সুখের ঠিকানা পর্ব-৩৮+৩৯

0
193

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৮

মধ্য দুপুর। সূর্যালোকের তাপে অস্থির পৃথিবীর প্রাণীকূল।এতক্ষণ ক্লাস রুমে ফ্যানের নিচে থাকার ফলে গরমের তীব্রতা এতোটা উপলব্ধি হয়নি। লাঞ্চ টাইমে বাইরে বের হতেই গায়ে জ্বলন ধরার মতো অসয্য গরম লাগছে সবারই।গরমে লিয়ার কপালে ঘাম জমেছে।কপাল থেকে ঘামের রেখা গাল বেঁয়ে পড়তে থাকে।লিয়া টিস্যু দিয়ে ঘামটুকু মুছে ফেলল।অরিন দুইহাত দুলিয়ে হেলেদুলে হাঁটছে।সাথে চোখেমুখে একরাশ খুশি তার।তেমনি উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

“আ্যই লিয়া।বলতো স্যার আমাদেরকে কিজন্য দেখা করতে বলেছে?স্যার কি বলতে পারে গেস কর তো।”

লিয়া হাঁটার গতি স্লো করল।অরিনের দিকে একপল চাইল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,”আই ক্যা’ন্ট গেস এবাউট দিস।”

অরিন ঠোঁট উল্টালো।মুখটা শুকনো করল।কিছু বলবে এমন সময় পুরুষালী মোটা কণ্ঠস্বর আসল,

“ফাস্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট?”

লিয়া অরিন দু’জনে কপাল কুঁচকে চাইল। লিয়া ছোট করে বলল,”হ্যা।”

লোকটা ফের বলল,”আপনারা নিশ্চয় লিয়া আর অরিন। ফারহান স্যার আপনাদেরকে ওনার চেম্বারে ডেকেছেন।”

গবেষণাগারের একজন কর্মচারীকে দিয়ে লিয়াদেরকে বলতে পাঠায় ফারহান। তিনচারটা ছেলে মেয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখানে লিয়া-অরিনের খোঁজ করতেই।ওখান থেকে একটা মেয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দেয়। অতঃপর লোকটা লিয়াদেরকে জিজ্ঞেস করে।কথাটা বলেই লোকটা হনহন করে চলে যায়।লিয়া আর অরিন ফারহানের রুমের দিকে যেতে থাকে।ফারহানের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনে কার্টেসি মেইনটেইন করে। নম্রস্বরে অরিন বলল,”স্যার আসতে পারি?”

ফারহান ওর চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ছিলো।একহাতে কপাল চেপে ধরে কিছু ভাবছিলো।এমন সময় মেয়েলি গলার স্বর শুনে মাথাটা কিঞ্চিৎ তুলে চাইল।খানিকটা দূরত্বে সামনাসামনি দরজা হওয়ায় স্পষ্ট অরিন লিয়াকে দেখতে পায়। ফারহান হালকা কেশে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

“শিওর।আসো।”

লিয়া-অরিন দু’জনে এগিয়ে যায়। ফারহান সোজা হয়ে বসল। দুইহাত ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখল।অরিন লিয়া টেবিলের সামনে চেয়ার রাখা। চেয়ারের কাছাকাছি দাঁড়াল।অরিন গমগমে স্বরে বলল,

“স্যার আপনি তো লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে দেখা করার কথা বলেছিলেন।আমরা তো এখন ক্যান্টিনেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ এখন এখানে ডেকে পাঠালেন।”

ফারহান একটু অপ্রস্তুত হলো। নড়েচড়ে বসল।গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“আসলে আমার হঠাৎ করে একটা কাজ পরে গিয়েছে।আমাকে একটু পরেই বাইরে যেতে হবে।আর তোমাদেরকে বলে ফেলেছিলাম।তোমরা নিশ্চয় ওয়েট করবে।সেই কথা ভেবেই এখন তোমাদেরকে এখানে ডাকা।”

লিয়া ভ্রু যুগল কুঁচকে নিশ্চুপ রয়।অরিন স্মিত হাসল।ফের ঠোঁট আওড়ালো,”ব্যাপার না,স্যার।”

ফারহান কাঠের টেবিলের সামনে থাকা ড্রয়ারটা একহাতে খুলল।সেখান থেকে একসাথে এ্যড করা কয়েকটা পেপার বের করল। টেবিলের উপর রেখে একহাতে পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে বলল,

“অরিন সেদিন বলছিলে তোমার নাকি**চ্যাপ্টারে প্রবলেম আছে।আমার কাছে এটার নোট ছিলো।তাই ভাবলাম তোমার কাজে লাগবে হয়ত।এটা রাখতে পারো।আশাকরি সামান্যতম হলেও কাজে দিবে।”

অরিনের চোখ ছানাবড়া হওয়ার ন্যায় হয়েছে।অরিন ভাবে, বাহবা স্যার আমার বলা কথাগুলো মনে রেখেছে। সেইজন্য আবার নোটও দিচ্ছে। এতোএতো ব্যস্ততা সব কিছুর মধ্যেও স্যার আমার কথাটা মনে রেখেছে।শুধুই কি এমনি এমনি?নাকি ডাল মে কুচ কালা হে?আমার মতো সামথিং সামথিং নয় তো?অরিন ভাবুক ভঙ্গিতে এসব ভাবতে থাকে।লিয়া বিস্মিত হয়ে ভাবছে,স্যারের তখন দেখা করার কথা বলার কারন কি তবে এটাই ছিলো?তবে কেনো জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। শুধু নোট দেওয়ার হলে তো স্যার তখনই সরাসরি বলতে পারতো। ব্রেক আওয়ারে নোট নিতে এসো।যাগগে যা হওয়ার হোক।ব্রেনে চাপ দিয়ে এসব ভাবার কোনো মানেই নেই।এসব মনেমনে ভেবে মাথা ঝাড়ল লিয়া।অরিনের দিকে সরু চাহনিতে চাইল।অরিনের চোখমুখ খুশিতে চকচক করছে।লিয়া ফের মনেমনে আওড়ায়,স্যারের সাথে কথা বলার অজুহাতে যেখানে সেখানে দেখা হলেই এই প্রবলেম,ঐ প্রবলেম।এই বিষয়টা বুঝতে পারছি না হেনোতোনো প্রবলেমের কথা বলতো এই অরিন।আর কিছু হোক বা নাহোক। না চাইতেই ফ্রিতে ভালোভালো নোট পেয়ে যাচ্ছে অরিন।এটা ভেবে লিয়া আড়ালে মুচকি হাসল।অরিন নিজেকে ধাতস্থ করল।ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“থেংকিউ স্যার। থেংকিউ ভেরি মাচ্।”

ফারহান বিনিময় অমায়িক হাসল।লিয়া তৎক্ষণাৎ মৃদুস্বরে বলল,”স্যার এবার আমরা আসি তাহলে।”

“ওকে।”

লিয়া সালাম দিয়ে প্রস্থান করতে থাকে।অরিন বি’র’ক্তি’ক’র শ্বাস ফেলে লিয়ার পিছুপিছু পা বাড়ায়।দুই মানবীর যাওয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারহান। অতঃপর টেবিলের উপরে থাকা পেপার ওয়েটটা একহাতে ঘুরাতে থাকে। ফারহান তখন হুট করেই লাঞ্চে দেখা করার কথা বলে ফেলে। পরক্ষণে ঠান্ডা মস্তিষ্কে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়।এভাবে লিয়াকে প্রোপোজ করা মোটেই ঠিক হবে না।যদিও এখন আধুনিক যুগ।সবাই সরাসরি সামনাসামনিই মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ফেলে।তবে টিচার হয়ে স্টুডেন্টকে এভাবে বলা ভালো দেখায় না।আর মেয়েটাকে দেখে আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা মনেহয়। বর্তমান সময়ের সাথে আধুনিকতার নামে বেহায়ায়পনা, উগ্রভাবে চলাচল করে না।মেয়েটা চালচলনে, বেশভূষায় বেশ মার্জিত। কথাবার্তায়ও তার যথেষ্ট আদব কায়দা প্রকাশ পায়।মোটকথা হাইলি পার্সোনালিটি, স্ট্রং ক্যারেক্টার সম্পুর্ণ একটা মেয়ে ‌।তাকে এইভাবে প্রোপোজ করলে বিষয়টা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।তাই ফারহান ভেবেচিন্তে মত বদলায়।ভাবে কয়েকদিন পর বাড়ি যাবে। বাড়িতে বলে তারপর ফ্যামেলির মাধ্যমে প্রস্তাব রাখবে।আর তখন যেহেতু দেখা করার কথা বলে ফেলেছিলো।তাই বিষয়টা ম্যানেজ করতে,অরিনকে নোটের কথা বলে। যেহেতু অরিন এর আগে কথা বলার সময় পড়াশোনার বিভিন্ন প্রবলেম এর কথা বলেছে।

অরিন লিয়ার সাথে দরজা অব্দি আসার আগেই ফিসফিসিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,”এই লিয়া। এখানে তো ফ্যানের বাতাসের নিচেই ছিলি।এই গরমে বাইরে থাকার চেয়ে শতগুণ বেটার ছিলো না কি?তোর তো সয্য হলো না অমনি আসি আসি।মুখে শুধু একটা শব্দ তোর।স্যারের সাথে একটু গল্প জুড়তে পারতাম। ধ্যাত!ভালো লাগে না।”

লিয়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আছে। অরিনের কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। এইমেয়ে এখন ভা’ঙ্গা টেপ রেকর্ডারের মতো কিছুক্ষণ বাজতেই থাকবে। আর এই অসয্য রেকর্ডারের ঘ্যানঘ্যান অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিয়াকে টলারেট করতে হবে।

জারিফ বাইরে যাচ্ছিল।এমন সময় করিডোরে একজন সিনিয়র টিচারের সাথে দেখা হয়।স্যারের সাথে পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলতে থাকে। স্যারটা জারিফের টিচার ছিলো।তবে বর্তমানে কলিগ।তবুও জারিফ সম্মান দিয়ে স্যার বলেই সম্মোধন করে।এমন সময় দৃষ্টি কিছুটা দূরে ডান দিকে যেতেই লিয়াকে দেখতে পায়।লিয়া আর অরিন ফারহানের রুম থেকে বের হচ্ছে। লিয়া আগে অরিন পেছনে।অরিন দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আরেক নজর ফারহানের দিকে চায়।লিয়া কয়েক কদম এগিয়ে ছিলো।ফলে লিয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।অরিন পেছনে থাকায় লিয়ার আড়ালে পরে। লিয়াকে ফারহানের রুম থেকে বের হতে দেখে জারিফের কপালে জ্যামিতিক রেখার ন্যায় কয়েকটা সরু ভাঁজের সৃষ্টি হয়।লিয়া ফারহানের রুম থেকে বের হচ্ছে।তবে ভাবে কোনো দরকার ছিলো হয়তো।বিয়ষটা নিয়ে জারিফ আর বেশি ঘাটে না।ফের স্যারের সাথে কথায় মনোযোগ দিয়ে যেতে থাকে।
.
পরেরদিন,,
আজকে লিয়াদের প্রাকটিক্যাল ক্লাস আছে। প্রথম দিন হওয়ায় ক্লাস টিচার স্টুডেন্টদেরকে সাথে করে নিয়ে যায়।ফারহান স্টুডেন্টসদেরকে সাথে করে এগ্রোনমির ফিল্ডে নিয়ে যায়। এগ্রোনমিতে প্লট করা আছে। কয়েকটি দলে ভাগ করে দেওয়া হয়।সব দলের টার্গেট থাকবে সর্বোচ্চ প্রোডাকশন।

অরিন ফারহানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবদার করে বলল,”স্যার আমাকে আর লিয়াকে কিন্তু একদলে রাখবেন।না হলে আমি কিন্তু খেলবো না।উপসস সরি! প্রাকটিক্যাল ক্লাসে কোনো কাজই করবো না, হুঁ।”

লিয়া একহাতে কপালে হালকা করে চা’প’ড় দিলো।অরিনের এহেন বাচ্চামো কথায় ফারহান হেসে ফেলল।কথা শুনে মনেহয় মেয়েটার মধ্যে এখনো ম্যাচিউরিটি আসেনি।আর নয়তো ইচ্ছে করে এমন ফান করে।এসব ভেবে মাথা ঝা’ড়’ল ফারহান। কিয়ৎকাল পরে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।আমি বলে দিবো। তোমাদের দু’জনকে একসাথে যাতে রাখে।”

“থেংকিউ স্যার।এইজন্য তো আপনাকে এতো ভালোবা

এতটুকু বলে অরিন জিহ্বায় কামুড় দিলো।লিয়া আড়ালে মুখ টিপে হাসতে থাকে।ফারহানের নজর,ধ্যান লিয়ার দিকে থাকায় ফট করে অতটা খেয়াল করেনি অরিনের কথা।তবে কয়েক সেকেন্ড পরে মস্তিষ্কের নিউরনে সাড়া জাগাতেই চোখ বড়বড় হয়ে যায়।অরিন একহাতে মাথা চুলকিয়ে জোর করে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“আপনি আমাদেরকে কত্ত হেল্প করেন। এইজন্য তো আপনাকে আমি আমার ফেবারিট টিচার ভাবি।এখন অব্দি পছন্দের টিচারের তালিকায় আপনিই শীর্ষে আছেন স্যার।”

ফারহান সৌজন্যমূলক হাসল। অতঃপর কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ডেমোনেস্টেটরের দিকে এগিয়ে গেলো।যিনি কেবলই এখানে আসতে নিচ্ছিলেন। ফারহান স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলতে থাকে।

অরিন আকাশের দিকে চাইল।আবার লিয়ার দিকে চেয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
“ধ্যাত!কেনো যে টেকনিক্যাল ভার্সিটিতে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম।এতোএতো ক্লাসের প্যারা ভালো লাগে না।আবার শুরু হলো প্রাকটিক্যাল। উফ্ফ!এই লিয়া এই কাঠফাঁটা রোদ্দুরের মধ্যে আমি শেষ হয়ে যাবো।ও আম্মু!বাসায় থাকলে এতক্ষণ এসির মধ্যে পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রল করতো তোমার মেয়ে।সেখানে কিনা চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তোমাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে।শুধু কি তাই!এখন তো কৃষকের মতো ক্ষেতের কাজ করতে হবে।সব কিছু জেনেশুনে তুমি এ কোথায় ভর্তি হতে আমাকে ইন্সপায়ার্ড করেছিলে।”

অরিন বিলাপের সুরে এক্টিং করে কথাগুলো বলে।লিয়া কপাল কুঁচকে বলল,”তোর এখানে না থেকে।তোর থাকা দরকার ছিলো ভেটেরিনারি সায়েন্সে। সেখানে থাকলে গ’রু’র একবার একটা লাথি খেলে তোর মাথার ছেঁ’ড়া তাঁর গুলো আরেকটু ছিঁ’ড়’তো।আর নয়তো ধাক্কায় জয়েন্ট লাগতো। তাহলে যদি একটু বুদ্ধি শুদ্ধি হতো।উফ্!এসব কিছু না হলেও আমি অন্তত বাচতাম।সারাদিন কানের পাশে এরকম ন’ষ্ট ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে টেপ রেকর্ডারটা অন্তত বাজতো না।”

অরিন একগাল হেসে বলল,”আরে জানু।তুই ক্ষেপছিস কেনো?হুয়াই?আ’ম জোকিং ইয়ার।আমি তো মজা করে এসব বলছিলাম।এই দেখ বাঙালি কৃষক কাকে বলে?কত প্রকার?ও কি কি?সব আজ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে প্র্যাকটিক্যালি দেখিয়ে দেবো, হুঁ।আমি একজন খাঁটি বাঙালি কৃষক,হু।”

এই বলে অরিন পায়ের দিকে জিন্স প্যান্টটা গুটাতে থাকে।লিয়া তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,”এই কি করছিস কি?হ্যা।ছেলেরাসহ,ডেমোনেস্টেটর স্যার তারপর সাহায্যকারী চাচারা পর্যন্ত কাজ ফেলে তোর ফর্সা লোমহীন পা দেখতে থাকবে।কতদূর অব্দি গুটাচ্ছিস? খেয়াল আছে।”

অরিন ধপ করে গোটানো অংশটা ফের গোড়ালি পর্যন্ত রাখল। ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,”হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে একদম কৃষক কৃষক ফিলিংস আনতে চেয়েছিলাম।বাট তোর কথায় আর ফিলিংস আনতে পারলাম না। গোড়ালি থেকে মাত্র তিন ইঞ্চি উপর অব্দি হতে না হতেই তুই তো হইহই করে উঠলি।”

লিয়াদের দলের একটি মেয়ে ওদের দু’জনকে ইশারা করে আসতে বলল।লিয়া পায়ের জুতাটা খুলতে থাকে।লিয়া একটু হামু দেয়।এক পায়ের সাথে অপর পা একটু উঁচু করে রেখে জুতার বেল্ট খুলতে থাকে।

ফারহানের নজর এমন সময় লিয়াদের দিকে যায়। লিয়া প্লাজুটা কিঞ্চিৎ তুলে পায়ের জুতা খুলছে।লিয়ার পায়ে থাকা পায়েলটা রোদের আলোতে ঝলমল করছে।লিয়ার ফর্সা পায়ে চমৎকার দেখাচ্ছে।পায়েলটার সাদা পাথরগুলো রোদের আলোতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।পায়েলটা বেশি ডিজাইন করা নয়।তবুও এই সাদা পাথরগুলো যেনো পায়েলটাকে নজরকাড়া করে তোলে সবার কাছে।পায়েলটার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।আর যার পায়ে পায়েলটার স্থান নয়তো সেই মানবীর জন্যই আরো বেশি নজরকাড়ে সবার কাছে। ফারহান দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়।

লিয়া জুতা খুলে রাখতে থাকে।এমন সময় প্লাজুর থেকে এড়ানো একটা সুতা পায়েলের সাথে আঁটকে যায়।লিয়া ছাড়ানোর জন্য হেঁচকা টান দেয়।সুতা ছিঁড়ে আসে।সাথে পায়েলের অংশও কে’টে যায়।তবে সামান্য একটু অংশ বেঁধে থাকে। যেকোনো সময় খুলে পড়তে পারে এমন অবস্থায় আছে। লিয়া আর অতটা খেয়াল করেনি।গরমে লিয়ার কপাল বেঁয়ে ঘাম ঝরছে।সাথে গলাটাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। লিয়া জিহ্বা দিয়ে ঢোক গিলে গলাটা ভিজে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালালো।এক আঙ্গুলের সাহায্যে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,

“আমার তো এখনই প্রচন্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। উফ্!গলা শুকিয়ে আসছে।”

অরিন একহাত উঁচু করে খানিকটা দূরে দেখিয়ে বলল,”ঐযে ঘাসের উপর আমার ব্যাগ দেখতে পাচ্ছিস ।আমার ব্যাগে দেখ ওয়াটার বোটল আছে। যা এক দৌড়ে খেয়ে আয় কেমন।”

লিয়া অবশেষে পানি খেতে আসল। বোতলটা উঁচু করে ঢকঢক করে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়।বোতলটা ব্যাগে রেখে আসতে থাকে।খালি পায়ে হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো।পরে থাকা ছোটছোট পাথর,ইটের কিংবা মাটির টুকরায় ব্যাথা লাগছিলো।এমন সময় একটা ইটের টুকরায় হোঁচটও খায়।ওদিকে অরিন তাড়া দিচ্ছে।তাই কোনোদিকে না তাকিয়ে লিয়া হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর, ফারহান শুধুশুধু আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যাবে মনঃস্থির করে।ফারহান প্রস্থান করতে থাকে।কয়েক পা হাটার পর ঘাসের উপর কিছু চিকচিক করতে দেখে। কৌতুহলি নজরে ফের ভালো করে চাইল।এমন সময় পাথরের পায়েল দেখতে পায়। পাথরগুলো দেখে মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করে এইরকম পাথর যুক্ত পায়েল কোথায় দেখেছে। পরক্ষনেই মনেহয় লিয়ার পায়েই তো। সম্ভবত এটা লিয়ারই হবে। সযত্নে পায়েলটা মাটি থেকে তুলল। ফারহান মনেমনে আওড়ায়,এটা নিশ্চয় লিয়ারই হবে। অতঃপর ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে চাইল। অনেকটা দূরত্বে লিয়াকে দেখল।সবার মাঝে লিয়া আছে তাই ভাবল,একদম শিওর-ও না পায়েলটা লিয়ারই কিনা।কারন একই রকম পায়েল আরো কারো থাকতেই পারে।তাই এখন সবার মাঝে না বলাই বেটার হবে।পরে পাছে লিয়া অরিনের সাথে দেখা হলে পায়েলটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে লিয়ার কিনা।এই ভেবে ফারহান পায়েলটা পকেটে রাখল।আর কাজ থাকায় দ্রুত চলে যায়।

প্রাকটিক্যাল ক্লাস শেষে লিয়া অরিন একসাথে হেঁটে আসছে। অরিন ঢকঢক করে পানি খেয়ে বোতলটা ব্যাগে রাখতে যাবে।সেই সময় লিয়া ইশারা করে পানির বোতলটা চাইল।লিয়া একহাত বাড়িয়ে দিল। অরিন লিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

“বাহ্!লিয়া তোর আংটিটার ডিজাইন বেশ সুন্দর তো।আমি ভেবেছি সেইম ডিজাইনের আংটি অর্ডার করব।আর দেখি দেখি আংটিটার উপরে কিছু লেখা মনে হচ্ছে।”

লিয়া স্মিত হেসে হাতটা অরিনের সামনে মেলে ধরল।ভাব নিয়ে বলল,”এটা আমার বরের দেওয়া গিফট।আমার বরের পছন্দ করা । সুন্দর তো হতেই হবে।”

জারিফ’স ওয়াইফ লেখাটা মুখে আওড়ালো অরিন। অতঃপর চঞ্চল গলায় বলল,”তারমানে তোর বরের নাম জারিফ।রাইট?”

লিয়া দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।অরিন ঠোঁট বাঁকিয়ে ফের বলল,”কবে মিট করিয়ে দিবি তোর বরের সাথে?এত সুন্দর যার পছন্দ!না জানি সেই মানুষটা দেখতে কত্ত সুন্দর!”

লিয়া নিঃশব্দে হাসল।অধর প্রসারিত করে বলল,
“আগামী রবিবার। বিয়ের কার্ড অলরেডি ছাপাতে দেওয়া হয়েছে।এই শুক্রবার দেবে হয়তো।রবিবার ক্যাম্পাসে এসে বিয়ের কার্ড তোকে দেবো।সাথে আমার বরকেও তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।”

“ওকে জানু।আমি তো খুব এক্সাইটেড। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম কাংখিত রবিবারের।”

ক্লাস শেষ করে লিয়া ক্যাম্পাসের গেইটের সামনে দাঁড়ায়।অরিন লিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে রিকশা নিয়ে চলে যায়।লিয়াকে নিতে ড্রাইভার এখনো আসেনি।লিয়া ফোন হাতে কল দিতে যাবে এমন সময় ঠান্ডা গলার আদেশ স্বরুপ বার্তা এলো,

“ড্রাইভার আঙ্কেল আসবে না।চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।আমার সাথে চলো।”

লিয়া ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে জারিফকে দেখতে পেলো।সাদার উপর কালোর চিকন বর্ডারের শার্ট,কালো প্যান্ট ইন করে পরা। কপালের উপর স্লিকি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ির মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।এই লুকে জারিফকে খুব আকর্ষণীয় লাগছে।লিয়া জারিফের মুখায়বে শান্ত চাহনিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। কিয়ৎক্ষন পরে লিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করে উঠলো,

“আঙ্কেল আসবে না।সে খবর আপনি কিভাবে জানলেন?”

জারিফ লিয়ার পাশে দাঁড়ালো। ত্যাড়া করে বলল,”যা বললাম তাই করো।আমি কিভাবে জানলাম সেটা তোমার না জানলেও চলবে।”

লিয়া মুখ বাকালো।দুইহাত বুকে গুঁজে স্ট্রেইট দাঁড়াল।কিছু বলবে তার আগেই জারিফ ধমকের সুরে বলল,”এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।আমার কাজ আছে। তাই দেরি না করে চলো।”

কথাটা বলে জারিফ হনহন করে গাড়ির কাছে হেঁটে যেতে থাকে।লিয়া অবাক হলো।বুকে গুঁজে হাত দুইটা ঝা’ড়ি দিয়ে ফেলল।একটু রা’গ হলো জারিফের বিহেভে। একবার মনে হলো রা’গ করে যাবে না জারিফের সাথে।আবার কিছু ভেবে হাঁটা ধরল।জারিফের পিছুপিছু হাঁটতে লাগল।লিয়াকে ভাবাচ্ছে জারিফকে কেমন জানি গম্ভীর লাগছে।উনি কি কোনো কারনে রে’গে টেগে আছেন নাকি?লিয়ার ভাবনার মাঝেই জারিফ গাড়ির ডোর খুলে লিয়াকে বসতে বলল। লিয়া গাল ফুলিয়ে উঠে বসল।জারিফ অপর পাশে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।লিয়া জারিফের দিকে তাকালো না।জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।জারিফ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বলল,

“এরপর থেকে তুমি আমার সাথেই আসবে।সকালে রেডি হয়ে নিচে থাকবে।আমি তোমাকে নিয়ে আসবো।আবার দিয়ে আসবো।”

লিয়া অবাক হলো।তবে সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না। দৃষ্টি অন্যদিকে রেখেই বলল,”হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত।কারনটা জানতে পারি?”

জারিফ দক্ষতার সাথে গাড়ি চালাচ্ছে। দৃষ্টি গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে রাস্তায়।পাশে বসা লিয়াতে সম্পূর্ন মনোযোগ তার। তড়িৎ বলল,”হঠাৎ নয়। প্রথম থেকেই তোমাকে বলেছিলাম। বাট তুমিই না করেছিলে।আর সেই সময় আমার এক্সাম ছিলো।তারপর থিসিসের ডাটা কালেক্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।তাই জোর করে বলিনি।তবে এখন যেহেতু আপাতত বাড়তি পেশার নেই।তাই ভাবছি নিজের বউয়ের সব দায়িত্ব ধীরে ধীরে নিয়েই নেই।”

লিয়া কিছু না বলে চুপচাপ ঠাঁই বসে রইল।বাকি রাস্তা দু’জনে নিশ্চুপ রয়।বাসার সামনে গাড়ি এসে থামে।জারিফ বলল,”আমি আন্টিকে ফোন দিয়ে ড্রাইভারকে আসতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম লিয়া আমার সাথে আছে।আমি দিয়ে যাবো।এখন তোমার কাজ থাকবে তুমি বাসায় আমার কথা বলবে।আমি যখন এখন ফ্রি আছি।তাই আমিই একেবারে তোমাকে নিয়ে ভার্সিটিতে যাবো।একটু ঘোরা হবে তবে ব্যাপার না।”

লিয়া স্বাভাবিকভাবে”ঠিক আছে” বলে। অতঃপর জারিফকে ভেতরে আসতে বললে, জারিফ না করে। অন্যসময় আসবো বলে।লিয়াও আর জোর করে না।
.
সন্ধ্যার পর ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়ে টিভি দেখছিলো নীল।এমন সময় নাতাশা ড্রয়িং খাতা আর বক্স হাতে এসে দাঁড়াল।নীল শুয়ে থেকেই নাতাশাকে দেখে দুষ্টুমির স্বরে বলল,”কি খবর নাতাশা বেবি।আজকেও বোধহয় বাতাসা পাওনি।সেই দুঃখে মুখটা ভার করে রেখেছো বোধহয়।”

নাতাশা শব্দ করে বক্সটা টি টেবিলের উপর রাখল।নাক মুখ কুঁচকে টেনেটেনে বলল,”উফ্ফ!নীল মামু আবার বাতাসা।”

নীল এবার উঠে বসল।নাতাশার গালটা একহাতে টেনে দিয়ে বলল,”আচ্ছা আর বলবো না বাতাসার কথা।তো বলো তোমার মুখটা এরকম বাংলা পাঁচের মতো হয়ে আছে কেনো?কেউ তোমাকে ব’কে’ছে?আমাকে নামটা বলো আমি খুব করে তাকে ব’কে দেবো।”

নাতাশা একবার ডানদিকে তো আবার বামদিকে ঘাড় ঘুরালো।না বোধক উত্তর দিলো। তারমানে কেউ ব’কে’নি।”

নীল ফের প্রশ্ন করল,”তাহলে কি হয়েছে সোনা?মন খা’রাপ দেখাচ্ছে তোমার।”

নাতাশা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,”ড্রয়িং করতে পারছি না।খালামনির পরীক্ষা।খালামনি পড়ছে।তাই খালামনিকে ডিস্টার্ব করিনি।এদিকে কথা খালামনিকে বললাম সে বলল পারবে না।মামাও তো বাসায় নেই। নানুমনি রান্নারুমে কাজ করছে।এখন আমাকে ড্রয়িংটা শেখাবে কে?”

নীল সোজা হয়ে বসল।নাতাশার হাত ধরে নিয়ে নিজের পাশে বসালো।হাসিমুখে বলল,”আমি আছি তো।আমি ড্রয়িং শেখাচ্ছি।কি আঁকতে হবে একবার বলো। আমি দারুণ করে এঁকে দিচ্ছি।”

নাতাশা চোখ উপরের দিকে উল্টিয়ে বলল,”তুমি?”

নীল একটু অবাক হলো। এইটুকু বাচ্চা মেয়েটাও আমার উপর ভরসা করতে পারছে না।এ জীবন রেখে আর কি লাভ। উফ্!যেখানে চুল পরিমাণও দাম নেই।আমার তো কচু গাছের সাথে ফাঁ’স দিয়ে ম’র’লেও এই দুঃখ মিটবে না। এসব কথা মনেমনে আওড়ায় নীল। অতঃপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“কি আঁকতে হবে আগে বলো। আঁকিয়ে দেখিয়ে দেই।নীল কেমন ড্রয়িং পারে।”

“উড়ন্ত পতাকা আঁকতে হবে।”

স্কেল, পেন্সিল নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে আঁকতে থাকে নীল।রঙ শেষ করে নীল নিজেই চোখ করে দেখতে থাকে।এমন সময় কলিংবেল বাজায় জাহানারা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দেন।জারিফ সন্ধ্যার আগে একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলো।এখন ফিরল। ড্রয়িংরুমে নীল আর নাতাশাকে দেখে সোফায় এসে ধপ করে বসল। নাতাশা ড্রয়িং খাতাটা জারিফের সামনে মেলে ধরল। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,

“মামা।এটা নীল মামু এঁকেছে।কেমন জানি ঠিক লাগছে না।”

জারিফ নীলের দিকে একবার চাইল।নীল মুখটা কাচুমাচু করল।জারিফ নাতাশাকে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে।এটা রাখো।আমি করে দিচ্ছি।”

জারিফ নতুন করে আঁকতে থাকে।নীল এঁকেছে উড়ন্ত পতাকার মাঝে ঢেউ দেয়নি। স্কেল ধরে সোজা করে এঁকেছে। জারিফ নাতাশাকে দেখিয়ে বলছে আর আঁকছে। স্কেল দিয়ে খুঁটি একে।খানিক দূরতে দুইটাকরে একটু বাঁকিয়ে টান দিয়ে বাঁশের গিরা নাম বলছে।নাতাশা উৎসুক হয়ে দেখছে।খুটিতে কালার করার সময় জারিফ হলুদ রঙ নেয়।নীল তড়িৎ বলে উঠলো,
“এই ব্রো বাঁশ সবুজ রঙের থাকে না।তুই হলুদ রঙ দিচ্ছিস কেনো?এই ক্ষেত্রে তুই আমার থেকে পিছিয়ে পড়লি।দেখ আমি কিন্তু বাঁশে সবুজ রঙ দিয়েছি। নিশ্চয় আমারটা ঠিক।”

জারিফ চোখ তুলে নীলের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,”পাকা বাঁশের রঙ কি কালার হয়? সাধারনত পাকা বাঁশই থাকে। কাঁচা বাঁশ নয়।কারন পাকা বাঁশই সবাই ব্যবহার করে কাঁচা বাঁশের থেকে।”

“আমার ড্রয়িং বইয়ে তো ইয়োলো কালারই আছে নীল মামু।তুমিই তো উল্টাপাল্টা রঙ করেছো।”

নাতাশা দুইহাত কোমড়ে রেখে বলল।নীল ফের বলল,”আরে আমারটা বাঁশ না ভেবে ভাবো লোহার তৈরি খুঁটি।আর লোহার তৈরি খুঁটিতে যেকোন রঙ দিলেই হয়।মূল কথা তো পতাকাটা কিছুর সাথে আঁটকে রাখা। সেখানে একটা কিছু হলেই হলো।”

“হুম।সেখানে আমার মনেহয় বাঁশের জায়গায় ব্যাম্বুর মতো লম্বা দেখতে আমাদের নীলের সাথে আটকে রাখলে আরো ভালো হবে।”

কথাটা বলতে বলতে জারা এগিয়ে আসে।নীল চোখ পাকিয়ে জারার দিকে তাকাল।জারা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় ধপাস করে বসল। এরমধ্যে জাহানারা বেগম এসে জারিফকে বললেন,

“জারিফ।”

জারিফ ছোট করে বলল,”হ্যা মা বলো।”

জাহানারা বেগম সিঙ্গেল সোফায় বসলেন।বললেন,”কাল বা পরশু জুয়েলার্সে যাবো ভেবেছি। তাই বলছি লিয়াকে নিয়ে আসিস,কেমন?ওর পছন্দ অনুযায়ী সব কিছুর অর্ডার দিয়ে আসবো।হাতে তো আর বেশি সময় নেই। এরমধ্যে একএক করে সব কেনাকাটাও করে ফেলতে হবে।”

“আচ্ছা।”
.
পরেরদিন,
ডীন স্যার সকল টিচারদের নিয়ে***মিটিং এ বসেছিলেন। মিটিং শেষে ডীনের ভবন থেকে সবাই একএক করে বাইরে যাচ্ছেন।কারো কারো ক্লাস থাকায় ক্লাস নিতে চাচ্ছে।কেউ কেউ নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে। মিটিং শেষে কবিতা আর ফারহান পাশাপাশি হেঁটে আসছে।আর বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে।এমন সময় জারিফকে দেখতে পেয়ে কবিতা আগ বাড়িয়ে কথা বলল।জারিফ সৌজন্যতার খাতিরে দাঁড়িয়ে পড়ল।কবিতা ফারহান কে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। ফারহানের সাথে কবিতার দেখা সাক্ষাৎ হলেই হাই,হ্যালো কুশলাদি বিনিময় হয়।ফারহানকে দেখে জারিফ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল।এই একটা ব্যক্তিকে কেনো জানি জারিফের কাছে এলার্জি লাগে।জমিজমা, টাকা-পয়সা বা কথাকাটাকাটি কোনো কিছু নিয়েই বিরোধ নেই।তারপরেও অজান্তেই ফারহানকে দেখলে বি’রক্ত লাগে জারিফের।কয়েকবার লিয়ার সাথে কথা বলতে দেখার পর থেকেই এই রকম অটোমেটিক বিরক্ত বোধ করে জারিফ ফারহানকে।লিয়ার সাথে অরিনও থাকে তারপরেও জারিফের কাছে বিষয়টা ভালো লাগে না। জারিফ জোর করে মুখে হাসির রেখা টেনে আনে। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে থাকে।এমন সময় ফারহানের পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট থাকায় কেঁপে উঠল। ফারহান পকেট থেকে ফোনটা বের করতে গিয়ে ফোনের সাথে পকেটে থাকা পায়েলটা বের হয়ে নিচে পরে যায়। তড়িঘড়ি করে ফারহান পায়েলটা তুলতে নেয়।জারিফের দৃষ্টি যায় নিচে পড়া পায়েলের দিকে।ফারহান দ্রুত তুলে ফের পকেটে রাখতে নেয়। কবিতা টিপ্পনি কে’টে বলল,

“কি ব্যাপার? মিস্টার ফারহান। মেয়েদের পায়েল আজকাল পকেটে নিয়ে ঘুরছেন।বিয়ষটা তো মোটেই সুবিধার ঠেকছে না। দ্রুতই বিয়ের ইনভাইট পাচ্ছি নাকি।নাকি ডুবে ডুবে জল খেয়েই যাবেন।কোনটা?”

“দোয়া করবেন।যাতে দ্রুত ইনভাইট করতে পারি। আচ্ছা আমি একটু আসছি।”

হাতের ফোনের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে ফারহান দ্রুত বিষয়টা এড়িয়ে গেল।কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ফারহান চলে যেতে থাকে। প্রথমে মিটিং থাকায় আগে ডীন স্যারের এখানে আসে। এখনো লিয়া বা অরিন কারো সাথেই দেখা হয়নি ফারহানের।তাই পায়েলটা ফেরত দিতে পারেনি এখনো।জারিফের যেনো বিস্ময় কাটছেই না।জারিফের তীক্ষ্ণ নার্ভ বলছে পায়েলটা হুবহু লিয়ার পায়েলের অনুরুপ।এটা কি লিয়ার?লিয়ার হলে ফারহানের কাছে গেলো কিভাবে?এই প্রশ্নগুলো জারিফের মনে উঁকি দিতে থাকে।

.
জারিফ নিজের কক্ষে গিয়ে চেয়ারের হেডে ঘাড়টা রাখল। বারবার ভাবতে লাগল। অবশেষে জারিফ সিদ্ধান্ত নেয়।আগে লিয়ার কাছ থেকে পায়েলের খবর জানতে হবে।লিয়ার পায়ে পায়েল আছে কি নেই?কারন একই পায়েল আরো অনেকের থাকতেই পারে। জারিফের যেনো আর তর সইছে না। জারিফ একজন কর্মচারীকে দিয়ে লিয়াকে ডাকতে পাঠায়।লিয়ার ফোনে কল দেয়। কিন্তু রিসিভ হয়না।হয়তো ফোন ব্যাগে সাইলেন্ট করা আছে।কারন ভার্সিটিতে আসলে লিয়া সবসময় ফোন সাইলেন্ট রাখে এটা জারিফ জানে।

একটা ক্লাস শেষে লিয়া আর অরিন বসে এটাসেটা কথা বলছে।লিয়া আফসোস করে বলছে তার পায়েলটা গতকাল বাসায় যাওয়ার পর থেকে আর পায়ে দেখতে পায়নি।হয়তো বাইরেই হারিয়েছে। এমন সময় একজন এসে বলল,

“এনাবুল জান্নাত খাঁন লিয়া কে?”

লিয়া উঠে দাঁড়াল।বলল,”আমি।”

“আয়মান জারিফ স্যার আপনাকে ডেকেছেন।”

কথাটা হলে লোকটা চলে গেলো।কিছু স্টুডেন্ট বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব করছে।কেউ আবার রুমেই।লিয়ার পিছন থেকে ব্যাকা করে এক মেয়ে বলে উঠল,

“এদের হয়েছে টা কি?গতকাল ফারহান স্যার ডাকল।আজকে জারিফ স্যার।সব ইয়াং টিচাররা এ’কেই কেনো নিজ চেম্বারে ডাকছে।ব্যাপার স্যাপার কি?”

“কিছু মেয়েদের চরিত্রও এরকম।সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো।সব ইয়াং স্যারেরা রুপ দেখে ফিদা হয়েছে হয়তো।”

কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল মেয়ে দুইটা।রাগে লিয়ার চোখমুখ লাল হয়ে যায়।

চলবে,,,

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৯

রা’গে লিয়ার ফর্সা মুখটা মূহূর্তেই লাল হয়ে যায়।চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।লিয়া চোখ বন্ধ করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।অরিন দাঁত কিড়মিড় করে মেয়ে দুইটাকে উদ্দেশ্য করে কড়া কিছু বলবে। এমন সময় লিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে নিষেধ করল।অরিন রাগে গজগজ করতে করতে নিশ্চুপ রইল।তবে কিছু কড়া কথা পেটের ভেতর গুড়গুড় করছিলো।এই লিয়া ইশারায় বারণ না করলে অরিন এতক্ষণ উপযুক্ত পাল্টা জবাব দিয়ে ডিটারজেন্ট ছাড়াই ক্লিন করে দিতো,হু।অরিন মনেমনে এসব ভাবতে থাকল।লিয়া পিছন ফিরল।মেয়ে দুইটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

“তোমরা সব কিছু জানো না।আর না জেনে এরকম কথাবলা সাজে না।কারন না জেনেশুনে কিছু বললে সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।আর এই মুহূর্তে তোমরা যেটা বললে,তা বলে নিজেদের কুরুচিপূর্ণ মনের প্রকাশ ঘটালে।একজন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে হলে,আগে তার সম্পর্কে জানা জরুরী।আর অবশ্যই জানাটা সঠিক হতে হবে।তুমি মনে করলেই,ভাবলেই সেটা রাইট হবে না। নোংরা কথা বলে নিজেদের নিচু মনেরই পরিচয় দিলে।এটা হচ্ছে কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। এছাড়া ভালো কিছুই খুঁজে পেলাম না তোমাদের কথায়।যার মন মানসিকতা যেমন,তার চিন্তা ভাবনাও তো সেরকমই হবে।”

লিয়ার কথাশুনে মেয়ে দুইটার মুখটা থমথমে হয়ে যায়। প্রত্যুত্তরে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না।সাথে অপমানিত বোধ করল।লিয়া ঠান্ডা মস্তিষ্কে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে এতে অরিন মনেমনে লিয়াকে বাহবা দেয়।মেয়ে দুইটা বেশ লজ্জিত হয়। দৃষ্টি আপনাআপনি নত হয়ে যায়।লিয়া আর কোনো বাক্য প্রয়োগ না করে অরিনকে ইশারা করল যাওয়ার জন্য।অরিন ইতস্তত বোধ করে না করল। লিয়া এক প্রকার জোর করেই অরিনকে সাথে নিয়ে আসতে লাগল। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় ফারহানের সামনা-সামনি পরে। লিয়া সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নেয়।এমন সময় ফারহান ডেকে উঠল,

“এই লিয়া?ওয়ান মিনিট, ওয়েট।”

লিয়া পা থামল।ঘাড় ফিরালো।অরিন চিকন ভ্রু যুগল কুঁচকে চাইল। ফারহান দু কদম এগিয়ে আসল। ফারহান পকেট থেকে পায়েল টা বের করে লিয়ার সামনে মেলে ধরল।কিছুটা জড়তা নিয়েই বলল,

“ইয়ে মানে এটা তোমার?”

লিয়া পায়েলটা দেখে অবাক হলো। সাথে খুশিও হলো বটে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস পাওয়া গেলে সবারই ভীষণ ভালো লাগে।হোকনা সেটা সামান্য দামী তাতে কি?আর এই পায়েলটা লিয়ার অনেক দিনের।রাজিয়া সুলতানা বানিয়ে দিয়েছিলেন। খুঁজে না পাওয়াতে লিয়ার ভীষণ মন খা’রাপ হয়েছিলো। এখন নিজের পায়েলটা ফারহানের হাতে দেখে লিয়ার চোখমুখ খুশিতে চকচক করে উঠল। পরক্ষণে কিছু ভেবে ঠোঁট কামড়ে ধরল।অবাক গলায় নম্রস্বরে ফারহান কে উদ্দেশ্য করে শুধালো,

“স্যার এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

ফারহান স্মিত হাসল।সে বলল,”কোথায় পেয়েছি সেটা বড় কথা নয়‌। আগে বলো তোমার কিনা?”

লিয়া দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক বলল। ফারহান লিয়ার হাতে পায়েল টা ধরিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এগ্রোনমির ফিল্ডে পেয়েছিলাম। মনে হলো তোমার পায়ে হয়তো দেখেছিলাম।তুলে রেখেছিলাম। ভাবলাম আগে তোমার থেকে শুনে নেই।তারপর তোমার না হলে গবেষণাগারের কোনো কমর্চারীর কাছে দিতাম।ওরা যা হয় তাই করতো।যাকগে,আমার ফাস্ট ধারণা তবে ঠিক হলো।এটা তোমারই।”

লিয়া মৃদুস্বরে বলল,”থ্যাংকস স্যার।এটা আমার খুব প্রিয় ছিলো।”

ফারহান বিনিময় মৃদু হাসল। অতঃপর নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।লিয়া-অরিন দু’জনে জারিফের দিকে যেতে লাগল। রুমের কাছাকাছি আসতেই অরিন বলল,

“আ্যই লিয়া।আমি এখানে ওয়েট করছি।তুই ফাস্ট স্যারের সাথে দেখা করে আয়,কেমন।”

লিয়া বলার জন্য বলল,”তুইও চল।”

অরিন দুদিকে মাথা ঘুরালো। তৎক্ষণাৎ বলল,”উঁহু!স্যার তোকে ডেকেছে তুই যা।আমার নাম তো আর বলেনি।সো আমি ভেতরে যেতে পারবো না, ইয়ার।তবে স্যারের উপর ভরসা হচ্ছিল না।সেদিন মাত্র টেন মিনিটস দেরি হওয়ার জন্য পানিশমেন্ট দিলো।তাই তোকে একলা ছাড়তে ইচ্ছে করলো না। সেইজন্য এই পর্যন্ত তোর সাথে আসলাম।যা গিয়ে দেখ স্যার কি বলে।স‌্যারের খা’রাপ কোনো ইন্টেনশন থাকলে তুই সেসবের ছিটে ফোঁটাও যদি টের পাস।সাথে সাথে আমাকে ডাকিস।তখন আমি রকেটের গতিতে হাজির হবো।আমি বাইরে আছি।”

অরিনের কথা শুনে লিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো।আর কথা না বলে লিয়া চোখের পলক ফেলল।ইশারায় ঠিক আছে বোঝায়। অতঃপর পা বাড়ায়।
.
মাথার উপর থাকা সিলিং ফ্যানটা শো শো শব্দ তুলে বাতাস দিয়ে যাচ্ছে।জারিফ চেয়ারের হেডে কাঁধটা রেখেছে। দুইহাত চেহারের হাতলের উপর।জারিফের মানসপটে বারংবার জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠছে সেদিন ফারহানের রুম থেকে লিয়ার বের হওয়ার দৃশ্য। আবার বিভিন্ন সময় লিয়াকে ফারহানের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখার দৃশ্য।জারিফের মনে হচ্ছে,একজন টিচারের সাথে তার ছাত্রী কথা বলতেই পারে।কোনো দরকারে তার চেম্বারে যেতেই পারে।এটা স্বাভাবিক বিষয়।এটাকে অস্বাভাবিক নজরে দেখার কোনো কারনই নেই।পরক্ষণেই জারিফের মনে আবার নেগেটিভ চিন্তার উদ্রেক হয়।পায়েল টা যদি লিয়ারই হয়।তবে সেটা ফারহানের কাছে কীভাবে?এটা কি শুধুই কো-ইন্সিডেন্সলি?

জারিফের ভাবনার ছেদ ঘটে মৃদু আওয়াজে।লিয়া দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে হালকা কেশে “এহেম এহেম”শব্দ করে জারিফের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।জারিফ সোজা হয়ে বসল।চোখ তুলে লিয়ার দিকে চাইল। লিয়া বিনিময় চমৎকার হাসলো।লিয়া এগিয়ে যেতে থাকল।লিয়া এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়াল। মিষ্টি হেসে মজার ছলে বলল,

“তো বলুন মাস্টারমশাই কীজন্য হঠাৎ জরুরী তলব পাঠিয়েছেন? হঠাৎ কী দরকার পড়ল?এমনি সময় তো চলাচল করেন সামনাসামনি পড়লেও চিনেন না এমন এটিটিউড নিয়ে থাকেন।তা আজ হঠাৎ?”

কথাটা শেষ করে লিয়া ঘনঘন চোখের পলক ফেলে উত্তরের আশায় রইল।জারিফ ইশারা করে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল,”বসো।”

লিয়া চেয়ারে বসল।জারিফ দুইহাত টেবিলের উপর ভাঁজ করে রাখল।জারিফ দোটানায় পরল।এখন লিয়াকে কীভাবে বলবে?সরাসরি পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করলে লিয়া কী ভাববে? সরাসরি পায়েলের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা আদৌতেও ঠিক হবে কি?জারিফ দুই ভ্রুয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে এসব হেনোতোনো ভাবনায় নিমজ্জিত হয়। লিয়া জারিফের থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কিঞ্চিৎ বি’র’ক্ত হলো।কাঠের টেবিলের উপর মোটা কাঁচ দেওয়া। কাঁচের নিচে সাদা তুলতুলে ফর্ম জাতীয় কিছু রাখা।মোটা কাঁচ টা খুব স্বচ্ছ দেখাচ্ছে।লিয়া টেবিলের উপর হাতের কনুই ভর দিয়ে থুতনিতে হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল,

“জারিফ।”

লিয়ার ডাকে জারিফের ধ্যান ভাঙল।জারিফের কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে।না পারছে সহজেই প্রশ্ন টা করতে।আর না পারছে লিয়ার সাথে সহজ হতে। অজান্তেই কোথা থেকে যেনো অদৃশ্য এক বেড়া এসে ঠেকেছে দু’জনের মাঝে।সেই অদৃশ্য বেড়াজাল রাখতে চায় না জারিফ। মনেমনে সিদ্ধান্ত নেয়, কোনোকিছু না দেখে অনুমানের উপর ভিত্তি করা ঠিক নয়। পায়েলের এই বিষয়টা মাথা থেকে ঝে’ড়ে ফেলে দেওয়াই বেটার হবে।লিয়াকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে,লিয়ার মনে আমার প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হতে পারে।লিয়া ভাবতে পারে, আমি হয়তো ওকে সন্দেহ করছি।তাই এই চ্যাপ্টারটা মাথা থেকে ফেলে দেওয়াই ভালো।এসব কথা মনেমনে ভেবে মাথা ঝা’ড়’ল জারিফ।লিয়ার মুখশ্রীতে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল।মজার ছলে বলল,

“ক্যাম্পাসে আছো তুমি।টিচার হই তোমার।তাই এভাবে ডাকা শোভা পাচ্ছে না। রেসপেক্ট দিয়ে অন্তত কথা বলো।”

লিয়া মুখ বাকালো।দুইহাত টেবিলের উপর রাখল। ঠোঁট উল্টে বলল,”ছাত্রীকে যদি চেম্বারে বসিয়ে নিষ্পলক চাহুনিতে চেয়ে থাকেন।তাহলে ছাত্রী তো স্যার হিসেবে টিট না করে প্রেমিক হিসেবে টিট করবেই।আগে নিজের ক্যারেক্টার ঠিক করুন, মিস্টার।তারপর রেসপেক্ট আশা করবেন,হু।এর আগে নয়। স্যা…র।”

শেষে একটু টেনে বলে লিয়া।জারিফ চমৎকার হাসল।জারিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লিয়া ফের শুধালো,”কিজন্য ডেকেছেন বলুন। ক্লাসের সময় হয়ে আসছে। ফাস্ট বলুন।”

জারিফ একহাত চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করে নিলো।ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভেবে নিয়ে বলল,”মা বলছিলো তোমাকে নিয়ে জুয়েলার্সে যাওয়ার কথা। আগামীকাল রেডি থেকো।আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।”

লিয়া অবাক হলো।এই কথাটা বলার জন্য লোক দিয়ে ডেকে এইখানে এনেছে। অদ্ভুত!লিয়া অবাক গলায় বলল,”এটা বলার জন্য!এই কথা তো ফোনেও বলতে পারতেন।বা যাওয়ার সময় গাড়িতেও বলা যেতো। এরজন্য কেউ ডেকে পাঠায়। আশ্চর্য!”

জারিফ অপ্রস্তুত হলো।আমতা আমতা করে বলল,”ইয়ে আসলে। মা গতকালকে বলেছে।মনে থাকে না।এখন মনে পড়লো তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।”

প্রসঙ্গ পাল্টাতে জারিফ তড়িৎ বলে উঠল,”তোমার ক্লাস আছে না এখন।কি ক্লাস আছে?সময় হয়ে গিয়েছে তো।”

লিয়া সময় দেখে নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল,”এইতো সময় হয়ে গিয়েছে প্রায়।এখন সয়েল সায়েন্স ক্লাস।”

লিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হঠাৎ বলে উঠল,”এই রে আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।আমার পায়েলটা হারিয়ে গিয়েছিলো।তবে কপাল ভালো পাওয়া গিয়েছে।হারালেও অবশেষে ঘুরে ফিরে পায়েলটা আমার কাছেই আসে।বিষয়টা ইন্টারেস্টিং না?”

শেষের কথাটা বলে লিয়া জারিফের মুখায়বে চেয়ে রইল।সয়েল সায়েন্স ক্লাসের কথা শুনে জারিফের মাথায় ফের ফারহানের বিষয়টা দপ করে উঠল।সাথে লিয়ার মুখে পায়েল হা’রা’নো’র ঘটনা শুনে জারিফ শিওর হয়। ফারহানের কাছে থাকা পায়েলটাই লিয়ার ছিলো। অটোমেটিক রা’গের সৃষ্টি হতে থাকে জারিফের।

লিয়া বলল,”ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে।আমি আসছি এখন।পরে আপনাকে সবটা বলবো।”

এই বলে লিয়া যেতে নিবে।এমন সময় জারিফ গম্ভীর গলায় বলল,”ক্লাস করতে হবে না তোমাকে।”

জারিফের এহেন কথায় লিয়া অবাক হলো।লিয়া ভাবল জারিফ মজা করছে হয়তো।লিয়া জারিফের দিকে একপল চাইল।জারিফের মুখায়ব গম্ভীর দেখাচ্ছে।খানিক আগের মানুষটার ফর্সা মুখটা মূহূর্তেই যেনো আমাবস্যা নেমেছে।লিয়া অবাক গলায় ফের বলল,
“আপনি নিশ্চয় মজা করছেন। হঠাৎ এখন ক্লাস করতে নিষেধ করছেন যে।”

“এই ক্লাসটা করার দরকার নেই।বাকি ক্লাস করে নিও।”

“কিন্তু কেনো?”

কেনোর জবাব জারিফের জানা নেই।তারপরেও কেনো জানি ফারহানকে জারিফের সয্য হচ্ছে না।জারিফের ইচ্ছে করছে ফারহানের থেকে লিয়াকে শতশত মাইল দূরত্বে রাখতে।লিয়ার আশেপাশে ফারহানকে আর সয্য করতে পারছে না। ফারহানের ক্লাসটাই করতে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না জারিফের।জারিফ চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিলো।জারিফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে।জারিফ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। পরক্ষণে জারিফের মনেহয়,একটু বেশিই হয়তো ভাবছে জারিফ। টিনএজারদের মতো চিন্তা ভাবনা হয়ে যাচ্ছে।এভাবে লিয়াকে জোর করে বলে,হয়তো ক্লাসটা না করাতে পারে।তবে এটা কোনো বুদ্ধি বিবেক সম্পন্ন মানুষের কাজ নয়।জারিফ স্বাভাবিক ভাবে বলল,

“এমনি মজা করে বলেছি।দেরি হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে যাও তুমি।”

কথাটা শেষ করে জারিফ জোর করে হাসার চেষ্টা করলো।লিয়া বিনিময় মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। গুটিগুটি পা ফেলে প্রস্থান করল। লিয়ার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল জারিফ।লিয়ার সাথে স্বাভাবিক কথা বললেও ভেতরে ভেতরে জারিফকে খুব ভাবাচ্ছে।জারিফ মনেমনে আওড়ায়,লিয়াকে যতটা চিনি, জানি ও-তো ওরকম ক্যারেক্টারের মেয়ে না। শুধুশুধু সন্দেহ করা ঠিক হবে কি?আবার মস্তিষ্ক বলে উঠল, বিভিন্ন আড্ডায় বন্ধুরা বলতো মেয়ে মানুষকে যে পাত্রেই রাখা হয়, সেই পাত্রেরই নাকি আকার ধারণ করে।মেয়ে মানুষের মন পাল্টাতে নাকি সময় লাগে না।জারিফের সত্ত্বা তড়িৎ বলে উঠল,তবে সব কথাই সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।এটা মানতে হবে।জারিফের আর কোনো কিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না।যতো ভাবতে যাচ্ছে ততো নিজেকে এলোমেলো লাগছে।কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
.
যাওয়ার সময় গাড়িতে লিয়া জারিফকে লক্ষ্য করল।কেমন জানি চুপচাপ। মুখটা মলিন হয়ে আছে।লিয়া ম্লান স্বরে শুধালো,”আপনার কি শরীর খা’রাপ লাগছে?না মানে কেমন যেনো ঠিকঠাক লাগছে না।নাকি কিছু নিয়ে টেনস?”

জারিফ ড্রাইভ করতে করতে দৃষ্টি সামনে রেখেই রাশভারী কণ্ঠস্বরে বলল,”না ঠিক আছি।মাথাটা ধরেছে।”

গাড়ি লিয়াদের বাসার সামনে থামল। লিয়া সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বলল,”আজকে নামুন।ভেতরে চলুন।মাথা ধরেছে যেহেতু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার দিকে যাবেন।”

জারিফ লিয়ার দিকে চেয়ে বলল,”না লিয়া।বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এখন একটা শাওয়ার নেওয়া খুব প্রয়োজন। সেইজন্য হলেও বাসায় যেতে হবে।আসি।এমনিতেও কালকে আসতে হবে।”

লিয়া মৃদুস্বরে বলল,”আচ্ছা। ঠিক আছে।দেখে শুনে যাবেন।গিয়েই ফোন করে জানাবেন, কিন্তু।”
.
জারিফ বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয়।সাদা টাওয়াল দিয়ে চুলগুলো মুছতে থাকে এমন সময় বিছানার উপর থাকা ফোনটা ছন্দে বেজে উঠল।জারিফ রিসিভ করে বলল,

“হ্যা বলো।”

“বাসায় গিয়ে জানালেন না তো।আমি আপনার ফোনের জন্য ওয়েট করছিলাম।”

“মাত্র শাওয়ার নিয়ে বের হলাম।”

“কথা ছিলো গিয়েই জানাবেন। আচ্ছা যাগগে,এসব বাদ দেন। আপনার হেডেক কমেছে?না কমলে মেডিসিন নিন।”

“মেডিসিন নিতে হবে না।ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।আচ্ছা লিয়া। ঠিক আছে।আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো।এখন রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

জারিফ কল কাটল।ফোনটা বিছানায় রাখল।গায়ে টিশার্ট জড়াল। চুলগুলো পরিপাটি করে নিলো।মাথাটা সত্যিই জারিফের ধরেছে খুব।মাথার ভেতর ধপধপ করছে। এখন একটু বিশ্রাম খুব করে প্রয়োজন।জারিফ দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছেড়ে ডেকে বলল,

“মা।চারুকে দিয়ে একমগ কফি পাঠিয়ে দাও তো।কড়া করে দিতে বলো।”

জারিফ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো।দুইহাত বিছানার সাথে ঠেস দিয়ে রাখল।এর আগে কখনো এতটা খারাপ লাগা উপলব্ধি হয়নি জারিফের।আজকে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।পেপার পত্রিকা,সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এখন অহরহ অসামাজিক কার্যকলাপের নিউজ থাকে। কেনো জানি না চাইতেও আজ সেসব নিউজ বারবার মনে উঠছে।আর অদ্ভুত সব চিন্তা হচ্ছে।এমন অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা হওয়ায় জারিফ নিজের উপর নিজেই বি’র’ক্ত হচ্ছে।এমন সময় জাহানারা বেগম দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে বললেন,

“জারিফ বাবা ভেতরে আছিস।”

জারিফ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বলল,”মা।আসো।”

জাহানারা বেগম জারিফের সামনে দাঁড়িয়ে কফিটা জারিফের হাতে দিলেন।জারিফ কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল,”চারুকে দিয়ে বানিয়ে পাঠালেই হতো।এই গরমে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।”

জাহানারা বেগম জারিফের পাশে বসলেন।মৃদু হেসে বললেন,”মায়েরা কখনো সন্তানের জন্য কিছু করতে কষ্ট পায় না।এখন তো খুব বড় হয়ে গিয়েছিস।মুখ ফুটে কোনো আবদার করিস না।রাতে মাঝে মাঝে কফি নিজেই বানিয়ে নিস দেখি। মা’য়ের ঘুম ভাঙিয়ে ডাকিস না।মা’য়ের কষ্ট হবে দেখে। বাবা, মা সহ পরিবারের সবার জন্য দায়িত্ব পালন করিস।আমার বাচ্চাটা দেখতে দেখতে কতো বড় হয়ে গিয়েছে। এখনো মনে পরে তোদের ছোট বেলার কথা।মনেহয় এইতো কদিন আগের কথা।”

জাহানারা বেগম পুরানো স্মৃতি চারণ করতে থাকেন।জারিফ মগে থাকা শেষ কফিটুকু ঢকঢক করে গিলে নেয়।মগটা টেবিলের উপর রেখে জারিফ বিছানায় মা’য়ের কোলের উপর মাথাটা রাখল। জাহানারা বেগম জারিফের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিলেন। জাহানারা বেগম ছেলের চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।জারিফ মা’য়ের কোলে মাথা রেখে চোখদুটো বন্ধ করল। জাহানারা বেগম বুঝতে পারলেন ছেলের কিছু একটা হয়েছে। জাহানারা বেগম কণ্ঠে শীতলতা নিয়ে আদুরে স্বরে বললেন,

“জারিফ বাবা।”

“হু।”

“তুই কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?নাকি শরীর খা’রাপ।তোকে কেমন জানি অন্যমনষ্ক লাগছে।”

জারিফ ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,”না মা।ঠিক আছি। মাথাটা ধরেছে একটু। এছাড়া তেমন কিছুই না।”

জারিফের কথাটা জাহানারা বেগমের তেমন বিশ্বাস হলো না।ছেলে বড় হয়েছে যথেষ্ট ভালো মন্দ বোঝার
জ্ঞান বুদ্ধি হয়েছে। তাই আর জোর করলেন না। কোনো সমস্যা হলে ছেলে নিজেই ঠিক করতে পারবে। এটা ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন জাহানারা বেগম। জাহানারা বেগম জারিফের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফের বললেন,

“লিয়াকে বলেছিস কালকে যাওয়ার কথা?”

জারিফ ছোট করে বলল,”হুঁ।”

জাহানারা বেগম ফের মায়াময় স্বরে বললেন,”জারিফ বাবা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতে চাচ্ছি।বড় হয়েছিস। উচ্চ শিক্ষিত হয়েছিস। ভালোমন্দ বাছ বিচার করার ক্ষমতা তোর আছে।তবে সংসার জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হয়তো খুব কমই আছে।সংসার জীবন শুরু করতে যাচ্ছিস। সংসার করা এতটা সহজ বিষয় নয়।আবার হয়তো খুব সহজও। দু’জন দু’জনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, শ্রদ্ধা,সমীহ থাকতে হয়।তাহলে হয়তো একসাথে চলাটা সহজ হয়ে যায়। সংসার করতে গিয়ে ভুলবোঝাবুঝি, কথাকাটাকাটি এসব হয়েই থাকে।তবে ইগোটাকে বড় করে না দেখে নিজে থেকে সব কিছু মিটমাট করে নিতে হয়।আর নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝি হলে তৃতীয় পক্ষকে কখনো সুযোগ দিতে নেই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে এসকল বিষয় কারো কাছে শেয়ার করতে নেই।এখনকার সময় মানুষ এসবের সুযোগ নিয়ে আরো উস্কানি মূলক কথা বলে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্ধন হলো বিশ্বাস। শুধু স্বামী স্ত্রীই নয় প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই আলাদা আলাদা জায়গা থেকেই বিশ্বাস থাকাটা জরুরী।আর সবশেষে বলবো কখনো কোনো কিছু নিয়ে হতাশ হতে নেই। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে সবুর করতে হয়।জীবন কখনো স্মুথলি হয় না।জীবনের বাঁকে বাকে সমস্যা থাকে।তবে আমাদের সবারই উচিত বুদ্ধি দিয়ে ধৈর্য্যর সাথে সকল সিচুয়েশনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া।আর সমস্যার সমাধান করা।”

এতক্ষণে বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট টা যেনো মূহূর্তেই কমতে লাগল।জারিফের নিজেকে একটু হলেও হালকা মনে হচ্ছে।লিয়া এমন একটা মেয়ে যাকে কিনা একবাক্যে সবাই আদর্শ , ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একটা মেয়ে বলতে বাউন্ড। যাচাই-বাছাই না করে তার প্রতি হুট করে সন্দেহ করা মোটেই ঠিক নয়।জারিফ ভাবে আগে লিয়ার সাথে এব্যাপারে কথা বলা দরকার। ফারহানের সাথে বিভিন্ন সময় কথা বলা, চেম্বারে যাওয়া,আর পায়েলটা ফারহানের কাছে থাকা।এসব বিষয় ক্লিয়ার হওয়া জরুরী।

জাহানারা বেগমের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে জারিফ ঘুমিয়ে পরে। জাহানারা বেগম কোল থেকে জারিফের মাথাটা বালিশের উপর আলতো করে রাখলেন। সারাদিন ব্যস্ততার মাঝে থাকে ছেলেটা আজ বোধহয় একটু বেশিই ক্লান্ত ছিলো।আজ অবেলায় ঘুমিয়ে পড়লো।এসব ভাবতে ভাবতে জাহানারা বেগম জানালার পাশে দাঁড়ালেন। পড়ন্ত বিকেলের এক ফালি রোদ জানালা গলিয়ে রুমে এসে পড়ছে।জানালার দামি আভিজাত্যপূর্ণ রুচিশীল সফেদ রঙা পর্দাটা বাতাসে মূদু দোল খাচ্ছে। জাহানারা বেগম পর্দাটা একহাতে টেনে দিলেন।এসির পাওয়ার একটু কমিয়ে দিলেন। পড়ন্ত বিকেল হলেও বাইরে অসহনীয় গরম পড়ছে।ঘরে যান্ত্রিক যন্ত্র গুলোর জন্য গরমের তীব্রতা ওতোটা উপলব্ধি হয় না।রুমটা এবার একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখলেন।ছেলেটা ঘুমাক মনেমনে আওড়িয়ে জাহানারা বেগম জারিফের দিকে ফের একনজর চেয়ে রুম থেকে প্রস্থান করলেন।
.
শুক্রবারের দিন বিকেলে লিয়াকে জুয়েলার্সে গহনার অর্ডার দিতে নিয়ে গিয়েছিল জারিফ। জাহানারা বেগম, নিরুপমা বেগম আর জারা আগে থেকে ওয়েট করছিলো।জারিফ লিয়াকে আনতে আসে।লিয়াকে নিয়ে যাওয়ার সময় জারিফ লিয়াকে প্রশ্ন করে পায়েল টা ফারহানের কাছে কীভাবে ছিলো।লিয়া প্রাকটিক্যাল ক্লাসে হারিয়ে ফেলে বলে।আর ওখান থেকেই ফারহান পেয়েছে সেটা জানায়।জারিফ কৌশলে এও বলে,”তোমাকে একদিন ফারহানের রুম থেকে আসতে দেখলাম।সয়েল সায়েন্স সাবজেক্টে তোমার প্রবলেম হচ্ছে কি?”লিয়া স্বাভাবিকভাবে জানায়,”আসলে প্রবলেম আমার নয়। প্রবলেম আমার ফ্রেন্ড অরিনের।”লিয়া অরিনের পা’গ’লা’মি’র কথা বলতে থাকে।সব শুনে জারিফ নিজেই লজ্জিত হয়।আসলে চোখের দেখা আর সঠিক বিষয়টা জানার মধ্যে অনেক সময় আকাশ পাতাল তফাৎ থাকে।সবাই মিলে গহনার অর্ডার দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে স্ন্যাকস করে সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরে।জারিফ লিয়াকে ড্রপ করে দিয়ে যায়।
.
আজ রবিবার। মধ্যদুপুর। টিএসসির ক্যান্টিনে বসে আছে কবিতা,ফারহান পাশাপাশি অপর পাশে জারিফ।জারিফ বারবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইছে। এরমধ্যে কবিতা টিস্যু দিয়ে কপালটা মুছতে মুছতে বলল,

“মিস্টার জারিফ।আজ হঠাৎ নিজে থেকেই লাঞ্চের অফার দিলেন।ব্যাপার স্যাপার কি? ট্রিট দিলেন নাকি? কোনো বড়সড় গুড নিউজ আছে নিশ্চয়।”

জারিফ মৃদু হাসল। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,”হয়তো।”

ফারহান বলল,”জারিফ সাহেব কি কারো জন্য ওয়েট করছেন নাকি? বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছেন যে।তাই বললাম আরকি।”

জারিফ কিছু বলার আগেই কবিতা বলে উঠল,”ওহ্। তারমানে আজকে লাঞ্চের দাওয়াত শুধু আমরা দু’জনই পাইনি।আরো কেউ আছে।তবে সে কে মিস্টার জারিফ। আমাদেরই কলিগ?নাকি বাইরের কেউ?”

“ওয়েট। মিস কবিতা।চলে আসবে এক্ষুনি।”

কবিতা ঠোঁট উল্টে বলল,”ওকে।”

জারিফ কল লিস্টে গিয়ে সবার উপরে থাকা কাংখিত নম্বরে কল করল।রিসিভ করে ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে আসল,”এই তো এসে গিয়েছি।ওয়ান মিনিটের মধ্যেই।”

“ওকে। তাড়াতাড়ি আসো। অপেক্ষায় আছি।”

জারিফ কল কাটল। ফারহান,কবিতার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে থাকল।জারিফ লিয়া দু’জনে মিলে একসাথে ইনভাইটেশন কার্ড দিবে। মিনিট খানেক পরই জারিফ ঘাড় ফিরিয়ে ফের চাইতেই লিয়া আর অরিনকে দেখতে পায়। জারিফ উঠে দাঁড়ালো।একহাত কিঞ্চিৎ উঁচু করে ডাকল,”এই লিয়া।এদিকে।”

লিয়া ডাকটাকে ফলো করে তাকিয়ে জারিফকে দেখে স্মিত হাসলো।এগিয়ে আসতে লাগলো।অরিন অবাক হলো।লিয়া বলল আজ ওর বরের সাথে আলাপ করিয়ে দিবে।আর স্যার, ম্যামরা একসাথে বসে আছে।সেখান থেকে জারিফ স্যার কেনো লিয়াকে ডাকছে? অদ্ভুত!সেদিন লিয়াকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো।জারিফ স্যার কি বলল।লিয়া বলেনি,এড়িয়ে গিয়েছিলো। লিয়া জারিফের সামনাসামনি দাঁড়ালো। ফারহান অবাক হলো। জারিফ লিয়াকে কেনো ডাকলো এইভেবে।কবিতা মুখটা কালো করলো। মনেমনে আওড়ালো,”মিস্টার জারিফ আমাদের মাঝে স্টুডেন্টদেরকে কেনো আনছে। আশ্চর্য!এই মেয়েটাও কি আমাদের টেবিলে বসবে নাকি! নিশ্চয় এর জন্যই ওয়েট করছিলো জারিফ।তবে আমাদের কলিগদের মাঝে এই মেয়েটাকে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”

এসব কথা মনেমনে ভাবতে থাকে কবিতা। ভদ্রতার খাতিরে মুখে এসব বলতে পারল না।তবে মুখটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে। ফারহান অবাক চোখে চেয়ে আছে।জারিফকে যতটুকু চেনে জানে তাতে কোনো মেয়ের সাথে কখনো খোশ গল্প করতে দেখা যায়নি। তবে আজ হুট করে জারিফের লিয়াকে এইভাবে ডাকাটা কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে ফারহানের কাছে।

চলবে,,,