সাহেবা পর্ব-১১+১২

0
49

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___

১১.
পরেরদিন সকাল সকাল সাইরাহ্-র বড় বোন সাইমা আসে বাড়িতে৷ ছোট বোনের আবার বিয়ে হবে শুনে কোনো রকমে শ্বশুরবাড়ির মানুষকে মানিয়ে, বুঝিয়ে বাপের বাড়ি আসে। হাতের, গলার, শরীরের বিভিন্ন জায়গার ক্ষ’তকে আড়াল করে মায়ের সামনে হাসিমুখে দাঁড়ায়। তাহেরা বড় মেয়েকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে সে কি খুশি! মেয়ের বিয়ের ৪ বছরের মধ্যে বাপের বাড়ি গুণে গুণে বোধহয় ৬ বার এসেছে এবার নিয়ে। সাইমাকে দেখে বাড়ির সবাই ই খুশি হয়। সাইমা কাপড়ের ব্যাগসহ ঘরে ঢুকে। সাইরাহ্ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বোনকে৷ সাইমা ব্যাথা পেলেও নিজেকে সামলে হাসিমুখে বলে,

‘ভালো আছিস বোন?’

‘তুমি ভালো আছো বুবু? এতোদিন পর আসলে! তোমার শ্বশুরবাড়ির সবাই এতো জ’ল্লাদ কেন বুবু?’

সাইমা হাসে। বোনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পড়নের শাড়ি খুলতে শুরু করে। স্পষ্ট ভেসে ওঠে গায়ের কা’ল’শিটে দাগ। সাইরাহ্-র দৃষ্টি এড়ায় না সেই দাগ। সাইমার হয়তো খেয়াল ছিলো না। সাইরাহ্ সাইমার হাত ধরে নিজের দিকে ফিরায়। শান্ত কন্ঠে শুধায়,

‘তোমার গায়ে এতো দাগ ক্যান বুবু?’

সাইমা আঁতকে ওঠে। সাইরাহ্-র থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকে। কোনো রকমে বলে, ‘কোনো দাগ নাই।’

‘মিথ্যা বলবা না বুবু। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক তোমারে মারে বুবু?’

সাইরাহ্-র মুখ চেপে ধরে সাইমা। নিচু স্বরে বলে, ‘আস্তে বল!’

সাইরাহ্ কিছু বলার আগেই তাহেরার ডাক পড়ে। সাইমা ‘আসতেছি’ বলে আরেকটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নেয়। বোনকে সাবধান করে বলে যেনো সে কাউকে কিছু না বলে। রাতে তাকে সবটা বলবে। সাইরাহ্ কোনো জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। গায়ের রঙও চেপে গেছে। আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই। সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বোনটাও ভালো নেই। তার না হয় স্বামী নেই সংসার নেই। সে না হয় অলক্ষী তাই তার ভালো থাকার অধিকারও নেই। কিন্তু সাইমা! তার তো স্বামী আছে, সংসার আছে তবুও কেনো সে অসুখী? কেনো তার শরীরে এতো এতো মা’রের দাগ? প্রশ্ন থাকলেও উত্তর নেই৷ সাইরাহ্ অপেক্ষা করে রাতের। যখন সে তার বোনকে একা পাবে আর সব টা শুনতে পাবে৷ সেদিন আর বাড়ি থেকে বের হয় না সাইরাহ্। সারাদিন সাইমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। অনেক অপেক্ষার পর আসে রাত। চারপাশ যখন ঘুমন্তপুরী তখন দু বোন জেগে গল্প করছে৷ কথার এক পর্যায়ে সাইরাহ্ ফের প্রশ্ন করে তার গায়ে এতো দাগ কেনো? বিনিময়ে হাসে সাইমা। ব্লাউজ খানিকটা টেনে তুলে দাগের ওপর হাত বুলায়। হেঁসে বলে,

‘স্বামী, শ্বাশুড়ির ভালোবাসা এগুলা। তারা এতো বেশি ভালোবাসে যে তা শরীরে দাগ হয়ে থাকে। ছেলের বউ তাদের পছন্দ না। বাপের ঘর থেকেও ভরি ভরি সোনা, যৌতুক দেওয়া হয়নি। তাহলে তারা ভালোবাসবে কেনো? প্রতিদিন খোটার সাথে থাকে এই ভালোবাসাগুলো।’

সাইরাহ্ বোঝে বড় বোনের ব্যাথা। ব্যাথিত কন্ঠে বলে, ‘বুবু! এতো কিছু সহ্য করে থাকো কেনো?’

সাইমা ফের হাসে। বোনের দিকে ফিরে শুয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে, ‘পৃথিবীটা বড্ড নিষ্ঠুর রে বোন। সংসার ছেড়ে চলে আসলে আমাকে ওরা বাঁচতে দেবে না রে। তুই যে যন্ত্রণা সহ্য করছিস আমারও সেসব সহ্য করতে হবে না। আমি তো এতো কিছু সহ্য করে বাঁচতে পারবো না। আমার যে অতো সহ্যক্ষমতা নেই। তার থেকে না হয় স্বামী, শ্বাশুড়ির অত্যাচারই সহ্য করে নিলাম।’

সাইরাহ্ জড়িয়ে ধরে সাইমাকে। সাইমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে এতো দিনে বুঝে গেছে সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মটাকে। তারও তো ভীষণ ইচ্ছে হয় ওই সংসার থেকে বের হয়ে আসতে কিন্তু সে তো মেয়ে। তার যে এই অধিকার নাই। কতক্ষণ দু বোন নীরবতাতেই কাটায়। তারপর সাইমা উপদেশের সুরে বলে,

‘শুনলাম তোর হবু স্বামী নাকি আমাদের বাবার বয়সী? তুই ওই লোকটাকে বিয়ে করবি?’

‘আমি জানি না বুবু। আমি জানি না আমার ভাগ্যে কি আছে! জানি না কি হবে! আমার সবকিছুর ওপর থেকে মন থেকে উঠে গেছে। মন চায় শুধু সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে।’

‘এই সমাজ এতো সহজে মুক্তি দেবে না বোন।’

সাইরাহ্ উপরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বোনের কথার পিঠে সে কথা বলে না। সে জানে সে এতো সহজে মুক্তি পাবে না। সাইমা সাইরাহ্-র মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘তুই না চাইলে বিয়েটা ভেঙে দে।’

‘আমার চাওয়াতে কি কখনো কেউ দাম দিয়েছে বুবু? বিয়েটা হোক এটা আব্বা চায়। আমি বললেই বিয়ে ভাঙবে না।’

‘আব্বা চায় আমিও জানি। লোকটার টাকা পয়সার অভাব নেই। তারওপর বয়সও তো কম না! আব্বা চায় তুই এই বাড়ি থেকে বিদায় হ। কিন্তু অন্যের ইচ্ছারে দাম দিয়া নিজের জীবন নষ্ট করিস না। তোর বয়সও কিন্তু ম্যালা না। ভাইবা দেখ!’

সাইরাহ্ আর জবাব দেয় না। চোখ বন্ধ করে বোনের বুকে পড়ে থাকে। জীবন তাকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে তার জানা নেই। স্রোতের টানে সে ভেসে যাচ্ছে ঠিকই তবে জীবনটা যেনো থেমে গেছে আরো আগেই।


নাজিরা শুনেছে সাইরাহ্-র বিয়ের কথা। যেমন অবাক হয়েছে তেমন মনের এক কোণে খুশিরাও দানা বেঁধেছিলো। তবে যারা ভালোবাসে তারা সহজে স্বার্থপর হতে পারে না। ভালোবাসার মানুষকে অসুখী দেখতে পারে না। নাজিরার স্বার্থটুকুও ফুরিয়ে যায়। নিজের কষ্ট গিলে নিয়ে, নিজেকে শক্ত করে সীমান্তের কাছে যায়। সীমান্ত তখন নিজের ঘরেই ছিলো। নাজিরা এসে ছন্দ আর বেলীর সাথে কতক্ষণ কথা বলে এগোয় সীমান্তের ঘরের দিকে। আশে পাশে একবার তাকিয়ে সীমান্তের ঘরের ভেতর ঢুকে সরাসরি প্রশ্ন করে,

‘সীমান্ত ভাই, এসব কী শুনলাম? সাইরাহ্ বুবুর কিসের বিয়ে? আপনি না উনাকে ভালোবাসেন!’

সীমান্ত হঠাৎ কথাগুলো শোনায় চমকে তাকায়। সামনে নাজিরাকে দেখে শান্ত হয়ে যায়। অন্যমনষ্ক হয়ে বলে, ‘তুমি ছোট মানুষ। এসবে ঢুকো না।’

‘জ্ঞান আমাকে পরেও দিতে পারবেন। আগে ঠিক করেন এখন কী করবেন? নাকি কিছুই করবেন না? সাইরাহ্ বুবুর বিয়ে হতে দিবেন?’

‘যাকে ভালোবাসি তার বিয়ে হতে দেবো?’

‘তাহলে কিছু করছেন না কেনো? আর আজ, কাল গেলেই পরশু বিয়ে। আপনি এখনও এভাবেই থাকবেন?’

‘আমি জানি না।’

নাজিরার রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ হয়। রাগের মাথায় সীমান্তের ঘরে থাকা টেবিলের ওপরের গ্লাসটা হাত দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। সীমান্ত চমকে তাকায়। নাজিরা আঙুল তুলে বলে,

‘আপনাদের মতো পুরুষরা ভালোবাসা পাওয়ার-ই যোগ্য না সীমান্ত ভাই। আপনারা ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করার চেষ্টা না করে দেবদাস হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করেন। আবার ঢং করে বিষাদ দেখান! আপনি পুরুষ মানুষ, আপনি চাইলেই অনেক কিছু সম্ভব। সাইরাহ্ বুবুর সাথে কথা বলেন। নিজের বাবার সাথে কথা বলেন। ভালোবাসার মানুষকে শুধু ভালো না বেসে তাকে আপন করার চেষ্টা করেন।’

নাজিরা ঠা’স করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। সীমান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নাজিরা যেনো মুখের ওপর তাকে অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়ে গেলো। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নেয়। কঠিন সিদ্ধান্ত।

নাজিরা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে শ্বাস আটকে সরাসরি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়৷ বড় বড় শ্বাস নিয়ে কান্না আটকায়। চোখের কোণটা জ্বালা করে। তবে মনের ক্ষো’ভ থেকেই আওড়ায়,

‘আপনি আমাকে ভালোবাসেননি ভালো হয়েছে। আপনি শুধু উন্মাদের মতো ভালোই বাসতে পারেন কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন না। এরকম ভালোবাসা আমি কখনোই চাইনি। আপনি ভালোবেসেও পুরোপুরি ব্যর্থ পুরুষ।’


আজ, কাল বাদে পরশুই সাইরাহ্-র বিয়ে। সাইরাহ্ কি করবে কিংবা কিভাবে আটকাবে তা তার জানা নাই। এই বিয়ে করলেও তার জীবন্ত লা’শ হয়ে যাবে আর বিয়েটা না করলেও তার বাবা তাকে বাঁচতে দিবে না। এরকম জীবন নিয়ে বাঁচার থেকে ম’রে যাওয়া ভালো কিন্তু তাকে তো একবারে মা’রা হবে না। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে মা’রবে। আর এইটা যে তার সহ্য ক্ষমতার বাহিরে চলে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে নদীর পাড়ে যায়। শান বাঁধানো সিড়িতে বসে পানিতে পা ভেজায়। সেই পায়ের দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ পরেই কানে আসে সীমান্তের কন্ঠ। সাইরাহ্ পিছু ফিরে তাকায়। সীমান্ত এক প্রকার ছুটে আসে৷ কোনো কিছু না দেখে সাইরাহ্-র পাশে বসে খপ করে তার হাত আঁকড়ে ধরে। সাইরাহ্ চমকে ওঠে। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই সীমান্ত গড়গড় করে বলে,

‘তোমাকে কাল দেখতে আসছিলো? তোমার ৩ দিন পর বিয়ে? তুমি বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে সাইরাহ্? তুমি আবার আমাকে ছেড়ে যাবে?’

সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সীমান্ত একের পর এক প্রশ্ন করেই যায়। সাইরাহ্-র জবাব না পেয়ে করুণ চোখে তাকায়। সীমান্ত যখন চুপ হয়ে যায় তখন সাইরাহ্ অনুভূতিহীনের মতো আওড়ায়,

‘আমার কিছু করার নাই সীমান্ত ভাই। আমি জানি না জীবন আমার কাছে কী চায়!’

‘তুমি কি চাও?’

সাইরাহ্ সহসাই জবাব দিলো না। কান্নাগুলো হজম করে নিয়ে কোনোমতে বলে, ‘মেয়েদের চাওয়া বলতে কিছু হয়না সীমান্ত ভাই। আর বিধবা মেয়ে হইলে তো কোনো কথা-ই নাই। এখানে পুরুষদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এতে আমরা কি চাই তা দেখা হয় না।’

সীমান্ত ব্যাথিত নয়নে তাকায়। সাইরাহ্ হাসে। হাত আলগোছে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘৩ দিন পর আমি অন্যের ঘরের ঘরণী হবো। দয়া করে আমাকে ছুঁয়ে আমার কলঙ্ক বাড়াবেন না।’

সীমান্ত পিছিয়ে বসে। হাত মুঠো করে বসে থাকে। পুরুষ মানুষের কান্না করা বারণ। এ কারণেই বোধহয় সীমান্ত কাঁদতে পারে না। সামান্য দূরত্বে দুটো মানুষ বসে থাকে। দৃষ্টি তাদের নদীর পানির দিকে। চারপাশে মাগরিবের আযান পড়লে হুশ ফিরে সাইরাহ্-র। বসা থেকে উঠে হাঁটা লাগায় দ্রুত। সিড়ি ডিঙিয়ে চলে যাওয়ার আগে সীমান্তের উদ্দেশ্যে বলে যায়,

‘আপনি শুধু আমাকে ভালোইবাসেন সীমান্ত ভাই। আমাকে চাইলে আপন করে নেওয়া যাবে এ বোধহয় আপনার চিন্তায় আসে না। তাই না?’

সীমান্ত পিছু ফিরে তাকায়। সাইরাহ্ আর দাঁড়িয়ে নেই। হাঁটতে শুরু করেছে৷ নদীর পাশ দিয়ে আসার সময় সাহিত্যকে দেখে সাইরাহ্। দাঁড়িয়ে আছে নদীরে কিনারে। সাইরাহ্ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্যকে পাশ কা’টিয়ে চলে যেতে নিলে সাহিত্য গম্ভীর কন্ঠে ডাকে,

‘সাহেবা!’

সাইরাহ্ দাঁড়িয়ে যায়। তাকায় সাহিত্যের দিকে। সাহিত্যের চোখে মুখে আজ অন্যকিছু ছিলো। রাগ নাকি কষ্ট! পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। সাহিত্য চোখ ফিরিয়ে একবার অন্যদিকে তাকায়। নিজেকে সামলে নিয়ে স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করে,

‘তোর বিয়ে?’

সাইরাহ্ উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। সাহিত্য সরাসরি সাইরাহ্-র সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে, ‘কার সাথে? এক বুইড়া ব্যাটা তোরে দেখতে আসলো আর তুই রাজি হয়ে গেলি! জীবনডা কী মজা মনে হয় নাকি?’

‘সবাই মজা-ই মনে করতেছে সাহিত্য ভাই। কে, কোথায়, কবে আমার কথাকে কথা মনে করেছে? আমার জীবনটাকে জীবন মনে করেছে? আমাকে ভালো ভাবে বাচতে দিয়েছে? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তবুও কেউ আমাকে ছাড়েনি।’

সাইরাহ্-র গলা কেঁপে ওঠে। সাহিত্যের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ইচ্ছে করে ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাহেবাকে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু সব যে একটা নিয়মে বাঁধা। মন, মস্তিষ্ক সাহেবাকে চাওয়া সত্বেও সে চাইতে পারবে না। আঁকড়ে ধরতে পারবে না। সাহিত্য বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। সাইরাহ্ শুধু সাহিত্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্যের এমন আচরণে একটু অবাক হয়। শুধায়,

‘ঠিক আছেন আপনি?’

সাহিত্য মাথা নাড়ায়। সাইরাহ্ হেঁসে বলে, ‘আমার জীবন নিয়ে পুতুল খেলা হচ্ছে আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা আপনার সাথে হচ্ছে।’

সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে। নিজ মনে আওড়ায়, ‘তুই যদি জানতি তাহলে দেখতি তোর এক সমুদ্র বিষাদের জায়গায় আমার এক আকাশ বিষাদ তোর জন্য।’

সাইরাহ্ তাড়া দিয়ে ফের বলে, ‘কিছু বলবেন সাহিত্য ভাই? আমার বাড়ি যেতে হবে। আব্বা নয়তো আবার ঝামেলা শুরু করবে।’

‘তুই সীমান্তকে ভালোবাসিস?’

সাহিত্যের প্রশ্নে সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সাহিত্য এবার তাড়া দিয়ে বলে, ‘প্রশ্ন এড়াবি না আর সত্যি সত্যি উত্তর দে।’

সাইরাহ্-র ইচ্ছে করে না তর্ক করতে৷ তাই ছোট্ট করে বলে দেয়, ‘ভালোবাসা মানে আমি বুঝি না সাহিত্য ভাই। তবে কিশোরী মনে আবেগ, ভালো লাগা জুড়ে উনি ছিলেন। তবে এসব সত্য হওয়ার না। প্রধান কাকা বা কাকী কোনোদিনই আমাকে মানবে না।’

সাইরাহ্ কথা শেষ করে চলে যেতে নেয়। সাহিত্য পেছন থেকে ফের শুধায়, ‘যদি সীমান্ত তোকে চায়, বিয়ে করতে চায় তুই করবি? মামা, মামিমাকে আমি, তামজীদ আর সীমান্ত মিলে মানিয়ে নিবো। তুই করবি ওকে বিয়ে?’

‘আপনি আমার জন্য এতোকিছু কেনো করবেন?’

সাহিত্য হাসে। সাইরাহ্-র প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, ‘বাড়ি যা। তোর সুখের জন্য আমি সব করবো সাহেবা। তোর জীবনটা ন’ষ্ট হতে দেবো না।’

সাইরাহ্ শেষের দু লাইন ঠিকমতো শুনতে পায় না। আবছা আবছা যা শোনে তাতে শুধু দু’বার পিছে তাকিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। জীবনের সমীকরণ অনেককিছু মিলানো বাকি। কেবল জটিলতা শুরু। আরো অনেক কিছু দেখার বাকি। মন বলছে জটিলতা দেখা আরো বাকি। সাইরাহ্ চলে গেলে সাহিত্য ফিরে দাঁড়ায়। বড় বড় দুটো শ্বাস টেনে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে শুরু করে। একবার পিছে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘ এক শুভ্রা, স্নিগ্ধ সাহেবাকে আমার হৃদয়ে ঠায় দিয়েছি। তার মুখ হৃদয়ের দৃশ্যপটে এঁকেছি ভীষণ যত্ন করে। তার সেই অবচেতন স্নিগ্ধ চেহারা, ভীতু কন্ঠ আমি আজও স্পষ্ট করে রেখেছি হৃদয়ে। আমি প্রেমিক হতে চেয়েছি। তবে আমার ভালোবাসাটুকু নিঃশব্দে, ভীষণ গোপনে তাকে দিয়ে গেছি। সাহেবা, আমি তোকে ভীষণ ভালোবেসেছি। আমি সম্মান করি তোকে, তোর অনুভূতিকে। তবে আমি ব্যর্থ। আমি চাইতে পারিনি তোকে। তোর অনুভূতিকে সম্মান করেই আমি চাইতে পারিনি তোকে, কিছু অ’ন্যায়, কিছু পাপ তোকে চাইতে দেয়নি সাহেবা। হোক! ভালোবাসায় না হয় খানিকটা ব্যর্থতা থাক। তোর অ-সুখ দেখতে দেখতে আমার অসুখ বাড়ছে৷ তোকে সুখী দেখার লোভ নিয়ে আমি আরো একবার নিজের হৃদয় ভঙ্গ করবো। তবুও আমার সাহেবা সুখী হোক। পাই বা না পাই তবে সাহেবা থাকবে আজীবন। হয়তো স্মৃতিতে নয়তো অজান্তে।’

চলবে..

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

১২.
সীমান্ত অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবার সাথে কথা বলবে৷ প্রধান তখন রাতের খাবার খেয়ে মুখে পান গুজে বসে আছে। প্রধানের গিন্নিও প্রধানের পাশে বসে আছে৷ সীমান্ত ঘরে ঢোকার আগে বাইরে থেকে অনুমতি নেয়,

‘আব্বা আসবো!’

প্রধানের গমগমে স্বরের উত্তর, ‘আইয়ো বাপজান।’

সীমান্ত ঘরে ঢোকে। তবে সহসাই কিছু বলে না। মাথা নিচু করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রধানের গিন্নি শুধায়, ‘কিছু কইবা আব্বা?’

সীমান্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রধান আর তার স্ত্রীও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সীমান্ত শান্ত কন্ঠে বলে, ‘আব্বা আমি সাইরাহ্-কে বিয়ে করতে চাই।’

প্রধান আর তার স্ত্রীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। প্রধানের গিন্নি তো রীতিমতো হায় হায় করা শুরু করে দেয়। প্রধান চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘সবুরের ওই বিধবা মাইয়ারে তুমি বিয়া করবা?’

সীমান্ত মাথা নাড়ায়। প্রধান কতক্ষণ চুপ থাকে। এরপর ধীর স্থির ভাবে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে সীমান্তের সামনাসামনি দাঁড়ায়। ফের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ওই মাইয়ার লগে সম্পর্ক আছে?’

সীমান্ত দু’দিকে মাথা নাড়ায়। নিচু কন্ঠে বলে, ‘না আব্বা। তবে আমি ওরে ভালোবাসি।’

সাথে সাথেই সীমান্তের গালের ওপর থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয় প্রধান। সীমান্ত নড়ে ওঠে। অবাক চোখে বাবার দিকে তাকায়। প্রধান চোখ রাঙিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলে,

‘আমাগো মতো উচ্চবংশের পোলা হইয়া একটা বিধবা মাইয়ারে বিয়া করতে চাও তোমার লজ্জা লাগে না? আর কোনো দিন এই ধরণের কথা কইলে তোমার জিভ কা’ইটা রাইখা দিমু। তোমারেও কু’রবানি দিমু সাথে ওই মাইয়ারেও কু’রবানি দিমু।’

সীমান্ত প্রধানের পা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই! সে সকল নিয়মকে ভেঙে চুড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘এমন করবেন না আব্বা। আমি ওরে খুব ভালোবাসি আব্বা। ওর অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে আমি আর বাঁচতে পারবো না। একবার সব সহ্য করে নিলেও দ্বিতীয়বার যে আর পারবো না। আপনি আপনার ছেলের জীবন ভিক্ষা দেন আব্বা!’

প্রধানের কঠিন মন গলে না। পা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয় ছেলেকে৷ দু পা এগিয়ে গিয়ে কঠিন স্বরে বলে, ‘তোরে আমি শেষ বারের মতো কইয়া দিতাসি ওই মাইয়ারে ভুইলা যা। কালকার পরের দিন ওর বিয়া। এইডা ভালো মতো হইতে দে নাইলে আমি তোর সামনে ওই মাইয়ারে মা’ইরা ফালামু৷ চোখের সামনে থেইকা এক্কনি বিদায় হ!’

সীমান্তের আর কোনো কথা শোনে না প্রধান। সীমান্ত কাঁদতে কাঁদতেই বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে৷ ভেতরে চাপা কষ্টটা মুহুর্তে মুহুর্তে বেড়ে যাচ্ছে। বাহিরে দরজার আড়ালে সাহিত্য ছিলো। সীমান্ত তাকে দেখেই অসহায় চোখে তাকায়। সাহিত্য নিজেকে শক্ত করে সীমান্তের হাত ধরে তার ঘরে যায়। সীমান্ত অসহায় কন্ঠে বলে,

‘আব্বা কখনো সাইরাহ্-কে মানবে না সাহিত্য। এবার আমি কি করবো? সাইরাহ্-র তো বিয়ে!’

সাহিত্য ভীষণ শান্ত কন্ঠে বলে, ‘ভালোবাসিস? সবার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আছে?’

সীমান্ত চুপ থাকে। সাহিত্য তবুও রেগে যায় না৷ তবে সাহেবার সুখ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। সীমান্ত সবার বিরুদ্ধে গিয়ে সাহেবাকে সুখী রাখতে পারবে? সাহিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুদিকে মাথা নাড়ায়। মাথা ঠান্ডা রেখে বলে,

‘তুই সাহেবাকে চাইলে আমি আর তামজীদ সব সামলে নিবো। তোর ভয়ের কারণ নাই। মামা, মামিমা’কে আমরা বুঝাবো। তুই শুধু বল তুই ওকে চাস কি না!’

‘কিভাবে আনবি ওকে? ওর আব্বা তো দিবে না। তাছাড়া আজ বাদে কাল’ই ওর বিয়ে।’

‘আমি সামলে নিবো। আমি সাহেবাকে আনবো। সবুর কাকারে বুঝিয়ে বলবো।’

সীমান্ত সহসাই সাহিত্যের হাত চেপে ধরে। ভরসার কন্ঠে বলে, ‘সাইরাহ্-কে এনে দে ভাই৷ আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।’

‘সুখে রাখবি তো?’

‘রাখবো।’

সাহিত্য হেঁসে হাত ছাড়িয়ে নেয়। কাঁধ চেপে আশ্বস্ত করে। সীমান্ত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। সাহিত্য বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে। প্রধানের বাড়ি থেকে বের হতে হতে একবার পিছু ফিরে তাকায়। প্রধান তখন নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে। সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে তার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করে। প্রধান খেয়াল করে না তাকে। সাহিত্য কতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে চলে যায়। প্রধান নিজের ঘরের জানালার কপাটে হাত রেখে রাগে ফুঁসতে শুরু করে। রাগে বিড়বিড় করে বলে,

‘আমি তোদের দুই ভাই-কেই চিনি৷ ওই ফ’কিন্নির বা’চ্চা যেনো আমাদের বাড়ির বউ না হয় এইজন্যই তো এতো কিছু করেছি। একবার ওকে সরালাম আবার ফিরে এলো। এবার ওকে আবার সরাবো। এবারও তোদের কিছু করার থাকবে না।’


লুবনা বিকেল সময়ে বাড়ি থেকে বের হয়। সাহিত্যদের বাড়ির পাশেই তাদের বাগান। লুবনা সব ঘুরে ঘুরে বাগানের দিকে যায়। বাগানে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ কেউ পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। চমকে উঠে পিছে তাকাতেই নজরে আসে এক যুবককে। লুবনা দ্রুত আশে পাশে তাকিয়ে যুবকটির হাত ধরে টেনে গাছের আড়ালে লুকায়। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘তুমি এখানে কেন তারেক? কেউ দেখে ফেললে কি হবে?’

তারেক নামের পুরুষটি হাসে। লুবনার একহাত হাতের মুঠোয় নিয়ে চু’মু খায়। লুবনা ইতস্তত দৃষ্টিতে আরো একবার আশে পাশে তাকায়। তারেক বেশ নেশালো কন্ঠে বলে,

‘তুমি এতো কাছে থাকা সত্বেও তোমারে পাইতেছি না। আমার আর ভালো লাগে না। তুমি চলো আমার সাথে।’

লুবনা আঁতকে উঠে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘পা’গল হইছো? আমি যা করতেছি তোমার আর আমার জন্যই তো করতেছি৷ দেখো! তোমার আর আমার সুখে সংসার করতে হইলে আগে আমার সাহিত্যরে বিয়ে করা লাগবে।’

‘বিয়ে করা লাগবে কেন? তুমি এমনিতেই সব নেওয়ার ব্যবস্থা করো!’

‘হ্যাঁ আমি চাইবো আর ওরা দিয়ে দিবে।’

‘তাহলে বিয়ের পর কিভাবে নিবে?’

লুবনা কুটিল হাসে। তারেক ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। লুবনা তারেককে তাড়া দিয়ে বলে, ‘সেসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি যাও!’

তারেক জিদ দেখায়। সে যাবে না। বরং আরো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে অদ্ভুত স্বরে বলে, ‘আমার যাইতে মন চায় না। তোমারে একটু..’

কথা শেষ করার আগেই লুবনা তারেককে সরিয়ে দেয়। ব্যস্ত হয়ে তারেককে উল্টো ফেরাতে ফেরাতে বলে, ‘যা হবে পরে দেখা যাবে। তুমি এখন যাও। আর নাইলে তুমি থাকো, আমি গেলাম।’

তারেক মানে না। দুজনের কথার মধ্যেই বাড়ির বাহির থেকে সুফিয়ার কন্ঠ ভেসে আসে। ভয়ে লুবনা লাফিয়ে ওঠে। তারেককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দৌড় লাগায়। মুখে সেই নিষ্পাপ ভাবটা অটুট। তারেক সেদিকে তাকিয়ে বি’শ্রী একটা হাসি দেয়। থু থু ফেলে বলে,

‘আজ তো বাঁইচা গেলা পাখি। কয়দিন বাচবা তারেকের থেইকা? পড়ছো তারেকের কবলে, ম’রতে তোমার হবেই।’

পুরো ঘটনা-ই সাহিত্য তার ঘরের জানালা থেকে দেখে। হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেও হাসে। অদ্ভুত রহস্যময় এক হাসি। একটু পর-ই লুবনা আসে৷ মাথা নিচু করে দরজায় টোকা দেয়। সাহিত্যের ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। মুহুর্তেই তা লুকিয়ে লুবনাকে অনুমতি দেয় ভেতরে আসার। লুবনা লজ্জা লজ্জা মুখে বলে,

‘আপনাকে নিচে ডাকে সাহিত্য ভাই।’

‘যা! আসতেছি।’

লুবনা চলে যায়। নিখুঁত অভিনয়ে সাহিত্যের চোয়াল শক্ত হয়। তবে সে জানে কখন কি করতে হয় তাই সহসাই কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। আস্তে ধীরে সবকিছুর শোধ দেয়া যাবে। সময় আসুক!


সাইরাহ্-র বিয়ের আগের দিন থেকে সাইরাহ্-কে আর বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি সবুর মিয়া। রীতিমতো তাহেরা আর সাইমার ওপর চাপ দিয়ে সাইরাহ্-কে একটা ঘরে আটকে রেখেছে। সাইরাহ্-র অবশ্য এতে কিছু মনে হয়নি। যার মনটাই অনুভূতিশূণ্য হয়ে রয়েছে তার আর কিসেই বা কি হবে! আজ সাইরাহ্-র বিয়ে। সবাই যখন ঘুমে বিভোর তখন সাইরাহ্ সারারাত জেগে। পাশে সাইমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সাইরাহ্ উঠে পড়ে। কলপাড় থেকে ওজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে। দু রাকাআত নামাজ পড়ে হাত তুলে আল্লাহর কাছে-ই সাহায্য চাইতে থাকে। সাইরাহ্-র ফোপাঁনোর শব্দে সাইমা জেগে যায়। বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার নিজেরও চোখ ভিজে যায়। সাইরাহ্ মোনাজাত শেষ করতেই সাইমা উঠে আসে। সাইরাহ্ অবাক হয় না। শুধু চেয়ে থাকে। সাইমা কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে সাইরাহ্-কে। সাইরাহ্ নিজেকে আটকাতে পারে না। বোনকে ধরেই কাঁদতে থাকে। সাইমাও কাঁদে। সাইরাহ্ ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে,

‘বুবু! আমি তো মেনে নিছিলাম আমার কপালে স্বামীর সুখ নাই তাহলে এতোদিন পর এসে এতো বড় বি’পদে কেন পড়লাম? বুবু, আমি আর নিতে পারতেছি না বুবু। আল্লাহ আমার কোন পরীক্ষা নিচ্ছে বুবু!’

সাইমা বোনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘কাঁন্দিস না বোন। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, তিনি সব ঠিক করে দিবে।’

‘আমার তো তিনি ছাড়া কেউ নাই। তাই আমার সব ভরসাও তার ওপর।’

দু বোনের অনেকটা সময় কাটে কেবল নীরবতায়, কান্নায়। সময় সময়ের মতো যেতে থাকে কিন্তু কিছুই থেমে থাকে না। কেবল থেমে গেছেই সাইরাহ্-র জীবন। মাঝে মাঝে জীবন নিয়ে বড্ড অভিযোগ আসে আবার তখনই ভাবে ‘আল্লাহর’ পরিকল্পনা সবচেয়ে সুন্দর পরিকল্পনা। সাইরাহ্-র ভাবনার মাঝেই সাইমা বলে ওঠে,

‘তুই বিয়ের আগে পালায় যা সাইরাহ্।’

সাইরাহ্ সাইমাকে ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, ‘আমি কই যাবো আপা? আমার তো যাওয়ার জায়গা নাই।’

‘এইখানে থাকলে তোর এই বিয়েটা করা-ই লাগবে। যদি করতে না চাস তাহলে পালায় যা।’

সাইরাহ্ আর কিছু বলে না। পালিয়ে সে যাবে কোথায়? যে মেয়ে কোনোদিন এই গ্রামের বাইরে অন্য গ্রামেই যায়নি সেই মেয়ে কোথায় যাবে? কেবল একবারই গ্রামের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আর সেবার-ই ছিলো তার বিয়ে। সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারারাত ওভাবেই বসে থাকে। সাইমা অনেক কষ্টে সাইরাহ্ শুইয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সাইরাহ্ নিজের ভাঙা জীবনের সমীকরণ মিলাতে থাকে। মনে আসে সীমান্তের কথা। একবার হাসে সে। মনে মনে আওড়ায়,

‘আপনি ভালো বাসেন ঠিকই তবে আমাকে নিজের করে নেওয়ার ক্ষমতা আপনার নাই। তবুও আমি শেষ পর্যন্ত দেখবো। আপনি আসবেন কী?’

রাত পেড়িয়ে সকাল হয়। সকাল থেকেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়। বিয়েটা বেশি বড় করে হবে না তবুও বাড়ির মেয়ের বিয়ে মানেই অনেক কাজ। তাহেরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজ করে যাচ্ছে। সাইমা একবার সাইরাহ্-কে দেখছে আরেকবার দেখছে কাজ। দুপুরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হবে। সকাল বেলাতেই সাইরাহ্-র সাদা শাড়ি বদলে পড়ানো হয়েছে বাসন্তী রঙের শাড়ি। সাইরাহ্ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে নিজের নতুন রং। এই রং তার না। তবুও এই রং কেই আপন করতে হবে। সাইরাহ্ পুতুলের মতো বসে দেখছে সবাইকে। সকাল গড়িয়ে ধীরে ধীরে দুপুর হয়েছে। ছেলেপক্ষ এসে পড়বে বোধহয়। সাইরাহ্ ঘরের ভেতর বসা। পথ চেয়ে আছে কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। সবুর মিয়া আয়েশ করে বসে ছিলো উঠানে। সে সময় সাহিত্য আর তামজীদ আসে৷ সবুর মিয়া তাদের দেখে কপাল কুঁচকায়। সে যেনো জানতো ঘটনাটা ঘটবে তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে ছিলো। সাহিত্যরা এগিয়ে আসতেই সবুর মিয়া হাসি মুখে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

‘আরে বাপজান আপনেরা! আসেন আসেন। বসেন!’

‘আমরা বসতে আসি নাই কাকা। কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।’

তামজীদ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবুর মিয়া একবার তার দিকে তাকিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকায়। স্বাভাবিক ভাবেই বলে, ‘কন।’

সাহিত্য দম নেয়। চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নিয়ে বোঝানোর মতো করে বলে, ‘দেখেন কাকা! সাইরাহ্-র বয়স অনেক কম। সে হিসেবে পাত্রর বয়স প্রায় ৩ গুণ বেশি। কাকা আপনার উচিত না এখানে ওর বিয়ে দেওয়া।’

‘তাইলে কার লগে বিয়া দিমু? কে করবো ওরে বিয়া?’

‘সীমান্ত করবে।’

সবুর মিয়া হাসা শুরু করে। সাহিত্য আর তামজীদ একে অন্যের দিকে একবার তাকায়। সবুর মিয়া হাসি থামিয়ে বলে, ‘প্রধান সাহেবের পোলা আমার বিধেবা মাইয়ারে করবো বিয়া? মশকরা করার আর সময় পান নাই? দেহেন সাহিত্য বাবা! আইজ আমার মাইয়া বিয়া। আইজ কোনো ঝামেলা পাকায়েন না। আমার মাইয়া আমি কার লগে বিয়া দিমু এইডা আমি বুঝমু। আপনাগো ওরে নিয়া এতো ভাবা লাগবো না। আপনে আপনের রাস্তা দেহেন।’

সাহিত্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়ায়। কন্ঠস্বর যথেষ্ট শক্ত করে বলে, ‘আপনি ওর বাপ, আপনার অধিকার আছে ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিন্তু ওর জীবন ন”ষ্ট করার কোনো অধিকার আপনার নাই। আর এইটা আমি করতেও দিবো না। আপনি কেমনে ওরে ওই বুইড়ার সাথে বিয়ে দেন আজ আমিও দেখবো!’

সবুর মিয়ার সাথে ছোটখাটো একটা ঝামেলা লেগে যায়। তামজীদ সবুর মিয়াকে আটকে ধরে। আশে পাশের মানুষ জড়ো হয়ে যায়। অনেকে এগিয়ে আসতে গেলে সাহিত্য আর তামজীদ একসাথে কঠিন গলায় বলে,

‘একজন এগোবে তার দেহ থেকে গলা আ’লা’দা করতে দুইবারও ভাববো না।’

কেউ ভয়ে এগোয় না। তামজীদের হাতে সত্যি সত্যি রাম দা’। সাহিত্য জোড়ে চেঁচিয়ে ডাকে, ‘সাহেবা! এ্যাই সাহেবা!’

সাইরাহ্ সাহিত্যের কন্ঠ শুনে চমকে ওঠে। এভাবে চেঁচিয়ে ডাকায় ব্যস্ত পায়ে বের হয়ে আসে। এসেই দেখে উঠানে ছোট খাটো হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সাহিত্যের আরো লোক এসে পুরো উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে। সাইরাহ্ বাইরে আসতেই সাহিত্য এগিয়ে এসে সরাসরি সাইরাহ্-র হাত ধরে। সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সাহিত্য চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘চল!’

হাত ধরে টেনে এগোতে গেলে সাইরাহ্ ব্যস্ত গলায় শুধায়, ‘কি করছেন? কোথায় যাবো সাহিত্য ভাই?’

সাহিত্য না দাঁড়িয়ে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘তোর সুখের সন্ধানে নিয়ে যাচ্ছি।’

সাইরাহ্ বুঝে ওঠে না। সাইরাহ্ আর সাহিত্যের পিছু পিছু বাকিরাও যায়। তাহেরা আর সাইমা কিছু বুঝেই উঠতে পারে না। তারা সাইরাহ্-র জন্য পিছু পিছু যেতে যেতে ডাকতে থাকে। কিন্তু সাহিত্য কারোর কথা শোনে না। সাইরাহ্ বার বার থামতে বললেও সাহিত্য শোনে না। সরাসরি গ্রাম প্রধানের বাড়ির সামনে গিয়ে থামে। সাইরাহ্ ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর যে কত বড় ঝড় এখানে বইবে তা বুঝতে তার আর বাকি নেই।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)