সুখের ঠিকানা পর্ব-২০+২১

0
196

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২০

সরি বলে আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে জারিফ গটগট করে চলে যায়।জারিফের যাওয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে লিয়া রুমে চলে আসে। নিঃশব্দে ডোর লকড করে সন্তর্পণে গিয়ে বেডে পা ঝুলিয়ে বসে। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রজনীতে উদাসীন হয়ে জারিফের বলা কথা স্মরণ করে আনমনেই মুচকি হাসে লিয়া। কিয়ৎকাল পরেই মস্তিষ্কে কিছু স্মরণ হতেই ঠোঁটের কোণের বিস্তৃত হাঁসিটা মিলিয়ে যায় লিয়ার। চাঁদবদন মুখে আমাবস্যা নেমে আসে। গোলগাল মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়।কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে লিয়া মনেমনে আওড়ায়,,উফফ!আমি বিবাহিত।আমার বর আমার চোখের সামনে আছে।তবুও আমাদের মাঝে কত দূরত্ব। একে অপরের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব।কোনোদিন কি এই যোজন যোজন দূরত্ব দূর হবে?নাকি আর দুইমাস পর এই নামে মাত্র ভাঙ্গা ভাঙ্গা সম্পর্ক টা জোড়া লাগার বদলে একদম ভেঙ্গে যাবে? উফ্!জানিনা!জানিনা শেষটা কি হবে?তবে মন থেকে আপনাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার তীব্র থেকে তীব্রতর রয়েই যাবে। তবুও সেটা কাউকে কোনোদিন বুঝতে দিবো না।আর মিস্টার আয়মান জারিফ আপনাকে তো কখনোই না।ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবো তবুও কখনো আপনার কাছে কোনো দাবী রাখবো না।নাতো ভালোবাসার আর নাতো স্ত্রীর।কারো উপর বিন্দুমাত্র অভিযোগ থাকবে না।নিজের ভাগ্যের উপর পাহাড়সম অভিমান নিয়ে দূরে চলে যাবো।এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে।আপনার ত্রিসীমানার বাইরে।যাতে করে কাকতালীয়ভাবেও আপনার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট থাকে।
.
আজ বিয়ে।বাড়ির সামনে ফুলে ফুলে সজ্জিত গাড়ি দাঁড় করানো।এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই বরপক্ষ রওনা হবে কনের বাড়িতে।কেউ কেউ তো রেডি হয়ে গাড়িতে উঠেছে।আবার কেউ বা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।একটা গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোহান। শার্টের পকেটের সাথ থেকে সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে চোখে দিতে দিতে বলল,,”এই শাওন।জারিফ এখনো আসছে না যে।সেই যে সকালে গেলো এখনো আসলো না যে।যাওয়ার সময় না বলল এখানে এসে একসাথেই বিয়েতে যাবে।কই এখনো যে দেখা মিলছে না।”

পাশ থেকে শাওন বিরক্তিকর গলায় বলল,,”আমি কিকরে বলব?তুই যেখানে আমিও সেখানে তাই তোর থেকে বেশি কিছু আমার নিশ্চয় জানার কথা নয়।আর ওতো ফোন করেও কিছু বলেনি।তবে আমার মনেহয় এখানে না এসে সরাসরি বিয়ে বাড়িতে এটেন্ড করবে। শুধুশুধু মনেহয় না আবার উল্টো এখানে আসবে।”

ছেলেরা সব রেডি হয়ে একএক করে বের হলেও মেয়েদের দেখা যাচ্ছে না।মেয়েরা তো সাজগোজ করতে বিজি। রুপন্তীর রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে কাজিন পার্টির লম্বা লাইন পড়েছে।একজন সরছে তো আরেকজন মেকাপ,আইলানার কতকি দিচ্ছে। একজনের মাথার উপর দিয়ে আরেকজন পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আয়নায় দেখছে আর সাজছে।লিয়া নীল কালারের ভারী গাউন পড়েছে। চুলগুলো চিরুনি করবে সেই স্কোপ টাই পাচ্ছে না।মনেহয় না আজ আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিয়ার চুল চিরুনি করা হবে।কারন যে ভিড় জমেছে আয়নার সামনে। উফ্!একজন চোখে আইলানার দিয়ে সরতে না সরতেই ফের আবার এসে আরেকটু গাঢ় করছে।এটা দেখে লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে নিজের চিরুনিটা বের করে ফোন সামনে রেখে চিরুনি করতে থাকে।একটু আগেই শাওয়ার নেয়ার জন্য চুলগুলো ভেজা। শ্যামপু করা ভেজা চুলগুলো খোলাই রাখে লিয়া। রুপন্তী সাজগোজ করে এসে দুইহাতে লেহেঙ্গার দুইকোণা ধরে একটু দুলতে দুলতে বললো,,

“এই লিয়া দেখতো আমাকে কেমন লাগছে?”

লিয়া রুপন্তীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে বলল,,”মাশআল্লাহ। হেব্বি লাগছে।বিয়ে বাড়িতে এই লুকে তোকে দেখে কত ছেলে যে আ্যটাক ফ্যাটাক করে বসে, আল্লাহ মালুম।”

রুপন্তী ঠোঁট উল্টে বলল,,”আমাকে কি পেত্নীর মতো লাগছে যে আ্যটাক করবে,হুম। নিশ্চয় ভালো লাগছে না।সাজটা ভালো হয়নি।তাই এরকম বলছিস।”

লিয়া মৃদু হাসলো।কোমল স্বরে বলল,,”আরে সত্যি তোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।আমি তো মজা করে বললাম।আর তোকে তো একদম আগুনের স্ফুলিঙ্গ এর মতো লাগছে।তাই বলছি,ছেলেরা দেখার সাথে সাথেই তাদের বিপি এতো বেড়ে যাবে যে,আ্যটাকও করে বসতে পারে।”

“মে হু সারারা।”
রুপন্তী খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বললো।বাড়ির মুরব্বিরা ওদিকে তাড়া দিতে থাকে। রুপন্তী হাসি থামিয়ে লিয়াকে ইশারা করে বলল,,”চল।ওদিকে তাড়া দিচ্ছে।”

রুপন্তী হঠাৎ লিয়ার মুখের দিকে সরু চোখে চাইল।নাক মুখ কুঁচকে বলল,,”এতো লাইট সাজগোজ বিয়ে বাড়িতে। শুধু ঠোঁটে লিপবাম আর কিছুই তো চোখে পড়ছে না।চোখে কাজলও তো নেই দেখছি।”

“এই গরমে চোখে কাজল দিলে ঘেমে লেপ্টে একাকার হয়ে যাবে।আর তখন আমাকে একদম উয়িচ লাগবে।”

রুপন্তী ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে একটা টিপের পাতা হাতে নিল।সেখান থেকে একটা ছোট্ট গোল নীল টিপ হাতে নিয়ে লিয়ার দুই ভ্রু এর মাঝে বসিয়ে দিলো।লিয়া কপাল কুঁচকে কিছু বলবে তার আগেই রুপন্তী লিয়ার হাত ধরে বলল,,”টিপটাতে তোকে আরো বেশি সুন্দরী লাগছে।আমি নিজে যখন দিয়েছি ফেলিস না কিন্তু,হু।আর চল দোস্ত।ওদিকে গাড়ি বুকড হয়ে যাবে।তুই আমার সাথে ভাইয়ার গাড়িতে যাবি।কেমন?”

জারিফ মিনিট পাঁচেক হবে আসছে।রুপম খয়েরি রঙের শেরওয়ানি পড়েছে।মাথায় পাগড়ি।বর বেশে দারুন লাগছে।রুপম গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ওর সাথে ওর ফ্রেন্ডরা এটাসেটা বলে মশকরা করছে। গাড়িগুলো বাড়ির মেইন ফটকের সামনে রাস্তায় দাঁড় করানো।রোহান গাড়ির দরজার উপর একহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।এমন সময় গেইটে চোখ যেতেই মৃদুস্বরে বলল,”মারডালা ইয়ার।”কথাটা বলেই একহাতে সানগ্লাস টা খুলল।জারিফ দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে ছিলো।রোহানের কথাশুনে জারিফ কপাল কুঁচকে রোহানের দিকে তাকায়। রোহানের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তাকাতেই জারিফের দুইচোখ থমকে যায় নীল গাউন পড়া লিয়ার মাঝে।বাতাসে স্লিকি কিছু চুল উড়ে এসে মুখের উপর পড়ছে।লিয়া একহাতে কানের পাশে গুঁজে নিল।মুখে কোনো কৃত্রিমার ছোঁয়া নেই। ফর্সা ইন্নোসেন্ট ফেসটা যেনো শুভ্রতার প্রতিক। মায়াবী হরিণী আঁখিযুগল সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে। ফর্সা মুখে পাথরের ছোট্ট নীল গোল টিপটা খুবই আকর্ষণীয় করেছে লিয়াকে।রোহান মৃদুস্বরে গুনগুনিয়ে বলে উঠলো,,”নীল নীল নীলাঞ্জনা,চোখ দুটো টানাটানা।কপালের টিপ যেনো জোনাকির দিপ।আমি

জারিফের কপালের রগগুলো বেশ ফুলে উঠেছে।জারিফ কটমট চোখে রোহানের দিকে চাইল।একহাত মুঠো পাকিয়ে রোহানকে থামিয়ে দিতে কর্কশ গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,”স্টপ। প্লিজ স্টপ।”

রোহান জারিফের কথায় বেশ বিরক্ত হলো।একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। বিরক্তকর গলায় বলল,,”এই জারিফ তোর সমস্যা কোথায় বলতো? হেল্প করতে বললাম তা তো করলিই না।আর এখন আমার অনুভূতিগুলো একটু প্রকাশ করছি গানের মধ্যে সেখানেও বা হাত দিয়ে সব স্পয়েল করে দিলি। তোর সমস্যাটা কি বলতো?”

জারিফ ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।নিজেকে স্বাভাবিক করে।মুখে স্বাভাবিক ভাবটা ফুটিয়ে তুলে শান্ত গলায় বলে উঠলো,,”সমস্যা অনেক।”

“হোয়াট?”

রোহানের কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না জারিফ।রোহানকে উদ্দেশ্য করে শান্ত স্বরে ফের বলল,,”তওবা পড়।আর অন্যের বউয়ের দিকে নজর দেওয়া বাদদে।”

কথাটা রোহানের মাথার উপর দিয়ে যায়।অন্যর বউ এর উত্তর জানতে রোহান ফের প্রশ্ন করে উঠলো,,
“বুঝলাম না।কি বলতে চাইছিস?অন্যর বউ মানে?বুঝেছি আবার উল্টাপাল্টা বলবি।কালকে রাতের মতো।যা এবার আর আমি তোকে বিলিভ করছি না।আমি কি প্লান করেছি জানিস তুই? আমি তো ভেবেছি এখান থেকে বিয়ে খেয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর মা বাবাকে বলে সোজা লিয়ার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।আই হোপ জামাই হিসেবে লিয়ার ফ্যামেলি আমাকে একসেপট করবে।ওয়েট কর কিছুদিনের মধ্যেই আবার একটা বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছিস।”

নিজের বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে নিজের বন্ধু কথাটা খুবই অপমানজনক লাগলো জারিফের কাছে।ভিতরে ভিতরে রাগে ফুঁসছে জারিফ।রোহানকে উদ্দেশ্য করে জারিফ কিছু বলবে।সেই মুহূর্তে রূপম তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,,”এই রোহান গাড়িতে ওঠ।এই তোরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এভাবে গল্প করবি নাকি।দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।সবাই এসে পড়েছে তো।”

বরের গাড়ির সামনেই রুপম সহ ওর ফ্রেন্ডরা দাঁড়িয়ে ছিলো। রুপন্তী আর লিয়া গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ায়।রোহান সাইড হয়ে দাঁড়ায়।জারিফ পূর্বের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে লিয়া একহাত দূরত্বে।রুপম অপর সাইডের ডোর দিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল,,”এই রুপু উঠ।আর লিয়া তুমিও বসো।”

রুপন্তী উঠে বসে ডান দিকে চেপে বসে লিয়াকে ইশারা করলো।লিয়া গাড়িতে উঠতে যাবে সেই মুহূর্তে জারিফ লিয়ার দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,,”তুমি আমার সাথে যাবে।চলো।”

লিয়া এতক্ষণ চোরাচোখে জারিফকে দেখলেও এবার মুখটা ঘুরিয়ে সরাসরি জারিফের দিকে চাইল জারিফের চোখে চোখ রাখল।কোনো কথা না বলে পাঁচ সেকেন্ড পর মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসল।এদিকে জারিফের কথা না শোনায় জারিফের খুব রা’গ হতে থাকে।জারিফ মনেমনে আওড়ায়,আমি ওকে বললাম।ও আমার কথা কানেই তুলল না। কথাটা রাখা তো দূর কোনো প্রতিউত্তর করলো না।এভাবে ইগনোর করার মানে কি?

লিয়া গাড়িতে বসে শব্দ করে ডোর লাগিয়ে দেয়।মাঝে রুপন্তী তারপর জানালার পাশে রুপম।জারিফ ভাবনা থেকে বের হয় রোহানের কথায়।রোহান উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলো,,”জারিফ তোর সাথে শাওন যাবে।আমি এই গাড়িতে যাচ্ছি।আমি সামনে বসছি।”

“তুই আমার সাথে যাবি। এমনিতেই তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে।।”

রোহানকে বাঁধা দিয়ে জারিফ বলে উঠলো।রোহান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। ঠোঁট চেপে ফের বলল,,”কী কথা?”

“গাড়িতে গিয়ে বস।সব বলছি।”

বরের গাড়িতে গেলে কত্ত ভালো হতো।আর কিছু হোক বা নাহোক লুকিং গ্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে লিয়াকে দেখা তো যেতো।এই জারিফের জন্য সেটাও হলো না।আমার এইভালোলাগার ক্ষেত্রে জারিফ বারবার বাঁধা হয়ে আসছে কেনো? আশ্চর্য! জারিফের মতলবটা কী?এসব কথা মনেমনে বললেও মুখে কিছুই বলল না রোহান। বন্ধুর কথা মতো বন্ধুর গাড়িতে গিয়ে বসল।আর ভাবল,জারিফ তো ফা’জ’লা’মো করার ছেলে নয়। নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু বলার আছে।সেটাই বলবে হয়তো।গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথেই একসাথে অনেকের কন্ঠ আসলো

“শাদি মোবারক”

গাড়ি চলছে আবাসিক এলাকার পথ দিয়ে।একটু স্লো গতিতে।লিয়া জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে আওড়ালো, উফ্!জারিফ আপনি যদি কথাটা ফিসফিসিয়ে না বলে,অধিকার নিয়ে জোর গলায় সবার সামনে বলতেন।তাহলে আমি হাসি মুখে সাচ্ছন্দ্যের সাথে আপনার সাথে যেতাম।যেদিন আপনার মধ্যে অধিকার বোধ জাগ্রত হবে।সাথে যদি বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা,টান দেখতে পাই।সেদিন ফের নিজের মনোভাব প্রকাশ করবো।তার আগে নয়।

বিয়ে বাড়িতে প্রথমে খাওয়া দাওয়া পর্ব হয়। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষে বিয়ে পড়ানো শুরু হয়।জারিফ বাইরে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো।বিকেল অথচ রোদের তেজ দেখে মনে হচ্ছে মধ্যদুপুর।লোকজনের ভীড়ে গরমটাও একটু বেশিই লাগছে।খাওয়া দাওয়া শেষে গরম লাগায় একপাশে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায় জারিফ।এখানে এসে খাওয়ার সময় লিয়াকে দেখেছে তারপর আর দেখা হয়নি।লিয়া হয়ত ভেতরে আছে।জারিফের ভাবনার ছেদ ঘটে মেয়েলি স্টাইলি চিকন স্বর শুনে।

“হায়! মিস্টার জারিফ।কেমন আছেন?”

জারিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে ব্লাক কালারের জর্জেট শাড়ি পরনে দাঁড়িয়ে আছে কবিতা। বলাবাহুল্য ফর্সা গায়ে ব্লাক শাড়িতে এককথায় অসাধারণ লাগছে কবিতাকে।জারিফ স্বাভাবিকভাবে বলল,,”ওয়েল।এন্ড ইউ?”

কবিতা স্মিত হেসে কোমল স্বরে বলল,,”আ’ম ভেরি ওয়েল।”

কফি কালারের ক্যাট আই শার্ট।এ্যশ কালারের প্যান্ট ইন করে পড়া।পায়ে ব্লাক স্যু। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা।হাতের লোমগুলো ঘেমে পেশির সাথে লেপ্টে আছে। জারিফকে এইলুকে খুবই আকর্ষণীয় লাগছিলো।কবিতা একপল জারিফকে পরখ করলো। অতঃপর জারিফের মুখশ্রীতে শান্ত চাহনিতে চাইল।কন্ঠে একরাশ কোমলতা নিয়ে ফের ঠোঁট আওড়ালো,,
“তা বলুন মিস্টার জারিফ আমাদের আপ্যায়নটা কেমন লাগলো আপনার?আর আমাদের পরিবেশ প্লাস আমাদের বাসাটা কেমন লাগছে?”

জারিফ একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দাঁড়ালো।অন্যহাতে কপালের উপর আসা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেয়। স্মিত হেসে বলল,,”ভালো।খুব ভালো।”

কবিতা মুচকি হাসলো।ফের বলল,,”এতো ছোটো উত্তর।আমি তো ভেবেছিলাম আপনি লং উত্তর দিবেন।আমাদের এখানে এসে আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে সেসব বলবেন। সর্বোপরি এখানে না আসলে কি মিস করতেন?”

শেষের কথাটা জারিফের বোধগম্য হলো না।আর জারিফ বোঝার চেষ্টাও করলো না।জারিফ কপাল কুঁচকে বলল,,”আমি মানুষটাই স্বল্পভাষী।এইজন্য বোধহয় আমার অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারিনা। ভালো লাগছে আপনাদের এখানে এসে।আপনাদের পরিবেশটা এককথায় বললে অসাম।আর এখানে এসে খুব ভালো লাগছে।”

“থেংকিউ।”

কবিতা বাম হাতের উপর রাখা শাড়ির আঁচলটা ডানহাতের সাহায্যে একটু ঠিক করে নিল।লাল লিপস্টিক দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙিয়ে রাখা পাতলা ওষ্ঠদ্বয় নেড়ে চিকন স্বরে ফের বলল,,”সেদিন একটা কাজে আপনাদের ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম।আপনার রুমের সামনে দিয়ে গেলাম। আপনার রুম লকড দেখলাম আপনি বোধহয় সেইসময় ছিলেন না।আমি তো ক্যান্টিনে গেলেও মাঝে মাঝে আপনাকে খুঁজি।বাট আফসোস আপনাকে দেখা যায় না।”

“আমি ক্যান্টিনে খুব কমই যাই। খুব প্রয়োজন ছাড়া ওদিকটায় যাওয়া হয় না।”

“ওহ্।বাই দ্য ওয়ে কখনো এগ্রোনমি ডিপার্টমেন্টে গেলে আসবেন।চায়ের ইনভাইট আগাম করে রাখলাম।”

“থেংকিউ।”

কবিতা খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বিত গলায়ই বলল,,”আমরা তো এখন রিলেটিভ আবার একই ভার্সিটিতে একই প্রফেশনে আছি।তাই বলছি কখন কোন সময় দরকার পড়ে।সো কিছু মনে না করলে আপনার কন্টাক্ট নম্বরটা কি দেওয়া যাবে?”

জারিফ একশব্দে বলল,,”শিওর।”

জারিফ মোবাইল নম্বর বলতে থাকে কবিতা ফোনে নম্বর তুলতে থাকে।

বিয়ে পড়ানো দেখে লিয়ার সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে।নিজের বিয়ের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মনটা কেমন যেনো বিষিয়ে উঠলো। অস্থিরতার সৃষ্টি হলো।লিয়া অস্থিরতা কা’টা’নোর জন্য বাইরে আসে।বাইরে এসে গার্ডেন এরিয়ায় যায়।লিয়া কিছুটা সামনে তাকাতেই জারিফ আর কবিতাকে দেখতে পায়।একনজর দেখে লিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মনমস্তিষ্ক চম্বুকের মতো ঐদিকেই টানছে।লিয়া আবার ওদিকে তাকালো। আড়চোখে কবিতাকে পরখ করলো। ব্লাক জর্জেট শাড়িতে ফর্সা মেদহীন পেটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ব্লাউজের হাতটাও তুলনামূলক শর্ট।কি সুন্দর মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে জারিফের সাথে কথা বলছে।আবার দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুজনে নম্বর আদান প্রদান করছে।এটা দেখে লিয়া রাগে গজগজ করতে থাকে।লিয়ার সব রা’গ হচ্ছে জারিফের উপর।লিয়া অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,, অসভ্যলোক কোথাকার। বান্ধবীরা বলতো পুরুষ মানুষের নাকি কখনো নির্দিষ্ট শখের নারী হয়না।সব নারীই শখের হয়।একে দেখো তো এখন প্রুভ হয়ে যাচ্ছে কথা হানড্রেড পার্সেন্ট সত্যি।বউ থাকতে সুন্দরী মেয়ে দেখছে আর অমনি ছুকছুকানি স্বভাব ফুটে উঠেছে।বিয়ে বাড়িতে এসেই মেয়ে দেখে আলাপ শুরু করে দিয়েছে।আরেব্বাস এতো সবার থেকে আরো বেশি ফাস্ট দেখছি।এক ঘন্টা হলো না আসছে।আর এরমধ্যে কিনা সুন্দরী প্লাস হ’ট দেখতে একটা মেয়েকে পটিয়ে কন্টাক্ট নম্বর পর্যন্ত আদান প্রদান শুরু করছে। উফ্!উনার যে বিষয়টা আমাকে বেশি আকর্ষিত করতো।সেটা উনার হাই পার্সোনালিটি।আমি তো দেখছি বিসমিল্লাহই গলদ করে ফেলেছি।এর ক্যারেক্টার যে মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। এক ঘন্টার আলাপে যে কন্টাক্ট নম্বর নিতে পারে,সে যে একদিনে বেড পার্ট

এতটুকু বলে লিয়া জিহ্বায় কামুড় দেয়।নিজের মাথায় নিজেই বাম হাত দিয়ে হালকা থা’প্প’ড় দেয়।ফের ভাবে, উফ্!আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলছি নাতো?উনার সাথে তো দুই দুবার রাতে একাএকা আসলাম।কই খা’রাপের এতটুকুও আভাস টের পাইনি তো।আর উনি আমার বর।তাই না জেনে অহেতুক এরকম ভাবাটা পা’প হবে।তবে ছুকছুকানি নেচার কিছুটা আছে।এটা আমি অস্বীকার করতে পারছি না।এতএত মেয়ে থাকতে উনার কিনা ঠিক সুন্দরী দেখতে,ডানাকাটা পেট-পিঠ বের করা মেয়ের সাথেই খেজুরে আলাপ জুড়তে হলো। উফ্!লিয়া তোর একদম ফাটা কপাল।

মুখের উপর আসা চুলগুলো একহাতে কানের পাশে গুজতে গিয়ে হঠাৎ লিয়ার কানের দুলের সাথে কয়েকটা চুল আঁটকে যায়।চুলে টান লাগে।লিয়া ছড়ানোর জন্য দুইহাতে চেষ্টা করতে থাকে।জারিফ এড়িয়ে যেতে চাইলেও কবিতা এটাসেটা গল্প জুড়ে নিয়েছে।জারিফ হা হু করছে কবিতা নানান কথা বলছে।কিছুক্ষণ পর জারিফের নজর যায় গার্ডেনের পাশে লিয়ার দিকে।জারিফ কবিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“মিস কবিতা আমার একটু কাজ আছে।আমি আসছি।”

কবিতা হাসিমুখে বলল,,”ওকে।আর বিয়ে পড়ানো বোধহয় এতক্ষণে শেষ হয়েছে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো বিদায় হবে।আমাকেও এবার ভেতরে যেতে হবে। মিস্টার জারিফ আবার আসবেন কিন্তু। আপনার বন্ধুর সাথে মাঝে মাঝেই আসবেন।”

কবিতা কথাটা বলেই ভেতরে যেতে থাকে। উফ্ !জারিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে টানা পা ফেলে লিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।কোনো কথা ছাড়াই একহাতে লিয়ার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।লিয়ার কানের পাশে হাত দিয়ে চুল ছাড়িয়ে দেয়।লিয়া অবাক চোখে জারিফের দিকে চেয়ে রইলো। দুই সেকেন্ড খানেক পরেই কিছুক্ষণ আগে জারিফ আর কবিতার আলাপন দৃশ্য মনে পড়তেই লিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।দমে থাকা রা’গ টা ফের জেঁকে বসলো।ভিতরে ভিতরে লিয়া সাপের মতো ফুঁসছে।জারিফ সুগভীর শান্ত চাহনিতে লিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,,

“অনেক তো হলো বিয়ে খাওয়া।এখন তুমি আমার সাথে যাবে।আর আমি তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দেবো।”

লিয়া তড়িৎ বিস্ময়কর চাহনিতে চাইলো।কপাল কুঁচকে বলল,,”হোয়াট?কি বলতে চাইছেন?”

জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,”বাংলাতেই তো বললাম।বুঝতে পারোনি? ওকে ব্যাপার না একদম ডিটেইলসে বুঝিয়ে বলছি।আমি আজকে রাতে থাকছি না।তাই তোমারও থাকা হচ্ছে না।আর রোজ রোজ তোমাকে সিকিউরিটি দেওয়ার জন্য আমার থাকা সম্ভব নয়।সো আমি যেহেতু থাকতে পারছি না।আর তোমাকে ওভাবে ইনসিকিউর রাখাও আমার জন্য সম্ভব নয়।তাই ভেবে দেখলাম তোমার বাসায় যাওয়াটাই বেটার হবে।এখান থেকে সরাসরি তুমি আমার সাথে তোমার বাসায় যাবে।আর ইউ ক্লিয়ার?”

জারিফ মুখায়ব টানটান করে উত্তরের আশায় থাকে।লিয়া ভ্রু যুগল কুঁচকে কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলল,,”আপনি থাকতে পারবেন না তার জন্য আমার না থাকার সম্পর্ক কি? অদ্ভুত!আর কে বলেছে আমার সিকিউরিটি নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে?আমি সব সময়ই সিকিউর থাকি, হুম।আমাকে নিয়ে আপনার এই খামোখা হেডেক বাদ দিন।”

জারিফ বেশ স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো,,”কালকে রাতের কথা ভাবো।আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে বিষয়টা কেমন হতো?অতশত কথা বাদ দাও যা বলছি তাই করো।”

লিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,,”কালকে রিসেপশন।কালকে আব্বু আম্মু আসবে। আর আমি আব্বু আম্মুর সাথেই বাসায় ফিরবো। আপনার সাথে নয়,হু।”

“আন্টি আঙ্কেল আসবে।আর তুমি যদি রিসেপশনে আসতেই চাও আমাকে বলো আমি নিয়ে আসবো।তবুও তোমাকে এভাবে রেখে যাওয়া পসিবেল নয়।আর আজকে আমাকে বাসায় যেতে হবে। এক্সামের খাতা দেখা বাকি আছে। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে।সো আমি চাইলেও আজকে থাকা সম্ভব হবে না।আশাকরি আর বাড়তি কথা বলবে না।”

কথাটা শেষ করেই লিয়াকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জারিফ পিছন ঘুরে পা বাড়ায়।লিয়া একহাত উঁচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,”এইযে মিস্টার।”

জারিফ তড়িৎ পিছন ঘুরে লিয়ার দিকে চাইলো।বাম ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলল”কি হয়েছে?”

লিয়া ফাঁকা একটা ঢুক গিলে নেয়। অতঃপর একটু জড়তা নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,,”আপনি কে আমাকে এইভাবে হুকুম জারি করার, হুম?আর আমি কেনোই বা আপনার কথা শুনবো?আমি বাধ্য নই আপনার কথা শুনতে,হু। আপনার কোনো রাইট নেই আমাকে এইভাবে বলার।”

জারিফ লিয়ার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায়।লিয়ার সামনা-সামনি দাঁড়ায়।জারিফের মুখের এক্সপ্রেশন দেখা বোঝা যাচ্ছে না রেগে গিয়েছে নাকি স্বাভাবিক আছে।তবে লিয়ার নিজের কাছে খা’রাপ লাগছে আরেকটু ভদ্রভাবেও তো বলা যেতো এভাবে না বলে। উফ্!তখন থেকেই মাথাটা গরম আছে।ওনার খেজুরে আলাপন দেখে।জারিফের এভাবে এগিয়ে আসা দেখে লিয়া ঘাবড়াতে থাকে।এমনি গরম তার উপর টেনশনে লিয়া ঘামতে শুরু করে।লিয়া পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক দেখলো। নাহ্ পিছনে সরার জায়গা নেই। কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া।বাগানের ফুলগুলোর বেড়া পিছনে আর সামনে জারিফ।জারিফ লিয়ার সামনা-সামনি দাঁড়ালো।দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে একদম লিয়ার চোখে চোখ রাখল।জারিফের প্রতিটা নিঃশ্বাস লিয়া কাউন্ট করতে পারছে।লিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,,”ক কি হচ্ছে কি?সরে দাঁড়ান।”

জারিফ ভাবলেশহীন আছে।ওভাবে দাড়িয়েই নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,”নাতাশার মামী!তুমি ভালো করেই জানো আমার রাইট আছে কি নেই।তবে শুধুশুধু জোর করে অধিকার খাটানো আমার নেচার নয়।আর আমি এটা লাইকও করি না।নাতাশার মামীকে সেভ রাখা আমি আমার রেসপনসিবিলিটি মনে করি।”

লিয়া তাৎক্ষণিক বলে উঠলো,,”নাতাশার মামাও শুনে রাখুক,কেউ এই সো কল্ড দায়িত্ব পালন করুক।আমি সেটা কখনোই চাইনা।আমার এতটাও করুণ দিন আসেনি কারো দায়িত্ব হয়ে থাকার।”

জারিফ দুই আঙ্গুলে কপালে স্লাইড করে ছোট করে শ্বাস টেনে নিলো।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খানিকা মোটা স্বরে দাঁত চেপে বলল,,”এই তোমার সমস্যা কি বলোতো?যেকোনো কথাকে জটিল করে ফেলো কেনো?সব সময় একটা সাধারণ কথাকে তুমি জটিল বানিয়ে ফেলো। প্রবলেম টা কোথায় তোমার,হাহ?তুমি যেটা মিন করছো,আমি সেভাবে বলিনি।কোনো বিষয় তুমি সহজভাবে নিতেই জানো না।সব সময় সুন্দর পরিবেশটা ন’ষ্ট করে দেওয়ার উস্তাদ তুমি।”

জারিফের কথায় লিয়া হকচকিয়ে যায়।লিয়া অবাক হয়ে বোকাবোকা চোখে জারিফের দিকে চেয়ে রইলো।জারিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।পকেট থেকে টিস্যু বের করে লিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। ইশারায় মুখ মুছতে বলে।লিয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।লিয়া টিস্যু দিয়ে কপালটা মুছে নেয়।আচমকা জারিফ লিয়ার কপালে হাত দেয়।লিয়া একটু নড়ে উঠলো। ঠোঁট মেলে কিছু বলবে তার আগেই টের পেলো বিষয়টা।টিস্যু দিয়ে মোছার সময় কপালের টিপ টা খানিকটা সরে যায়।জারিফ দুই আঙ্গুলে তুলে আবার দুই ভ্রুয়ের মাঝে ঠিক করে বসিয়ে দেয় টিপ টা।জারিফ ফের শান্ত গলায় থ্রেট স্বরুপ বলল,,

“যাওয়ার সময় সুন্দর করে সোজা আমার গাড়িতে গিয়ে বসবে।আমি তোমার জন্য ওয়েট করবো।আশাকরি তুমি চাইবে না লোকজনের মধ্যে কোনো সিনক্রিয়েট হোক।”

জারিফ আর বাক্য ব্যয় না করে প্রস্থান করে।লিয়া জারিফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,,”সাহস নেই সবার সামনে বউ বলে পরিচয় দেওয়ার।আর এখানে আসছে অধিকার ফলাতে।আমিও আপনার সাথে যাচ্ছি না।দেখা যাবে আপনি কি করেন?হু।”

চলবে,,,

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২১

গোধূলি লগ্ন।পশ্চিম আকাশের বুকে সূর্য ঢলে পড়ছে। সন্ধ্যা নামনাম ভাব। কনে বিদায় পর্ব চলছে।বিদায় মূহূর্তে পরিবেশটা কেমন জানি ভারি হয়ে উঠেছে।রোজের বাবা রোজকে রুপমের হাতে তুলে দিয়ে একহাতে চোখের কোণে জমা পানিটুকু মুছে নিলেন। উপদেশ মূলক কিছু কথা রুপমকে বলতেই ওনার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে। প্রত্যেকটা বাবার কাছেই তার কন্যা সন্তান তার কাছে রাজকন্যা।নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের সাথে কিভাবে মানিয়ে চলবে।এই নিয়ে বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।রোজ বাবাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করতে থাকে।রোজের বাবা মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে এটাসেটা বলে সান্ত্বনা দেয়।বিদায়ক্ষণে বাবা মেয়ের এইদৃশ্য দেখে লিয়ার মুখটা মলিন হয়ে যায়।নিজের বাবার কথা মনে হতে থাকে। অজান্তেই দুচোখে পানি চলে আসে।এমন সময় পুরুষালী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই লিয়া হকচকিয়ে উঠলো।

“আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী।রোজ ভাবীর বিদায় দেখে ভাবী কি নিজের বিদায় ইমাজিন করছেন।সেইজন্য মুখটা মলিন হয়ে আছে।”

লিয়া চকিতে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ডান সাইডে ঘুরায়।লিয়ার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।লিয়া বিস্ময়কর চাহনিতে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকে।মানুষটাকে চিন্তে লিয়ার একমিনিটও সময় লাগে না।লিয়া ভাবে,এটা তো জারিফের ফ্রেন্ড। কিযেনো নাম।শুনেছি তো।উমম! মনে পড়েছে রোহান।তবে লিয়ার বোধগম্য হচ্ছে না।রোহান ভাবী বলে সম্বোধন করলো কিজন্য?লিয়ার মাথার মধ্যে এই একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।লিয়া যেনো কোনো জটিল সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত।লিয়া ভাবছে,ভাবী বলছে কোন দিক দিয়ে? অদ্ভুত!!তবে কি উনি আমার আর জারিফের বিয়ের বিষয়টা কোনোভাবে জানতে পেরেছে?কিভাবে জানলো? আশ্চর্য!!জারিফ বলেছে?লিয়ার ভাবনার মাঝেই রোহান হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকস টা লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,

“প্রচন্ড গরম পড়ছে।নিন ভাবী কোল্ড ড্রিংকস খান।”

ফের একই সম্বোধনে লিয়ার বিস্ময় যেনো কমার থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যায়।লিয়া অবাক হয়েই ক্ষীণ আওয়াজে ঠোঁট আওড়ালো,,”নো থ্যাংকস।”

এরমধ্যে রুপন্তী এসে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে তাড়া দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,,”এই লিয়া চল।সবাই তো গাড়িতে উঠে পড়ছে।চল এবার।”

লিয়া আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে রোহানকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির কাছে যায়।গাড়ির সামনে দেখতে পায় রুপম গাড়ির সামনে।জারিফ রুপমকে হাগ করে বললো,,”কনগ্রাচুলেশন দোস্ত।বেস্ট লাক ইউর কনজুগেল লাইফ।আই উইশ ইউর ফিউচার লাইফ ফুল ফিল উথদ জয়।খুব ইনজয় করলাম।আমাদের জন্যও দোয়া করিস, যেনো আমরাও সামাজিক জীবনে পদার্পণ করতে পারি।নতুন জীবন সুখের হোক এই কামনা করি। অবিরাম প্রশান্তিতে ভরে উঠুক তোর নিউ লাইফ।আবারো শুভ কামনা জানাই।”

রুপম হাসিমুখে বলল,,”থেংকিউ।”

জারিফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা একটু নুইয়ে জড়তা নিয়ে বলল,,” রুপম আজকে আমাকে বাসায় যেতে হবে।সরি আজকে থাকতে না পারার জন্য।কিছু কাজ পেন্ডিং আছে। ইমার্জেন্সি সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। প্লিজ, মাইন্ড করিস না।কালকে রিসেপশনে দেখা হবে।”

রুপম তড়িৎ বলে উঠলো,,”আরে ব্যাপার না। ঠিক আছে।”

রুপম একটু থেমে পাশে থাকা রুপন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,”রুপু গাড়িতে উঠ।রুপু তুই সামনে বস।আর লিয়া রোজের পাশে গিয়ে বসো।”

লিয়া খানিকটা দোটানায় আছে।কি করবে বুঝতে পারছে না।জারিফের কথামতো জারিফের সাথেই যাবে?নাকি রুপন্তীদের সাথেই?এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে।একবার জারিফের মুখশ্রীতে চাইলো।আবার কিছু ভেবে বর বউ এর গাড়ির দিকেই পা বাড়াল।এমন সময় লিয়ার হাতে টান পড়ে।আচমকা হাতে টান পড়ায় লিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে।মাথাটা ঘুরিয়ে দেখতে পায়।জারিফ একহাতে লিয়ার হাত ধরে রেখেছে।লিয়া কিছু বলার আগেই জারিফ রুপমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,

“রুপম লিয়া আমার সাথে যাবে।লিয়ার তো সামনের সপ্তাহেই এক্সাম। ওর নাকি অনেক কিছুই এখনো বাদ আছে।রিভিশন দেওয়া বাদ আছে।সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে।পড়া মিস যাচ্ছে। লিয়াকে আমি বাসায় ড্রপ করে দিবো।”

জারিফের এহেন কথাবার্তায় লিয়া আশ্চর্যের চরম লেবেলে পৌঁছে যায়।লিয়া অবাক হয়ে মনেমনে আওড়ায়,কি সুন্দর সাজিয়ে মন মতো বলছে। আজব!আমি কখন ওনাকে এসব বললাম।

জারিফ লিয়ার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে ঠোঁট আওড়ালো,,”চলো। যাওয়া যাক।”

রুপম রুপন্তী দুজনেই অবাক।জারিফ এখনো লিয়ার হাতটা ধরে আছে। রুপন্তী সেদিকে একবার চাইলো আবার লিয়ার দিকে। রুপন্তীর চোখেমুখে প্রশ্নের ঝুড়ি ঝুলছে।তবে প্রশ্ন করার মতো স্কোপ পাচ্ছে না।তাই চুপচাপ দর্শক হয়ে ড্যাবড্যাব করে শুধু চেয়ে আছে। রুপম বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে অবাক গলায় জারিফকে শুধালো,,”তুই লিয়াকে ড্রপ করবি?ঠিক বলছিস?”

জারিফ স্বাভাবিকভাবে সুন্দর করে এককথায় বলল,,”হ্যা।”

রুপমের চোখেও একই প্রশ্ন।তবে আশেপাশে লোকজনের জন্য প্রশ্নটা করে উঠতে পারছে না।জারিফ রুপমের মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝতে পারে কি বলতে চাইছে। জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,
“রোহানের থেকে জেনে নিস।রোহান সবটা জানে।এই রোহান রুপমকে সবটা বলিস। দোস্ত ভাবী গাড়িতে একা আছে।এসব ভাবা বাদ দিয়ে যা গাড়িতে উঠ। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে অলরেডি।”

তখন আসার সময় গাড়িতে জারিফ রোহান কে শর্টকাটে সবটা বলেছে। লিয়া আর ওর বিয়ের কথা।জারিফ রিলাইজড করতে পারে,যত সময় যাবে রোহান লিয়ার উপর তত দুর্বল হয়ে পড়বে।তাই সময় থাকতে থাকতে সত্যিটা বলে দেয়াই বেটার।বিয়ে হলো এমন একটা পবিত্র বন্ধন।যেখানে সৃষ্টিকর্তা অটোমেটিকলি দুজন নর ও নারীর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করেন।জারিফ নিজেও এখনো জানেনা লিয়াকে ভালোবাসে কিনা?বা লিয়ার প্রতি কোনো আ্যফেকশন তৈরি হয়েছে কিনা?তারপরেও লিয়া কে নিয়ে রোহানের পাগলামি।লিয়াকে নিয়ে ভালোলাগার কথা এসব রোহানের মুখে শুনতে জারিফের মোটেও ভালো লাগছিলো না।জারিফ প্রচন্ড জেলাস ফিল করছিলো।না চাইতেও অটোমেটিকলি রা’গ ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছিলো।তাই জারিফ রোহানকে সরাসরি সবটা বলে দেয়।তবে আজকাল জারিফের মনমস্তিষ্ক জারিফের অবাধ্য হয়েছে।কেনো জানি মনমস্তিষ্ক হুট করেই লিয়ার কথা স্মরণ করায়। লিয়ার কথা স্মরণ হতেই মনে হয় খুব কাছের কেউ। অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা আছে দুজনে।অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা আছে লিয়ার সাথে।লিয়ার কথা ভাবলেই অজানা অনুভূতি হয় হৃদয় কুঠরিতে।

জারিফ ফের লিয়ার দিকে সুগভীর শান্ত নজরে চাইলো। কন্ঠে একরাশ শীতলতা নিয়ে বললো,,”লিয়া।চলো।লেটস গো।”

লিয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না।কথা যেনো কন্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে আসছেই না।লিয়া অবাক চোখে চেয়েই জারিফের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।কয়েকপা এসে গাড়ির সামনে আসতেই জারিফ লিয়ার হাতটা ছেড়ে দেয়।গাড়ির ডোর খুলে লিয়ার দিকে চেয়ে ইশারা করে শান্ত কন্ঠে বলল,,”কিহলো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?উঠো।”

লিয়া কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে।লিয়ার গলায় কয়েকটা প্রশ্নরা জট পাকিয়েছে।তবে জড়তার জন্য লিয়া বলতে পারছে না। লিয়া দুইহাতের তালু ডলতে থাকে।জারিফ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।একপলক লিয়ার দিকে চাইলো।লিয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চায় আবার কোনো কারনে হয়তো বলতেও পারছে না। হেজিটেশন ফিল করছে হয়তো। স্ট্রায়িংয়ে হাত রেখে দক্ষতার সহিত ড্রাইভ করছে জারিফ।শান্ত নজরজোড়া পিচের রাস্তায় থাকলেও পাশে বসা লিয়ার দিকে মনোযোগ।লিয়া গাড়িতে বসে উসখুস করছে।দুজনের মাঝেই নিরবতা চলছে।নিরাবতা ভেঙ্গে জারিফ নরম গলায় লিয়াকে শুধায়,,

“কিছু বলবে? হেজিটেশন না রেখে যা বলার বলে ফেলো।আনসার দেওয়ার জন্য আ’ম রেডি।”

লিয়া তড়িৎ জারিফের মুখপানে চাইলো। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো। লিয়া এবার জমে রাখা প্রশ্নগুলোকে কন্ঠনালী ভেদ করে ঠোঁট প্রসারিত করে আমতা আমতা করে বলেই ফেললো,,”ইয়ে মানে আপনার বন্ধু আমাকে ভাবী বললো কেনো?না মানে আপনি কি বলেছেন?আর সবার সামনে ওভাবে বললেন।মিথ্যে কেনো বললেন?আমি কখন আপনাকে ওসব বললাম? আশ্চর্য!!”

জারিফের দৃষ্টি সামনে।জারিফ মৃদু হাসলো।জারিফের শব্দহীন হাসিটা লিয়ার কাছে খুব চমৎকার লাগলো। ইশশ্!কি সুন্দর দুর্দান্ত মারাত্মক হাসি। যেকোনো মেয়ে দেখলেই এই হাসিতে নির্ঘাত ঘায়েল হয়ে যাবে ।এইযে লিয়া ড্যাবড্যাব করে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জারিফের মুখায়বে। উত্তরের কথা লিয়া বেমালুম ভুলে বসে আছে।লিয়া তো জারিফকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে আছে।জারিফ দৃষ্টি সামনে রেখেই ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাঁসি নিয়ে মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়ালো,,”বুঝেছি বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে তোমার পেট ভরেনি।তাইতো এখন চোখ দিয়ে আমাকে

“মোটেই না।আপনি ভুল ভাবছেন।আমি তো আমার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় আছি। এছাড়া কিছুই না।”

জারিফের কথা শেষ করতে না দিয়ে লিয়া কথার মাঝেই ব্যাঘাত ঘটিয়ে চঞ্চল কন্ঠে একনাগাড়ে কথাগুলো বলল।জোর করে কথাগুলো বললেও লিয়া ভিতরে ভিতরে লজ্জা আর অস্বস্তিতে নুইয়ে পড়ছে।সত্যিই তো ড্যাবড্যাব করে জারিফের দিকে তাকিয়ে ছিলো।কি লজ্জাকর অবস্থা। উফফ!মানুষটার দৃষ্টি পিচের রাস্তায়। অথচ কিকরে বুঝলো লিয়া তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে?আবার লজ্জায় ফেলতে এহেন কথা।যা শুনে লজ্জায় লিয়ার মাটির তলায় লুকোতে ইচ্ছে করছে।জারিফ ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে একপল তাকালো। অতঃপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। কন্ঠে গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললো,,

“আমার বন্ধুর ভাবী ডাক তোমার পছন্দ হয়নি।নাকি আমার বন্ধুর মতো তুমিও অন্যকিছু ভাবছিলে। কোনটা?”

জারিফের শেষের কথা লিয়া বুঝতে পারলো না।লিয়া অবাক হয়ে ফের প্রশ্ন করে উঠলো,,”বুঝলাম না।অন্যকিছু মানে?কি বলতে চাইছেন?”

“যাকগে বাদ দাও এসব।আর কিযেনো বলছিলে।উম!ও মিথ্যে কেনো বললাম।তাইতো? মাঝে মাঝে এরকম হোয়াইট টক বলা যায়।যে মিথ্যায় অন্যর যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।আর কাউকে সেভ রাখা,কারো ভালোর জন্য দুই একটা হোয়াইট টক বলা যেতেই পারে।”

একটু থেমে ফের বললো,,”আর তুমি।যার কিনা আজ বাদে কাল বোর্ড এক্সাম। পড়াশোনার কোনো প্যারা নেই।চিলমুডে বিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছো।”

ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে।জারিফের গাড়ি এসে লিয়াদের কোয়ার্টার এর সামনে থামে।লিয়া সিট বেল্ট খুলতে থাকে।জারিফ গাড়ির দরজার লকড খুলে দেয়। লিয়া খুলে নেমে পড়ে।লিয়া ঘুরে জারিফের জানালার পাশে এসে সৌজন্যতার খাতিরে ভদ্রভাবে নম্রস্বরে বললো,,”ভেতরে আসুন। আম্মুর সাথে দেখা করে যাবেন।”

জারিফ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,,”আজ নয়।এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। এখন ফাস্ট বাসায় যেতে হবে। বললাম তো তোমাকে আজ রাতের মধ্যে খাতাগুলো দেখে শেষ করতে হবে।”

লিয়া ছোটো করে বলে,,”ইটস্ ওকে। আসি।”

আসি বলে লিয়া যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।কয়েক পা এগিয়ে যেতেই শান্ত গলার মোহনীয় ডাকটা শ্রবণেন্দ্রিয়ে বারি খেতেই লিয়ার পা থেমে যায়।লিয়ার মনটা শিহরিত হয়ে উঠলো।জারিফ দুইহাত স্টেয়ারিংয়ের উপর রেখে জানালা দিয়ে লিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

“লিয়া।”

নিজের নামটা আজ নতুন জারিফের মুখে শুনছে এমন নয়।তবে এযাবৎ কালের ডাক আর আজকের ডাকের মাঝে যেনো আকাশ পাতাল ফারাক ছিলো লিয়ার কাছে। ছোট্ট করে এই ডাকটা আজ অদ্ভুত শোনালো লিয়ার কাছে। নিউরনে সাড়া জাগাতেই লিয়ার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।লিয়া একটু সময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফের দিকে চাইলো।জারিফের সাথে চোখাচোখি হলো।লিয়া দৃষ্টি নুইয়ে নেয়।জারিফ স্মিত হেসে বললো,,

“সরি।তোমাকে ওভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে আসাতে। প্লিজ রা’গ করো না। আমাদের ফ্যামেলি কনজারভেটিভ। ওভাবে গার্ডিয়ান ছাড়া একলা অত লোকজনের মাঝে থাকা এটা আমি নিজেও লাইক করি না।আমার আচরণে কষ্ট পেলে,এ্যগেইন সরি।আর তোমার সামনে এক্সাম পড়াশোনায় কন্সানট্রেট করো।মাথা থেকে সব রা’গের ভূত,জিদ ঝেড়ে ফেলো,কেমন।

একটু থেমে,,”আন্টি আঙ্কেল কে আমার সালাম দিও।
বায়।টেক কেয়ার।”

লিয়া মাথাটা তুলে জারিফের দিকে শান্ত চাহনিতে চাইলো। কোমল স্বরে বললো,,”ব্যাপার না।ঠিক আছে।থ্যাংকস।বায়।”

লিয়া উপরে উঠে একহাতে কলিং বেল চেপে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকতেই রাজিয়া সুলতানা দরজা খুলেন।দরজা খুলে লিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হন।দরজার সামনে দাঁড়িয়েই অবাক গলায় শুধালেন,,”কি ব্যাপার লিয়া এইসময় তুই?এখন কিকরে আসলি?তোর না কালকে আমাদের সাথে আশার কথা।তবে এখন?আর রাতে কার সাথে এসেছিস? আশ্চর্য হচ্ছি লিয়া তোর সাহস দেখে।একাএকাই চলে এসেছিস নিশ্চয় তাও এই রাতের বেলা।”

রাজিয়া সুলতানা শেষের কথাগুলো বেশ শক্ত গলায় বললো।সাথে ওনার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে।লিয়ার থেকে উত্তরের আশায় থাকে।লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।একহাত কপালে রেখে বললো,,

“ওহ্! আম্মু।থামবে এবার একটু।আরে আমাকে আগে বলতে দিবে তো।তা না। উফ্!”

রাজিয়া সুলতানা ফের শক্ত কন্ঠে ঠোঁট আওড়ালেন,,
“কি বলবি শুনি?যখন যা মন চায় তাই তো করে বেড়াচ্ছিস।দিনদিন তোর এই অধঃপতন দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।”

লিয়া চোখ বন্ধ করলো।মৃদু শ্বাস টেনে নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলল,,”আমি একা আসিনি।তোমার জামাই দিয়ে গিয়েছে আমাকে। বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে শুনে নিও।”

রাজিয়া সুলতানা কপাল কুঁচকে ঠোঁট আওড়িয়ে বললেন,,”জামাই।কোন জামাই?কার কথা বলছিস?বুঝতে পারছি না।”

লিয়া এবার বি’রক্ত হলো। ঠোঁট চেপে বলল,,”আম্মু।তোমার কয়টা মেয়ে আছে বলোতো?আমি ছাড়া তোমার আরো এক বা একাধিক মেয়ে আছে নাকি?”

রাজিয়া সুলতানা এবার বিষয়টা খানিকটা বুঝতে পারলেন। বললেন,,”জারিফ।জারিফের সাথে তোর দেখা হলো কিভাবে?”

“উনার ফ্রেন্ড রুপম ভাইয়া।”

“ওহ্! বুঝলাম।তা আজকেই আসলি যে।শরীর খা’রাপ করছে কি?নাকি কোনো সমস্যা হয়েছে।”

শেষের কথাটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন। লিয়া এবার একটু থতমত খেয়ে বসে।মা-কে কি বলবে?বুঝতে পারছে না। লিয়া মায়ের প্রশ্ন সুক্ষ্মভাবে এড়িতে যেতে বলে,,
”কোনো সমস্যা বা শরীর খা’রাপ কোনোটাই না।এমনি ভালো লাগছিলো না। ওহ্! আম্মু এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি।তোমার মতলবটা কী?আমায় বলো তো দেখি।ভিতরে যেতে দেবে না নাকি?”

মেয়ের কথাশুনে রাজিয়া সুলতানা মৃদু হাসলেন।দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন।লিয়া ভেতরে যেতে যেতে ফের বললো,,”ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুম প্রয়োজন।”

রাজিয়া সুলতানা দরজা লকড করে দেন। মনেমনে আওড়ায়,জারিফ পৌঁছে দিয়েছে লিয়াকে।তবে কি ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।যাতে ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়।আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক লাইফ লিড করতে পারে।
.
জারিফ বাসায় গিয়ে বেল চাপতেই জারা এসে দরজা খুলে দেয়।ভেতরে যাওয়ার সময় ড্রয়িংরুমে দুজনকে দেখে কপালে খানিকটা ভাঁজের সৃষ্টি হয়।জারিফ কার্টেসির খাতিরে দাঁড়িয়ে যায়।সালাম দিয়ে বলে,,

“ফুপ্পি কেমন আছো?কখন আসছো?”

কল্পনা বেগম আর উনার একমাত্র মেয়ে কথা সোফায় পাশাপাশি বসে।অপর পাশে জাহানারা বেগম।নীল সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে। কল্পনা বেগম মৃদু হাসলেন।হাসি মুখেই বললেন,,

“আমি ভালো আছি বাবা।তা ফুপ্পি সেই বিকেলে আসছে।তোর তো দেখাই নেই।কথা এসে থেকে তোর কথা বারবার ভাবীকে জিগ্গেস করছে। বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলি নাকি?”

জারিফ ছোট করে বলে,,”হুম।”

কথা পায়ের উপর পা তুলে হাঁটুতে দুইহাত রেখে বসে ছিলো।জারিফকে উদ্দেশ্য করে কোমল স্বরে ঠোঁট মেলে বললো,,”ভাইয়া কেমন আছো?”

জারিফ একশব্দে বললো,,”ওয়েল।”

কল্পনা বেগম ভরাট গলায় বলতে শুরু করলেন,”জানিস জারিফ কথা তো আনন্দ মোহন কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। ইংলিশে চান্স পেয়েছে।কথা মেসে থাকতে চেয়েছিলো।আমি ভাইকে ফোন করে বললাম,ভাই কথার জন্য একটা ভালো দেখে মেস দেখে দাও তো। পরিবেশটা যেনো ভালো হয়।ওমা!আমি বলার সাথে সাথেই ভাই কি বলে উঠলো,কথা মেসে উঠবে কেনো?আমাদের এখানে থাকবে।জানিসই তো ভাইয়ের কথা আমি কখনো ফেলতে পারিনা।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইয়ের কথামতো কথা কে এখানে থাকতে রাজি করালাম। কথা তো রাজি হচ্ছিলোই না।অনেক করে বলার পর মেয়ে আমার রাজি হলো।মেয়ের এককথা লোকে কি বলবে,মামুর বাড়িতে থাকলে। আমিও অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম একা একটা মেয়েছেলে মেসে না থাকাই ভালো।তাইতো জোর করে বলে কয়ে কথাকে এখানে নিয়ে এনেছি।আর ভাবলাম নীলও একই কলেজে পড়ে।আপাতত প্রথম প্রথম নীল নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখেশুনে দিবে।”

নীল আড়চোখে কথার দিকে চাইলো। দাঁত কিড়বিড় করে মনেমনে আওড়ালো,, উফ্!বড় আব্বুকে ফোন করে বলতে গিয়েছে।বড় আব্বু তো সৌজন্যতার খাতিরে এখানে থাকার কথা বলবেই।তাই বলে ঢ্যাং ঢ্যাং করে থাকতে চলে আসবে।আর আমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এই ন্যাকারানিকে নিয়ে কলেজে যাবো। উফ্!আর কেউ না জানলেও আমি ভালো করেই জানি। ব্রো এর বিয়ের কথাশুনে ন্যাকারানি রা’গ করে বিয়ে খেতে আসেনি।এখন যে কোনো মতলবে এসেছে আমি শিওর।

জারিফ কল্পনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে নম্রস্বরে বললো,,”ভালো করেছো। ফুপ্পি আমি খুব ক্লান্ত।পড়ে কথা বলবো,কেমন।”

যাওয়ার সময় জারিফ জাহানারা বেগমকে ডেকে বললেন,,”মা চারুকে দিয়ে এক মগ কফি দিও তো।”

জাহানারা বেগম”ঠিক আছে” বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় কথা চঞ্চল গলায় বলে উঠলো,,”বড় মামী তুমি বসে থাকো। রেস্ট করো।আমি কফি বানিয়ে দিয়ে আসছি।”

জাহানারা বেগম সরু চোখে কথার মুখপানে চাইলেন।কিছুটা বিস্ময়কর কন্ঠে বললেন,,”তুমি?”

কথা উঠে দাঁড়ায়।মাথা নাড়ায় যার অর্থ হ্যা। এরমধ্যে নীল ফোন স্ক্রল করতে করতে ফোড়ন কে’টে বললো,,”তুমি কফি বানাবে?চিনি আর লবণের মধ্যে কোনটা চিনি আর কোনটা লবণ চিনতে পারবে তো?”

নীলের কথা শুনে কথার ভীষণ রা’গ হয়।এইছেলে ইঁতুড়ে স্বভাবের তা জানা আছে কথার।কথা এক আঙ্গুল নাকের সাথে ঘষে নেয়। স্পষ্ট রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,”নীল তোমার এরকম কেনো মনে হলো?সুগার এন্ড সল্ট এর ডিফারেন্স আমি করতো পারবো না,হু।”

নীল সোজা হয়ে বসলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,,
”আমার তো মনেহয় তুমি স্যাডো, ফাউন্ডেশন, আইলানার,উম!এককথায় সাজগোজের যা কিছু আছে সেসব ছাড়া অন্যকিছু তেমন চেনোই না।বলতে গেলে সাজগোজ ছাড়া এর বাইরের জগৎ এর সাথে তোমার কোনো সম্পর্কই নেই।”

কথা কাঁদো কাঁদো ফেস করে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,,”বড় মামী নীলকে চুপ করতো বলো, না।ও কিন্তু বেশি বেশি বলছে,হুম।”

জাহানারা বেগম ধমকের সুরে বললেন,,”আহ্!নীল হচ্ছে কি?থামবি।আর কথা মামনি তোমাকে এই গরমের মধ্যে কিচেনে যেতে হবে না।আমি কফি বানাচ্ছি।তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না।তুমি পড়াশোনার জন্য আসছো।মন দিয়ে পড়াশোনা করো।”

কথাটা বলে জাহানারা বেগম কিচেনে চলে যান।কথা কটমট চোখে নীলের দিকে তাকালো।নীল সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো, কখনো একগ্লাস পানি ভরে খেতে যাকে দেখেনি।সে কিনা আগ বাড়িয়ে বলছে কফি বানাবে।ভাবা যায় উফ্! ফুপ্পি তো একমেয়ে বলে বেশি আদর দিয়ে একটা ন্যাকার গোডাউন বানিয়েছে নিজের মেয়েকে।
.
আজকে শুক্রবার।কাল বাদে পরশু রবিবার থেকে লিয়ার পরীক্ষা শুরু। পশ্চিম আকাশ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।দূরে আকাশের বুকে একঝাঁক পাখি ডানা মেলে চলছে।হয়তো তাদের নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উঠা কফির মগে চুমুক দেয় লিয়া।লিয়া আশায় আছে আজ না হোক কাল একবার অন্তত জারিফ ফোন করবে।অল দ্যা বেস্ট জানাবে। পরীক্ষা নিয়ে কিছু সুন্দর সুন্দর উপদেশ বাণী আওড়াবে। ইশশ্!লিয়ার এই ভাবনাটা এখনো পূরণ হচ্ছে না জন্য লিয়ার মনটা ভীষণ ভীষণ খা’রাপ লাগছে। আত্মীয়-স্বজনের প্রায় সবাই ফোন করে এটাসেটা উপদেশ দিচ্ছে।অথচ যার একটা কলের জন্য চাতক পাখির মতো লিয়া অপেক্ষা করছে।তার কল আসার নাম গন্ধও নেই।কাল অব্দি সময় আছে। এরমধ্যে কাংখিত ব্যক্তির কল আসবে কি?এই একসপ্তাহে জারিফকে আরো বেশি করে খুব করে মনে পড়ছে লিয়ার।লিয়া ভাবে ওনার কি আমার কথা মনে পড়ে না?হয়তো বা না।কারন মনে পড়লে একবার না একবার তো অন্তত একটা কল দিতে পারতো।লিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই রুমে থাকা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো।লিয়া কফির মগ হাতেই রুমে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।রিসিভ করে ফোনের ওপাশ থেকে লিয়া যা শুনলো।তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।লিয়ার হাত থেকে কফির মগটা শব্দ করে পড়ে যায়।ভারি মগটা কয়েক টুকরো হয়ে ফ্লোরে ছিটে পড়ে।লিয়ার পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছে।

চলবে,,,