#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৩)
রাজন রাতে বাসায় ফিরলো। সে যে বিকালে আসবে বলে কথা দিয়েছিল কিন্তু ফিরলো রাত করে এ বিষয়ে নাজনীন তাকে কিছুই বললো না। অথচ ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার, চেচামেচি করার কথা ছিল। হওয়ার কথা ছিল তর্ক যুদ্ধ। অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখার কথা ছিল। নাজনীন রইলো দীঘির টলটলে পানির মত শান্ত, স্থির।
রাতে খেতে বসে মুখোমুখি হলো দুজন। রাজন মুখ খুললো তখন। নাজনীনকে জিজ্ঞাসা করলো, “ওই বিষয়ে কিছু ভেবেছো?”
নাজনীন রাজনের চোখে চোখ রেখে প্রতিত্তোরে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কোন বিষয়ে?”
“হেয়ালি করছো কেন? জানো না কোন বিষয়ের কথা বলছি?”
“না।”
রাজনের মেজাজ দুপুর থেকেই উত্তপ্ত। সেই গরম মেজাজে যেন ঘি ঢাললো নাজনীনের ‘না’ শব্দটি। রাজন চোখ রাঙিয়ে তাকায় নাজনীনের দিকে।
“চোখ নামিয়ে। আমি এমন কিছু করিনি যার জন্য আপনার চোখ রাঙানো সহ্য করতে হবে। আপনি আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিতে যাবেন না। নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়বেন।”
“তাহলে সোজাসুজি উত্তর দিতে পারো না?”
“না, পারি না। আপনি যা শুরু করেছেন তাতে আপনার দুটো মুখ যে পায়ের স্যান্ডেলের আদর থেকে রেহাই পাচ্ছে তাতেই শুকরিয়া আদায় করুন।”
রাজন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। নাজনীন বড্ড বেড়েছে। চিৎকার করে ওঠে, “নাজনীন!”
নাজনীন মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো, “একদম চিৎকার নয়। আমি এসব পছন্দ করি না। আপনার সাথে খাওয়া শেষে কথা হবে। এখন বিরক্ত করবেন না। খাওয়ার সময় অহেতুক কথাবার্তা ঠিক নয়।”
নাজনীনের এই অতিরিক্ত কুল স্বভাবটা রাজনের খটকা লাগে। গতরাত থেকে ওর করা কর্মকাণ্ডে অন্য মেয়ে হলে হুলস্থুল পড়ে যেতো। অথচ এই মেয়ে একদম নিরব। তার উচ্চবাচ্যে ও শান্ত রয়েছে। এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে রাজনের ক্ষুদা ম”রে গেল। সে আর খেতে পারলো না। বেসিংয়ে গিয়ে হাত ধুয়ে সোজা শোবার রুমে চলে গেল। বসে বসে নাজনীনের ফেরার অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো।
নাজনীন ফিরলো মিনিট দশেক পরে। এতেই যেন অধৈর্য হয়ে পড়লো রাজন।
কিন্তু, কথার শুরুটা হলো নাজনীনকে দিয়ে। বলা শুরু করলো, “আমি কী দেখতে অসুন্দর রাজন? স্ত্রী হিসাবে আপনার অযত্ন করেছি কখনও? আপনার কষ্ট হবে ভেবে আমার বাবার বাড়িতে গিয়ে দুটো দিন থাকিনি পযর্ন্ত। আপনার সংসারে আসা পর্যন্ত আমাকে বহু আদেশ নিষেধের মধ্যে রেখেছেন। কখনও সেসব নিয়ে ঝামেলা করেছি? প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।”
একের পর প্রশ্ন বাক্য ছুড়ে রাজনের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো নাজনীন।
কিন্তু রাজন উত্তর সাজিয়ে উঠতে পারলো না। অগ্যতা সে চুপ রইলো। কিন্তু নাজনীন তাকে প্রশ্ন করেই চলেছে।
“চুপ করে থাকবেন না। আমার জবাব চাই রাজন। ঠিক কোন কারণে আপনি আবার বিয়ে করতে চাইছেন?”
রাজন এবারও চুপ। সে তো আর বলতে পারে না, আমি ফ্রিতে মজা লুটতে গিয়ে ফেসে গিয়েছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে রাজন মুখ খুললো, “দেখ নাজনীন। কথায় কথা বাড়ে। তুমি ভেবে দেখ, আমি চাইলেই তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু, করিনি আমি সেটা। তোমার মতামত নিয়ে সুন্দর ভাবে আরেকটা জীবনের শুরু করতে চেয়েছি। তোমার অধিকার ক্ষুণ্ন করতে চাইনি। এতে আমার দোষটা কোথায় বলো?”
রাজনের অবান্তর, স্বার্থপর যুক্তিতে নাজনীন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে মেয়েটি চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে বুকে। ভিজিয়ে দেয় পরণের জামার একটু অংশ। হাসি থামিয়ে নাজনীন রাজনকে শুধায়, “আমার বুকে ছুড়ি চালাতে আমার মতামত চাইছেন? কখনও শুনেছেন নিজেকে আঘাত করতে কোন ব্যাক্তি অনুমতি দিয়েছে? তাহলে আমার কাছে কোন বুদ্ধিতে মতামত চান? আমাকে ভালো না লাগলে সোজাসুজি বলে দিবেন। আমি সরে যাব। কিন্তু আমাকে বর্তমান রেখে আরেকজনকে ঘরে তুলে আমার জীবনকে জাহান্নাম বানাতে চাওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? কোন সাহসে আমার সামনে এসব কথা বলেন?”
রাজন বাক হারা। নাজনীনের যুক্তির কাছে সে কুপোকাত। কিন্তু তাকে যে পিয়ালিকে বিয়ে করতেই হবে। নাহলে এ জীবনে সে চিরতরে হারাবে বেঁচে থাকার অধিকার।
রাজন কিছু বলার আগে নাজনীন আবারও বলতে শুরু করলো, “একটি সম্পর্কে যখন বিষ বাষ্প ঢোকে তখন সেটি আর ভালো থাকে না। আপনার মনে পচন ধরেছে। ভালো মন্দের তফাৎ নজরে পড়ছেনা। আপনার দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মতি দিয়ে নিজের জীবনকে বিষাক্ত করার মত নির্বোধ বোকা মেয়েটি আমি অন্তত নই। আমি নরম বলে কঠিন হতে পারব না এ আপনি ভাববেন না। সরল তাই জটিল পথে হাঁটতে পারি না এ ও ভাববেন না। কোনো টক্সিক রিলেশনে থাকার চেয়ে নিঃশঙ্গ থাকাই শ্রেয়। রাতটুকু সহ্য করুন। ভোরের আলো ফুটুক। আমি এ সংসার ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিব। তখন আপনি একটা কেন দশটা বিয়ে করলেও আমার কিছু এসে যাবে না।”
রাজন কিছু বলার আগেই নাজনীন নিজের কথা শেষ করে পাশের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
রাজন ওভাবেই কিছুক্ষণ বসে রইলো। মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। বিড়বিড় করে বললো, “যাক বাবা। বাঁচা গেল। ঝামেলা যদি নিজ থেকে বিদায় নেয়, খারাপ কী তাতে!”
রাজন চতুর প্রজাতির পুরুষ। তার মস্তিষ্ক বলে, “নাজনীনকে তোর হাত ছাড়া করা উচিত হবে না। অমন রূপে, গুণে, আনুগত্যে একশোতে নিরানব্বই দেওেয়া মেয়েটিকে হারিয়ে ফেললে কোথায় পাবি? কিন্তু, মন বলে অন্য কথা। পরিস্থিতি তার অনুকুলে নেই। দিশেহারা বোধ করে রাজন। ক্রমেই অসহনীয় যন্ত্রণার দিকে এগোতে থাকে সে। যেখান থেকে তাকে উদ্ধার করার মত কেউ নেই।
পিয়ালির সাথে রাজনের সম্পর্ক চাকরিসূত্রেই। ডেস্কে ফাইল আনা নেওয়া, মাঝেমধ্যে সুস্বাদু খাবার এনে খাওয়ানো, বুকের খাজ, কোমরের বাক দেখিয়ে একপ্রকার পটিয়ে ফেলেছিল রাজনকে। শুরুতে রাজন পিয়ালিকে মজা হিসাবে নিয়েছে। হাসি তামাশা থেকে ধীরে ধীরে তার ঘোর বাড়তে থাকে। অন্যদিকে পিয়ালিও যেন এটাই চাইছিলো। সে আশকারা দিতে থাকে রাজনকে। রাজন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। আজ কফি শপে যায়। তো কাল রেস্টুরেন্টে। অন্যদিন শপিংয়ে। শেষমেশ সেটা গিয়ে থামলো বিছানায়।
যে নারীর প্রতি কোন রকম দায়বদ্ধতা নেই। যাকে চাইলেই পাওয়া যায়। আবার ছেড়ে দিতেও ঝামেলা পোহাতে হয় না। সেই নারীর শরীরের প্রতি কিছু পুরুষের অসীম লোভ। এ লোভ তারা ছাড়তে পারে না। কিন্তু কোনরকম দায়বদ্ধতা না থাকলেও একদিন পিয়ালির একটি টেস্টে ধরা পড়ে অপ্রত্যাশিত কিছু। ঝামেলা মনে করে মিটিয়ে ফেলতে চাইলেও পিয়ালি নারাজ। রাজন যতই পিছিয়ে যেতে চায় পিয়ালি যেন অক্টোপাস হয়ে ততই তাকে পেচিয়ে ধরে। সেই সঙ্গে তাদের আদিম খেলায় মেতে ওঠার উত্তেজনাকর মুহুর্তের সাক্ষী স্বরুপ ভিডিও ফুটেজ। ব্যাস আর পালাবে কোথায় রাজন?
রাজন পড়েছে উভয় সংকটে। নাজনীন তার এহেন অশ্লীলতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। চাইলেই পিয়ালিকে সে ছেড়ে আসতে পারে। তার সুখের সংসার সুখেরই থাকবে। কিন্তু পিয়ালি তাকে এত সহজে ছাড়বে কেন? নাজনীনকে অবশ্য ছেড়ে দেওয়ায় যায়। তাহলে বিকল্প হিসাবে পিয়ালিকে পেল। সম্মান বাঁচলো।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, নাজনীন কী সব জেনেও রাজনের ঘর করতো? যে মেয়ে স্বামীর অবহেলা মানতে পারে, দ্বিতীয় বিয়ে মানতে পারে না। সে কিভাবে এহেন অনাচার সহ্য করে সংসার করতো?
________________________
বদ্ধ ঘরে বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে নাজনীন। যার দিকে সুখের আশায় তাকি থাকে। সেই তার দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ায়। সাজানো সংসারে আজ সে কেউ না। সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে রাজনের জীবনে সে কিছুই নয়। তার জন্য লোকটির মনে কোন অনুভূতি নেই।
একটি সম্পর্ক ভাঙা যত সহজ। গড়া যেন ততই কঠিন। নাজনীন চেয়েছিল সম্পর্কটা অটুট থাকুক। তাইতো ধৈর্যের সাথে এতটা সময় রাজনকে বুঝিয়েছে। তার অবহেলায়, কথা দিয়ে কথা না রাখায় নাজনীনকে যেমন ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। তেমনি নাজনীনের মস্তিষ্ক তাকে বারবার রাজনকে বোঝানোর পরামর্শ দিয়েছে। আজ সম্পর্ক ভাঙে যাক। কাল দোষারোপ করা হবে তাকেই। তাইতো নাজনীন সব বুঝেও স্বামীর কাছাকাছি যেতে চেয়েছে। তাকে বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু রাজন? সে আজ এতই অন্ধ হয়েছে যে, হীরা ফেলে কাঁচ ধরতে দ্বিধাবোধ করছেনা।
ভোরের আলো ফুটেছে বেশ খানিকক্ষণ। রাজন অফিসে বেড়িয়ে পড়েছে। রাজন যেতেই নাজনীন ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। নেওয়ার মত শুধু নিজের একাডেমিক কাগজপত্র। রাজনের নেওয়া একটি সুতা নিতেও তার আত্মসম্মানে বাধে। যে লোকটি তাকে বোঝার চেষ্টা করলো না। তার দেওেয়া জিনিসপত্র মূল্যহীন ছাড়া আর কিছুই নয়।
চোখ ভর্তি পানি নিয়ে নাজনীন যখন নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিল বাসা ছাড়ার তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। একবার নয়, বারবার।
নাজনীনের অবুঝ মন বলে ওঠে, “রাজন এসেছে তোমাকে ফেরাতে।”
দ্বিধা নিয়ে দরজা খোলে নাজনীন। আবিষ্কার করে অপরিচিত নারীমুখ।
ইন শা আল্লাহ চলবে…….
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি