#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৬
খুব সাধারণ ভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফায়জার হলুদ সন্ধ্যা। ফারহান প্রথমে নিষেধ করেছিলো এসব করতে।কিন্তু ফারহানা বেগমের জন্য আর না করতে পারে নি। তবে কড়া গলায় বলে দিয়েছে,অনুষ্ঠানে কোন ছেলে মানুষ থাকতে পারবে না। আর কোন গান বাজনা চলবে না। ফারহানের রাগের সাথে না পেরে একটু মন খারাপ হলেও সবাই মেনে নিয়েছে।ফায়জার এসবে কোন মাথা ব্যাথা নেই। জীবন্ত পুতুলের মত বসে আছে সে।কয়েক জন এসে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে গেছে।বিয়েটা কমিউনিটি সেন্টারে হবে।তাই বাসায় খুব একটা চাপ নেই।তবুও যে আত্মিয় স্বজন এসেছে তাদের আপ্যায়ন করার জন্য ফারহান কয়েকজন লোক নিয়োগ করেছে।রান্না বান্না সব বাসার ছাদে হচ্ছে। রান্না করে খাবার বাসায় পৌঁছে দেয়া তাদের কাজ।বাসার ভিতরের সমস্ত কাজ সুমি আর কয়েকজন মেয়ে মিলে করে ফেলছে।তাদের কে ফারহান ই নিয়ে এসেছে।তদারকি করা ছাড়া ফারহানা বেগমের আর কোন কাজ নেই।সায়েবা নিজ থেকে কিছু করতে গেলেই ফারহানের চোখ রাঙানির শিকার হচ্ছে।
পর পর কয়েকটা ধমক খেয়ে সায়েবা অসহায় গলায় বললো,
— এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?বাড়িতে এতো কাজ।আর আমি বাড়ির বউ হয়ে এভাবে পটের বিবি সেজে বসে থাকলে মানুষ কি বলবে?আর আমার নিজের কাছে ও ভালো লাগছে না। কিছু একটা তো করতে দিন?
সায়েবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো ফারহান।ফোনে কাউকে কিছু টাইপ করতে করতে বললো,
— কোন দরকার নেই।কাজ করার জন্য যথেষ্ট লোক আছে। তুমি শুধু আপুর কাছাকাছি থাকো।আর যদি বেশি বউগিরি করতে ইচ্ছে হয় তাহলে রুমে আসো।আমি ই একমাত্র মানুষ যার কাছে আসলে তোমার নিজেকে বউ মনে হবে। আর আমার বউ পটের বিবি ই।তাতে কারোর কোন সমস্যা হলে আমার কিছু যায় আসে না।
সায়েবা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। কি নির্লজ্জ লোক।মুখে কিছুই আটকায় না!সায়েবা চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব এনে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের কাজ শেষ করে সায়েবার দিকে তাকালো ফারহান। সায়েবার করুন মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। ফোন পকেটে ভরে গম্ভীর গলায় বললো,
— চুমু চাই?
সায়েবা সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠে বললো,
— মুখ বন্ধ রাখুন অসভ্য লোক। কখন থেকে কি সব বলে যাচ্ছেন! আপনার লজ্জা শরম লোপ পাচ্ছে জেনে রাখুন।
— আমি লাজুক কোন কালেই ছিলাম না রানী সাহেবা। তবে নির্লজ্জ ও ছিলাম না। বিয়ে করার পর থেকে এই রোগ দেখা দিয়েছে। আর আমার রোগের মেডিসিন হচ্ছো তুমি।আসো একটা চুমু খেয়ে বিকেলের ডোজ টা নিয়ে নেই।বলা তো যায় না, কখন রোগ টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তখন তোমার ই সমস্যা হবে। (গম্ভীর গলায়)
ফারহানের মুখভঙ্গি দেখে সায়েবা বিরক্ত হয়ে গেলো। এত রোমান্টিক কথা ও কেউ এমন গম্ভীর গলায় বলে। মনে হচ্ছে চুমু খেতে না ফাসিতে ঝুলাতে চাইছে। বিরক্তি ঝেরে সায়েবা ক্লান্ত গলায় বললো,
— চুমুর অভাবজনিত রোগে আপনি আপনি অসুস্থ হয়ে যান এই দোয়া ই করি।আপনার মতো মানুষ চুমু না খেয়ে করলা খেলে বেশি ভালো লাগবে।বাসায় করলা নেই।বাজার থেকে আনতে হবে। আমি লোক দিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি। যত্তসব।
রাগে গজগজ করতে করতে সায়েবা নিচে চলে গেলো। তাতে ফারহানের কোন হেলদোল নেই। সে আবার ফোনে মন দিলো।
কয়েক সিরি নিচে নামতেই সায়েবার ফোনে টুং করে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। ম্যাসেজ চেক করতেই আনমনে ঠোঁট প্রসারিত হলো সায়েবার।
‘ তুমি ই তো আমার করলা বউ।বাজার থেকে আনতে হবে না। আমার করলা আমি সময় মতো নিয়ে নিবো। নিচে মা আর শোয়েব এসেছে।তাদের যেন কোন অযত্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে। কারোর ফরমায়েশ পুরোন করতে যাবে না।এ বাড়ির রানী তুমি।সে ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করবে।যা কিছু দরকার হয় আমাকে বলবে।তোমার সেবায় তোমার রাজা মশাই সব সময় হাজির।সাবা আর নীতি কে কল করে দেখো কতটুকু এসেছে।আমি গাড়ি পাঠিয়ে ছিলাম।আর লিজার থেকে দূরে থাকবে বউ।আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে এক চুল ও ছাড় দিবো না। তোমাকেও না।তাই নিজের খেয়াল রাখবে। আমার আমানত তুমি।আমার আমানতের যেন খেয়ানত না হয়। আপুর আসেপাশে থাকবে।ভালোবাসি বউ।’
সায়েবা মুচকি হেসে নিচে চলে গেলো। নিচে যেতেই লিজার মুখোমুখি হলো। লিজা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সায়েবা এসব পাত্তা না দিয়ে শোয়েব আর আর মায়ের কাছে গেলো।
— আপুর কাছে যাও মা।আম্মু ওখানেই আছে। আর শোয়েব আমার সাথে আয়।
সাহেরা বেগম সায়েবার কথায় সায় জানিয়ে ফায়জার কাছে চলে গেলেন।
— আপু তোমার ফোন টা একটু দাও তো।আমি গেম খেলবো।এসব মেয়েদের অনুষ্ঠানে আমার বোর লাগে।
— তোর ফোন কোথায়?
— চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
সায়েবা নিজের ফোনটা শোয়েবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— খেয়েছিস কিছু?
— একটু আগেই খেয়েছি আপু।এখন আর কিছু খাবো না। আমি উপরে গেলাম।তোমার রুমে ই থাকবো। ফারহান ভাইয়া কোথায়?
— রুমেই আছে।তুই যা।বারান্দায় তোর পছন্দের বই আছে।
শোয়েব ফোনে গেম খেলতে খেলতেই উপরে চলে গেলো। সায়েবা কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। সকাল থেকেই সানোয়ার সাহেব মন মরা হয়ে বসে আছেন।দুপুরে ঠিক করে লাঞ্চ ও করেনি।বিয়ে বাড়ির ভীড়ে হয়তো কেউ খেয়াল করে নি।সায়েবা হালকা কিছু খাবার নিয়ে সানোয়ার সাহেবের রুমের দিকে গেলো।
🌸
সুন্দরী রমনীদের হাসির শব্দে বিয়ে বাড়িতে পরিবেশ মুখরিত। তাদের মধ্যমনি হচ্ছে আদিব। মৌমাছির মতো ঘিরে ধরছে সবাই তাকে।আদিব ও দাত কেলিয়ে তাদের সাথে হাসি তামাশা করে যাচ্ছে। আপাতত তার কোন কাজ নেই।দূর থেকেই প্রেয়সীর হৃদয় পোড়া গন্ধ তাকে তৃপ্তির শ্বাস দিচ্ছে। না তাকিয়ে ও বুঝতে পারছে এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
হাসি তামাশার মাঝেই খুশিতে গদগদ হয়ে উপস্থিত হলো আদিবের মা।হাসি হাসি মুখ করে আদিব কে বললো,
— বাবু তোর বিয়ের ব্যাপার টা ফাইনাল করে ফেললাম বুঝলি।মেয়ে তো আমার সেই পছন্দ হয়েছে।দেখতে যে কি সুন্দর। সাক্ষাৎ পরী।তোর কোন আপত্তি নেই তো?
— কি বলছো আম্মু!আপত্তি থাকবে কেন?তুমি বললে এক্ষুণি কবুল বলে বউ ঘরে তুলবো।
আদিবের মা যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেয়ে গেলেন।খুশিতে তার চোখে পানি চলে এসেছে।আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— আমি তাহলে এখনই সব ব্যবস্থা করছি।
— আরে দাড়াও দাড়াও।আগে এই বিয়ে টা শেষ হোক। তোমার ছেলের বিয়ে হবে পুরো শহর জানিয়ে।এভাবে হুট করে তোমার একমাত্র ছেলের বিয়ে করালে মানুষ কি বলবে?
আদিবের মা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। আসলেই তো। এভাবে তো আর একমাত্র ছেলের বিয়ে করাবে না সে।ঢাক ঢোল পিটিয়ে ছেলের বিয়ে দিবেন।
— আমি বরং সব কথা পাকা করে রাখি।তুই আমার সাথে আয়।মেয়ে দেখবি।
— আমার মায়ের পছন্দ বেস্ট। তোমার পছন্দ হলেই হবে।আমাকে দেখতে হবে না।
আদিবের মা আবেগী হয়ে গেলেন।হাত দিয়ে ছেলের চিবুকে চুমু খেয়ে বললেন,
— আমার সোনার টুকরো ছেলে।
🌸
কমিউনিটি সেন্টারের সব কিছু ফরহাদ সামলাচ্ছে। প্রায় দুই হাজার মানুষের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক নামীদামি লোক আসবে কাল।তাই কোন কিছু ভুল হওয়া যাবে না। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে বার বার।পরনের শার্ট টা ঘেমে গায়ের সাথে চিপকে আছে।রান্নার সমস্ত আয়োজন শেষ বারের মতো চেক করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো ফরহাদ।বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ তার প্রিয় মানুষ টা আসবে।যাকে সে অন্তরালে ভালবাসে বহুকাল ধরে।কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠে নি।সবার সামনে বিয়ে নিয়ে দুষ্টুমি করলেও সিরিয়াসলি বিয়ে করার কথা সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেছে বারবার। তবে বিয়ে তাকে করতেই হবে একদিন।পৃথিবীর নিয়মের বাইরে নয় সে। কিন্তু তাকে কি আর পাওয়া হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে গা এলিয়ে দিলো সে।
🌸
এখন মধ্যরাত।ছাদের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আদিব।
— একবার জাবের কে বলা দেখা যেতো।
ফরহাদের কথা শুনে বাকা হাসলো আদিব। না বোঝার ভান করে বললো,
— কি বলার কথা বলছো ভাই?
— না বোঝার ভান করিস না আদিব।আমার কথা তুই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিস।জাবের কে বুঝিয়ে বললে হয়তো সে বিয়ে টা ভেঙে দিতো।
— সেটা তো তোমরা ও ভাঙতে পারতে ভাই।তোমরা আপন জন হয়ে যাখন হাত গুটিয়ে বসে আছো সেখানে অপরিচিত একটা ছেলের কাছে সাহায্য চাইবো কেন?
— আব্বু আম্মু বিষয় টি জানে না আদিব।হুট করে এনগেজমেন্ট ও হয়ে গেছে। ফায়জা ও বেকে বসেছে। আমরা কি করবো বল?যেখানে ফায়জা নিজেই চাইছে বিয়ে টা করতে।জাবের বিয়ে ভেঙে দিলে হয়তো কিছু একটা করা যেত।
— আমার জিনিস আমি অন্যের কাছে চাইবো কেন ভাই?যা আমার তা শুধুই আমার।আমার কোন কিছুতে আমি কাউকে ভাগ দেই না।সেখানে তোমার বোন তো আমার কলিজা। কলিজা কি কাউকে দেয়া যায়?চিন্তা করো না ভাই।সময় মতো আমার জিনিস আমি বুঝে নিবো। তবে তোমার বোন কে এর মুল্য দিতে হবে। আমার চোখের পানি এতো সস্তা না ভাই।এই মুল্যবান চোখের পানির দাম তোমার বোন কে দিতে হবে। তবে পেয়ার সে।
— রাগের মাথায় উল্টো পালটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে।এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না ভাই।ওর উপর কতো চাপ যাচ্ছে বুঝতেই পারছিস? তার উপর তোদের বয়সের পার্থক্য!
— তাতে আমার কষ্ট গুলো মিথ্যা হয়ে যাবে না ভাই।নির্ঘুম রাত গুলো ফিরে আসবে না। যে না জেনে ভুল করে তাকে মাফ করে দেয়া যায়।তোমার বোন ইচ্ছে করে জেনে বুঝে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।তাকে কি করে ক্ষমা করে দেই।চিন্তা করো না। আমি এতোটা ও পাষাণ নই। একবারে শাস্তি দিবো না। শুধু অবহেলা গুলো ফিরিয়ে দিবো।এখন আবার বোনের উপর মায়া দেখাতে গিয়ে ভাইয়ের উপর অবিচার করো না।আমি কিন্তু তোমার ভাই হই মনে রেখো।
চলবে,,,
#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৭
বিয়ের সাজে স্টেজে বসে আছে ফায়জা।ঘড়ির কাটা গিয়ে ৪ টায় ঠেকেছে কিন্তু বরযাত্রী আসার খবর নেই।ফারহান আর ফরহাদ গিয়েছে খোঁজ নিতে। ফারহানা বেগমের চিন্তায় প্রেসার ফল করেছে।সায়েবা তার পাশে বসে আছে। বিয়ে বাড়িতে কানাঘুষা বেরেই চলেছে।ফায়জার চাদের মতো মুখটা আষাঢ়ের কালো মেঘে ঢেকে আছে। নিজের মতো স্থির হয়ে বসে আছে সে।কোন দিকে কোন খেয়াল নেই তার।ফোনের ম্যাসেজ টোন বাজতেই চোখ তুলে তাকালো সে।
‘কি বলে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন নিজের মনের মধ্যে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম।গম্ভীর একটা মেয়ে এভাবে আমার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। ভালোবেসে ফেললাম তোমায়।তোমার আম্মু খু স্নেহ করতেন আমাকে।আমি জানি তোমাদের তুলনায় আমরা কিছুই না।তবুও সাহস করে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম তোমার আম্মু কে। আমার মনে হয়েছিলো তোমাকে পাওয়ার একটা চেষ্টা করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে এটা ভেবে আফসোস করতে না হয় যে চেষ্টা করলে হয়তো তোমাকে পেয়ে যেতাম।বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, যেদিন আমাদের এনগেজমেন্ট হলো সেদিন বাসায় এসে বাচ্চা ছেলেদের মতো কেদেছিলাম।এনেগেজমেন্টের পর থেকে খুব চেষ্টা করেছি তোমার সাথে সহজ হতে।তোমাকে বুঝতে।কিন্তু বরাবর ই ব্যার্থ হতে হয়েছে। তবে এই টুকু বুঝতে পারতাম, তুমি আমাকে মেনে নিতে পারছো না।আমি সামনে আসলেই তোমার চোখে মুখে অস্বস্তি ভর করে।ভাবলাম বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। একবারের জন্যও মাথায় আসে নি তুমি অন্য কাওকে ভালোবাসতে পারো।যখন বুঝলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তোমাকে এ পর্যন্ত টেনে আনতে চাই নি বিশ্বাস করো। নিজের সাথে বার বার যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছিলাম। খুব স্বার্থপর হতে চাইছিল মন।আমার ভালো থাকার খোরাক যে তুমি।তাই একটু স্বার্থপর হয়ে তোমাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে হেরে গেলাম।দুজন কে কষ্টের সাগরে না ভাসিয়ে আমি নাহয় একাই ভেসে গেলাম। তবুও তো আমার ভালোবাসার মানুষ টা সুখী হলো। ছোট বেলা থেকে অভাবের সংসারে বড় হয়েছি।বাবা মা খুব কষ্ট করে আমাকে এ পর্যন্ত এনেছে।তোমার কথা বাড়িতে জানানোর পর থেকে মা একটু রেগে ছিলেন। তবে পরে মেনে নিয়েছিলেন।আমার এতো প্রচেষ্টা বিফলে গেল। সত্যি করে একটা কথা বলি ফায়জা,আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না!আমাকে কি একটু ও ভালোবাসা যেতো না? একবারের জন্যও কি হাসি মুখে কথা বলা যেতো না? জানো,আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম তোমার একটু হাসি দেখার জন্য। কিন্তু আফসোস তা আর দেখা হলো না। আমি চলে যাচ্ছি তোমার শহর ছেড়ে। জীবনের বাকে আবার যদি কখনো দেখা হয় আমার সাথে হাসি মুখে কথা বলো প্লিজ। বিয়ের আসরে অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমা চাইছি।সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো তাই,,,,,
ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।
‘জাবের’
চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো ফোনের স্ক্রিনে। ঝাপসা চোখে একবার আসে পাশে তাকালো ফায়জা।ফায়জার অসহায় দৃষ্টি দেখে বুক কেপে উঠলো আদিবের।দুই পা এগিয়ে যেতেই ফায়জা নিজ জায়গা থেকে উঠে গেলো। সামনেই সানোয়ার সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।তার পায়ের কাছে বসে শান্ত গলায় বললো,
— বিয়ে টা হচ্ছে না আব্বু।জাবের চলে গেছে এ শহর ছেড়ে।এতে তার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।তুমি এসব কিছু বন্ধ করতে বলো আব্বু।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি রুমে যাচ্ছি। কিছুক্ষন একা থাকতে চাই।আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো।আমার ভুলের জন্য আজ তোমাদের এতো অসম্মান হতে হলো।
সানোয়ার সাহেব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।ফায়জার সব কথা না বুঝলেও এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে,বিয়ে টা আর হচ্ছে না। মেয়ের বিদ্ধস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুক চিনচিন করে উঠছে তার।
— সবাই কে খাইয়ে সসম্মানে বিদায় দেও আদিব।বিয়ে টা হচ্ছে না। আর এ নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না।
আদিব মনে মনে খুশি হলেও ফায়জার বিদ্ধস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছে তার। তবে প্রেয়সীর সব কষ্ট ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দিবে সে।তাই আর মাথা ঘামালো না।
🌸
এমনিতেই মেয়ের বয়স বেশি।তার উপর আবার বিয়ে ভেঙে গেলো। এই মেয়ে কে আর কে বিয়ে করবে।এতো টাকা পয়সা নাম ডাক দিয়ে কি হবে সেই তো ছেলে বিয়ে করবে না বলে বরযাত্রী নিয়েই এলো না।নিশ্চয়ই এই মেয়ের কোন সমস্যা আছে।শুধু শুধু তো আর বিয়ে ভাঙে নি!দেখো গিয়ে কার সাথে কি ইটিসপিটিস ছিলো।
ফারহানের মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। এই মহিলাদের কথা শুনে তাতে যেন ঘি পরলো। অগ্নি চোখে তাদের দিকে তাকাতেই ফরহাদ তাকে সামলে নিলো।
— বাদ দে ভাই।এদের কাজ ই হচ্ছে বলা।বলতে দে।এখন এদের কথায় পাত্তা দেয়ার সময় না।ফায়জু কে সামলাতে হবে। ওর এখন আমাদের কে দরকার।এদের জবাব সময় মতো এরা পেয়ে যাবে।
ফারহান আক্রোশে ফেটে পরলো। ফরহাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
— ওদের বোঝা উচিত ওরা কাকে নিয়ে কথা বলছে।আমার বোনের দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস পেলো কোথায় এরা?আমার বোন কে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে সব কয়টা কে এখানেই পুতে ফেলবো।ফারহান সাদিকের বোন ও।ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলার আগে হাজার বার ভাবতে হবে। এদের এই মুহুর্তে এখান থেকে বিদায় করো ভাই।না হলে আমার দ্বারা কোন অঘটন ঘটে যাবে।
ফরহাদ কে রেখেই ফারহান হনহন করে ভিতরে চলে গেলো। কমিউনিটি সেন্টার অলরেডি খালি হয়ে গেছে।হাতে গোনা কয়েকজন আছে।এতক্ষণ যারা ফায়জা কে নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছিলো তারা ফারহানের রক্তিম চেহারা দেখেই কেটে পরেছে।ফায়জা তখন সানোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলেই বেরিয়ে গেছে এখান থেকে। ফারহান বাকি সবাইকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সানোয়ার সাহেব আর ফারহানা বেগম কে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। শোয়েব, আদিব,ফরহাদ আর সাহেরা বেগম এক গাড়ি তে যাচ্ছে। সায়েবা ফায়জার সাথেই বেরিয়ে গেছে। নীতি আর সাবা ও ওদের সাথে আছে।ফারহানা বেগম এখনো কেদেই যাচ্ছেন।
— ওখানে গিয়ে ওদের পেলে না ফারহান?
সানোয়ার সাহেবের বিরস গলা শুনে ফারহান তার দিকে তাকালো। বাবার এমন অসহায় চেহারা এর আগে কখনো দেখেনি সে।এতো টাকার মালিক হয়েও তাদের জীবন সব সময় সাধারণ মানুষের মতো ছিলো। সানোয়ার সাহেব খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন।সব সময় হাসি খুশি মানুষ টা আজ মেয়ের চিন্তায় একদম নেতিয়ে গেছেন।
— না আব্বু।ওরা কালকে রাতেই নাকি এখান থেকে চলে গেছে।কোথায় গেছে কেউ কিছু বলতে পারছে না।আত্মীয় স্বজন ও তেমন কেউ এখানে নেই।তুমি চিন্তা করো না আব্বু।আমি ঠিক ওদের খুজে বের করবো।আমার বোন কে ধোকা দেয়ার ফল ওদের পেতে হবে।
শেষের কথা গুলো দাতে দাত চেপে বললো ফারহান।রাগ যেন কিছুতেই কমছে না ওর।না জানি ফায়জা কি অবস্থায় আছে।এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এখন তারাতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে হবে।বোন কে দেখার আগ পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।
🌸
ফারহানের আগেই ফরহাদরা বাসায় পৌঁছে গিয়েছে।গাড়ি থামতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে বাসার দিকে ছুটলো ফারহান।বোন টা ঠিক আছে তো!এই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে।
একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে চলে গেলো। আদিব ড্রাইভিং সিটে বসে আছে এখনো। এই মুহুর্তে বাসায় যাওয়া যাবে না। এখন ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে তাকে।
— শুধু শুধু আমাকে রাগিয়ে দিলে সোনা।তোমার জন্য এখন কত কত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে দেখো তো। পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে তোমার ওই হতে হতে না হওয়া বর কে রাতারাতি গায়েব করতে হলো। তার উপর এতো এতো কাজ।ইসসস,হাত পা ব্যাথা হয়ে গেছে। এখন যদি গিয়ে দেখি তুমি বরের শোকে ঘরে দোর আটকে মরা কাদা কাদছো তাহলে তোমাকে সাত তালা থেকে ফেলে দিতে আমি একবার ও ভাববো না। গেট রেডি ফর বি মাইন।
চলবে,,,,