সুখান্বেষণ পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
2

#সুখান্বেষণ (পর্ব:৮)

#আরশিয়া_জান্নাত

ভাদ্রমাসের রোদে কাপড় দেওয়া আমাদের বাসার সাধারণ নিয়ম। এ সময়ের রোদ তিতা হয় বলে পোকামাকড় বাসা বাঁধতে পারেনা এমনটাই আমার দাদী বলতেন। তাই বছরের এই সময়টায় আলমারির সব শাড়ি কাপড় রোদে দিয়ে ঠান্ডা করে গুছিয়ে রাখা হতো। অভ্যাস অনুযায়ী আমিও আমার সব শাড়ি থ্রিপিস ছাদে রোদে দিয়েছি। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা তালের রস বের করছেন। সত্যি বলতে এটার গন্ধ আমার একদম সহ্য হয়না। শ্বশুরবাড়িতে কী এসব বলতে আছে? মা আমাকে দেখে বললেন, “তানহা আরেকটা গামলা নিয়ে বসে পরো।”

আগে কখনো তালের রস না ছাড়ালেও মায়ের দেখাদেখি সেটা করতে শুরু করেছি। মা সবগুলো তালের রস বের করে জালে বসালেন। তারপর ঠান্ডা করে বোতলে করে ফ্রিজে স্টোর করলেন। আমি রুমে এসে আসরের নামাজ পড়ে নিলাম। তাশরিফ বলেছিল আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে, তার এক বন্ধুর বোনের বিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য। ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি নাফিসা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বললো, ভাবি দেখেছো সামনের বিল্ডিং এর কাজ কত দ্রুত শেষ হয়েছে!”

“হ্যাঁ খুব দ্রুত ই হয়েছে। কিছুদিন পর ভাড়াটে ও চলে আসবে।”

“ভাবি তোমাকে একটা ঘটনা বলেছিলাম?”

“কী ঘটনা?”

“ও বলা হয়নি তাহলে। একটা দারুণ ঘটনা ঘটেছে।”

“কী বলো শুনি?”

“আমাদের ক্লাসের টুম্পা, দেখতে খুব সাদাসিধে টাইপ। এমনভাবে ক্লাসে আসে মনে হয় না পারতে এসেছে। মানে একটুও পরিপাটি না। চুলটাও ঠিকঠাক আচড়ায় না। তোহ ওকে সবাই একটু অপছন্দ করে বলা যায়। ওর সঙ্গে কেউ বিশেষ মিশতেও চায় না।”

“হুম তারপর?”

“আমি তোমাকে বলেছিলাম না স্যারের কথা? উনার নজর ভালো না, সবাই গুছিয়ে থেকেও উনার কুদৃষ্টি থেকে ছাড় পায় না, সেখানে টুম্পা কোন ছাড়! উনি ওকে পড়া জিজ্ঞেস করার বাহানায় পিঠে হাত দিয়ে বসতে বলতেন। ইচ্ছে করে বেঞ্চে ঘেঁষে হাঁটাচলা করতেন। একদিন নাকি ওকে ডেকেছিলেন অফিসরুমে।”

“কি সাংঘাতিক লোক এটা! উনার দৌরাত্ম তো বেড়েই চলছে। তোমরা সবাই মিলে কমপ্লেইন করোনা কেন?”

“ম্যাথ পরীক্ষায় ফেইল করতে চাইবে কে?”

“তবুও, কোনো ফিমেল টিচার বা ক্লাস টিচারকে কী জানানোর উপায় নেই? যিনি এ বিষয়ে কোনো স্টেপ নিবেন? দেখো এখনের যুগে এসেও এরকম ভয়ভীতি পেলে চলে? তোমরা চুপচাপ সয়ে গেলে তো সমস্যা সমাধান হবেনা।”

“হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছো। আমাদের উচিৎ আওয়াজ তোলা। ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটাই শুনলেনা।”

“হুম বলো?”

“টুম্পার বাবা পুলিশ অফিসার এটা আমরা কেউ জানতাম না, অবশ্য জানার মতো করে কখনো মেশাই হয়নি। তো ও করলো কী ওর বাবাকে সব বলে স্কুলে নিয়ে আসছে। আরো অনেকেই নাকি পরিচয় গোপন করে সাক্ষ্য দিয়েছে। উনার সঙ্গে সাংবাদিক ও নাকি ছিল। প্রিন্সিপাল স্যার স্কুলের রেপুটেশন বাঁচানোর ভয়ে স্যারকে বহিষ্কার করেছেন। ব্যাপারটা মিডিয়ায় না বলার জন্য অনুরোধ করেছেন। তবে শুনেছি পরে তাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল।”

“তাহলে তো বলা যায় আপদ কেটেছে তোমাদের। এ ঘটনার পর আশা করি আর কেউ এমন জঘন্য কাজ করার স্পর্ধা দেখাবেনা।”

“হ্যাঁ ভাবি ঠিক বলেছো। আমি আল্লাহর কাছে কত দোয়া যে করেছি, আল্লাহ এভাবে উদ্ধার করবেন আশা করিনি।”

নাফিসার প্রফুল্ল চেহারা দেখে আমার মনটা হালকা হলো। যাক ঝামেলা মিটেছে আলহামদুলিল্লাহ।

সন্ধ্যায় সবার জন্য কাবাব ভেজে চা বসাতেই দেখি তাশরিফ এসেছেন। মা তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললেন, সবাই একসঙ্গে চা খেতে।
আমিও ঝটপট সব গুছিয়ে ডাইনিং এ রাখলাম।
তন্ময় ভাইয়া আর নাফিসা কাবাব নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। ভাইয়া বয়সে বড় হলেও ছোট ভাইবোনদের সাথে এমনভাবে খুনসুটি করে যেন তাদের বয়সী। আরমান সেই তুলনায় শান্তই থাকে। তাশরিফ ওদের এসব দেখে বললো, “এখন এতো খেয়ে পেট ভরিয়ে লাভ নেই, একটু পর বিয়ে বাড়ির খাবার আর খেতে পারবি না। ওয়াজেদ বারবার বলেছে সবাই যেন উপস্থিত হয়।”

তন্ময়-“ও তুই চিন্তা করিস না ভাই আমাদের পেট এতো সহজে ভরেনা।”

নাফিসা- “ভরবে কিভাবে আমার ভাগে খাবার খেয়ে খেয়ে ঢোল হয়েছে কি না!”

তন্ময়-“ঢোল বলিস কেন? ভুঁড়ি বল ভুঁড়ি। নারীর শাড়ি, পুরুষের ভুঁড়ি
দুটোই বাঙালির মনোহারি!”

আরমান-“বাহ বস বাহ কেয়া কবিতা কাহি হ্যায়”

নাফিসা-“কবি তন্মেন্দ্রনাথ দত্ত!”

চায়ের পর্ব শেষে সবাই বিয়েতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে চলে গেলো। আমিও সব কিচেনে রেখে রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি জনাব আলমিরা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, “এই হুমায়রা কোন শাড়ি পড়বে আজ ঠিক করেছো?”

“যেকোনো একটা পড়লেই তো হলো, ওখানে সবাই বৌকে দেখতে আসবে আমাকে না.”

“আজকে ম্যাচিং ম্যাচিং পড়বো তাই জিজ্ঞেস করলাম। এতো আনরোমান্টিক তুমি!”

“আপনি বলুন কোনটা আমাকে ফুটে?”

“ফুটে আবার কী? যা পড়ো তাতেই তো সুন্দর লাগে।”

“কচু! সব রঙে সবাইকে মানায় না। দেখুন তো এটাতে মানাবে কি না?

বলেই আমি আকাশী রঙের কাঞ্জিভরম মেলে ধরলাম। তিনি কিছুক্ষণ চেয়ে বললেন, “না এটা পড়া যাবেনা আজ। এটায় বেশি সুন্দর লাগবে। অন্য একটা সিলেক্ট করো।”

একে একে ১০/১২টা দেখানোর পর জনাবের পছন্দ হলো জাম কালারের শাড়ি। আমি হাঁফ ছেড়ে বললাম, আপনি এতো চুজি! এই নাক নিয়ে আমাকে পছন্দ করেছেন কিভাবে আল্লাহ মালুম!”

তিনি হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে বললেন,”তোমাকে চুজ করার পরও কনফিডেন্স আসেনা তুমি বেস্ট বলেই আমার চোখে পড়েছো?”

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,”এই চোখে কি আছে বলুন তো? তাকালেই সব বিশ্বাস করতে মনে চায়..

“কি আছে বুঝতে অসুবিধা হয়?”

আমি উনার গলা জড়িয়ে বললাম, “বুঝতে অসুবিধা হলে কী এ কথা বলতাম?”

“গুড গার্ল।”

বিয়েতে উপস্থিত হবার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হোস্টদের অভ্যর্থনা। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা ব্যতীত বিয়েতে আসা মাটি হয়ে যায়। ওয়াজেদ ভাই ও তার পরিবার আন্তরিকতার ত্রুটি রাখেন নি। তাশরিফ আমাদের কে বসিয়ে উনার অন্যান্য ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে চলে গেলেন। সেখানে একটা নাম শুনে আমার সমস্ত মনোযোগ পেছনের দিকে যায়। হ্যাঁ নামটা ফাইজা! আমি পেছনে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কে ফাইজা। তখন ই চোখ যায় এশ কালারের গর্জিয়াস শাড়ি পড়া মেয়েটার দিকে। মেয়েটার গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, চুলগুলো শাইনি এন্ড সিল্কি, মেকাপ আহামরি না করলেও চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে। আমি তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে ভাবতে থাকি এতো সুন্দর ও মানুষ হয়! আমার বুকের মাঝখানে কেমন চাপ অনুভব হয়। আমি নিজেকে সামলে সামনে তাকাই। তাশরিফ আমাকে নিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করান। আমি হাসিমুখে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। সেখানে ফাইজাও এসে উপস্থিত হয়, তাশরিফের দিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে মুচকি হেসে বলে, কিরে আমার সঙ্গে পরিচয় করাবি না?

তাশরিফ ভীষণ চমকে বললেন, “আরেহ ফাইজা যে! তুই ও এসেছিস দেখছি, দেশে ফিরলি কবে?”

“এইতো কিছুদিন আগে।”

তাশরিফ আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, মিট মাই ওয়াইফ হুমায়রা। হুমায়রা ও আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড ফাইজা। সবাই ওকে বিউটি উইথ ব্রেইন বলে। চুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরিয়েছে কি না!”

আমি হেসে তাকে সালাম দিলাম। উনি আমার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকালো, হাসিমুখেই বললো, “ভারী মিষ্টি বৌ পেয়েছিস তো!”

তাশরিফ-“দেখতে হবেনা বৌটা কার?”

“হ্যাঁ সেটাই।”

তাশরিফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, আমি তার পাশে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। চোখ বন্ধ করলেই ফাইজা আপুর চেহারা ভাসছে। আপুর হাইট ও ৫’৬”, হিল ছাড়াই উনি এতো লম্বা,তাশরিফের হাইটের সাথে মানানসই। আল্লাহ আসলেই কিছু মানুষকে রূপে গুণে অনন্যা বানিয়ে দেন। তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকেনা।
নিজেকে আজকাল অদ্ভুত মনে হয়। আমি দিনদিন কেমন নিব্বি হয়ে যাচ্ছি। এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মন খারাপ করা মানায়? মানুষের পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে, এটা বড় কোনো ব্যাপার না। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আমিই বরং কষ্ট পাচ্ছি।
ডিম লাইটের আলোয় আমি তাশরিফের দিকে তাকাই। ঘুমালে তাকে ভীষণ আদুরে লাগে। কী সুন্দর মাথার নিচে হাত রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন! তার রোমশ বুকে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি দু’হাতে ভর দিয়ে তারদিকে তাক করে শুয়ে তাকে দেখছি আর কত কী ভাবছি!
সে আকস্মিক চোখ মেলে চাইতেই আমি হকচকিয়ে যাই, সে আমার দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো, “রহস্য কী বলো তো?”

“কই কিসের রহস্য?”

“কোনো রহস্য নেই? এমন গভীর পর্যবেক্ষণ চলছে কেন?”

“নিজের বরকে দেখতে রহস্য লাগে নাকি! এমনি দেখছি।”

“তাই?”

“হুম।”

“কারো কিছু চাই না তো?”

কথাটা শুনে লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে গেল, উনি আমাকে কি ভেবে বসলেন! আমি আমতা আমতা করে বললাম, ” না না আপনি ভুল ভাবছেন ওরকম কিছু না।”

তিনি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন। চোখ কচলে আমার দিকে তাকালেন বললেন, ” তোমার চেহারা তো অন্য কথা বলছে ম্যাডাম!”

আমি উনার কথা শুনে প্রতিবাদ করে বললাম, “নাহ ভুল। আপনি আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লেই হবেনা। ”

“আচ্ছা মানলাম।”

বলেই উনি পিঠ দেখিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি উনার বাহুতে হাত রেখে বললাম, “রাগ করেছেন?”

“করার মতো কিছু করেছো?”

“প্রশ্ন না , সোজাসাপ্টা বলুন না প্লিজ।”

“তোমাকে একদিন বলেছি আমি তোমার, তুমি আমার। এখানে রাখঢাকের কারণ কী? তোমাকে আমি যেমন কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখতে পারি, তুমিও পারো। এটা খুব স্বাভাবিক হুমায়রা।”

“আমি জানি তো।”

“জানলে ভালো। ঘুমিয়ে পড়ো।”

“এই..”

“কী?”

“আপনি এভাবে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকবেন? আমি বুঝি আমার বরের চেহারা ও দেখতে পারবোনা?”

“এতোক্ষণ দেখেও যার প্রেম প্রেম পায়নি তার আর দেখা লাগবেনা।”

আমি উনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে গাল ঠেকিয়ে বললাম, “আমি আপনাকে অনুভব করতে ভালোবাসি। আপনার সবকিছু আমার মুখস্থ হোক সেই প্রচেষ্টা চালাই, আপনাকে নিয়ে গবেষণা করতে ভালো লাগে, পর্যবেক্ষণ করতে ভালো লাগে। আপনাকে দেখার তৃষ্ণা আমার মেটেনা। আপনি যখন থাকেন না আপনাকে যেন স্পষ্ট কল্পনা করতে পারি তাই যতক্ষণ থাকেন বেশি করে দেখে নিই। আমার ভালোবাসার ধরন হয়তো স্বাভাবিক নয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”

তাশরিফের হার্টবিট স্লো হয়ে গেল যেন। সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার দিকে ফিরলো, আমার হাতটা তার বুকের মাঝখানে নিয়ে বললো, “অনুভব করতে পারছো বুকের ভেতর কেমন করছে তোমার কথা শুনে?”

আমি তার বুকে নাক ঘষে বললাম, “যাদের বুকে পশম থাকে তারা বৌকে অনেক ভালোবাসে জানেন সেটা? ওদের মন নরম হয়..”

“তা বুঝি আজকে বুঝলে?”

“শুনেছি আগে, বুঝেছি আপনাকে পাওয়ার পর।”

তিনি আমাকে দু’হাতের বন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করে বললেন, “তোমার আশেপাশে থাকলেও আমার শান্তি লাগে। তুমি আমার চক্ষুশীতলকারীনি‌। তোমার উপর রাগ আসেনা আমার, বরং ইচ্ছে করে তোমাকে অনেক ভালোবাসতে। এতো ভালো মেয়ে আমার ভাগ্যে ছিল ভাবা যায়!”

আমি নিশ্চিন্তে তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ি। সে আমার সাড়া না পেয়ে বলে, “দেখেছো মেয়ের কান্ড, আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে কেমন ঘুমিয়ে গেল!”

সময় গড়িয়ে যায়, দিন সপ্তাহ মাস গুনতে গুনতে বছর পেরিয়ে যায়। আমাদের ভালোবাসার পরিমাণ কমেনা। বরং দিনদিন যেন আরো বাড়ে। সাথে যুক্ত হয় একে অপরের প্রতি অপার মায়া মমতা। আমার ছোট ছোট ব্যাপারেও তার মনোযোগ থাকে, আমার গলার টোন শুনেই সে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। একদিন রাগের চোটে উনি পানির গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছিল, মুহুর্তেই কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রই, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। হাত পা থরথর করে কাঁপতে থাকে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। বিয়ের আগে যেমনটা হতো, সে আমার দিকে চেয়ে বিস্মিত হয়ে যায়। দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে, “হুমায়রা কি হয়েছে তোমার চেহারা এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন? তুমি কী ভয় পেয়েছ? স্যরি কলিজা আর কখনো এমন করবোনা। শান্ত হও…”

সে যখন থেকে বুঝতে পেরেছে আমি ঝগড়া- চেঁচামেচি নিতে পারিনা, সে তখন থেকে কোনোদিন উঁচু গলায় কথা বলেনি। রাগের মাথায় ও কোনো জিনিস ভাঙচুর করেনি। আমাকে ভালো রাখতে যা যা করা প্রয়োজন সব এই মানুষটা করেছে। মনপ্রাণ উজাড় করেই করেছে। আমি এই সুখের আশায় কত রাত কেঁদেছিলাম, এমন শান্তির আশ্রয়ের জন্য সেজদায় মাথা ঠুকে ছিলাম। আমার রব আমাকে নিরাশ করেন নি। তিনি আমাকে আমার চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন। আমার বাবা স্ট্রোকের পর শান্ত হয়ে গেছেন।
মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন, আগের কর্মকান্ডের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চান। শুনেছি আম্মুকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও একা থাকতে চান না। সবসময় মায়ের সাথেই থাকেন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম আর বলেছিল, তুই আমার মায়ের রূপ ধারণ করে জন্মেছিলি, তাও আমি তোকে কদর করিনি। সবসময় আজেবাজে ব্যবহার করেছি। যেখানে আমার উচিৎ ছিল তোকে মাথায় তুলে রাখা। আমাকে ক্ষমা করিস মা। আমি তোদের সবার সাথেই অন্যায় করেছি।”

যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি অন্যায় করেছিলেন সে ই যখন ক্ষমা করে দিয়েছেন আমি আর রাগ পুষে কী করবো। তাকে ক্ষমা করে নিজের মানসিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই বরং শ্রেয় মনে হলো। পুরুষ মানুষ আসলে বড়সড় ধাক্কা খেলেই বুঝতে পারে তার স্ত্রী বাদে কেউই তার আপন নয়। যার সাথে অন্যায় করে; দিনের পর দিন অত্যাচার করে শেষ বয়সে তার কাছেই আশ্রয় খুঁজে পায়। আফসোস যে সোনালী সময় চলে গেছে তা আর ফিরে আসেনা, পুরনো ক্ষত ও সারেনা। কিছু মানুষ তো মৃত্যুর আগ অবধিও রিয়েলাইজ করতে পারেনা সে অন্যায় করেছিল। সেই তুলনায় আব্বু নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, আম্মুর মনের ক্ষত সারানোর চেষ্টা করছেন এটাও কম কী? সুযোগ পেলেই মাকে সাথে করে কক্সবাজার, বান্দরবান বেড়াতে যান। সপ্তাহান্তে পার্কে গিয়ে বসেন। এসব শুনে আমার বরং আনন্দ ই লাগে। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই ধাক্কাটা আরেকটু আগে পেলে মন্দ হতোনা!

আমার সুখের ঘটি পরিপূর্ণ করার জন্য মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এই এক জীবনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শেষ করতে পারবোনা বোধ করি। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন এভাবেই সুখেশান্তিতে বাস করতে পারি। জীবনের চড়াই উৎরাই এ একে অপরের ঢাল হয়ে থাকতে পারি। আমাদের দুই সন্তানকে যেন মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারি।
আমার সুখান্বেষণের যাত্রা এখানেই শেষ হলো।

#সমাপ্ত