সুখের আশায় চেয়ে থাকি পর্ব-০৮

0
1

#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৮)

মাইমুনা বেগম মেয়ের রুমের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছেন। এটা সেটা দেওয়ার নাম করে বারবার রুমে প্রবেশ করছেন। বেশিক্ষণ থাকছেন না। ব‍্যাস্ততার দোহায় দিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়ছেন। ভদ্রমহিলার কপালে চিন্তার ভাজ! মেয়ের বান্ধবীরা তার মন ভাঙা মেয়েটাকে না আবার গুড়িয়ে দিয়ে যায়! মানুষের কোন গ‍্যারান্টি নেই। কাঁটা জায়গায় খোচা দিতে পছন্দ করে কীনা!

বিকেলের দিকে নাজনীনের বাল‍্য বয়সের বান্ধবীরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। যাদের সঙ্গে নাজনীনের শুধু বাল‍্য জীবন কেঁটেছে তা নয়। কাটিয়েছে কৈশর এবং যৌবনের বেশ কিছু সময়। তাদের বন্ধুত্ব স্কুল পেরিয়ে কলেজ অব্দি গড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাদের প্রত‍্যেকের অবস্থান বদলেছে ঠিকই। কিন্তু বন্ধুত্বের জায়গায় তারা অটুট রেখেছে নিজেদের। প্রত‍্যেকেই সংসার জীবনে পা রেখেছে। সবার জীবনেই হরেক রকমের ব‍্যাস্ততা বেড়েছে।

নাজনীন বেশ কিছুদিন বাড়িতে অবস্থান করলেও, তাদের সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি বান্ধবীকে দেখতে আসার। তাদের মধ্যে তাসফিয়া নামের একজন নরম কন্ঠে নাজনীনকে বললো, “কিছু মনে করিস না রে নাজু। যখনই শুনেছি, মন চেয়েছিল ছুটে আসি তোর কাছে। কিন্তু এমন এক সংসারে আটকে গেছি। যে চাইলেও হুট করে আসতে পারিনি। তোর জন্য আমার যে কতটা মন খারাপ হয় বলে বোঝাতে পারব না।”

তাদের মধ্যে একজনের আবার ছোট্ট বাবু কোলে। সে বললো, “আমার বাবুটা কিছুদিন খুবই অসুস্থ ছিল রে। নাহলে কবে তোকে দেখতে আসতাম।”

নাজনীন পরম আদরে বান্ধবীর মেয়েটিকে কোলে নেয়। কপালে ঠোঁট ছুইয়ে শুধায়, “কেমন আছো মামনি?”

বাচ্চাটির বয়স কেবল সাত। নতুন নতুন বসতে শিখেছে। এখনো বুলি আয়ত্ব করতে পারেনি বেচারী। ফলে, সে শুধুই ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইলো নতুন মুখের দিকে।

নাজনীন বরাবরই বান্ধবীদের সাথে সব কথা শেয়ার করে। ছোটবেলার বান্ধবী কীনা! আজও যখন সবাই জিজ্ঞাসা করল তার সংসার ত‍্যাগের প্রকৃত কারণ। তখন নাজনীন নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখের পানির সাথে যন্ত্রের মত বলে গেল তার সাথে হওয়া প্রতারণার গল্প।

বান্ধবীর চোখের পানি, মনের দুঃখ বাকি তিনজনের চোখেও পানি আনলো। হৃদয় স্পর্শ করলো। কতটা নিষ্ঠুরতার স্বীকার হয়েছে মেয়েটি। তারা সবাই অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইলো। বান্ধবীকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে। সে ভাষা তাদের শব্দ ভান্ডারে খুজে পেল না।

তাদের মধ্যে মলি নামের মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো, “তাহলে এখনো বেয়া”দবটার নামে মামলা করছিস না কেন? ওদের এভাবে ছেড়ে দিলে ও সহ ওই ক‍্যাটাগরির মানুষগুলোর সাহস আরও বাড়বে রে। ওরা মানুষের মন ভেঙে মজা পায়। ওদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব‍্যবস্থা করছিস না কেন?”

নাজনীন ভাঙা গলায় জবাব দেয়, “আমি এতটাই ভেঙে পড়েছি যে এসব ঝামেলায় জড়ানোর মত সাহস পাচ্ছিনা। ধর, তার নামে মামলা করলাম। পুলিশ তাকে ধরলোও। তারপর আদালতে জানোয়ারটার মুখোমুখি হতে হবে। নানান রকম ঝামেলায় জড়াতে হবে। দেখা গেল আমি ন‍্যায‍্য বিচার পেয়েও গেলাম। জানোয়ারটার জেল হলো। কয় বছরের হবে? স্ত্রীকে না জানিয়ে বিবাহিত বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর দায়ে আমাদের দেশের আইন তেমন কড়াকড়ি না। তারওপর আইনের যে ভ‍্যাজাল। টাকার কাছে আইন যে হাতের পুতুল হয়ে যায়। আমি তো তার দুই চার বছরের কারা জীবন দেখে তৃপ্ত হব না। আমি যদি বিচার করি, আমার বিচারে ফাঁকফোকর থেকে বেড়িয়ে যেতে পারবে। কিন্তু আমি ওই দুই জানোয়ারের নামে প্রতিনিয়ত আমার মহাপরাক্রমশালী রবের নিকট দুই হাত তুলে বিচার দিই। বিচারপতি যদি হয় স্বয়ং আমার মহামহিম রব। তখন সেই বিচারের কোন ফাঁকফোকর থাকে না। আমার বিচার থেকে ছাড় পেয়েও যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর বিচার থেকে নয়। অচিরেই ওদের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হবে দেখিস। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। আমার নরম মনে যারা ইচ্ছাকৃত পাথর মে”রে রক্তাক্ত করেছে। তাদের দুনিয়া ও আখিরাত আল্লাহ তায়ালা নিজেই ধ্বংস করতে যথেষ্ট হবেন ইন শা আল্লাহ।”

“তাতো বুঝলাম। আল্লাহ তায়ালা তো আমাদের সব বিষয়ের আশা ভরসা। কিন্তু, তোর অবস্থা তো ভালো না। এক মাসেই শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ কোটরে ডেবে গেছে। নিশ্চয় নিজের মিনিমাম যত্নটুকুও নিস না। এভাবে করলে হবে? তুই যথেষ্ট বুঝবতী। ভেঙে পড়লে হবে না। মুছে ফেল জীবন থেকে দুটো বছর। পড়াশোনায় মন দে। জীবন এখনো পড়ে আছে। এখনো কত কিছু করা বাকী।”

সবাই যার যার মত করে নাজনীনকে বোঝাচ্ছে। এরমধ্যে নাজনীন বলে ওঠে, “লুবাবা কেন আসেনি তা কিন্তু আমি জানি।”

নাজনীনের কথায় ওরা সবাই থমকে যায়। লুবাবা নাজনীনের সেই বান্ধবী। যার বিয়েতে রাজন নাজনীনকে প্রথম দেখেছিল। প্রথম দেখায় মেয়েটিকে তার মনে ধরে। লুবাবার হাসবেন্ড আর রাজন দুজন অফিস এবং বন্ধু। তারপর লুবাবা ও তার হাসবেন্ডের মধ‍্যস্থতায় নাজনীনের সাথে রাজনের বিয়েটা হয়েছিল। যদিও এসবের কিছুই নাজনীন জানতো না। বিয়ের বেশ কিছুদিন পরে লুবাবা তাকে বলেছিল।

তাসফিয়া বললো, “ও লজ্জায় তোর সামনে আসতে পারছেনা। ওদের হস্তক্ষেপেই তো বিয়েটা হয়েছিল। এসব কিছুর জন্য ও কিছুটা হলেও নিজেকে দায়ী ভাবে। হয়তো সেই লজ্জা থেকেই আসছে না।”

নাজনীন হালকা হাসলো। বললো, “কপালের লিখন না যায় খন্ডন। আমার কপালে সংসারজীবন এই পর্যন্তই লেখা ছিল। ওকে শুধু শুধু আমার জন্য মন খারাপ করতে নিষেধ করিস। যা হওয়ার তাতো হয়েই গিয়েছে।”

দেওয়ার ওপাশ থেকে সব কথা মাইমুনা বেগমের কানে আসছে। মেয়ে তার আইনি ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না। অথচ, আজমল শেখ আর নাহিদ ইত‍িমধ‍্যে থানায় যোগাযোগ করে ফেলেছে। বাবা ছেলে প্রচুর ক্ষেপে আছে। অন‍্যদিকে মেয়ে এসবে জড়াবে না।

অল্পতেই উত্তেজিত হওয়ার স্বভাব মাইমুনা বেগমের। এ জীবনে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়নি। একটু বেশি নরম স্বভাবের হওয়ায় আজীবন সকলের আহ্লাদের একজন হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। এত এত চিন্তা নিতে অভস্থ নন। ফলে অল্পতেই মাথা ঘুরে ওঠে।

ফাহমিদা শাশুড়িকে পিছন থেকে জাপটে ধরে। সোফায় নিয়ে বসায়। শাসানোর সুরে বলে, “আপনাকে না করেছি না। এত দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি হাই প্রেশারের রুগী। এত টেনশন আপনার জন্য না। আপনি মা হয়ে যদি এভাবে ওর সামনে ফিট খা”ন। তাহলে ওই মেয়েটার মনের অবস্থা কী হয় বলুন তো? কোথায় ওকে সবসময় বোঝাবেন। তা না নিজেই চিৎ কাৎ হয়ে পড়ছেন। এত নরম হলে হয় না আম্মা। একটু শক্ত হন।”

“তুমি বুঝবানা বউ। আমার একমাত্র মেয়ে। নরম সরল আজীবনই। সেই মেয়ে এত ছোট বয়সে কত বড় দুঃখ পেল। এত বড় ধাক্কা সামলানোর বয়স কি ওর হইছে? গোলাপের পুতরে আমি কি কম যত্ন করছি? কি জন্য করছি? আমার মেয়েটা যেন ভালো থাকে, সুখে থাকে। মেয়ে আমার সারাক্ষণ মুখ বেজার করে রাখে। মা হিসাবে আমি কেমনে সহ‍্য করি বলো?”

ফাহমিদা কিছু বলতে পারে না। আসলে, জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন সৃষ্টিকর্তার দিকে নির্বাক চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। হয়তো সেই নির্বাক চোখদুটোতে মিশে থাকা সুখের আশা।
_____________________________

সেই রাতের পর থেকে রাজনের চোখ ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গিয়েছে। সে রাতে তারা বাসা ঠিকই খুজে পেয়েছিল। ভালো বাসা। আগের বাসার তুলনায় ভাড়াও কম। এমন সুযোগ লুফে নিয়েছিল রাজন। পরদিন সকালে ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রাক বোঝায় করে মালপত্র নতুন বাসায় এনে তোলে। বাসা বদলানো ভীষণ ঝামেলার। একপ্রকার একা হাতেই সবকিছু করতে হয়েছে তাকে। এসবের ঝামেলায় তার ভাড়া নেওয়া নতুন বাসাটার আশপাশে নজর দেওেয়া হয়নি। বাসায় ওঠার পর সময় নিয়ে আসবাবপত্র সেটিং করতে করতে সেদিন পার হয়ে গিয়েছিল। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই তীব্র দূর্গন্ধে পেটের গা গুলিয়ে আসে। দূর্গন্ধের উৎস খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করে তাদের ফ্লাটের বিপরীত পাশেই বিশাল এক ডাস্টবিন।

এখন তাকে খেতে গেলে দূর্গন্ধ, ঘুমাতে গেলে, গোসলে গেলে দূর্গন্ধ শুকতে হচ্ছে। পুরো দূর্গন্ধময় জীবন হয়ে গেছে। নিজের এ করুণ দশার কথা পিয়ালিকেও জানাতে পারছেনা। সামনে তাদের বিয়ে। বেশ খরচাপাতির বিষয়। নাজনীনের সাথে সব রকম হিসেব চুকাতে ডিবোর্সের আবেদন করেছে। তার মধ‍্যে বাসা বদলাতে গিয়ে শারীরিক শ্রমের পাশাপাশি টাকা পয়সাও খরচ হয়েছে। দূর্গন্ধের কারণে বাসা বদলাতেও পারছেনা। রাজন নিজেকে নিজেই গালমন্দ করতে থাকে রোজ। জীবনটা তার কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। একটা সময় অফিস থেকে বাসা এলে এক অদৃশ্য সুখ তাকে ঘিরে ধরতো। আর এখন?

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

[রিচেক দেওেয়া হয়নি।]