#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪৭
মৌমো তিতলী
❤️
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে পরিত্যক্ত একটা ফ্ল্যাট। পুরনো আর জরাজীর্ণ। দেয়ালে শ্যাওলার দাগ, লোহার জানালায় জং ধরা গ্রিল, আর চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, এই নীরবতার আড়ালে সবকিছু অত্যাধুনিক আসবাবপত্রে সাজানো। ভেতরটা দেখলে কারো বোঝার উপায় নেই ভেতরটা আধুনিক এবং বিলাসবহুল। করিডোরে ঝকঝক করে জ্বলছে এক-দুটো বৈদ্যুতিক বাল্ব, ভেতরের ঘরগুলো পরিষ্কার কিন্তু স্বাভাবিকের তুলনায় নিস্তব্ধ।, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসে মৃদু গাড়িঘোড়ার শব্দ।
সবচেয়ে ভেতরের একটা ছোট ঘরে মহিদকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সাত বছরের বাচ্চা ছেলের মুখে বিভ্রান্তির ছাপ। দুনিয়ার জটিলতার কিছুই বোঝে না সে, শুধু জানে নানু ভাই তাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছে। মহিদ ভেবেছে হয়তো নানুর বাসায় যাবে, কিন্তু এখানে এসে কেমন অচেনা পরিবেশ দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। তারওপর নানু তাকে নিয়ে এসেই এই ঘরে আটকে রেখে কোথায় যেনো চলে গেছে। আম্মুর কথা ভেবে কান্না করে দিলো মহিদ। জোরে জোরে একবার নানু ভাই কে, একবার মা কে, কখনো বাবাকে ডাকতে লাগলো চিৎকার করে। কিন্তু কেউই সাড়া দিলো না। সেই সকালে ব্রেকফাস্ট করিয়ে স্কুলে দিয়ে এসেছিলো তার আম্মু। এরপর থেকে না খাওয়া বাচ্চা টা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়লো। এরশাদ হামিদের কুটিল ষড়যন্ত্রে বাবা মায়ের আদরের ছোট্ট মহিদ অসহায়ের মতো পড়ে রইলো অন্ধকার সেই বন্ধ দরজার আড়ালে।
____________
বাবার পাঠানো লোকেশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গায় এসে রিকশা থামালো সৃষ্টি।
রিকশা থেকে নামার আগে গভীর শ্বাস নিলো। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। সামনে একটা পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, যার ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো চারপাশে অস্ত্রধারী গার্ডেরা টহল দিচ্ছে। তাদের চোখের শীতল দৃষ্টি সৃষ্টির বুকের ভেতরটায় অস্বস্তি ছড়িয়ে দিলেও সন্তানের সুরক্ষার জন্য সে নিজেকে শক্ত করে নিলো।
ধীরে ধীরে ভেতরে এসে ড্রইং রুমে পা রাখতেই দেখতে পেলো এরশাদ হামিদ সোফায় বসা, দৃষ্টি সদর দরজার দিকেই। মুখে ঠান্ডা হাসি, পাশে তার ভাই জাহাঙ্গীর কবির। সেখানেও কিছু অস্ত্রধারী লোকজন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সৃষ্টি বাবার সামনে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,,,
:-“আমার মহিদ কোথায় বাবা? কি করেছো ওর সাথে? তুমি তো ওর নানা ভাই! কি করে এত ছোট্ট একটা বাচ্চাকে অপহরণ করে নিজের পাপ কাজের গুটি বানালে?”
এরশাদ হামিদের চোখে এক বিন্দু অপরাধবোধ নেই। বরং হালকা হেসে বললো,,,
:-তুমিও তো আমার ঔরসজাত কন্যা। বাবার পিঠ পিছে ছুরি বসাতে বুক কাঁপলো না? একবারও ভাবলে না ধরা পড়লে কি পরিণাম হতে পারে?
সৃষ্টি কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিল,,
:-তুমি পাপ করেছো, অন্যায় করেছো! তুমি খুনি!
এরশাদ হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। যেন সৃষ্টি খুবই মজার জোকস শুনিয়েছে।
:-বাহ! ছোট্ট একটা ফাইল পড়েই বাবাকে এতোটা চিনে ফেললে?
সে জাহাঙ্গীর কবিরের দিকে ইশারা করে বললো,,
:-ফাইলটা নিয়ে নে।
সৃষ্টি কিছুটা পিছিয়ে গেলো। কাঁপা গলায় বললো,,,
:-আগে আমার মহিদকে এনে দাও!
এরশাদ হামিদ শক্ত গলায় বললেন,,,
:- জিদ করোনা। ফাইলটা চাচুর হাতে দিয়ে দাও, আম্মা!”
চিৎকার করে উঠলো সৃষ্টি,,,
:-আমার মুহিদ কোথায় বাবা? আগে আমার মুহিদ কে এনে দাও! নয়তো আমি ফাইল দেবো না।
জাহাঙ্গীর এগিয়ে এসে জোর করে সৃষ্টির কাছ থেকে ফাইল কেড়ে নিলো।
এরশাদ এবার কণ্ঠ নিচু করে বললো,,
:-আমাদের সত্যটা তোমার জানা উচিত হয়নি আম্মা। এখন যখন জেনেই গেছো, তোমাকে ছেড়ে রাখা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। বাবাকে ক্ষমা করো আম্মা… কিন্তু তোমাকে আর ছাড়া যাবে না!”
সৃষ্টির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তার বাবা! যাকে সে মনেপ্রাণেশ্রদ্ধা করতো, যে কিনা ছিলো তার জীবনের সুপার হিরো, আজ সেই বাবা এতটা নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে! এটা ভাবতেও কষ্টে হৃদয়টা ছিড়ে যাচ্ছে সৃষ্টির। দম বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ে সে, চোখে জল জমে ওঠে, কিন্তু চোখে শুধু ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এরশাদ হামিদের দিকে।
জাহাঙ্গীর কবির ফাইলটা খুলেই চমকে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন,,,
:- ভাইজান…! ফাইলের ভেতরে তো কিছুই নেই!
সে রক্তিম চোখে এরশাদের দিকে তাকালো। এরশাদও রেগে উঠলো। সৃষ্টির দিকে ক্রোধানিত্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন তিনি,,,,
:-ডকুমেন্টগুলো কোথায় রেখেছো সৃষ্টি?
উত্তর দেয় না সৃষ্টি। শুধু ঘৃণা করার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।
জাহাঙ্গীর এগিয়ে এসে সৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে গর্জে উঠলেন,,,
:-কাগজগুলো কাকে দিয়েছিস? বল কাকে দিয়েছিস?
এরশাদও এবার অধৈর্য হয়ে উঠলেন। ডকুমেন্টগুলো যে তাদের বিনাশের একেকটা অস্ত্র!! তিনি সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হুমকি দিয়ে বললেন,,
,
:-“সত্যি কথাটা বলো সৃষ্টি। না বললে মুহিদকে তোমার চোখের সামনে মেরে ফেলবো।
সৃষ্টির দুচোখ ভরে এলো বাবার নিষ্ঠুরতায়। অতি কষ্টে ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললো,,
:-আমি তোমাকে চিনতে পারছি না বাবা… তুমি কি আমার সেই বাবা, যে আমাদের অসুখ হলে রাত জেগে মাথার কাছে বসে থাকতো? আমাদের ছোট ছোট ইচ্ছে গুলোও এক চাওয়াতেই পূরণ করতো? আজ এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হলে বাবা?
এরশাদ হামিদ দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,,,
:-এইসব সো কল্ড ইমোশন অন্য কোথাও দেখাবে। বাবা তোমাদের ভালোবাসে বলেই এখনো বেঁচে আছো, নইলে আমার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে আমি দুবার ভাবি না।
জাহাঙ্গীরকে ইশারা করলেন,,
:-নিয়ে যা ওকে।
,,,,,,,,,
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজায় বিকট শব্দ করে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো তৈমুর আর তার গ্যাং। আলভী, সায়ান, রাফি, আবির।
আলভী ড্রইং রুমে ঢুকেই জাহাঙ্গীর কবিরের পিঠে এক লাথি মেরে সৃষ্টিকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
:-“Now Yours game is over, father-in-law!
গেমের মোড় মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। এরশাদ হামিদ ক্রোধানিত দৃষ্টিতে সৃষ্টির দিকে তাকালেন। এতক্ষণে বুঝতে পারলেন,সৃষ্টি চাল চেলেই এসেছে।
জাহাঙ্গীর এগিয়ে এসে সৃষ্টির গালে স্বজোরে চড় মারতে চাইলে আলভী তার হাত মুচড়িয়ে ধরে। সৃষ্টি কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
:-Don’t even think about touching my wife!!
Otherwise, এই হাত আর আস্ত থাকবে না।
৮ বছরের বিবাহিত জীবনে প্রথমবার আলভীর মুখে “আমার স্ত্রী” শুনে সৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখে অশ্রু আর অবাকের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আলভীর মুখের দিকে।
এরশাদ হামিদ গার্ডদের কে চিৎকার করে বললেন,,
:-এই তোরা হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? খতম করে দে কুত্তার বাচ্চাদের!!
গার্ডেরা তাদের অস্ত্র উঠানোর আগেই গর্জে উঠলো তৈমুরের হাতের গান। মুহুর্তেই রাফি আর আবিরও কয়েকটা কে ধরাশায়ী করে দিলো।
সেই মুহূর্তে নিজেকে বাঁচাতে শেষ চাল হিসেবে এরশাদ মুহিদকে সামনে এনে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গর্জে উঠলো,,,
:-কেউ এক পা এগোবে না। আমাকে এখান থেকে যেতে না দিলে মুহিদকে মেরে ফেলবো!”
বেচারা মুহিদ ঘুমঘুম আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুঝতেই পারছে না এখানে কি ঘটছে। সুখের সামনে বাবা মাকে দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো মোহিদ।
নিজের একমাত্র আদরের সন্তানকে গান পয়েন্টে দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সৃষ্টি।
:- প্লিজ নাহ! বাবা না।
তৈমুর হাত উঠিয়ে সবাইকে থামতে বললো। ক্রুড় হাসি ফুটে উঠলো এরশাদের ঠোঁটে। মোহিদকে গান পয়েন্টে রেখেই পেছন হঠতে শুরু করলো এরশাদ হামিদ। জাহাঙ্গীর কবিরও কুটিল হেসে ভাইয়ের সাথে বেরোতে নিলেন।
সুযোগ বুঝে সায়ান পেছন থেকে কৌশলে লাথি মেরে এরশাদের হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিলো। ঠিক তখনই তৈমুর ঝাঁপিয়ে পড়ে মহিদকে নিজের কাছে টেনে নিলো।
শুরু হলো এরশাদ আর জাহাঙ্গীরের সাথে তৈমুরের দলের মধ্যে তীব্র লড়াই। গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত মহিদকে বুকে আগলে ধরে সৃষ্টি। চারদিক এলোমেলো।
লড়াইয়ের মাঝখানে হঠাৎ করে এরশাদ হামিদ হল রুমের মাঝখানেই গোলাকৃতি কিছু একটা ছুড়ে দিতেই মুহূর্তেই ধোঁয়ায় ভরে গেল জায়গাটা। এরশাদ হামিদ এর মাঝেই সুযোগ বুঝে পালালো। তৈমুর চেষ্টা করেও লাগাল পেলো না এরশাদের। কিন্তু জাহাঙ্গীর ধরা পড়ে গেল আলভীর হাতে। একজন ট্রেইনিং প্রাপ্ত মিলিটারির হাতে মার খেয়ে তখন আধমরা অবস্থা জাহাঙ্গীর কবিরের।
তৈমুর এগিয়ে এসে জাহাঙ্গীর কবিরের ধরে টেনে তুলল। রাফি আর আবিরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,,
:-এটাকে এর জায়গা মত চালান করে দে! এর বিচার কাল করবো! তারপর হাই তুলে বললো!
:-আমার বউয়ের কথা খুব মনে পড়ছে!! এনার্জি লো!! পাওয়ার লোভ দিতে হবে। আলভির দিকে তাকিয়ে বলল,,
:-তুইও ভাবি আর মুহিদকে নিয়ে বাড়ি যা!! তোর শ্বশুর মশাই কে পরে খাতির যত্ন করবো। ভাবিস না, পালাতে পারবে না।
বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। সায়ান বাকিদের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,,,,
:-ইয়ে মানে আমারও ব্যাটারি লো!! আমিও যায় কেমন!!
সেও তৈমুরের পিছু পিছু ছুটলো!!
রাফি আর আবির দরজার দিকে হাঃ করে তাকিয়ে আছে এখনো। এরা দু’টো কি বলে গেলো বোধগম্য হতেই ভিরমি খেলো তারা।
রাফি উদাস মুখে বললো ,,,
:-ভাই আজ সিঙ্গেল বলে 🤧
আবির ফুসস করে দম ছাড়লো। এদের নটাঙ্কি চলতেই থাকে!! বেশি কিছু না ভেবে জাহাঙ্গীর কবির কে ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেলো গন্তব্যে।
*********
নিজের রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তৈমুর। চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ।, চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো।
বিছানায় বসে ছিলো সারা। পায়ের ওপর এখনো ব্যান্ডেজ, হাঁটতে কষ্ট হয় বলে এক জায়গায় বসেই ছিলো। তৈমুর এগিয়ে এসে কিছু না বলে আলতো করে তার হাত ধরলো সারার।
:-কি হলো?চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো সারা।
কোনো উত্তর না দিয়ে তৈমুর ধীরে ধীরে তাকে দাঁড় করালো। মুহূর্তেই সারাকে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে।যেন সারাদিনের সব ক্লান্তি এই আলিঙ্গনেই গলিয়ে দেয়ার চেষ্টায়।
সারা তৈমুরের পিঠে আলতো করে হাত রেখে বললো,,,
:-সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলেন? আমাকে বলে যাননি। সারার কণ্ঠে হালকা অভিমান ঝরে পড়ে।
তৈমুর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি এনে বলে,,,
:-হাসপাতালে কাজ ছিল। তারপর গভীর স্বরে বললো,,,
:- এই মুহূর্তে আমার ব্যাটারি লো বউ…”I need a charge! and you are my personal power bank!
তৈমুর কথাটা শেষ করতেই সারার গাল লাল হয়ে উঠলো। লজ্জা পেয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলো সারা। কিন্তু তৈমুর শক্ত করে তাকে আটকে রাখলো সারাকে। চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বললো,,,
:-তুই আমার প্রাণ সঞ্চারিনী জান… একবার তোকে ছুঁলে আমার সব এনার্জি ফিরে আসে।
সারা কিছু বলার আগেই তৈমুর তার ঠোঁট জোড়ায় ভালোবাসার ছোঁয়ায় আটকে নিলো। দু’জনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো। কয়েক মিনিট পর ছাড়া পেলো সারা। হাঁপিয়ে উঠলো যেন।
তৈমুর সারার কানের লতিতে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,,,
:-তুই জানিস না সারা, তোকে কাছে পেলে আমি কেমন দিশেহারা হয়ে যায়। তোকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলে শান্তি পাই। তুই দুরে থাকলে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তোকে না দেখলে আমি অন্তরতৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ি। দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠ জান। I need you so badly, so personally, in my entire being.
সারার মাথা নুয়ে এলো একরাশ লজ্জায়। গালে গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই। তৈমুর টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো সারার দুই গালে। এলোমেলো অনুভূতিতে হাঁসফাঁস করে উঠলো সারা। নিভু নিভু চোখে মিনমিন করে বললো,,
:- এভাবে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন আপনি!!
তৈমুর বাঁকা হেসে সারার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। থরথর করে কেঁপে উঠলো সারা। তৈমুরের দুই হাত সারার কোমরের কাছে কামিজ গলিয়ে নরম কোমল উদরে গিয়ে থামলো। সেথায় আলতো স্লাইড করে কাতর করে তুললো সারা কে। বেসামাল অনুভূতিতে তৈমুরের গলার কাছটা খামচে ধরলো সারা। অস্ফুট আর্তনাদে গোঙিয়ে উঠলো।
তৈমুরের হালও বেহাল হলো সারার সেই অস্ফুট গোঙানির শব্দে। অস্থির হয়ে উঠলো তৈমুর। সারাকে নিজের সাথে একেবারে মিশিয়ে নিলো। কোমর জড়িয়ে ধরে উঁচু করে কোলে তুলে নিলো। সারাও নিজের ব্যালেন্স রাখতে ব্যথা ভুলে দুপায়ে তৈমুরের কোমর আঁকড়ে ধরলো।
তৈমুর সারাকে আগলে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। দিন দুনিয়া ভুলে শুষে নিতে লাগলো সারার কোমল নরম অধরযুগল। সারার পিঠ গিয়ে ঠেকলো বিছানায়।
তৈমুর অস্থিরতায় সারার অসুস্থতার কথাও ভুলতে বসেছে যেনো। বেসামাল হাতে সারার ওড়না টেনে নিতেই!
নিচ থেকে রিনা শিকদারের কণ্ঠ ভেসে এলো। লাঞ্চের জন্য সবাইকে ডাকছে রিনা শিকদার।
মায়ের ডাকে হুস ফেরে তৈমুরের। সারাকে ছাড়তেই লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো সারা। তৈমুর আলতো করে সারার গাল ছুঁয়ে মুচকি হেসে বললো,,,
:-মায়ের জন্য একবারের মতো বেঁচে গেলি!
সারা ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলো। এই মুখ তৈমুর কে সে আর দেখাবে না। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
সারার কান্ডে গা দুলিয়ে শব্দ করে হাসে তৈমুর। হাসতে হাসতেই তাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শাওয়ার নিতে, আর সারা লজ্জা মাখা হাসি নিয়ে বিছানায় পড়ে রইলো।
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৪৮
মৌমো তিতলী
❤️
মহিদকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকে সৃষ্টির মনটা কিছুটা হালকা হলেও এখনও ভীত হয়ে আছে। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ,বিপদ আর আতঙ্কের পর ছেলেটাকে সহি সালামতে ফিরে পেয়ে এখন তার একটাই চাওয়া,ছেলেটাকে নিরাপদে, শান্তিতে রাখা।
রাতে নিজের হাতে মহিদ কে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিলো।
মহিদ তার ছোট্ট হাত দুটো আঁকড়ে মায়ের কোলে শুয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লো। মনে যেন এক টুকরো শান্তি নেমে এলো সৃষ্টির।
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আলভী।
নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করলো,,
:-ঘুমিয়ে গেছে?
সৃষ্টি আলভীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো,,,
:-হ্যাঁ, একটু আগেই।
আলভী কিছুক্ষণ মহিদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর সৃষ্টি কে উদ্দেশ্য করে বললো,,
:- সৃষ্টি আমাকে এক কাপ কফি করে দেবে? আমি ছাদে আছি। বলেই বেরিয়ে গেলো আলভী।
সৃষ্টি অবাক হলেও কিছু বললো না। আগে কখনো আলভী নিজের জন্য সৃষ্টিকে কিছু করতে বলেনি কখনো। বাসায় আসলে চা, কফি যখন যা প্রয়োজন আলভী নিজেই করে নিতো! আজ হঠাৎ আলভীর আচরণে পরিবর্তন মনে হচ্ছে সৃষ্টির কাছে।
তাই আলভির কফি চাওয়াতে বেশ অবাক হয়েছে সৃষ্টি। বেশিকিছু না ভেবে কফি বানাতে কিচেনে চলে গেলো।
রাতের আকাশটা যেন কালো মখমলের চাদর, তাতে ছড়িয়ে আছে হাজারো তারা। চাঁদের আলো নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। হালকা শীতল হাওয়া মুখে এসে লাগছে, কোথাও দূরে হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। শহরের কোলাহল যেন এখানে এসে থেমে গেছে,শুধু দূরে কুকুরের এক-আধটা ডাক আর মাঝে মাঝে গাড়ির ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে।
কয়েক মিনিট পর দু’কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে নিয়ে ছাদে এলো সৃষ্টি। আলভী রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে। কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো।
সৃষ্টি গিয়ে তার পাশেই দাঁড়ালো, কিন্তু কিছু বললো না। শুধু ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো নিরবে। পাশাপাশি দুজনের নিরবতা রাতটাকে আরও নিস্তব্ধ করে তুললো।
নীরবতা কিছুক্ষণ টিকে থাকলো। তারপর হঠাৎ সৃষ্টি নিজেই নীরবতা ভেঙে বললো,,,
:-সরি…!”
আলভী ভ্রু কুঁচকে তাকালো,,
:-“”Why you saying sorry?”
সৃষ্টি কষ্টভরা কণ্ঠে বললো,
:-আমার বাবার করা পাপের কারণে তোমার জীবন নষ্ট হয়েছে। তোমার জীবন থেকে তোমার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। এই সবকিছুর জন্য কোথাও না কোথাও আমিও দায়ী। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও আলভী। সৃষ্টি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা গ্লানি মিশ্রিত জল।
আলভী গভীর নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বললো,,,
:-এখানে তোমার কোন দোষ ছিলো না সৃষ্টি। আমরা দু’জনই পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। শুধু মাঝখান থেকে নিষ্পাপ মায়ার প্রাণটা গেলো।”
কথাটা শেষ করে কিছুটা উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো আলভী, যেন চাঁদের আলোয় মায়ার মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে।
সৃষ্টি মলিন হেসে বললো,,
:-“জানো, আমি এতদিন ভাবতাম, সেদিন কেনো তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে। জানি, তুমি কখনো আমাকে মায়ার জায়গাটা দিতে পারোনি… বা দাওনি।
তাহলে সেদিন “না” বলার পরেও হঠাৎ কেনো রাজি হয়েছিলে বিয়ে করতে? কিন্তু আজ বুঝতে পারছি,আমার বাবা তোমাকে বাধ্য করেছিলো।
সৃষ্টির কণ্ঠ কিছুটা কেঁপে উঠলো।
:-এটা ভাবতেও নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে আমার, আলভী। আমার ভালোবাসাটা হয়তো অভিশাপ হয়ে এসেছিলো তোমার জীবনে। আমার একটা ভুলের কারণে তোমাদের সুন্দর ভালোবাসাময় জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে…
কি করলে এই ভুলের ক্ষমা পাবো আমি?”
আলভী সাথে সাথে কিছু বললো না, শুধু ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে কফির মগের দিকে তাকালো। রাতের ঠান্ডা হাওয়া তাদের দুজনের নীরবতার মাঝে মিশে গেলো, কিন্তু সেই নীরবতায় যেন অনেক না-বলা কথা ভেসে রইলো।
আলভী কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা রেলিংয়ের ওপর রাখলো। তারপর কিছুক্ষণ সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা দীর্ঘ, গভীর দৃষ্টি, যেখানে রাগ নেই, ঘৃণাও নেই। শুধু একরাশ ক্লান্তি আর অদ্ভুত এক মমতা মিশে আছে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলভী নিম্নস্বরে বললো,,
:-সৃষ্টি, ভালোবাসা কখনো অভিশাপ হয় না। মানছি
আমাদের মধ্যে যা ছিলো, সেটা ভালোবাসা ছিলো না। ছিলো একটা সম্পর্কের দায়িত্ববোধ, যা শুরু হয়েছিলো ভুল সময়ে, ভুল পরিস্থিতিতে।
মায়াকে আমি ভালোবেসেছিলাম, হয়তো এখনো বাসি। কিন্তু তোমাকে আমি কখনো ঘৃণা করিনি।
তুমি মায়ার জায়গাটা কখনো পাবে না,এটা ঠিক। কিন্তু তোমারও নিজের একটা জায়গা আছে আমার জীবনে।”
একটু থামলো আলভী, তারপর শ্বাস নিয়ে বললো,,,
:-আমি জানি, তুমি আমার প্রতি যেটুকু অনুভূতি রেখেছো, সেটা নিখুঁতভাবে সত্যি। আর আমি…আমি চেষ্টা করেছি তোমাকে নিরাপদ রাখতে, যতটুকু পেরেছি।
মায়ার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী নও। দায়ী তোমার বাবা আর তোমার চাচা। আর তার শাস্তি তারা পাবে। At any cost!!
আলভী হালকা হাসলো, কিন্তু সেই হাসিতে ছিলো নিঃশব্দ এক কষ্ট মেশানো।
:-ক্ষমা…? আমি তো তোমাকে দোষই দিইনি কখনো সৃষ্টি। ক্ষমা চাওয়ার কিছুই নেই। শুধু… মনে রেখো, আমরা দু’জনই এই লড়াইয়ের যোদ্ধা, আমার সন্তানের মা, কোন শত্রু নই।
কথা শেষ করে সে আবার আকাশের দিকে তাকালো।
তার চোখে চাঁদের আলো পড়ছে, কিন্তু সেই আলো যেন মায়া আর সৃষ্টির মাঝের অদৃশ্য এক সেতুকে আলোকিত করে দিচ্ছে। যেটা হয়তো কখনো ভাঙ্গা সম্ভব নয়। কিন্তু নদীর দুই পাড় এখনও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
সৃষ্টির মনে কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা কিছুটা কেটে গেছে। মুখে এখন অদ্ভুত এক শান্তির ছোঁয়া। আলভী ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে সৃষ্টি’র হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,,
:-সৃষ্টি, আজ থেকে আর কোন দুরত্ব ,ভুল বোঝাবুঝি চাই না। জীবনের বাকি দিনগুলো আমরা সাধারণ দম্পতির মতো কাটাবো। ভালোবাসা দিয়ে, যত্ন দিয়ে।
সৃষ্টি যেনো আজ অবাকের চুড়াই পৌঁছে গেলো।আলভীর মুখ থেকে শোনা কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু কেমন স্বপ্ন মনে হলো। যেনো এখনি ঘুম ভাঙলেই সবটা মিথ্যা হয়ে যাবে। পরিস্থিতির তাড়নায় হতভম্ব হয়ে রইলো সৃষ্টি।
আলভী হয়তো বুঝতে পারলো সৃষ্টির মনের ভেতরের অবস্থা।চোখ নামিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিলো।
আলভী আর দেরি করলো না। সৃষ্টির হাতটা ধরে নিজের বুকে টেনে নিলো। সৃষ্টি’ও আলভীর বুকে মুখ গুঁজে রাখলো, যেন এতদিনের সব অভিমান এই আলিঙ্গনে গলে যাচ্ছে। জলন্ত কোন মোমের মতো!!
পরপর ভেসে এলো আলভীর কন্ঠ,,,
:-প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সৃষ্টি… এখন থেকে আমরা একে অপরের জন্যই বাঁচবো। কোন অতীত নয়, কোন দেয়াল নয়। শুধু তুমি, আমি আর আমাদের সন্তান মহিদ। আলভীর গলায় দৃঢ়তা।
সৃষ্টির চোখে এক ফোঁটা জল ঝলমল করে উঠল। অবাধেই তা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
কিছুক্ষণ এভাবেই তারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো একে অপরকে জড়িয়ে। তারপর আলভী একটু হেসে বলল,,
:-আরেকটা কথা বলবো?
সৃষ্টি মুখ তুলে তাকালো আলভীর দিকে।
:-আমি ভাবছি, তালহার জন্য অতি শিগগিরই তৈমুরের বাসায় সম্বন্ধ নিয়ে যাবো। তালহার জন্য তৈমুরের বোন রেশমী হাত চাইতে…
সৃষ্টি ভুরু কুঁচকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, এই খবর শুনলে সাবিকা’র রিয়াকশন কি হবে কে জানে!
আলভী গভীর শ্বাস নিলো, চোখে একধরনের পুরনো ব্যথার ছাপ ফুটে উঠলো আলভীর,,,
:-দেখো সৃষ্টি, তোমার হয়তো শুনতে খারাপ লাগবে! কিন্তু যখন আমাদের বিয়ে হয়েছিলো, তখন আমার পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে, আমি চাইলেও কিছু করতে পারতাম না। তোমার বাবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্ট্যান্ড নেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার তখন ছিলো না। আমার সামনে আমার পরিবারের দায়িত্ব কর্তব্যের দায়বদ্ধতা ছিলো,
কিন্তু তালহার জীবনের সেই দায়বদ্ধতা নেই। তালহার জীবনটা তালহারই, তার জীবনের সিদ্ধান্তে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আমি হতে দেবো না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বললো,,,
:-আমি চাই না আমার ছোট ভাইয়ের জীবনটাও আমার মতো হোক। ওর ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার ওর শতভাগ অধিকার আছে।
আমি জানি সাবিকা তালহাকে ভালোবাসে… কিন্তু তালহা তো ওকে ভালোবাসে না, ও ভালোবাসে রেশমীকে। এটা তোমার বোনকে বুঝতে হবে। না বুঝলেও কিছু করার নেই।
জোর করে কাউকে বিয়ে করতে বাধ্য করা যায়, কিন্তু জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না, সৃষ্টি।
সৃষ্টি চুপ করে শুনছিলো, আলভীর চোখের গভীরে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলো,এই মানুষটা আর নিজের প্রিয়জনের জন্য লড়াই থামাবে না। আলভীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে সৃষ্টি ধীরে বলল,,,
:-আমি চেষ্টা করবো সাবিকা’কে বোঝাতে! কারণ আমিও চাই না আর কারো ভালোবাসা হারিয়ে যাক, যেমনটা একসময় তোমাকে হারাতে হয়েছিলো।
আলভী হালকা হাসলো, আবারও সৃষ্টি’কে বুকে টেনে নিলো। এইবারে আলিঙ্গনটা ছিলো আরও দৃঢ়, যেন শুধু প্রতিশ্রুতি নয়,এবার সত্যি এক নতুন জীবনের শুরু হলো।
————-+————–
সিকদার হাউস
দেখতে দেখতে কেটে গেছে কয়েক সপ্তাহ। সারা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। পায়ে আর কোনো অসুবিধা নেই, নিজে নিজেই হাঁটাচলা করতে পারে। গত একমাস ধরে তৈমুরের অগাধ যত্নের ফল এটা।
আজ শিকদার হাউসে যেন উৎসব লেগেছে। বাড়ির চারপাশে একধরনের আনন্দময় ব্যস্ততা ছড়িয়ে আছে।
ড্রইংরুমে ঝাড়বাতির আলোয় সবকিছু আরও উজ্জ্বল লাগছে। শিকদার হাউসের কোণা কোণা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, কোথাও কোথাও রঙিন কাপড়ের ঝালর ঝুলছে। বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরের দিক থেকে ভেসে আসছে গরম গরম বিরিয়ানি আর কাবাবের সুগন্ধ।
সাইফ শিকদার আর আলিফ শিকদার দুই ভাই আজ ভীষণ ব্যস্ত। হাসিমুখে অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। কারণ, আজ আলিফ শিকদারের একমাত্র মেয়ে রেশমীর বিয়ের পাকা কথা বলতে আসছে তালহার পরিবার।
তৈমুর অনেক আগেই সবাইকে জানিয়েছে রেশমির জন্য তার এক বন্ধুর ভাই তালহা এহমাদ কে ঠিক করেছে সে। যদিও তাদের প্রেমের গল্প জানে শুধু তৈমুর, রেশমি, সারা, সায়ান আর তুলি। অন্য কেউ টের পায়নি, কারণ তৈমুর নিজেই চেয়েছে বিষয়টা প্রকাশ না করতে।
শিকদার হাউসের সবাই তৈমুর জাহান শিকদারের সিদ্ধান্ত চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে। আলিফ শিকদারও জানেন,তার বড় ভাইপো কাউকে তার মেয়ের জীবনসঙ্গী ঠিক করলে, সেটা কখনো অপাত্র হবে না। ছেলেটা ভার্সিটির প্রফেসর। সারার এক্সিডেন্টের সময় ছেলেটাকে দেখেছেন তারা। তার অমায়িক ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সকলে। তাই কেউ এই সমন্ধে অমত করেননি।
এদিকে রেশমি ঘরে বসে লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছে।চোখ নামিয়ে বসে আছে আয়নার সামনে। ফাইনালি! সে তার প্রণয় পুরুষকে পেতে চলেছে। সবকিছু যে এতোটা স্মুদলি হয়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি রেশমী। মনে মনে সে বড় ভাইয়ের প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ!! আজ যদি সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাচ্ছে তা কেবল তৈমুর ভাইয়ার জন্য।
সারা আর তুলি মিলে তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। হালকা মেকআপ, মাথার খোঁপায় জুঁই ফুলের গাজরা, পরনে গাঢ় লাল সিল্কের শাড়ি। হালকা গোল্ডেন জুয়েলারিতে বউ বউ লাগছে রেশমী কে।
সারা মাঝে মাঝে মজা করে ফিসফিস করে কিছু বলছে,,,
:-রেশমি আপু তোমাকে এত সুন্দর লাগছে না!!! দেখো আজই তালহা স্যার তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে না যায়!!
সারার কথায় গালে গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়লো রেশমীর। তুলিও হেসে কানের দুল ঠিক করে দিচ্ছে রেশমীর। রেশমির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, লজ্জা আর উত্তেজনা মিলেমিশে তার চেহারায় অদ্ভুত এক দীপ্তি এনে দিয়েছে।
রান্নাঘরে রিনা শিকদার আর সীমা শিকদার ব্যস্ত। কেউ বিরিয়ানির হাঁড়ি নেড়েচেড়ে দেখছে, তো কেউ মিষ্টির ট্রে সাজাচ্ছে। গৃহপরিচারিকারা আজ যেন দ্বিগুণ গতিতে কাজ করছে।
এতো ব্যস্ততার মাঝেও শুধু তৈমুর আর সায়ান এখনো অনুপস্থিত । তারা কেউই বাসায় ফেরেনি এখনো। দু’জনই হাসপাতালে। যেকোনো সময় ফিরবে।
********
রেশমী কে সাজিয়ে দিয়ে তুলি আর সারাও নিজেদের রুমে চলে গেলো নিজেরা রেডি হতে। কয়েকদিন ধরে তুলির শরীর টা ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরছে। অদ্ভুত এক অস্থিরতা কাজ করছে শরীরে। তবে তুলি সেভাবে গুরুত্ব দিলো না।
সারাও নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। ওয়াশ রুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে এলো চটজলদি।
আলমারির কাছে গিয়ে কোন ড্রেসটা পর্বে সেটাই দেখছিলো,এর মাঝে বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা সারার ফোনটা বেজে উঠলো।
সারার শরীরে তখনও তোয়ালে জড়ানো। এগিয়ে এসে ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দেখলো সামিরার কল। প্রিয় বান্ধবীর কল পেয়ে আনন্দে ঝলমল করে উঠলো সারার মনটা।
মেয়েটা দেশের বাইরে ছিলো এতদিন। কানাডায় নিজের ফুপির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। মাঝে সারার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনেও আসতে পারেনি বেচারী। তা নিয়েও হাজার বার দুঃখ প্রকাশ করেছে সামিরা। ফোনে খোঁজ খবরও নিয়েছে বেশ কয়েকবার।
সারা ফোন রিসিভ করে হাসিমুখে বলে,,
:-হ্যাঁ দোস্ত বল!
:-এই ছেড়ি কই থাকিস তুই? কয়বার কল দিয়েছি দেখে তো!
:-সরি রে সুইটু! আমি বাথরুমে ছিলাম। ওসব কথা ছাড়, তুই আসছিস তো?
সারার কথাই ফস করে দম ছাড়লো সামিরা।
:-হুম আসছি। এদিকে আমার ভাই সাহির, আমার সাথে যাবে বলে বায়না ধরেছে। এসব টাউল পাউল নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে বলতো!!
সামিরার কথায় খিলখিল করে হাসে সারা।
:-সমস্যা নেই,সাহির কে নিয়ে আয়। আমাদের ছোট্ট তন্ময় আছে, সাহিরের ভালো লাগবে। লেইট করিস না কিন্তু। কতদিন দেখা হয়নি বলতো! তুই আসলে জাম্পেস আড্ডা দেবো।
:-আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি তাহলে। ফোন কেটে দিলো সামিরা।
সারা ফোন রেখে আবারো ড্রেস চুজ করায় মন দিলো।
পুরো আলমারি ঘেঁটে বেগুনী আর সাদার কম্বিনেশনে একটা ফ্লোরটাচ গাউন বেছে নিলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পরে নিলো ঝটপট। তারপর হেয়ার ড্রায়ারের সাহায্যে চুল শুকাতে লাগলো। এতো লম্বা চুল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সারা।
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজাটা ধীরে খুলে গেলো। তৈমুর ক্লান্ত পায়ে ভেতরে ঢুকলো, কিন্তু সারা তৈমুর কে খেয়ালই করলো না। সে চুল নিয়ে কসরত করতে ব্যস্ত।
তৈমুর নিঃশব্দে সারার পেছনে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে উষ্ণ দুটো হাত এসে সারার কোমর জড়িয়ে ধরলো।
হালকা চমকে উঠলো সারা, শ্বাস কেঁপে উঠলো তার।
কিন্তু মুহূর্তেই তৈমুরের অস্তিত্ব টের পেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কাঁপা গলায় বললো,,,,
:-এসে গেছেন? সারা এখনও আয়নায় তৈমুরের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে।
তৈমুর কিছু বললো না, বরং মুখটা নামিয়ে সারার চুলের ভাজে নাক ডুবিয়ে গভীর শ্বাস টেনে নিলো। যেনো দিনের সমস্ত ক্লান্তি, হাসপাতালের ব্যস্ততা, সব চাপ সারার চুলের সুবাসেই ধুয়ে যাচ্ছে।
সারাকে মুচড়া-মুচড়ি করতে দেখে তৈমুর ফিসফিস করে বললো,,,
:-আমি কাছে এলেই তুই এতো পালায় পালায় করিস কেনো জান? একটুখানি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাক না। আমাকে একটু শান্তি নিতে দে…
সারা হালকা লজ্জায় হেয়ার ড্রায়ারটা বন্ধ করে দিলো।
:-মেহমান রা চলে আসবে… আপনি আগে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিন না!!
তৈমুরের কণ্ঠ আরও গাঢ় হলো, মুখটা সারার ঘাড়ের কাছে এনে হাস্কি স্বরে বললো,,,
:-আসুক! আমি একটু দেরি করলেও ক্ষতি নেই… পৃথিবীর সবকিছুর থেকে, তোর থেকে চুরি করে নেওয়া এই কয়েকটা মুহূর্ত আমার কাছে অনেক দামী।”
সারার শরীর কেঁপে উঠলো, বুকের ভেতর ধুকপুকানি যেনো বাড়ছে হাজার গুণ।
তৈমুর ধীরে ধীরে সারার চুল সরিয়ে কানের পাশে আলতো করে চুমু খেলো। থরথর করে কেঁপে উঠলো সারা। পরপর আবারও তৈমুরের হাস্কি স্বর ভেসে এলো,,,,
:-আজকে তোকে খুব সুন্দর লাগছে। Like purple grapes…!! So mach sweet,tasty and so juicy!!
যে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
সারা চোখ নামিয়ে নিলো লাজে। নিচের ঠোঁট কামড়ে হালকা হেসে বললো,,,
:-আপনি সবসময় এমন বলেন!!
তৈমুর মুচকি হেসে সারার হাতটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে চেপে ধরে বললো,,,
:-কারণ প্রতিদিন তোকে নতুনভাবে ভালো লাগে! নতুন ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে…!!বলেই সারার ঠোঁটে গাঢ় একটা চুমু বসালো তৈমুর।
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,৪৯
মৌমো তিতলী
❤️
সাবিকা ফোনে তালহা আর রেশমীর সম্বন্ধের খবরটা শুনে রাগে-ক্ষোভে অস্থির হয়ে উঠলো। সৃষ্টির ফোন কল থেকে মাত্রই সে জানতে পেরেছে আজ তারা পরিবার সহ তালহার জন্য রেশমীর সম্বন্ধ নিয়ে যাচ্ছে শিকদার হাউসে। খবরটা শুনেই তার মুখটা কালো হয়ে গেছে, বুক ধুকপুক করছে, মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে।
সাবিকা ফোনটা বিছানায় আছাড় মেরে বিড়বিড় করতে লাগলো,,
:- এটা কি করে হতে পারে! আমি তো তালহাকে ভালোবাসি… তোমরা সবাই জানো… তারপরও?!
কণ্ঠ কেঁপে ওঠে সাবিকার।, চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমায়।
সাবিকা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সৃষ্টির শ্বশুরবাড়িতে ছুটে এলো।
সরাসরি সৃষ্টির ঘরে ঢুকে বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো
:- আপু তোমরা জানো আমি তালহাকে ভালোবাসি… তারপরও তোমরা কেনো এমনটা করছো! ওকে অন্য কারো সাথে… আমি পারবো না আপু, পারবো না দেখতে!”
সৃষ্টির বোনের জন্য কষ্ট হলেও শান্ত স্বরে মাথায় হাত রেখে বলে,
:- তুই শান্ত হ, সাবিকা… আগে আমার কথা শোন!
সাবিকা থামলো না, গলার স্বর চড়িয়ে বললো,,,
:- আপু তুমি তো আমার আপন, তুমি কেনো আমার সাথে এই অন্যায় হতে দিচ্ছো? আমি জানি একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তালহা আমাকে মেনে নেবে একদিন, শুধু একটু সময় দিলে…”
ঠিক তখনই আলভী ঘরে ঢুকলো। তার চোখের দৃষ্টি দৃঢ়, কিন্তু কণ্ঠ শান্ত।
:- সাবিকা, শোনো… তালহা তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি।এটা সে অনেকবার খোলাসা করে বলেছে। ওর যদি কোন পছন্দ না থাকতো, আমি নিজে তোমাকে আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতাম। কিন্তু সে রেশমীকে ভালোবাসে। তাই ওর সাথেই বিয়েটা হবে।”
সাবিকা মাথা নেড়ে চিৎকার করে বললো,
:- না… আমি মানি না এটা!
আলভী এবার একটু গম্ভীর হয়ে উঠলো,,,
:- বিশ্বাস না করলে তোমার কষ্টই হবে বোন। আর একটা কথা মনে রেখো,তুমি এখানে এসে সিনক্রিয়েট করছো এটা জানলে তালহা ভীষণ রেগে যাবে। আমি চাই না সে আজকের দিনে অন্তত তালহা তোমাকে অযথা অপমান করুক।”
সৃষ্টিও শান্তভাবে বললো,,
:- তুই বুঝতে চেষ্টা কর, বোন… জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। তালহার নিজের পছন্দ আছে, আর সেটা রেশমী। অযথা বাড়াবাড়ি করে নিজের কষ্ট বাড়াস না।
সাবিকা অসহায়ভাবে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতো দিন যাবত তার জেদ পূরনের পেছনে সবসময় তার বাবার শক্তি ছিলো, কিন্তু এখন তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। বোনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সাবিকা আর একটা কথাও বললো না।
হৃদয়ভরা কষ্ট নিয়েও সে চুপ করে থাকলো। চোখের পানি মুছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো ধীর পায়ে। এক তরফা ভালোবাসা কখনো কখনো আঘাত করতে করতে মানুষ কে পাথর বানিয়ে দেয়।
এদিকে বিকেলের শেষ প্রহরে আলভীর পরিবার শিকদার হাউসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন আলভী তালহার মা মনোয়ারা বেগম। তার কোলে মহিদ। দাদির কোলে চুপটি করে বসে আছে ছেলেটা। মনোয়ারা বেগম জানালার বাইরে শূন্যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুখে তার একরাশ প্রত্যাশা।
বড় ছেলেটা কে তিনি দেখেশুনে বিয়ে করাতে পারেননি। চাকরির শুরুতেই তালহা নিজেই সৃষ্টি কে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। (ভেতরের কাহিনী কিছুই জানেন না ভদ্রমহিলা। আলভীও চায়নি তার জীবনের জটিলতা সম্পর্কে জেনে তার মা কষ্ট পাক)। কিন্তু আলভীর মা সবসময় চাইতেন,ছেলে-বউমা ,নাতি-নাতনি নিয়ে তার একটা ভরা সংসার হোক। বড় বউটা ভালো তবে,আলভী তার স্ত্রী -সন্তান নিয়ে সেনাবাহিনী কোয়ার্টারে থাকার ফলে বাড়িতে বড় একা হয়ে যান তিনি।
অবশ্য মিতালী বলে একটা মেয়েকে রেখেছে তার ছেলেরা তার সঙ্গ দেয়ার জন্য। কিন্তু তাতে কি সংসার ভরে? কিন্তু ছেলেদের ইচ্ছে,সুবিধার কাছে নিজের ইচ্ছে আর তুলে ধরেননা তিনি। থাক না ভালো যে যার মতো। ছেলেরা সুখে থাকলে তিনি সব সয়ে নেবেন। এখন দেখা যাক! তার ছোট ছেলে কেমন মেয়ে পছন্দ করলো।
************
শিকদার হাউসের ভেতরে তখন রমরমা মুহূর্ত চলছে।
সূর্যের শেষ আলো আঙিনার সোনালি লনটাকে যেন গলে যাওয়া সোনার মতো স্বর্নালী বর্ণ ধারণ করেছে। শিকদার হাউসের আভিজাত্য আজ যেন নতুন করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সাদা মার্বেলের সিঁড়ি, দরজায় রঙিন ফুলের তোড়া, বারান্দায় শিকদারি নকশার ঝাড়বাতি আর ভেতরে সুগন্ধি মোমবাতির মিষ্টি গন্ধ।
চারপাশে ব্যস্ততা। মহিলা কর্মীরা অতিথি আপ্যায়নের শেষ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, রান্নাঘর থেকে আসছে কাবাব, বিরিয়ানি আর শাহী ফিরনির গন্ধ।
গাড়ির শব্দে সদর দরজার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন সাইফ শিকদার ও রিনা শিকদার।
প্রধান ফটক দিয়ে একে একে ঢুকলো আলভী এহমাদ, তার মা মনোয়ারা বেগম,তালহা এহমাদ ,সৃষ্টি, আর ছোট্ট মহিদ।
তাদের স্বাগত জানাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো তুলি, সারা, সায়ান, রাফি, আবির আর সামিরা।
সায়ান আলভী কে দেখে যথারীতি মজা করেই বললো,,,
:-আসুন জাহাপনা! আপনাদের জন্য আজকের এই শাহী শুভেচ্ছার আয়োজন!
আলভী ও হেসে বললো,,,
:-তুই আর ভালো হলি না।
আলভীর কথায় উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো, পরিবেশটা নিমিষেই হালকা হয়ে এলো।
ভেতরে ড্রইংরুমে বসানো হলো অতিথিদের। কার্পেটে নকশা করা সোনালি কুশন, টেবিলে রূপোলী ট্রেতে সজ্জিত মিষ্টি ,ফল আর শরবত।
শিকদার পরিবারের আন্তরিকতা প্রথম থেকেই নজর কাড়লো মনোয়ারা বেগমের।
তিনি রিনা শিকদারের হাত ধরে বললেন,,,
:-আপনাদের বাড়িতে ঢুকেই মনটা ভরে গেল আপা। কত যত্নে সাজিয়েছেন, মনে হচ্ছে এক টুকরো শান্তির নীড়।
রিনা শিকদারও বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন,,,,
:- ঠিকই বলেছেন আপা। এ আমার শান্তির নীড়ই বটে। তবে আপনাদের জন্যই আজকের দিনটা আমরা বিশেষ করে রেখেছি।”
সাইফ শিকদার,,আলিফ শিকদার,, তৈমুর মিলে মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। হালকা নাস্তার পর্ব সেরে মেয়েকে দেখতে চাইলেন মনোয়ারা বেগম। এবার তালহা একটু নড়েচড়ে বসলো। বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির অনুভূতি হচ্ছে তালহার। প্রেয়সীকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে নাকি তাকে নতুন রুপে আবিষ্কার করার উত্তেজনায় ঠিক বুঝতে পারলো না তার প্রেমিক হৃদয়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো রেশমীর আগমনের।
এরই মধ্যে রেশমীকে ভেতর থেকে নিয়ে এলো তুলি আর সারা।
লাল রঙের সিল্কের শাড়িতে রেশমী যেন ফুটন্ত গোলাপ,চোখে কাজলের ছোঁয়া, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, মাথায় বেলি ফুলের গাজরা। তার প্রতিটি পদক্ষেপে ফুলের সুগন্ধ যেন বাতাসে ভেসে ভেসে তালহার নাকে সুরসুরি দিচ্ছে।
তালহা প্রথম দেখাতেই থমকে গেল।
তার চোখে রেশমীকে ঘিরে যেন এক ধরনের কোমল আলো ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই।
চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলো তালহা। মনে হলো, এই দৃশ্য সে শুধু দেখেই ক্ষান্ত হবে না, বরং মনে গেঁথে রাখবে আজীবন।
রেশমীর চোখ এক মুহূর্তের জন্য তালহার চোখে গিয়ে থামলো, তারপর লজ্জায় নীচু হয়ে গেল।
তালহার মনে রেশমীর গালের এই লালিমা টুকু যেনো শাড়ির রঙের সাথে মিশে গেলো।
মনোয়ারা বেগম চুপচাপ এই বিনিময় লক্ষ্য করলেন, তার মুখে তৃপ্তির হাসি।
মনোয়ারা বেগম রেশমী কে নিজের পাশে বসিয়ে থুতনিতে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললেন,,,
:-“মাশাআল্লাহ আপা!! কি সুন্দর আপনাদের মেয়েটা! একদম ফুলের মতো।
রেশমী মৃদু গলায় সালাম করলো, সবার সাথে পরিচিত হলো।
সায়ান মজার ছলে বললো,,,
:-আন্টি এই বাড়ির সব মেয়েগুলোই কিন্তু ফুলের মতো। শুধু নিজের ছোট ছেলের হবু বউটাকে দেখলেই হবে??
সায়ানের কথায় আবারো সবাই হেসে উঠলো, “ছোট ছেলের হবু বউ” কথাটা শুনে তালহার মুখে হালকা লজ্জার সাথে গোপন এক আনন্দ ফুটে উঠলো হৃদয়ে।
রিনা শিকদার, সীমা সিকদার চা-নাস্তা পরিবেশন করলেন। সিমা শিকদার মেয়েকে বললেন সবাইকে চায়ের কাপ তুলে দিতে।
রেশমী মায়ের কথামতো চায়ের কাপ পরিবেশন করতে করতে মাঝে মাঝে তালহার দিকে তাকিয়ে ফেলছিলো কয়েকবার ,আর তালহা প্রতিবারই মুগ্ধ হয়ে সেই দৃষ্টি ধরে রেখেছিলো।
ঘরের ভেতরে হাসি, কথা, আর এক ধরনের উষ্ণতার আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। যেন দুই পরিবারই বুঝে ফেলেছে, আজ কেবল সম্বন্ধের নয়, নতুন একটা সম্পর্কেরও সূচনা হলো।
রেশমীকে দেখে আলাপ শেষে মনোয়ারা বেগমের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
তিনি ব্যাগের ভেতর থেকে বের করলেন একজোড়া সোনার বালা আর একটি স্বর্ণের চেইন।
সৃষ্টিকে উদ্দেশ করে বললেন,,,,
:-“বড় বৌমা, এগুলো রেশমীর হাতে আর গলায় পরিয়ে দাও।”
সৃষ্টিও হাসিমুখে শাশুড়ির কথামতো স্নেহ মিশ্রিত হাতে রেশমীর কব্জিতে বালা পরিয়ে দিলো, গলায় পরিয়ে দিলো চেইন। রেশমীর গালের লালিমা আরও বেড়ে গেল, চোখ নামিয়ে লাজুক হাসি দিলো।
ছোট জা হিসেবে রেশমী কে বেশ পছন্দ হলো সৃষ্টির।
ঠিক তখনই ছোট্ট মহিদ দৌড়ে এসে রেশমীর সামনে দাঁড়ালো। রেশমীর বালা পরা হাত দুটো আঁকড়ে ধরে
নির্ভেজাল কণ্ঠে বললো,,,
:-তুমি কি আমার রোশ মাম্মা?”
ঘরে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা ছেয়ে গেলো, উপস্থিত সবার বিস্মিত দৃষ্টি মহিদের দিকে।
সবার তাকানো দেখে মহিদ হেসে বললো,,,
:-“চাচু বলেছে রোশ আমার মাম্মা হবে।”
মহিদের এমন হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গা দেখে কাশি উঠে গেলো তালহার। রেশমীও লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো, ড্রইং রুমের সবাই হেসে উঠলো মুহুর্তেই।
তৈমুর মহিদকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে বললো,,,
:-তোমার ছোট চাচু একদম ঠিক বলেছেন, রোশ তোমার মাম্মা। কিন্তু তুমি কি জানো এই বাড়িতে তোমার মত আর একটা বাচ্চা আছে?
মহিদের চোখ বড় হয়ে গেল।
:-সত্যি? কোথায়?”
তৈমুর ছোট চাচি কে ইশারা করলে সীমা শিকদার হেসে মহিদকে তন্ময়ের কাছে নিয়ে গেলেন। মহিদ নতুন বাচ্চা পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলো।
এদিকে ড্রইংরুমের এক কোণে সাইফ শিকদার ও আলিফ শিকদার আলভীর সাথে কথা বলছিলেন। যেহেতু আলভী,তালহার বাবা নেই, তাই আলভী’ই ভাইয়ের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছে।
তাদের দু ভাইয়ের ব্যবহার, বিনয়, আর আন্তরিকতায় সাইফ-আলিফ দুজনেই মুগ্ধ হলেন।
মাঝে হঠাৎ সায়ান হেসে বললো,,
:-আমার মতে হবু বর-কনেকে একটু একান্তে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত।”
সবাই সম্মতি জানালো।
তৈমুর তুলিকে বললো,,
:-তুলি, সারা আর সামিরা রেশমীকে ছাদে নিয়ে যাও, আমরা তালহাকে পাঠাচ্ছি।”
ওরা ছাদের দিকে রওনা দিলো রেশমীর চোখে-মুখে তখনও লাজুক আভা। পরিবারের সামনে এভাবেই সে লজ্জা পাচ্ছে।
এদিকে বড়রা নিজেদের মধ্যে গল্পে মগ্ন।
অন্য কোণে তৈমুর, আলভী, সায়ান, রাফি আর আবির বসে কিছু গোপনীয় কথাবার্তা শুরু করলো। যে কথাগুলো কেবল তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ,যেনো এই গোপনীয়তার এক ফোঁটা শব্দও বাইরে যাওয়া উচিত নয়।
***************
তুলি, সারা আর সামিরা রেশমীকে নিয়ে ছাদের দিকে উঠলো। সন্ধ্যার নরম আলো ছাদে এসে যেন সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। দূরে আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। ছাদের একপাশে বড় বড় টবে ফুল ফুটে আছে, বাতাসে গন্ধরাজের সুবাস ভেসে আসছে।
রেশমী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রেলিংয়ের ওপারে তাকিয়ে আছে। লাল শাড়ির আঁচল হালকা বাতাসে দুলছে। মনে হচ্ছে যেন এই নীরবতা ভেঙে কিছু বলার সাহস খুঁজছে সে।
তুলি মিষ্টি হেসে বললো,,
:-আচ্ছা, আমরা ওদিকটায় যাচ্ছি। তোরা নিজেদের মতো করে কথা বলে নে,
সারা রেশমীর কানে ফিসফিস করে বললো,,,
:-ভয় পেয়ো না আপু , তোমার তালহা স্যারের চোখে শুধু তোমার জন্য ভালোবাসাই দেখেছি আমরা।
সারার কথায় সামিরা,তুলি খিলখিলিয়ে হেসে সবাইকে নিয়ে ছাদের এক পাশে চলে গেলো।
এবার এপাশে ছাদে শুধু রেশমী একা দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরেই ছাদে উঠে এলো তালহা।
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো রেশমীর দিকে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রেশমীর দিকে তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ নয়নে। যেন বছরের পর বছর শুধু এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছে সে।
:-রোশি!
তালহার মৃদু কন্ঠে হালকা কেঁপে উঠলো রেশমী।
তালহা এগিয়ে এসে রেশমীর পাশ ঘেঁষে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। রেশমীর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,,
:-আজ তোমাকে এইভাবে দেখে মনে হচ্ছে, আমি আমার স্বপ্নটাকে হাতে পেয়ে গেছি,তালহার কণ্ঠে গভীর আবেগ।
রেশমী মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। মিনমিন করে বললো,,
:-সবকিছু যেন খুব হঠাৎ করে হচ্ছে… বিশ্বাসই হচ্ছে না, আজকের দিনটা সত্যি এলো আমাদের জীবনে।
তালহা এগিয়ে এসে তার ঠিক সামনে দাঁড়ালো।
:-এটা হঠাৎ করে হয়নি রোশি… আমি অনেক দিন ধরে এটার জন্য অপেক্ষা করেছি। লড়াই করেছি। তুমি জানো না, তোমাকে নিজের করে পাওয়ার চিন্তায় আমি কত রাত ঘুমাতে পারিনি।
রেশমীর শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো তালহার কথায়। গলা কেঁপে উঠলো,,,
:-আমি শুধু প্রার্থনা করতাম, আল্লাহ যেন আপনাকে আমার করে দেন… আজ মনে হচ্ছে, আমার দোয়া কবুল হয়েছে।
তালহা মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতো করে রেশমীর হাত নিজের হাতে নিলো।
:-তুমি জানো, তোমার হাসিটা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য?
রেশমীর চোখে জল এসে গেলো।
:-আর আপনার চোখের এই ভালোবাসা আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।
তালহা ধীরে হাত টেনে নিয়ে রেশমীকে প্রথমবারের মতো নিজের বুকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো।
হালকা বাতাসে রেশমীর শাড়ির আঁচল উড়ে গেলো, আর সেই বুকে থাকা অনুভূতির উষ্ণতা যেন সারা পৃথিবীকে ভুলিয়ে দিলো রেশমীকে। অজানা এক অনুভূতিতে সিক্ত হলো অন্তরের অন্তঃস্থল!
তালহা তার কানে ফিসফিস করে বললো,,,
:-প্রতিদিন তোমাকে এভাবেই কাছে চাই, রোশি… তুমি আমার জীবন, আমার শান্তি, আমার ভালোবাসা।
রেশমী চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্তটাকে নিজের হৃদয়ের গভীরে গেঁথে রাখলো। আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তালহার সুঠাম পৃষ্ঠদেশ।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, শুধু দূরে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের ধ্বনি।
মনে হলো, এই মুহূর্ত থেকেই তাদের নতুন জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হলো।
#চলবে
#সারা_জাহান
পর্ব,,,,৫০
মৌমো তিতলী
❤️
নেমেসিস সেলের অভ্যন্তরীণ এক কক্ষে মুকুল আর জাহাঙ্গীর কবির কে লোহার শেকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে। দু’জনেরই হাত ওপরের দিকে বাঁধা, মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে কালো পোশাক পরা সেলের গার্ডরা, সবার মুখে কালো মাস্ক, পরনে কালো ড্রেস,হাতে বড়বড় স্টেনগান।
সামনে এগিয়ে এলো নেমেসিস সেলের প্রধান গার্ড। ঠান্ডা, নিষ্ঠুর চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
:-তোমরা যেই নোংরা খেলা খেলেছো, তার শেষ আজ এখানেই হবে। আসছে তোমাদের জম। ততক্ষণে তোদের কে আরেকটু খাতিরযত্ন করি!! বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো গার্ডেরা।
শেকল মুক্ত করে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো দুজনকে। ভারী পদক্ষেপে এগিয়ে এলো এক মুখোশধারী।তার হাতে লোহার চাবুক, যেটার মাথায় ছোট ছোট কাঁটার মতো দাঁত।
প্রথম আঘাত পড়তেই জাহাঙ্গীরের মুখ থেকে বেরিয়ে এল দমবন্ধ করা চিৎকার। মুকুল ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু তারও পালা আসতে দেরি নেই।
সেদিনের ধরা পড়ার পর অজ্ঞান মুকুলের জ্ঞান ফিরলে নিজেকে এই ভয়ংকর জায়গায় আবিষ্কার করে সে। তারপর একসময় সেখানে নিয়ে আসা হলো জাহাঙ্গীর কবিরকেও। এর পর থেকে লাগাতার একই সাথে দুজনের ওপর পালাক্রমে শাস্তির অগ্নি বৃষ্টি চলছে।
শিকল, পানির বালতি, বিদ্যুতের তার সব কিছু প্রস্তুত। প্রতিটি শাস্তি ধীরে, নিখুঁতভাবে দেওয়া হচ্ছে, যেন তাদের অপরাধের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য একেকটা হিসাব চুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাইরের দুনিয়ায় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে,,শো শো বাতাসের ঝাপটা আর ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে মুখরিত ধরনী। অপরদিকে মাটির নিচে অন্ধকার এক দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে শুধু শিকল টানার শব্দ, লোহার আঘাত, আর করুণ আর্তনাদ। যেটার শব্দ হয়তো কোনোদিনই বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছাবে না।
আজকের রাত তাদের জন্য শেষ রাত। এখানেই শেষ হবে মুকুল আর জাহাঙ্গীর কবিরের গল্প।
জঙ্গলের গভীরে ঢুকলেই যেখানে শব্দ থেমে যায়। সেখানে গাছের মাথা এমনভাবে আকাশ ঢেকে রেখেছে যে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছায় না।
সেই জঙ্গলের গভীরে, বুনো গাছগাছালির ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ প্রাচীন এক ভগ্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। চারপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু রাতের অন্ধকারে শেয়ালের ডাক আর মাঝে মাঝে বাতাসে দুলে ওঠা শুকনো পাতার খসখস শব্দ। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এ জায়গাটা বহু বছর ধরে জনমানবশূন্য। কিন্তু মন্দিরের ভাঙা সিঁড়ির এক পাশে, পাথরের নিচে লুকানো আছে গোপন প্রবেশপথ। যেটা কেবলমাত্র নেমেসিস সেলের সদস্যরাই জানে।
সেই ভাঙ্গা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তৈমুর আর সায়ান।
তৈমুর এগিয়ে গেলো কয়েক পা। মন্দিরের ভেতরে ঢুকে গোপন পাটাতনের সিল্টের ওপরে নিজের হাতের ছাপ রাখার সঙ্গে সঙ্গে খট করে একটা শব্দ হলো। মুহুর্তেই বেরিয়ে এলো একটা ধাতব পদার্থের তৈরি হাতল।
সায়ান হাতল টা টেনে খোলার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে ভেসে আসে ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে বাতাস। দেখা মিললো এক গোপন সিঁড়ির ।
পরপর দুজন সিক্রেট সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। পৌঁছালো ভয়ঙ্কর এক দুনিয়ায়। নেমেসিস সেল, যেখানে ধরে আনা শিকারদের প্রতি কোনো করুণা নেই, নেই মুক্তি।
মাটির নিচের বিশাল চেম্বারে দেয়ালগুলো ইস্পাতের, প্রতিটি কোণে মোটা শিকল, আর ছাদের সাথে ঝোলানো মরচে ধরা লোহার হুক। মৃদু আলো জ্বালানো বাল্বগুলো দুলছে, আর সেই আলো-ছায়ার খেলায় প্রহরীর দায়িত্বে থাকা এক একজনের মুখগুলো আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
সিঁড়ি বেয়ে দশ ফুট নিচে নামতেই একটা করিডোরে। সেখানে পেছনের দিকের দেয়ালে হাত দিলে ধাতব ঠকঠক শব্দ শোনা যায়। আসলে সেটা এক গোপন দরজা। কিন্তু দেখলে মনে হবে কোন শক্ত পাথরের দেয়াল মাত্র। ভারী সেই পাথরের স্ল্যাব সরাতেই দেখা যায় সরু, পাকানো আরো একটা সিঁড়ি নেমে গেছে অন্ধকারের দিকে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই অনুভূত হয় স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা হাওয়া, যেন ভূগর্ভস্থ কোনো প্রাণঘাতী গুহায় ঢুকে পড়েছে। দেয়ালে মরিচা ধরা চেইন, ছাদ থেকে ঝুলে থাকা লোহার হুক, মেঝেতে জমে থাকা শুকনো রক্তের দাগ। সবই বলে দেয় এখানে কোন অপরাধী সজ্ঞানে একবার ঢুকলে আর ফেরার পথ নেই। বাতাসে যেন ধাতব গন্ধের সাথে পচা রক্ত মাংসের আভাস মিশে আছে।
এখানে দাঁড়িয়ে আছে নেমেসিস তৈমুর জাহান শিকদার। সাথে সায়ান, রাফি, আর আবির।
রাফি এগিয়ে এসে বললো,,,
:-দোস্ত এই জাহাঙ্গীর শালা পাক্কা ইবলিশ মাইরি! ওর এক একটা অপরাধের লিস্ট করে, লিস্ট অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করেছি,মাগার লিস্টই শেষ হয়না। এই জাহাঙ্গীর কি সত্যিই ডাক্তার ছিলো নাকি কষাই!
রাফির কথায় আবির কিছুটা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,,,
:-তুই জাহাঙ্গীরের অপরাধের লিস্ট শেষ করতে হিমসিম খাচ্ছিস,ভাব একবার এরশাদ হামিদ ধরা পড়লে কি পরিণাম হবে!
রাফি ঘৃন্য দৃষ্টিতে তাকালো জাহাঙ্গীরের দিকে। পাশের ডেস্ক থেকে একটা লিস্টের খাতা নিয়ে বসে পড়লো সেখানে। আবির তৈমুরের দিকে তাকালে তৈমুর ইশারা করে, তৈমুরের ইশারা বুঝতে পেরে আবিরও পা চালিয়ে অপারেশন সেকশনে গিয়ে ঢুকলো। হয়তো এরপর তার কাজ শুরু হবে।
তৈমুর ধীর পায়ে এগিয়ে আসে, হাতে কালো গ্লাভস পরে নেই। তার চোখে শীতল এক ধারালো দৃষ্টি।
তৈমুর আরামসে গিয়ে জাহাঙ্গীর কবিরের সামনে চেয়ার টেনে বসে।
হাঁপিয়ে ওঠা ক্লান্ত দৃষ্টিতে তৈমুরের দিকে তাকায় জাহাঙ্গীর কবির। নিজ পায়ে উঠে দাড়ানোর শক্তিটুকু আগেই হারিয়েছে। আতঙ্কে হৃদপিন্ডটা কাঁপছে ধকধক ধকধক। বহু কষ্টে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করার চেষ্টা করে জাহাঙ্গীর কবির,,
:-মা…ফ করে দাও তৈমুর।
বাক্যটা কানে পৌঁছাতেই নাক কুঁচকে তাকালো তৈমুর। তাচ্ছিল্য করে বললো,,
:- মানুষের জীবন বাঁচানোর শপথ নিয়েছিলি,,,, অথচ মানুষের অঙ্গ বিক্রি করেছিস কালোবাজারে। নিষ্পাপ মেয়েগুলো কে পাচার করেছিস শুধুমাত্র কয়েকটা টাকার লোভে। আর মায়া..মায়া কি ক্ষতি করেছিলো তোদের! যে তাকে শুধু মৃত্যুই দিয়ে ক্ষান্ত হসনি। ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটাকে তোরা ধর্ষণ করেছিস, নিজের হাতে গলায় দড়ি দিয়ে তার শেষ নিঃশ্বাস টুকুও কেড়ে নিয়েছিস।”তখন নিশ্চয় মায়া চিৎকার করেছিলো, তোদের মত নরপশুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করেছিলো। মৃত্যুর অন্তিম প্রহরে মরণ যন্ত্রণায় কাতরেছিলো। ওর তো কোন অপরাধই ছিলো না,,তাও তাকে ক্ষমা করেছিলি তোরা? আর আজ নিজের বেহিসাব পাপের পাহাড় সামনে দেখেও ক্যামনে ক্ষমা চাইলি? If you forgive a brute like you, Maya’s soul will not find peace. শান্তি পাবে না ওইসব নিষ্পাপ মেয়ে গুলো যাদেরকে তুই অন্ধকারের নরক যন্ত্রণায় ঠেলে দিয়েছিস। শান্তি পাবে না ওই সকল পথ শিশুরা যাদেরকে বিনা দোষে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষা করিয়েছিস। তাদের শরীরের অঙ্গ হয়েছে তোদের লোভের অংশ। এত অপরাধের পরেও ভাবলি কি করে যে তোকে ক্ষমা করে দেবো?
জাহাঙ্গীরের গলায় শুকনো থুথু গিলে ফেলার শব্দ শোনা যায়। মাথাটা কেমন ভো ভো করছে জাহাঙ্গীরের।
:-আমি… আমি শুধু ব্যবসা করছিলাম… মায়ার ব্যাপারটা ভুল ছিল, কিন্তু”
তৈমুর হঠাৎ সামনে ঝুঁকে তার মুখ চেপে ধরে,,,
:-“চুপ! আজ তোর শরীর দিয়ে শেখানো হবে, অঙ্গ কেটে বিক্রি করা কেমন লাগে।”মেয়ে দেখলেই লালসা জেগে ওঠে তাইনা? তোকে আজ এমন এক নরকের মাঝে দাড় করাবো, যেখানে প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ডে তুই নিজের মৃত্যু কামনা করবি, কিন্তু এত সহজে তোর মৃত্যু হবে না।
পাশ থেকে সায়ান অন্ধকারে মৃদু হেসে ওঠে,,,
বুঝলে চান্দু! তোর হাসপাতালের সার্জারি রুমে হয়তো আলো, অ্যানাস্থেশিয়া ছিলো। কিন্তু এখানে শুধু থাকবে ব্যথা, আর অন্ধকার।”😁
তৈমুর ইশারা করতেই আবির এগিয়ে আসে। তার হাতে স্ক্যালপেল আর ট্রে ভর্তি ধারালো সার্জিক্যাল টুলস।
আবির শীতল কণ্ঠে বলে,,,
:-প্রথমে তোর পাঁজরের হাড় খুলবো। তারপর তোর হৃদয়… এই অপারেশন তোকে বাঁচানোর জন্য নয়, নেমেসিসের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে রাখার জন্য।
জাহাঙ্গীর আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে,,,
:-না! আমাকে ছেড়ে দাও! আমি টাকা দেবো, যত লাগে। তৈমুর….দেখো আমার কথা শোনো, তোমার কত টাকা চায় বলো! সব দেবো সব। তবুও আমাকে প্রাণে মেরো না। দয়া করো। বলতে বলতে জাহাঙ্গীর কবির তৈমুরের পা জড়িয়ে ধরে।
তৈমুর জাহাঙ্গীর কবিরের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,,
:-তুই দু পয়সার পালতু কুত্তা,,তৈমুর জাহান শিকদার কে টাকা দেখাস?? বলেই জাহাঙ্গীর কবিরের মুখ বরাবর স্বজোরে লাথি দিলো।
ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো জাহাঙ্গীর কবির। তৈমুর আবারো হিসহিসিয়ে বললো,,
:-তৈমুর জাহান শিকদার টাকায় বিক্রি হয় না, তার এই Black State নেমেসিস টাকায় বিক্রি হয় না। Can you hear me? বলেই কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো জাহাঙ্গীর কবিরের গালে।
সায়ান কে ইশারা করতেই , জাহাঙ্গীর কবির কে ধরে হ্যাঁচকা টানে অপারেশন টেবিলে শুইয়ে দেয় সায়ান। চার হাত পায়ে ক্রাফ দিয়ে আটকে দেয়।
আবির দক্ষ হাতে স্ক্যালপেল চালায়। চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে পড়ে ঠান্ডা স্টিলের টেবিলে। জাহাঙ্গীরের মরণ যন্ত্রণার চিৎকার মিশে যায় সেলের প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে। ভয়াবহ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তার কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায় ভূগর্ভস্থের আড়ালে।
অন্য চেম্বারে, মুকুলকে হাঁটু গেড়ে বসানো হয়েছে বরফ-ঠান্ডা মেঝেতে। হাত-পা শক্ত চেইনে বাঁধা। তার চোখে আতঙ্ক, শরীর কাঁপছে।
সায়ান ধীর পায়ে এগিয়ে আসে, চারপাশে ঘুরতে থাকে শিকারির মতো।
:-নারী পাচার, অঙ্গ পাচারে হাত লাগিয়েছিস। তর পাপ এই পর্যন্তই কাফি ছিলো, কিন্তু তোর আবার মরণের পাখনা গজাইলো,তুই সরাসরি হাতা মারলি তৈমুর জাহান শিকদারের বোন রেশমীর দিকে। তাকে ট্রাক চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিস। সেই ট্রাকের ধাক্কায় আহত হলো কে??? তর জম, তৈমুরের প্রাণভোমরা। তুই নিজেও জানিস না তোর মৃত্যু পরোয়ানা সেখানেই সেটে গেছে। I feel so helpless for you bro….বলেই লম্বা করে দম ছাড়লো সায়ান।
মুকুল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,,,
:-আমি… আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি স্যার! আমি শুধু এরশাদ হামিদের আদেশ মেনে চলছিলাম! আমি কাউকে মারতে চাইনি! বিশ্বাস করেন স্যার! আমার কোন দোষ নাই।
সায়ান হঠাৎ তার চুল ধরে মাথা পেছনে টেনে তোলে,,,
:- তরে,আর বিশ্বাস? ছ্যাঃ 🤧
কারো আদেশ মেনে অপরাধ করা কাপুরুষের কাজ। আর কাপুরুষদের শাস্তি হয় ধীরে ধীরে। বুঝলি….
ঠিক তখনই তৈমুর ভেতরে ঢোকে, হাতে ভারী বৈদ্যুতিক শক ডিভাইস। মুকুলের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,,,
:-তোর মেয়েদের নাচানোর খুব শখ তাইনা? মেয়ে দেখলেই তাকে ছোঁয়ার জন্য তোর হাত নিশপিশ করে। আজ তোর শরীর দিয়ে বাজবে মৃত্যু সঙ্গীত। তাতে গাইবিও তুই আর নাচবিও তুই!!
প্রথম শক লাগতেই মুকুলের শরীর ছিটকে ওঠে, মুখ দিয়ে চাপা চিৎকার বের হয়। সায়ান বারবার পানি ঢালে তার মাথায়, যাতে শক আরও তীব্র হয়।
দরজায় দাঁড়ানো রাফি ঠান্ডা গলায় বলে,,,
এই লুল্লার বাচ্চার প্রতিটা অপরাধ আমি লিখে রেখেছি। এই শকের পর মাইনাস -50°C বা তার নিচে হবে এই লুল্লার শেষ হিসাবের লাইন।”
মুকুল কাঁদতে কাঁদতে কোনমতে গোঙানির মতো আওয়াজ করে বলে,,,
:-আমাকে মেরে ফেলো না! আমি সব বলবো! এরশাদ হামিদের খোঁজও দেবো। আমাকে মেরো না।
তৈমুর হাত উঠিয়ে বললো,,
:-এখানে অপরাধীর জন্য দয়া বলে কিছু নেই। আর এরশাদের খোঁজ তোকে দিতে হবে না। I know where he is… তুই আমার কলিজায় আঘাত করেছিস,তাকে কুৎসিত ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলি না তুই? তোর এই হাত আমি এসিডে ঝলসে দেবো।
বলেই পাশে রাখা একটা কাঁচের পাত্রের সবটুকু তরল ঢেলে দিলো মুকুলের ডান হাতের ওপর।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো মুকুল। হাতের চামড়া, মাংস গলে গলে পড়তে লাগলো মুহুর্তেই। মুকুলের যন্ত্রণায় ছটফটানি দেখে তৈমুর ঠান্ডা গলায় বলে,,,
:-তোকে ক্ষমা করা এই তৈমুর জাহান শিকদারের বড় অন্যায় হবে। অন্যায় করা হবে তার প্রাণের সাথে। তার তোতাপাখির সাথে অন্যায় হবে সেটা তো হতে দিতে পারে না তৈমুর। কিছুতেই না!
শেষ শকে মুকুলের শরীর নিথর হয়ে যায়। চারপাশে শুধু নেমেসিস সেলের ঠান্ডা নীরবতা। রাফি আর সায়ান মুকুলের অচেতন দেহটা তুলে ফ্রিজার রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে লক করে বেরিয়ে আসে।
আপাতত আজকের মতো তাদের কাজ শেষ। এবার শুধু মাত্র এরশাদ হামিদ কে কব্জা করার অপেক্ষা।
************
তুলি নিজের রুমে বসে বসে লাগেজে জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখছে। রাতের ডিনার সেরে সায়ানের সাথে বাসায় ফিরে যাবে তারা। সারা আর রেশমী হেল্প করছে তুলি কে।
রেশমী হাতের ওড়না ভাঁজ করতে করতে বলে,,,
:-তুই আর কয়দিন থেকে যা তুলি। তোকে কেমন যেনো অসুস্থ মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাসায় গিয়ে একা কি করে থাকবি। সায়ান ভাইয়া ফিরলে না হয় আমি আর সারা ভাইয়াকে বলবো।
তুলির আসলেই কয়েকদিন ধরে কেমন দুর্বল লাগছে। তবুও রেশমীর কথায় ক্লান্ত মুখে হাসি টেনে বললো,,,
:-ধুরর কোথায় অসুস্থ লাগছে আমাকে? আর সায়ান কে বললেই তো নিয়ে আসে এবাড়িতে। এতো ভাবিস না তো। আমি ঠিক আছি।
রিনা শিকদার কিছু আচারের বয়াম গুছিয়ে রাখছে একটা বক্সে। তুলির জন্য কয়েক পদের আচার বানিয়েছেন তিনি। মেয়েটা আগাগোড়ায় মায়ের হাতের আচার খেতে ভালোবাসে। এবারো তুলি আবদার করলো তার আচার খেতে ইচ্ছে করছে। এই জন্যই কাজের ফাঁকে হাতে হাতে বানিয়ে রেখেছেন তিনি। আজ মেয়েটা চলে যাবে। মায়ের মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে। শশুর শাশুড়ি ছাড়া ও বাড়িতে মেয়েটা একা একা কিভাবে থাকে কে জানে! তবুও সায়ান তুলির বড় খেয়াল রাখে তাই রিনার ভরসা।
সিমা শিকদার কিচেন থেকে একটা গরুর মাংসের আচারের বয়াম হাতে ড্রইং রুমে আসলেন। রিনার হাতে বয়াম টা দিয়ে বললেন,,,
:-আপা মেয়েরা শশুর বাড়ি চলে যাওয়ার সময় এমনিই খারাপ লাগে তাইনা? কয়দিন পর তো আমার রেশমীও এমন শশুর বাড়ি চলে যাবে! ভাবলেই কেমন বুকটা শূন্য হয়ে যায়।
সিমার কথায় রিনা হেসে বলে ,,,,
:-এটাই তো নিয়ম ছোট! তুই, আমি আমদের সব মেয়েদের এভাবেই বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়!
এমন সময় তুলির রুম থেকে সারা আর রেশমির চিৎকার শুনে রিনা আর সীমা দু’জনেই চমকে ওঠেন। হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসেন তুলির রুমে।
রুমে এসে দেখতে পান,তুলি অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। সারা কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলেছে। রেশমী তুলির জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেছে।
রিনা শিকদার দ্রুত পায়ে তুলির কাছে গিয়ে মেয়েকে আগলে ধরলেন। বিচলিত হয়ে বললেন,,,
:-কি হলো আমার মেয়েটার? ও রেশমী কি হলো তুলির?
:-জানি না বড়মা। তুলি তো আমার আর সারার সাথে কথা বলছিলো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বিছানার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো!
নিচ থেকে মেয়ের রুমে হৈচৈ শুনে সাইফ শিকদার হন্তদন্ত হয়ে ওপরে ছুটে এলেন। ঘটনা জেনে তাৎক্ষনিক ফোন করলেন তৈমুর কে। রিসিভ হতেই বিচলিত কন্ঠে সবটা জানিয়ে জলদি বাসায় আসতে বললেন তিনি।
দশ মিনিটের মধ্যেই শিকদার হাউসে পৌঁছে যায় তৈমুর আর সায়ান। তৈমুর দ্রুত পায়ে ছুটলো বোনের কামরায়। সায়ানের হাত পা কাঁপছে। হৃদয়টা হাহাকার করছে তার প্রিয়তমার অসুস্থতার কথা শুনে। এলোমেলো পায়ে তুলির রুমে গেলো সায়ান। তুলিকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো দরজায়।
তৈমুর তুলির পাশে বসে। স্থেটিসকোপ ঠেকিয়ে তুলির হার্টবিট চেইক করলো। পরপর বোনের হাত ধরে পার্ল্সরেট পাও চেইক করলো।
রিনা শিকদার সায়ান কে দরজায় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলির পাশ থেকে উঠে সরে দাঁড়ালেন। শাশুড়ির প্রস্থান বুঝতে পেরে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তুলির পাশে বসলো সায়ান।
কামরায় উপস্থিত সকলেই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তৈমুরের দিকে। তৈমুর বোনের আরো কিছু Symptoms চেইক করে সবার দিকে কেমন উত্তেজিত দৃষ্টিতে তাকালো।
রিনা শিকদারের বুকটা তিরতির করে কাঁপছে। কি হলো তার মেয়েটার! তৈমুর কেনো কিছু বলছে না?
সাইফ শিকদার অধৈর্য হয়ে তৈমুর কে সুধালেন,,,
:-তৈমুর হয়েছেটা কি? তুলি ঠিক আছে তো? কিছু বলছ না কেন?
তৈমুর বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,,,
:-আমার বোন এখন এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবে না। এখন থেকে তুলি এই বাড়িতে থাকবে।
সায়ানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কি বলছে তৈমুর! তাকে বউ ছাড়া করার ষড়যন্ত্র! কাভি নেহি!
সায়ান হাঁ করে তাকিয়ে আছে তৈমুরের মুখের দিকে।
সায়ানের হতভম্ব মুখ দেখে মুচকি হাসলো তৈমুর।
:- কনগ্রাচুলেশন ! You’re going to be a father, সায়ানাইড!!. আমি মামা হতে চলেছি!!!
তৈমুরের কথায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো শিকদার হাউসের প্রত্যেকটা সদস্য। রিনা শিকদার তো অচেতন অবস্থায়ই তুলির কপালে চুমু এঁকে দিলেন।
সারা আর রেশমী দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো।
সাইফ শিকদার হাসতে হাসতে আলিফ শিকদার কে ফোন করে খবরটা জানিয়ে মিষ্টি কিনতে চললেন।
সায়ান এখনো দম মেরে বসে আছে! তার দৃষ্টি অচেতন প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না সায়ান। সে বাবা হতে চলেছে! বাবা! They are going to be parents. চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠলো সায়ানের।
তৈমুর সায়ানের কাঁধে হাত রেখে চোখের ইশারায় নিজেকে সামলাতে বললো। জানালো কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফিরবে তুলির। সায়ানকে তুলির কাছেই থাকতে বলে সারা কে রুমে আসতে বলে বেরিয়ে গেলো তৈমুর।
তৈমুরের পিছনে সারা আর রেশমীও বেরিয়ে আসলো। সারা তাদের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রেশমীও নিজের রুমে গিয়ে ফোন করে প্রিয় মানুষটাকে সুখবর টা জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
#চলবে