সায়েবা আসক্তি পর্ব-২৮+২৯

0
804

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৮

ধরনীর বুকে আধার নেমেছে অনেকক্ষণ। ব্যস্ত পায়ে ফায়জাদের ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছে আদিব।বিয়ে না হলেও বাড়িতে মেহমানের কমতি নেই।বিয়ে টা আজকে সেরে ফেলতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু মহারানী রাজি হলে তো! কোন শয়তানের বুদ্ধিতে সিনিয়র মেয়ের প্রেমে পরেছিলো কে জানে।নাহলে আজকে আর এইদিন দেখতে হতো না।মনে মনে সে শয়তান কে ভয়ংকর কিছু অশ্লীল গালি দিলো আদিব।লজ্জা থাকলে তাকে আর কোন কুবুদ্ধি দিতে না বলে তিরস্কার করতে ও ভুললো না।শয়তানের ই বা কি দোষ?নিজের মন ই তো মীরজাফরি করে বসে আছে।তার মন তার কথা না ভেবে এক পাষন্ড নারীর জন্য আনচান করে!এদিকে সে ভালোবাসা নামক পুষ্টির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাতে তার মনের কিছু যায় আসে না।কি বেঈমান! একবার বিয়ে টা হয়ে গেলে এই মন নামক মাংসপিন্ড কেও সে এক হাত দেখে নিবে।

কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো সুমি।আদিব কে দেখে লাজুক হেসে দরজা থেকে সরে দাড়ালো।

সুমি কে লজ্জায় পানি পানি হতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদিব।এই মেয়েটাও তাকে দেখলে লজ্জা লজ্জা ভাব করে, অথচ যার জন্য সে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে স্বপ্নে চার বাচ্চার বাবা হয়ে বসে আছে তার কোন হেলদোল নেই!কলেজের কতো সুন্দরী রমনীকে সে পাত্তা না দিতে পেরে হাপিত্তেস করে মরেছে তার একটা লিস্ট করতে পারলে ভালো হতো। অন্তত পক্ষে চিৎকার করে বলা তো যেতো, দেখো হে নিষ্ঠুর মহিলা,তোমার জন্য এই অবুঝ রমনীগণকে তুচ্ছ করেছি আমি।আর আজ তুমি কিনা আমাকে এভাবে অবহেলা করছো!

— তোর আপা কোথায় সুমি?

সুমি মলিন মুখে বললো,

— আপায় তো রুমে।হেইযে দরজা লাগাইছে!আর তো খুলে নাই ভাইজান।

— অহ আচ্ছা। বাকি সবাই কোথায়?

— আম্মা আর খালুজান তো রুমে গেছে গা।হেগোর শরীল নাকি ভালা না।আর বড় ভাইজান আপার রুমের সামনে বইসা রইছে।আপা দরজা খোলার আগ পর্যন্ত নড়বো না।ছুডো ভাইজান সবাই রে ঘুমানের ব্যবস্থা কইরা দিতাছে।ভাবি ও হের লগেই আছে।

সুমি এক নিশ্বাসে সব বলে থামলো।

— মেহমানদের খাওয়া হয়ে গেছে সবার?

— হ ভাইজান।খালি বড় ভাইজান,ছুডো ভাইজান,ভাবি আর হের বান্দুবি রা বাকি আছে।আফনে ও তো খান নাই।

— তুই খেয়েছিস?

— আফনেগো খাওয়া হইলে খামু।

— তুই খেয়ে শুয়ে পর।আমাদের টা আমরা নিয়ে খেয়ে নিবো।

— আইচ্ছা। দরকার হইলে ডাইকেন।

— হুম।

ফায়জার রুমের দিকে পা বাড়ালো আদিব।এই মেয়েটা তার ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছে বারবার। সে তো ভালো হয়ে থাকতে চায়।কিন্তু এই ভয়ংকর নারী তাকে ভালো হয়ে থাকতে দিলে তো!

🌸

সবাইকে রুমে পৌছে দিয়ে মাত্রই নিজের রুমে এসেছে সায়েবা।পড়নের আবায়া টা খুলে নিজেকে একবার দেখে নিলো আয়নায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে বার বার। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। বাসার এই পরিস্থিতি তে কোন ভাবেই রেষ্ট করা যাবে না। মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে শান্তির ঘুম ধরা দিবে কি করে! ফায়জা আপু কে একবার দেখে আসলে মন টা শান্ত হতো।

— তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো ।তুমি আজ সারাদিন কিছু খাওনি।এখন খেতে হবে।

ফারহানের কথায় ধ্যান ভাংলো সায়েবার।

— আপনি কখন আসলেন?

— এইমাত্র ই আসলাম।কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

সায়েবা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। যে এই মুহুর্তে পাঞ্জাবীর বোতাম খুলতে ব্যস্ত।সায়েবা ফারহানের কাছে গিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজেই বোতাম খুলতে লাগলো। সবগুলো বোতাম খুলে ফারহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

— সুন্দর লাগছে আপনাকে।মাশআল্লাহ।

সায়েবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকালো ফারহান।ঘটনা সুবিধার নয়। তার বউয়ের এতো ভালোবাসা কবে হলো তার প্রতি?

সায়েবার কোমড় আকরে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ফারহান। কপালের কাছের অগোছালো চুল গুলো কানের পিছনে গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

— আজ এতো ভালবাসার কারণ কি রানী সাহেবা?

— বারে!আমি কি আমার বর কে ভালোবাসতে পারি না?

— অবশ্যই পারো।একমাত্র তাকেই ভালোবাসার অনুমতি আছে তোমার।তাহলে তাকে ছেড়ে আর কাকে ভালোবাসবে!এবার বলো কি চাই?

— আপু,,,

সায়েবা কে থামিয়ে দিলো ফারহান।

— সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি আছি তো।টেনশন কেন করো?আমরা সবাই আছি আপুর সাথে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহ আছেন তো।তিনি নিশ্চয়ই উত্তম কিছু ভেবে রেখেছেন।তিনিই সর্ব উত্তম পরিকল্পনাকারি।

— হুম।

সায়েবা আদুরে বিড়াল ছানার মতো মাথা এলিয়ে দিলো ফারহানের লোমশ বুকে।নিচু হয়ে সায়েবার মাথায় চুমু খেয়ে আগলে নিলো তাকে ফারহান।শক্ত করে জরিয়ে ধরে বুকের মাঝেই পিষে ফেললো তাকে।

— আরে কি করছেন?ব্যথা পাচ্ছি তো।(আর্তনাদ করে)

— নড়াচড়া করলে আরো বেশি ব্যাথা পাবে।

— আহ্। আস্তো পাথর একটা। এই ছাড়ুন তো,হাড়গোড় সব ভেঙে দিলো একেবারে।

— ভাঙতে আর পারলাম কই।ধরার আগেই তো মিয়িয়ে যাও!আচ্ছা ছাড়লাম, এবার পাচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসো। আপুর কাছে যাবো।

— হুম।

কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো সায়েবা। সায়েবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো ফারহান।সবার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভিতর টা পুড়ছে বোনের জন্য। ফায়জা খুব ভেঙে পরেছে। ফায়জা কে সাপোর্ট করতে হলে সবার আগে তাদের সবাই কে স্বাভাবিক হতে হবে। নিজেদের বিদ্ধস্ত মুখ নিয়ে ফায়জার কাছে গেলে সে আরো ভেঙে পরবে।
কবার্ড থেকে টাওজার আর টিশার্ট বের ফ্রেশ হতে করে স্টাডি রুমে চলে গেলো ফারহান।

🌸

আর কতক্ষন এভাবে বসে থাকবো ভাই?এভাবে বোয়াল মাছের মতো মুখ করে বসে না থেকে কিছু একটা করলে সময় টা ভালো ভাবে কেটে যেতো।

আদিবের দিকে কটমট করে তাকালো ফরহাদ। নিজের রাগ কনট্রোল করতে না পেরে নিজের পায়ের সেন্ডেল ছুড়ে মারলো তার দিকে।

— আরেকটা কথা বললে সত্যি সত্যিই মার খাবি তুই।বসে থাকতে ইচ্ছে না করলে চলে যা।তোকে কেউ বেধে রেখেছে নাকি?

— ছোট বোনের হবু জামাই কে জুতো ছুড়ে মারছো!আল্লাহ! এই তোমার লজ্জা করলো না এভাবে আমাকে অপমান করতে?

— না। প্রয়োজন হলে জুতোর ফ্যাক্টরি এনে ছুড়ে মারবো।

— তাহলে ঠিক আছে। জুতার ফ্যাক্টরি বেচে পঞ্চাশ লাখ উসুল করবো।

আদিবের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো ফরহাদ। আদিব ও যোগ দিলো সাথে।তাদের হাসির মাঝেই সেখানে উপস্থিত হলো নীতি আর সাবা। দরজার পাশে টুলের উপর হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা দুইজন যুবকের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেললো তারা।

— আপু এখনো দরজা খুলে নি ভাইয়া?

নীতির কথা শুনে ফরহাদের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। এই মেয়ে তাকে মিনিটে মিনিটে ভাইয়া কেন ডাকে তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠে পারলো না সে।দিনে একবার ডাকলে ই তো হয়।

— আরে তোমারা এখনো ঘুমাও নি কেন?

আদিবের কথায় লাজুক হাসলো সাবা।মিনমিনে গলায় বললো,

— আপুর জন্য টেনশন হচ্ছে ভাইয়া।আমরা কি আপনাদের সাথে বসতে পারি?

আদিব বিগলিত গলায় বললো,

— হুম অবশ্যই। তোমাদের কোম্পানি খারাপ লাগবে না।চল একটা গান ধরা যাক।শুধু শুধু বসে থাকতে খারাপ লাগছে।বিরহ বিরহ টাইপের গান হলে ভালো হয়।পরিবেশের সাথে মানানসই হতে হবে। আজকাল ট্রেন্ড ছ্যাকা খাওয়া গানের লিস্ট টা বলো তো।ওখান থেকেই একটা গান ধরবো, বুঝলে? নিষ্ঠুর প্রিয়তমা গাইতে পারলে ভালো হতো। তবে এটা ছেলেদের জন্য।মেয়েদের জন্য একটা ভালো ছ্যাকা খাওয়া গান খুজে বের করো।কুইক।

আদিবের উল্টো পালটা কথা শুনে বিরক্তি তে ‘চ’ শব্দ করলো ফরহাদ।গমগমে গলায় বললো,

— তুই এখান থেকে যা ভাই।অযথা বিরক্ত করিস না।

ফরহাদের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসলো আদিব।দরজায় হালকা টোকা দিয়ে ফায়জা কে ডাকলো,

— এভাবে আর কতক্ষন দরজা বন্ধ করে রাখবে?আমি এখান থেকে নড়ছি না।যখনই দরজা খুলবে আমাকে এখানেই পাবে। আর যদি ধৈর্য ভেঙে যায় তাহলে দরজা ভাঙতে ও সময় লাগবে না। তাই নিজ থেকেই দরজা খুলে দাও সোনা থুক্কু আপুউউউউউ।

চলবে,,

#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_২৯

এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকা মহল এখন বিষাদের রুপ নিয়েছে।রুমের ভিতরে থাকা রমনীর আত্মচিৎকার
সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।ফায়জার কান্নার শব্দে দৌড়ে এসেছে ফারহান। চেঞ্জ করে সে এদিকেই আসছিলো। মাঝ পথে ফায়জার চিৎকার করে কান্না কর্ণগোচর হতেই ছুটে এসেছে সে।আদিব,ফরহাদ,সাবা আর নীতি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহান সেদিকে ধ্যান না দিয়ে তারাতাড়ি দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো,

— আপু,আপু দড়জা খোলো।

ফারহানের বার বার কড়া নাড়ায় ধ্যান ভাংলো সবার।ফরহাদ অস্থির হয়ে ফায়জা কে ডাকতে লাগলো। তার চোখে জলেরা ভীড় করেছে। একমাত্র ছোট বোনের কান্না হৃদয় ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে।
আদিব অনুভূতি হীনের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। ভালোবাসার মানুষের কান্নায় হৃদয় পুড়ে।কিন্তু তার চেয়ে ও বেশি কষ্ট তখন হয় যখন সেই কান্না অন্য কোন পুরুষের জন্য হয়।

রুম থেকে এখন আর কান্নার শব্দ আসছে না। এবার সবাই ভয় পেয়ে গেলো। ফারহান অস্থির হয়ে সায়েবা কে ডাকতে লাগলো।ডাইনিং রুমে খাবার সাজাচ্ছিল সায়েবা।ফারহানের ডাক শুনে একপ্রকার দৌড়ে এসেছে সে।এতোক্ষণ সবার ডাক শুনেও আসতে পারে নি। ফারহান এদিকে আসতে নিষেধ করেছিলো তাই।এতক্ষণ ফারহানের ডাকের ই অপেক্ষা করছিলো ও।

— কি হয়েছে? আপু দরজা খুলছে না কেন?

— আম্মুর রুম থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসো।কুইক। (অস্থির হয়ে)

আদিব এখনো নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত ভঙ্গিতে থাকলেও চোখ মুখ থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে।
আদিবের শক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হচকচিয়ে গেলো সাবা।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীতিকে খোচা দিয়ে ইশারা করতেই সাবার দিকে বিরক্তির চোখে তাকালো নীতি। সাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই আদিবের কঠিন চেহারা দেখে অবাক হলো। আদিব ওদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে পকেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করলো। কাল রাতেই বাণিয়ে এনেছে এটা।আজকে কাজে লাগবে এটা ও আগে থেকেই জানতো।ফরহাদ কে সরিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে ওদের মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে দিলো আদিব।

এর মধ্যেই রুমের সামনে সবাই এসে ভীড় করবছে।লিজার মুখের বাকা হাসি কারো চোখে না পড়লেও সায়েবার চোখে ঠিকই পড়েছে। নিচ থেকে ফারহানা বেগম উঠে এসেছেন।সানোয়ার সাহেব প্রেসারের মেডিসিন নিয়ে গভীর ঘুমে।তাই এতো চিৎকার শুনেও তার ঘুম ভাঙে নি।ফায়জার রুমের সামনে আসতেই বুক কামড়ে উঠলো তার।কাপা কাপা গলায় ছেলেদের বললো,

— কি হয়েছে আব্বু।ফায়জার কি হয়েছে?

— কিছু হয়নি আম্মু।আমরা একসাথে খাওয়ার জন্য আপু কে ডাকতে এসেছি।আপু রাগ করে দরজা খুলছে না তাই এভাবে ধাক্কা দিচ্ছি।তুমি নিচে যাও।আমি আপুকে নিয়ে আসছি।সায়েবা,আম্মু কে নিয়ে নিচে যাও।

— আমি কোথাও যাবো না।আমার মেয়ে দরজা খুলছে না কেন?ফায়জা,আম্মু দরজা খোলো।আমার মন কেমন করছে ফারহান।আমার মেয়ের কিছু হয়েছে।দরজা ভেঙে ফেলো আব্বু।আমার আম্মু ভালো নেই।তোমারা দরজা ভেঙে ফেলো।

ফারহানা বেগম কান্না করতে করতে ফায়জার দরজার সামনেই বসে পরেছে।সাহেরা বেগম তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

— চিন্তা করবেন না আপা।আদিব আছে ভিতরে।ফায়জার কিছু হয় নি।একটু রাগ করে আছে।সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

রাগে ফারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।এই মুহুর্তে আদিব কে পেলে হয়তো খু*ন করে ফেলবে ও।নিজের চুল টেনে ছিরে ফেলার অবস্থা। চোখ লাল হয়ে ভয়ংকর দেখাচ্ছে।

— ভাই ওকে দরজা খুলতে বলো।আমার মাথা খারাপ হলে আমি উল্টো পালটা কিছু করে ফেলবো।দরজা খোল আদিব।

দরজায় দুটো লাথি মারতেই ফরহাদ টেনে দূরে সরিয়ে নিলো ফারহান কে।

— মাথা ঠান্ডা কর ভাই।আদিব আছে তো।একটু ঠান্ডা হয়ে বোস।আপনারা নিজেদের রুমে চলে যান।অনেক রাত হয়েছে।সবাই ঘুমিয়ে পরুন।

— আমার ছেলে বের হওয়ার আগে আমি কোথাও যাবো না।

আদিবের মা মুখ বাকিয়ে বলতেই ধমকে উঠলো আদিবের বাবা।

— এখানে সার্কাস চলছে?নাকি তোমার ছেলে বাঘের খাচায় ঢুকেছে? নাটক না করে রুমে যাও।

আদিবের মা আর কিছু না বলে কটমট চোখে তাকিয়ে রুমে চলে গেলো। এর শোধ সে সময় মতো নিয়ে নিবে।

🌸

অন্ধকার রুমে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিব।সোডিয়ামের হালকা আলো তে ফায়জা কে দেখে যাচ্ছে সে।খাটের উপর টান টান হয়ে শুয়ে আছে। মাথা কিছুটা খাটের বাইরে থাকায় লম্বা চুল গুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কি নিষ্পাপ মুখ!বাইরের চেচামেচি তার কান পর্যন্ত আসছে না। সে তার প্রেয়সীকে দেখায় বিভোর। দরজার পাশের সুইচবোর্ডের মাঝের সুইচে চাপ দিতেই আবছা হলদেটে আলোয় সব কিছু হালকা পরিস্কার হলো। একটু সামনে এগুতেই পা দুটো আপনা আপনি স্থির হয়ে গেলো। ফ্লোরের লোহিত ধারার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল।মস্তিষ্ক সচল হতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ফায়জার দিকে। পাগলের ন্যায় নিস্তেজ শরীর টাকে আগলে নিলো নিজের বুকে। কান্নার আর্তনাদ আটকে বললো,

— এই এটা কি করেছো তুমি?বার বার কেন আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো? আমি কিন্তু মে*রে ফেলবো তোমাকে। চোখ খোলো জান।প্লিজ চোখ খোলো।চুপ করে থেকো না সোনা।আমি আর বিরক্ত করবো না তোমায়।তবুও আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না।আমি ম*রে যাবো।

আদিবের আর্তনাদ রুমের বাইরে যেতেই ফারহান পাগলের মতো দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ফরহাদ ও ফারহানের সাথে যোগ দিলো। এতক্ষণ নিশ্বব্দে কাদলেও এবার শব্দ করে কেদে উঠলো সায়েবা।

সাবা নীতি ও কেদে যাচ্ছে নিশ্বব্দে।

— আল্লাহর দোহায় লাগে আদিব দরজা খোল ভাই। আমার বোনের কি হয়েছে আদিব?ফায়জা ঠিক আছে তো?আল্লাহ!

— সায়েবা দ্রুত চাবি নিয়ে এসো।

সায়েবা চাবির জন্য যাতে নিতেই ভিতর থেকে দরজা খুলে গেলো। দরজা খুলেই আদিব আবার দৌড়ে ফায়জার কাছে চলে গিয়েছে।ফায়জার হাত থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। রুমে ঢুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো দুই ভাই।সামনেই ফায়জার নিস্তেজ দেহ।আদিব পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত বেধে কোলে তুলে নিলো ফায়জা কে।চিৎকার করে ফারহান কে বললো,

— তারাতাড়ি গাড়ি বের কর ফারহান।

ফারহানের সেদিকে কোন হুস নেই।সে এখনো ফায়জার রঞ্জিত হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানা বেগম দরজায়ই জ্ঞান হারিয়েছে।ফরহাদ দৌড়ে বেরিয়ে গেছে গাড়ি বের করতে।আদিব টলমলে পায়ে অশ্রুসিক্ত চোখে ফারহান কে বললো,

— একটু আমার সাথে ধর ভাই।আমি ঠিক ভাবে দাড়াতে পারছি না। আমার ওকে এতো ভাড়ি কেন লাগছে!

সায়েবা ফারহান কে ধাক্কা দিয়ে বললো চিৎকার করে বললো,

— এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি।আপুর অবস্থা ভালো না ফারহান। আপুকে তারাতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।

সায়েবার কথায় হুস ফিরলো ফারহানের।আদিবের কোল থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো ফায়জা কে।

— কিছু হবে না তোমার আপু।আল্লাহ! সাহায্য করো।কেন এমন ভুল করলে আপু!এত বড় ভুল কিভবে করতে পারলে?

শব্দ করে কান্না করছে ফারহান।এক প্রকার দৌড়ে ফায়জা কে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে সে।আদিব লিফটের বাটন চাপতেই দরজা খুলে গেলো।ফরহাদ ওদের দেরি দেখে আবার উপরে এসেছে।

— তারাতাড়ি আয় ভাই।আমার ফায়জু কথা বলছে না কেন?আল্লাহ, একটু রহম করো আমাদের উপর।

তিনজন যুবকের বোবা কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।আদিব লিফটের মধ্যেই হাটু গেরে বসে পরলো। মাথার চুল টেনে ডুকরে কেঁদে উঠতেই ফরহাদ জাপটে ধরলো ওকে।

— আল্লাহ কে ডাক ভাই।

হাসপাতালে পৌঁছাতে দশ মিনিট লেগেছে।ফরহাদ ফোন করে সব কিছু আগেই রেডি করে রেখেছে।নিজেদের হসপিটাল হওয়ায় পুলিশের ঝামেলা করতে হয় নি। আসার সাথে সাথেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে ফায়জা কে।

— ও কেন এমন করলো ভাই?আমরা কি ওর কেউ না? সারাজীবন আমাদের সাথেই না হয় থেকে যেতো।আমরা কলিজার ভিতর ঢুকিয়ে রাখতাম ওকে। এতো বড় স্টেপ ও কিভাবে নিলো!তা ও ওই লোভী ছেলেটার জন্য!

ফারহান ফ্লোরে এক পা ছড়িয়ে বসে আছে। গায়ের গেঞ্জি রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে সে।ফরহাদের কথার জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে ওভাবেই বসে রইলো।

আদিব অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাচ্ছে বারবার, একবার ফায়জা সুস্থ হয়ে গেলে আর কখনো যাবে না ফায়জার সামনে।আগে জানলে জাবের কে কখনো টাকা দিয়ে সরিয়ে দিতো না। বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এই যন্ত্রণার শেষ কোথায়!

চলবে,,