সিঙ্গেল মাদার পর্ব-০১

0
34

#সিঙ্গেল_মাদার (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

“নিজের সন্তানের কথা ভেবে সংসারটা করে যা মিনু। একটা সংসার ভাঙা সহজ, সেই ভাঙা সংসার জোড়া লাগানো কঠিন। সংসারের কথা নাহয় না ভাবলি, সন্তানের কথা তো ভাব।”
মায়ের কথা শুনে অসহয় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো মিনু। তার মা আবারও সুন্দরভাবে বলে,“একজন স্ত্রীর জন্য স্বামী, সন্তানের থেকে মূল্যবান আর কিছু হয় না। স্বামীর একটা ভুল তুই ক্ষমা না করলে কে ক্ষমা করবে বল? ভুলগুলো শুধরে নিয়ে চলার নামই জীবন, ভুলটাকে আকড়ে ধরার নাম জীবন নয়।”

“একজন স্ত্রীর জন্য স্বামী, সন্তান সবচেয়ে মূল্যবান। তো একজন স্বামীর কাছে স্ত্রী, সন্তান এত অবহেলার কেন মা?”
মিনুর এই কথার জবাব তার মা দিতে পারেনি। তবে সে নিজের সাধ্যমতো মিনুকে সংসার করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। মিনু চুপচাপ মায়ের কথা শোনে। মিনুর মা ঘর থেকে চলে গেলে সে নিজের পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত ছেলের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়ার জগতে হারিয়ে যায় মিনু। তার মন তাকে বলে,“এই নিষ্পাপ বাচ্চার কি দোষ, তাকে বাবাহারা কেন করবি? একজন সন্তানের জীবনে বাবা, মা দু’জনকেই প্রয়োজন।”
এই কথাটি মিনুর মনে আসতে তার চোখে ভেসে উঠে তার স্বামী পলাশের বেঈমানী। সাত বছরের সাজানো গোছানো মিনুর সংসার পলাশের এক মূহুর্তের বেঈমানীর মাধ্যমে ভেঙে গেছে। সাত বছর ধরে মিনু নিজের সংসার, নিজের স্বামী, নিজের সন্তান নিয়ে শত শত স্বপ্ন দেখেছে। তার সব স্বপ্ন এক মূহুর্তে শেষ হয়ে গেছে। মিনুর এসব ভাবনার মাঝে পলাশ ঘরে আসে। মিনু বাবার বাড়ি এসেছে সাতদিন হলো, এই ক’দিনে প্রতিদিনই পলাশ এই বাড়িতে আসছে। সে মিনুকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসছে। তবে মিনু যেতে রাজি হয় না। প্রতিদিনের ন্যায় আজও পলাশ মিনুর পা জড়িয়ে ধরে বলে,“আমাকে ক্ষমা করে দাও মিনু। আমি মস্তবড় একটি ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করো। বিশ্বাস করো জেনেবুঝে আমি এসব করিনি।”

মিনু পলাশের চোখের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে। পলাশ এক পর্যায়ে কান্না করে দেয়। সে বলে,“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না মিনু। তুমি পরশ(ছেলে) এরাই আমার জীবন।”

“আর প্রিয়া?”
মিনুর এই প্রশ্নে পলাশ এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি মিনু। আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্রিয়া আমার কেউ না। বিশ্বাস করো যা হয়েছে সবটা ভুল হয়েছে। ভুল করে হয়েছে।”

“প্রিয়া একা একা তোমার সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে বুঝি?”
মিনুর এই প্রশ্নে পলাশ তার পা ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। সে বলে,“গত সাতদিন ধরে আমি তোমাকে এটাই তো বলতে চাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনতে চাচ্ছো না।”

“আচ্ছা এখন বলো। আজ আমি তোমার কথা শোনার জন্য তৈরি আছি পলাশ। তুমি আজ বলো?”
পলাশ মিনুর কথা শুনে বলতে শুরু করে। তার সাথে কিভাবে প্রিয়ার একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।
__
প্রিয়া নিজের স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাকে ডিভোর্স দেয়। প্রিয়া মিনুর খুব ভালো বান্ধবী হওয়ায় তার কাছে সাহায্য চায়। তাকে যদি একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে ভালো হয়। মিনুকে প্রিয়া তার স্বামীর অত্যাচারের সব কথা বলতো, মায়ায় পড়ে মিনুও পলাশকে তার ঘটনা খুলে বলে। অতঃপর পলাশ প্রিয়াকে নিজের অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। সেই থেকে শুরু হয় প্রিয়ার পলাশকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা। মিনুর বন্ধু হওয়ার সুবাদে তাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতো প্রিয়া, সেই সাথে অফিস তো রয়েছে। প্রিয়া সবসময় চেষ্টা করতো পলাশের গা ঘেষে চলার। প্রথম প্রথম সবকিছু পলাশ এড়িয়ে চলতো। এক পর্যায়ে প্রিয়া নানা অজুহাতে তাকে তার বাড়ি ডাকতে শুরু করে। প্রথম দিকে গেলেও পরবর্তীতে সে না করে দেয়। তবে পলাশও পুরুষ মানুষ। প্রিয়ার নিজ থেকে তার দিকে এগিয়ে আসায় সে নিজেকে আটকাতে পারেনি। যেই পলাশ সবসময় প্রিয়ার ম্যাসেজ ইগনোর করে রাখতো সেই পলাশ তাকে রিপ্লাই দেওয়া শুরু করে। প্রিয়া ডাকলে তার বাড়িতে যাওয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের মাঝে কথাবার্তা বাড়তে থাকে। প্রিয়া তাকে তার মনের কথা জানায়। প্রিয়া পলাশকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। এই কথা শুনে প্রথমে অবশ্য পলাশ জবাব দেয়নি, তবে পরবর্তীতে জবাব দেয়। এরপর থেকেই তাদের দুজনের মধ্যে অবৈধ এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

______
পলাশ সবকিছু বলে মিনুর পা জড়িয়ে ধরেই বলে,“আমাকে ক্ষমা করে দাও মিনু। আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি। আমার সবকিছু তোমাকে জানানো উচিত ছিলো। আমার এসবে জড়ানো উচিত ছিলো না।”

“তোমাদের সম্পর্কটা ঠিক কতদূর গড়িয়েছে?”
মিনুর প্রশ্নের গভীরতা বুঝতে পারে পলাশ। তাই তৎক্ষনাৎ বলে উঠে,“না। তুমি যেমন ভাবছো তেমন নয়। আমরা শুধু দেখা করতাম, কথা বলতাম। এছাড়া বেশি কিছু হয়নি আমাদের মাঝে। তবে বিয়ের কথা উঠতো। প্রিয়া আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমারও মাঝে মাঝে তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা হতো কিন্তু আমি আমার এই ইচ্ছা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারিনি। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে পরশকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য প্রিয়ার কথার জাদুতে আটকে পড়েছিলাম কিন্তু সত্যি বলতে ভালো আমি তোমাকেই বাসি।”

“যে মানুষ একবার বিশ্বাস ভাঙতে পারে সে বারবার পারে। আর আমি তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো? আজ তুমি আমাকে নিতে আসছো, কাল আমাদের মাঝে যখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তখন তো সেই তুমি আবার প্রিয়ার সাথে লুকিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

“না। আমি প্রিয়ার সাথে আর কখনো কোন যোগাযোগ রাখবো না। তুমি বিশ্বাস করো মিনু। এই ভুল দ্বিতীয়বার হবে না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি। আমি যা ভুল করেছি সব শুধরে নিবো। আমাকে একটা সুযোগ দাও মিনু। একটা সুযোগ দাও।”
পলাশের এসব কথায় মিনুর মন নরম হয়। তবুও সে শক্ত গলায় বলে,“তোমাদের মাঝে সম্পর্ক তত গভীর ছিলো না এবং তুমি সেই সম্পর্কর ইতি টেনে আমাকে নিতে আসছো। এই কথা বিশ্বাস করে আমি তোমার সাথে যেতে রাজি আছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার যদি আমাকে ঠকাও কিংবা আমি যদি কখনো জানি তোমরা শারীরিক সম্পর্কে ছিলে তাহলে আমি সেদিন চলে আসবো। সেদিন তুমি চেয়েও আমাকে আটকাতে পারবে না। এই কথাটি মাথায় রেখো পলাশ।”
মিনুর এই কথায় পলাশ সম্মতি জানায়। সে রাজি। সে বলে,“কথা দিচ্ছি জীবনে কখনো তোমাকে আর ঠকাবো না।”

“আর হ্যাঁ আমি তোমার সাথে যাবো ঠিকই তবে এখনই তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙেছো, আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছো। এই ক্ষত সারতে আমার অনেক সময় লাগবে। তাই আমি তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ক্ষমা করতে পারবো না পলাশ।”

“মানে?”
পলাশ অবাক হয়ে মিনুর দিকে তাকায়। সে ব্যথিত হলো। মিনু কঠিন গলায় বলে,“আমি তোমাকে ক্ষমা করবো তবে সেটা তখন যখন আমি আমার ভালোবাসাকে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করতে পারবো। যখন আমার মনে হবে সাত বছর ধরে আমি যে মানুষটিকে ভালোবেসেছি সেই মানুষটি আজকের তুমি তখন আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো। তার আগে নয়।”
পলাশ মিনুর এই কথায় রাজি হয়ে যায়। মিনু মাথা নাড়ায়। সে পরশকে জড়িয়ে ধরে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। পলাশ ওপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তবে সে মিনুর দিকে মুখ করে শুয়েছে। তাই পলকহীন চোখে মিনুকে দেখে যায়। মিনু এটা দেখে উল্টো দিকে ঘুরে যায়। পলাশ এতে খুব কষ্ট পায়। মিনুর এই এড়িয়ে চলা তাকে বুঝিয়ে দেয় সে কতবড় ভুল করেছে। সে পরশকে বুকে নিয়ে মিনুর উদ্দেশ্য মনেমনে বলে,“আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি মিনু। আমি ভুল করেছি, মস্তবড় ভুল। তবে সেই ভুল শুধরে আমি ঠিকই তোমার ভালোবাসা আবার অর্জন করে নিবো মিনু। ঠিক অর্জন করে নিবো।”


চলবে,