#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩০
ক্লান্ত চোখে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।কয়েক দিনের বিয়ের ধকল শেষে এখন এমন মানুষিক বিপর্যয় সবাইকে নিস্তেজ করে দিয়েছে।সবার প্রার্থনায় শুধু একজনের সুস্থতার দোয়া।
একে একে সবাই এসে হসপিটালে জমা হয়েছে।ফায়জার মতো বুদ্ধিমান বিচক্ষণ মেয়ের এমন পদক্ষেপে সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে।সবার মুখের কষ্ট আর প্রিয়জনকে হারানোর ভয় থাকলেও কিছু কিছু মানুষের মুখে আছে ধরা পরে যাওয়ার ভয়।
ঠান্ডা আবহাওয়ায় ও কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছে আদিবের মা। চোরা দৃষ্টিতে সবাই কে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সে।ফারহানের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। এই ছেলে যদি তার কার্য সম্পর্কে একবার অবগত হয় তাহলে তার অনেক পস্তাতে হবে তা সে জানে।আর আদিব! আদিব হয়তো তাকে ভয়ংকর ভাবে ঘৃণা করবে।মা বলে কখনো সম্বোধন করবেনা ইহজনমে। তার ই বা কি দোষ? একমাত্র ছেলে বয়সে বড় মেয়ের জন্য দেওয়ানা হয়ে গেছে।তাও ও তিন বছরের বড়! মানুষ শুনলে সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। ছেলের এমন অবিশ্বাস্য পাগলামি মা হিসেবে সে মেনে নিতে পারে না। বয়সে বড় মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়ে সারা জীবন ছেলের বউয়ের অধিনে সে কিছুতেই থাকবে না। দেখা যাবে ছেলের সাথে সাথে তার উপরে ও ছড়ি ঘুরাচ্ছ।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের জন্য দুই ব্যাগ রক্ত লেগেছে।ফরহাদ আর ফারহান দুজনেই রক্ত দিয়েছে ফায়জা কে। ফারহানা বেগম কাদতে কাদতে অজ্ঞান হয়ে গেছেন কয়েকবার।জ্ঞান ফেরার পরেই অপারেশন থিয়েটারে ছুটেছেন তিনি।নিজে ডাক্তার হয়ে সে কিছুতেই এভাবে বসে থাকতে পারেন না।
শাহানা বেগম আর লিজা ও এসেছে।শাহানা বেগম যতই রেগে থাকুক না কেন ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের খুব ভালোবাসে সে। আসার পর থেকেই নিশ্বব্দে কান্না করছেন তিনি।লিজা মায়ের কান্নায় প্রচন্ড বিরক্ত। এভাবে ম*রা কান্না করার কি হয়েছে!এখনো তো ম*রে যায় নি।
— উফফ আম্মু থামবে।সেই কখন থেকে কান্না করে করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছো।
লিজার বিরক্ত গলা শুনে শাহানা বেগম রাগী চোখে তাকালো তার দিকে।
— আরেকটা বাজে কথা বললে থাপড়ে গাল লাল করে দিবো বেয়াদব মেয়ে।তোকে এখানে আমি আসতে বলেছি?ভালো না লাগলে চলে যা। এখন এটা বলিস না তোর খুব কষ্ট হচ্ছে বা চিন্তা হচ্ছে। আমি জানি তুই শুধু ওদের কষ্ট দেখে মজা নিতে এসেছিস।তাই কথা না বাড়িয়ে বাসায় যা।
শাহানা বেগমের রাগী গলা শুনে দমে গেলো লিজা।শাহানা বেগমের কথা একটা ও মিথ্যা না।সে সত্যিই এখানে ফারহানদের যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখতে এসেছে।
রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। হসপিটালের করিডরে পায়চারি করে যাচ্ছে ফারহান।চোখ গুলো রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। প্রায় দুই ঘন্টা হতে চললো ফায়জা কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। ডাক্তার এখনো কিছু বলছে না। ফারহানা বেগম কে কোন ভাবে সামলানো গেছে।সানোয়ার সাহেব কে কিভাবে সামলাবে সেটা ভেবে আরো পাগল পাগল লাগছে ফারহানের। ঘুম থেকে উঠলেই তো সব জানতে পারবে সে।এমনিতেই কাল থেকে প্রেসার হাই হয়ে আছে।
ফারহানের অস্থিরতা আন্দাজ করতে পারলো সায়েবা।তার ও কি কম কষ্ট হচ্ছে? ফরহাদ চুপ চাপ বসে আছে। ফরহাদ বরাবর ই শান্ত মেজাজের মানুষ। ভিতরে ভিতরে বোনের জন্য ভেঙে পরলেও বাইরে নিজেকে শান্ত রেখেছে।ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে চারিদিকে চোখ বুলালো সায়েবা।আদিব কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না! এই মুহুর্তে আদিবের সাথে কথা বলা টা জরুরি। তবে পরিস্থিতি এতে খারাপের দিকে যাবে।একটু দূরেই আদিবের মা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে রাগ হলেও নিজেকে সামলে নিলো সায়েবা।ফায়জা যখন কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাসায় চলে এসেছে তার সাথে সায়েবা,সাবা আর নীতি ও ছিলো। বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই ছিল।সমস্যা বাধে আদিবের মা আসার পর। বিয়ে ভাঙতে ফায়জা খুব একটা আপসেট ছিল না। আদিবের মায়ের বিষাক্ত কথায় ফায়জা কে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছে।সায়েবা অনেক চেষ্টা তাকে থামানোর। সে সায়েবা কে ও কটু কথা শোনাতে পিছু হাটে নি।তার ভাষ্য মতে, ফায়জা আদিব কে ফাসিয়েছে।সে নিজেই নিজের বিয়ে ভেঙেছে যাতে আদিবের গলায় ঝুলে পরতে পারে।নির্লজ্জ, বেহায়া এমনকি নষ্টা মেয়ে বলেও গালাগালি করছে ফায়জা কে।বিদেশে বিভিন্ন ছেলেদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক ও ছিল ফায়জার এই অভিযোগ করতেও ভোলে নি সে। এমন দুশ্চরিত্রা মেয়ে কে সে কিছুতেই মেনে নিবে না আদিবের জন্য। আদিবের বিয়ে সে অলরেডি ঠিক করে ফেলেছে। তাই আদিবের দিকে হাত বাড়ালে ভালো হবে না বলে শাসিয়েছে ফায়জা কে। সায়েবা বাধা দিলে তাকেও বলেছে,সে ফারহান কে ফাসিয়ে বিয়ে করেছে।বড়লোক ছেলে ফাসিয়ে বিয়ে করে এতো বড় বড় কথা বলতে লজ্জা করে না? সায়েবা তার কথায় তোয়াক্কা না করে তাকে ওখান থেকে চলে যেতে বলে।না হলে তার এই ব্যবহারের কথা সে সবাইকে জানাতে বাধ্য হবে।আদিবের মা তার আরো কিছু তিক্ত কথা শুনিয়ে রুমে চলে যায়।আর ফায়জা আস্তে করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। সাবা আর নীতি শুধু নিরব দর্শক ছিল সেখানে।ওইদিন ফায়জার কথা শুনে আদিব কে অডিও ক্লিপ না শুনিয়ে কতো বড় ভুল করেছে আজ তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সায়েবা।
ফায়জা দদরজা বন্ধ করার পর সায়েবা অনেকক্ষন দরজা নক করেছে।ফায়জা দরজা খুলে নি। তবে সায়েবা কে আস্বস্ত করেছে সে ঠিক আছে। তাই সায়েবা আর কিছু বলে নি। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো!
— সায়েবা,,,
ফারহানের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো সায়েবা।ফারহানের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলো সে।রক্তিম চোখে সায়েবার দিকে তাকিয়ে আছে ফারহান। তবে চেহারায় রাগের আভাস নেই।সায়েবা নিজেকে সামলে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
— হুম।
— বাসায় কি হয়েছিলো সায়েবা?কোন কিছু লুকাবে না। প্রথম থেকে সবটা বলবে।এই সামান্য বিয়ে ভাঙার জন্য আপু এমন একটা স্টেপ নেয় নি। আমার ফোনে আপুর সাথে কথা হয়েছিলো। তখন ও সব ঠিক ছিলো। হঠাৎ কি এমন হলো যে আপু,,,
ফারহানের গলার স্বর কাপছে।ফরহাদ ও প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে সায়েবার দিকে। আর কেউ না জানলেও ওরা দুই ভাই জানে ফায়জা এ বিয়ে ভাঙাতে কোন কষ্ট পায় নি।তাহলে কি এমন হলো? এতটা দুর্বল তো ফায়জা কখনোই না যে সামান্য বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সুই*সাইড করবে।
সায়েবা ভয়ার্ত চোখে তাকালো ফারহানের দিকে। শুকনো ঢোক গিলে আড় চোখে আদিবের মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখে ও আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে।
— চুপ করে থেকো না সায়েবা।আমার রাগ সম্পর্কে তুমি জানো।এই মুহুর্তে আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। প্লিজ সত্যি টা বলো।
ফারহানের কাটকাট গলায় বলা কথা গুলো সায়েবা কে অসহায় করে তুললো। এই মুহুর্তে এসব নিয়্র আলোচনা করা মানে ঘুর্ণিঝড়ের নিমন্ত্রণ দেয়া।যেই ঝড়ে সবার আগে ধ্বংস হবে আদিব। সায়েবা আরেক বার আসে পাসে চোখ বুলালো আদিবের আশায়।কিন্তু আদিব কোথাও নেই।ফারহান সায়েবার ভীতু চোখ দেখে নিশ্চিত তারা পৌছানোর আগে বাসায় কিছু হয়েছে।সায়েবা ফারহানের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বললো,
— তেমন কিছুই হয়,,,,
সায়েবা কে মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো ফারহান। অত্যন্ত রাগী গলায় বললো,
— মিথ্যা নয়,সত্যি টা জানতে চাইছি।
— এখন এসব থাক।আগে আপু ঠিক হয়ে যাক। এগুলো পরে ও আলোচনা করা যাবে ফারহান।(অসহায় গলায়)
সায়েবার পাশে সাবা আর নীতি এতক্ষণ সব কিছু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো। কিন্তু এবার আর চুপ থাকতে পারলো না, অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়েই নীতি সায়েবা কে বললো,
— থাকবে কেন সায়বু।ভাইয়ার সব কিছু জানা দরকার। আমি আপনাকে বলছি ভাইয়া।সায়েবার বাধা দেয়া সত্ত্বেও নীতি ফারহান কে আগাগোড়া সব কিছু খুলে বললো। ফারহান চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। সব কিছু শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে ফরহাদ।সব সময় শান্ত থাকা ছেলেটা ও আজ ক্ষিপ্ত বাঘের মতো তাকিয়ে আছে আদিবের মায়ের দিকে। ফারহানের মামা স্তব্ধ হয়ে গেছে স্ত্রীর এমন কাজে।
— আপনার সাহস কিভাবে হলো আমার আপু কে এসব বলার?হাউ ডেয়ার ইউ?
ফারহানের হুংকারে উপস্থিত সবাই কেপে উঠলো।সায়েবা অশ্রুসিক্ত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এজন্যই সে এখন এসব বলতে চায় নি।
ফরহাদ রাগে কয়েকটা চেয়ার তুলে আছাড় মেরে তেড়ে যেতে নিলেই শাহানা বেগম তাকে আটকে ধরে ফেললো,
— আমাকে ছাড়ো ফুপ্পি।ওনার সাহস কিভাবে হয় আমার বোন কে নষ্টা বলার।এই আপনি কি জানেন আমার ফায়জু সম্পর্কে?আপনার ছেলের মতো দশটা আদিব আমার বোন তার চাকর বানিয়ে রাখতে পারে।ডাকুন আপনার ছেলেকে।তার কাছে জিজ্ঞেস করুন কে কার পিছনে পড়ে আছে। ইউজলেস মহিলা।আদিবের বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো চেয়ারে। সে তো জানে তার ছেলে কতটা ভালবাসে ফায়জা কে।বুঝ হওয়ার পর থেকে আদিব ফায়জা বলতে পাগল। আদিব যদি জানতে পারে তার মায়ের জন্য ফায়জার এই অবস্থা তাহলে ছেলেটা ম*রে যাবে!
ফারহান আর ফরহাদ এখনো রাগে ফোসফাস করছে।আদিবের মা ভয়ে সিটিয়ে আছে। সে ভেবেছে আগের বারের মতো এবার ও কেউ কিছু জানতে পারবে না। কিন্তু এখন সবাই সব কিছু জেনে গেছে।আদিব!আদিব কোথায়?আদিব জানলে সব শেষ হয়ে যাবে!
— আম্মু,,,,
আদিবের বিদ্ধস্ত গলা শুনে কলিজা কেপে উঠল আফরিন বেগমের। তার ছেলে কি সব শুনে ফেলেছে?
ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকাতেই সারা শরীর কেপে উঠলো তার।মাথায় টুপি পড়ে টলমল চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে আদিব।
চলবে,,,#সায়েবা_আসক্তি
#লেখিকা_সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩১
ফিনাইলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে সায়েবার। তার উপর এই থমথমে পরিবেশ আরো বেশি উদগ্রীব করে তুলছে তাকে।ভয়ার্ত চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে আছে সায়েবা।যে এই মুহুর্তে তার মায়ের সামনে হাটু গেরে বসে আছে। তখন থেকে একটা কথা ও বলে নি আদিব। আদিবের নিস্তব্ধতায় ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে আফরিন বেগমের মনে।
— বুঝ হওয়ার পর থেকে ফায়জা কে ভালোবাসি আমি। যাকে বলে চোখে হারানো ভালোবাসা।
এস এস সি পরিক্ষার পরে ফায়জা কে নানান ভাবে বোঝাতে চেয়েছি আমার ভালোবাসার কথা। তখন সে মেডিকেল এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার সমস্ত চেষ্টা যখন ব্যার্থ হলো তখন তাকে জ্বালাতে শুরু করলাম।সে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমার মনে কি চলছে!তাই পড়াশোনার নাম করে আমেরিকা চলে গেলো। তুমি জানো আম্মু ফায়জা কে আমি কতটা ভালোবাসি?যতটা ভালোবাসলে তাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঠিক ততটা।যেমন এই মুহুর্তে তাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।তার কোন দোষ নেই আম্মু।তোমার ছেলে তার পিছনে পরে ছিলো।সে নয় তোমার ছেলে তাকে ভালোবাসার জালে ফাসাতে চেয়েছে।বার বার বারণ করা সত্ত্বেও রাস্তার কুকুরের মতো তার পেছনে পরে আছে। এই যে আজ সে এভাবে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে! সেটাও তোমার ছেলের জন্য। এই তোমাদের কথার ভয়ে সে বিয়ে করে আমার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল। ও আমাকে ভালোবাসে আম্মু। আমি জানি।তবুও দূরত্ব মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু আমি তাকে হারানোর কথা চিন্তা ও করতে পারি না। আমার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। যদি বলো কাওকে ছাড়া কেউ মরে যায় না তাহলে সেটা কারোর ক্ষেত্রে ঠিক। এই আদিবের ক্ষেত্রে নয়।আমি তাকে ছাড়া মরে যাবো। তাকে ছাড়া বাচা তো অনেক দূর।সে আমার নয় এটা ভাবলেই আমি মরে যাবো। তুমি আমার মা।আমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছো।আমি তোমাকে ত্যাগ করতে পারবো না। কিন্তু আজ থেকে তুমি তোমার ছেলে কে হারালে। যে তোমাকে খুব ভালোবাসতো।এখন থেকে যাকে তুমি পাবে সে শুধু একজন মানুষ। যার তোমার উপর দায়িত্ব আছে।সে শুধু তার দায়িত্ব পালন করবে। আমি জানি না এর পরেও ফায়জা আমার হবে কি না?তবে আমি সারাজীবন তাকে চেয়ে যাবো। আমি কথা দিয়েছি তাকে।একবার সুস্থ হয়ে গেলে আমি আর তার সামনে যাবো না। আর সেটা এখানে থাকলে সম্ভব না। আব্বু,,,(ফরিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে)
ফরিদ সাহেব অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে।
— আমি কানাডা যেতে চাই।এখন থেকে ওখানকার বিজনেস আমিই দেখবো।
— ঝোকের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নিস না আদিব।আমি কথা বলবো ফায়জার সাথে।অন্য কারো ভুলের শাস্তি তুই কেন পাবি?ফায়জার বিয়ে তোর সাথেই হবে।আমি সানোয়ার আর ফারহানার সাথে কথা বলবো। ফায়জা কে একবার সুস্থ হতে দে।যে অপরাধ করেছে সে তার অপরাধের শাস্তি পাবে।আর যদি তুই দেশ ছাড়ার কথা চিন্তা ও করিস তাহলে তোর মায়ের সাথে ও আমার আর সংসার করা হবে না। অনেক ছাড় দিয়েছি আর নয়। দিন দিন তার ঔদ্ধত্য বেড়েই চলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া উচিত।
আফরিন বেগমের চোখ লাল হয়ে আছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে কান্না করে যাচ্ছে সে।এখন বুঝতে পারছে কতো বড় ভুল করেছে। ফারহান আর ফরহাদ এখনো রেগে আছে। তা তাদের রক্তিম চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু নিজেদের রাগ প্রকাশ করতে পারছে না। যাকে রাগ দেখাবে সে নিজেই তো বিদ্ধস্ত। আদিব অপরাধী চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মাফ করে দিস ভাই। আমার ভালোবাসা ওর জীবনে এভাবে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা আমি ভাবতেও পারি নি। তোর বোনের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। যে শাস্তি দিবি তা আমরা মাথা পেতে নিবো।
আদিব মাথা নিচু করে বসে আছে। টপটপ করে চোখ থেকে পানি পরছে ওর।বুকের ভিতর হৃদয় নামক মাংসপিন্ড শত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে বারবার। বুকের এই অসহ্য ব্যাথা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আদিব। সবার চোখ ছলছল করছে।ফরিদ সাহেব আগলে নিলেন ছেলেকে।
হঠাৎ করে থাপ্পড়ের শব্দে সবাই চমকে গেলো।
আফরিন বেগম রাগে ফুসছেন।তার সামনেই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিজা।আফরিন বেগম চিৎকার করে বললো,
— মিথ্যা বলেছিস কেন?আমাকে এই দুই বছর ভুল বুঝিয়েছিস কেন বল?
শাহানা বেগম আফরিন বেগমের সামনে থেকে সরিয়ে নিলো লিজা কে। কর্কশ গলায় বললো,
— আপনার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললেন কোন সাহসে?
— সাহস আমার প্রশংসা করার মতোই।আপনার এই কুলাঙ্গার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন কেন তার গায়ে হাত তুলেছি।অসভ্য মেয়ে।মুখ খোল, না হলে তোর এই মুখ আমি ভেঙে দিবো এখন।
আফরিন বেগমের হুংকারে কেপে উঠলো লিজা।মায়ের সাপোর্ট পেয়ে ন্যাকা কান্না শুরু করলো।
— আপনি কি বলছেন আন্টি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি আমাদের সবার সাথে অন্যায় করছেন কিন্তু।
আফরিন বেগমের রাগ এবার আকাশ ছুলো। দাত কিড়মিড় করে বললো,
— নাটক করিস হ্যা?নাটক? তোর এই সস্তা নাটক আমার কাছে চলবে না। ভালোয় ভালোয় সত্যি টা বলে দে।নাহলে আজ তোকে খুন করে আমি জেলে যাবো।
সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ এগিয়ে এসে বললো।
— এটা হসপিটাল। ঝামেলা না করে যা বলার পরিস্কার করে বলুন।
— এই মেয়ে দুই বছর আগে ফায়জা যখন দেশে আসে তখন আমার কাছে এসেছিলো। ফায়জার কিছু আপত্তিকর ছবি দেখিয়ে বলে ফায়জা আমেরিকা অনেক ছেলেদের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত আছে।আর এখন আদিব কেও ফাসাচ্ছে।আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নি। কিন্তু ও অনবরত আমাকে বিভিন্ন ছেলেদের সাথে ফায়জার অশ্লীল ছবি পাঠাতো। একটা সময় আমি ও বিশ্বাস করে নেই।আর এই বিশ্বাসের ফায়দা নিয়ে আমাকে বার বার উস্কে দিচ্ছিল ও।রাগে বোধ জ্ঞান হারিয়ে এমন নিকৃষ্ট কাজ করে ফেলেছি আমি।(কান্না করে)
সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে লিজার দিকে। ফারহান তো পারলে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে ওকে।
— মিথ্যা কথা। আমি এসব কিছুই করি নি। কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?আম্মু এই মহিলা আমাকে ফাসাতে চাইছে।
লিজার কুমিরের কান্নায় কারোর মন গললো না।
— প্রমাণ চাই তো?প্রমাণ আছে আমার কাছে।দেখাচ্ছি দাড়া।
সায়েবা এগিয়ে এসে বললো,
— আমাকে দিন মামী।
আফরিন বেগম কয়েকটা ছবি বের করে সায়েবার হাতে দিল।ছবির দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সায়েবা।সায়েবার হাত থেকে ফোন একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো আদিব। ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সাথে সাথে। ফরহাদ আর ফারহান সাহস করলো না সেই ছবি দেখার।হোক নকল।তবুও ফেস তো ফায়জার।শাহানা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে লিজার দিকে।
আদিব নিজের সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেললো। সবার সামনে কষিয়ে একনাগাড়ে চ*ড় লাগালো লিজার গালে।তাতে ও শান্তি হলো না ওর।দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিয়ে গলা চেপে ধরলো।
— তোকে আজ আমি খু*ন করে ফেলবো। তোর সাহস কিভাবে হলো আমার ফায়জার নামে এসব বলার।নোংরা মেয়ে।
আদিবের চিৎকারে হাসপারালের পরিবেশ থমকে গেছে। ফারহান আর ফরহাদ নির্লিপ্ত ভাবে দাড়িয়ে আছে।সায়েবা হতভম্ব হয়ে ওদের দেখছে।সাবা নীতি কেউ এগিয়ে আসছে না। ফরিদ সাহেব আর শাহানা বেগম টেনে আদিব কে সরাতে পারছে না। লিজার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে সত্যি সত্যিই মরে যাবে।
এতক্ষণ পরে তৃপ্তির হাসি হাসলো ফারহান।চেয়ারে আয়েশ করে বসে সাথে ফরহাদ কেও টেনে বসিয়ে দিলো। আদিবের দিকে তাকিয়ে উৎসাহিত গলায় বললো,
— মেরে দে।সেটেলমেন্ট আমি করে নিবো।আমার বাবার অনেক টাকা।গলা টিপে মারা হয়ে গেলে এই পাচ তালা থেকে আরো দুই বার ফেলবি।একা না পারলে বলিস।আমি লোকের ব্যবস্থা করে দিবো। হসপিটাল আমাদের, ডাক্তার ও আমাদের।সুইসাইড কেস বলে চালিয়ে দিবো।আই উইটনেস ও আছে।কি বলো শালিকারা?
— প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে এভাবে আত্মহত্যা করবে ভাবতে পারিনি দুলাভাই।আহা বেচারি!
চলবে,,,