সুখের আশায় চেয়ে থাকি পর্ব-১১

0
1

#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (১১)

দূর থেকেই নাজনীনের নজর কাড়ে রাজন পিয়ালি। ওদের দেখেও আপাতদৃষ্টিতে মেয়েটির মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। নাজনীন তখন নীলাভ পানির সমুদ্র ঢেউ দেখতে ব‍্যাস্ত। হঠাৎই এক দম্পতির দিকে নজর যায় । চেনা মুখ দেখা মাত্রই তার দৃষ্টি হয় স্তম্ভিত!

পরিবারের সকলের সাথে সমুদ্রবিলাস করতে এসেছিল নাজনীন। অপ্রত্যাশিত প্রতারণা, বিচ্ছেদে নামক ভারি ভারি বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখে সে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তো ভাইয়ের প্রস্তাবে নিরবে সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু, যদি জানতো এখানে এসে তাকে এসবের মুখাপেক্ষী হতে হবে, ভুলেও এ পথে পা বাড়াতো না। সদ‍্য নিজেকে গুছিয়ে ওঠা মনটা আবেগে টনটন করে উঠলো।

‘প্রাক্তন’ শুধু একটি শব্দ নয়। এটি যে মানুষটির নামের আগে বসে, তার সঙ্গে জুড়ে থাকে অপর মানুষটির ঘৃণা, না পাওয়ার বেদনা, মন ভাঙার প্রতারণা। আরও কত কী। রাজন নাজনীনের শুধু প্রাক্তন স্বামীই নয়। সেই সঙ্গে সে তার জীবনের দুটো বছর নষ্টকারী, প্রতারক, চরিত্রহীন, ঘৃণ্য মানুসিকতার একজন মানুষ। যার জন্য নাজনীনের মনে এক ফোটা আবেগ কাজ না করলেও, ফেলে আসা অতীতেরা স্মৃতি হয়ে যন্ত্রণা দেয়। মানুষটিকে দেখলে মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো। আবেগেরা আয়োজন করে দুঃখ দেয়। তবে নাজনীনের খারাপ লাগলো নিজের জন্য। ওদের মুখটা ওর জন্য ভিষন দুঃখের। ওরা পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুর মানুষ। দেখা মাত্রই চোখ সরিয়ে ফেলল। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে নড়ল না। দু হাত দূরে নাহিদ ফাহমিদার ফটো তুলে দিচ্ছে। বিচে আজমল শেখ আর মাইমুনা বেগম হ‍্যাট মাথায় আমব্রেলার ছায়ায় ডাব পান করছেন। চোখে আটা রোদ চশমা। মধ‍্য বয়স পেরিয়ে আশা দুজন মানব মানবিকে এ সাজেও চমৎকার লাগছে। মা বাবাকে দেখে নাজনীনের মন খুশি হয়ে ওঠে। কি সুন্দর জুটি। এই বয়সে এসেও কত সুন্দর দৃঢ় বন্ধন। নজর না লাগুক। মাশা আল্লাহ!

সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউয়ে নাজনীনের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে।।পায়ের পাতা ঢুবে আছে বালুর পাতলা স্তরের নিচে। হাওয়ার তালে উড়ে যেতে চাইছে গায়ের ওড়না। নাজনীন মাথায় ওড়না টেনে নেয়। পরনের হালকা নীল রঙের কুর্তিতে তাকে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখায়। এমন সময় নাহিদের কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

“বোনু, এদিকে তাকা। সুন্দর করে পোজ দে। আমি ছবি তুলছি।”

নাজনীন হেসে ব‍্যাস্ত হয়ে পড়ে ভাইয়ের মুঠোফোনের ক‍্যামেরার দিকে। ঠোঁটে অল্প হাসির রেখা ফুটতেই নাহিদ ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলে।

“নতুন নাগর জুটিয়েছে বোধহয়। ডিবোর্স হতে না হতেই, এরা পারেও বটে।”

নাজনীন ছবি দেখতে পা বাড়াতে নিলে কানে ভেসে আসে কিছু অপ্রত্যাশিত বাক‍্য। যা মুহুর্তেই মেয়েটির বুকটা এফোর ওফোর করে দিতে যথেষ্ট ছিলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলেও, চোখে পানি এলো না। কন্ঠস্বর তার চেনা। বাতাসের তীব্র গতিতে ফিসফিসিয়ে বলা কথাও ঠিকই তার কানে গেল। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কথার উৎস খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করলো পিয়ালিকে। পাশেই রাজন। পিয়ালিকে মিন মিন স্বরে কিছু একটা বলছে। তাতে পিয়ালি খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। নাজনীনের রাগান্বিত চেহারায় পিয়ালি আরেকটু ঘি ঢাললো।

“দেখছ না, নাগর নিয়ে ঘুরতেও এসেছে। তুমি হয়তো ভাবতে তোমার শোকে কাতর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ, দেখলে তো?”

হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পিয়ালির নাক বরাবর নারী দেহের সবটুকু শক্তি দিয়ে নাজনীন দিলো এক ঘুষি। নাক স্পর্শকাতর অঙ্গ। এক ঘুষিতেই রক্ত বেড়িয়ে গেল। পিয়ালি নাক ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। রাজন শুধু অবাক চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নাজনীন থেমে রইলো না। পিয়ালিকে হেচকা টানে পায়ের কাছে এনে ফেললো। ঠিক ভুল, উচিত, অনুচিত, ন‍্যায়, অন‍্যায় সব ভুলে সে পিয়ালিকে একের পর এক লাথিতে নাজেহাল করে ফেললো। নাজনীনের মেদহীন চিকনা শরীরের কাছে একেবারে ধরাসয়ি হয়ে পড়ে রইলো পিয়ালি। নাজনীন চুল ধরে দাড় করালো। মারের পর মার খেয়ে পিঠ টান করে দাড়াতেও পারছেনা পিয়ালি। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে রাজন কাছাকাছি থেকেও কিছু করতে পারলো না। কিছু বলতে গিয়েও নাহিদকে দেখে তখনই স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

নাজনীন রাগান্বিত কন্ঠে বলতে লাগলো, “কি বললি? আবার বল? আমি নতুন নাগর জুটিয়েছি? তোর মত নষ্টা নারী লোক আমি না। তুই পেট বাধিয়েছিস বলে সবাইকে তোর মত ভাবিস কোন সাহসে? নিজে একজন নারী হয়ে, আরেকজন নারীর সংসার ভাঙতে তোর বুকে কাপে না। তোদের ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহর ওয়াস্তে। এখানেও কেন আমার পিছু নিস? তোর মত বারো ভাতারির নিজের ভাইকেও নাগর মনে হয়। তোকে আমি আজ মে””রেই ফেলব। খা”””ন** কোথাকার। বে****, বেজন্ম”””””।”

ভাইবোন দুজনই গরম মেজাজের মানুষ। এ কথা রাজনের জানা। তবে তাদের পরম সম্মানের একজন হওয়ায় এ কথা শুধু শুনেই এসেছিল।আজ তার প্রতক্ষ‍্য দর্শনের সুযোগ হলো তার। নাহিদ, ফাহমিদা দৌড়ে নাজনীনের কাছে এলো। ওদের কানেও কথাগুলো পৌছেছিল। কিন্তু ওরা ভাবতেও পারেনি এসব কথা নাজনীনকে উদ্দেশ্য করা বলা হয়েছে।

জনসমাগম স্থানে এমন দৃশ্যে সবাই ছুটে আসে সেদিকে। নানান প্রশ্নে ঘিরে ধরে নাজনীন সহ রাজন পিয়ালিকেও। পিয়ালি আঘাতে কিছুই বলতে পারে না। রাজন নিজেকে বাঁচাতে নতুন করে ঝামেলা হওয়ার থেকে ঠেকাতে কিছু না বলেই পিয়ালিরকে স্থান ত‍্যাগ করলো।

নাহিদ নাজনীনের কাধে হাত রাখতেই নাজনীন ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি গড়াতে লাগলো। জীবন তাকে শুধুই আজলা ভরে দুঃখ দিচ্ছে। নিজেকে শক্ত করতে, মানিয়ে নিতে যে ডালটি ধরছে সেটিই ভেঙে পড়ছে। অপবাদে স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে হাত উঠিয়ে ফেলেছে। এতে যে সে খুব অনুতপ্ত তা নয়। কিন্তু জনবহুল স্থানে লোকের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে। সেই সঙ্গে পুরোনো দুঃখ তো আছেই।

বোনের হাত ধরে হোটেলে ফিরে এলো নাহিদ। বোনকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞাসা করলো না। শুধু বললো, “ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। আশপাশটা ঘুরে দেখব। কিছু আবর্জনার জন্য মুড নষ্ট করিস না।”

মাইমুনা বেগম এবং আজমল শেখ এসবের কিছুই জানেন না। তাদেরকে জানানো হয়নি। ওনারা ব‍্যাস্ত ছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে। ওনাদের মতই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছে আরেকটি পরিবার। ছেলে প্রমশন পেয়ে মা বাবা এবং বোনকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে।

পৃথিবী আধারে ছেয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তটা হয় চমৎকার। পশ্চিমাকাশে সূর্য ডুবে যাবার সময়টা চোখে পড়ার মত। চারপাশ তখন কমলা রঙের নরম আলোয় ছেয়ে থাকে। একটা নিরব নিস্তব্ধতা বিরাজ করে প্রকৃতিতে। গোধূলি লগ্ন যাকে বলে। নাজনীন মুগ্ধ চোখে সেসবই দেখছিল। একটু একটু করে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে চারিপাশ।

“নাজনীন! এদিকে এসো।”

মায়ের ডাক। মা সবসময় তুই করেই সম্বোধন করেন। কিন্তু অপরিচিত মানুষের সামনে তিনি আবার সন্তানদের এক্সট্রা আদর করে তুমি সম্বোধনটা করেন। এ নাজনীনের জানা। মায়ের ডাকে অদূরে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি তাদের দিকে এগিয়ে যায়। কাছে যেতেই মাইমুনা বেগম পরিচয় করিয়ে দেন, “এইযে আমার মেয়ে নাজনীন।”

“আপনার মেয়ে তো ভারি মিষ্টি!”

ওর মায়ের মতোই আরেকটি নারী কন্ঠ ভেসে এলো। নাজনীন কি বলবে ভেবে পেল না। মাইমুনা বেগম নতুন পরিচিত হওয়া পরিবারটির সাথে নাজনীনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

শ‍্যামবর্ণের এক সুঠাম দেহি পুরুষ অল্প সময়ের জন‍্য হলেও নাজনীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। চোখে চোখ পড়তেই নাজনীন দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। পরিচয় সূত্রে ছেলেটি ওই পরিবারটির একমাত্র ছেলে।

ঘুরতে এসে নতুন বান্ধবী পেয়ে মাইমুনা বেগম খুব খুশি। তিনি সংসারের গল্প খুলে বসেছেন। আজমল শেখও নতুন পরিচয় হওয়া টাক মাথার ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প জমিয়ে ফেলেছেন। চায়ের কাপে তাদের দারুণ গল্প জমে যাচ্ছে। নাহিদ ফাহমিদার হাত আকড়ে একটু দূরে সড়ে যায়। নতুন পরিচিত হওয়া পরিবারে বছর ষোলোর যে কিশোরী মেয়েটি, সে নাজনীনকে ভিষন পছন্দ করে ফেলে। আগ বাড়িয়ে বলে,”আমার তো কেউ নেই এখানে। আপু, আমি কি তোমার কাছে একটু দাড়াতে পারি।”

নাজনীন হেসে সম্মতি জানায়।

“এসো না। নাম কি তোমার?”

মেয়েটি খুশি হয়। এ বয়সের মেয়েরা অল্পতেই মানুষকে আপন ভেবে ফেলে। এইযে নাজনীনের বলা ছোট ছোট দুইটি বাক‍্যে তাকে পছন্দ করে ফেললো।

সবাই যখন নিজের মত সঙ্গী পেয়ে গল্প জুড়ে বসেছে। ঠিক সেখানেই একজন সঙ্গীহীন হয়ে দাড়িয়ে রই কিছুক্ষণ। নিজের মা বাবা এবং ছোটবোন হাতছাড়া হওয়ায় ছেলেটি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। নাহিদ হয়তো সঙ্গ দিতে পারতো, যদি তার বউ না থাকতো। সবার মাঝে পাত্তা না পেয়ে ছেলেটি যখন স্থান ত‍্যাগ করতে পা বাড়াতে নিলো। ঠিক তখন রুকাইয়া নামের কিশোরী মেয়েটি ভাইকে ডেকে বলে ওঠে, ”ভাইয়া! তুমি আমাদের সাথে গল্প করো না। আপুটা খুব ভালো। তোমাকেও আমাদের দলে নিব। কি বলো আপু?”

মেয়েটি যতটা অবুঝ। নাজনীন ততটাই বুঝবতী। সে উত্তর সাজিয়ে উঠতে পারলো না। জবাবে কিছুই বলতে পারলো না। কিন্তু নাজনীনের জবাবের অপেক্ষা না করেই ছেলেটি বললো, “তোমরা গল্প করো। আমি কাছেই আছি। কিছু লাগলে ডাক দিও।”

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি