠোঁটে। শুকনো ঢোক গিলে। এক মুহূর্ত, নিঃশ্বাস থেমে থাকে…
তারপর খুব ধীরে, খুব আদরে সারার ঠোঁটে এক গাঢ় চুমু এঁকে দেয় তৈমুর।
সারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তৈমুরের আকস্মিক করা কাজে। লজ্জায় গাল লাল। চোখ নামিয়ে ফেলে।
তৈমুর সারার রক্তিম লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। ধীরে ধীরে ওষুধ খাইয়ে দেয়। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,,,
:- ঘুমিয়ে পড় জানপাখি। আর দশ মিনিট পর আমার একটা ইমারজেন্সি অটি আছে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। একটুও ভয় পাবি না। তোর পাশে একজন ফিমেল নার্স রেখে যাচ্ছি। ঠিক আছে?? আসছি আমি!!
সারা বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে একটু মাথা হেলিয়ে দেয়। তৈমুর ঝুঁকে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সারার দুচোখে কোমল শান্ত একটা ঘুম নেমে এলো।
তৈমুর উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সারার মুখের দিকে। তারপর কপালে একটা ভালোবাসার চুমু এঁকে দিয়ে এসির পাওয়ার ঠিকঠাক করে পাতলা একটা চাদর টেনে দিলো। বাকি সব গুছিয়ে ঠিক করে বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে।
*********”
নিজের কেবিন থেকে ডিউটি রেডি অবস্থায় তৈমুর বেরিয়ে আসে। অটির ভেতরে ঢোকে। আগে থেকেই হাতে গ্লাভস পরে অপেক্ষা করছিল সায়ান।
:- ও হো! এতক্ষণে তোর লেডি লাভ ঘুমিয়েছে বুঝি?
তৈমুর চোখে কনফিডেন্ট হাসি!
:- ঘুমিয়ে গেছে। আমার জান বলে কথা! একদম লক্ষি শান্ত সুইট কিউটের ডিব্বা।
সায়ান চোখ বড়বড় করে তাকায় তৈমুরের দিকে। ভেবেছিলো পিঠে দু’ঘা পড়বে নিশ্চিত! কিন্তু তৈমুরের ঠান্ডা রিয়াকশন দেখে ঠোঁট উল্টে বলে,,,
:- ভাভা গো ভাভা ফিরিত! ভালোবাসা যদি ওষুধ হত, তাহলে মনে হয় তুই একাই ICU চালিয়ে নিতে পারতি।
সায়ানের কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে তৈমুর। মুখে বলে,,
:-তোর জোকার গিরি শেষ হলে সার্জারিতে কনসেনট্রেট কর!
সায়ান মুখ বাঁকিয়ে এ্যানাস্থেসিয়ার ইনজেকশন হাতে তুলে নিলো।
************
রাত তখন গভীর।
ঘরের সব আলো নিভানো। শুধু বিলাসবহুল বাড়িটার স্টাডি রুমের জানলা দিয়ে ঢুকছে ফ্লাডলাইটের ম্লান আলো।
সৃষ্টি নীরবে পা ফেলে ঢুকে পড়লো তার বাবা এরশাদ হামিদের ঘরে। বুক ধুকপুক করছে উত্তেজনায়, তবুও তার চোখে ছিলো অদম্য দৃঢ়তা। আর দুদিন সে এই বাড়িতে আছে,এর মধ্যেই ওই ফাইলটা খুঁজে বের করতে হবে।
বেডরুমে বইয়ের শেলফ, ডেস্কের নিচে, আলমারির পেছনের গোপন স্লট সব জায়গায় খুঁজে ফেলল সে। কিন্তু কিছুই পেলো না। আলমারির একটা ড্রয়ার,বাঁদিকে নিচেরটা। শুধু এইটাতেই হাত দিতে পারলো না সৃষ্টি। ড্রয়ার টা লক,চাবিটা নেই।
সৃষ্টি দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো। বিরক্ত হয়ে পড়লো বেশ।
“যতসব ফাইলটা এই ড্রয়ারেই থাকবে বুঝি! এর চাবিটা নিশ্চয় বাবা সবসময় সাথে রাখে। এখন ওটাকে পাওয়া যায় কিভাবে?
মনে মনে প্ল্যান করতে লাগলো সৃষ্টি।
—
অন্যদিকে, শহরের ব্যস্ততম এক স্কাই-ভিউ বিল্ডিংয়ের ১৫ তলা বিল্ডিংয়ের অফিসে এরশাদ হামিদ বসে আছেন কালো একটা গদি আঁটা চেয়ারে হেলান দিয়ে। তাঁর চোখে কিছুটা চিন্তার ছায়া, তবে মুখে দম্ভ।
সামনে বসে আছে ভাই জাহাঙ্গীর কবির।
:-“আরও দুজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ভাইজান।চাপা গলায় বলল জাহাঙ্গীর,,,
:-রায়হান আর ইমতিয়াজ… দুজনেই নিখোঁজ। সন্ধ্যা থেকে ফোন বন্ধ। কালকে লাস্ট দেখা গিয়েছিল হাসপাতালে। দু’জনেই একসাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলো হসপিটাল থেকে। কিন্তু কেউই বাড়ি ফিরেনি।
এরশাদ ধীর পায়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
:-কে করছে এসব…?” তোর কাউকে সন্দেহ হয়?
জাহাঙ্গীর কবির ঢোক গিলে বললো,,
:-এতো বছর ধরে আমাদের এই কালোবাজারি ধান্দা চলে আসছে। আগে তো কখনো কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কোনো শালা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে কার নজর পড়লো আমাদের কালো কারবারের ওপর।
বেছে বেছে আমাদের ফিল্ডে কর্মরত লোকগুলোকেই তাদের টার্গেট বানাচ্ছে।
সবথেকে বড় কথা, তারা নিখোঁজ লোক গুলোর অর্গান বের করে জীবিত ছেড়ে দিচ্ছে। যেভাবে আমরা অর্গান চুরি করে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেভাবেই আমাদের কর্মীদের অর্গান কেউ বের করে নিচ্ছে। তারমানে সে নিশ্চয় আমাদের এই কাজ সম্পর্কে জানে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না সে কি নিজের ব্যবসার জন্য এটা করছে নাকি কোনো প্রতিশোধ!!
সমস্তটা শুনে এরশাদ গলা শক্ত করে বললো,,,
:-তুই চিন্তা করিস না জাহাঙ্গীর। আমি লোক লাগাচ্ছি। দেখি কে আমাদের পিছে কলকাটি নাড়ছে। তাকে খুঁজে বের করবোই। একবার যদি ধরি, তাহলে বুঝে যাবে এই এরশাদ হামিদ পিছে লাগা কতটা ভয়ংকর!”
জাহাঙ্গীর নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। তবুও সে টের পাচ্ছিলো চিন্তাই তার কপাল ঘেমে উঠেছে!
—
এদিকে নিজের বেডরুমে এক অন্য জগতে বিভোর সাবিকা। চারদিকে দেয়ালে তালহার অসংখ্য ছবি লাগিয়ে রেখেছে। ফেইরি লাইটে সেজিয়েছে সেসব।
আয়নার সামনে বসে চুলে ব্রাশ করতে করতে হঠাৎই একটা ছবি হাতে নিলো। তাতে তালহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলা একটা ছবি।
পাঠিকা স্মিত হেসে বলল,,
:-তালহা… আর ক’টা দিন… তারপর তুমি আমারই হবে। ওই রেশমি থাকবে না তোমার জীবনে। একমাত্র আমি, শুধুই আমি হবো তোমার জগৎ।” I love you Talha. I love you too much, without any limits….
বলেই সবিকা হাসতে লাগলো। সেই হাসিতে মিশে ছিলো শয়তানি, অন্ধ ভালোবাসা আর একপাক্ষিক দখলদার মনোভাবের পাগলাটে সংমিশ্রণ।
#চলবে