সাহেবা পর্ব-২১

0
284

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

২১.
সকাল থেকে বাড়িতে বিরাট আয়োজনে কাজ চলছে। আজ সাইরাহ্ আর সাহিত্যের বিয়ে। জুম্মার পর তাদের বিয়ের কার্যক্রম শুরু হবে৷ তামজীদ চারদিকে দৌড়ে দৌড়ে সব কাজ দেখছে। সাহিত্য আসতে চেয়েছিলো কিন্তু তামজীদ-ই নিষেধ করেছে। নাজিরা, বেলী, ছন্দ, বড় ভাবী, ছোট ভাবী মিলে সাইরাহ্-কে বেনারসি পড়িয়ে সাজিয়ে দেয়। সাহিত্যসহ বাড়ির বড়রা গেছে মসজিদে নামাজ পড়তে। এর মাঝেই তাহেরা, সবুর মিয়া, সোহেল, সাইমা আর তার স্বামী রাজীব আসে। সাইরাহ্ তো তাদের দেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। একই গ্রামে বিয়ে হওয়া সত্বেও মা, ভাইয়ের মুখ দেখা হয় না কবে থেকে! সাইরাহ্ সোহেলকে জড়িয়ে ধরতেই সোহেল মনম’রা স্বরে বলে,

‘বুবু, তুমি বাড়ি যাও না ক্যান? তোমারে দেখি না কতদিন!’

সাইরাহ্-র চোখ ছলছল করে ওঠে। ভাইয়ের গালে হাত রেখে তাকায় নিজের বাবার দিকে। সবুর মিয়ার চোখ তখন চারপাশে। মেয়ের চোখের জল সে দেখে না। সাইরাহ্ নিজেকে সামলে বলে,

‘আমি যাই না তাই কী? তোর যখন আমারে দেখতে মন চাইবে তুই তখনই চলে আসবি। ঠিক আছে?’

সোহেল হাসিমুখে মাথা নাড়ায়। তাহেরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। সাইরাহ্ শান্ত করে তাকে। সাইমা বেশ খুশি হয় বোনকে এইরকম ভাবে দেখে। স্নেহজড়িত কন্ঠে শুধায়,

‘ভালো আছিস তো?’

সাইরাহ্ হাসে। সে হাসিতেই সাইমা বুঝে যায় তার বোন ভালো আছে৷ সাইমাও হাসে। হাতে হাত রেখে বলে, ‘তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে বোন।’

সাইমা সরতেই সাইমার স্বামী রাজীব অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে, ‘সাইরাহ্ সত্যি সত্যি তোমার বিয়া এতো বড় বাড়িত হইসে? এইরকম বড় চাল দিলা কেমনে?’

সাইমা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সাইরাহ্ শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটাকে সে খুব ভালো মতো জানে। ভাবে জবাব দেবে। তবে তার আগেই হাজির হয় লুবনা। হাসতে হাসতে বলে,

‘তাও একটা দেয় নাই, একসাথে দুই দুইটা চাল দিছে৷ যেইটারে ফাসাইতে পারবে ওইটার দিক থেকেই লাভ। তাই না সাইরাহ্?’

পাশ থেকে নাজিরা ধমকো ওঠে, ‘লুবনা?’

‘ধমকাচ্ছিস কেনো? সত্যিটাই তো বলেছি। কিভাবে ফাসিয়েছে আল্লাহ ভালো জানেন। নিশ্চয় কা’লো জাদু টাদু জানে নাহলে দুই দুইটা ছেলেকে নখের ঈশারায় নাচিয়ে দিচ্ছে! তাও আবার বিধবা হয়ে!’

সাইরাহ্ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে৷ তাহেরার দিকে চোখ পড়তেই দেখে তিনি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। সাইরাহ্ আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটায়। এরপর মুখের হাসি ধরে রেখেই বলে,

‘প্রথমত, আমার জানামতে আমি আপনার বড় ভাইয়ের বউ। তাই বড় ভাবীকে নাম ধরে ডাকাটা বেমানান। শুধু সাইরাহ্ না বলে ভাবী কিংবা সাইরাহ্ ভাবী বললেও চলবে। দ্বিতীয়ত, আমার প্রয়োজন নেই কাউকে ফাসানোর। আমি আমার অবস্থানে খুশি। তাই কাউকে জাদু করে, ফাসিয়ে আমার বিয়ে করার প্রয়োজন নাই। আমার মনে এতো লোভ, হিংসা নেই।’

লুবনা ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নাজিরা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকায়। এর মাঝেই নিচে পুরুষরা চলে আসে। সবাই ধীরে ধীরে নিচে নেমে যায়। নাজিরার ঘরে শুধু তাহেরা, সাইমা থাকে। সোহেলও নিচে নেমে গেছে। সাইমা সুযোগ বুঝে সাইরাহ্-কে চেপে ধরে,

‘ওরা তোকে মেনে নিয়েছে? তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে তো? সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক কেমন তোর?’

সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, ‘যে বিধবাকে ওরা অ’লক্ষী ভাবে সেই বিধবাকে কী এতো সহজে মেনে নিবে বুবু? তবে সাহিত্য ভাই অনেক ভালো। উনার বড় ভাবী, ছোট ভাবী, নাজিরা ওরাও খুব ভালো। সহজেই আমাকে মেনে নিয়েছে। কাকী আমার সাথে কথা বলে না।’

‘সীমান্তকে নিয়ে তোদের মধ্যে ঝ’গড়া হয় না তো?’

সাইরাহ্ হেঁসে ফেলে। সীমান্তকে বাদ দিয়ে তাদের মধ্যে সব বিষয় নিয়েই ঝ’গড়া হয়। কিন্তু এটা বললে সাইমা আর তাহেরা চিন্তা করবে। তাই বলে না কিছু। সাইমা অবাক হয়ে শুধায়,

‘হাসছিস কেনো? হাসার মতো কিছু কইছি?’

‘বুবু, সীমান্ত ভাইকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা-ই হয় না। উনি চেষ্টা করে আমি যেনো অতীত নিয়ে বসে না থাকি।’

সাইমা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। বোনকে জড়িয়ে ধরে। সে যেই সংসারের অশান্তিতে আছে এই অশান্তিতে কখনো তার বোন না পড়ুক। এই দোয়া সে আজীবন মনে প্রাণে করে যাবে। বোনটা তার অনেক কিছু সহ্য করেছে এবার সুখের মুখ দেখুক।


বিয়ের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে সাহিত্য নিজের ঘরে এসেছে৷ চোখে মুখে পানি দিয়ে সব ঠিকঠাক করে নিয়ে যখনই আবার নিচে নামতে যাবে তখনই সীমান্তের মুখোমুখি হয়ে যায়। সাহিতয় শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সীমান্ত মাথা নিচু করে সরাসরি বলে,

‘তুই বিয়েটা করিস না সাহিত্য।’

সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে। কথাটা কানে গেলেও মানে পুরোপুরি বুঝতে পারে না। তাই উল্টো শুধায়, ‘মানে? বিয়ে করবো না কেন?’

সীমান্ত মাথা তুলে তাকায়। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। সাহিত্য বুঝে যায়। তবুও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে আওড়ায়, ‘সাহেবাকে চাস না, সীমান্ত। চাস না।’

কিন্তু তার মনের কথা না শুনেই সীমান্ত হাত জোড় করে বলে, ‘সাইরাহ্-কে বিয়ে করিস না। আমি বাঁচতে পারবো না সাহিত্য। তুই দিয়ে দে ওরে। আমি অনুরোধ করতেছি তোর কাছে।’

সাহিত্য চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিজেকে শক্ত রাখে৷ সীমান্ত ফের বলে, ‘তোর পাশে ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না, সাহিত্য। বিশ্বাস কর আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আমি সব ছেড়ে ছুড়ে ওকে নিয়ে চলে যাবো। আমি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওকে নিয়ে যাবো। তুই ওকে ছেড়ে দে সাহিত্য।’

‘ছেড়ে দিবো? বিয়ে করবো না? তুই ওকে নিয়ে যাবি? সবার বিরুদ্ধে গিয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

সাহিত্য শব্দ করে হেঁসে ওঠে। সীমান্তের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘সেদিন যেভাবে সবার বিরুদ্ধে গেছিলি সেভাবেই? সীমান্ত, তুই অনেক দেড়ি করে ফেলছিস। তুই এই সিদ্ধান্তটা সেদিন যদি সাহস করে নিতি তাহলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে, কাউকে পরোয়া না করে তোদের বিয়েটা দিয়ে দিতাম। কিন্তু তুই সেদিন পারিসনি সাহেবাকে আগলে রাখতে।’

‘আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে৷ তুই তো জানিস বড় ভাইজান নিখোজ হওয়ার পর আমিই আব্বা আম্মার একমাত্র অবলম্বন ছিলাম। তাই তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। তবুও আমি জানি আমি সাইরাহ্-র সাথে অ’ন্যায় করেছি। তার জন্য সারাজীবন ধরে ক্ষমা চাইলেও আমার ক্ষমা হবে না। কিন্তু সেই ভুলটা আমি শুধরে নিতে চাই। তুই করিস না বিয়েটা। আমি সাইরাহ্-কে নিয়ে দুরে চলে যাবো। কারোর কথা মানবো না।’

‘সাহেবা কোনো খেলনা না সীমান্ত। শুধু তুই আর আমি চাইলাম আর বার বার ওকে নিয়ে খেললাম এমনটা হয় না। সাহেবা নিজের জীবনের গতি এগোতে চাচ্ছে ওকে এগোতে দে। আর! আমি আজ বিয়ে করি বা না করি তাতে এটা পাল্টে যাবে না যে ওর সাথে আমার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। একবার তুই চাইলি বিয়ে করলি না, আরেকবার আমি বিয়ে করবো আবার ছেড়ে দিবো, আবার তুই বিয়ে করতে চাইবি! এটা কোনো নাটক সিনেমা না। এটা সাহেবার জীবন।’

সীমান্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হৃদয় ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত হচ্ছে কিন্তু সাইরাহ্-কে ফিরে পাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। সাহিত্যও তো ভুল বলেনি কিন্তু মন যে মানে না। মন সব যুক্তিকে ভুল করে দিয়ে কেবল চাইছে সাইরাহ্-কে। তবে সময় বলছে সে এগিয়ে গেছে। সাইরাহ্-ও অনেক দুরে চলে গেছে। সাহিত্য সীমান্তকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়েও থেমে যায়। থমথমে স্বরে বলে,

‘আর সাহেবা এখন সম্পর্কে তোর বড় ভাবী। আমরা সমবয়সী হলেও আমি তোর থেকে কিছুদিনের বড়। আর সেই সুবাদে সাহেবা তোর ভাবী হয়। এবং এটাও মনে রাখিস সাহেবা তোর বন্ধুর বউ। আশা করবো বন্ধুর বউয়ের প্রতি তুই কোনো অনুভূতি রাখবি না।’

সাহিত্যের একেকটা শব্দে সীমান্ত থমকে যায়। ‘বড় ভাবী’ আর ‘বন্ধুর বউ’ শব্দগুলো তার কানে বাজতে থাকে। সে ভুলেই গেছিলো সাইরাহ্ আর সাহিত্যের সম্পর্কটা। সে এতোদিন শুধু এটা শুনেছে সাইরাহ্ আর সাহিত্য বিবাহিত কিন্তু আজ যেনো অনুভবও করে নিলো সত্যিটা। সাহিত্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে সীমান্ত পেছন থেকে শুধায়,

‘তুই তো সাইরাহ্-কে ভালোবাসিস না। তাহলে ওকে ছাড়তে পারছিস না কেনো?’

সাহিত্য শুধু হাসে। জবাব দেয় না। প্রশ্নটা এড়িয়ে সে নিচে নেমে যায়। সীমান্ত নিচে বসে পড়ে। সাহিত্য চোখের আড়াল হয়ে গেলে নাজিরা আসে। এতক্ষণ সে ছাঁদেই ছিলো। কিন্তু দুজন কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় তাকে খেয়াল করেনি। নাজিরা অনুভূতিশূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘সত্যটা কঠিন হলেও তা মেনে নিতে হবে। নিজেকে সামলে নিন সীমান্ত ভাই।’


খুব সুন্দর ভাবেই দ্বিতীয় বারের মতো সাইরাহ্ আর সাহিত্যের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সবাই যার যার মতো চলে যায়। তাহেরা, সবুর মিয়া, সাইমা, রাজীব, সোহেল সবাই বাড়ি চলে যায়। কাল বউভাতে তারা ফের আসবে। সোহেল থাকার বায়না করলেও তাহেরা তাকে থাকতে দেয়নি। রাত হয়েছে। তামজীদরা মিলে সাহিত্যের ঘর সুন্দর করে সাজিয়েছে ফুল দিয়ে। নাজিরা, বড় ভাবী, ছোট ভাবী মিলে সাইরাহ্-কে সাহিত্যের ঘরে দিয়ে যায়। বড় ভাবী আর ছোট ভাবী মজার মাধ্যমে অনেক কথা বলে ফেলেছে। তবে সেদিকে সাইরাহ্-র মন নেই। সে এর আগেও এ ধরণের কথা শুনেছে। তার প্রথম বিয়ের সময়। তখনও আশে পাশের ভাবীরা এসব বলেছিলো। তাই এই কথাগুলোতে তার খুব একটা মন নেই। তার মন বার বার প্রথম বারের সেই স্মৃতির দিকে যাচ্ছে। সে সেবারও এরকম সাজানো ফুলের মাঝেই বসেছিলো। হঠাৎ বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচি শুনে বেড়িয়ে দেখে একটা লা’শ। সাইরাহ্ কেঁপে ওঠে। স্মৃতিগুলো মনে করতে না চাইলেও মনে পড়ে যায়। বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলায়। মনে মনে আওড়ায়,

‘একবার যা হয়েছে তা যেনো আর কখনো না হয় আল্লাহ।’

বড় ভাবীরা চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদেই ঘরে ঢোকে সাহিত্য। সাইরাহ্-কে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কন্ঠে শুধায়,

‘আবার কী আগের অবস্থায় ফিরে গেলি নাকি? ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা, মুখ দেখলেই অ’মঙ্গল হবে! এগুলাতে গেলি নাকি আবার?’

সাইরাহ্ বুঝে ওঠে না লোকটার মাথায় বুদ্ধি আছে নাকি নাই৷ এটাও জানে না নতুন বউ ঘোমটা দিয়েই বসে থাকে! হঠাৎ করে সে আগের মতো কেনো করবে? তাই নিজেই চট করে নিজের ঘোমটা তুলে বলে,

‘নতুন বউ বলে আপনার ভাবীরা ঘোমটা দিয়ে রেখে গেছে৷ আমি দেইনি। আমার অতো ঠ্যাকা পড়েনি যে আপনার জন্য ঘোমটা দিবো।’

বলেই মুখ বাকায়। সাহিত্য এগিয়ে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলে, ‘ঘোমটা দিয়ে গেছে তাইলে তো আমি তুলবো, তুই কেন তুললি?’

‘আপনার যা জানার অবস্থা তাতে নিজে না তুলে থাকতে পারলাম না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা হইছে! জীবনে প্রথমবার এভাবে বিয়ে করলাম তাই তো জানি না। পরের বার ঠিক হয়ে যাবে।’

সাইরাহ্-র কপালে ভাজ পড়ে। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে, ‘কী? পরের বার মানে? আপনি কী আরো বিয়ে করবেন নাকি?’

সাহিত্য আরাম করে পা তুলে সাইরাহ্-র সামনাসামনি বসতে বসতে বলে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তুই যদি ঠিকমতো সেবাযত্ন না করিস তাহলে তো আমি আরো ২-৩ টা বিয়ে করবোই।’

সাইরাহ্ কটমট করে বলে ওঠে, ‘করেন। আরো ২-৩ টা ক্যান? পারলে আরো শ’খানেক বিয়ে করেন। প্রত্যেকবার বিয়ের সময় এমন জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন কইরেন যেনো পেটপুরে খেতে পারি। ঠিক আছে?’

‘করবো? পাক্কা?’

‘হ্যাঁ। করেন। আমার কী?’

সাহিত্য সামান্য এগিয়ে গিয়ে মুখ এগিয়ে দেয়। সাইরাহ্ হকচকিয়ে পিছিয়ে যায়। সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘তোর কিছু না?’

সাইরাহ্ শ্বাস আটকে দুদিকে মাথা নাড়ায়। সাহিত্য সেভাবেই হেঁসে একটানে সাইরাহ্-কে নিজের দিকে টেনে নেয়। সাইরাহ্ চমকায়। সাহিত্য সাইরাহ্-র কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মুখের দিকে এগোয়। সাইরাহ্-র কন্ঠ কেঁপে কেঁপে ওঠে,

‘কি করতেছেন সাহিত্য ভাই?’

সাহিত্যর নির্লিপ্ত জবাব, ‘বাসর রাতে যা করে তাই।’

সাইরাহ্ শান্ত হয়ে যায়। সরে যায় না। শক্ত হয়ে বসে থাকে। সাহিত্য সাইরাহ্-র পরিবর্তন টের পেয়ে বলে, ‘কি হইছে সাহেবা?’

‘কিছু না তো।’

‘আমি কাছে আসলে তোর সমস্যা নাই?’

সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘না। আমি আপনার বিয়ে করা বউ। আপনার হক আছে আমার ওপর। তাই আপনাকে বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই।’

সাহিত্য হেঁসে মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সরাসরি সাইরাহ্-র কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সাইরাহ্ বন্ধ চোখেই চমকায়। চোখ মেলে তাকাতেই সাহিত্যের চোখে চোখ পড়ে যায়। সাহিত্য দু হাতে তাকে আগলে নিয়ে বলে,

‘তুই আমার বউ, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোর বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই না। তুই আমাকে ভালোবেসে যেদিন চাইবি সেদিন সম্পূর্ণ তোকে আমার করে নিবো।’

সাইরাহ্ হাসে৷ সাহিত্যের কথার বিপরীতে জবাব দেয় না। সে জানে সাহিত্যকে, বোঝে। জোড় করার হলে আগেই করতো। যে পুরুষ এতোটা উজাড় করে ভালোবাসতে পারে সে পুরুষ পা’ষাণ নয়। সাহিত্য সাইরাহ্-কে ছেড়ে একপাশে শুয়ে পড়তে পড়তে বলে,

‘শুয়ে পড়। সারাদিন অনেক ধকল গেছে।’

সাইরাহ্ মাথা নাড়িয়ে নিজের গায়ের গহণাগুলো খুলতে থাকে। এগুলো নিয়ে ঘুমানো সম্ভব না। শাড়িটাও বেশ ভারী তাই সে উঠে আলমারি থেকে বাসন্তী রঙের শাড়ি নিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। শাড়ি পাল্টে এসে দেখে সাহিত্যের চোখ বন্ধ। সাইরাহ্ শাড়ি রেখে ভাবে সাহিত্যকে ডাকবে কী না! তবে না ডেকে পাশে শুয়ে পড়তেই সাহিত্য এক হাতে তাকে টেনে নিজের বাহুতে আনে৷ শান্ত স্বরে বলে,

‘তবে এটুকু আমি ছাড়তে পারবো না।’

সাইরাহ্ আকস্মিক কাজটায় কিছু বুঝে ওঠে না। সরে যেতে গিয়েও আর সরে না। ওভাবেই সাহিত্যের বুকে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করে নেয়। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে হাওয়ার গতিতে ছুটতে থাকে৷ বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে থাকে। এক হাত সাহিত্যের বুকের ওপর রেখেই ঘুমানোর চেষ্টা করে। নীরবতায় স্পষ্ট শুনতে পায় সাহিত্যের হার্টবিট।


পরেরদিন বউভাত। আজ সাইরাহ্-কে তাহেরা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। অন্য কোনো অনুষ্ঠান, নিয়ম না মানলেও তাহেরা এই সুযোগটুকু ছাড়েনি। দুপুরের আগে থেকে সকলে এসে বউ দেখে যাচ্ছে। সাহিত্যদের বিভিন্ন আত্মীয়রা। সাইরাহ্ বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। আরেকটু পর আবার নতুন করে সেজেগুজে নিচে গিয়ে বসতে হবে। ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে৷ এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক পড়ে। নাজিরা ব্যস্ত ভাবে ছুটে এসে বলে,

‘ভাবী, জলদি নিচে চলেন।’

সাইরাহ্ না বুঝে বলে, ‘কেনো? কিছু হইছে?’

‘পুলিশ আসছে। আপনাকে খুঁজতেছে। জলদি চলেন।’

পুলিশের কথা শুনে সাইরাহ্-র মাথা ঘুরে যায়। হঠাৎ পুলিশ তারে খুঁজতেছে কেন? নাজিরার হাত ধরে ভয়ে ভয়ে নিচে নামে। মেহমান যারা ছিলো সবাই এক পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করতেছে। সাহিত্য পুলিশের সাথে কথা বলতেছে। শেখর সাহেব সাইরাহ্-কে দেখে ডাকেন। পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘এই তো সাইরাহ্ চলে আসছে। এবার বলুন, কী হয়েছে?’

পুলিশ অফিসারটি সাইরাহ্-কে শুধায়, ‘আপনি সাইরাহ্?’

সাইরাহ্ উপর নীচ মাথা নাড়ায়। তিনি আবার শুধান, ‘আপনি তুহিন সরদারকে চেনেন?’

সাইরাহ্ চমকে তাকায়। তুহিন সরদার! ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, ‘চিনি। আমার বিয়ে হয়েছিলো উনার সাথে।’

‘হ্যাঁ। আমরা সে বিষয়েই কথা বলতে এসেছি। যদিও মনে হচ্ছে আজ আপনাদের একটা বিশেষ দিন তবুও বিরক্ত করছি। আসলে আমরা আশংকা করছি উনি আ’ত্ম’হ’ত্যা করেননি বরং ওটা খু’ন ছিলো। সে বিষয়ের ওপরেই তদন্ত চলছে। যেহেতু আপনি উনার স্ত্রী ছিলেন তাই প্রয়োজনে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। আশা করছি আপনি সাহায্য করবেন আমাদের।’

সাইরাহ্ চোখ তুলে সাহিত্যের দিকে তাকায়। সাহিত্য চোখের ঈশারায় ‘হ্যাঁ’ বলতে বলে। সাইরাহ্-ও হ্যাঁ বলে দেয়। পুলিশ চলে যায়। সাইরাহ্ ধপ করে বসে পড়ে। অতীত বার বার তার জীবনে কেনো ফিরে আসে? তুহিনের মৃ’ত্যু আসলেই বা কিভাবে হয়েছে? এতোদিন পরই বা কেনো তদন্ত?

চলবে..