#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____
১৭.
সাইরাহ্ আর সাহিত্য বেড়িয়েছে। সাইরাহ্-র পড়নে সাহিত্যের দেয়া শাড়ি। মাথার আঁচল টেনে নিয়ে সাহিত্যের পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে সাইরাহ্। দাদীমার বাড়ির পেছনের নদীর পাড় ঘেষে দুজনে হেঁটে চলেছে। সাইরাহ্ হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি? শুধু হাঁটছি আর হাঁটছি।’
সাহিত্য রাস্তায় মনোযোগ দিয়েই বলে, ‘এই তো সামনে এক লোক আছে, তার কাছে তোকে বিক্রি করতে যাচ্ছি।’
সাইরাহ্-র কপালে ভাজ করে। ভ্রু কুঁচকে একবার সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনি সোজা প্রশ্নের উত্তর সোজা ভাবে দিতে পারেন না?’
‘না।’
‘এখন দিলেন কিভাবে?’
‘মুখ দিয়ে।’
সাইরাহ্ কপাল চাপড়ায়। লোকটার সাথে কথা বাড়ানোর চেয়ে না বাড়ানোই ভালো। তাই দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ হাঁটতে থাকে । সাইরাহ্-র অগোচরে সাহিত্য ঠোঁট চেপে হাসে। আরো কিছুটা দুর আসতেই নদীর পাড় পায়। সেখানে শান বাঁধানো সিড়ি। সাহিত্য সিঁড়ির ওপর ধপ করে বসে পড়ে। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
‘সূর্য মামার তেজও তোর মতোই বেশি।’
‘তা আপনি আমার কোন তেজটা দেখলেন?’
‘সূর্য মামা রোদের তাপে পোড়ায় আর তুই প্রেমের তাপে।’
শেষের দুটো শব্দ আস্তেই বলে। সাইরাহ্ পাশে বসতে বসতে সাহিত্যের দিকে তাকায়। লোকটার কথার কোনো আগামাথা নাই। শেষে কি বলেছে শুনতে পায়নি বলে উল্টো শুধায়, ‘আমি কী?’
‘তুই না’গিন।’
সাইরাহ্ কটমট করে ওঠে। সাহিত্য ঠোঁট উল্টে নির্দোষ চেহারা নিয়ে বসে থাকে। সাইরাহ্ আশে পাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে নিজেই চট করে উঠে সাহিত্যের কাছে যেতে যেতে বলে,
‘আমি না’গিন? দাঁড়ান, আপনাকে দেখাচ্ছি আমি কী!’
সাহিত্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইরাহ্ সরাসরি সাহিত্যের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। সাহিত্য ‘থ’ মে’রে যায়। ব্যাথায় আর্তনাদ করতে করতে বলে, ‘এ্যাই সাহেবা! তোকে না’গিন বলেছি, রা’ক্ষসী বলিনি। কামড়াচ্ছিস কেনো? ছাড় ছাড়। এ্যাই রাক্ষসী ছাড়!’
সাইরাহ্ আরো জোড়ে কামড়ে দেয়। যতক্ষণ না রাগ কমে ততক্ষণে কামড়ে ধরে থাকে। সাহিত্য আর্তনাদ করা থামিয়ে দেয়। সাইরাহ্-ও ছেড়ে দেয়। সাহিত্য হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে কামড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। নিজের হাতে ফু দিতে দিতে বলে,
‘তোর দাঁত কবে থেকে রা’ক্ষসীদের মতো হইছে? তুই তো দেখি না’গিন না, পুরাই রা’ক্ষসী।’
সাইরাহ্ আবার এগিয়ে আসতে গেলে সাহিত্য দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। সাইরাহ্ বিজয়ের হাসি হেঁসে বলে, ‘না’গিন বলবেন আর না’গিনের ছোবল খাবেন না তাই কখনো হয়!’
সাহিত্য ভ্রু কুঁচকে মাথা এদিক ওদিক করে। ভালো মতো সাইরাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘না’গিনরা ছোবল দেয় জিহ্বা দিয়ে আর তুই ছোবল দিচ্ছিস দাঁত দিয়ে! বাহ্ বাহ্!’
সাইরাহ্ কটমট করে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে, ‘বে’হায়া লোক।’
সাহিত্য শুনলেও প্রতিক্রিয়া করে না। সাইরাহ্ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে৷ সাহিত্য নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। ফিসফিস করে আওড়ায়, ‘তুই তো আমার সাহেবা।’
তাদের ঝ’গড়ার মাঝেই দুর থেকে ভেসে আসে দুটো কন্ঠস্বর। কেউ একজন ‘সাইরাহ্’ বলে ডাকে। সাইরাহ্ আর সাহিত্য একসাথে তাকায়। দুরে কাকলীকে আসতে দেখে সাইরাহ্ অবাক হয়ে তাকায়। যখন তার সাথে এসব হলো তখন কাকলী শ্বশুরবাড়ি ছিলো। তাই সে ধরেই নিয়েছিলো কাকলী এসব জানে না। আরো বেশি অবাক হয় কাকলীর পাশে কাকলীর মা’কে দেখে। এবং তাদের পিছে কাকলীর স্বামী। সাইরাহ্ অবাকের ওপর অবাক হয়। সাহিত্য উঠে দাঁড়ায়। কাকলীরা কাছাকাছি আসতেই সাহিত্য কাকলীর স্বামীর সাথে হ্যান্ডশেক করে। দুজনে একটু দুরে দাঁড়িয়ে যায়। কাকলী এসে সোজা সাইরাহ্-কে জড়িয়ে ধরে। বাদ যায় না কাকলীর মা-ও। সাইরাহ্ নিজের কন্ঠে অবাকতা ধরে রেখে বলে,
‘তোমরা এখানে? কিভাবে? কেউ তো জানে না আমরা এখানে! তাহলে?’
কাকলী জবাব দেয়, ‘ক্যান? আমরা আসছি দেইখা তোর সমস্যা হইছে?’
‘না না তা না। আসলে আমি বুঝতেছি না কিছু।’
কাকলীর মা হেঁসে সাইরাহ্-র মাথায় হাত রেখে বলে, ‘সাহিত্য বাবা খবর দিছে আমাগো।’
সাইরাহ্ সাহিত্যের দিকে তাকায়। সে বুঝে ওঠে না সাহিত্য কেনো হঠাৎ এই কাজ করলো! তারা তো আজ বাদে কালই গ্রামের ভেতরে ফিরে যাবে তাহলে এভাবে আলাদা করে ওদের ডাকলো কেনো? কাকলীর কথায় সাইরাহ্ আপাতত সব ভাবনা রেখে দেয়। ৩ জন কথা বলতে থাকে। কাকলীর মা দুজনকে কথা বলতে দিয়ে সাহিত্যদের দিকে এগিয়ে যায়। সাইরাহ্ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পাশ থেকে কাকলী শুধায়,
‘আম্মার থেকে শুনলাম কী থেকে কী হইছে। আচ্ছা সীমান্ত ভাই তোরে ভালোবাসতো না? আমার চোখের সামনেই তো তার কত পাগলামি দেখছি! তাহলে সে বিয়ের সময় এসে পিছিয়ে গেলো ক্যান?’
সাইরাহ্-র চোখের সামনে ভেসে ওঠে গতদিন গুলোর কথা। এবং স্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে যায় সেদিন সীমান্তের প্রত্যাখান। মানুষের জীবন কখন তাকে কোথায় দাঁড় করিয়ে দেয় এটা কেউ জানে না। কাকলী সাইরাহ্-র কোনো জবাব না পেয়ে বোঝে সাইরাহ্-র মন খারাপ হয়েছে। তাই নিজেই তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
‘জানিস আম্মা বলে আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্য করেন। হয়তো আল্লাহ তোর ভাগ্যে সীমান্ত ভাইকে লেখেনি। লিখেছিলো সাহিত্য ভাইকে। আর হয়তো এটাই তোর জন্য সুখের, ভালো। হয়তো সাহিত্য ভাই-ই তোকে সেইসব দিবে যা তোকে আগে কেউ দেয়নি৷ যা হয়তো সীমান্ত ভাইও দিতে পারতো না।’
সাইরাহ্ চট করে তাকায় কাকলীর দিকে৷ এরপর সাহিত্যের দিকে তাকায়। সাহিত্য কথার ফাঁকে ফাঁকে তাদের দিকেও তাকাচ্ছে। হয়তো খেয়াল রাখছে দুজনের দিকে। সাইরাহ্ চোখ সরায় না। ভাবে, গভীরভাবে ভাবে। কাকলী হেঁসে একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে,
‘তবে তোকে একটা কথা বলতেই হয়। তুই আসলেই চমৎকার একটা মানুষ পাইছিস। সাহিত্য ভাইয়ের মতো মানুষ খুব কম হয়। দেখবি তোকে এমনভাবে আগলে রাখবে, ভালোবাসবে যে তুই অতীতের একটাদিনও মনে করবি না ভুল করেও। আফসোস করবি কেনো সাহিত্য ভাই আগে আরো আসলো না!’
সাইরাহ্-র কানে দুটো শব্দ বারবার বাজতে থাকে৷ ‘আগলে রাখবে, ভালোবাসবে’। সত্যিই? সাহিত্য তাকে আগলে রাখবে? ভালোবাসবে? বিড়বিড় করে দু’বার উচ্চারণ করে, ‘ভালোবাসবে? ভালোবাসবে? সত্যিই? সাইরাহ্-কে ভালোবাসা যায়? তাহলে কেউ কখনো বাসেনি কেনো?’
প্রকৃতি যেনো নিজ থেকে জবাব দিয়ে দেয়, ‘সাহেবাকে ভালোবাসা যায়। কে বললো বাসেনি? এক পুরুষ কতগুলো দিন ধরে তোমাকে হৃদয়ের এক কোণে গভীরভাবে রেখেছে। সে খবর কী তুমি রেখেছো? রাখোনি সাহেবা। তুমি তখন অন্য পুরুষের আবেগে আবেগ মেলাতে ব্যস্ত, এই সমাজ নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত, নিজের জীবনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। তাহলে তুমি জানবে কেমন করে যে তোমাকেও কেউ এক আকাশ সমান ভালোবেসেছে?’
সাইরাহ্ কেঁপে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ তারা সেখানে থাকার পর কাকলীরা বিদায় নিয়ে চলে যায়। কাকলীর মা যাওয়ার আগে সাইরাহ্-র মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘তুই অনেক সুখী হইবি মা। সাহিত্য তোর সব দুঃখ একদিন মিলাইয়া দিবো।’
সাইরাহ্ অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। সাহিত্যের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবে কাকলী আর তার মায়ের বলা কথাগুলো। এই মানুষটার প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস। সত্যিই কী এই মানুষটা তার সুখের কারণ? সাহিত্য সাইরাহ্-কে এভাবে চুপচাপ মাথা নত করে হাঁটতে দেখে খোঁচা দিয়ে বলে,
‘পুরোনো যুগে যেভাবে রাজাকে সম্মান দেয়া হইতো তুই কী ওভাবেই আমাকে সম্মান দিচ্ছিস?’
সাইরাহ্ বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে, ‘মানে?’
‘মানে তুই যেভাবে মাথা নত করে হাঁটছিস মনে হচ্ছে আমাকে সম্মান-ই দিচ্ছিস। দে দে! আমি অবশ্য এটার প্রাপ্য।’
সাইরাহ্ কথার বিপরীতে জবাব দেয় না। সাহিত্য মজা থেকে বেড়িয়ে আসে। শান্ত চোখে তাকিয়ে সাইরাহ্-কে পর্যবেক্ষণ করে। এরপর কন্ঠস্বর শান্ত করে শুধায়,
‘কি হইছে সাহেবা?’
সাইরাহ্ সরাসরি চোখ তুলে সাহিত্যের চোখের দিকে তাকায়। শুধায়, ‘আপনি কী সত্যিই আমার সুখের কারণ সাহিত্য ভাই? নাকি এই বিয়েটা শুধুই আমার ওপর দয়া! আপনার সাথে তো আমার কোনোকালে কোনোকিছু ছিলো না। তাহলে? সেদিন তো আপনি আমাকে নিজের জন্য নিয়ে যাননি, নিয়ে গিয়েছিলেন সীমান্ত ভাইয়ের জন্য। যখন সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলো, সমাজ আমাকে শা’স্তি দিলো, কলঙ্ক লাগলো তখন আপনি আমাকে বিয়ে করলেন। এই বিয়েটা আসলে কী সাহিত্য ভাই? আমার ওপর অ’ন্যায় হচ্ছিলো, শা’স্তি পাচ্ছিলাম, ওরা কলঙ্ক দিচ্ছিলো বলেই কী আপনি করুণা করেছেন আমার ওপর? নাকি অন্য কোনো কারণ? সত্যটা কী সাহিত্য ভাই?’
সাহিত্য পুরোপুরি শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেছে। সাইরাহ্ কেঁপে ওঠে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকায়। সাহিত্যও সামনে তাকায়। কিছুটা পথ যেতেই জবাব দেয়,
‘তোর প্রতি আমার করুণা নেই সাহেবা, যা আছে তা তুই বুঝতে পারবি না।’
—
প্রধানের বাড়িতে পুলিশ দেখে তামজীদ ভেতরে যায়। বাহিরে তেমন মানুষ নেই। কিছু মানুষ কি হয়েছে তা দেখার জন্য এসেছে। তামজীদ ভেতরে ঢুকে দেখে প্রধানের সাথে বাকি সদস্যরাও আছে। ফিরোজ তাঁতি আর তার বউও দাঁড়িয়ে আছে। তামজীদ কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে এগিয়ে যায়। পুলিশ অফিসার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
‘দেখুন! আপনারা গ্রামের প্রধান। তাই আমার মনে হলো বিষয়টা আপনাদের সঙ্গেই আলোচনা করা উচিত। এবং আমরা আশা করছি আমাদের কাজে আপনারাও সাহায্য করবেন।’
প্রধান মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে, ‘অবশ্যই অফিসার সাহেব। আপনে কন কি হইছে! কি সাহায্য লাগবো! আমরা অবশ্যই করমু।’
পুলিশ অফিসারটি কতক্ষণ চুপ থাকেন। এরপর বিস্ফোরণের মতো ফিরোজ তাঁতির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘উনাদের মেয়ে যে মা’রা গেছে তার গর্ভে দু মাসের বাচ্চা পাওয়া গেছে। এতে বোঝা যায় তিনি গর্ভবতী ছিলেন। কিন্তু আমাদের জানামতে উনি অবিবাহিত ছিলেন তাহলে এই সন্তান? কিভাবে?’
এতটুকু বলতেই ফিরোজ তাঁতি ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। ফিরোজ তাঁতির বউ কপাল চাপড়ে কাঁদতে শুরু করেন। তামজীদ চমকে ওঠে। পুলিশ অফিসারটি শান্ত স্বরে বলেন, ‘আপনারা একটু শান্ত হোন৷ আপনাদের মেয়ে এটা নিজ থেকে করেছে নাকি কেউ এই সন্তানের বিষয়টা লোকাতে তাকে মে’রেছে আমরা শিউর না। আর এই বিষয়ে শিউর হওয়ার জন্যই আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি আপনাদের সাহায্য পাবো।’
তামজীদ মনে মনে পুলিশ অফিসারকে বকা দেয়। কথাটা বলার আর মানুষ পাইলো না। শেষে এসে এই প্রধানদেরই বলতে হলো! এরা এখন ফিরোজ তাঁতির জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে। বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে পুলিশ অফিসারের দিকে। পুলিশ অফিসারটি নিজের কথা শেষ করে বের হতেই ফিরোজ তাঁতি আঁকড়ে ধরে প্রধানের পা। সবাই হকচকিয়ে যায়। প্রধান সহসাই বলেন, ‘এ্যাই ছাড়, ছাড়!’
ফিরোজ তাঁতি না ছেড়ে আরো শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘প্রধান সাহেব! আমার বড় মাইয়াডা কি করছে এই ব্যাপারে আমরা কিছু জানতাম না। ওর পা’পের শা’স্তি আমাগো দিবেন না। আমার ছোট দুইটা পোলা মাইয়ার জীবনডা ন’ষ্ট কইরেন না। মাফ কইরা দেন।’
প্রধান নাক সিটকে পা ছাড়িয়ে নেয়। এক পাশে থু থু ফেলে কঠিন গলায় ফিরোজ তাঁতির মেয়েকে বি’শ্রীভাবে গা’লি দেয়। সবার কান ঝা ঝা করে ওঠে। তামজীদ দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রধান স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়,
‘তোর মাইয়া যে ন*ষ্টা মাইয়া এইডা তো আর বুঝতো বাকি নাই। হয় বউ, পোলা-মাইয়া নিয়া গেরাম ছাড়বি নাইলে তোগো মাইয়ার শা’স্তি তোগোরে দিমু। আ’গুনে পু’ড়াই মা’রমু তোগোরে।’
তালেব উদ্দীন, শাহিন শেখসহ বাকিরাও মত দিলেন। তামজীদ পারে না গিয়ে দুটো থা’প্পড় দিতে৷ নিজেকে দমিয়ে নিয়ে ছুট লাগায় সাহিত্যের উদ্দেশ্যে। এই সময় একমাত্র সাহিত্যই পারে ওদের বাঁচাতে। সবাই ধীরে ধীরে জায়গা ফাঁকা করে দেয়। ফিরোজ তাঁতি আর তার বউ বাইরে বেড়িয়ে রাস্তায় বসেই হাহাকার করতে থাকে। বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে। মেয়েটা তাদের এতো বড় ভুল কিভাবে করলো? কিভাবে তাদের ওপর এতো বড় অ’ন্যায় চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলো? একবারও ভাবলো না তার বাবা-মা, ভাই-বোনগুলোর কী হবে!
—
তামজীদ হাঁপাতে হাঁপাতে আসে দাদীমার বাড়ি। ততক্ষণে সাহিত্য আর সাইরাহ্-ও চলে এসেছে৷ দুজনের মুখেই হাসি নেই। দুজনেই গম্ভীর হয়ে আছে। তারা বাড়িতে ঢুকতেই তামজীদ হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকে সাহিত্যকে। সাহিত্য তামজীদের এই অবস্থা দেখে ছুটে যায়। ব্যস্ত গলায় বলে,
‘কি হইছে তামজীদ? হাপাইতেছিস ক্যান? কি হইছে?’
তামজীদ কোনোরকমে সাহিত্যের হাত টেনে বাহিরে নিয়ে যায়। সাইরাহ্ আর দাদীমা চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্যকে সবটা খুলে বললে সাহিত্য অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শূণ্যে। রাগে তার মাথা দপদপ করে জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে না চাইতেও কয়টা গা’লি ছুড়ে মা’রে প্রধানের উদ্দেশ্যে। এরপর বলে,
‘আপাতত ফিরোজ কাকাকে বল গ্রাম ছাড়তে৷ কয়দিন পর এই প্রধানরে আমি দেখতেছি। তার আগে খুঁজে বের কর এগুলোর পিছনে কে আছে! ফিরোজ কাকার মেয়ে আ’ত্ম”হ’ত্যা করুক বা কেউ খু’ন করুক দুটোর পিছনেই একজনই দোষী। যে ওই বাচ্চার বাবা। আর আমি যদি ভুল না করি তাহলে আমি যাকে ভাবছি সে-ই।’
তামজীদ সাহিত্যের চোখের দিকে তাকিয়ে, কথার ধরণ দেখে চমকে ওঠে। হয়তো সেও অনুমান করতে পেরেছে এটা কে! তামজীদ কী বলবে বুঝে ওঠে না। সাহিত্য কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে। গম্ভীর গলায় বলে,
‘আমরা যে পেশায় আছি এখানে আমরা শুধু কাজটা দেখি। অ’প’রা’ধীকে খুঁজে বের করি। আমরা ন্যায় অ’ন্যায়টাকে গুলিয়ে ফেলবো না তামজীদ।’
তামজীদ মাথা নাড়ায়। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোরা কবে ফিরবি?’
‘কিছুদিন পর। দাদীমার এখানে কয়েকদিন থাকার পর শহরে যাবো। সাহেবারও হাওয়া বদলাবে আর আমারও কাজটা হবে।’
তামজীদ মাথা নাড়ায়। তামজীদকে বিদায় দিয়ে সাহিত্য বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই পেছন থেকে ভারী, গম্ভীর এক আওয়াজ আসে। সাহিত্য চট করে পিছু ফিরে তাকায়। উঠানে তামজীদ এবং শেখর সাহেবসহ তাদের কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। তামজীদ অসহায় চোখে তাকায়। সাহিত্য বোঝে তামজীদ কিছু জানে না। ওরা-ই খুঁজে বের করেছে৷ তাই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। শেখর সাহেব ভনিতা ছাড়াই নির্দেশ দেন,
‘বাড়ি চলো।’
সাহিত্য একটু পিছিয়ে গিয়ে সাইরাহ্-র হাত ধরে৷ অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে, ‘আব্বা, আপনিই শিখিয়েছেন দায়িত্ব নিলে তা মন থেকে, ভালো ভাবে পালন করতে হয়। আর আমি দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন তা অবশ্যই পালন করবো। যেইটা আপনারা মানবেন না। তাই ফিরে যেতে বলবেন না।’
‘আমি তোমাকে একবারও বলিনি তুমি বউ রেখে চলো! আমি তোমাকে বলেছি ‘বাড়ি চলো’ এবং দুজনেই চলো।’
সাইরাহ্ অবাক হয়ে তাকায়। সাহিত্য বাবার মুখের ওপর কথা বলেনি কোনোকালেই। কারণ তার প্রয়োজনই হয়নি। এই মানুষটা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়ে এসেছেন। অ’ন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। তবুও আজ সে বলে,
‘কিন্তু আম্মা নিজে আমাদের ও বাড়িতে ঢুকতে মানা করেছেন। বাড়ির সামনে থেকে নতুন বউকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা অবশ্যই তার জন্য অ’প’মা’ন আব্বা। যদি আপনার সাথে এমন করতো কেউ তবে কী তার বাড়িতে আর পা দিতেন?’
‘দিতাম না। মুখও দেখতাম না ওই রাস্তার। কিন্তু ওটা তোমার বাড়ি। আর তোমার বাড়ি মানে তোমার অর্ধাঙ্গিনীরও বাড়ি। নিজের বাড়িতে কোনো অ’প’মা’ন হয় না। তবুও আমি নতুন বউয়ের সামনে ক্ষমাপ্রার্থী।’
সাইরাহ্ সাথে সাথেই বলে ওঠে, ‘না না। এরকম বলবেন না। আপনি আমার বাবার বয়সী। আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না কাকা সাহেব।’
শেখর সাহেব গম্ভীর চোখে ছেলে আর বউমার দিকে তাকালেন। যেনো চোখ দ্বারা আদেশ দিলেন ‘বউ নিয়ে এক্ষুণি চলো’। সাহিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দাদীমা আর তামজীদও সায় দেয় যাওয়ার জন্য। সাইরাহ্ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্যের দিকে তাকালে সাহিত্যও মাথা নাড়ায়। সাইরাহ্ মাথা নাড়িয়ে ঘরের ভেতর যায়। নিজের জন্য আনা দুটো শাড়ির ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। একবার জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ফের ফিরে আসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদীমার থেকে বিদায় নিয়ে দুজনেই শেখর সাহেবের পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। সাইরাহ্ এক পা করে এগোয় আর ভাবে ধীরে ধীরে তার জীবন বদলাতে শুরু করেছে৷ ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন ভবিষ্যতের দিকে। এই ভবিষ্যৎ এতোটাও সোজা হবে না৷ যাদের চক্ষুশুল ছিলো তাদেরকে মানিয়ে নিয়ে এগোতে হবে৷ তার ভাবনার মাঝেই সাহিত্য শক্ত করে তার হাত ধরে। সাইরাহ্ চমকে তাকায়। সাহিত্যও তাকায়। যেনো নিঃশব্দে ভরসা দিলো,
‘ভয় পাস না সাহেবা। সাহিত্য আছে তোর জন্য। তোকে আগলে রাখার জন্য। আজীবন আছে।’
চলবে..
#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____
১৮.
শেখর সাহেব সাহিত্য আর সাইরাহ্-কে নিয়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাহিত্য একবার আশে পাশে নজর বুলিয়ে পরিস্থিতি দেখে নেয়। সাইরাহ্ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনেই পুরো পরিবার। সুফিয়া কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে আছে শেখর সাহেবের দিকে। ছেলে বাড়ি ফেরায় তার যতটা আনন্দ হচ্ছে তার থেকেও বেশি রাগ হচ্ছে পাশে দাঁড়ানো সাইরাহ্-কে দেখে। সাহিত্য বোঝে মায়ের মনোভাব। তবে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। শেখর সাহেব আদেশের স্বরে বলেন,
‘সুফিয়া, ওদের বরণ করে ঘরে তোলো।’
সুফিয়া মাথা নত করে নেয়। স্বামীর আদেশ অমান্য করা তার সাধ্যে নেই কিন্তু এই অপয়া মেয়েকে ঘরে তোলার মতো ক্ষমতাও তার নেই। তাই কন্ঠস্বর নিচু করে বলে,
‘কামডা আমি পারমু না। আমারে মাফ করেন। কিন্তু কোনো অ’লক্ষী মাইয়ারে আমি আমার ঘরে জায়গা দিয়ে ঘরে অমঙ্গল ডাকতে পারমু না।’
‘আর তুমি কিভাবে জানলে মেয়েটা অ’লক্ষী?’
‘আপনে জানেন না ওয় কী? জানেন না বিয়ার রাইতেই ওর স্বামী ম’রসে।’
শেখর সাহেব রেগে গেলেন না। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলেন, ‘তো? কারোর মৃ’ত্যুর ওপর কী কারো হাত থাকে নাকি? আজ যদি আমি মা’রা যাই কাল কী তুমিও অ’পয়া, অ’লক্ষী হয়ে যাবে?’
সুফিয়া আঁতকে ওঠে। কঠিন চোখে একবার সাইরাহ্-র দিকে তাকায়। তারপর শেখর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এইডা কী কথা কন? এমন কথা মুখে আইনেন না। এই মাইয়া ঘরে পা-ই রাখতে পারলো না আর আমার এতো বড় অলুক্ষণে কথা হুনা লাগলো।’
শেখর সাহেব বেশ বিরক্ত হলেন। সাইরাহ্ দুজনের কথায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নেয়। সে জানে এদের তাকে মানতে কতটা কষ্ট হবে, আর প্রতিদিন কতবার তাকে ‘বি’ধবা, অ’লক্ষী, অ’পয়া’ আরো কতকিছু শুনতে হবে। তাই কেউ তার পক্ষে কিছু বললে তার বেশ মজা লাগে। সাইরাহ্ সাহিত্যের শার্টের হাতায় টানে। সাহিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সাইরাহ্ মুখ এগিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘আপনার আম্মার চোখ মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছে আমি যদি এই বাড়িতে ঢুকি তাহলে তিনি গড়াগড়ি দেবেন।’
সাহিত্য গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায়। সাইরাহ্ যে মজা নিলো তা সে ঢের বুঝতে পেরেছে। সাইরাহ্ মুখে হাত চেপে হাসি আটকায়। শেখর সাহেব কড়া কন্ঠে বলে,
‘শিক্ষার মান যে কী এইটা তোমাদের না দেখলে অনুধাবন করতে পারতাম না। আমি যখন বলছি যে সাইরাহ্-কে বরণ করো তার মানে করো। মুখে মুখে তর্ক করাটা আমার পছন্দ না সুফিয়া। আর বাড়ির ছেলে বিয়ে করে এনেছে এই নিয়ে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে এতো তামাশা করার কিছু হয়নি।’
সুফিয়া অসহায় চোখে তাকায়। নাজিরার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঈশারা করে। নাজিরার মা ভেতর থেকে বরণ করার সামগ্রী আনে। আর সুফিয়া নিজের ঘর থেকে গহনা আনে। নিজেকে সামলে কোনোরকম বরণ করে গহণার বাক্স ধরিয়ে দেয় সাইরাহ্-র হাতে। সাহিত্য আর সাইরাহ্ একসাথে বাড়ির ভেতর ঢোকে। শেখর সাহেব সাহিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ওকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। নাজিরা কিছু খাওয়ার জন্য নিয়ে যাবে।’
সাহিত্য মাথা নাড়ায়। শেখর সাহেব চলে যান। সুফিয়া ছুটে যান ছেলের কাছে। সাইরাহ্-কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
‘আব্বা-রে! এই মাইয়া রে তুই বাইর কইরা দে আব্বা। ওয় বি’ধবা। ওয় তোর অ’মঙ্গল ডাইকা আনবো। তোর জন্য ওয় ঠিক না। আমি আবার তোর বিয়া করামু। লুবনার লগে।’
সাহিত্য শান্ত দৃষ্টিতে একবার সাইরাহ্-র দিকে তাকায়। ধাক্কা খেয়ে বেচারি একটু ছিটকে পড়েছে। তবে মাথা নত। ফের নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,
‘আম্মা, ওয় বিধবা ছিলো আগে। কিন্তু এখন ওর বিয়ে হইছে। স্বামী আছে৷ বার বার বিধবা বইলেন না। আমি তো আপনারই ছেলে।’
‘আমি মানি না তোগো কোনো বিয়া। ওইডা কোনো বিয়া হইলো!’
‘আম্মা, শান্ত হোন। আপনি মানেন বা না মানেন আমাদের কিন্তু সত্যিই বিয়ে হইছে। আর আমি বিশ্বাস করি না আমার বউ অ’পয়া।’
সুফিয়া ছেলের থেকে দুরে সরে যান। দূরে দাঁড়িয়ে অনবরত বকতে থাকে সাইরাহ্-কে। সাইরাহ্ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহিত্য সাইরাহ্-র হাত ধরে সিড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলে,
‘আম্মা, আমি এখন বিবাহিত। তাই আবার লুবনাকে বিয়ে করার প্রশ্ন আসে না। আর আপনি যদি সাহেবাকে মানতে না পারেন তাহলে আমি আব্বার সাথে কথা বলে ওকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। আমি আমার আম্মা কিংবা বউ কারোর সাথেই অ’ন্যায় করতে পারবো না।’
পুরো পরিবেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সুফিয়া মেঝেতে বসে মাথা চাপড়ে কাঁদতে থাকে। সাহিত্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পিছু ফিরে না তাকিয়ে সরাসরি চলে আসে নিজের ঘরে। সাইরাহ্ বিছানার ওপর বসতে বসতে বলে,
‘এভাবে কতদিন আর লড়বেন সবার সাথে?’
‘যতদিন না তোর সম্মান ফিরে আসে।’
সাইরাহ্ শব্দ করে হেঁসে ফেলে। সাহিত্য তাকাতেই বলে, ‘আমার আর সম্মান? বিধবা ক’লঙ্কিনীকে বিয়ে করেছেন সাহিত্য ভাই। সইতে পারবেন তো? সাইরাহ্-কে তো কেউ মেনে নিতে পারে না। মানিয়ে নিতে পারে না। এজন্যই তো পৃথিবীর সকলকিছু তার বিপরীতে।’
সাহিত্যও সাইরাহ্-র চোখে চোখ রেখে জবাব দেয়, ‘কিন্তু সাহিত্য পৃথিবীর বিপরীতে।’
—
বাড়ির চিৎকার চেচামেচি থেমে গেছে। যোহরের আজান পড়ে গেছে। সাইরাহ্ সাহিত্যের দেয়া শাড়ি থেকে একটা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে থাকে। সাহিত্য বাইরে গেছিলো৷ ঘরে এসে সাইরাহ্-কে এভাবে বসে থাকতে দেখে শুধায়,
‘বসে আছিস কেনো?’
‘তাহলে কী করবো?’
সাহিত্য সাইরাহ্-র হাতের শাড়ির দিকে তাকায়। বুঝতে পারে সাইরাহ্ গোসল করতে চাচ্ছে। তাই ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম দেখিয়ে বলে, ‘গোসল করে আয়।’
সাইরাহ্ প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে আগে গোসল করে নেয়। তারপর নামাজ পড়ে বসে থাকে। সাহিত্য গেছে গোসলে। এর মাঝেই নাজিরা আর সাহিত্যের বড় ভাবী, মেজো ভাবী আসে। উনারা মূলত সাহিত্যের জেঠাইয়ের বউমা। দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি নেয়,
‘আসবো?’
সাইরাহ্ মাথায় কাপড় তুলে নেয়। সাহিত্য জোড়ে বলে, ‘দরজা খোলা আছে ভাবী।’
দুজনে একসাথে ঘরে ঢোকে। একজনের হাতে খাবারের থালা আরেকজনের হাতে অনেকগুলো শাড়ি। বড় ভাবী হাতের শাড়ি গুলো বিছানার ওপর রাখতে রাখতে বলে,
‘এই যে মেয়ে! তোমার নাম কি?’
সাইরাহ্ নিচু স্বরে জবাব দেয়, ‘সাইরাহ্।’
‘আমি কিন্তু বাড়ির বড় বউ। তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাবো। কিছু কইতে পারবা না।’
ছোট ভাবী সশব্দে হেঁসে ওঠেন। বড় ভাবী চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এমন করে হাসছিস কেনো? নিষেধ করেছি না! এভাবে হাসতে নেই!’
ছোট ভাবী দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। বড় ভাবী ফের সাইরাহ্-র উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শাড়ি গুলো নাও। মেজো বাবা পাঠিয়েছে। আর খাবার গুলো টেবিলের ওপর রাখা থাকলো। খেয়ে থালাগুলো বাইরে রাইখা দিও। আমি কিংবা ছোট বউ কেউ একজন নিয়া যাবো।’
সাইরাহ্ মাথা নাড়ায়। দুই বউ-ই চলে যায়। নাজিরা তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার সাহিত্য, সাইরাহ্-র দিকে তাকায়। সীমান্ত আর সাইরাহ্-কে নিয়ে ভাবা ভাবনাগুলো সাহিত্যের সাথে সত্য হয়ে গেলো। নাজিরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহিত্য শুধায়,
‘কিছু বলবি?’
নাজিরা দুদিকে মাথা নাড়ায়। তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সাইরাহ্ আর সাহিত্য চুপচাপ খেয়ে নেয়। এরপর থালাগুলো বাহিরে দরজার এক পাশে রেখে ঘরে আসে। সাইরাহ্ অলস গলায় বলে, ‘এখন কী করবো?’
‘না’গিন যা করে তাই করবি।’
সাইরাহ্ কটমট করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনি আবার শুরু করছেন?’
‘আমি আবার কী করলাম?’
সাইরাহ্ আশে পাশে তাকিয়ে কিছু না পেয়ে বলে, ‘কোনো একদিন আমিই আপনার মাথা ফা’টিয়ে ফেলবো। তখন আপনার আম্মা আমারে আবার বলবে ‘অ’লক্ষী’।’
সাহিত্য পাত্তা দেয় না। আড়মোড়া ভেঙে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। কেবলই কিছু বলতে যাবে তার আগেই ডাক পড়ে। সাহিত্য একবার সাইরাহ্-র দিকে তাকিয়ে জোড় গলায় বলে, ‘আসছি।’
দুজনে একসাথে নেমে আসে নীচে। সবাই মিলে বৈঠকে বসেছে। শেখর সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘সাহিত্যের বিয়ে যেভাবেই হোক হয়েছে, তাই আমি চাচ্ছিলাম বিয়েটার অনুষ্ঠান করতে। সবাই জানুক, এসে ওদের দোয়া করে যাক।’
সুফিয়া শুনেই চলে যায়। তার আর এই মেয়ের কোনোকিছু সহ্য হচ্ছে না। সাহিত্য আর সাইরাহ-র দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তোমাদের সমস্যা আছে?’
সাহিত্য মাথা নাড়ায়। তার আপত্তি নাই৷ কিন্তু সাইরাহ্ কী বলবে বোঝে না। তার কী বলা উচিত! সাহিত্য ঈশারায় ‘হ্যাঁ’ বলতে বলে। সাইরাহ্ও মাথা নিচু করে ‘সমস্যা নেই’ জানিয়ে দেয়। এরপর সবাই বসে তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। বড় ভাবী আর মেজো ভাবী সাইরাহ্-কে নিয়ে টিটকারি করে। কথা শেষ করে দুজনে আবার ফিরে আসে। সাইরাহ্ সন্দিহান গলায় বলে,
‘ব্যাপারটা কী বলেন তো! আপনার আম্মা আমারে তাড়াইতে পারলে বাঁচে ওদিকে আপনার আব্বা আমারে পাকাপাকি ঘরে তুলে আনার ব্যবস্থা করতেছে।’
‘আম্মা কু’সংস্কার মানে৷ আব্বা মানে না।’
‘সত্যি এটাই কারণ তো? নাকি অন্য ব্যাপার আছে?’
সাহিত্য জবাব দেয় না। শেখর সাহেব এতো দ্রুত মেনে নিলেন বিষয়টা আসলেই হজম করার ব্যাপার না। কিন্তু এটাও সত্যি তার বাবা কারোর সাথে অ’ন্যায় হতে দেন না। সাইরাহ্ বিছানার ওপর পা তুলে বসে বলে,
‘কবে যেনো দেখি এই বাড়িতে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ লেগেছে। তাও আবার আমাকে নিয়ে।’
সাইরাহ্ হাসতে শুরু করে। সাহিত্য এবারও কিছু বলে না। আড়চোখে ক’বার তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। সাইরাহ্ বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে গুণ গুণ করে গান ধরে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ায়,
‘জীবন বার বার নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। চোখের সামনে এমন অনেক কিছু ঘটছে যা ঘটার ছিলো না।’
—
রাতের আঁধারে প্রধানের সদস্য শাহিন শেখের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অজ্ঞাত ব্যাক্তি। আঁধারে এবং কালো পোশাক পড়া এই মুখোশধারীকে চেনা যাচ্ছে না। অনেকটা সময় ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। যখন চারপাশটা শান্ত, নীরব তখন বেড়িয়ে আসে। শাহিন শেখের ঘরের জানালার কাছে অদ্ভুত কিছু শব্দ করে। শাহিন শেখ ঘুমের ঘোড়েই ঘর থেকে ক’বার বলে ওঠে, ‘কে রে?’
অজ্ঞাত ব্যাক্তি জবাব দেয় না। সাবধানে আরো শব্দ করতে থাকে। শাহিন শেখ বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। ভাবে কোনো ছেলেপেলে রাতের বেলা বিরক্ত করতে এসেছে। তাই হাতে লাঠি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়৷ সবাই তখন গভীর ঘুমে। ঘরের পেছনে জানালার কাছে আসতেই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি চোখে পড়ে। শাহিন শেখ গা’লি দিয়ে ধমকে উঠে বলে,
‘রাইত বিরাতে মাইনষের বাড়ির সামনে কি করস? বে’য়া’দ’ব পোলা।’
অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি মেয়ে নাকি ছেলে বোঝার উপায় নেই। শাহিন শেখ মুখের ওপর লাইট মে’রে বলে, ‘কেডা রে তুই?’
ব্যাক্তিটি জবাব দেয় না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সোজা ছুটে গিয়ে শাহির শেখের মুখের ভেতর এক টুকরো কাপড় ঢুকিয়ে দিয়ে হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মাথায় বা’রি দেয়। শাহিন শেখ আত্মরক্ষার চেষ্টার আগেই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে৷ ব্যাক্তিটি শক্ত করে শাহিন শেখের হাত বেঁধে নিয়ে টেনে নিয়ে যায় দুরে। নদীর পানি এনে ছোড়ে মুখে। কিছুক্ষণের মাঝে শাহিন শেখের জ্ঞান ফেরে। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকে ব্যাক্তিটির দিকে। ব্যাক্তিটি ঠোঁটের কোণে ভ’য়ং’কর হাসি ঝুলিয়ে বলে,
‘ভয় লাগতেছে শাহিন শেখ? এতো এতো অ’ন্যায় কইরা এখন দেখি শাহিন শেখের চোখে মৃ’ত্যুর ভয়। আমিই তো ভয় পেয়ে গেলাম।’
শাহিন শেখ গোঙাতে থাকে। ব্যাক্তিটি ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ‘তোমারে কিভাবে মা’রলে মনে শান্তি পাওয়া যাবে বলো তো! হাত, পা আগে কা’ইটা নিবো? নাকি শরীরের চামড়া ছি’লে নিবো? নাকি একবারে মাথা থেকে দেহ আলাদা করে দিবো? কোনটা ভালো হবে?’
শাহিন শেখ ভয়ে দুদিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কাঁদতে শুরু করে। মুখে কাপড় থাকা সত্বেও গোঙাতে গোঙাতে বাঁচার আকুতি করতে থাকে হয়তো। অস্পষ্ট শব্দে কিছু কথা ভেসে আসে। ব্যাক্তিটি শোনে না৷ বরং রেগে শাহিন শেখের মুখ চেপে ধরে বলে,
‘বাঁচার আকুতি করিস? তোদের কাছেও তো সে বাঁচার আকুতি করছিলো। বাঁচতে দিছিলি? দিস নাই৷ বরং মনের খোরাক মিটিয়ে তারপর নৃ’শং’স ভাবে খু’ন করেছিস। তোরে আমি বাঁচতে দিবো এতো সহজে! তোদের জন্য আমি ওরে হারাইছি। এবার তোদের একটা একটা পা’পের শা’স্তি দিবো।’
ব্যাক্তিটি রাগে নিজের ব্যাগ থেকে রাম দা বের করে। এক কোপে শাহিন শেখের লি*ঙ্গ কে’টে ফেলে। শাহিন শেখ তড়পাতে শুরু করে। ব্যাক্তিটির রাগ কমে না। একের পর এক কোপ দিতেই থাকে। গলায়, বুকে, পেটে, মাথায়। শাহিন শেখ ছটফট করতে করতে মা’রা যায়। তবুও যেনো ব্যাক্তিটির শান্তি হয় না। শেষ একটা কোপ দিয়ে রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে আওড়ায়,
‘এরপর তোরা। তৈরী থাক।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)