সুখের আশায় চেয়ে থাকি পর্ব-০৯

0
1

#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০৯)

ঘরোয়া আয়োজনের মধ‍্য দিয়ে পিয়ালিকে রাজন বিয়েটা করেই ফেললো। কাছের দুই চারজন বন্ধুবান্ধব, পিয়ালির মা এবং রাজনের মা ও উপস্থিত ছিলেন।

বহু কসরত করে রাজন মাকে বিয়েতে এনেছে। রাজনের বাকি দুই ভাই এ প্রস্তাব শুনেই না করে দিয়েছে। তারা প্রকৃতির কোলে মানুষ। নিতান্তই সহজ সরল তাদের জীবন। ভাইয়ের মত শহুরে জীবনে অভস্ত নয়। খেটে খাওয়া মানুষেরা ভাইয়ের এহেন অপকর্ম কিছুতেই সমর্থন করলো না। সাফ জানিয়ে দিলো, “তোমার এমন হটকারি সিদ্ধান্তে আমাদের মত নেই। তুমি শিক্ষিত হয়েছ, ধরা কে সরা জ্ঞান করা শিখেছো। তোমার সাথে আমরা পারব কেন? যা করেছ, নিজের বিবেক কে প্রশ্ন করে দেখ। যা করেছো কতটুকু ঠিক! মা তো আমাদের একার নন। তিনি যা ভালো বুঝবেন করবেন।”

এরপর আর ভাইদের শক্ত কথার পিঠে রাজন কিছু বলার সাহস করে ওঠেনি। কিন্তু মা কে ম‍্যানেজ করা তার জন্য সহজ হলো। প্রতি মাসে চার সংসার চারটি নোট মায়ের কাছে পাঠায় সে। ভদ্রমহিলার প্রতি মাসে যে ওষুধপত্র লাগে তা এই ছেলের পয়সাতেই আসে। তাই এই জনম দুখিনী ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞ বটে। তবে সব জেনে আসতে তার মন চাইলো না। আবার ছেলের খুব করে বলা অনুরোধ বাক‍্যে ও নিজেকে আটকাতে পারলেন না। বিয়ের আগের দিনই গ্রাম থেকে এসে উপস্থিত হলেন ছেলের বাসায়।

শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। বিয়ের আয়োজন হয় রাজনের বাসাতেই। মেয়েপক্ষ হতে শুধুমাত্র মেয়ে এবং মেয়ের মা উপস্থিত। রাজনের মা অবাক চোখে তাকান সেদিকে। তার পয়ষট্টি বছরের জীবনে এমন বিয়ে কোনদিন দেখেননি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলেন না।

পিয়ালির ইচ্ছে বিয়ের কাবিন হোক দশ লক্ষ্য টাকা। রাজন সরাসরি এ প্রস্তাব নাকচ করে। বর এবং কনের মধ্যে মৌখিক যুদ্ধ লেগে যায়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। রাজন বলে, “দুই লক্ষ‍্যের বেশি এক টাকাও না।”

পিয়ালি জবাবে বলে, “দুই লক্ষ্য টাকায় আমাকে বিয়ে করতে চাও? এত শখ! কম হলেও পাঁচ তো হতেই হবে।”

রাজন সকলের সামনে ভেতরের কথা আনতে চায় না। পিয়ালির হাত ধরে সাইডে নিয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে, “কি চাস? বিয়ে হোক নাকি ভেঙে দিব সব?”

পিয়ালি ভয় পায়। তার সাজানো ফাদে পা দেওেয়া শিকারী হাত ছাড়া হতে চলেছে যে। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে প্রতিত্তোরে বলে, “আমার একটা দাম আছে না? এই যুগে কেউ দুই লক্ষ্য টাকা কাবিনে লেখে?”

রাজনের কপালের রগ ফুলে যায়। এমনিতেই সে নানান সমস্যায় ফেঁসে আছে। চারিদিক থেকে ঝামেলা ধেয়ে আসছে। নতুন করে পিয়ালির এই অন‍্যায় আবদারে সে যারপরনাই দিক হারিয়ে ফেলে। মুখ ফসকে বলে ফেলে, “তোর আবার দাম? তোকে তো এমনিতেই বিছানায় পেয়েছি। যদি বিয়ের শখ থাকে, তাহলে রাজি হয়ে যা। নাহলে মা মেয়ে বিদায় হ।”

“কেন? বউয়ের কথা মনে পড়ছে নাকি?”

“অলরেডি ডিবোর্সের সব কাগজপত্র জমা দেওেয়া হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই নোটিশ চলে যাবে। তোকে কিজন‍্য বিয়ে করছি, ভুলে যাচ্ছিস নাকি?”

প্রতিত্তোরে পিয়ালি কিছুই বলে না। কেবল থমকে তাকিয়ে থাকে রাজনের দিকে। কথা বাড়ালে বাড়তেই থাকবে। পিয়ালি অত্যন্ত চতুর প্রজাতীর প্রাণী। তর্ক বাড়িয়ে নিজের ক্ষতি সে করবে না। রাজন মানুষ ভালো না। ভালো মানুষ হলে ঘরে অমন সুন্দর স্ত্রী রেখে তার কাছে যেত না। ভদ্রবেশী লু”””চ্চা যাকে বলে। ওকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরবে না, তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে? এজন্যই তো কাবিনে দশ লক্ষ্য লিখাতে চেয়েছিল। নাজনীনের মত পরিস্থিতিতে পড়লে শক্ত একটা অবস্থান নিতে পারতো। মোটা অংকের একটা এমাউন্ট তো পেতই। সেসব আর হচ্ছে কোথায়? রাজন যা ক্ষ‍্যাপা ক্ষেপেছে। দেখা যাবে তর্ক বাড়ালে বিয়েটাই না বন্ধ হয়ে যায়। একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিয়ালি মনে মনে নিজেকে বুঝ দিল, বিয়েটা হোক। গলায় শিকল কিভাবে পড়াতে তা আমার ভালোই জানা আছে।

অবশেষে বিয়ের ঝামেলা মিটলো। রাজন তার নতুন স্ত্রীকে নিয়ে মাকে সালাম করাতে নিলে ভদ্রমহিলা গম্ভীর স্বরে বললেন, “প্রয়োজন নেই।” বলেই সরে দাড়ালেন।

বিয়েতে ভুড়িভোজ হবে না, তাই কী হয়? নাম করা রেস্টুরেন্ট থেকে পোলাউ, খাসির লেগপিসের রোস্ট, বিফ কাবাব, জর্দা, আর গরুর মেজবান আনা হয়েছে। সবাইকে খাবার পরিবেশন পর্ব শেষ হলে পিয়ালি নিজ হাতে পাতে খাসির লেগ রোস্ট তুলে নিল। তা দেখে রাজনের কিঞ্চিৎ মন ক্ষুণ্ন হলো। সে ভেবেছিল নব দম্পতি হিসাবে তার একসঙ্গে খাবে। অথচ পিয়ালির খাবারের ধরন দেখে মনে হচ্ছে বহুকাল অনাহারে কাটানো মানুষ খাবারের সান্নিধ্য পেয়েছে। তবুও মনে আশা রেখেছিল অন্তত রোস্ট টা তার সঙ্গে শেয়ার করে খাবে।

রাজনের প্লেটের খারাপ নড়ে না। সে আড়চোখে পিয়ালির গাপুস গুপুস খাওয়া দেখছে। ভাবছে, এই বুঝি পিয়ালি বলে লেগ রোস্টটা আমরা ভাগ করে খাই। পিয়ালিকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। পাশে যে রাজন নামক নতুন বর উপস্থিত তা সে ভুলেই গিয়েছে।

অথচ নাজনীনের সঙ্গে তার বিয়ের পরের সময়টা কতই না মধুর কেটেছিল। নতুন কালে কয়েকটা দিন তারা একে অপরকে খাইয়ে দিত। এক পাত্রে খাবার খেত। মেয়েটির মুখ সারাক্ষণ লাজে ছেয়ে থাকতো। ভদ্রতার সাথে নরম স্বরে কথা বলতো। যার প্রত‍্যেকটি কাজে ভালোলাগার পরশ খুজে পেত রাজন। অথচ এ কেমন খাদক বিয়ে করেছে সে? কেবল নিজের পেট ভরতেই ব‍্যাস্ত। রাজনের হয়তো এই প্রথম বুকের ভেতর কেমন একটা ধাক্কা লাগলো।

সুন্দর বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। টকটকে লাল রঙের সিফন শাড়িতে নিজেকে মুড়িয়েছে পিয়ালি। হাতাকাটা ব্লাউজ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। খোপায় বেলির গাজড়া। রাজন ভিষন খুশি হলো পিয়ালিকে দেখে। নাহ! মেয়েটি নিজেকে সাজাতে কাপর্ণ‍্য করেনি। বাসর সুন্দর কাটবে। যদিও বহুবার তাদের বাসর হয়েছে।

দুজন মানুষ যখন পরস্পরের খুব কাছে তখনই পিয়ালি বললো, “মাকে সঙ্গেই রাখব।”

রাজন বিরক্ত হলো। এ সময় কি ধরনের কথা?

“আমার মা যদি চলে যেতে পারেন। তাহলে তোমার মা থাকবেন কেন? জামাইয়ের বাসায় থাকবেন এ কেমন কথা?”

“তোমার বাসা কি আমার বাসা নয়? মেয়ের বাসায় মায়ের থাকতে আপত্তি কোথায়?”

“আপত্তি আছে।”

“কেন?”

“তোমার মায়ের চলন বলন আমার পছন্দ না। কেমন যেন কথা বলে। ওনাকে দ্রুত বিদায় করবে।”

রাজনের কাটখোট্টা কথায় পিয়ালির হাসিখুশি মুখখানা থমথমে হয়ে যায়। নিজের মায়ের নামে এহেন কথা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুহূর্তেই রেগে গেল। সটান দাড়িয়ে বললো, “তোর মত বিয়াত্তা মাল কি আমি এমনি বিয়ে করেছি? আমার মাকে কাছে রাখতে পারব না। সব তোর ইচ্ছা মত?”

রাজন প্রতিত্তোরে বলে, “ইয়েস। ওরে আমার সতি নারী রে। তুই কত ভালো যে, বিয়ের আগে পর পুরুষের কাছে শুতে চলে আসিস। ছিলিস তো সাধারণ একজন ওয়ার্কার। সেখান থেকে এই অব্দি এসেছিস আমার দয়ায়। এত বড় গলা তোর আসে কি করে? পেট বাধিয়ে আমায় ফাসিয়েছিস। বড় কথা কোন মুখে বলিস?”

পুষ্প রঞ্জিত বাসর ঘর রূপ নেয় তর্ক যুদ্ধে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। কেচ খুড়তে গিয়ে অ‍্যানাকন্ডা বেড়িয়ে আসছে। আদর সোহাগে নিজেদের ভরিয়ে দিতে ব‍্যাস্ত থাকার কথা ছিল। সেখানে একে অন‍্যকে কথার বানে জর্জরিত করতে ব‍্যাস্ত। নিয়তি বুঝি একেই বলে!

ড্রয়িং রুম থেকে অস্পষ্ট ভাবে সব কথায় কানে যায় রাজনের মায়ের। বহু অজানা সত‍্যের দ্বার উন্মোচন হয় তার নিকট। পানি খেতে এসেছিলেন। শুনে গেলেন অজানা কথা। ছেলের জন্য মন থেকে শুধু ঘৃণায় আসছে। ঠিক করলেন সকালের প্রথম বাসে গ্রামে ফিরবেন। দরকার পড়লে ওষুধ না খেয়ে ম””রবেন। তবুও এ ছেলের দ্বারস্থ হবেন না। ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো ভদ্রমহিলার। যেনার স্রোতে গা ভাসিয়ে এ কোন মহা সমুদ্রে ডুবতে চলেছে তার ছেলে। এ যে গর্ভের কুলাঙ্গার!
___________________________

যে বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছে সেই ফেলা আসা মানুষটা কি করছে না করছে তা নিয়ে নাজনীনের কিছু হওয়ার কথা নয়। যা হওয়ার তাতো বহু আগেই হয়েছে। প্রতারণার শিকার হয়ে সে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে।

রাজন বিয়ে করেছে। এ খবর নাজনীন ও জানে। যে মানুষটা তাকে জেনে বুঝে ক্ষতি করেছে, জঘন্যভাবে ঠকিয়েছে, তার জন্য মনে কোন অনুভূতি না থাকলেও। ঠকার কষ্ট তাকে পোহাতে হচ্ছে।

বাড়ির আশপাশ ঘিরে বহু গাছগাছালি বেড়ে উঠেছে। মাথা উচু করে বিরাট মহিরুহ দাড়িয়ে আছে। তারই ডালপালায় কিচিরমিচির শব্দে পাখিকুল ডাকাডাকি করছে। উঠানের এক কোনায় হাতল দেওেয়া বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সেসব দেখছিল নাজনীন। নিজের বাড়িতে একটু একটু করে অভ‍্যস্ত হয়ে যাচ্ছে সে।

নাহিদ গতকাল পড়ার তাগিদ দিয়েছে।

বাবা নিজের ফোন মেয়ের হাতে দিয়ে বলেছেন, “প্রয়োজনে ব‍্যবহার করিও।”

বান্ধবীরা ফোন করে পড়ার আপডেট দিচ্ছে। আগামী মাসেই এক্সাম। সময় নিকটে। পড়াশোনায় হাত দিলে দুশ্চিন্তা কমবে, মন অন‍্য দিকে ঘুরবে, ফ্রেশ লাগবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ফাহমিদা ও। বাড়ির সবাই একটি মানুষকে মুভ অন করাতে ব‍্যাস্ত।

মাইমুনা বেগম নারিকেল তেল আর চিরুনি নিয়ে হাজির হন মেয়ের কাছে। মোড়া এগিয়ে দিয়ে মেয়েকে বলেন, “এটায় বস। মাথায় তেল দিয়ে দিই। চুলগুলো লালচে হয়ে গেছে।”

নাজনীন চুপচাপ মায়ের কথা শোনে।

মাইমুনা বেগম সানন্দে মেয়ের মাথায় বিলি কেটে তেল দিতে থাকেন। নিজেকে রুমে আবদ্ধ করে রাখা মেয়ে তার উঠোনে এসে বসেছে। মনে মনে ভাবেন, মেয়েটি বুঝি একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে।

নাজনীনের মাথায় সর্বক্ষণ শুধু পুরোনো কথা ভেসে বেড়ায়। চাইলেও বেড়িয়ে আসতে পারে না। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। ভালো থাকা কি এত সোজা? চাইলেই মনকে বোঝানো যায়?

নাজনীন কাউকে বলতে পারে না, খেতে গেলে কান্নারা আমার গলায় দলা পাকিয়ে আসে। একা রুমে হঠাৎ হঠাৎ তার দম বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অনবরত চোখ থেকে পানি পড়ে। কথা বলতে গেলে আমার গলা ধরে আসে। তোমাদের কাউকে আমি আমার অনুভূতি বোঝাতে পারি না। হয়তো পারবো ও না। যার ক্ষত, ব‍্যাথা ও যে তারই। মনের দুঃখের ভার নিজেকেই বইতে হয়।

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি