#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৫)
বাস স্টপেজেই বাবাকে বসা অবস্থায় দেখতে পেল নাজনীন। বাবাকে ফোন করে জানিয়েছিল ও আসছে। অপরপক্ষ থেকে কোন কিছু না শুনেই কল কেঁটে দিয়েছিল। মেয়েটি ভাবতে পারেনি বাবা তাকে নিতে চলে আসবেন। বাবা মানুষটি কঠোর তবে বেখেয়ালি কোনকালেই ছিলেন না। ও সোজাসুজি বাবার কাছে চলে গেল।
মেয়েকে দেখতে পেয়ে নাজনীনের বাবা বসা থেকে দাড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো?”
প্রতিত্তোরে নাজনীন জানায়, “এখন আর কোন সমস্যাকে আমার সমস্যা মনে হয় না। সব সমস্যার উর্ধ্বে চলে গেছি।”
নাজনীনের কন্ঠস্বরে স্পষ্ট একজন হেরে যাওয়া মানুষের ছাপ। দুটো চোখ কোটরে দেবে গিয়েছে। আজমল শেখ হয়তো এই প্রথমবার মেয়ের মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেন। তার পিতৃ হৃদয় মেয়ের দুঃখ একটু হলেও বুঝলো। মনে চাইলো, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, “মারে আমি আছি তো। ভেঙ্গে পড়িস না। তোর মলিন মুখ আমার সহ্য হয় না রে।” কিন্তু তা আর বলা হয় কোথায়? তার কঠোরতায় মোড়া পুরুষ মস্তিষ্ক তাকে সজাগ করে দেয়, “তুমি পুরুষ। তোমায় কঠোরতায় মানায়। হও তুমি বাবা, তাতে কী?”
আজমল শেখ বরাবরের মত মস্তিষ্কের কথা শুনলেন না। মুখে কিছু না বললেও মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।
জন্ম থেকে যে বাবাকে আদেশ নিষেধের হুকুমদাতা হিসাবে দেখেছে মাথায় সেই বাবার নির্ভরতার হাত নাজনীনকে বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেল। অবাক চোখে বাবাকে দেখতে দেখতে তার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। টলমলে চোখর পানি বাধ ভাঙা স্রোতের ন্যায় গড়াতে লাগলো গালে। গাল বেয়ে বুকে।
দুনিয়ার ব্যাস্ততম স্থানগুলোর মধ্যে বাস স্টপেজ অন্যতম। নিত্যনতুন মানুষের কোলাহলে ভরপুর। চলার পথে বাবা মেয়ের স্নেহের আদান প্রদান মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে রইলো অনেকে। অবাক চোখে কেউ কেউ খানিক দাড়িয়ে গেল।
আজমল শেখ নিরবতার খোলশ ছেড়ে বলে উঠলেন, “বাড়ি চল।”
নাজনীন নিঃশব্দে বাবার পথ অনুসরণ করলো।
আজমল শেখ সদ্য ষাট পেরনো পৌঢ় পুরুষ। এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য। নিজের মুদিখানার দোকানে নিজেই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন। বাস স্টপেজের একটু দূরেই তার শূন্য দশকের ছাপ বহন করা মোটরসাইকেলটি রাখা। বাবা মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতেই নাজনীন উঠে বসলো। বাতাসে ইঞ্জিনের কালো ধোয়া উড়িয়ে বাইক এগিয়ে চললো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
চলার পথে আজমল শেখ উচ্চস্বরে মেয়েকে বললেন, “ভালো করে ধরে বস। পরে যাবি নাহলে।”
নাজনীন শক্ত করে বাবার কাধ আকড়ে ধরে।
পিচঢালা রাস্তায় ঘট ঘট শব্দ করে বাইক এগিয়ে চলছে। নাজনীন ফিরে যায় তার ফেলা আসা স্বর্ণালী অতীতে। যখন ছিল সে নিতান্তই অবুঝ বালিকা। বাবার এই মোটরবাইকে করেই তো সে স্কুলে যেত। নানীর বাড়িতে যেত। কখনও বাবা সেলুনে নিয়ে যেতেন চুল ছাটাতে। বাবার শাসনে মোড়ানো দিন হলেও দিনগুলোতে অন্যরকত শীতলতা লুকিয়ে থাকতো। স্মৃতি হাতরে প্রশান্তি দায়ক কিছু খুজতে ছোটবেলার সেই দিনগুলোয় হয় ফেলে আসা সবচেয়ে সুন্দর সময়।
দূর থেকেই নাজনীনের নজর কেড়ে নেয় কটকটে খোলাপি রঙা বাগান বিলাসের আকাশ চোখ ডালে। ওই তো বাড়ির কালো রঙের গেটটা দেখা যায়। আজও বাড়ির বিশ্বস্ত পাহারাদার হিসাবে কুকুরটি বসা। নাজনীনের বুকের ভেতর ধুকপুক আওয়াজ হতে থাকে। বাড়ির যত কাছে আসে বুকের ভেতরের ধুকপুক আওয়াজ যেন ততই যেন বাড়ে। নাজনীন বিয়ের পর থেকে যতবার বাবার বাড়িতে এসেছে বেশিরভাগ সময়ে রাজন সঙ্গে ছিলো। কিন্তু আজ সে সব ছেড়ে শূন্য হাতে এসেছে।
তারা গন্তব্যে এসে পড়েছে। আজমল শেখ গেটের সামনেই মোটরসাইকেল দাড় করান। নাজনীন নেমে পড়ে। বাবার পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। নিজের বাড়িতেও নাজনীনের কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো।
গাড়ি বাড়ির ভেতর রেখে আজমল শেখ মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বুঝলি, লোকে ভাঙা বাড়ির ইট পর্যন্ত রাখে না। যে যা পারে খুলে নিয়ে যায়। তুই তো আস্ত মানুষ রে। মনে রাখবি, এ বাড়ি তোর বাপের। সে এখনো বেঁচে আছে। ভয় কিসের? যা বাঘের বাচ্চার মত ঘরে ঢোক। আমি আসছি।”
নাজনীনের অস্বস্তি মুহূর্তেই উবে যায়। বড় একটা শ্বাস ফেলে ভেতরে ঢোকে।
দুপুরের রান্নার আয়োজনে ব্যাস্ত নাজনীনের মা আর ভাবি। মা খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়ছেন। আর নাজনীনের ভাবি মেঝেতে বসে বটিতে লেবু শশা কাঁটছেন। দুজনের কারোই দরজায় দাড়ানো নাজনীনকে নজরে আসছেনা। তারা দুজনের কাজে মনোযোগী। নাজনীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজ থেকে মা’কে ডেকে উঠলো, “মা!”
দু জোড়া চোখ বিস্ময় নিয়ে তাকায় নাজনীনের দিকে। তাদের মধ্যে কেউই জানতো না নাজনীনের আসার খবর। চুলা নিভিয়ে নাজনীনের কাছে এগিয়ে যায় মা। মেয়ের হাত ধরে শুধান, “তুই আসবি আমি জানতাম না তো। ভালো আছিস মা? চোখমুখ এমন শুকিয়ে গিয়েছে কেন? নিশ্চয় খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস না।”
মায়ের প্রশ্নের ফুলঝুড়ির পিঠে নাজনীন জবাব দেয়, “করি মা।”
নাজনীনের মা এবার মেয়েকে ছেড়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরান। তা দেখে নাজনীন নিজ থেকেই বলে, “কেউ নেই। আমি বাবার সাথে এসেছি।”
“জামাই কোথায়?”
“জানিনা।”
“জানিস না মানে?”
“তোমাকে বাবা কিছু জানাননি?”
“কি জানাবে?”
“সময় হোক, জানাবো। এতো জেরা করা হচ্ছে কেন? ওর বাড়িতে ও আসবেনা?” পিছন থেকে আজমল শেখ বলে ওঠেন।
মায়ের জেরা অবশেষে থামে। বাবার আগমনে মা কিছুটা ঝিমিয়ে গেলেন। ততক্ষণে নাজনীনের ভাবি লেবু পানির শরবত নিয়ে হাজির। ভাবির সাথে কুশল বিনিময় শেষে নাজনীন শরবত টুকু ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। গরমে লেবুর শরবতের চেয়ে স্বাদু পানীয় আর দুটো হয় না।
মেয়ের উদ্দেশ্যে আজমল শেখ বলেন, “যাও, তোমার রুমে যাও। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে খেতে আসো। নাহিদের মা খাবার বাড়ো। আমি আসছি।”
নাজনীনের মা আপাদমস্তক একজন স্বামী ভক্ত প্রাণী। যার সবটা জুড়ে কেবল নাহিদের বাবা। স্বামীর কথায় অমান্য করার চেয়ে মৃত্যু তার কাছে অধিক শ্রেয়। বরাবরের মতো স্বামীর কথায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। নাজনীন পা চালায় তার নির্ধারিত রুমে।
রুমে ডুকে নাজনীনের মনে হলো এ রুমে বহুদিন তার থাকা না হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। নাজনীন কাধের ব্যাগটি বিছানায় ছুড়ে ফেলে ফ্যানটা চালিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে বিছানায়। এ জীবনে তার আর কী রইলো? রাজন তাকে দাবার গুটির মত ব্যবহার করলো।
রাজনের কথা মনে পড়লেই নাজনীনের মন আবেগী হয়ে ওঠে। দুই দুইটা বছর একসঙ্গে থেকেছে। মায়া নামক জিনিসটা মানুষকে বেহায়া করে তোলে। সে প্রতারণা করলেও নাজনীন তো করেনি। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি তো সে করেনি। অথচ আজ তাদের দূরত্ব যেন পাহাড়সম। হাজার অন্যায়েও অপর মানুষটাকে মনে পড়ে যায়। ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নাজনীন নিজের মনকে কঠোরভাবে শাসায়। রাজন নামক কোন বিষাক্ত কীটের স্থন তার জীবনে নেই।
বাবার পাশের চেয়ারটাতে খেতে বসেছে নাজনীন। আজমল শেখ মেয়েকে নিজ গরজে পাশে বসিয়েছেন। নিজেই মেয়ের প্লেটে ভাত বেড়ে রুই মাছের মাথাটা তুলে দিলেন। নাজনীন নিষেধ করতে গিয়েও চুপ থাকে। এ জীবনে বাবার এমন আদর পাওয়া তার নিকট বড়ই সৌভাগ্যের।
অন্যদিকে নাজনীনের মা মনে মনে ছটফট করতে থাকেন। মেয়ে একা ফিরলো। অথচ জামাই এলো না। জামাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেও তেমন গোছানো উত্তর মেয়ের থেকে পেলেন না। এ নিয়ে তিনি বেজায় চিন্তিত। তার নারী মন মেয়েকে স্বামীর সংসারে দেখতে সন্তুষ্ট। জামাই ছাড়া মেয়ের বাড়িতে ফেরা তার নিকট অন্যরকম লাগে। ফলে বাবা মেয়ের ভালোবাসাময় সুন্দর দৃশ্যটিও তার চোখের সামনে ঘটলেও মন ছুতে পারে না।
___________________________
কুকুর পুষলেও মানুষের মনে তার জন্য দয়া মায়ার জন্ম হয়। তাকে দুদিন না দেখলে মনের মধ্যে খচখচ করে। অথচ দুইটা বছর যে নারীর সাথে রাজন সংসার করলো তার চলে যাওয়ায় সে একেবারেই নিরব, স্বাভাবিক। পিয়ালি নামক লোকসম্মুখে ভদ্রবেশি ব্যে”””শার শরীরে সে অনায়াসেই ডুবে যেতে পারে। বরং স্ত্রীর চলে যাওয়ার কথা ভাবলে তার মন প্রাণ শান্তিতে ভরে ওঠে। আপদ যদি নিজ থেকে বিদায় নেয় তবে ক্ষতি কী?
“আরেকটু দেই?” আদুরে কন্ঠে পিয়ালি শুধায়।
রাজন মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায়। পিয়ালি কাচের বরফ কুচির মধ্যে আরেক পেগ লাল পানি ঢালে। রাজন নিমিষেই গিলে নেয়। মাথা ঝিম ধরে যায়। ঝাপসা দৃষ্টিতে মুখে ব্রনভর্তি থলথলে শরীরের পিয়ালিকেও তার কাছে ক্যার্টিনার মত লাগে। রাজন জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে, “ডার্লিং ইউ আর সো হ৳”””””।”
পিয়ালির ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। মুরগি এবং ডিম দুটোই এখন তার কব্জায়।
ইন শা আল্লাহ চলবে…
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি।