সিঙ্গেল মাদার পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
33

#সিঙ্গেল_মাদার (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

পরবর্তী দিন মিনু পলাশের সঙ্গে নিজের সংসারে ফিরে আসে। পলাশ সেই সময় থেকে এক মাস ধরে মিনুর মান ভাঙানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিনু এবং পরশকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছে, ভালোবাসা দিচ্ছে পলাশ। পলাশের এত ভালোবাসা, এত যত্ন দেখে মিনু একটা সময় তাকে ক্ষমা করে দেয়। মিনু এবং পলাশের দাম্পত্য জীবন আবারও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। পলাশ, মিনু, পরশ এই তো তাদের তিনজনার ছোট্ট একটি পরিবার। এই কয়েক মাসে মিনু পলাশের হাবভাব, ফোন সবসময় চেক করতো। তার মাঝে কোন সমস্যা দেখেনি মিনু। কিন্তু তাও তার মাঝে মাঝে কষ্ট অনুভব হয়, প্রিয়া পলাশের সাথে একই অফিসে কাজ করে। যদি কোনভাবে তাদের মাঝে আবারও সম্পর্ক হয়ে যায়, এই ভয় সবসময় পায় মিনু।

পলাশ মিনুর এই ভয় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। তাই তাকে সবসময় সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“আমি তোমারই আছি। আমি তোমারই থাকবো মিনু। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
পলাশের ভালোবাসার কাছে মিনুর সন্দেহ মিছে হয়ে যায়। মিনু যে পলাশকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের থেকে ভালোবাসার চেয়ে বেশি কি-বা সে চাইবে। অন্যদিকে প্রিয়া পলাশকে নানাভাবে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে, পলাশ যাতে তার সাথে দেখা করতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। এসব নিয়ে পলাশ মাঝে মাঝে ভাবনায় পড়ে গেলেও, একটা সময় সে প্রিয়ার ডাকে সাড়া দেয়। এজন্যই বলে পুরুষ মানুষের মন একবার বিগড়ে গেলে সেটা আর ঠিক হওয়ার নয়। পলাশের ক্ষেত্রে তাই হয়। প্রিয়া তাকে এমনভাবে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে যে একটা সময় পলাশ সেই গুরুতর অপরাধটাও করে ফেলে। তারা দুজন শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। মিনুকে লুকিয়ে পলাশ দিনের পর দিন প্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটায়। একটা সময় পর প্রিয়া তাকে বিয়ে করার জন্য জোর করে পলাশকে। পলাশ তাতেও রাজি হয়ে যায়।

মিথ্যে যতই শক্তিশালী হোক তার মেয়াদ বেশিক্ষণ থাকে না। তেমনভাবে পলাশের এই কর্মকান্ডও মিনুর চোখের আড়াল হলো না। দ্বিতীয়বার পলাশকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া মিনু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সে মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে যায়। এবারও পলাশ তার সেই চিরচেনা রূপ নিয়ে তার পায়ে পড়ে। তার কাছে ক্ষমা চায়। পলাশ বলে,“আমাকে ক্ষমা করে দাও মিনু। সব দোষ প্রিয়ার। ও তোমার সুখ সহ্য করতে না পেরে হিংসায় আমাকে নিজের মায়াজালে বেধে নিয়েছে। আমিও ওর মায়াজালে আটকে পড়েছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও মিনু। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।”

“তাই তো অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতেও দুবার ভাবলে না?”
মিনুর এই কথার জবাবে পলাশ ক্ষমা চায়। সে বলে,“মিনু সবটা মেনে নাও। আমি তোমাদের দুজনকেই সুখী রাখবো। আলাদা আলাদা সংসারে তোমরা সুখী থাকবে।”
এটা শুনে মিনু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। এতদিন পলাশ বলতো সে প্রিয়াকে ছেড়ে দিবে আর আজ বলছে দুজনকে নিয়েই থাকবে। মিনু এসব সহ্য করতে না পেরে পলাশকে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কঠিন গলায় বলে,“ছিহ। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম এটা ভাবতেও আমার লজ্জা করছে পলাশ।”

“মিনু স্যরি। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।”

“ব্যাস পলাশ। এবার থামো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসতে তাহলে এরকম একটা সিদ্ধান্ত কোনদিন নিতে পারতে না। কখনো পারতে না এভাবে আমাকে ঠকাতে। যতই প্রিয়া তোমাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করুক না কেন তুমি যদি আমার বা পরশের কথা ভাবতে তাহলে কখনোই তোমাদের সম্পর্ক এতদূর অব্দি গড়াতো না। স্যরি পলাশ। আমার পক্ষে তোমাকে আর ক্ষমা করা সম্ভব নয়।”

“মিনু এমন বলো না। আমার কথা না ভাবো অন্তত পরশের কথা ভাবো?”

“আমি আমার সন্তানের কথা ভাবছি বলেই এখনো শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি পলাশ। তোমার ভালোবাসার ধোকা আমাকে কতটা যন্ত্রণা দিয়েছে এটা যদি তুমি বুঝতে, তাহলে জানতে আমি তোমার প্রতারণায় একটা জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছি। পরশের কথা ভাবছি বলেই এই জীবন্ত লাশটাকে পুরোপুরি লাশ করতে পারছি না। নয়তো শেষ করে দিতাম নিজেকে। তোমাকে ভালোবেসে যে ভুল আমি করেছি সেটা নিজেকে শেষ করে শুধরে নিতাম।”
মিনুর মুখে এই কথা শুনে পলাশ ভেতর থেকে অনেক কষ্ট পায়। তবুও সে নিজেকে সামলে মিনুকে মানানোর চেষ্টা করে। মিনু যখন একেবারে মানছে না তখন পলাশ বলে,“এই সমাজে একা সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কত কঠিন তুমি জানো? তুমি কখনোই পরশকে নিয়ে একা বাঁচতে পারবে না। জীবনে চলার পথে তোমাকে আমার প্রয়োজন পড়বেই। কিন্তু আমার তোমাকে প্রয়োজন পড়বে না। কারণ তোমার স্মৃতি ভোলানোর জন্য আমার কাছে প্রিয়া আছে। আমি ওর সাথেও অনেক সুখী। আমি তোমার সাথেও সুখীই থাকতে চাই। কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না এই সহজ বিষয়টা।”

“আমি বুঝতেও চাই না। আর হ্যাঁ জীবনে চলার পথে আমার কোন বেঈমানের সঙ্গ প্রয়োজন পড়বে না। যদি পড়ে সেদিন আমাদের মা ছেলের মৃ ত্যু দিন হবে।”
এই কথা বলে মিনু পরশকে বুকে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়। পলাশের ঘর থেকে দ্বিতীয় এবং শেষবারের জন্য বের হয় মিনু।

___
বাবার বাড়ি এসে সব ঘটনা মিনু খুলে বলে। এবারও তার মা তাকে বলে,“এই সমাজে ডিভোর্সি হয়ে বাঁচা কত কষ্টের এটা তুই জানিস? স্বামীদের একটু আকটু ভুল থাকে। মেয়েদের এটা মানিয়ে চলতে হয়। তোর স্বামী ভুল করেছে তাকে সেই ভুল থেকে বের করে নিয়ে আসা তোর দায়িত্ব।”

“পলাশ এতবড় প্রতারণা করার পরও তুমি এই কথা বলছো? তুমি আদো আমার মা তো? মা এই একই ভুল যদি আমি করতাম তখন কি তোমরা পলাশকে বোঝাতে যে স্ত্রী ভুল করছে শুধরে নে? না করতে না। কারণ এই সমাজে পুরুষের ভুল সামান্য আর মেয়েদের ভুল না থাকলেও সে অনেকটা দোষী। তাই তো?”
মিনুর এই কথার জবাবে মা নিশ্চুপ। একটু সময় নিয়ে বলে,“স্বামীর সংসারে অবহেলায়ও কাটিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে সারাজীবন পার করা যায় না রে মা।”

“চিন্তা করো না। আমি তোমার ছেলের এই সংসারে বোঝা হয়ে বেশিদিন থাকবো না।”

“মিনু আমার কথাটা ভাব। একটা মেয়ের কাছে তার স্বামী সন্তানের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু হয় না।”

“হয় মা। একজন মেয়ের কাছে তার স্বামীর চেয়েও তার আত্মসম্মান বেশি মূল্যবান। পলাশ আমার সেই আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। সে বিশ্বাস ভেঙেছে৷ আজ আর আমি পলাশকে ক্ষমা করতে পারবো না মা। কারণ ওর চোখে চোখ রাখলেই আমার মনে পড়বে ও অন্যকাউকে আমার মতো করেই স্পর্শ করেছে। ভালোবেসেছে।”

“একা হাতে সন্তান মানুষ করা অনেক কঠিন।”
মায়ের এই কথার জবাব মিনু দেয় না। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। কান্নারত অবস্থায় বলে,“মা আমাকে তুমি আর কিছু বলো না। ও মা গো। আমাকে তুমি এমন কিছুই বলো না যাতে আমাকে এক প্রতারকের সাথে সারাজীবন কাটাতে হয়। আমি পারবো না মা। তুমি আজ সমাজের ভয়ে যে কথাগুলো বলছো একবার এই সমাজকে ভুলে নিজের মেয়ের যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করে দেখো। তাহলে তুমি বুঝতে পারবে, তোমার কথাগুলো কত ভুল। একজন মেয়ের কাছে সেটা কত যন্ত্রণাদায়ক।”
এই পর্যায়ে এসে মিনুর মাও মেয়েকে জড়িয়ে কান্না করে দেয়। সে মেয়েকে আর কিছু বোঝায় না। মিনুও তার মাকে জড়িয়ে সেই রাতটা কান্না করেই কাটিয়ে দেয়।

*
দিন কেটে সপ্তাহ হয় সপ্তাহ শেষে মাস। এভাবে সময় কেটে যায়। এরমাঝে কয়েকবার পলাশ এসে মিনুর কাছে মাফ চায়। তাকে তার সাথে নিতে চায়। কিন্তু না। মিনু এবার তাকে আর সুযোগ দেয় না। মিনু জানে এই পলাশকে সে যতই সুযোগ দিবে সে ততই তার অপব্যবহার করবে। যে একবারে শুধরায় না সে দশবারেও শুধরাবে না। এরমাঝে মিনু জানতে পারে পলাশ এবং প্রিয়ার বিয়েও হয়েছে। সেই বিয়ের পরেরদিনই পলাশ আবার মিনুর কাছে আসে ক্ষমা চাইতে। মিনু বিয়ের কথা তুললে পলাশ জানায় সে দুই স্ত্রীকেই ভালো রাখবে। মিনু পলাশকে সেদিন থাপ্পড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপর কেটে যায় আরও কিছু সময়। মিনু ঢাকা শহরে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি নেয়। সেই টাকায় চলার মতো একটি বাসা ভাড়া নেয়। যেখানে মা ছেলের ছোট্ট একটা সংসার সাজায় মিনু। এসবের মাঝে তার সাথে পলাশের ডিভোর্সও হয়ে যায়। তারপর তার মা ভাই তাকে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো কিন্তু মিনু রাজি হয়নি। সে সারাজীবন তার বাচ্চাকে নিয়ে কাটিয়ে দিবে। সেই আশায় নতুন এই সংসার সাজাচ্ছে মিনু।

সমাজে চলার পথে তাকে প্রতি পদে পদে সিঙ্গেল মাদার হিসাবে লাঞ্চণা বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। সবকিছু উপেক্ষা করে মিনু পরশকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। কথা শুনতে শুনতে একটা সময় মানুষকে কথা শোনাতে শুরু করে। মিনু যেদিন থেকে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে সেদিন থেকে তাদের মুখও বন্ধ হয়ে যায়। মিনু তার ভাষা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হিসাবে থাকা লজ্জার নয় বরং একটা দুশ্চরিত্র মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানোটা লজ্জার। পরশকে বুকে নিয়ে মিনুর এই নতুন জীবনের যাত্রা দিয়েই এই গল্পটি এখানে সমাপ্ত হয়। মিনুর এই নতুন জীবনে হয়তো অনেক বাধা বিপত্তি আসবে, তবে একজন মা চাইলে সবই সম্ভব। সকল বাধা বিপত্তি কাটিয়ে মিনু ঠিকই তার এবং তার সন্তানের সুন্দর এক ভবিষ্যত গড়ে নিতে পারবে। সেই সাথে আশা করা যায় কোন একদিন সময় জবাব দিয়ে দিবে। পলাশ এবং প্রিয়ার মতো মানুষদের সময় ঠিকই যোগ্য জবাব, যোগ্য শাস্তি উপহার দিয়ে দিবে।

(সমাপ্ত)
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের ভালো লাগছে না তাই শেষ করে দিলাম। খারাপ লাগলে ক্ষমা করবেন। স্যরি।)