#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৭)
বাড়িওয়ালার হটকারী সিদ্ধান্তে রাজন বেজায় বিরক্ত। প্রতিমাসে ভাড়া পরিশোধ করার পরেও হঠাৎ করে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিবেন কেন? তাও আবার রাতারাতি!
চিন্তিত মুখে রাজন ড্রয়িং রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করতে থাকে। বাড়িওয়ালা যখন বলেছে বাসা খালি করতে, তখন ভাড়াটিয়া হিসাবে তাকে সেটাই করতে হবে। এক রাতের মধ্যে বাসা কোথায় পাবে? সে নিজে একা হলে এক রাত যেভাবে হোক সামাল দিতে পারতো। কিন্তু, বাসা ভর্তি ফার্নিচার নিয়ে সে কোথায় উঠবে? আকাশ সমান বোঝা মাথায় নিয়ে রাজন যখন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে, ঠিক তখন কফি হাতে ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক লাগিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয় পিয়ালি। ফ্যানের বাতাসে তার চুলগুলো দূরন্ত কিশোরীর ন্যায় উড়তে থাকে।
পিয়ালির উপস্থিততে রাজন আরও বিরক্ত হয়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলে না। পিয়ালি যখন কফির কাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয় ঠিক তখনই তার উত্তপ্ত মেজাজে যেন ঘি ঢালা হয়। চেচিয়ে বলে ওঠে, “চিন্তাই আমি ম”””রে যাচ্ছি। আর তুমি কি বা”””ল নিয়ে এসেছো? বেশ্যার মত সেজেছো কেন?”
পিয়ালি ও কম যায় না। দ্বিগুণ আওয়াজে চেচিয়ে প্রতিত্তোরে বলে, “লজ্জা করে না এই বে”””শ্যার কাছে শুতে আসিস। তুই আসলেই একটা ভো””””দাই। পারিস শুধু ষাড়ের মত চেচাতে।”
রাজন অবাক হয়। সে নাহয় রেগে গিয়ে দুটো কথা শুনিয়েছে। কিন্তু পিয়ালি এমন তুই তুকারি করবে ভাবতে পারেনি বেচারা রাজন। গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হুশ ফিরে পিয়ালির ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যে।
পিয়ালি হনহন করে চলে যাচ্ছে। রাজন দ্রুতগতিতে গিয়ে পিয়ালির হাত ধরে আটকায় তাকে। নরম স্বরে বলে, “দেখতেই পাচ্ছো। আমি কতটা টেনশনে আছি। রেগে গেলে কিছুই ভালো লাগে না আমার। তুমি এমন করলে কি করে হয় বলো তো? তোমার জন্য আমি সব ছাড়লাম। সেখানে তুমি দুটো কথা সহ্য করতে পারবেনা? নাজনীন তো এমন ছিল না। ও আমায় বুঝতো।”
রাজনের বুঝবাক্যে পিয়ালির মন নরম হতে থাকে। হাঁটা থামিয়ে দাড়িয়ে পরে। রাজনের কাছে তার গুরুত্বে মন আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই মন তার বিষিয়ে যায় রাজনের শেষ দুটো কথায়। এক ঝটকায় রাজনের থেকে হাত সরিয়ে নেয়। ঝাঝালো কন্ঠে বলে ওঠে, “এতই যখন ভালো। তখন তাকে নিয়েই থাকতে। আমার কাছে কী?”
রাজন প্রতিত্তোর করে না। শুধু মনে মনে বলে, “কে জানতো ফ্রিতে খা”””ওয়া মা””””ল এভাবে পেচিয়ে ধরবে। নাহলে তোকে বিয়ে করতে আমার ঠেকা পড়ছে।”
“বাদ দাও এসব। কথায় কথা বাড়ে। পারলে বুদ্ধি দাও কি করা যায়। রাতারাতি বাসা কোথায় পাওয়া যাবে।”
“বাসার খোঁজ পরে করো। কে বা কারা এমন সর্বনাশ করলো। সেটা আগে জানো। আমি নিশ্চিত তোমার বউ এমন করেছে। ও বাড়িওয়ালাকে ফুসলে তোমাকে বাড়ি ছাড়া করতে চাইছে। ওকে ফোন করে জানো। কেন এমন করলো।”
পিয়ালির কথায় রাজন নড়েচড়ে বসে। আসলেই তো। এভাবে ভাবা হয়নি তার। কিন্তু নাজনীনের কখনও বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়নি। মাসিক ভাড়া, বিভিন্ন সমস্যাই রাজনই বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করেছে। নাজনীন নয়। রাজন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
পিয়ালি পুনরায় জিজ্ঞাসা করে, “কী ভাবছো?”
প্রতিত্তোরে রাজন বলে, “হলেও হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনা ক্ষীণ।”
“কেন?”
“ও তো মোবাইলটা ও নেয়নি। আমার দেওয়া সবকিছু রেখে গিয়েছে। এক কাপড়ে বেড়িয়েছে সম্ভাবত। ও ভিষন লাজুক স্বভাবের মেয়ে। এসব করবে বলে মনে হয় না।”
পিয়ালি লক্ষ্য করলো, বর্তমানে রাজনের সর্বত্র জুড়ে তার বিচরণে ও নাজনীনের গুণের প্রশংসা করতে ভুলছে না। দোষ দিতেও আপত্তি। পুরুষ লোক আসলেই অদ্ভুত! এক নারীর কোলে শুয়ে অন্য নারীর প্রশংসা করে। এতসব পাত্তা দিলে তার চলবে না। পিয়ালি মনে মনে কুটিল হাসে। তাদের বিয়ে এবং নাজনীনের সঙ্গে ডিবোর্স টা হোক। তারপর সব কড়াই গণ্ডায় উসুল করবে। সব চলবে তার ইচ্ছেতে। জীবনে সুখী হতে গেলে আপাতত রাজনের মনের কাছাকাছি তাকে থাকতেই হবে।
চুলের ভাজে পিয়ালির নরম হাতের স্পর্শে রাজন আবেশে চোখ বুজে। রাজনের মাথায় হাত চালাতে চালাতে পিয়ালি বলে, “তাহলে বাড়িওয়ালার সাথে যোগাযোগ করো। কেন এমন করলেন সেটা জিজ্ঞাসা করো। তার বাড়ি, বেড়িয়ে যেতে বলতেই পারেন। কিন্তু এভাবে বিপদে ফেলার অধিকার তো তার নেই। ফোন লাগাও। নাম্বার আছে তো?”
“হু।”
পিয়ালির কথামতো রাজন বাড়িওয়ালা নাম্বার কল করে। দুবার রিং হলেও ওপাশ থেকে কল ধরে না। তৃতীয়বারের কলে ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়। মাঝ বয়সী পুরুষ কন্ঠস্বর। সালাম জানায় রাজনকে।
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
রাজন থতমত খেয়ে যায়। সালামটা তার তরফ থেকে দেওেয়া উচিত ছিল। নিজেকে সামলে জবাব দেয়, “ওয়লাইকুমুস সালাম। আমি তিন তলার বাম পাশের ফ্লাটের ভাড়াটিয়া বলছিলাম।”
“ওহ! নোটিশ পেয়েছেন নিশ্চয়ই?”
“পেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে বাড়ির ছাড়তে বলার কারণ বুঝতে পারলাম না। আমার কি কোন ভুল হয়েছে?”
ওপাশ থেকে মাঝ বয়সী লোকটার হাসির আওয়াজ আসে। রাজন বিরক্ত হলেও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকে। হাসার মত কিছু বলেছে নাকি?
বাড়িওয়ালা প্রতিত্তোরে বলেন, “বাবারে, আমি সাধাসিধা মানুষ। কোনরকম প্যাচগোছের মধ্যে নাই। আপনি যে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়েছেন তা আমি জানতে পেরেছি আজই। আরও আগে জানতে পারলে নোটিশ আপনার দুয়ারে আগেই যেত। আপনাকে বিবাহিত এবং স্ত্রীসহ ভাড়া দিয়েছিলাম। আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে নেই। বর্তমানে যেনায় ডুবে আছেন। বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে লিপ্ত। উক্ত নারীর অবাধ আশা যাওয়া। ভাবছেন এসব কি করে জানলাম? আমার বাড়িতে থাকছেন। এটুকু খবর আমার রাখতেই হয়। আল্লাহর ওপর খুব ভরসা করি। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করি। সেই বোধ থেকেই আপনার মত লোককে আমার বাড়িতে রাখতে আমার বিবেকে বাধছে। আমি চাই না আমার বাড়িতে থেকে এই ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধিটা অন্যত্র ছড়ান।”
“কিন্তু, এক রাতের মধ্যে আমি বাসা কোথায় পাব? তাছাড়া একমাসের এডভান্স ভাড়া ও তো নেওয়া।”
রাজনের অনুনয় কানেই তুললেন না। গাম্ভীর্যে মোড়ানো কন্ঠে ফের বললেন, “সকাল দশটার মধ্যে এডভান্সের টাকা পেয়ে যাবেন। দ্রুতই আমার বাসা খালি করবেন। নতুবা আমি লোক ডাকিয়ে খালি করব।”
রাজন আর কিছু বলার সাহস পেল না। ওপাশ থেকেই কল কেঁটে দেওেয়া হলো। তারপর পিয়ালির কাছে সবটা বললো। পিয়ালিও চিন্তায় পড়ে গেল।
ভাবনা চিন্তায় কোন উপায় মিলছে না।
পৃথিবীর বুকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নামে। উপায়ন্তর না পেয়ে রাজন পিয়ালিকে সঙ্গে করে বাসা খুজতে বেড়িয়ে পড়লো।
শহরের অলিগলিতে দুজন মানুষ বিরামহীন হেঁটে চলেছে। কোথাও বা বাসা মিলছে কিন্তু ভাড়া বেশি। আবার কোথাও ভাড়া কম বাসা পিয়ালির পছন্দ হয় না। রাজন মনে মনে অশ্রাব্য ভাষায় ব’কতে থাকে পিয়ালিকে। এমন ঝামেলায় সে আগে কখনও পড়েনি। জীবন তাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
_______________________
বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের বিশেষ যত্নে দিন কাটছে নাজনীনের। কষ্ট থেকে সবাই তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়ছে। যে বাবার কন্ঠনালি দিয়ে গম্ভীর স্বর ছাড়া বেড়তো না। সেই বাবা ই নাজনীনের সকাল সন্ধা খবর নেন। বাড়িতে অবস্থানরত সময়ে মেয়েকে ডেকে ডেকে কাছে আনেন। নানান রকম গল্প বলেন।
নাহিদ, সে তো বোনটির দিকে তাকাতে লজ্জা পায়। একমাত্র বোনের মলিন মুখ তার সহ্য হয় না।
মাইমুনা বেগম মেয়ের আড়ালে আবডালে মুখে আচল চেপে কেঁদে বেড়ান।
পরিবার হয় একটি দেহের মত। যেখানে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে সাজানো থাকে। দেহের একটি অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন বাকি অঙ্গগুলো দূর্বল হয়ে পড়ে। তেমনি পরিবারের একজন সদস্যের জীবনের প্রতিকুল সময়ে অন্যদের জীবন থেকেও হাসি আনন্দ বিলিন হয়ে যায়। দূর্বল হয়ে পড়ে বাকিরাও।
নাজনীন দিনদিন হাসতে ভুলে গিয়েছে। খেতেও অনিহা তার। নিস্তব্ধতার বেড়াজালে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে। মা এবং ভাবির সঙ্গ ও তার সহ্য হয় না। সবকিছুই যেন বিষাদে ভরপুর। বন্ধ ঘরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফুলে রক্ত জবার মত হয়ে ওঠে দুটো চোখ।
নাহিদ এবং আজমল শেখ মনেমনে প্রস্তুত রাজনের বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নিতে। তার মেয়েকে দুঃখের অথৈ সাগরে ফেলে দিয়েছি বদবাইশটা। জীবন্ত পু”””ততে পারলে শান্তি পেতেন। কিন্তু আগাতে পারেন না নাজনীনের শোচনীয় অবস্থার জন্য। মেয়েটি দিন দিন নিজের প্রতি অযত্নে, অবহেলায় জীবন্ত লাশ হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে থানা পুলিশ, কোট কাচারীতে মেয়েটিকে টানা হেচড়া করারও মন সম্মতি দেয় না। প্রসঙ্গ তুলে মেয়ের মনের ক্ষত তাজা করতে চান না। কিন্তু এভাবেও তো ছেড়ে দেওেয়া যায় না। প্রতারকের কোন ছাড় হয় না।
বাড়ির চারপাশে ইটের দেওয়াল। পিছনটাই বিভিন্ন ফলের গাছগাছালি লাগানো। শেষ বিকেলের ক্লান্ত আলোয় মাখামাখি হয়ে নাজনীন তাকিয়ে দেখছিলো থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা আম, জাম, লিচু। গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাজনীনের মনে হলো, মানুষ নামক জ্ঞান সম্পন্ন পশুর থেকে এই বৃক্ষ সম্প্রদায় আরও ভালো। কিছু সুন্দর হাওয়াল তালে পাতা নড়ছে। প্রকৃতির যেহতু পরিবেশে তারা মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকে। দুঃখ নেই, বিচ্ছেদ নেই। কতই না সুন্দর তাদের বেড়ে ওঠা।
আবার নাজনীনের হঠাৎ করেই ইচ্ছা জাগে, সে যদি পাখি হতে পারতো। উড়ে চলে যেতো এমন স্থানে যেখানে বিষাদের ছোঁয়া পৌছায় না। বিচ্ছেদ যন্ত্রণা যেখানে কাতর করতে পারে না। কিন্তু সে তো মানুষ। পাখি কি আর হওয়া যায়? শখের পুরুষের দেওেয়া আঘাত নিয়েই কাতরাতে কাতরাতে মৃ”ত্যু”র দিন গুনতে হবে তাকে। ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে চোখ বেয়ে।
ইন শা আল্লাহ চলবে……
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি