#সুখের_আশায়_চেয়ে থাকি (০১)
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
“আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাই নাজনীন। এবং খুব শীঘ্রই।”
“পাত্রী ও নিশ্চয় ঠিক করা?”
স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ করতে ইচ্ছুক। একথা শুনেও নাজনিন বেশ শান্ত, স্বাভাবিক। কথার পিঠে প্রশ্নও করেছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। কিন্তু থতমত খেয়ে গেল নাজনীনের দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাওয়া স্বামী। তিনি বোধহয় স্ত্রীর এহেন স্বাভাবিক আচরণ আশা করেননি। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নাজনীনের স্বামী প্রতিত্তোরে বললেন, “ওই আর কি।”
“ওই আর কি, আবার কেমন কথা?” এবারও নাজনীনের স্বাভাবিক প্রশ্ন। কিন্তু ভরকে দিলো রাজনকে। সে বারবার এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে।
“আমার যদি খুব ভুল না হয়, পাত্রী আপনার অফিস কলিগ মেয়েটি। যে মেয়েটি আপনার ফোন দিলে আপনার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে যেতো। যখন তখন আপনাদের ফোনালাপ চলতো। তাই নয় কী?”
রাজন এবারও চুপ রইলো। কিন্তু চুপ রইলো না নাজনীন। সে রাতের খাবার শেষে থালাবাসন ধুয়ে, স্বামী এবং নিজের জন্য চা করে নিয়ে এসেছিল রুমে। পরনে তার হালকা গোলাপি নাইটসুট। ভিষন সুন্দর লাগছে তাকে। কিন্তু রাজনের মন ঘুনে ধরেছে। দুদিন পর পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। সে এসব সুন্দর জিনিস দেখবে না। পুরোনো নর্দমার পচা গন্ধ ই তার অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছে।
নাজনীন ট্রে থেকে একটি কাপ উঠিয়ে রাজনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। রাজন বিস্মিত হলো যেন। তবে কাপটি নিলো। নাজনীন আরেকটা কাপ নিয়ে ট্রেটি বেড সাইট টেবিলে রেখে খাটে পা উঠিয়ে বসলো। চায়ে এক চুমুক দিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো, “আপনার মন যে পরনারীর দিকে ধাবিত হচ্ছিলো আমি আপনার ঘরের স্ত্রী হয়ে বুঝেছিলাম বটে। আমি চিৎকার, চেচামেচি পছন্দ করি না। জোর গলায় ঝগড়া করাও আমার স্বভাবে না। আজেবাজে ভাষা তো এ মুখ দিয়ে কখনও বেড় হবে না ইন শা আল্লাহ। আমি কি আপনাকে এ ব্যাপারে সাবধান করিনি? সুন্দর করে বোঝাইনি? বলিনি, পরকীয়া সুন্দর একটি সুন্দর সম্পর্ককে নষ্ট করে না। নষ্ট করে দুজন মানুষের জীবন। সঙ্গে নষ্ট হয় দুজন মানুষের সাথে জড়িত মানুষগুলোর জীবন। পরকীয়া একটি সামাজিক ব্যাধী। এ ব্যাধী কিন্তু আমরা চাইলেই নিরাময় করতে পারি। বলেছিলাম না? আপনি করেছেন? পরনারীর থেকে দৃষ্টি হেফাজতে রাখতে বলেছিলাম। কথা রেখেছেন আমার? বলেছিলাম, অফিস থেকে রিজাইন নিতে। অন্য কোথাও চাকরি খুজতে। আপনি সম্মত হলেন। কিন্তু সে ঘটনার মাস তিনেক পর এসে বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছেন? বাহ্!”
এবার মুখ খুললো রাজন, “বারবার পরকীয়া পরকীয়া বলছো কেন? কাউকে পছন্দ করা, ভালোবাসা নিশ্চয় অপরাধ নয়। আমি সাবলম্বি পুরুষ। চাইলেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারি। আমাদের ধর্মে তো আছে। তাহলে?”
“ইসলাম নিয়ে স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করবেন না। আমার আপনার থেকে কম জ্ঞান নেই সে বিষয়ে। আমি জানি এবং বুঝি। আপনি যে বিয়ে করবেন সমাঝোতা করতে পারবেন দুই স্ত্রীর? সমান অধিকার, সমান ভালোবাসা সব দিতে পারবেন? তাছাড়া প্রথম স্ত্রীর অনুমতির একটি ব্যাপার ও তো আছে।”
“সেটাই তো চাইছি।”
“যদি না দেয়?”
রাজন নাজনীনের হেয়ালি পছন্দ করছেনা। নড়েচড়ে বসলো। চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রাখলো। এ চায়ে বড় বিস্বাদ। মুখে দেওেয়া যায় না। অথচ এই চা সে বিগত দিনগুলোতে পরম আয়শে গিলতো। ভ্রু দ্বয় কুচকে বললো, “মানে?”
নাজনীন হাসলো। হাসলে মেয়েটির গালের একপাশে গর্ত তৈরি হয়। ভিষন সুন্দর লাগে তাকে। রাজন তার এ হাসি দেখলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। অথচ আজ একই মানুষটার মন তার জন্য পচে গিয়েছে। ভাবতেই নাজনীনের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আকাশ ভারি করে কাঁদতে মন চায়। অথচ সে হাসছে। রাজন যদি দেখতে এ হাসির আড়ালে কত দুঃখ, কষ্ট লুকায়িত। তাহলে কখনোই সে নাজনীন নামক সুন্দর মেয়েটিকে কষ্ট দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতো না। আজ রাজন শুধুই বোবা, বধির, অন্ধ।
নাজনীন নিজের অনুরক্তি আটকিয়ে কন্ঠে ব্যাকুলতা মিশিয়ে বলে উঠলো, “আমার তো ভিষন লোভ হয় রাজন। একটি সুন্দর সংসারের। আমাদের সংসারের আলো হয়ে আসবে আমাদের সন্তান। যাকে নিয়ে কেঁটে যাবে আমাদের দিন রাত। আমার যে বড্ড লোভ হয় আপনার সাথে বাঁচার। আমি যে আপনাকে কম ভালো বাসতে পারিনি। ভালো বাসতে গিয়ে আপনাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছি। অথচ আপনি অন্যজনাতে মত্ত।”
“আমি তোমাকে ছেড়ে দিব একথা কখন বললাম পাগলি? তুমি থাকবে। সঙ্গে সেও থাকবে।”
“কিন্তু, আমি সহ্য করতে পারব না। একই ঘরে আপনার বুকে অন্য কেউ মুখ লুকাবে এ আমি কিভাবে সহ্য করব? আমি বাঁচব কিভাবে রাজন?”
“সে আলাদা থাকবে। এবার খুশি? আশা করব এবার তোমার আপত্তি থাকবেনা।”
“আমার মোটেও সন্তুষ্ট নই। বাবা অনেক ভরসা করে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই দিন দেখার জন্য?”
“আমি কি তোমাকে মন্দ রেখেছি নাজনীন।?”
“ভালোই তো বাসেননি। সেখানে ভালো মন্দর প্রশ্ন তো পরে।”
রাজন সটান দাড়িয়ে পড়ে। এত প্যাচাল তার ভালো লাগছে। সে যে সোসাইটি মেন্টেন করে সেখানে বিয়ে বর্হিভূত সম্পর্ক দৃষ্টিকটু। প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে বিয়ে করাও বড় অন্যায় হিসাবে ধরা হয়। সে তো সমাজের বাইরে বাস করতে পারবেনা। চলতে ফিরতে এই সমাজের বিধীনিষেধের সম্মুখীন হতে হবে। তাই তো আগেভাগে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। নাহলে এসব সে তোয়াক্কা ই করে না।
“আমার যা বলার বলে দিয়েছি। সময় নাও। মনকে বোঝাও। স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখ। সেখবে সব ঠিক আছে। আর যদি ভালো না লাগে…”
বাকি কথা আর বলা হয় না রাজনের। চোখ চলে যায় নাজনীনের পানিভরা চোখে। মেয়েটি কাঁদছে। আটকে আসে কথা। ঠিক তখন টুংটাং আওয়াজে ফোনে ম্যাসেজ এসে পৌঁছে তার জানান দেয়। পকেট থেকে ফোন হাতরে ম্যাসেজ সিন করেই সে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হয়। যাওয়ার আগে শুধু বলে যায়, “রাতে ফিরব না।”
রাজন চলে যেতেই নাজনীন উঠে দাড়ায়। ফ্লাটের দরজা লক করে রুমে এসে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে মেয়েটি। কান্নায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনগুলোর কথা।
এইচএসসি দিয়ে নাজনীন তখন মনে মনে প্রস্তুত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু বাবা মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন পড়াশোনা পড়ে। ভালো পাত্র এসেছে। আগে বিয়ে। মা তার চিরকালই স্বামী অন্ত প্রাণ মহিলা। ছেলেমেয়ের চাওয়া সে কখনও মমতা ভরে দেখেননি। দেখেছেন শুধু স্বামীর আদেশ। একপ্রকার জোরপূর্বক বিয়ে হলো। পাবলিকে পড়ার শখ ঘুচলো। লোকাল একটি কলেজে বহু চেষ্টা সাধনায় রাজন তাকে ডিগ্রীতে ভর্তির অনুমতি দিলো। বাবাকে জানালে, তিনি বললেন জামাই যা চায় তাই হোক। তুমি চুপটি করে থাকবে। নালিশ যেন না আসে। বহু ইচ্ছে, আবদারের কোরবানি হতে লাগলো। কিন্তু একসাথে থাকতে গিয়ে কিভাবে যেন মেয়েটি ভালোবেসে ফেললো। বোধহয় একটু বেশিই। তাই তো এত পুড়ছে মনটা।
নাজনীন বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায় খোলা জালানার দিকে। আজ আকাশ ভরা তারকার মেলা। দিগন্তের এক কোনে রুপালি চাঁদ। নাজনীন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে পলকহীন দৃষ্টিতে। এ কেমন জীবন? বিড়বিড় করে আরশের অধিপতির নিকট প্রশ্ন রাখে, “রুপে, গুণে, বাধ্যতায় কোন কিছুতেই তাকে আমি আটকাতে পারিনি। সে আজ পরনারীতে মত্ত। আর কিভাবে পুরুষের মন গলে? ঠিক কোন পন্থায়?”
উত্তর মেলে না। নাজনীনের মনও মানে না। এ মুহূর্তে সে কি করবে বুঝেও উঠতে পারছেনা। জন্মদাতা পিতা-মাতার ওপর তার কোন ভরসা নেই। সুন্দর কোন ফয়সালা তারা কোনদিন করবেন না। কিন্তু এমন জীবনও সে চায় না। চুপচপ স্বভাবের মেয়ে হলেও ভিষন দৃঢ়চেতা মনোভাবের। ভেবেছিল এ জীবন সংসার আর ভালো বউ হয়েই কাঁটিয়ে দিবে। সে সংসার, স্বামী যদি একান্ত নিজের না থাকে তাহলে সেসব দিয়ে সে কি করবে? আদৌ তার প্রয়োজনে আসবে? না ছুড়ে ফেলে দিবে?
নাজনীন বাবার নাম্বারে কল দিলো। ওপাশ থেকে দুবার রিং হতেই কল ধরলো। খসখসে পুরুষালি কন্ঠস্বর। নাজনীন বাবাকে সর্বপ্রথম কোনরকম ভনিতা ছাড়ায় বলে ফেললো, “তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান বাবা। রাত বিরেতে অবশ্যই আপনার সঙ্গে মশকরা করার মত মেয়ে আমি নই। সে জানেন অবশ্যই। এখন আমার কি করণীয় আপনিই বলুন?
ইন শা আল্লাহ চলবে…….