#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (১৫)
তখন বর্ষাকাল। পরপর দুটো বছর কেঁটে গিয়েছে। আকাশ কাঁপিয়ে ভারি বর্ষণের দিনগুলোতে জীবনে নতুন শুরুর শুভক্ষণ নির্ধারণ করা হলো। গাছগাছালি বৃষ্টির পানি পেয়ে নতুন করে সজীব হতে শুরু করেছে। আসমান থেকে মেঘেদের ঘর্ষণে প্রকৃতিতে তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। ঘন আধারিতেও চারিপাশ অল্প সময়ের জন্য আলোকিত হয়ে ওঠে। সেই আলোর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয় এক দ্বিধাগ্রস্ত রমনী। জীবনের ছন্দ তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে যাবে? নাকি ছন্দের পতন ঘটিয়ে নতুন ছন্দের আর্বিভাব ঘটাবে? কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
পাতার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়লে যেমন কেঁপে ওঠে। তেমনই ফোনের মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশন বেজে ওঠার শব্দ কানে যেতেই কেঁপে ওঠে নাজনীন। নিশ্চয় ওই মানুষটির ম্যাসেজ! মনে হতেই লজ্জায়, অস্বস্তিতে নুয়ে পড়ে মেয়েটি। পাগল ছেলেটি দুই বছরেও তার পিছু ছাড়লো না। নাজনীন জানালা থেকে সরে আসে। ফোন হাতে নেয়।
শীঘ্রই তাদের বিয়ে হতে চলেছে। শ্রাবণের মাঝামাঝিতে বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দু পক্ষের আলাপ আলোচনা হয়েছে। দুই পরিবার মিলে সব আয়োজন এই বৃষ্টিমুখর পরিবেশেই সেরে ফেলবেন।
নাজনীনের মনে এখনো ছবির মত স্পষ্ট ভেসে ওঠে প্রথম পরিচয় হবার সময়। মানুষটার সাথে দেখা হলো। কিন্তু কথা হলো না। চেনা জানা কিছুই হলো না। সে তখন ভাঙা মন নিয়ে নিজেকে জোড়াবার চেষ্টায় নিজেকে নিয়ে বড্ড বেশি মগ্ন। তার প্রতি অন্যকারো মুগ্ধ দৃষ্টি মেয়েটির নজর কাড়তে পারেনি। সেই সমুদ্রপাড়ে পরিচয় হওয়া পরিবার থেকে আসা হঠাৎ বিবাহ প্রস্তাব, ভাবির বুদ্ধিতে মায়ের সে প্রস্তাব নাকচ করা, কুরিয়ারে তার নামে পার্সেল আসা। সবই তো হলো পরপর, হঠাৎ, হঠাৎ! সেসব ফেলে এসেছে আরও দুই বছর আগে। স্নাতক শেষ হয়েছে। মাস্টার্সে সবে ভর্তি হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। চেহারায় ভারিক্কি ভাব, ব্যবহারের কখনও কাঠিন্যতা, কখনও বা নরম সরল। কিছুদিন একটি কিন্টার গার্ডেনে চাকরি করেছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে, এ জীবনে ধৈর্য নামক গুণটি আয়ত্ব করা খুবই জরুরী। নচেৎ মাথা খারাপ পাগল হওয়া ছাড়া গতি নেই।
তবে রুমানের সাথে তার মৌখিক আলাপ হয়নি। আর না হয়েছে ফোনালাপ। পার্সেল থেকে ফেসবুক বন্ধু অব্দি গড়িয়েছে। মেসেঞ্জারে ছেলেটির কালেভদ্রে ম্যাসেজ আসে। কিন্তু ভয়েসে কথা বলা হয়ে ওঠে না। এ পাশের যুবতী মেয়েটি সে আস্কারা রোমান নামের যুবগ ছেলেটিকে কখনও দেয় না। আর না রোমান সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সে তো কেবল সময় গুনতে থাকে। আর কতদিন হলে মনের মধ্যে যত্ন করে রাখা প্রিয়তমা তার বুকের সাথে লেপ্টে থাকবে!
এবার অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। রোমানের মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা ভালোবাসাগুলো ডালপালা গজিয়ে বিরাট মহিরুহে রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে নাজনীন মেয়েটি পড়ে রয় দ্বিধা দন্দের বেড়াজালে। জীবনে যে পুরুষকে মনে, শরীরে ঠাই দিয়েছিল, সেই পুরুষ তাকে নির্মমভাবে ঠকিয়েছে। তৃতীয় ব্যাক্তির আবির্ভাব ঘটিয়ে বুঝিয়েছিল, তুমি আমার কেউ নও। তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই। জীবনে এত বড় প্রতারণার স্বীকার হওয়া মেয়েটির অন্য পুরুষকে নিজের জীবনে জড়াতে জড়তা থাকবেই। ভয়ে, ভীতিতে আড়ষ্টতা আসবেই। ঠকার যন্ত্রণা সেই জানে, যে ঠকেছে। মনের কষ্ট, দহন মন ছাড়িয়ে মস্তিষ্ক, সমস্ত শরীরের ছেয়ে যায়। তীব্র থেকে তীব্রতর হয় সে কষ্ট। সেই কষ্ট জীবনে দ্বিতীয়বার নাজনীন কখনও চাইবে না। তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও চাইতো না। তাইতো অপেক্ষা নামক আগুনে রোমানকে পুড়িয়ে আসল সোনা কিনা যাচাই করতে চাইছে। দুই বছরে ছেলেটির একগুয়েমি, ভদ্রতা, নম্রতায়, ভালোবেসে অপরপক্ষ্যের কোনরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়েও পাগলের মত ভালোবাসা নাজনীনের হৃদয় ছুয়েছে। তাই তো পরিণয়ে সম্মতি জানিয়েছে নিরবে। এখন দেখার পালা পাগল ছেলেটি তাকে কতটুকু ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে!
ম্যাসেজে রোমান লিখেছে, “স্নিগ্ধতা, কোন রঙের পোশাক পড়বেন বিয়েতে?”
নাজনীন ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে একটু সময় নিলো। গালে আঙুল ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো। মিনিট খানিক পরে মনে কাঙ্খীত উত্তর আসতেই জবাব দিলো, “সাদা।”
ওপাশের মানুষটা হয়তো কিঞ্চিত অবাক হলো। সাদা কোন বিয়ের পোশাক হতে পারে? তবুও নিজের অবাকতা নিজের কাছে রেখে পুনরায় ম্যাসেজ করলো, “শাড়ি, ল্যাহেঙ্গা না গাউন?”
এবারে নাজীনের জবাব দিতে সময় লাগলো না, “শাড়ি।”
ওপাশ থেকে ম্যাসেজ এলো, “একটা প্রশ্ন করতে পারি স্নিগ্ধতা?”
“নিশ্চয়।”
“বিয়ের শাড়ি সাদা ই কেন? অন্য রঙ কেন নয়। যাস্ট কৌতূহল থেকে জানতে চাওয়া।”
“মেঘেদের রঙ সাদা। বর্ষার কদম সাদা। বর্ষার বৃষ্টি সাদা। আমার মনে হয় যে মানুষটিকে জীবনে জড়াতে চলেছি তার মনটাও সাদা। তাহলে সাদা রঙ কেন নির্বাচন করব না?”
“স্নিগ্ধতা, আপনি জানেন কী? যার মন সুন্দর, কেবল সেই অন্যের মনকে সাদা আখ্যায়িত করতে পারে। আপনাকে আরও একটি কথা জানিয়ে রাখি, সাদা রঙ আমার ভীষণ পছন্দের। এভাবে মিলে যাবে ভাবিনি।”
“মিলে যাওয়ার জন্য তাহলে আমাকে ধন্যবাদ জানান।”
“ধন্যবাদ তো আপনাকে সবসময় জানাতেই হয় মিস। আমাকে এতটা সহ্য করার জন্য। বাকিটা জীবন আপনার পাশে থাকার সম্মতি জানানোর জন্য। আর কত কির জন্য যে জানাতে ইচ্ছে হয়।”
পাগল লোকটার পাগলাটে অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নীজনীনকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তোলে। মুখে লেপ্টে থাকে নিঃশব্দ লাজুক হাসি।
অন্যদিকে রাজনের জীবনে চলছে ঘোর অমানিশার প্রহর। স্ত্রী নিয়ে গ্রামের চাষাভূসার কাজ করে দিনাতিপাত করছে। সকালে একটু গুড় আর এক মুঠ মুড়ি খেয়ে কাধে কোদাল চাপিয়ে মাঠে যায়। মাথার ওপর রোদ উঠে আসতেই পিয়ালি স্টিলের থালায় ভাত, তরকারি বেড়ে ওপরে আরেকটি থালা দিয়ে ঢেকে গামছা দিয়ে বেধে নিয়ে যায়। মাঠের আইলের সবুজ ঘাসের ওপর বসে দিন মজুরের মত সে খাবার গাপুসগুপুস গিলে রাজন।
তাদের এ অবস্থা একদিনে হয়নি। ভেতরে ঘটে গিয়েছে অনেক কাহিনী। পায়ের হওয়া ক্ষত নিয়ে বহু ভুগতে হয়েছে। ভাগ্য সহায় না হলে অল্প আঘাতেও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। রাজনকে দেওেয়া পিয়ালির সেই পায়ের আঘাতে হওয়া ক্ষতর যন্ত্রণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। উন্নত চিকিৎসা, ওষুধপত্র, ভেষজগুণ সমৃদ্ধ ওষুধ। কোনটাই তার ক্ষত নিরাময়ে কাজে আসেনি। দিনের পর দিন অফিস কামাইয়ে একসময় চাকরিটা হাতছাড়া হয়। হাতে টাকা পয়সা যা ছিল সে বছর খেয়ে পড়ে দিব্যি চলেছিল। এরপর নিজেদের পেটের দায়ে, বাসা ভাড়া বাবদ বিরাট অংকের ঋণ জমলো। দূর্গন্ধে অতিষ্ট হলেও বাসা আর বদলাতে পারেনি। পরবর্তীতে বড় বাসার ভাড়া ঠিকঠাক পরিশোধ না করতে পারায় ছোট্ট টিনসেডের খুপচি ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। বাসার সব জিনিসপত্র বিক্রি করতে করতে ঠেকেছিল শুধুমাত্র একটি তোষক আর কিছু হাড়ি, বাসনকোসন। পায়ের ক্ষতে একসময় পোকা ধরে গেল। পোকারা কিলবিল করত পায়ের মধ্যে। দুটো আঙুল কেটে বাদ দিতে হয়েছে। পাওনাদাররা রোজ বাড়ি বয়ে কথা শুনিয়ে যেত। হুমকি দিত, পয়সা পরিশোধ না করলে জেলে পুড়বে। এরমধ্যে বোঝার ওপর শাকের আটি হয়ে নেমে আসে আরেক দুঃসংবাদ। পিয়ালি কখনও মা হতে পারবেনা। তার সন্তান ধারণের সেই নারীটিই তো নেই। এ্যাবোর্শন করার সময় নারীটি কেটে ফেলা হয়েছিল। এ সংবাদ রাজনকে একেবারে নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল। শারীরিক মানসিক উভয় দিক থেকেই সে ভেঙ্গে পড়লো। সিদ্ধান্ত নিল, শহুরে জীবন ছেড়ে শেষ ভরসা হিসাবে গ্রামে ফিরবে।পিয়ালিকে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, “তোমাকে বিয়ের মোহরানা দিয়ে ছাড়ানোর দিন আমার নাই। আমি নিজেই পথের ফকির। তোমার পথ তুমি দেখ নাও। যে কটা দিন আয়ু আছে মা ভাইদের পায়ের তলায় কাটিয়ে দিতে চাই। ওরা লাথি দিয়ে ফেলতে চাইলেও আঙুল ধরে ঝুলে থাকবো। রাজন কে অবাক করে দিয়ে পিয়ালি থেকে গেল। তাকে ছাড়লো না। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ির পথ ধরে।
মা হলে হরেক যন্ত্রণা। মা ভালোটা সন্তানটাকে যেমন বুকে আগলে রাখে। তেমনই খারাপটাকেও পায়ে ফেলতে পারে না। আমতা আমতা করে মায়ের কাছে ঠাই হলো তাদের। ভাইয়ের নিরব রইলো। তার আগমনে তাদের মধ্যে কোন হেলদোল দেখা গেল না। ভাইয়ের বউয়ের মুখ ঝামটা দিয়ে পিছন দেখিয়ে চলে গেল।
তারপর থেকেই শুরু হয় রাজনের ভরাক্রান্ত হৃদয়ের যাত্রা।সেই সঙ্গে পেটে দু মুঠো ভাত দেওয়ার জন্য অসুস্থ শরীরে সকাল সন্ধা সংগ্রাম।
গ্রামবাসিরা কেউই ভালো চোখে দেখে না তাদের। প্রথমে আড়ালে আবডালে কানাকানি হলেও এখন মুখের ওপর ছোট করে কথা বলতেও বাধে না তাদের। তাদের অভাবগ্রস্ত জীবন, অসুখে জর্জরিত শরীর কারো মনে তাদের জন্য সহমর্মিতা জন্মে না। মুখ বাকিয়ে লোকে বলে, “ঠিকই আছে। যখন শক্তি আছিলো, ভালা বউডা ছাইড়া আরেক বেডি ধরছে। মানুষরে দুঃখ দিলে এমনই হয়। ওর আরও খারাপ হওয়া উচিত। এসব কথা ঠিকই রাজন পিয়ালির কানে আসে। তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রয় নিরব, নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে। আল্লাহর দেওেয়া বিচারের এক চুল ছাড় হয় না। এ বোধদ্বয় তাদের ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে তোলে।
ফসলে দেওেয়া কিটনাশকের বোতলটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে রাজন। কোনদিন হয়তো এর স্বাদ মুখে গ্রহন করবে। পিয়ালির আশার শব্দ পেয়ে লুকিয়ে ফেলে মাটির ভারে।
____________________________
দিনের শুরুতে নরম রোদের আনাগোনা দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে উজ্জ্বলতা বাড়ার পরিবর্তে আকাশ কালো হতে শুরু করলো। নাজনীন মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ওঠে, “শ্রাবন দিনের বিয়েতে বৃষ্টিরা না নামলে হয়? ওরাও যে বিশেষ নিমন্ত্রিত অতিথি।
জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদেই তাদের বিয়েটি হলো। বিয়ের শেষে ইমাম সাহেবের খুতবা ও খেজুর বিতরণের মধ্যে দিয়ে বিয়ের একপাক্ষিক কাজ শেষ হলো। কবুল বলার সময়ে, রুমান একবার দুবার নয় বারবার কবুল শব্দটি উচ্চারণ করে ফেললো। হাসির হুল্লোড় পড়লো তাতে।
কান্নার নোনাপানির সাথে কবুল উচ্চারিত হলো নাজনীনের কন্ঠনালি দিয়ে। কাঁপা হাতে সই করলো রেজিস্ট্রি খাতায়। জীবনকে জড়ালো আরেকটি মানুষের সাথে। দ্বিতীয়বার জীবনের নতুন শুরু হলো।
দু হাত ভর্তি মেহেদী আর সাদা রঙের সুন্দর শাড়িতে নাজনীনকে রূপকথার কোন এক অপরূপা রাজকন্যার মতো লাগছে। মাথার সাদা দোপাট্টায় সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে রুমের দেয়ালগুলোতে।
বিয়ের কাজ সমাধা হতেই, বর কনেকে একত্র করা হলো। সাদা রঙের পাঞ্জাবীতে রোমানের সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত। ছেলেটিকে ভিষন স্নিগ্ধ লাগছে। পাশাপাশি দুটো মানুষ। নতুন জীবন যাদের শুরু হলো শুধুই তাদের ঘিরে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বললো না। রুমান নিঃশব্দে নাজনীনের একটি হাত শুধু মুঠোয় বন্দি করলো।
মাইমুনা বেগম আজ মহা ব্যাস্ত। মূলত, কান্না লুকাতে তিনি ব্যাস্ততার ভান করছেন। চোখ ঘুরিয়ে মেয়ে এবং জামাইকে দেখছেন। আর মনে মনে দোয়া করছেন, “এবার যেন মেয়েটি সুখী হয়।”
বিদায় বেলাটা ছেলেপক্ষের যতটা আনন্দের। মেয়ে এবং মেয়ে পক্ষের তেমনই কষ্টের, যন্ত্রণার। রোমানের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। অন্যদিকে নাজনীনের চোখ ভর্তি পানি।
ভাইয়ের এক বছরের মেয়েটি ঝাপিয়ে ফুফুর কোলে উঠে পড়লো। ভারি সাজ পোশাকেও নাজনীন তাকে জড়িয়ে ধরলো। বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ।
মা, বাবা, ভাই, ভাবির সাথে আলিঙ্গন, ভরসা বাক্যর মধ্য দিয়ে রোমান বউ নিয়ে উঠলো গাড়িতে। গাড়ির চাকাগুলো সচল হতেই নাজনীন খোলা জানালায় মুখ বাড়িয়ে পিছন ঘুরে তাকায়। পিছে চোখভরা পানি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার স্বজনেরা।
সাদা রঙের একটি দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামে। রোমানের হাত ধরে শশুরের ভিটায় পা পড়ে নাজনীনের। রুকাইয়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের নামে অভিযোগ করে বললো, “শুধুমাত্র বৃষ্টির জন্য মা আমায় যেতে দিলো না। কোন মানে হয় বলো মিষ্টি ভাবি?”
“মিষ্টি ভাবি” ডাকটা কানে পৌছাতেই নাজনীনের মনটা ভালোলাগার আবেশে ছেয়ে উঠলো। এক হাত বাড়িয়ে রুকাইয়াকে কাছে টেনে নিলো।
বৃষ্টির দিনে বাড়িতে একটু কাদা জড়াবেই। তার ওপর সেটা যদি হয় বিয়ে বাড়ি! কিন্তু নাজনীনের সদ্য হওয়া শাশুড়ি মা ভীষণ খুতখুতে স্বভাবের মানুষ। তাই সাদা টাইলসে কাদার ছাপ পড়তে না পড়তেই এক নারী মুখ সেটি বারবার পরিষ্কার করে চলেছেন। অন্যদিকে কিচেন থেকে ভেসে আসছে খাবারের ঘ্রাণ। বাড়ির ভেতরের আশপাশটাও সাদা নকল ফুলে সেজে উঠেছে। বউমাকে দেখে শাশুড়িমা জড়িয়ে ধরলেন। আসতে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। নাজনীন নম্রতার সাথে উত্তর দিলো। শাশুড়ি, বউমা কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। এরপর একে একে আত্মীয়স্বজনের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলল নাজনীন।
রুমানের সাথে নাজনীনের দেখা হলো বাসর ঘরে। হলুদ সাদা মোমবাতি আর ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে বাসর ঘর। তার মধ্যে সাদা জামদানি গায়ে জড়িয়ে হাটু ভাজ করে বসে আছে এক মানব পুতুল। সাদা বর্ণে সাদা শাড়ি, হালকা কাজের সোনার গহনায় সেজে উঠেছে এক অপূর্ব নারী মুখ। মুখে কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। আপাদমস্তক প্রাকৃতিক সুন্দরী।
রোমান নব বিবাহিত স্ত্রীকে দেখে সম্মোহনী চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। ঘোর কাটতেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নাজনীনের কাছে। হাত ধরে হাটা ধরলো ছাদের দিকে। নাজনীন পুতুলের মত পিছন চলে।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির তালে রুমুঝুমু শব্দ তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে রোমানের পায়ের তালে তাল মিলিয়ে হাঁটছে তার নববধূ।
এ বাড়ির ছাদে একটি ছোট রুম আছে। যেটা রোমান বড় হবার পর থেকে নিজের ব্যাক্তিগত লাইব্রেরি ও অবসর জ্ঞাপনের স্থান হিসাবে ব্যবহার করে আসছে। রোমান নাজনীনকে নিয়ে সেখানে গেল না। রাতের খোলা ছাদে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে নববধূকে নিয়ে দাড়াল রেলিং ধরে। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির ফোটার তালে হালকা কেঁপে উঠছে নাজনীন। রোমান নাজনীনের হাত ছেড়ে তার দিকে ঘোরায়। সময় ব্যায় না করেই নাজনীনের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। নাজনীনের দিকে একগুচ্ছ কদমফুলের তোরা ধরে বলতে শুরু করে, “এই কদম ফোটা ঘন বরষার নিঝুম রাত সাক্ষী রেখে বলতে চাই, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতে চাই। তোমার প্রতি হওয়া মুগ্ধতা, মায়াকে প্রতি মুহুর্তে বাড়াতে চাই। তোমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখতে চাই। তোমার হাতদুটো আজীবন শক্ত করে ধরে রাখতে চাই। হুটহাট তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই। আমার এই এত এত চাওয়াকে কি পূর্ণতা দেওেয়া যায় মিস রোমান সিকদার?”
এত মোহনীয় আবেগমাখা আবদার। এ আদুরে ভালোবাসা মাখা আবদার কি নাজনীনের প্রতাখ্যানের সাহস আছে? না আদৌ সম্ভব? নাজনীনের চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে। এ কান্না দুঃখের নয়। তীব্র সুখের। হাত বাড়িয়ে কদমগুচ্ছ রোমানের থেকে নিয়ে তাকে দাড়াতে বললো। রোমানের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো, “আপনার আবদার প্রত্যাখানে সাধ্য আমার নেই। আমি কি সুখের আশায় চেয়ে থাকতে পারি আপনার দিকে?”
রোমান নাজনীনের মুখের চোখ বেয়ে পড়া পানি ও বৃষ্টির পানির স্রোত দু হাতে মুছে দিয়ে বললো, “নিশ্চয় আমার প্রিয়তমা। আমার সুখও তাতে। যেখানে তুমি সুখি। আমিও যে তোমার দিকে তাকিয়ে রই সুখের আশায়।”
এরপরের ঘটনাটা উষ্ণ। দুজন দুজনার খুব কাছাকাছি আসে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়।
হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ছাদের এক কোনায় টিমটিমে জ্বলা লাইটটাও নিভে গেল। প্রগাঢ় আধারে তলিয়ে গেল ভিজতে থাকা দুজন নর নারী। প্রকৃতি তাদের একান্ত কিছু সময় উপহার দিতে চাই। যে সময়ের সাক্ষী কেউ না হোক। শুধুই দুজন দুজনার।
_________________সমাপ্ত____________
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি