#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____
৩০.
পাশের গ্রামের পুলিশ এসেছে সাইরাহ্-র সাথে কথা বলার জন্য। তুহিন সরদারের মৃ’ত্যুর তদন্ত চলছে বিধায় সাইটাহ্-কে কিছু প্রশ্ন করা হবে। সাহিত্য অফিসারকে বসিয়ে তার সাথে কথা বলেছে। সাইরাহ্ ভয়ে দুরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাহিত্য তার কাছে যায়। নিচু স্বরে বলে,
‘তুই ভয় পাচ্ছিস কেনো? কিছু করেছিস?’
সাইরাহ্ দু’দিকে মাথা নাড়ায়। সাহিত্য তার হাত ধরে ভরসা দিয়ে বলে, ‘ওরা তোকে খেয়ে ফেলবে না। কিছু প্রশ্ন করবে তুই শুধু জবাব দিবি। আর আমি আছি না? আমি থাকতে তোর কোনো ক্ষতি হবে না। চল!’
সাইরাহ্-কে সামনে এনে দাঁড় করালে অফিসারটি তাদের হাতের দিকে তাকায়। সাহিত্য তা দেখেও হাত ছাড়ে না। অফিসার নিজের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলে,
‘আমরা একটু আলাদা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’
‘ছাঁদে আসুন। ওখানে কেউ যাবে না।’
সাহিত্য আর সাইরাহ্-কে অনুসরণ করে অফিসার গেলেন ছাঁদে। সাইরাহ্-কে রেখে সাহিত্য সিড়িতে গিয়ে উল্টো ফিরে বসে। তুহিনের কেইসটা আবার কে খুলেছে সে অনুমান করতে পারছে, এখন শুধু খোঁজ নেওয়ার পালা। সাইরাহ্-কে ভীত হতে দেখে অফিসার বলেন,
‘ভয় পাচ্ছেন কেনো? আমি আপনাকে স্বাভাবিক কিছু প্রশ্ন করবো। ভয় পাবেন না।’
সাইরাহ্ মাথা নাড়িয়ে বড় করে শ্বাস নেয়। অফিসার প্রথম প্রশ্ন করে,
‘আপনাদের বিয়ের তারিখ মনে আছে?’
সাইরাহ্ দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘ওভাবে তো হিসাব রাখতাম না। তবে আমার মায়ের মনে থাকতে পারে।’
‘আচ্ছা। তুহিনের সাহেবের সাথে আপনার পারিবারিক ভাবে বিয়ে নাকি প্রেমের বিয়ে?’
‘পারিবারিক। আব্বা-ই ঠিক করেছিলেন বিয়েটা।’
অফিসার বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, ‘ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না? তুহিন সরদারের পারিবারিক অবস্থা আপনাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ ভালো। আর আমরা তার সম্পর্কে যা জেনেছি তাতে এতো মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ে করার মতো মহৎ পুরুষও সে নয়। অথচ আপনাদের বিয়েটা খুব দ্রুত, একটুও সমস্যা ছাড়া হয়ে গেছিলো!’
‘এ ব্যাপারে যে আমার প্রশ্ন নেই ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। তুহিন সরদার কেমন ছিল তা আমার জানা নেই কিন্তু হঠাৎ, এতো বড় বাড়িতে আমার বিয়ের সম্বন্ধ কিভাবে হলো তা আমি জানি না। তাও আবার দুদিনের মাঝে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায়।’
‘বিয়ের আগে বা পরে তুহিনের ব্যবহার আপনার সাথে কেমন ছিল?’
সাইরাহ্ অবাক হয়ে বলে, ‘আমার সাথে তো উনি কখনো কথা-ই বলেনি। বিয়ের আগেও না আর বিয়ের পরেই তো মা’রা গেলো।’
অফিসার বেশ অবাক হয়। মেয়ের সাথে কথা না বলেই তুহিন বিয়ে করে নিলো? এতো শুদ্ধ পুরুষ তো সে নয়। তবে এই বিয়ের পিছনে কি অন্য কোনো কারণ ছিল? অফিসার ফের প্রশ্ন করলেন,
‘তুহিন সাহেব আর ওর পরিবারের কোনো কাজ আপনার সন্দেহজনক মনে হয়েছিলো?’
‘না। সবই স্বাভাবিক ছিল।’
‘সেদিনকার ঘটনাটা একটু খুলে বলতে পারবেন? যেদিন আপনাদের বিয়ে হয়!’
সাইরাহ্ মাথা নাড়ায়। সেদিনের ঘটনা মনে করে বলতে শুরু করে, ‘সকাল থেকে বাড়িতে বিয়ের উৎসব চলছিলো। সবাই নিজেদের কাজ করছিল। আব্বা-আম্মা অতিথি আপ্যায়ন করছিলেন, আপা আর ভাই আমার সাথে ছিল। বিকালে আসরের পর উনারা আসেন। কোনো ঝামেলা ছাড়া-ই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর ওখানে বউ বরণ করে আমাকে ঘরে বসানো হয়। এরপর একে একে আশে পাশের মানুষ এসে আমাকে দেখছিল। রাত হচ্ছিল বলে যখন ঘর ফাঁকা হয় তার কতক্ষণ পরই সবাই চেঁচামেচি শুরু করে। বাহিরে গিয়ে দেখি উনি…’
সাইরাহ্ চুপ মেরে যায়। অফিসার বুঝতে পেরে বলে, ‘আচ্ছা, আপনাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তুহিন সাহেব আপনার সাথে কথা বলেনি? বা আপনি বলেননি?’
‘না। উনি নিজের মতো ছিল, আর আমি নিজের মতো ছিলাম।’
‘তুহিন সাহেবকে কি কোনো কারণে চিন্তিত মনে হচ্ছিল?’
সাইরাহ্ এবারও ‘না’ বলে। অফিসার জানে এটা খু’ন। কিন্তু না আছে কোনো প্রমাণ, না আছে কোনো সাক্ষী। একটা মানুষ যে বিয়ে করল, চিন্তা ভাবনা ছাড়া-ই ছিল সে কিভাবে হঠাৎ করে আত্ম’হ’ত্যা করে? অফিসারকে চুপ থাকতে দেখে সাইরাহ্ বলে,
‘আমি একটা প্রশ্ন করবো?’
‘জ্বি, করুন।’
‘এতোদিন তো সবাই জানতো উনি আত্ম’হ’ত্যা করেছে। হঠাৎ কীভাবে বুঝলেন খু’ন হয়েছে? আর এটা আরও আগে তদন্ত না করে এতো পরে কেনো?’
অফিসার হেসে বললেন, ‘সুন্দর প্রশ্ন। তখন তারা ভেবেছিল এটা আত্ম’হ’ত্যা কারণ কোনো প্রমাণ-ই তারা পায়নি। আপনার আবার বিয়ে হলো তার দু’দিন আগেই রি-ওপেন করা হয়েছে। এতোদিন সব দিক থেকেই তদন্ত করেছি তবে কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না তাই আজ আপনার সাথে কথা বললাম। এগুলো সাধারণ তদন্ত। ভয় পাবেন না।’
সাইরাহ্ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালে অফিসার হাসেন। এরপর চলে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে বলে, ‘আরেকটা শেষ প্রশ্ন আছে।’
‘জ্বি, করুন।’
‘বিয়ের আগে আপনার কারো সাথে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল? বা আপনাকে কেউ ভালোবাসতো বা বিরক্ত করতো?’
সাইরাহ্ এ প্রশ্নে থম মেরে যায়। সীমান্তের নাম সে বলতেই পারে কিন্তু এতে তো খু’নের কেইসের সাথে সে জড়িয়ে যাবে। দ্বিধাদ্বন্দে বার বার সে সিড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। তা দেখে অফিসার বলেন,
‘উনাকে জানাবো না। বলেন!’
‘উনি জানে সবই। উনার মামাতো ভাই হয়। প্রধানের ছেলে, সীমান্ত।’
অফিসার একদমে থ মেরে যায়। সে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘কে?’
‘সীমান্ত ভাই। আমাদের গ্রাম প্রধানের ছেলে উনি।’
অফিসারের কাছে সবটা যেনো পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে গেছে। সে ভালোমতোই সাইরাহ্-র বিয়ের কারণ বুঝে যায়। সাইরাহ্ কিছু একটা আন্দাজ করে ব্যস্ত গলায় বলে,
‘না না। সীমান্ত ভাই এমন মানুষ না। উনি কাউকে মা’রতে পারে না।’
অফিসার নিজের মাথায় ক্যাপটা পরতে পরতে এগোন নিচের দিকে। যাওয়ার আগে বলে যান, ‘সে তো সম্পূর্ণ তদন্ত শেষেই জানা যাবে। তবে আপনার বিয়ের রহস্য সমাধান। তুহিন সরদার মূলত আপনাকে বিয়ে করেছিল প্রধানের কথায়। কিন্তু এদের এতো সখ্যতা কিভাবে হলো?’
অফিসার চলে গেছেন। সাইরাহ্-র মাথায় সব পেঁচিয়ে গেছে। সে তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাহিত্য এগিয়ে আসে। তার পাশে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
‘কি হয়েছে? কি বলেছেন উনি?’
সাইরাহ্ সরাসরি প্রশ্ন করে, ‘আমার যে আগে বিয়ে হয়েছিল ওটা প্রধান কাকার কথায়? তার মানে উনি আগে থেকেই জানতেন সীমান্ত ভাই আমাকে পছন্দ করতো! আর এজন্যই উনি আমাকে সরাতে বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। তাই না?’
সাহিত্য রহস্যময় হাসি দেয়। মাথায় টোকা মে’রে বলে, ‘তুই তো বেশ বুদ্ধিমতী।’
‘আপনি কখন জেনেছিলেন সীমান্ত ভাই আমাকে ভালোবাসে? কারণ আমার বিয়ের আগে জানলে আপনি সেবারও এভাবেই বিয়ে ভাংতেন তা আমি ঢের বুঝেছি।’
সাহিত্যের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। মেয়েটা বেশি বুদ্ধি খাটাতে গিয়ে বেশিই অতীতে চলে যাচ্ছে। পরে কেউটো খুঁজতে গিয়ে সাপ না বের হয়ে আসে! সাহিত্য তাকে সামাল দিয়ে বলে,
‘তোর বিয়ের পরে জেনেছিলাম। সীমান্তকে কাঁদতে দেখেছিলাম। ‘ও’ নিজ মুখে কখনো বলেনি তবে ওর চোখ সবই বলে দিতো। তোর যেদিন বিয়ে হয় সেদিন আমি গ্রামেই ছিলাম না। তার ১ সপ্তাহ আগে থেকে কাজের জন্য আমাকে আর তামজীদকে শহরে যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে শুনেছিলাম সব।’
সাইরাহ্ আর প্রশ্ন করে না। তার মাথার মধ্যে সবগুলো কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সাহিত্য তার চোখ মুখ দেখেই বোঝে এর মাথায় কি চলছে! তবে ভাবতে ভাবতে মুখে জিজ্ঞাসাও করে বসে,
‘তুহিন সরদার আর প্রধান কাকার মধ্যে সম্পর্কটা কী? উনার কথায় তুহিন সরদার আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো কেনো?’
_
তালিব উদ্দীন দুই ছেলের সাথে খেতে বসেছে। তামজীদের মা ৩ জনকে খেতে দিচ্ছে। তামজীদ চুপচাপ খাবার নিয়ে খেতে শুরু করে। তারেক একবার ভাইয়ের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় তালিব উদ্দীনের দিকে। তালীব উদ্দীন আর তারেক নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তামজীদ খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে বলে,
‘আব্বা, আমার একটু কথা আছে।’
তালিব উদ্দীন স্বাভাবিক ভাবেই বলেন, ‘ক, কি কইবি।’
তামজীদ এক দমে বলে ফেলে, ‘আমি বেলীকে পছন্দ করি আর ওরেই বিয়ে করতে চাই। প্রধান কাকার সাথে কথা বলেন।’
কথাটা তামজীদ স্বাভাবিকভাবে বললেও তালিব উদ্দীন আর তারেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বোম ফেটেছে এমন একটা ভাব দুজনের মুখে। তামজীদ সে প্রতিক্রিয়া আমলেই নেয় না। তামজীদের মা বলে,
‘প্রধান ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের মাইয়াডা?’
তামজীদ ছোট্ট করে ‘হু’ বলে। তামজীদের মা বেশ খুশিই হয়েছেন। তবে তালিব উদ্দীন আর তারেক খুশি হয়নি। তালিব উদ্দীন কড়া গলায় বললেন,
‘তোর মনো হয় প্রধান সাহেব তার ভাইয়ের মাইয়ারে তোরে দিবো?’
‘না দেওয়ার কী আছে, আব্বা? আপনার সাথে তো উনার সম্পর্ক অনেক ভালো। তা আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না?’
‘আমার পোলার লগে দিবো না ক্যা! তোর জায়গায় তারেকের কথা কইলেও রাজি হইয়া যাইবো।’
‘হ্যাঁ, তা তো যাবেই। ভালো জিনিস উনার পছন্দ না এইটা আমার থেকে ভালো কে জানে? যা-ই হোক! আমি বিয়ে করলে বেলীকেই করবো। আপনি কথা বলেন নাইলে আমি ওরে নিয়ে চলে আসবো। কি হবে তার পরোয়া আমি করি না।’
তালিব উদ্দীন কিছু বলার আগেই তামজীদ উঠতে উঠতে তারেকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শোন! তুই আমার ছোট ভাই। কি করে বেড়াস সব আমি জানি! তাই আগে থেকে বলে দিচ্ছি, বেলীর দিকে চোখ তুলে তাকাবি না। তাকাইলে তোর চোখ তুলে নিতেও আমি ২য় বার ভাববো না।’
এ কথা শুনে তারেক ফুঁসতে থাকে। লুবনার ঘটনার পর চুনকালি মাখিয়েছিল এ নিয়ে একটা রাগ তার ভেতরে আছেই। তালিব উদ্দীন চেঁচাতে থাকে। সাহিত্যের সাথে থেকেই তার এতো অধঃপতন। তামজীদের মা বড় ছেলে আর ছোট ছেলে দুজনের দিকেই তাকায়। বড় ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হলেও ছোটটা হয়নি। সাহিত্যের সাথে থেকে তার অধঃপতন হয়নি বরং মানুষ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি সব গোছাতে থাকেন।
বিকালের মধ্যেই কথাটা প্রধানের কানে ওঠে। তামজীদ বেলীকে বিয়ে করতে চায় এ নিয়ে তার রাগ আকাশচুম্বী। সাহিত্য আর তামজীদ দুটোই এক ধাঁচের। তার কাছে মেয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তালিব উদ্দীন তামজীদের চলাফেরা পছন্দ না করলেও তিনি তো বাবা তাই ঠিকই ছেলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন প্রধানের কাছে। প্রধান রেগে তার কলার চেপে ধরে। তালিব উদ্দীন অবাক হয়ে তাকালে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোমার সাহস দেইখা অবাক না হইয়া পারলাম না, মিয়া। তুমি কোন সাহসে তোমার ওই পোলার বিয়ার কথা কও তাও আমার বাড়ির মাইয়ার লগে?’
‘তাই বইলা আপনে আমার কলার ধরবেন, প্রধান সাব? আর আমরা তো গরীব না, আমার পোলাও খারাপ না তাইলে বিয়া দিলে ক্ষতি কী?’
প্রধান তালিব উদ্দীনের কলার ছেড়ে দেন। গম্ভীর গলায় বলেন, ‘নিজের পোলারে চেনো না? তুমি তারেকের লগে বিয়ার কথা কইলেও আমি ভাবতাম কিন্তু তামজীদের লগে কক্ষনো না।’
তালিব উদ্দীন জানতেন এটা। তিনিও মানেন তার বড় ছেলে সত্যিই মানুষ হয়েছেন তবে ছোটটা তার মতো অ’মানুষই হয়েছে বটে। তবে যে পাপে সে জড়িয়ে গেছে তা থেকে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। সে পারবেও না বের হতে। তার এতো ভালো ছেলেটার সাথে প্রধান কখনোই বিয়ে দিবেন না। তার কারণ তিনি তো আর চান না নিজের বিপদ ডাকতে। তালিব উদ্দীন কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে চাইলেন। তবে তার আগেই নিচ থেকে সাহিত্যের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। তালিব উদ্দীন আর প্রধান সাহেব একে অন্যের দিকে তাকায়। ঘটনা অনুমান করতে পেরে দুজনেই ছুটে যায় নিচে। সাহিত্য, তামজীদ আর শেখর সাহেব বসে আছে। বাড়ির আর সকলেও বসে আছে। তালিব উদ্দীনকে দেখে সাহিত্য হেসে বলে,
‘আরে কাকা, আপনিও আছেন! আসেন আসেন। আপনার ছেলের বিয়ের কথা বলতেই আসছি। অবশ্য জানতাম যে আপনি এখানেই থাকবেন।’
প্রধান গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘কিসের বিয়ে? কার বিয়ে?’
সাহিত্য এবারও হেসে তাকায়। দুষ্টু গলায় বলে, ‘আপনার বয়স বেশি না হইলে আপনার বিয়েটাই করাই দিতাম।’
শেখর সাহেব তাকে থামান। ভদ্র ভাবে বেলীর বাবার উদ্দেশ্যে বলে, ‘তালিব ভাইও এখানে আছে আর আপনারাও আছেন যখন তখন আমিই বলি! তামজীদ আমার ছেলের মতোই তাই ওর বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই আসছি। বেলীকে আমরা তামজীদের জন্য চাচ্ছি।’
বেলীর বাবা জবাব দেওয়ার আগেই পাশ থেকে প্রধান বলেন, ‘তামজীদের কাছো আমরা মাইয়া দিমু না। আপনে বাড়ির জামাই তাই খারাপ ব্যবহার করতাছি না। আইছেন, থাকেন, খাইয়া-দাইয়া যাইয়েন।’
‘আমরা খেতে আসিনি। আপনার সাথে আমার আরও একটা সম্পর্ক ছিল ভাই-সাহেব। ভুলে গেছেন হয়তো! যাক সেসব! আমি বেলীর বাবার সাথে কথা বলছি। দেখেন ছোট ভাই! তামজীদকে আপনিও চেনেন, সবাই চেনে। ওর মতো ভালো ছেলে আপনি আর খুঁজেও এগ্রামে একটা পাবেন না। তামজীদের সাথে বিয়ে হলে বেলী সুখী হবে এর কথা আমি দিচ্ছি। একবার এগিয়ে দেখেন!’
প্রধান বাঁধা দিলেন। তিনি সাফ সাফ জানালেন বিয়ে হবে না। ফিরে যাক সবাই তবে বেলীর বাবা সে কথা কানে নিলেন না। তিনি জানেন শেখর সাহেব, সাহিত্য আর তামজীদ কেমন! তাই তিনি বেলীকে ডাকেন। বেলী কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তার বাবা একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন,
‘তামজীদরে তোমার পছন্দ, আম্মা?’
বেলী মাথা তুলে তামজীদের দিকে তাকায়। তামজীদ অস্থির ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মানুষের মধ্যে ‘হ্যাঁ’ বলতে লজ্জা লাগলেও তামজীদের অস্থির মুখটা তাকে চুপও থাকতে দিল না। অজান্তেই মাথা উপর-নীচ নাড়িয়ে দিল। প্রধান অবাক হয়ে তাকায়। বেলীর বাবা তাকে ভেতরে যেতে বলে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
‘বড় ভাইজান, আব্বা যাওয়ার পরে আমি আপনারেই অভিভাবক মানছি কিন্তু আজকে আপনার কথাডা রাখতে পারলাম না। তামজীদরে মানা করার একটা কারণ দেখাইতে পারবেন আপনে?’
প্রধান আশপাশ হাতড়েও কারণ খুঁজে পেলো না। বেলীর বাবা হেসে চোখ সরিয়ে শেখর সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমার কোনো সমেস্যা নাই, ভাই। আমার মাইয়াও যহন রাজি তহন বিয়াডা দেওয়াই যায় কিন্তু কয়দিন আগে কেবল আমাগো বাড়ির আরেকটা মাইয়া আমাগো ছাইড়া গেছে গা। এহনই কি আমি পারমু আমার মাইয়ার বিয়া দিতে?’
সাহিত্য বোঝানো ভঙ্গিতে বলে, ‘ছোট মামা-সাহেব, আমরাও ছন্দের চলে যাওয়াতে দুঃখ পাচ্ছি। বিয়েটা খুব ধুমধাম করে হোক তা চাই না। আপাতত কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হোক। পরে তো আমাদের নাজিরারও বিয়ে, একসাথে দুজনের বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে।’
শেখর সাহেবও মত দিলেন। তালিব উদ্দীনও ছেলের পক্ষেই কথা বললেন। সীমান্তও বলে রাজি হতে। সবাই রাজি হওয়ার পর প্রধানের কাছে কোনো কারণ-ই থাকে না মানা করার। বাধ্য হয়ে সেও মত দেয়। ঠিক করা হয় আজ রাতেই দু পরিবারের উপস্থিতিতে তামজীদ-বেলীর বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে।
চলবে..
#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______
৩১.
সন্ধ্যায় কাজী ডেকে তামজীদ আর বেলীর পরিবারের উপস্থিতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হল। চোখের পলকেই যেন সবটা হয়ে গেছে। তামজীদের ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি লাগল। সে চেয়েছিল বেলীকে এবং অবশেষে বেলী তার হয়ে গেছে। বেলী ভাবেওনি এতদ্রুত তাদের বিয়েটা হবে তাই তার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। বিয়ে শেষ হলে ঠিক করা হয় আজ রাতে তামজীদ এ বাড়িতেই থাকবে। বাকিরা রাতের খাবার খেয়ে যার যার বাড়ি চলে যাবে। আজ খাবারের ব্যবস্থা প্রধানের বাড়িতেই করা হয়েছে। তামজীদ আর বেলীকে বেলীর ঘরে বসানো হল। সাহিত্য জানে তার বন্ধু এই বউটার জন্য কত উতলা ছিল তাই নিজেই সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যায়। তামজীদ দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেলীর সামনে আসল। সে বিছানার ওপর বসে শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাচ্ছে। দ্বিধাদ্বন্দে একবার তাকাচ্ছেও না তামজীদের দিকে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। তামজীদ কথা বার্তা ছাড়াই বেলীকে একটানে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরল। বেলী প্রথমে ভয় পেয়ে যায় এবং পরবর্তীতে অবাক হয়। তামজীদ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি সবার মধ্যে বলবে আমাকে পছন্দ করো না।’
বেলী এ কথা শুনে মুচকি হাসল। নিজের হাত তামজীদের পিঠে রেখে বলল, ‘আপনার অস্থির মুখটা দেখে ‘না’ বলতে পারিনি, তামজীদ ভাই।’
তামজীদ ছেড়ে দিল তাকে। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বরকে কেউ ভাই বলে?’
বেলী দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল, ‘অভ্যাস।’
‘তাহলে পাল্টাও। শুধু তামজীদ বলবে নয়তো বাচ্চার নাম ধরে ‘অমুকের বাবা, তমুকের বাবা’ বলবে। তাও ভাই বলবে না। কত শখের বউ আমার কিন্তু আমাকে ভাই ডাকে।’
বেলী ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। তামজীদের বুকের কাছটার শার্ট চেপে ধরে বলল, ‘ঠিক আছে, অমুকের বাবা।’
তামজীদের ভ্রু যুগল আবারও কুঁচকে গেল। বেলী তা দেখে হাসতে থাকে। তামজীদ দু হাতে বেলীর কোমড় জড়িয়ে ধরে মাথাটা বেলীর মাথায় ঠেকাল। নিচু স্বরে বলল,
‘তুমি না বলে দিলে আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম, বেলী।’
‘জানি তো।’
‘অনেক অপেক্ষা করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য। পেয়ে গেছি যখন তখন হাত কখনো ছাড়বো না। তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না কখনো। আমি যা করি এবং করবো সব ভালোর জন্য করবো।’
বেলী হাত দুটো তামজীদের গালে রাখল। আজলে নিয়ে ভীষণ বুঝদারের মতো বলল, ‘জানি আমি। আপনাকে বিশ্বাস করি। আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো।’
তামজীদের মনে হল সে তার পৃথিবী-ই পেয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষের কাছে যেটা বেশি কাম্য থাকে তা হল বিশ্বাস। এত এত খারাপ পরিস্থিতির মাঝে, এত বাঁধা পেরিয়ে তারা এক হতে পেরেছে এই বুঝি ঢের বেশি।
–
তামজীদের বিয়ে বলে সাহিত্য গিয়ে সাইরাহ্ আর নাজিরাকে এনেছিল। নাজিরা যতটা পেরেছে সীমান্তের চোখের আড়ালে থেকেছে। এই মানুষটার সামনে সে যেতে পারে না। তার বড্ড কষ্ট হয় আর সে কষ্ট এড়াতেই সেও এড়িয়ে চলে সীমান্তকে। নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকা নাজিরা টের পায় না কখন সীমান্ত তার পিছে এসে দাঁড়িয়েছে। নাজিরা অন্যমনষ্ক দেখে ডাকে,
‘নাজিরা!’
নাজিরা চমকে পিছে তাকায়। সীমান্তকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মানুষটার মুখ শুকিয়ে আছে। সীমান্ত মাথা নিচু করে এগিয়ে আসে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শুধায়,
‘তোমার বিয়ে কবে?’
নাজিরা সহজ গলায় বলে, ‘তারিখ ঠিক করেনি। এর মধ্যে ছন্দর সাথে এসব হল তাই পিছিয়ে দিয়েছে।’
সীমান্ত কতক্ষণ চুপ থাকে। নাজিরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কতটা সময় এভাবে নীরবতাতে গেলে নাজিরা নিজ থেকেই শুধায়, ‘ঠিক আছেন? শরীর ঠিক আছে?’
সীমান্ত হাসল। নাজিরার চোখে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘উহু, ঠিক নেই। সব হারাতে হারাতে আমি একদম শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। আমার প্রিয় জিনিসগুলোই কেন হারিয়ে যায়, নাজিরা? সাহিত্য, সাইরাহ্, ছন্দ কেউ আর নেই আমার।’
সীমান্তের কণ্ঠের ব্যাথাটুকু নাজিরা উপলব্ধি করল। গলায় এসে আটকে গেল একটা কথা, ‘আর আমি?’ তবে বলার সাহস পেল না। সীমান্ত ফের নিজেই বলল,
‘কষ্ট পেও না এটা ভেবে যে আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসিনি। বরং এটা ভেবে সুখী হইও যে আমি তোমার যোগ্য নই। বিশ্বাস করো, নাজিরা আমি সত্যিই তোমার যোগ্য নই। আমি সব হারিয়ে এখন শুধু প্রাণটুকু হারানোর অপেক্ষায় আছি।’
নাজিরার ইচ্ছে করল সীমান্তকে জড়িয়ে ধরতে। এবং কি মনে করে এই ইচ্ছেটুকু সে দমাতে পারলও না। হুট করে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সীমান্তকে। তার বুকে মাথা রাখতেই ফুপিয়ে উঠল। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে সীমান্ত কোনো প্রতিক্রিয়া করার অবস্থাতেই থাকল না। নাজিরার কান্নার শব্দে তার টনক নড়ে তবে শেষ এই সময়ে নাজিরাকে সরিয়ে দিল না। নাজিরা কাঁদতে কাঁদতেই শুধাল,
‘আমাকে কেন ভালোবাসলেন না, সীমান্ত ভাই?’
সীমান্তর কাছে জবাব নেই। সে কী জবাব দেবে? এক জীবনে সে একজনকেই ভালোবেসেছে, তার জায়গা সে কাউকে দিতে পারেনি আর পারবেও না। কতটা সময় এভাবেই কাটল। নাজিরার একটু স্বাভাবিক হয়েই সীমান্তকে ছেড়ে দিয়ে ছুটল পিছে। তার এখানে থাকার অধিকার নেই। সে অন্য কারো বাগদত্তা এবং তার প্রতি তার সৎ থাকাটা দায়িত্ব। সীমান্ত সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করে নিজেই বলল,
‘আমি ভালোবাসিনি বলেই তুমি সুখী হবে, নাজিরা। ভালোবাসলে তোমার জীবনটাও নষ্ট হয়ে যেত।’
নাজিরাকে এভাবে এলোমেলো হয়ে আসতে দেখে সাইরাহ্ তার কাছে এগিয়ে যায়। নাজিরার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। সাইরাহ্ তাকে টেনে এক কোণে নিয়ে ব্যস্ত গলায় শুধাল,
‘কি হইছে, নাজিরা? তোমারে এমন লাগে কেন?’
নাজিরা কিছু না বলে তাকে জড়িয়ে ধরল। সাইরাহ্ আন্দাজ করতে পারে সীমান্তের জন্যই এ অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাজিরাকে সোজা করল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘কষ্ট পেও না। যা হয় তা ভালোর জন্য হয়। ভাগ্য আর আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো।’
নাজিরা মাথা নাড়াল। সাইরাহ্ তাকে বুঝিয়ে সাহিত্যকে ডাকল। দুজনকে একসাথে দেখে সাহিত্য এগিয়ে আসল। শুধাল, ‘কি হয়েছে?’
‘আমরা বাড়ি যাই?’
সাহিত্য কিছু বলতে চেয়েও পাশে নাজিরার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখ মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে নিল। বিনা বাক্য ব্যয়ে জানাল, ‘দাঁড়া, আব্বাকে ডেকে আসি।’
সাইরাহ্ সম্মতি জানলে সাহিত্য গিয়ে শেখর সাহেবকে ডেকে আনে। একসাথে ৪ জন বের হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাইরাহ্, নাজিরা পাশাপাশি আর তাদের পিছে সাহিত্য আর শেখর সাহেব। বাড়ির দূরত্ব বেশি নয় বলেই দ্রুতই চলে আসল। নাজিরা সরাসরি নিজের ঘরে চলে গেলে সাহিত্য আর সাইরাহ্-ও চলে যায়। ঘরে এসে সাইরাহ্ ব্যাথিত কণ্ঠে বলল,
‘নাজিরার অবস্থা বেশি ভালো না। সীমান্ত ভাইয়ের সাথে ওর বিয়েটা না হলে ও আরও ভেঙে পড়বে।’
সাহিত্যের মাথায় এ কথা আসলেও পরমুহূর্তেই আসে নিজেদের কথা। সীমান্তের সাথে বিয়ে হলে নাজিরা সুখী হবে না তাই সাহিত্য গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বিয়েটা হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে।’
সাইরাহ্ কপাল কুঁচকাল। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘সব জানেন আপনি?’
‘না। তবে এটুকু জানি।’
‘বেশিই জানেন। আপনাকে গোয়েন্দার চাকরী কে দিয়েছে বলেন তো!’
‘তোর ওই লেজ ছাড়া বাপ।’
সাইরাহ্ কপাল আরোও বেশি কুঁচকে গেল। বাবার কথা বলায় সে এগিয়ে গেল সাহিত্যের দিকে। কোমড়ে হাত রেখে বেশ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘সব কথাতে আমার বাপকে টানেন কেন?’
সাহিত্যও তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। বেপরোয়া গলায় বলল, ‘কোথায় টানছি? তোর বাপ কি এমন অমূল্যবান জিনিস যে তাকে টেনে আনা লাগবে?’
‘মাত্রই তো টানলেন। শ্বশুর হয় আপনার, একটু সম্মান দিয়ে কথা বললে কি হয়?’
‘সম্মান পাওয়ার মত ভালো মানুষ হইলে দিনে দু’বার সালাম করতাম। কিন্তু যে বাপ নিজের মেয়ের কথা না ভেবে টাকার কথা ভাবে, মেয়ে বিধবা বলে মারধোর করে ওমন বাপকে সম্মান করার মতো সময় আমার কাছে নেই।’
সাইরাহ্ ব্যাঙ্গ করে বলল, ‘তা থাকবে কেন? অসম্মান করার সময় ঠিকই আছে।’
‘ওটাও নেই।’
সাহিত্যের এমন জবাব শুনে সাইরাহ্ চুপ মেরে গেল। এই লোকের সাথে কথায় পারা যায় না। আচ্ছা—গোয়েন্দারা এত বেশি ঝগড়াটে হয় নাকি? কথাটা মাথায় আসতেই সাইরাহ্ ছুটে এসে সাহিত্যের সামনে দাঁড়াল। সাহিত্য ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
‘কী?’
‘গোয়েন্দারা কি আপনার মত ঝগড়ুটে হয়?’
সাহিত্য চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। এরপর দু’হাতে সাইরাহ্-কে সামনে থেকে সরিয়ে বলল, ‘না। তোর মতো ঝগড়ুটে হয়।’
সাইরাহ্ এতে রাগ না করে উল্টো বলল, ‘তার মানে ঝগড়ুটে হয়!’
সাহিত্য হাতে থাকা ঘড়িটা দিয়েই সাইরাহ্-র মাথায় মা’রে। সাইরাহ্ আর্তনাদ করলে সে চুপচাপ গোসলখানায় যায়। সাইরাহ্ বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। লোকটার আশে পাশে থাকতে, ঝগড়া করতে এখন তার ভালো লাগে। আগে যাকে দেখলেই সে উল্টো ঘুরে পালাতো এখন তার সান্নিধ্যে তার সুখ সুখ লাগে। ভেবেই সাইরাহ্ হাসল।
–
সবাই ঘুমিয়ে গেলে তারেক বের হয়েছিল নেশা করতে। সে মাঝে মাঝেই নেশা করতে যায় বন্ধুদের সাথে। তবে আজ তার মন মেজাজ ভালো না। একে তো বেলীর ওপর তার নজর ছিল আবার সেই বেলীকেই তামজীদ বিয়ে করে ফেলেছে। আবার তাকে বলে দিয়েছে ওর দিকে নজর না দিতে। সে পারবে এটা? তামজীদকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। সাহিত্যের সাথে থেকে থেকে তার মাঝেও একই জিনিস খুব বেশি। এর মধ্যে একটা হল ন্যায়৷ কেউ অন্যায় করলে ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ কিচ্ছু দেখে না। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তাই সে যদি বেলীর দিকে নজর দেয় তার চোখ তুলে নিতেও মনে হয় দু’বার ভাববে না। এই রাগ, জিদ, দুঃখে সে এসেছিল নেশা করতে। আজ একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছে সে। গভীর রাতে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। আবছা চোখে হাতে লাইট নিয়ে এলোমেলো পা ফেলছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ পেছন থেকে তার গলায় দড়ি চেপে ধরে টানতে থাকে কেউ। আকস্মিক আক্রমণে সে দুম করে নিচে পড়ে গেল। গলায় দড়ি থাকায় চিৎকার করার বদলে গোঙানোর আওয়াজ বের হতে থাকল মুখ দিয়ে। ছটফট করতে থাকলে আগন্তুকের রাশভারী রাগী গলা ভেসে আসল,
‘আমার বোনরে মারছিস না! তোর এত বড় কলিজা! তোর কলিজা কে’টে দুই টু’করো করে ফেলবো।’
নেশাগ্রস্থ থেকেও কণ্ঠটা চিনতে একটুও ভুল হল না তার। আগন্তুকের শক্তির সাথে পেরে উঠছিল না। কিছু বলার চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিল। তা দেখে আগন্তুক প্রশান্তির হাসি হাসল। আরও শক্ত করে দড়ি চেপে ধরে বলল,
‘চিনতে পেরে গেছিস? কিন্তু লাভ নাই। আজ তোর শেষ দিন। নেশা ভালো মত হইছে তো?’
তারেকের দম আটকে আসল। আগন্তুক রাগে কয়েকটা গালি দিয়ে ওই অবস্থাতেই লা’থি মা’রল। এই খু’নটা আ’ত্ম’হ’ত্যা দেখাবে বলে বেশি মারল না। তারেক নেশাগ্রস্থ ছিল বলে আত্মরক্ষার চেষ্টাতেও ব্যর্থ হল। অবশেষে মাটিতে পড়েই ছটফট করতে করতে তার প্রাণটা বেড়িয়ে গেল। আগন্তুক যেন একটুও শান্তি পেল না। রাগে পা দিয়ে একটা লা’থি মা’রল তারেকের ব্যাক্তিগত অংশে। তারেকের মাঝে ততক্ষণে আর প্রাণ নেই। ফুঁসতে ফুঁসতে আগন্তুক তাকে টেনে নিতে থাকল বড় বাগানের দিকে। বিড়বিড় করে বলে গেল,
‘আমার বোনরে কত কষ্ট দিয়ে মা’রছিস! তোরে সেই পরিমাণ কষ্ট আমি দিতে পারিনি। তবে বাকি মেয়েগুলোরে যেভাবে মা’রছিস তোর মৃ’ত্যু সেভাবেই দিলাম। এবার তোর বাপের মাথার পালা।’
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)