#সারা_জাহান
পর্ব,,৪
মৌমো তিতলী
🫶
নিজের ঘরে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রিনা শিকদার। সারার বেপারে ছেলের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। ছোট জায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়ে। আসলেই তো,এভাবে কারো জীবন চলতে পারে না। ছেলে মেয়ে দুজনেরই এখন বড় হয়েছে। তাদের এক সাথে পথ চলার সময় আসন্ন। এই মুহুর্তে যদি ছেলে এমন বেঁকে বসে তাহলে বেপারেটা খুব বিশ্রি হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই কিছু সংখ্যক নিকট আত্মীয়-স্বজনদের জানা তৈমুর-সারার সম্পর্কের ব্যাপারে।
মনে পড়ে অতীতের কথা।
বড় শখ করে তিনি বড় বোনের কাছে তার মেয়েকে চেয়েছিলেন রিনা শিকদার। সে আজ থেকে কত গুলো বছর আগের কথা। সারার বয়স তখন মাত্র তিন। ছোট্ট পুতুলের মতো মেয়েটাকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে বোনের কাছে আবদার করে বলেছিলেন,,,
:-তোর এই পুতুলটাকে আমার জাহানের জন্য দিবি বুবু?
সেদিন বোন মিনা চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেছিলেন আচ্ছা নিস।
কিন্তু বছর দুয়েক পরেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বুবু- দুলাভাই দু’জনেই দুনিয়া ছাড়লেন। সেদিন পাঁচ বছরের ছোট্ট সারাকে তিনি তার সাথে এই শিকদার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সারা তার খালামণির কাছেই বড় হতে থাকে। তুলি, রেশমী দুজনেই সারাকে বোনের মতো আপন করে নেয়।কিন্তু সাইফ শিকদার এবং রিনা শিকদারের ভাবনা ছিলো পনেরো বছর বয়সের তৈমুর জাহান কে নিয়ে। তৈমুর তখন সদ্য বয়ঃসন্ধি কালের দোরগোড়ায়। অনেক কিছুই সে বোঝে। তার থেকে দশ বছরের ছোট্ট সারাকে যদি সে বাকি বোনেদের মতো নিজের আরেকটি বোন ভেবে মেনে নিতে শুরু করে তাহলে তাদের ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্ন টা পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই শুরু থেকেই যেন তৈমুর জাহান শিকদার নিশ্চিত থাকে যে তার জন্য ভবিষ্যত জীবন সঙ্গী ঠিক করে রাখা হয়েছে আর সেই মেয়ে টা সারা। তাহলে কোন চিন্তাই থাকবে না। কিন্তু তারপরও বড় হওয়ার পর যদি তাদের মত পরিবর্তন হয়ে যায় সেই ভয়ে সাইফ শিকদার এবং রিনা শিকদার সেই অপরিপক্ক বয়সেই পনেরো বছর বয়সের তৈমুরের সাথে পাঁচ বছরের ছোট্ট সারার ইসলাম ধর্ম মতে বিয়ে পড়িয়ে দেন। সারা তখন বিয়ে সম্পর্কে না বুঝলেও তৈমুর ঠিকই বুঝতো। সে বাবা-মা কে বলেছিলো,তারা যেহেতু আগে থেকেই সারাকে ছেলের বউ করার সিন্ধান্ত নিয়েছেন,সারা প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তৈমুর অবশ্যই বিয়েটা করবে। তবে সে সারার এই অবুঝ বয়সে বিয়েটা করতে চায়না। কিন্তু সেদিন সাইফ শিকদার এবং রিনা শিকদার একরকম জোর করেই ছেলেকে রাজি করিয়ে বিয়েটা দিয়েছিলেন। তারপর সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তৈমুর কে এই বিয়ে সম্পর্কে একটা কথাও তারা বলতে শোনেননি। আজ সত্যিই আফসোস হচ্ছে রিনা শিকদারের। তিনি হয়তো ছেলের সাথে অন্যায় করেছেন। তাদের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাদের জোর করে দুটো জীবন বেঁধে দেয়া উচিত হয়নি। কিন্তু বিয়েটা যখনই আর যেমন করেই হোক,সেটা হয়েছে। এখন তৈমুর জাহান শিকদার এই বিয়েটা নিয়ে কি ভাবছে তা জানা দরকার।
তিনি অস্থির হয়ে অপেক্ষা করেন ছেলের জন্য। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কেউ নক করে। পরমুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করে তৈমুর।
মাকে দেখেই তৈমুরের বুঝতে অসুবিধা হয় না তার জন্মদাত্রী ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। এবং তার অস্থিরতার কারণটাও তার জানা। মৃদু হেসে মায়ের পাশে গিয়ে বসেই কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। রিনা শিকদার ছেলের কান্ডে হেসে ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। খানিকটা সময় নিয়ে তিনি বললেন,,
:-তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো আব্বা।
তৈমুর চোখ বন্ধ করে শোনে। রিনা কিছু বলতে নিবেন তার আগেই তৈমুর বলে,,
:-আমি জানি আম্মু তুমি কি বলবে!! আর এটাও বলছি তোমাদের চিন্তা টা একদমই ভুল।
রিনা শিকদার ছেলের কথায় স্বস্তি বোধ করেন। তৈমুর আবারো বলে,,
:- আম্মু আমি জানি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সঙ্গিনী আমাদের সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সেখানে তুমি,বাবা আমাকে জোর করে বিয়েটা দিয়েছো এমন ভেবে নিজেরা অপরাধবোধে ভোগার কোন মানে হয় না। মহান আল্লাহ পাক চেয়েছেন বলেই আমাদের বিয়েটা হয়েছে। আর আমি জানি আমার বাবা-মা কখনো আমার খারাপ হোক সেটা চাইবে না। তোমাদের সিদ্ধান্তের ওপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে। আর যদি বলো তোমাদের নাদান সরল বউমাকে জানানোর বিষয়ে, সেটাও তাকে সঠিক সময়ে জানানো হবে,তা নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নেই।
ছেলের এহেন কথায় হেসে ফেলেন রিনা শিকদার। ছেলের কপালে সযত্নে চুমু খান। গর্বে বুকটা ভরে যায় মায়ের। ছেলেকে যে তারা খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন। এখন আর তাদের সারাকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা করতে হবে না।
****
শুক্রবার বিকেলে,,
শিকদার বাড়ির পেছনের লনে বাহারি ফুলের সমাহার। মালি বৃদ্ধ যহর আলি এই সব ফুলের গাছের যত্ন নেন। এই বাড়ির ছেলেমেয়েদের একজন পছন্দের মানুষ এই যহর আলি। এই বাড়ির সব বাচ্চাদের মালি দাদু তিনি। তিনিও এ বাড়ির ছেলে মেয়ে গুলো কে খুব ভালোবাসেন। পড়ন্ত বিকেলে তিনি গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। বাড়ির প্রাচীর ঘেসে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফলের গাছ। তার মধ্যে একটা পেয়ারা গাছের নিচেই তুলি, রেশমী আর সারা হৈচৈ করছে। তাদের হঠাৎ পেয়ারা মাখা খেতে মন চেয়েছে। সবকটা মিলে এখন সেই পেয়ারা পাড়ার অভিযানে নেমেছে। গাছটা বেশ পুরনো সেই হিসেবে বড়ও। তুলি কোত্থেকে একটা বাঁশের লাঠি এনে পাড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। রেশমী যহর আলির কাছে গিয়ে একটা বড় লাঠি জোগাড় করে আনতে বলে। যহর আলি ফোকলা দাঁতে হাসে তাদের কান্ড দেখে।
বাড়ির পেছনের ফুলের বাগান টা তৈমুরের রুমের ঠিক পেছন দিকে পড়ে। তার রুমের টানা বারান্দায় দাঁড়ালে তা সহজেই দেখা যায়। ছুটির দিন আর হসপিটালে ডিউটি না থাকায় সপ্তাহে এই দিনটা তৈমুর বাড়িতেই থাকে। এতক্ষণ নিজের ঘরেই সে ঘুমাচ্ছিলো। কিন্তু বাইরে তিন তিনটা শালিকের এতো কিচিরমিচিরে তার ঘুম ভেঙ্গেছে আরো আগে। মা কে দিয়ে একটা স্ট্রং কফি করে নিয়ে তৈমুর ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ছিপ নিতে থাকে হাতে বিদ্যামান কফির মগ হতে। নজর তার লনের দিকে।
লাল টুকটুকে গাউন গায়ে জড়িয়ে সারা। তুলির সাথে কথা বলছে হাত নেড়ে নেড়ে। কথার সাথে দুলছে পিঠের ওপর বিদ্যামান ঝুলন্ত বেণী। আবেশীত নয়নে সেদিকে তাকিয়ে দেখলো তৈমুর। কিছুক্ষণ পর লনে উপস্থিত হলেন সাইফ শিকদার। এতক্ষনে বাচ্চাদের সাথে পেয়ারা পাড়তে যোগ দিয়েছেন তিনি।
পরমুহূর্তেই ঘটনা দেখে চক্ষু চড়কগাছ তৈমুরের। তার সরল বোকা সারা কোমর বেঁধে পেয়ারা গাছে চড়ছে। নিচে থেকে তুলি, রেশমী সাথে স্বয়ং সাইফ শিকদার তাকে উৎসাহ দিচ্ছে।
শিকদার বাড়ির বউ কিনা কোমর বেঁধে গাছে চড়ছে আর নিচে থেকে শিকদার বাড়ির কর্তা যিনি কিনা সারার শশুর তিনিই নিচে থেকে তাকে সাবাসী দিচ্ছেন । এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে হতভম্ব তৈমুর জাহান। লনে উপস্থিত সবকটার মাথার তার ছিড়া বলে মনে হলো তার।
কিছু একটা ভেবে তৈমুর রুম থেকে বের হলো। গন্তব্য লন।
পেছন দিকে আসতেই চোখে পড়লো যহর আলি কোত্থেকে একটা চিকন গোটা বাঁশের লাঠি টেনে নিয়ে আসছেন। তৈমুর কে দেখে ফোকলা হাসলেন তিনি। মুহুর্তেই গমগম করে উঠলো তৈমুর জাহানের কন্ঠস্বর,,
:-বাঁশ লাগবে না দাদু। এটা সাইড করে রেখে আসুন।
:-জ্বী জাহান দাদুভাই!! বলেই বাঁশটা টেনে নিয়ে ওপর দিকের লনে চলে গেলেন যহর আলি।
তৈমুর বাগানে আসতেই তুলি আর রেশমী তৈমুর কে দেখে আঁতকে উঠেই ভো দৌড় বাড়ির ভেতরে!!
সাইফ শিকদার ছেলেকে দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। বাচ্চাদের মতো পারেনা তিনিও দৌড় দেন। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ছেলেকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালেন তিনি। তৈমুরের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পান ছেলের থমথমে গলা,,
:-গাছ থেকে পড়ে যদি আমার বউয়ের হাত পা ভেঙ্গে যায় আব্বু! তাহলে আমিও তোমার বউয়ের পা ভেঙ্গে দেবো!
আমার বউকে সরল বোকা পেয়ে উৎসাহ দেয়া তাই না??
ছেলের কথায় হতভম্ব সাইফ শিকদার। হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন তিনি।
:-আমার বউ তোমার মা। তোমার মায়ের পা ভেঙ্গে দেবে তুমি?
বাবাকে তোয়াক্কা না করে ধীর পায়ে পেয়ারা গাছের দিকে পা বাড়ায় জাহান।
সারা ততক্ষণে গাছের মগডালে। ডিপ ডাপ করে কয়েকটা পেয়ারা ততক্ষণে ভূতলে পতিত হয়েছে।
তৈমুর গাছের নিচে থেকেই গমগমে স্বরে আওয়াজ দেয়!!
:- গাছ থেকে নাম এক্ষুনি।
হঠাৎ তৈমুর জাহানের গলা শুনে চমকে ওঠে সারা। নিচের দিকে তাকিয়ে তৈমুর কে দেখেই চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে তুলি, রেশমী এমনকি আঙ্কেলকেউ চোখে পড়ে না সারার। আতঙ্কে ঢোঁক গিলে সারা।
সারাকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমক দেয় তৈমুর।
:- এই মেয়ে!! কি বললাম তোকে? নাম এক্ষুনি। এই সন্ধ্যা বেলা বাউন্ডুলের মতো গাছে চড়েছিস কেনো?
তৈমুরের তাড়া খেয়ে তরতরিয়ে নামতে নিলে আবারো ধমক খায়। ধমকে কাজ হয়! ধীরে ধীরে নেমে আসে সারা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে একদম নিচের ডালে এসে। গাছের নিচে কাটের টুলটা উল্টে পড়ে আছে। যেটাতে সে ভর করে গাছে চড়েছিলো। সারা আমতা আমতা করে তৈমুর কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
:-জাহান ভাইয়া ! টুলটা একটু সোজা করে দিন না!! আর কখনো চড়বো না গাছে!! প্রমিজ😒
সারার গাল ফুলিয়ে বলা কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর দুলে ওঠে তৈমুরের। তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই এই মুহূর্তে কতটা অনুভূতির ঢেউয়ে ভাসছে সে। ইচ্ছে করছে বোকা বউটা কে কোলে করে নামাতে। সারার কথায় তৈমুর গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। টুলটা সোজা করে দাড় করিয়ে দিতেই সারা তাতে পা ঠেকিয়ে নামতে নেয়। কিন্তু তৈমুরের উপস্থিতিতে ভীত থাকার কারনে পা কেঁপে ওঠে। ব্যালেন্স হারিয়ে যায় সারার। টুল উল্টে পড়তে নিতেই দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে তৈমুর জাহান। সারাও নিজের ভারসাম্য রাখতে তৈমুরের গলা জড়িয়ে ধরে।
মুহুর্তে ঘটা ঘটনায় থমকে যায় তৈমুর। বুকের মাঝে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সারাকে। বুকের মাঝে লেপ্টে থাকা তুলতুলে নারী শরীরটা কাঁপছে। সারার শরীর থেকে একটা মৃদু মেয়েলি স্মেল তৈমুরের নাকে এসে ঠেকছে যা তার নাশারন্ধ ভেদ করে মস্তিষ্কে গিয়ে ভয়াবহ তান্ডব চালাচ্ছে!
এদিকে উক্ত ঘটনায় আতঙ্কিত সারা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে। এই মুহূর্তে সে তৈমুর জাহানের বক্ষ পিঞ্জরে আটকে আছে তা বোধগম্য হতেই আতঙ্কে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে সারা। মাথা তার লেপ্টে আছে তৈমুর জাহানের চওড়া বক্ষে। সেথা হতে অনবরত হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ ভেসে আসছে ধুকপুক ধুকপুক!!!
চলবে,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৫
মৌমো তিতলী
🫶
সকাল সকাল হসপিটালের যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামলো তৈমুর। ডাইনিং টেবিলে শিকদার বাড়ির সদস্যরা। তৈমুর গিয়ে সারার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে মা কে আওয়াজ দেয়,,,
:-আম্মু আমার একটু তাড়া আছে, জলদি ব্রেকফাস্টটা দিও।
রিনা শিকদার দুইটা সেদ্ধ ডিম,এক গ্লাস দুধ সাথে কিছু কেটে রাখা ফ্রুটস প্লেটে এগিয়ে দেয় ছেলের দিকে। খেতে খেতেই তৈমুর বোনদের উদ্দেশে বলে,,
:- তোরা জলদি খাওয়া শেষ করে আয়। লেট করা যাবে না।হসপিটালে আমার ইম্পর্ট্যান্ট অটি আছে একটা।
তৈমুর প্লেটের অর্ধেক খাবার খেয়েই উঠে যায়। তুলি, রেশমী, সারাও উঠে যায় পরপর।
তৈমুর তাদেরকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে আসে। সায়ানকে আগেই অটি রেডি রাখতে বলে। সায়ানও থাকবে অটিতে। লাইফ কেয়ারে সব গুলো ক্রিটিক্যাল কেসই তৈমুর আর সায়ানই দেখে। এখনো পর্যন্ত এই দুজনের হাতে কোন অটিই অসফল হয়নি।
তৈমুর হসপিটালে এসেই সার্জারির জন্য রেডি হয়ে অটিতে ঢুকে যায়। একজন অর্ধ বয়সী লোকের হার্ট ব্লকের কেস। ইমার্জেন্সি অপারেশন করা প্রয়োজন।
হার্টে রিং বসাতে হবে। সায়ান আর তৈমুর জাহান এক সাথে বিষয়টাকে হেন্ডেল করে। দীর্ঘ ২ ঘন্টা পর অটি থেকে বের হয় সায়ান আর তৈমুর জাহান। অপারেশন সাকসেসফুল।
তৈমুর ফ্রেস হয়ে নিজের কেবিনে ঢুকতেই সায়ানও এসে হাজির। চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ে। অন্যদিনের মতো ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেল না সায়ান কে। যেন কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত সায়ান। তৈমুর বেপার টা খেয়াল করে। সারাক্ষণ কলকল করে বেড়ানো সায়ান যে অকারণে এমন চুপচাপ থাকবে না তা তৈমুরের থেকে ভালো কেউ জানবে না। বিষয় টা নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু। চিন্তার ভাঁজ পড়ে তৈমুরের ললাটেও। নিজ চেয়ারে বসতে বসতেই প্রশ্ন করে সায়ানকে,,,
:-হুয়াট হ্যাপেন ব্রো? তোকে কেমন চিন্তিত লাগছে! এনিথিং সিরিয়াস?
তৈমুরের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় সায়ান। গম্ভীর স্বরে বলে,,
:-কিড ওয়ার্ডে আজও একটা বাচ্চা গায়েব।
সায়ানের কথায় নড়েচড়ে বসে তৈমুর। আশ্চর্য হয়ে বলে,,
:- হুয়াট!! কখন হলো?
:-সকালেই হসপিটালে এসে খবরটা পেলাম। আগের ঘটনা গুলোর মতো এবারেও সেইম কেস। কেবিনে ডিউটিরত নার্সকে অজ্ঞান করে বাচ্চা চুরি করা হয়েছে।
:-সিসিটিভি ফুটেজে কিছু পাওয়া যায়নি?
সেইম। ওই সময়ের ফুটেজ গায়েব। যে ডিউটিতে ছিলো তাকেও সেন্সলেস অবস্থায় পাওয়া গেছে। জ্ঞান ফেরার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি। সে কিছুই বলতে পারছে না।
:-স্ট্রেইঞ্জ! চিন্তার ভাঁজ দেখা গেলো তৈমুর জাহান শিকদারের ললাটে। কিছু একটা ভেবে সায়ান কে বললো,,
:-আমার কি মনে হয় সায়ান!! এই লাইফ কেয়ারে কেউ তো আছে যে এই ক্রাইমের সাথে জড়িত। এভাবে বাচ্চা গায়েব হয়ে থাকলে তো হসপিটালের রেপুটেশনে প্রভাব পড়বে বিস্তর। কিন্তু কে আছে যে,যে থালায় খাচ্ছে তাতেই ছেদ করছে!!
তৈমুর সায়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,
:- ডিন স্যারের বক্তব্য কি?
সায়ান তাচ্ছিল্যো হেসে বললো,,
:-ডিনের কথা কি বলবো। উনি তো সপ্তাহে চারদিন আসেনি না। আর তার নেকু নাম্বার ওয়ান মেয়ে তো এসেই পড়ে থাকে তোর পিছে।
সায়ানের কথায় বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে তৈমুর। মস্তিষ্কে চলে গভীর চিন্তা ঝড়। এভাবে হসপিটাল থেকে বাচ্চা চুরির ঘটনা এটা তৃতীয় বার। এর আগেও দুবার একই ভাবে দুটো বাচ্চা চুরি গেছে। পুলিশ তদন্ত করেও কোন লাভ হয়নি। কোন প্রকার ক্লু পাওয়া যায়নি।
কে বা কারা এই জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত তা তাদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে। তৈমুর জাহান শিকদার এই জঘন্য অপরাধীদের খুঁজে বের করবেই। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তৈমুরের।
এরমধ্যে তার স্বরে বেজে ওঠে টেবিলে বিদ্যামান তৈমুরের মুঠো ফোন।
ফোন হাতে নেয় তৈমুর। স্ক্রিনের ওপর নাম ভাসছে “ছোট্ট চাচু”।
ফোন রিসিভ করে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। ওপর পাশ থেকে ভেসে আসে আলিফ শিকদারের গলা,,
:- কেমন আছো জাহান বাবা?
:- আলহামদুলিল্লাহ চাচু। তুমি কেমন আছো?
:-আমিও ভালো আছি। বড় ভাবী বললো বাচ্চারা খামার বাড়িতে আসবে বলে আবদার করছে। তুমি কি ফ্রী আছো বিকেলে?
তৈমুর হাত ঘড়ি দেখে বলে,,
:-বিকেলের আগে তো বের হতে পারবো না চাচু। সন্ধ্যায় আমি ওদেরকে নিয়ে যাবো। তুমি চিন্তা করোনা।
বাচ্চারা আসবে জেনে ভিষণ খুশি হয় আলিফ শিকদার। মাঝেমধ্যেই শিকদার বাড়ির সকলে খামার বাড়িতে হানা দেয়। জমিয়ে খামারের মোরগ দিয়ে বারবিকিউ পার্টি করে। আলিফ শিকদারও বাচ্চাদের পেয়ে খুশি হন। নিজের খামার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। তুলি, রেশমী, সারা ভিষন এনজয় করে। রেশমী বাবার কাছে গিয়ে আরো বাচ্চা বনে যায়। খুবই হাসিখুশি সময় পার করে তারা খামার বাড়িতে।
তৈমুর আরো টুকটাক কথা বলে ফোন রাখে। সায়ান এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো কিন্তু তৈমুররা খামার বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে শুনে বলে সেও যাবে
এমনিতেও শিকদার বাড়ির ছোট কর্তা এই আলিফ শিকদার ব্যক্তিটার সাথে সায়ানের বেশ জমে ভালো। তৈমুরের ভাষায় দুজনই আধা পাগল।
হসপিটালের ডিউটি শেষ করে সায়ানকে নিয়েই বের হয় তৈমুর।
******
কোচিং সেন্টার থেকে মাত্রই বের হলো সারা। সাথে তার বেস্টি সামিরা। কলেজ শেষে রোজ কোচিং করেই বাড়িতে ফেরে সারা। আজও তাই সামিরা কে সাথে নিয়ে মাত্রই বের হলো সারা । কোচিং সেন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় দুজন। অপেক্ষা রিকশার। সামনেই বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডের স্টল বিদ্যামান। সামিরা মেয়েটা ভিষন চটপটে আর ফুডি। তার জীবনে হয়তো একমাত্র দুর্বলতা খাবার। তাই সারাকে ডেকে বলে,,
:-এই সারা চল না ফুসকা খেয়ে আসি।
সামিরার কথায় অবাক হয় সারা। আশ্চর্য হয়ে বলে,,
:- এই সামু তুই না তখন বললি আর ফাস্টফুড খাবি না। এখন থেকে তুই ডায়েট করবি?
সামিরা বোকা বোকা হেসে বলে,,
:-প্লিজ সারা জানু আজকেই শেষ। প্রমিজ আর খাবো না দেখিস। চল না প্লিজ।
:-থাম তো তুই। তোর এই প্রমিজে কোন দাম নেই। এর আগেও তুই হাজার বার প্রমিজ করেছিস আর ভেঙ্গেছিস।
দুই বান্ধবীর তর্ক বিতর্ক চলতেই পেছন থেকে কারো ডাকে চুপ হয় দুজন। কেউ একজন সারাকে ডাকে। সারা তাকিয়ে দেখে কলেজের একজন সিনিয়র ভাই আব্রাহাম খান।
কলেজের সবাই তাকে আব্র বলেই ডাকে। কলেজে ভিষন ফেমাস এই ছেলে। বলতে গেলে কলেজের অধিকাংশ মেয়েদের ক্রাশ আব্র। দেখতে বেশ সুদর্শন পুরুষ সে। কলেজের টপার হওয়ার সাথে সাথে বেশ ফেমাস গায়কও। কাঁধে সবসময় একটা গিটার শোভা পায়। তার মতো একজন চকলেট বয় সারা কে কেনো ডাকছে ঠিক বুঝতে পারলো না সারা।
সারার কোন রেসপন্স না পেয়ে এগিয়ে আসে আব্র। কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিকে সামিরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে আব্রর দিকে। আব্র সামিরার ক্রাশ। তাকে এভাবে নিজের এতো কাছ থেকে দেখে হা হয়ে গেছে।
সারা অবশ্য কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। আব্র কাছে এসে দাড়াতেই সারা বলে,,
:-জ্বী আমাকে ডাকলেন?
আব্র বাঁকা হেসে জবাব দেয়,,,
:-তোমার কি মনে হয় কাকে ডাকছি?
আব্রর হেঁয়ালি কথা বুঝলো না সারা। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো কেবল। সারার বোকা বোকা চাহনি দেখে ফিসেল হাসলো আব্র। সারা ভাবে,এই ছেলে কি সবসময়ই এমন হাসে? নিজের মনের ভাবনা পাশে রেখে প্রশ্ন করে,,
:-জ্বী কিছু বলবেন?
আবারো হাসে আব্র। বলে,,,
:-নাম কি তোমার মেয়ে?
:-জ্বী??
:-বললাম কি নাম তোমার?
পাশ থেকে সামিরা ফট করে জবাব দেয়,,,
:-ওর নাম সারা,সারা চৌধুরী।
আব্র মনে মনে কয়েকবার নামটা আওড়ায়। সারা-সারা-সারা!
:-তুমি আমাদের কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের না?
এবার সারা মৃদু স্বরে জবাব দেয়,,
:-জ্বী হ্যাঁ।
এদিকে রাস্তার অপজিটে গাড়িতে বসে তিক্ষ্ণ চোখে সারা’দের দিকে তাকিয়ে আছে তৈমুর জাহান শিকদার।
কিছুক্ষণ পর দেখতে পায় ছেলেটা উল্টো রাস্তায় চলে গেল। কি কথা বললো সারার সঙ্গে ছেলেটা! ভাবনায় বিভোর হয় তৈমুর।
চলবে,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,৬
মৌমো তিতলী
🫶
আব্র প্রস্থান করতেই সারা ঘুরে দাড়াতেই তৈমুরের গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পায়। তৈমুর তখনও সারার দিকে তিক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। সারা কখনো তৈমুরের চোখে সরাসরি চোখ রাখে না নয়তো আজ তৈমুরের জেলাসি মাখা রক্তচক্ষূ দেখে নিশ্চিত অজ্ঞান হতো।
সারা সামিরা কে বিদায় জানিয়ে রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। সামনে ড্রাইভিং সিটে তৈমুর পাশেই সায়ান।
সারা গাড়িতে বসতেই সায়ান পেছনে মুখ বাড়িয়ে দাঁত বের করে হেসে বলে,,,
:- কেমন আছো ছোট ভা……
সায়ানের কথা শেষ না হতেই গলা খাঁকারি দিয়ে কাশি দিয়ে ওঠে তৈমুর। তৈমুরের সতর্কবার্তা বুঝতে পেরে সারার দিকে তাকিয়ে বোকা হাসি দেয়। ঢোক গিলে বলে,,
:-ইয়ে মানে কেমন আছো ছোট আপু??
এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো সারা। সায়ানের প্রশ্নের জবাব দেয়,,
:- আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া! আপনি কেমন আছেন?
:-আমি তো ঝাক্কাস আছি। তা তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
:-ভালোই।
সায়ান আড়চোখে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,,
:-আচ্ছা ছোট আপু তখন রাস্তায় তোমাদের সাথে কথা বলছিলো ছেলেটা কে?
সারা স্বাভাবিক ভাবেই জানায়,,
:- কলেজের এক সিনিয়র ভাইয়া।
:-কি নাম তার? আর কি বলছিলো তোমাদের সাথে?
:- পুরো নাম জানিনা। সবাই আব্র ভাই বলে ডাকে। আমার নাম জিজ্ঞাসা করছিলো।
:-আচ্ছা নাম জিজ্ঞাসা করছিলো! কেনো? তোমাকে পছন্দ করে নাকি??
তৈমুরের চোয়াল শক্ত হয়। সায়ান যে তাকে উস্কাতেই ইচ্ছে করে এসব আবাল প্রশ্ন করছে বেশ বুঝতে পারে। স্টিয়ারিং হুইলে হাতের চাপ বাড়ে। একমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে থাকে।
এদিকে সায়ানের প্রশ্নে হতভম্ব সারা। তৈমুরের দিকে তাকায় আড়চোখে। তৈমুরের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। সারা আমতা আমতা করে বলে,,
:-এসব কি বলছেন ভাইয়া? আমাকে পছন্দ কেনো করতে যাবে?
:-না দেখো,হতেও তো পারে। কলেজের সিনিয়র একজন হুট করে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে শুধু নাম জিজ্ঞাসা করবে কেনো? নিশ্চয় ডাল ম্যায় কুছ কালা হ্যাঁয়,,😁
:-স্টপ ইউর মাউথ সায়ানাইড!! আর একটা বাজে বকবক করলে তোর পশ্চাৎ দেশে লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেবো! দাঁতে দাঁত চেপে ধমক দেয় তৈমুর।
হুট করে তৈমুরের ধমকে চমকে ওঠে সারা। সায়ান দাঁত বের করে হাসে। যেন তৈমুরের ধমকে সে বেশ মজা পেয়েছে।
তৈমুর কে আরো উস্কে দিতে সারাকে বলে,,
:-বুঝলে ছোট আপু!! কেউ তোমাকে পছন্দ করবে এটা আবার কারো সহ্য হবে না। তবে তুমি কিন্তু চাইলে আমাকে বলতে পারো!!
তৈমুরের সামনে এহেন কথায় অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে থাকে সারা।
বাকিটা পথ নিরবতায় কেটে যায়। শিকদার বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি পার্কিং লটে থামতেই সায়ান গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে চলে যায়। সারা ধীরে সুস্থে নামতেই পা থেমে যায় তৈমুরের গম্ভীর স্বরে,,,
:-কলেজ টা লেখাপড়া করার জায়গা। প্রেম করার জায়গা নয়। তোর সাথে শিকদার বাড়ির সম্মান জড়িয়ে। সাথে তুই অন্য কারো আমানত! কথাটা মাথায় রাখবি!!
কথাটা বলেই গটগট পায়ে ভেতরে চলে যায় তৈমুর। এদিকে তৈমুরের কথা গুলো মাথার ওপর দিয়ে যায় সারার। শিকদার বাড়ির সম্মানের কথাটা বুঝলেও সে কার আমানত এটা মাথায় ঢুকলো না। চিন্তিত মনে বাসায় প্রবেশ করে সারা।
ড্রইংরুমে কথার ফুয়ারা ঝরাচ্ছে সায়ান। অনেক দিন পরে সায়ানকে পেয়ে রিনা শিকদার আর সিমা শিকদার দু’জনই ভিষণ খুশি। তৈমুর তো সেভাবে কথা বলে না বাড়িতে। কিন্তু সায়ান আসলে বাড়িটা মাতিয়ে রাখে। এর মধ্যেই সকলেই রেডি হয়ে নিচে আসে। আলিফ শিকদারের খামার বাড়িতে যাওয়ার জন্য সবাই এক্সাইটেড। সবার শেষে আসে তৈমুর জাহান। ব্ল্যাক ডেনিম সাথে গাঢ় নীল রঙের শার্ট। সিল্কি চুল গুলো কপালের ওপর পড়ে আছে। হালকা ধূসর চোখে এক গম্ভীর সুপুরুষ। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে নিচে নেমে আসে তৈমুর। এতক্ষণ সারা আড়চোখে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মস্তিষ্কে কাল বিকেলের অপ্রত্যাশিত ঘটনা!! হুট করেই মনে অন্যরকম অনুভূতি দোল খেয়ে যায়। রক্তিম হয় ফর্সা গোলাপী গাল দুটো। মাথা নিচু করে বসে থাকে সারা। ভুল করেও আর তাকানোর সাহস করে না চোখ ধাঁধানো পুরুষ টার দিকে। হঠাৎই রেশমীর উচ্ছাস বাক্য চমকে ওঠে সারা।
:-একি! জাহান ভাইয়া আর সারা দেখি ম্যাচিং ম্যাচিং হয়ে গেল!
রেশমীর কথায় নিজের দিকে নজর দেয় সারা। গাঢ় নীল রঙের গাউন পরেছে সারা। এটা তো এতক্ষন খেয়াল করেনি কিন্তু এখন কেমন অস্বস্তি লাগে। যে কেউ তাদের দেখলে কাপল ভাববে। তৈমুরের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। যেন কোন ব্যাপারই না। সায়ান খুকখুক করে কাশে। সকলকে তাড়া দেয় জাহান। হৈহৈ করে গাড়িতে গিয়ে বসে সবাই। ড্রাইভিং সিটে তৈমুর পাশে সায়ান। পেছনে তুলি, রেশমী, সারা। সারা জানালার পাশে বসে। এটা তার অভ্যাস। গাড়ির জানালা খুলে ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে প্রকৃতিবিলাস করা।
তৈমুর লুকিং গ্লাসটা কোনাকুনি সেট করে। কিছুক্ষণ পর পরই তার চোখ যায় স্নিগ্ধ এক প্রকৃতি বিলাসীর দিকে।
গাড়ি খামার বাড়িতে ঢুকতেই আলিফ শিকদার এগিয়ে আসেন। রেশমী গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আলিফ সিকদারও মেয়ের বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,,
:-কেমন আছে আমার আম্মা?
:-ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?
:- এই যে আমার আম্মারা এসে গেছে এখন কি ভালো না থেকে পারি?
বাবার আদুরে কথায় বিমুগ্ধ হয় রেশমী। সায়ান এগিয়ে এসে আলিফ শিকদারের সাথে কুশল বিনিময় করে। সায়ানকে পেয়ে একটু বেশিই খুশি হয়ে যান ভদ্রলোক।
সকলে হৈচৈ করে খামার বাড়িতে প্রবেশ করে। খামার বাড়িতে চারদিকে অসংখ্য গাছপালা দিয়ে ঘেরা। একপাশে বড়বড় দুটো পুকুর। তাতে অনেক ধরনের মাছ আছে। পুকুরের ওপরে মাচা বানিয়ে তাতে দেশি বিদেশি নানা জাতের হাঁস পালন করেন তিনি। গরুর খামার, মুরগি আর শত রকমের পাখির কিচিরমিচির পরিবেশটাকে একটা আলাদাই স্বর্গরাজ্য তৈরি করে।
সবাই ফ্রেশ হয়ে বাগানে পেতে রাখা চেয়ার দখল করে বসে। ফুরফুরে শীতল বাতাস বইছে। মাথার ওপর সচ্ছ নীল আকাশ। চমৎকার আবহাওয়া। তুলি, রেশমী হাতে চায়ের পাত্র নিয়ে হাজির। তুলি সকলের হাতে চা দেয়। তৈমুর ব্ল্যাক কফি নেয়। সবাই চায়ের সাথে হালকা পাতলা নাস্তা সেরে খামার বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখে। বড় বড় পাখির খাঁচার ভেতরে নানা রকমের পাখি। আলিফ শিকদার তাদের খাবার দিতে নির্দিষ্ট একটা টোনে শিষ বাজান। তাতে সব পাখি খাঁচা থেকে বেরিয়ে মাথার ওপর গোল গোল উড়তে থাকে। সারা এগুলো দেখে অভিভূত হয়। সে আলিফ শিকদারের কাছে আবদার করে নিজ হাতে পাখিদের খাওয়াবে। আলিফ শিকদার কিছু খাবার দেন সারার হাতে। কিছু পাখিরা উড়ে এসে সারার হাতের ওপর বসেই খাবার খায়। মাথায়, কাঁধেও বসে। তাতে সারা খিলখিল করে হাসে।
এদিকে তৃষ্ণার্ত এক প্রেমিক পুরুষের দুটো চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। তার মনে হয় সারা কোন রুপকথার পরী। সেই পরীর খিলখিল হাসিতে প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে তোলপাড় হয়। শত হারে বেড়ে যায় হৃদপিন্ডের গতি । বেসামাল হয় অন্তরকরণ। ফটাফট মুঠো ফোনে ক্যামেরাবন্দি করে নেয় এই আবেশিত মুহুর্তটা।
পাশ থেকে সায়ান তা খেয়াল করে আরেকটু আগুনে ঘি ঢালতে বলে ওঠে,,,
:- আহা কি কষ্ট!! হালাল হওয়া সত্ত্বেও কেউ একজন বউকে কাছে পাচ্ছে না। দুর দুর থেকে দেখেই দিন পার করছে। এটা কি মানা যায় 💔
তৈমুর সায়ানের কথায় বিরক্ত হয়। সায়ানের পিঠে দুম করে একটা কিল মেরে বলে,,
:- ভাড়মে যা তু সায়ানাইড!!
খামার বাড়িতে সারা বিকেল হৈচৈ করে কাটিয়ে রাতে বারবিকিউ চিকেন ফ্রাই করে ডিনার সেরে বের হয়। সায়ানকে বাসায় ড্রপ করে শিকদার বাড়িতে ফিরে আসে সবাই।
সারা গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাসায় ফিরে তুলি, রেশমী সারাকে জাহানের দায়িত্বে রেখেই গাড়ি থেকে নেমে যায়।
তৈমুর গাড়ির ডোর খুলে সারার নিকটে আসে। সারার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। গালে হালকা চাপ্পড়
মেরে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করে। সারা হালকা নড়েচড়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে। তা দেখে ঠোঁট প্রসারিত হয় তৈমুর জাহানের। ঘুমন্ত সারা কে আদুরে হাতে আলতো করে কোলে তুলে নেয়। পা দিয়ে গাড়ির ডোর ঠেলে দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে সারার রুমে গিয়ে শুইয়ে দেয়। গায়ে পাতলা চাদরটা টেনে দিয়ে এসির পাওয়ার টা হালকা কমিয়ে দেয়। সারার কপালে ভালোবাসার আলতো পরশ বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
চলবে,,,