সারা জাহান পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
17

#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪৪
মৌমো তিতলী
❤️

সময়ের কালক্রমে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। হাসপাতালের জীবাণুমুক্ত ঝকঝকে মার্বেল বাঁধানো মেঝেতে সূর্যের আলোর প্রতিফলনে সারার সকাল শুরু হয় সাদা ফিনফিনে পর্দা ভেদ করা উষ্ণ আলোয়।
বাইরে হসপিটালের আঙিনায় শরৎ এর কাশফুল সাদা মাথা তুলে দুলে উঠছে হালকা বাতাসে, যেন প্রতিদিনের রোদে ভিজে নতুন করে বেঁচে উঠছে তারা। বিকেলের আকাশে ভেসে থাকে সোনালি রঙের মেঘ, যার ফাঁক দিয়ে আলোর ধারা নেমে আসে। যেন, স্বর্গ থেকে ঝরে পড়ছে আশির্বাদ।
দূরে তালগাছের মাথায় এক জোড়া শালিকের দম্পতি বসে, গোধূলির আলোয় তাদের ছায়া যেন চিত্রকরের আঁকা ছবি। সারা মাঝে মাঝে বারান্দার জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে, বাতাসে ভেসে আসা শুকনো পাতার নরম শব্দ শোনে।
দিনগুলো যেন ধীরে ধীরে শান্ত নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে।কোনো তাড়াহুড়ো নেই, শুধু এক গভীর প্রশান্তি।

সারা এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থ। শুধু পায়ের ফ্র্যাকচারটা এখনও পুরোপুরি সারেনি, এজন্য বেডরেস্টে থাকতে হবে আরো কিছু দিন।
প্রতিদিনের তুলনায় সারা আজ একটু বেশিই খুশি!! আজ তার ডিসচার্জ হওয়ার দিন। দীর্ঘদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে শিকদার হাউসের প্রতিটি কোনা কোনা মিস করেছে সারা। এতো দিন পর আজ সে বাড়িতে ফিরবে ভাবতেই খুশিতে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুড়তে ইচ্ছে করছে সারার।
হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর, সাইফ শিকদার আর তৈমুর একসাথে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

অন্যদিকে,
রিনা শিকদার আজ রান্নাঘরে ব্যস্ত। সারার পছন্দের সব খাবারের সুবাস গোটা বাড়ি ভরিয়ে তুলেছে। সিমা শিকদার, রেশমী ভাই ছোট্ট তন্ময় কে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে আছে সারার ফেরার অপেক্ষায়।

শিকদার হাউসের সদর দরজায় গাড়ি থামতেই, তৈমুর দরজা খুলে নেমে এলো। সারার পায়ে এখনো সাদা রঙের ব্যান্ডেজ জড়ানো। সারা কিছু বলার আগেই তৈমুর কোমল হাতে অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে তাকে কোলে তুলে নিলো। পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরে। সাইফ শিকদারের সামনেই কোলে তুলে নেয়াতে মুখে হালকা লজ্জার ছাপ পড়ে সারার, কিন্তু চোখে তৃপ্তির ঝিলিক।
তৈমুরের কাজে সাইফ শিকদার মৃদু হাসে। সে নীরবে ভেতরে প্রবেশ করলো দুজনের পেছন পেছন।

ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই রেশমী হাসিমুখে এগিয়ে এলো। সারার মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি দিলো রেশমী। তা দেখে সারা লজ্জা পেয়ে তৈমুমের গলায় মুখ লুকালো মুহুর্তেই।
তৈমুর সোজা তার নিজের রুমে গিয়ে সারাকে যত্ন করে বেডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। নরম কুশনগুলো ঠিক করে দিয়ে, গ্লাসে পানি নিয়ে খাইয়ে দিলো সারা কে।
কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,,,

:-একটু রেস্ট কর, আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় সারা।
তৈমুর ওয়াশরুমে চলে গেলে, রেশমী ছুটে এলো খুশিতে ভরপুর মুখ নিয়ে,,,

:-ইসস সারা বেবি! অবশেষে তুই ফিরলি রে! এতোদিনে আমার প্রাণটা একটু শান্তি পেলো। খুশিতে গদগদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো সারাকে।

রেশমীর কথায় খিলখিল করে হাসে সারা। দুজনে মিলে এতো দিনে জমে থাকা নানান গল্পে মশগুল হয়। কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে রিনা শিকদারের ডাকে নিচে চলে যায় রেশমী।

শাওয়ার শেষে তৈমুর সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজারে বেরিয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। চুলে এখনও পানির ফোঁটা বিদ্যামান, যা কপাল,গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। কপালের ওপর লেপ্টে আছে কিছু ভেজা চুল।
সারা তখন বেডে হেলান দিয়ে বসে, হাত দিয়ে চুলের একপাশ সরাচ্ছিল। তৈমুরকে দেখেই চোখ আটকে গেলো সারার। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো,লাজুক দৃষ্টিতে পিটপিট করে তাকালো তৈমুরের সৌষ্ঠব সুঠাম দেহের দিকে। নিয়মিত শরীরচর্চার দরুন শরীরের প্রতিটি মাসাল ফুলে ফুলে আছে। সেদিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে সারা।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নায় সারার ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো তৈমুর।

তোয়ালে টা পাশের ডিভানে ছুড়ে ফেলে তৈমুর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বিছানার একপাশে বসে পা উঠিয়ে। সারার কাছাকাছি আসতেই ধ্যান ভঙ্গ হয় সারার,, এতক্ষণ ধরে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে ছিলো, মনে হতেই গাল দুটো লাল হয়ে ওঠে সারার। নরম গলায় সুধায় তৈমুর,,,

:-কেমন লাগছে এখন?

সারা মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বললো,,

:-ভালো লাগছে ভীষণ… বাড়ির মতো আর কোথাও থাকতে এতো শান্তি লাগে না।”

তৈমুর এক মুহূর্ত চুপ করে সারার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আলতো করে সারার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।

:-তুই জানিস না, তুই না ফিরলে এই ঘরটা কত ফাঁকা লাগতো। যে কয়েকটা রাত তোকে হসপিটালে রেখে বাড়িতে ছিলাম , একটা রাতও আমার ঘুম হয়নি বিশ্বাস কর জান!

সারা চোখ নামিয়ে ফেললো, যেন তার বুকের ভিতরে এক সমুদ্র অনুভূতির ঢেউ লুকাতে চাইলো। তৈমুর হাতের আঙুল দিয়ে সারার চিবুক ছুঁয়ে বললো,,

:-এখন তো আর হাসপাতালের নার্স নেই… তোকে আমি নিজের মতো করে খুব যত্ন করবো!

সারা হালকা অবাক হয়ে বলে,,, “

:-আপনি কি এখন বাড়িতেও কড়া পাহারা দিবেন?

তৈমুরের ঠোঁটে ধূর্ত হাসি।

:-আমার ইচ্ছে মতো যত্ন করাটা তোর কাছে কড়া পাহারা মনে হয়?

তৈমুরের কথার টোনে ভ্যাবাচ্যাকা খায় সারা। মুহুর্তেই তৈমুরের কথার মানে বুঝতেই কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয় যেন! গাল দুটো রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় বর্ণ ধারণ করলো মুহুর্তেই। সারা তৈমুরের দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে বলে,,,

:-আপনি,, আপনি আমার এই অবস্থায়ও নির্লজ্জের মতো এসব বলছেন!

তৈমুর ঠোঁট চেপে হাসে। দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলে,,,

:-আমার তো আদর পাচ্ছে জান। তোকে আদর করার লোভ সামলাতে না পারলে আমি কি করবো বল? এখন শুধু আদর করবো জান, প্রমিজ! কিন্তু বেডরেস্ট শেষ হলে আর তুই ছাড় পাবি না মনে রাখিস!

কান দুটো ঝাঝা করে উঠলো সারার।
পাশ থেকে কুশন হাতে নিয়ে তৈমুরের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে,,,

:-আপনি একটা অসভ্য, নির্লজ্জ পুরুষ!

তৈমুর হাসতে হাসতে সারার হাত ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
তারপর কুশনগুলো ঠিক করে দিয়ে নিজেও সারার পাশে শুয়ে পড়লো। দুজনের ওপরে কম্বল টেনে দিয়ে আলতো করে সারার কোমর জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজে দিলো তৈমুর। আর মৃদু স্বরে বললো,,

:-চোখ বন্ধ কর জান… কতোদিন তোকে বুকে জড়িয়ে ঘুমায়নি। বুকটা শূন্য হয়ে পড়েছে ভীষণ। আজ তোর বুকে ঘুমাতে দে পাখি! আমার একটা শান্তিপূর্ণ ঘুমের বড্ড প্রয়োজন।

সারাও খেয়াল করেছে এই কয়দিন তৈমুরের ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিছুই হয়নি। তৈমুরের চোখদুটো রক্তিম অগ্নিশিখা হয়ে আছে যেন, সহস্র বর্ষ না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে। মায়া হয় সারার।
তৈমুর চোখ বন্ধ করতেই, মাথায় একরাশ চুলে আঙ্গুল চালিয়ে দিলো সারা। হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আলতো হাতে। তৈমুরের চোখে মুখে এমন এক প্রশান্তি নেমে এলো যেন বহুদিন পরে নিজের জগৎ ফিরে পেয়েছে সে।

********
দুপুরের দিকেই শিকদার হাউস যেন একটু বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। শিকদার হাউসের প্রত্যেকটা সদস্য আজ বাড়িতে লাঞ্চ করবে। সেখান থেকে বাদ পড়েনি সায়ান-তুলিও! এতোদিন পর সারা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছে আর একটা সেলিব্রেশন হবে না তাই কি হয়!!

রিনা শিকদার তৈমুরের রুমে ঢুকলো এক থালা গরম গরম খাবার হাতে।
ততক্ষণে তৈমুর ঘুম থেকে উঠেছে। টানা ঘুম দিয়ে উঠে বেশ ঝরঝরে লাগলো নিজেকে। সারাকে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে নিজেও ফ্রেশ হলো আর সারাকেও ফ্রেশ করিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে দিলো তৈমুর। দুজনে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সারাকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই রিনা শিকদার রুমে ঢুকলেন। সারাকে পরিপাটি দেখে একগাল হেসে বললেন,,,

:-এই নে মা, তোর পছন্দের মুরগির ঝোল আর গরম ভাত। আগে একটু খেয়ে নে দেখি। কতদিন একটু ভালো করে খাওয়াতে পারিনি বলে তো!
সারা হাসিমুখে তাকালো খালামনির দিকে। রিনা স্নেহভরা চোখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,,,

:-তোকে ছাড়া এই বাড়ি ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।

এরপর সাইফ শিকদার এলেন।সারার দিকে তাকিয়ে চোখে মমতা ফুটে উঠলো সাইফ শিকদারের চোখে।

:-হ্যাঁ তুই এখন থেকে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত শুধু বিশ্রাম নিবি, বাকিটা আমরা দেখবো।
সারা মাথা নাড়লো,এতো ভালো পরিবার পেয়ে সারার দুচোখ ভরে আসতে চায়। আপ্লুত নয়নে তাকিয়ে থাকে সকলের দিকে। এই পরিবারটাই যে তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। আর তৈমুর! তাকে ছাড়া তো সে শূন্য।

পেছন থেকে হাসিখুশি উজ্জ্বল মুখ নিয়ে তুলি আর রেশমী হাজির। রেশমীর হাতে ফলের বাটি।

রেশমী দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে,,,

:- আমাকে তোকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে তোলার দায়িত্ব দিয়েছে বড় আব্বু, এখন থেকে যা যা খেতে দেবো সব খাবি এই বলে রাখলাম।”
সারা হেসে ফেললো রেশমীর কথায়।

তুলি এসে বেডের পাশে বসে হাত ধরলো সারার,,

:-তুই যে বাড়িতে ফিরেছিস এটা যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।
সারা তার হাত চেপে ধরলো পরম আবেশে।
এমন সময় দরজার পাশে সায়ান দাঁড়িয়ে হালকা হেসে বললো,,

আরে বাহ!! ছোট্ট ভাবিকে দেখে এখন মনে হচ্ছে শিকদার হাউসের মহারানী !!
তৈমুর ভুরু কুঁচকে তাকালো সায়ানের দিকে,,,

:- আমার বউ অবশ্যই মহারানী। তুই বেশি কথা না বলে এখান থেকে বের হ।
আই এম চোখ বড় বড় করে বলল,,

:- এই মুহূর্তে আমি শুধু তোর বন্ধু না, এই বাড়ির জামাই। বুঝতে পারলি? এভাবে আমাকে ইনসাল্ট করতে পারিস না তুই!
তৈমুর মুখ বাঁকিয়ে বলল,,

:-ড্রামাবাজ একটা!

সবাই হেসে ফেললো তৈমুরের কথায়, ঘর ভরে গেলো সকলের হাসির উষ্ণতায়।

*********”*

প্রায় মধ্যরাত!

ধাতব যন্ত্রের তিক্ষ্ণ ক্যাড় ক্যাড় শব্দের সাথে বন্ধ হলো নেমেসিস সেলের বিশাল সিসার দরজাটা।

অন্ধকার ঘরের মাঝবরাবর শুধু ক্যান্টারি লাইটের টিমটিমে ম্লান হতে থাকা আলোর মাঝে, তৈমুর, রাফি, আবির আর সায়ান দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনেই হাত,পা,মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে দুটো দেহ!

তৈমুরের চোখ জ্বলছে হিংস্র বাঘের ন্যায়। তার নিষ্ঠুরতা আর কঠোরতায় ঘরের বাতাস জুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে আগুনের উত্তাপের লুহাওয়া। হুঙ্কার দিয়ে ওঠে তৈমুর,,,

:-এই নেমেসিস সেল আমাদের অস্ত্র। এখানে একবার যে সজ্ঞানে প্রবেশ করে তার আর দুনিয়ার আলো নসিব হয় না! তৈমুরের কণ্ঠে অমোঘ বীরত্ব।

রাফি ধীরে বলল,,

:-এই দুটোই রায়হান আর ইমতিয়াজ, এরাই অর্গান চক্রের ছোটখাটো হাতিয়ার।
এদেরকে টর্চার করলে কিছু তথ্য বের করা যেতে পারে।

আবির আর সায়ান মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
সামনে বন্দী অবস্থায় দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করে ইমতিয়াজ। কিন্তু মুখ থেকে উমম..উমম ছাড়া কিছুই বের হয়না।

তৈমুর এগিয়ে গেলো,,, ইমতিয়াজের মাথার চুল খামচে ধরে মুখটা উচু করে ধরে বললো,,,

:-তোদেরকে বাঁচিয়ে রাখার একটাই কারণ,কে আছে তোদের পেছনে? মেন কার্লপিটের নাম বলবি! নয়তো এখানেই জীবিত কবর দিয়ে দেবো। বুঝতে পারলি?

সায়ান এগিয়ে এসে বলল,,,

:- দোস্ত আমাদের লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শপিং মলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সেদিন যে অ্যাক্সিডেন্ট হলো সেই ট্রাকের চালক ছিলো এই ইমতিয়াজ। এই রায়হানও ছিলো সাথে।

তৈমুরের চোয়াল শক্ত হলো! রায়হানকে কে ইশারা করে কঠিন গলায় বললো,,

:- একে টর্চার সেলে নিয়ে যা রাফি! ইমতিয়াজ কে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেই একে টর্চার করবি। তাহলেই সত্য বের করতে হবে। ভয়ে ভয়ে হলেও ওদের মুখ থেকে বের হতে হবে আসল হোতাদের নাম।
রাফি তৈমুরের কথামতো সরঞ্জাম সাজিয়ে ফেললো।
ইমতিয়াজ চোখ বড়বড় করে ভয়ে চেয়ে থাকলো সেদিকে । অন্ধকারে শুধুই টর্চার যন্ত্রের ঠান্ডা ধাতব শব্দ ভেসে আসছে।

রায়হান কে টেনে তুলে বেঁধে ফেলা হলো একটা ধাতব পাটাতনের ওপর। রায়হানের কয়েকদিনের না খাওয়া দুর্বল দেহ কাঁপছে, চোখের পলকটা টেনে খোলার চেষ্টা করতেই অপারেশন থিয়েটারের মতো আলো দেখে আঁতকে উঠলো শব্দহীন আতঙ্কে।

রায়হানের মুখের কাপড় টা খুলে দিয়ে তৈমুর কণ্ঠস্বরের তীব্রতা বাড়িয়ে বললো,,

:-বল,কার কথামতো কাজ করিস তোরা? তোদের আদেশ দেয় কে? কারা এসব চালায়? বল?

রায়হান আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো,,,

:-জানি না….আমি কিচ্ছু জানি না!

ইমতিয়াজ মুখ বাঁধা অবস্থায় গোঙিয়ে কান্না করে উঠলো,,,
তৈমুর ইশারা করতেই আবির একটানে খুলে দিলো ইমতিয়াজের মুখ। খোলা পেতেই হড়বড়িয়ে বলতে লাগলো ছেলেটি,,,

:-ওরা আমাদের ফোনে আদেশ দিয়ে কাজ করায় স্যার … কিন্তু আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই…স্যার সত্যি বলছি স্যার!

তৈমুর এবার আর থামলো না। পাশের দেয়ালে সুইচ বোর্ডের লাল রঙের বোতাম চাপতেই পাটাতনের ওপর ভয়ংকর বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেলো,সাথে রায়হানের সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো এক অসহ্য অপার্থিব যন্ত্রণায়। থরথর করে কাঁপতে লাগলো পুরো শরীর। অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজ আসতে লাগলো রায়হানের মুখ থেকে। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন,সাথে বাড়তে লাগলো অস্বাভাবিক খিঁচুনি।
এই সিসার পাটাতন আসলে একটা বিদ্যুতায়িত আসন। এখানে অপরাধীদের ইলেকট্রিক শক দিয়ে টর্চার করা হয়।
কিছুক্ষণ পর তৈমুর লাল বোতাম থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সাথে সাথে খিঁচুনি বন্ধ হয়ে গেলো। রায়হানের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়লো গলা বেয়ে। অত্যাধিক দুর্বল শরীরে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ শক পেয়ে কথা বলার শক্তি অবশিষ্ট নেই আর। তৈমুর এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের মুখ চেপে ধরে বলে,,,

:-এখন বল, ওরা কারা যারা তোদের ফোনের মাধ্যমে কাজ করায়? কারা এই চক্রে জড়িত?”

ইমতিয়াজের মুখ থেকে শব্দ না আসলেও, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল বলে দিচ্ছিল অন্তরের সমস্ত ভয় আর আতঙ্ক।

ইমতিয়াজ কে এখনো পর্যন্ত তাদের নাম বলতে না দেখে রাগে ভয়ঙ্করভাবে মাথা দপদপ করছে তৈমুরের।দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে তৈমুর। আবিরকে ইশারা করতেই অচেতন প্রায় রায়হানের বাহুতে কিছু একটা ইনজেক্ট করে আবির। রাফি আর আবির রায়হানকে পাটাতন থেকে তুলে অপারেশনের টেবিলে শিফট করে। তারপর আবির হাতে গ্লাভস পরে নাইফ তুলে নেয়। খুবই সুক্ষ্ম দক্ষতার সাথে আবির রায়হানের পেট নাইফের এক টানে চিরে ফেললো। দুহাতে রায়হানের পেটের ভেতর থেকে এক এক করে কিডনি, লিভার, হার্ট বের করে রাফির হাতে বিদ্যামান ট্রেতে রাখতে লাগলো।

ইমতিয়াজ সজ্ঞানে স্বচক্ষে এই বিভৎস দৃশ্য দেখে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। গা গুলিয়ে আসতে লাগলো ইমতিয়াজের । যেন পেটের ভেতর থেকে সবকিছু উল্টে আসবে এখনই। অদ্ভুত গোঙানির মতো করে বমি করতে লাগলো ইমতিয়াজ।
তৈমুর ইমতিয়াজের গলা চেপে ধরে বললো,,,,

:-এবার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে কারা তোদের কে আদেশ দেয়! বল বল! নয়তো এবার রায়হানের জায়গায় তুই থাকবি। নিজের ভালো চাইলে মুখ খোল!

ইমতিয়াজ আতঙ্কে হড়বড়িয়ে বলে,,,

:-এরশাদ হামিদ আর জাহাঙ্গীর কবির আমাদের কে দিয়ে হসপিটাল থেকে বাচ্চা চুরি,আর অর্গান পাচারের কাজ করায়। ওনারা দুজনই এই চক্রের মুলে রয়েছে। আমাকে মাফ করে দিন স্যার। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে জানে মারবেন না স্যার! মাফ করে দিন।

তৈমুর বাঁকা হেসে বললো,,,

:-আর এক্সিডেন্ট! কার কথামতো এই এক্সিডেন্ট করিয়েছিলি বল? ইমতিয়াজের নাক বরাবর ঘুষি মারতে লাগলো তৈমুর। মুহুর্তেই ইমতিয়াজের নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো।

দুর্বল গলায় বললো,,,

:-স্যার এক্সিডেন্ট আমি মুকুলের কথায় করেছিলাম। তবে মারার কথা ছিল আপনার বোন রেশমি শিকদার কে। কিন্তু ভুল করে ওই মেয়েটা সামনে চলে আসে।

রেশমির নাম শুনে কপাল কুঁচকে গেলো তৈমুরের।

:- ফা*কিং বাস্টা*র্ড রেশমিকে কেন মারতে চাইছিস বল? আমার বোন তোদের কার কি ক্ষতি করেছে? কার কথায় ওকে মারতে চাইছিলি বল??

আবারো ঘুষি মারতে গেলে বলে ইমতিয়াজ,,,

:-স্যার স্যার এরশাদ স্যার মুকুল কে বলেছিলো আপনার বোনকে মার্ডার করতে। আপনার বোন নাকি ওনার ছোট মেয়ের পথের কাঁটা! এর বেশি আমি আর কিছু জানি না স্যার! স্যার খোদার কসম আমি আর কিছু জানি না।

তৈমুর রাফি কে কিছু ইশারা করতেই রাফি একটা ইনজেকশন হাতে এগিয়ে এলো। সেটা তৈমুরের হাতে তুলে দিতেই তৈমুর সেকেন্ডের মাঝেই ইমতিয়াজের ঘাড়ে পুশ করে দিলো ইনজেকশনের রক্ত লাল তরল টুকু। মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পড়লো ইমতিয়াজ।

ওকে ছুড়ে ফেলে তৈমুর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,,

:-দুঃখিত ব্রো! যার দুঃসাহস একবার আমার পরিবার আর আমার জান পাখিকে অতিক্রম করে ফেলেছে,তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

সায়ান এগিয়ে এসে ধীরে বলল,,,

:-এখন আমাদের মেন কাজ প্রমাণ খোঁজা, তথ্য সংগ্রহ করা, আর তাদের শিকল গোটানো।”

তৈমুর বাঁকা হেসে বললো,,,

:-No problem! I have a plan that will pull the herd out of the ditch !!

নেমেসিস সেলের অন্ধকার যেন আরও গভীর হয়ে এলো। তার মাঝে তৈমুরের চোখের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো,এক অন্ধকারে আলো ঝলকানিতে। তাদের চারজনের হৃদয়ে তখন দৃঢ় প্রত্যয়। তাদের হাতে এই অন্যায় চক্রের ওপর ন্যায়ের বিজয় হবে অবশ্যম্ভাবী।

#চলবে

#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪৫
মৌমো তিতলী
❤️

তৈমুর যখন শিকদার হাউসের ভারী গেট নিঃশব্দে পেরিয়ে এলো তখন ঘড়িতে প্রায় ৩:২০। নিস্তব্ধ করিডোর পেরিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলতেই টেবিলে ল্যাম্পের হালকা নিয়ন আলোয় চোখে পড়লো সারা বিছানায় গুটিসুটি মেরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। মেডিসিনের গভীর প্রভাবে সারার শ্বাসপ্রশ্বাস সমান তালে চলছে, যেন পরম নিশ্চিন্ত সে। এই পৃথিবীর কোনো ঝড়-ঝাপটা তার কাছে পৌঁছায়নি।

তৈমুর দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার জান পাখির দিকে। রাতভর সে কোথায় ছিলো, কী করেছে সবই সারার অজানায় থেকে গেলো।

তৈমুর ধীরে ধীরে ফ্রেশ হয়ে এসে নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আলতো হাতে সারাকে জড়িয়ে নিলো বুকের মাঝে। তৈমুরের উষ্ণতায় সারা যেন অজান্তেই আরও কাছে সরে এলো, বুকের ভেতর লেপ্টে ছোট্ট শিশুর মতো গুটিয়ে গেলো। ঠোঁট নেড়েচেড়ে আবারো তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে।

তৈমুর ঘোর লাগা চোখে কিছুক্ষণ সারার ঘুমন্ত শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, আঙুলে আলতো করে সরিয়ে দিল কপালের এলোমেলো চুলগুলো। তারপর চুলের ভাঁজে আলতো করে গভীর এক চুমু এঁকে দিলো। সারার ফোলা ফোলা অধরযুগলেও ছুঁয়ে দিলো পরম আবেশে। শেষমেশ সারাকে বুকের মাঝে লেপ্টে নিয়েই চোখ বন্ধ করলো তৈমুর— অন্তত চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার।

**********

সকালটা সেদিন অদ্ভুত নরম।ভোরের দিকে ঝমঝমিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। ভোরের বৃষ্টির জল এখনো বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলে আছে ছোট ছোট ফোঁটায় মুক্ত কণার মতো। ভেজা রাস্তায় প্রথম রিকশার ঘণ্টি বাজলো যেন অলস শহরটাকে জাগিয়ে দিতে। হালকা বাতাসে কাশফুলের মতো নরম মেঘ ভেসে আছে, মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে নরম রোদ্দুর মেঘের ফাঁক গলে কাঁচের জানালায় এসে পড়েছে। সেই আলো ঘরের ভেতর এসে একরকম ধূসর-সোনালি আবহ ছড়িয়ে দিয়েছে।

সায়ানের ঘুম ভাঙলো অচেনা এক শিহরণে। ঠান্ডা পানির ফোঁটার মতো কিছু একটা এসে তার গালে আছড়ে পড়তে লাগলো। আধো ঘুমে চোখ মেলে প্রথমে শুধু ঝাপসা আলো দেখতে পেলো, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো ছবিটা। তুলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। সাদা-আকাশি কটন কামিজ, ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল কাঁধ গড়িয়ে পড়ছে। হাতে নরম তোয়ালে, যা দিয়ে সে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুল মুছছে। প্রতিটা ঝাপটায় সূক্ষ্ম জলকণা বাতাসে উড়ে এসে সায়ানের মুখে পড়ছে।

তুলির ত্বক তখনও হালকা ভেজা, গালের দুপাশে ছোট ছোট জলফোঁটা রোদের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে। ভেজা চুলের ভাঁজে শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে আছে। চোখের কোণে হালকা জল, ঠোঁটের কোণে অচেতন এক শান্ত হাসি,যেন এই সকালের নিস্তব্ধতার সঙ্গে পুরোপুরি মিশে আছে সে।

সায়ান মোহগ্রস্তের মতো ধীরে ধীরে উঠে এসে পেছন থেকে তুলিকে জড়িয়ে ধরলো। তুলির শরীর হালকা কেঁপে উঠলো তাতে, নিঃশ্বাস যেন এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেলো তুলির।
সায়ান মুখ নামিয়ে তুলির ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে গভীরভাবে ঘ্রাণ নিলো। সেই ঘ্রাণে ছিলো ভোরের আর্দ্রতা, জল, আর এক অদ্ভুত উষ্ণতার মিশেল।

তুলির গলা দিয়ে আস্তে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো, হাতের তোয়ালে অর্ধেক নেমেএলো। সায়ানের হাত তার কোমরে, স্পর্শটা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠছে। চোখ বন্ধ করে সে অনুভব করলো সায়ানের বুকের ধুকপুক আর নিজের ভেতরের কেমন এক অস্থিরতা, যা শব্দে বোঝানো যাবে না।

সায়ানের ছোঁয়া গভীর হতেই তুলি সায়ানের হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিলো! অনুভূতির জোয়ারে শ্বাস দ্রুত ছুটছে দু’জনের। তুলি অস্ফুট স্বরে বলে,,,

:-কি করেছো সায়ান! শাওয়ার নিয়ে এলাম তো!

:-উমমম আর একবার নিও নাহয়! So what?

:- ভার্সিটিতে ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে ভুলে গেলে? লেইট হয়ে যাবে তো!

সায়ান ফুসস করে দম ছাড়লো! নিজের আকাঙ্ক্ষায় গুল্লি মেরে তুলিকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,,,

:-Did you take a painkiller বেইবি?

তুলি ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বললো,,,

:-No need.

তুলির উত্তরে অবাক হয়ে তাকালো সায়ান। দুষ্টু হেসে বললো,,,

:-You have gained the strength to tolerate me!! I am impressed…!!!😜

তুলি লজ্জায় দুহাতে সায়ান কে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো! কিন্তু সায়ান কে একবিন্দুও সরাতে পারলো না। উল্টো সায়ান তুলির ঠোঁটের দিকে এগোতে নিলো,

ঠিক তখনই নিচ থেকে তারা ফুফুর কর্কশ ডাক ভেসে এলো

:-সায়ান বাবা নাস্তা রেডি! বউমা রে নিয়া আইয়া পড়ো!

তুলি এক ঝটকায় সামলে নিলো নিজেকে, চোখ নামিয়ে পাশে সরে দাঁড়ালো। গালে হালকা লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে তুলির। সায়ান এক চিলতে দুষ্টু হাসি দিয়ে তাকালো তার দিকে, তারপর ধীর ভঙ্গিতে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল শাওয়ার নিতে।

তুলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলো। চোখে এখনো সেই অস্থিরতা, ঠোঁটে এক অসমাপ্ত অনুভূতির রেখা। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সে জানালার দিকে তাকালো। আকাশে তখনো ভেসে আছে ধূসর রঙা মেঘ।

______________

আজকের দুপুরটা যেন ভাঁপ ওঠা কড়াই।
ভোরের বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তাগুলো রোদের তাপে শুকিয়ে ধূসর হয়ে গেছে, কিন্তু বাতাসে এখনো গরম বাষ্পের মতো আর্দ্রতা ভাসছে। দূরের পিচঢালা রাস্তা সূর্যের আলোয় যেন গলতে বসেছে, গাছের পাতাগুলো নুইয়ে পড়েছে তাপের চাপে।

ক্যাম্পাসের লনে তাপের ঝাপটা পড়ছে বিস্তর, কিন্তু তার মাঝেই আড্ডা জমে উঠেছে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মাঝে।
রেশমী, সালমা, নিশি, রাতুল আর নিরব সবাই মিলে অফ পিরিয়ডে ছায়াময় একটা জায়গায় বসে গল্প করছে। কারও হাতে ঠান্ডা ড্রিঙ্কস, কারও হাতে আংশিক গলে যাওয়া আইসক্রিম।

গল্পের মাঝেই ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়র ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালো রেশমীর সামনে।

:-আপু, তালহা এহমাদ স্যার আপনাকে তার কেবিনে ডাকছেন।”

ছেলেটার কথা শুনতেই সালমা মুখ চেপে হেসে ফেললো,,,

:-ওহহো… স্যার ডাকছেন বুঝি! তালহা স্যার ম্যাথ ছেড়ে ফিজিক্স ক্লাস কবে থেকে শুরু করলেন ,নাকি!”

নিশি চশমাটা নাকে ঠেকিয়ে বললো,,,

“যাও যাও, আমরা কিছু বলবো না, আমরা কেউ কিছু দেখিনি।

রাতুল আর নিরবও খুনসুটি শুরু করতে লাগলো,,,

:- এই তোরা এসব ফালতু কথা বাদ দিবি? রেশমীর তো স্যারের সাথে ইম্পর্ট্যান্ট স্টাডি ডিসকাশন আছে , তাই না বল রেশু?

নিরব খিক খিক করে হেসে বলে,,

:-ভরদুপুরে, অফ পিরিয়ডে, দরজা বন্ধ করে স্টাডি ডিসকাশন! এটা শুধু কি তোর জন্যেই প্রযোজ্য রেশমী চুড়ি?

রেশমী লজ্জায় কান ঝা ঝা করে উঠলো। , রাতুলের পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে বললো,,,

:-তোমাদের মাথায় কি শুধু বাজে চিন্তা ঘোরে?

রাতুল ন্যাকামো করে চিৎকার করে উঠলো,,,

:-রেশমী চুড়ির বাচ্চা! তোকে কি আমি একা বলেছি! আমাকে একা মারলি কেন? ওদেরও মার!

রেশমী ওদের দিকে চোখ রাঙিয়ে,,বন্ধুদের দুষ্টু চোখ এড়িয়ে সে ধীরে ধীরে তালহার কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো,,,

কেবিনের দরজায় হালকা নক করতেই ভেতর থেকে তালহার কণ্ঠ ভেসে এলো

:-Come in.”

রেশমী ধীর পায়ে কেবিনে ঢুকতেই তালহার চোখে যেন শীতলতায় ছেঁয়ে গেলো। তালহা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে দরজাটা ভেজিয়ে দিলো, পরের মুহূর্তে কোনো কথা না বলে, হঠাৎই রেশমীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

তার বুকের ধুকপুকানি স্পষ্ট অনুভব করলো রেশমী।যেন কয়েকদিনের অপেক্ষা একসাথে বিস্ফোরিত হলো।

:- you don’t know Roshi, এই ক’দিন তোমাকে না দেখে আমি কেমন অস্থির ছিলাম…” তালহার গলা ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো।

রেশমীও চুপচাপ হাত রাখলো তালহার পিঠে, বুকের ভেতর অজানা ঢেউ খেলে গেলো। বাইরে দুপুরের তাপ, কিন্তু কেবিনের ভেতর যেন আলাদা এক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে।

তালহা আস্তে তার চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,,,

:-আজ ভার্সিটিতে তোমাকে এভাবে ডাকবো কি না ভাবছিলাম,,এটা ঠিক হবে কিনা দোটানায় ছিলাম… তারপর বুঝলাম আমি আর পারবো না। তোমাকে না দেখে আমি পাগল হয়ে যায় রোশী। I need you, Roshi. Please be mine soon…

রেশমী হেসে মৃদু স্বরে বললো,,,

:- স্যার সবাই দেখবে…কি করছেন!

তালহা ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে ফিসফিস করলো,,,

:-দেখুক না, আমি তো আর লুকিয়ে রাখতে পারবো না যে তুমি আমার।”

তাদের চোখে তখন এমন এক গভীরতা, যা কোনো দুপুরের তাপকেও হার মানায়। রেশমী ঠোঁট কামড়ে হেসে আরেকটু খিচে জড়িয়ে ধরলো তালহা কে।

***********

সৃষ্টি নিঃশব্দে আলমারির দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করলো। তার হাতে বেগুনী রঙের একটা ফাইল। কয়েকদিনের প্ল্যানের পর ফাইলটা হাত করতে সক্ষম হয়েছে সৃষ্টি।
রাতের খাবারের সাথে মিশিয়ে দেওয়া স্লিপিং পিলগুলো সাবিকা আর বাবার ওপরে বেশ কব্জা করে নিয়েছে। এজন্যই তো নিরাপদে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছে সৃষ্টি।
নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে সৃষ্টির মনটা গুমোট হয়ে আছে,, কিন্তু চোখের মাঝে ঝলমল করছে এক আশার ঝলমলে আলো।

নিঃশব্দে চাবিটা লক থেকে বের করলো সে,বাবার আলমারির সিক্রেট ড্রয়ারের চাবি।
উত্তেজনায় হৃদয়ের গতি বাড়ছে, হাত কাঁপছে, কিন্তু ভেতরের জোর বলছে, “এই ফাইলটাই তোর সত্যে উন্মোচনের চাবিকাঠি।”
নিজেকে সামলে আবার লক করলো ড্রয়ার টা।

সৃষ্টি চাবিটা সতর্কতার সাথে যথাস্থানে রেখে আস্তে আস্তে দরজা খুলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

বিড়াল পায়ে নিজের রুমে ফিরে এসেই দরজা আটকে দিলো সৃষ্টি। মেঝেতে বসেই সাথে সাথে ফাইল খুলে পড়তে শুরু করল সৃষ্টি।
প্রত্যেকটা পাতা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার আর চাচার কালো অপকর্মের এক একটা পারচি।
অর্গান চুরির ডকুমেন্ট, পথশিশু পাচারের লুকানো নথি, সেনাবাহিনীতে পৈশাচিক করাপশন, আর মায়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট —
যেখানে লেখা, “ধর্ষণ ও শ্বাসরোধে হত্যা”।
সাথে একটা গোপন পেন ড্রাইভও পেলো।

সৃষ্টির বুক ভেঙে এলো, দুচোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুর ঝরনা।
“কিভাবে… কিভাবে বাবা আর চাচু এটা করলো?”
আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা কষ্ট আর ক্রোধ একসাথে মিশে গলদঘোঁটানো কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।

এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ভেসে উঠল আলভীর মুখটা, মায়ার কান্না,সেই শুদ্ধ ভালোবাসার ওপরে এক অন্ধকার অমাবস্যা হয়ে এসেছে সৃষ্টি। নিজের প্রতি ভীষণ ঘৃণা হলো সৃষ্টির।
কীভাবে তার বিয়ের খুশিতে মায়ার প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো!
সৃষ্টি নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না সৃষ্টি, চিৎকার করবার মতো বেদনা মগজে বাজতে লাগলো হাতুড়ির মতো।

বিছানায় ঘুমন্ত মহিদ ঘুমের মাঝেই হাতড়ে মা কে খুঁজলো। সৃষ্টির ছোঁয়া না পেয়ে অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠলো মহিদ। সৃষ্টি উঠে এলো বিছানায়। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মহিদের ঘুমন্ত মুখটা দেখে সৃষ্টি মনে মনে ভাবলো,,
“মহিদের জন্য হলেও সে তাঁদের জীবনের সমস্ত বোঝা একাই বহন করবে।”
সৃষ্টির হাত ছুঁয়ে দিলো মহিদের ছোট্ট মাথাটা, মন গর্জন করল,
“আমাকে ন্যায়ের জন্য লড়াই করতেই হবে… সবার জন্য ন্যায় পেতে হবে।”

একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে, সৃষ্টি সিদ্ধান্ত নিয়ে বললো,,

:-তৈমুর শিকদারের কাছে আমি যাবো। তৈমুর শিকদার ছাড়া আর কেউ আমার বাবার অন্ধকার চেহারা সামনে আনতে পারবে না।
ফাইলটা তার হাতেই তুলে দেবো… ন্যায় বিচার শুরু হবে সেখান থেকেই।”

আঁধারের মাঝে, সেই একাকী রুমের কোণে সৃষ্টির চোখে অশ্রুর মাঝেই ঝলকালো এক দীপ্তি।
একজন বিদ্রোহী নারীর, যে আজ থেকে নিজেই আলোর পথে হাঁটবে।

#চলবে

#সারা_জাহান
পর্ব ,,,,,৪৬
মৌমো তিতলী
❤️

ঘুম ভাঙতেই এরশাদ হামিদের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে গেলো। মাথাটা কেমন অদ্ভুত ভারী, চোখটাও একটু ঘোলাটে লাগছে। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে “ন” টা।
একটু অদ্ভুত লাগলো ব্যাপার টা এরশাদ হামিদের কাছে। তার জীবদ্দশায় কখনো এমন বেলা পর্যন্ত ঘুমানো হয়েছে বলে মনে পড়লো না। একসময় সেনাবাহিনীর একজন হওয়াতে রিটায়ার্ড হওয়ার পরেও বর্তমান লাইফ স্টাইলে সেই ডিসিপ্লিন মোতাবেকই চলা অভ্যাস রয়ে গেছে এরশাদ হামিদের। বিছানা থেকে নেমে হাতের আঙ্গুলে চোখ ডলে নিলেন তিনি। ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এসে হাঁক ছেড়ে মেইড শেফালী কে ডেকে কফি দিতে বললেন।

অফিসের কাজের ফাইল নিতে আলমারির চাবি নিতে গিয়ে বালিশের কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ালেন। চাবির অবস্থান যেন একটু এলোমেলো…
হালকা এক অস্বাভাবিকতা টের পেলেন তিনি। তাড়াহুড়ো চাবির গোছা টা নিয়ে আলমারির সিক্রেট ড্রয়ার খুলে ফাইলের মাঝে চোখ বুলাতেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো তার।
বেগুনি রঙের ফাইলটা গায়েব!

ত্রয়ী পদক্ষেপে পাশের রুমে গিয়ে দেখলেন সাবিকা তখনো গভীর ঘুমে, এমনকি ডাকার পরও ঠিকমতো সাড়া দিলোনা সাবিকা।

কপাল কুঁচকে এলো এরশাদের।

:-এই মেয়ের কি হলো? এত ঘুমাচ্ছে কেন? মনে মনে বিরক্তি নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলেন তিনি।

এরশাদের চোখ সরু হয়ে এলো। ঠান্ডা অথচ ধারালো দৃষ্টিতে চারপাশ তাকালো, যেন প্রতিটা কোণায় অপরাধীর ছায়া খুঁজছে তার ধূর্ত চোখজোড়া।

মাথায় বজ্রপাতের মতো চিন্তা এলো,,
“বাড়িতে তো আমি, সাবিকা আর সৃষ্টি ছাড়া কেউ ছিলো না…রাতে চোরিছুপে কেউ ঢুকেছিলো নাকি!

মেইড কফি দিতে এলে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলেন,,,

:-তোর বড় ম্যাডাম এখনো ঘুমাচ্ছে নাকি! এতো বেলা হয়ে গেলো আমাকে ডাকলো না যে!

মেইড শেফালী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,,,

:-জ্বী স্যার বড় ম্যাডাম তো বাড়িতে নেই!

কপাল কুঁচকে তাকালেন এরশাদ হামিদ।

:-নেই মানে! এতো সকালে কোথায় গেছে সে?

:-জ্বী স্যার তা তো জানিনা। উনি যাওয়ার আগে বললেন আপনাদের ঘুম না ভাঙ্গলে যেন না ডাকি। বললেন ওনার কোন একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে। মহিদ কে স্কুলে দিয়ে উনি বাড়িতে ফিরে যাবেন বললেন।

পুরো ব্যাপারটা শুনে কেমন সন্দেহজনক মনে হলো এরশাদের কাছে।
তিনি দ্রুত বাসার সিসি ক্যামেরা গুলো চেইক করতে লাগলেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন। রাতের ফুটেজ গুলো গায়েব। মানে সারা রাত ক্যামেরা বন্ধ করা ছিলো!
সন্ধ্যার দিকের ফুটেজ চেইক করতে গিয়ে তিনি অদ্ভুত এক জিনিস দেখে থমকে গেলেন। তা হলো, সৃষ্টি লুকিয়ে খাবারের সাথে কিছু মেশাচ্ছে। মুহুর্তেই ধূর্ত নেকড়ের মতো মস্তিষ্কে আজকের অস্বাভাবিক ঘুমের কারনটা ধরতে পারলেন তিনি।
দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করলেন এরশাদ হামিদ,,,

:-ধুরন্ধর মেয়ে… আমার চোখের সামনে দিয়ে খেলাটা খেলতে গিয়ে একবারও ভাবলে না, এইসব ছলচাতুরি আর কপটতায় হাম তুমহারা বাপ লাগতে হ্যাঁয়!
এরশাদের ঠোঁটের কোণে হালকা শয়তানি হাসি ফুটলো!

এরশাদ ফোনটা হাতে নিয়ে কল লাগালেন মুকুল কে। ফোন রিসিভ হতেই বললেন,,,

:-তুই যেখানেই থাকিস, এই মুহূর্তে এক কাজ কর…আমার বড় মেয়ে সৃষ্টির বাড়িতে যা। তাকে পেলে বলবি আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই। এখনই।”

মুকুল কণ্ঠ নিচু করে জিজ্ঞেস করলো,,

:-স্যার… কিসের ব্যাপারে?”

এরশাদের কণ্ঠে হুমকির মতো ঠান্ডা স্বর গরগর করে উঠলো,,

:-কারণ জানার দরকার নেই তোর। শুধু ওকে বল গিয়ে…ধীর স্বরে বললেন,, না আসতে চাইলে বলবি,বাবার ডাক এড়িয়ে যাওয়া ওর জন্য ভালো হবে না।”প্রয়োজন হলে জোর করে তুলে নিয়ে আসবি। বিশেষ করে ওর হাতে কোনো ফাইল পেলে সেটা আগে নিবি।

কল কেটে দিয়ে এরশাদ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের ভেতরে তখন এমন এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন শিকারী তার শিকারকে ফাঁদে ফেলার আগে শেষবার মাপজোক করে নিচ্ছে।

***********

আজকের সকালটা ছিলো আর্দ্র আর ধোঁয়াটে। এ যেন শীতের আগমনীর সুর।
শিকদার হাউসের গার্ডেনে তৈমুরের মুখে আজ অস্বাভাবিক গম্ভীর ভাব। রাতের মিশনের পর রাফি ও আবির এমন কিছু তথ্য এনেছে যা পাচার চক্রের শিকড় উন্মোচনে সাহায্য করতে পারে।
পাশেই সায়ান তার সহজাত স্বভাবে ঠাট্টা করছিলো, ঠিক তখনই তৈমুরের ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক অচেনা নম্বর। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা নারী কন্ঠ ভেসে এলো।

সৃষ্টির গলায় আজ উদ্বেগের কম্পন, কিন্তু দৃঢ়তাও স্পষ্ট। সৃষ্টি জানে না আজকের পর তার সাথে কি হতে চলেছে। সেই যে ফাইলটা সরিয়েছে সেটা তার বাবার বুঝতে বেশি সময় লাগবে না সেটা সৃষ্টি ভালো করেই জানে। তবুও ভয় পেলে চলবে না। একবার যখন সে এপথে এগিয়েছে, শেষ না দেখে সে পিছু হটবে না। কিছুতেই না!

সৃষ্টি নিজেকে সামলে গলা পরিষ্কার করে বললো,,,

:- ডঃ তৈমুর জাহান বলেছেন?

:-জ্বী বলছি। আপনি কে?

:-ভাইয়া আমি সৃষ্টি। আমি আপনার ফ্রেন্ড আলভী এহমাদের ওয়াইফ বলছি। আপনি চিনবেন হয়তো আমাকে…আপনার বোনের বিয়েতে দেখা হয়েছিলো আপনার সাথে।

ভ্রু কুঁচকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তৈমুর। সায়ানও তৈমুরের হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাকিয়ে রইলো!

:-জ্বী ভাবী! চিনতে পেরেছি। হঠাৎ ফোন করলেন,,সব ঠিক আছে তো!

:-জানি না ভাইয়া। কিছুই ঠিক আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।

:-কি বলতে চাইছেন ভাবী! আলভীর কিছু….

:-জ্বী না ভাইয়া। আলভী ঠিক আছে। আসলে আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিলো। আমি আপনাকে একটা ইম্পোর্টেন্ট জিনিস দিতে চাই। একা কোথাও দেখা করতে পারবেন?”
তৈমুর থেমে এক মুহূর্ত ভাবলো, তারপর সংক্ষিপ্ত উত্তর

:-ঠিক আছে আপনি আপনার লোকেশন পাঠান! আমি আসছি।

অন্যদিকে…

এরশাদ হামিদের নির্দেশে মুকুল মোটরবাইক ছুটিয়ে চলছে। তার কানে তখনও বাজছে এরশাদ হামিদের বজ্রকণ্ঠ,,,

:-ওকে ধরে আনো। যেভাবেই হোক।”

মুকুল জানে, এই কাজে জন্য তার বেশি সময় লাগবে না। সৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনা তার জন্য কঠিন নয়।

কিন্তু সৃষ্টি বাড়ির সামনে আসতেই মুকুল দেখতে পেলো সৃষ্টি তাড়াহুড়ো করে একটা রিকশায় উঠে বসেছে। সৃষ্টি চড়ে বসতেই রিকশাটা দ্রুত চলতে শুরু করলো। মুহুর্তেই রিকশাটা সামনের মোড় ঘুরে গেলো, মুকুলও বাইকের গতি বাড়িয়ে পিছু নিলো।

সৃষ্টি দুহাতে একটা ব্যাগ আঁকড়ে ধরে আছে। হাতে ধরা ব্যাগের ভেতরে কী আছে জানে না মুকুল । কিন্তু এরশাদের সুরে বোঝা গেছে বিষয়টা গুরুতর।

সৃষ্টি গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই রিকশার সামনে একটা বাইক এসে দাঁড়ালো। বাইকে বসা মুকুল কে দেখে তাৎক্ষনিক চিনতে পারলো না সৃষ্টি। মুকুলের মাথায় হেলমেট। তারওপর সৃষ্টি মুকুল কে শুধু একবারই দেখেছে, সেদিন তাদের বাড়িতে। এইজন্য হেলমেট পরা অবস্থায় দেখে চিনতে পারলো না সে।

মুকুল বাইক থেকে নেমে সৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলো। রিকশার হুড ধরে বললো,,,

:- ম্যাডাম এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় চললেন! আপনার বাবা যে ডাকছেন আপনাকে। এখনই আমার সাথে চলুন।

সৃষ্টি ব্যাগটা আরেকটু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,,,

:-আমি এখন যাবো না, আমার একটা কাজ আছে। আপনি প্লিজ রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান। বাবাকে বলবেন পরে দেখা করে নেবো।

মুকুল বাঁকা হেসে বললো,,,

:-তা বললে কি করে হয় ম্যাডাম! আপনার বাবা ডেকেছেন,সেটা শোনার থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট আর কি কাজ আছে আপনার? চলুন!

বলেই মুকুল হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা ধরতে গেলো, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সামনে একটা গাড়ি স্বজোরে ব্রেক কষার শব্দে যেন বজ্রপাত ঘটলো।
গাড়ির ধোঁয়ায় ঢেকে গেলো জায়গাটা। সৃষ্টি, মুকুল এমনকি রিকশা চালকও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
মুহুর্তেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সুঠাম দীর্ঘদেহী এক অবয়ব।
আগন্তুক রিকশার কাছে গিয়ে মুকুলের হাতের কবজি এমনভাবে চেপে ধরলো যে, মুকুলের হাতের প্রতিটি হাড়ে চাপা ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো।

চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকাতেই মুকুলের বুকের ভেতর আচমকা কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদন্ড বেয়ে। যেন হঠাৎ কেউ তার পিঠে বরফ ঢেলে দিয়েছে। মুকুলের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,,,

তৈমুর জাহান শিকদার…!
নামটা মনে আসতেই কপালে ঘাম ছুটে গেলো মুকুলের।

সে জানে, এই মানুষটার সামনে দাঁড়ানো মানে হলো সাক্ষাৎ মৃত্যু। শিকারীর চোখে নিজেই শিকার হয়ে যাওয়া।
তৈমুরের হাতের শক্তি, দৃষ্টি, আর নীরব হুমকিতে মুকুলের চোখ সরাসরি তার চোখে আটকে গেল তৈমুরের বাজ পাখির ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে।

তৈমুরের দৃষ্টি শীতল, তীক্ষ্ণ, আর সম্পূর্ণ নির্দয়। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বললো,,,

:-এখন কে বাঁচাবে তোকে?” তৈমুরের কণ্ঠে কোনো উচ্চতা নেই, তবু শব্দগুলো যেন ছুরির ফলা হয়ে ঢুকলো মুকুলের কানে।
মুকুলের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো, জিভ শুকিয়ে ঠোঁটে আটকে গেলো। পেটে যেন এক অদৃশ্য চাপ অনুভব করলো সে। শ্বাস নিতেও এখন কষ্ট হচ্ছে। কোন কুক্ষনে যে সে এখানে আসতে গেলো!
সে মুখ খুলে কিছু বলার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে নেমে এলো সায়ান। মুকুলের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তারপর হুট করে মুকুলের মাথা থেকে হেলমেট টা খুলে নিয়ে খিক খিক করে হেসে বললো,,,

:-আরেব্বাসস! দেখ, তৈমুর ,রাফি, আবির!! শিকারী খুদ ইহা শিকার হো গ্যায়া!! তা চান্দু কোন চিপায় চুমাচুমি করছিলে এদ্দিন?? প্রচুর হাওয়া খেয়ে নিয়েছো চান্দু! এবার একটু ক্ষ্যামা দেও!!

সেই মুহূর্তেই মুকুলের পকেটে ফোন বেজে উঠলো। রাফি এগিয়ে এসে মুকুলের পকেট থেকে ফোন টেনে বের করে নিলো। স্ক্রিনে কল ভাসছে—Ershad Sir…

তৈমুরের ঠোঁটে খুব হালকা এক হাসি ফুটলো। কিন্তু সেই হাসি এতটাই ঠান্ডা যে মুকুলের মেরুদণ্ড বেয়ে কাঁপুনি নেমে এলো।

রাফি দাঁত বের করে বললো,,,

:-যাক! আজকের দিনটা বৃথা গেলো না…শিকারকে নিজেই শিকারীর ফাঁদে পা দিয়েছে। There’s nothing left to do now!!

মুকুল আর কিছু বলার আগেই তৈমুরের ইশারায় রাফি আর সায়ান তাকে ধরে হাত পা বেঁধে মুখে কসটেপ এঁটে দিয়ে গাড়ির পেছনে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলো। ড্রাইভিং সিটে আবির। রাফি গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি শহরের ভিড় পেরিয়ে গতি বাড়ালো এক জঙ্গলে ঘেরা নির্জন রাস্তায়। মুকুল বুঝতে পারলো না তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার সমস্ত অস্তিত্ব টের পাচ্ছে,এরশাদের ভয়ংকর দুনিয়ার থেকেও ভয়াবহ জায়গায় সে আটকা পড়তে চলেছে সে। বা হয়তো এতক্ষণে আটকেও পড়েছে!

________________

রেস্টুরেন্টটা শহরের ব্যস্ততা থেকে অনেকটা দূরে, রাস্তার ধারে পুরনো কাঠের কারুকাজে সাজানো ছিমছাম নিরিবিলি একটা রেস্টুরেন্ট। বাইরে ঝুলছে কিছু রঙিন লণ্ঠন। জানালার ওপারে ঘন সবুজ গাছপালা, মাঝে মাঝে হাওয়ায় পাতার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
কর্মচারীরা খুবই নীরবে কাজ করছে—কেউ টেবিলে গ্লাস সাজাচ্ছে, কেউ ধীরে ধীরে কফি পরিবেশন করছে, যেন রেস্টুরেন্টের নির্জনতা ভেঙে না যায়।

তৈমুর আর সৃষ্টি কোণের একটা টেবিলে বসে আছে, সামনাসামনি । সৃষ্টির সামনে ঠান্ডা পানি রাখা। তৈমুর পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে বললো,,,

:-আগে পানিটা খান, ভাবী।

সৃষ্টি কাঁপা হাতে গ্লাসটা তুলে নিলো, ঠোঁটে ঠান্ডা পানির স্পর্শে কিছুটা শান্তি পেলো। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেললো, তারপর চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো।

তৈমুর সরাসরি তার দিকে তাকালো এবার।

:-এখন বলুন, ঘটনা কি? আর কি জিনিস দেয়ার কথা বলছিলেন?

সৃষ্টি ব্যাগ খুলে ধীরে ধীরে বেগুনি রঙের ফাইলটা বের করলো। নিঃশব্দে সেটা তৈমুরের সামনে ঠেলে দিলো।

তৈমুর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি রেখেই হাত বাড়িয়ে ফাইলটা টেনে নিলো। প্রতিটি পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে তৈমুরের দৃষ্টি বদলে গেলো মুহুর্তেই।
প্রথমে অবাক, তারপর ক্রমশ তীক্ষ্ণ, শেষে ঠান্ডা রাগে জমাট বাঁধলো মস্তিষ্ক।
এরশাদ হামিদ আর তার ভাই জাহাঙ্গীর কবিরের কালো কারবার ফুল প্রুফড্ প্রমাণ। অবৈধ অঙ্গ পাচার, বাচ্চা চুরি,নারী পাচার আর মোটা অঙ্কের সব করাপশনের লুকানো প্রমাণ। সাথে মায়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। রিপোর্ট টা পড়ে তৈমুরের চোখদুটো রক্ত জবার ন্যায় রক্তবর্ণ ধারণ করলো। ধর্ষণ করার পর খুন করা হয়েছে নিষ্পাপ ফুলের মতো মেয়েটাকে। মায়ার মিষ্টি হাসিমুখটা তৈমুরের চোখে ভেসে উঠলো,সবকিছু যেন কালকের ঘটনা, এতোটা স্পষ্ট।

তৈমুরের আঙুল ধীরে ধীরে টেবিলের উপর মৃদু আন্দোলন তুলে নাচতে লাগলো, যেন ভেতরের উত্তাল বিস্ফোরণ সামলাচ্ছে। শিরার ধমনী শক্ত হয়ে উঠেছে, চোয়াল কেঁপে উঠছে, চোখে ভয়ংকর নীরব আগুন জ্বলছে যেন যে কোনো মুহূর্তে সামনে পেলে ছিঁড়ে ফেলবে সেই দুজনকে।

হঠাৎ তৈমুরের দৃষ্টি সৃষ্টির দিকে গেলো। সৃষ্টি মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখদুটো ভিজে উঠেছে এই মুহূর্তে। তৈমুর গলা পরিষ্কার করে নিজের ভেতরের তাণ্ডব চাপা দিলো,,,

:-ভাবী, আপনি জানেন না, ঠিক কি উপকার করলেন আপনি। কিন্তু এরপর আপনার জীবন খুব সংকটে পড়বে তা জানেন? আলভী জানে এসব কিছু?

সৃষ্টি হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো,, অর্থাৎ আলভী কিছুই জানে না। বললো,,,

:-ভাইয়া, এই কাজটার জন্য এখন যদি আমি আমার পাপী বাবার হাতে মরেও যাই, তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি চাই আপনি এই অন্যায়ের ন্যায় বিচার করুন। আমি…..

ঠিক তখনই সৃষ্টির ফোন কাঁপতে শুরু করলো। স্ক্রিনে অতি পরিচিত নম্বর। তৈমুরের দিকে তাকালে তৈমুর ইশারা করে বললো ফোন রিসিভ করতে।
সৃষ্টি কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে এরশাদ হামিদের কর্কশ স্বর ভেসে এলো,,,

:- সৃষ্টি! আমার আম্মা! যে দুঃসাহস দেখিয়ে ফাইলটা নিয়ে গেছো! সেটা ফেরত না দিলে যে, তোমার ছেলে মহিদকে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না মা!

সৃষ্টি যেন মুহূর্তেই বরফ হয়ে গেল। শরীর টা কেঁপে উঠলো অজানা এক আতঙ্কে। গলায় কেঁপে উঠলো সৃষ্টির,,,

:-কি বলছো বাবা! আমার ছেলে…আমার মহিদ কোথায়? কি করেছো ওর সাথে?

:-আহা! এতো হাইপার হচ্ছো কেনো আম্মা! আমার নাতীকে শুধু স্কুল থেকে নিয়ে এসেছি। বেশি কথা নয়, বাবার গুড গার্ল হয়ে ফাইল ফেরত দাও। নইলে ছেলেকে দেখার আশা ঝেড়ে ফেলো।

কল কেটে গেলো। সৃষ্টি দুই হাত দিয়ে ফোন চেপে ধরলো। শ্বাস নিতে পারছে না, মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । শরীর কাঁপছে প্রচন্ড,,,

:-ভাইয়া… মহিদ… ওরা মহিদকে নিয়ে গেছে…!

তৈমুর হাত বাড়িয়ে সৃষ্টিকে থামিয়ে দিলো, স্বর গভীর কিন্তু দৃঢ়তার সাথে বললো,,,

:-ভাবী, শান্ত হোন। আপনার ছেলের কিছুই হবে না।যতক্ষণ আমি আছি, কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না।

সৃষ্টি তাকালো তৈমুরের চোখের দিকে। সেই দৃষ্টিতে শুধু প্রতিশোধ ছিলো না,ছিলো এক অটল প্রতিশ্রুতি। সৃষ্টি কি বুঝলো সেই জানে! কিন্তু শান্ত হলো কিছুটা।

#চলবে