#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৪)
সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ। যার সঙ্গে নাজনীনের না হয়েছে যোগাযোগ না চেনাজানা। অথচ মানুষটি তার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই বাসার ভেতরে চলে গেল। নাজনীন দরজা ধরে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি তার মেয়েটির গতিপথের দিকে।
শেয়ালের লেজের মত বাদামি রঙ করা মেয়েটির চুলে। পরণে কটকটে নীল রঙা পিচ্ছিল কাপড়ের সালোয়ার কামিজ। ওড়নাটা বারবার কাধ থেকে খসে পড়ছে। মেয়েটি বাসায় ডুকেই হা করে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলো। তারপর বসলো গিয়ে সোফায়। ততক্ষণে নাজনীন মেয়েটির একটু দূরে গিয়ে দাড়ায়। মেয়েটি নাজনীনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর সর্বপ্রথম যে কথাটি বললো তা হলো, “বাসাটি তো খুব সুন্দর সাজিয়েছেন। একদম ছবির মত। আপনি নিশ্চয় নাজনীন?”
মেয়েটি খুব দ্রুত কথা বলে।নাজনীন উপর নিচ মাথা দুলালো।
“আমি পিয়ালি। আপনার স্বামী যাকে শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছে।”
নাজনীন স্বাভাবিক স্বরে বললো, “ওহ, আচ্ছা।”
নাজনীনের সরল কথায় পিয়ালি নামক মেয়েটি বড়ই অবাক হলো। সে ভেবেছিল নাজনীন হয়তো চিৎকার, চেচামেচি বাধিয়ে ফেলবে। কেঁদে কেঁটে মেঝেতে গড়াগড়ি খাবে। আর তা চোখ ভরে দেখবে সে। কিন্তু হলো তার অন্যরূপ। নিজেকে ভাবনার অন্তরাল থেকে বেড় করে পিয়ালি বললো, “আপনি বসুন না। দাড়িয়ে কেন?”
নাজনীন আগুন গরম চোখে তাকায়। নাজনীনের মেজাজে মেয়েটির কর্মকাণ্ড যেন ঘি ঢালছে। কিন্তু নাজনীন ঠান্ডা মাথার মেয়ে। এটুকুতে সে হইচই বাধিয়ে ফেলবেনা। তার একটি খেলা খেলতে মন চাইলো। তাই নাজনীন পিয়ালির কথায় বসলো। এতে পিয়ালি আরেকটু আশকারা পেল। সে নিজের মত বলতে লাগলো, “ভাবলাম আপনার সাথে পরিচিত হয়ে যাই। আমরা বিয়ে করছি শীঘ্রই। রাজন নিশ্চয় জানিয়েছে আপনাকে।”
নাজনীন ছোট্ট করে বললো, “জানিয়েছে।”
“তাহলে আপনার আপত্তি নেই তো?”
“একটু বাদেই আমি চিরতরে বিদায় হব এই ঘর সংসার ছেড়ে। যে স্বামী আমার রইলো না। সে কাকে বিয়ে করলো না করলো না, তাতে আমার কী?”
নাজনীনের কথায় পিয়ালি অবাক হলো। সে জানতো না নাজনীন সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে। মনে মনে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হলো সে। কিন্তু মুখের ভাবখানা এমন করলো যেন নাজনীনের নির্বাসনের খবরে সে খুবই মর্মাহত। বললো, “সে কি আপা! আপনি চলে যাবেন কেন? আমরা একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতাম।”
পিয়ালির কথায় নাজনীন হেসে ফেলে। পরক্ষণেই নিজের আবেগ সংযত করে জবাব দেয়, “দুঃখিত! আপনার মত উন্নত শ্রেণীর প্রোস্টিটিউটের সাথে একঘরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
মুখের রঙ বদলে যায় পিয়ালি। ফট করে দাড়িয়ে পড়ে। রাগে রাগে ফুসতে ফুসতে বলে, “আমি প্রোস্টিটিউট হলে আপনার স্বামী কী? আপনিই বা কেমন? আটকে কেন রাখতে পারলেন না?”
“আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয়? রূপে গুণে কোনটাই আপনার থেকে পিছিয়ে? তবুও আমার স্বামী আপনার মত পচা শামুকে পা কেটেছে। তাই বলে আপনাকে আমি সহ্য করব সেটাই বা ভাবেন কোন সাহসে? আপনার মত কিছু নর্দমার কীট লোক সমাজে যিনা ব্যাভিচারের ভাইরাস ছড়িয়ে বেড়ান। আর আমার স্বামীর মত লম্পট, দুশ্চরিত্রের লোক সেসব গোগ্রাসে গিলে। ভুক্তভোগী হই আমাদের মত মেয়েরা।”
“খবরদার মুখ সামলে কথা বলবেন। আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।”
“তাহলে কিভাবে কথা বলব? খারাপের কি দেখেছিস? এখন দেখবি।” কথাগুলো বলতে বলতে নাজনীন উঠে দাড়ায়। গায়ের ওড়না কোমরে পেচিয়ে নেয়।
পিয়ালি নাজনীনের হাবভাব দেখে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসে। সে ভেবেছিল নাজনীন হয়তো নিতান্তই শান্ত অবলা টাইপ মেয়ে। কিন্তু এ মেয়ের সরলতার মাঝে যে এতটা ভয়ংকর রূপ থাকতে পারে তা পিয়ালির কল্পনাতেও আসেনি। সে তড়িঘড়ি করে কাধে ব্যাগ চাপিয়ে হাঁটা ধরে। কিন্তু ততক্ষণে তার একটা হাত নাজনীনের দখলে।
নাজনীন পিয়ালির ডান গালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তাতে পিয়ালি ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায়। নাজনীন সেখান থেকে তাকে চুল ধরে উঠায়। এবার থাপ্পড়টা বসায় বাম গালে। পিয়ালির ধবধবে ফর্সা মুখে নাজনীনের হাতের পাঁচটা আঙুলের ছাপ বসে যায়। দুজনের ধস্তাধস্তি বেধে যায়। কিন্তু নাজনীনের কঠোর বেষ্টনী থেকে পিয়ালি ছুটতে পারে না। অগ্যতা, পিয়ালি নাজনীনের পা ধরে বসে পড়ে। কান্নারত কন্ঠে বলে ওঠে, “প্লিজ! আমাকে মা””””রবেন না। দোষ কী শুধুই আমার? আপনার স্বামীর নেই? সে না চাইলে এসব কিছু হতে পারতো? কিন্তু আপনি শুধুই আমার ওপর অত্যাচার করছেন।”
নাজনীন পিয়ালির চুল ধরে মুখোমুখি দাড় করায়। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “অত্যাচারের কি দেখেছিস? আমার স্বামীর কি অবস্থা করব সেটা সময় হলেই দেখতে পাবি। কয়টা দিন ধরে তোরা দুজন আমার মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছিস। তোর মত বে”””শ্যার জন্য আমার সাথে সে ছলনা করেছে। ভেঙেছে আমার দুই দুইটা বছরের সাজানো সংসার। হারিয়েছে স্বামীর ভালোবাসা। সব তোর জন্য। তুই কোন সাহসে আমার কাছে আসিস? আগুনে ঘি ঢালতে এসেছিস না? সেই আগুনে তুই নিজেই পুড়বি।”
অবস্থা আরও বেগতিক দেখে শেষ চেষ্টা হিসাবে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নাজনীনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় পিয়ালি। ব্যাগ থেকে একটি রিপোর্ট দেখিয়ে বলে, ”আমি তিনমাসের প্রেগনেন্ট। আমার সন্তানের বাবা রাজন।”
পিয়ালির শেষের কথাটি যেন নাজনীনের বুকে তীরের ফলা হয়ে বিধলো। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে এলো। এই জগত সংসার সব যেন তার কাছে ফ্যাকাসে হয়ে এলো। কন্ঠে ফুটে উঠলো একরাশ বিস্ময়, “কীহ!”
পিয়ালি প্রতিত্তোরে বললো, “যা শুনেছেন তাই। আপনি চাইলেও এ সম্পর্কে বাধা হয়ে দাড়াতে পারবেন না। আমি শুধু মজা নিতে এসেছিলাম। কিন্তু ভাবতে পারিনি আপনি এমন প্রলয় সৃষ্টি করবেন। আমাকে আর কি আঘাত করবেন। আশাকরি যে আঘাত আপনি পেয়েছেন তাই যথেষ্ট হবে আমার আজকের অপমানের জন্য।”
পিয়ালি যেভাবে এসেছিল। ফিরলোও সেভাবে। মাঝখান থেকে ভেঙে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেল নাজনীন কে। স্বামীর মন অন্য নারীতে মত্ত তা জেনেই নাজনীন এ সংসার ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তার সরল মন ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি তাদের সম্পর্কের গভীরতা।
নাজনীনের মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। দৃষ্টি হয়ে এলো ঝাপসা। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
নাজনীনের জ্ঞান ফিরলো বেশ খানিক পরে। ঠিক কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিল জানা নেই তার। দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো দুপুর বারোটা বেজে দুই মিনিট। তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো। ডায়নিং টেবিলে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যাগটা রাখা। নিজেকে সামলিয়ে ব্যাগটা হাতে করে বেড়িয়ে পড়লো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে কল কেঁটে দিলো। কিন্তু পরক্ষণেই কল এলো। নাজনীন কল রিসিভ করে শুধু বললো, “আমি আসছি।”
কথা শেষ করে নাজনীন কল কেঁটে দিলো। এলোমেলো পা চালিয়ে বাসা থেকে নেমে রিকশায় উঠে বসে নাজনীন। শেষবারের মত তাকায় আজীবনের মত ফেলে আশা ফ্লাটের দিকে। সেখানে সাজিয়েছিল তার সুখ দুঃখের সংসার। নিজের সবটুকু দিয়ে যত্ন, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ গটেছিল যে সংসারে। সেই সংসার আর ভালোবাসার স্বামীর থেকে পেল এক আকাশ সমান অবহেলা, প্রতারণা।
ইন শা আল্লাহ চলবে……
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি