সুখের ঠিকানা পর্ব-৪০+৪১

0
191

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৪০

কবিতা বি’র’ক্তি’ক’র মুখশ্রীতে দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপ বসে আছে। ফারহান অবাক চোখে লিয়ার দিকে চেয়ে আছে।লিয়ার ফেস দেখে বোঝা যাচ্ছে,লিয়া বেশ স্বাভাবিক আছে। সবার মাঝে জারিফের এভাবে লিয়াকে ডাকাতে লিয়া যেনো একটুও অবাক হয়নি। বরং লিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসল।অরিন ভ্রু কুঁচকালো।কোনো জটিল সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে এমন ভাবসাব অরিনের।জারিফ লিয়ার দিকে সুগভীর নজরে চাইল। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পাশে থাকা অরিনকে উদ্দেশ্য করে চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল,

“অরিন বসো।”

অরিন অপ্রস্তুত হলো। হঠাৎ স্যার কেনো তাদের টেবিলে বসতে বলছে। স্ট্রেন্জ!এইভেবে দ্বিধায় পরল অরিন।অরিন ঠোঁট কামড়ে ধরে একবার লিয়ার দিকে চাইল।লিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করল।অরিন বুঝল লিয়াও বসতে বলছে।অরিন ভেতরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল।জারিফ লিয়ার দিকে ফের তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

“কি হলো?তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি। প্লিজ, টেক আ সিট।”

লিয়া হাসিমুখে বলল,”শিওর।”

লিয়া বসল। জারিফ লিয়ার পাশে বসল।কবিতা আড়চোখে সবটা অবলোকন করছে।আর মেজাজটা ক্ষিপ্ত হচ্ছে তার।কি দরকার ছিলো? এভাবে টিচারদের মাঝে স্টুডেন্টদেরকে আনার। আর জারিফের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয় লিয়া নামক মেয়েটার উপর উনার দূর্বলতা আছে।জারিফের চোখের নজরে তা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। অনেকের ক্রাশ লেকচারার আয়মান জারিফ কিনা শেষমেষ তার ছাত্রীর উপর দুর্বল হলো। উফ্!মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।মেয়েটা ফাস্ট ইয়ারের দু’জনের বয়সের ব্যবধানও বেশ ভালোই হবে।আর মেয়েটারও কোনো পার্সোনালিটি নেই।মানছি ছেলে মানুষ সুন্দরী মেয়ে দেখে ফিদা হয়েছে।তাই বলে টিচারের সাথে? উফ্! ডিসগাসটিং।এমন একটা লো পার্সোনালিটি সম্পন্ন মেয়ের সাথে এক টেবিলে বসে আমাকে লাঞ্চ করতে হবে। জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে উঠে চলে যেতেও পারছি না।আবার হজমও করতে পারছি না।এসব ভেবে কবিতা আড়ালে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল।

জারিফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় মুখটা মুছে নিতে বলল। এইটুকু হেঁটে আসতে গিয়ে গরমে লিয়ার কপাল থেকে ঘামের রেখা ভ্রু যুগলের কোণা বেঁয়ে গালে এসে পরছে।লিয়া মুখটা মুছে নিলো। টিস্যু ঘামে ভেজার ফলে সাদা খুঁত খুঁত ছোট্ট অংশ কপালের উপর ছিলো।জারিফ এক আঙ্গুলের সাহায্যে লিয়ার কপাল থেকে খুঁত খুঁত টিস্যুর অংশটা ফেলে দেয়। অরিনের চোখ যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।অরিন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।স্যার লিয়াকে টাচ করল।অথচ লিয়া নির্বিকার।ফারহানের হাতের আঙ্গুলগুলো আপনাআপনি মুঠো হয়ে যায়। ফারহানের প্রচন্ড রা’গ হচ্ছে।জারিফ লিয়াকে পাশাপাশি দেখে। ফারহান ভাবছে,লিয়া কি জারিফের পরিচিত না-কি?জারিফ যথেষ্ট ভদ্র মানুষ তবে লিয়ার সাথে তার এখনকার করা আচরণ অদ্ভুত লাগছে।লিয়া চুপচাপ না থাকলে।লিয়া যদি একটু বি’র’ক্তি ভাব প্রকাশ করতো জারিফ সাহেবের এহেন ব্যবহারে।তাহলে আমি প্রতিবাদ করতাম। ছাত্রীর সাথে কেয়ারের নামে এমন আচরণ অসভ্যতামিই প্রকাশ করে।ফারহানের ভাবনা ভাঙ্গে জারিফের কথায়।জারিফের কথায় লিয়া বাদে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়।জারিফ হালকা কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়াই স্পষ্ট গলায় বলল,

“আই ওয়ান্ট টু ইন্ট্রোডিউস মাই ওয়াইফ ইউদ ইউ।”

একসাথে তিনজোড়া চোখ জারিফের দিকে বিস্ফোরিত হয়ে চাইল।জারিফের কথায় কবিতা হতবাক হয়ে বিস্ময়কর চাহনিতে তাকাল।অরিন যা বোঝার সবটা বুঝে যায়।লিয়ার দিকে ব্যাকা চোখে তাকাল। ফারহান অবাক হয়ে বলল,

“হোয়াট!ওয়াইফ মানে?”

জারিফ স্মিত হাসল। বলল,”আসলে আপনারা বোধহয় জানেন না।আমি ম্যারিড।শী ইস মাই ওয়াইফ। মিসেস জারিফ।”

লিয়ার দিকে তাকিয়ে একহাত দিয়ে দেখিয়ে শেষের কথাটা বলল জারিফ।লিয়ার কেমন জানি লজ্জা অনুভব হতে থাকে।যতই হোক বাকি দু’জন স্যার ম্যামের সামনে এভাবে জারিফের বউ বলে পরিচিত হতে লজ্জা লাগছিলো।লিয়া লজ্জায় দৃষ্টি নত করে নেয়। উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিশ্চুপ রয়।ফারহানের মনের আকাশে ঘনকালো মেঘ খানিক আগেই জমা হয়েছিলো।ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা যেনো লহমায় বেড়ে গেলো। তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ চমকালো,ভারী বাজ পরলো। ফারহানের মনের আকাশে যেনো বিকট আওয়াজ তুলে বাজ পরলো। সাথে সাথেই বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।মনে হলো হৃদস্পন্দন যেনো কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্টপ হয়ে গিয়েছে। র’ক্ত চলাচল বোধহয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।গা টা কেমন জানি হিম শীতল হয়ে আসছে। উফ্!নিজেকে বড্ড এলোমেলো লাগছে।সব কিছুই ঠিক আছে।অথচ মনে হচ্ছে কিছুই যেনো ঠিক নেই। ফারহান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।কিছু স্বপ্ন যেনো দুঃস্বপ্নে হারিয়ে যাচ্ছে।সদ্য জন্ম হওয়া ভালোলাগার অনুভূতি প্রকাশ করার আগেই অপ্রকাশিত রয়ে যাবে। ফারহান চোখ বন্ধ করে ছোট করে শ্বাস টেনে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল।

কবিতার কিছুটা খা’রাপ লাগলেও মনেমনে লজ্জিত হলো।একটু আগে লিয়াকে নিয়ে ওরকম ব্যাড ধারণা করার জন্য।কবিতা জোর করে হাসির রেখা টেনে এনে বলল,

“ওহ্।তাই নাকি! জানতাম না।তবে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা কবে করলেন মিস্টার জারিফ?তাও আবার ছাত্রীকে।রিলেশন করে নাকি?আপনাকে দেখে আমি অন্তত ধারণা করতে পারেনি আপনি রিলেশন করতে পারেন।আপনাকে দেখে আমার বরাবরই মনে হয়েছে এসব প্রেম ট্রেম থেকে আপনি হয়তো হাজার গজ দূরে থাকেন।”

শেষের কথাটা খোঁচা মে’রে বলল কবিতা। জারিফ বেশ বুঝতে পারল।কারন কবিতা বিভিন্ন সময় কথা বলার সময় তার আচরণ দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিল সে জারিফের উপর দুর্বল।জারিফ বুঝেও না বোঝার এক্টিং করে থাকতো।আর একটা আনম্যারিড মেয়ে একজন পুরুষকে তার ভালো লাগতেই পারে।এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।জারিফ সেসব কখনো মাথায়ই ঢুকায়নি।জারিফ স্বাভাবিকভাবে প্রত্যুত্তরে বলল,

“মিস কবিতা।আমাদের রিলেশন করে বিয়ে নয়।আর ছাত্রী বিয়ের আগে ছিলো না।বিয়ের পরে ছাত্রী হয়েছে।লিয়া ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে।আমাদের বিয়েটা হঠাৎ করে হয়।শুধু আকদ করে রাখা হয়।এখনো তেমন কাউকে জানানো হয়নি।এই মাসের**তারিখে সবাইকে জানিয়ে নতুন করে বিয়ের প্রোগ্রাম করা হবে।”

জারিফ এর থেকে বেশি কিছু আর বলে না। কি দরকার ঘরের কথা বাইরে বলার। বিয়েটা কীভাবে হয়েছে যেসব কথা বলার প্রয়োজন বোধ জারিফ করল না।লিয়া জারিফের উপর সন্তুষ্ট হয়।বিয়েটা যে একটা দূর্ঘটনা ছিলো সেসব কাউকে না বলে, বিষয়টা সুন্দর করে হ্যান্ডেল করে নিলো জারিফ।এইজন্য লিয়া কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে জারিফের দিকে চাইল।জারিফ লিয়াকে ইশারা করল।লিয়া বুঝল।লিয়া তড়িৎ ব্যাগ থেকে কার্ড বের করল।জারিফের দিকে বাড়িয়ে দিলো।জারিফ একটা কার্ড হাতে নিয়ে ফারহানের দিকে বাড়িয়ে বলল,

“ফারহান সাহেব**তারিখে আমাদের রিসিপশনে আশাকরি উপস্থিত থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া রাখবেন।আপনাদের দোয়া কামনা করছি,সাথে উপস্থিতি।”

ফারহান কার্ডটা হাতে নিলো।জোর করে হাসার চেষ্টা করে ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে বলল,”শিওর। নিশ্চয় যাবো।আর আপনাদের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো।”

“থ্যাংকস।”

অতঃপর জারিফ লিয়াকে ইশারা করল কবিতা আর অরিনকে কার্ড দেওয়ার জন্য।লিয়া হাসিমুখে কবিতার দিকে কার্ড দিয়ে বলল,

“ম্যাম। অবশ্যই কিন্তু আসবেন।আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”

কবিতা হাসিমুখে কার্ড নেয়। ঠোঁট মেলে বলল,”মিস্টার জারিফ আমি তো দ্বিধায় পরে গেলাম।একদিকে ছাত্রী অন্যদিকে কলিগের ওয়াইফ। সেদিক দিয়ে ধরলে ভাবী হবে লিয়া।তো বুঝতে পারছি না লিয়াকে কী বলে সম্বোধন করবো নাম ধরেই নাকি ভাবী বলে।”

জারিফ স্পষ্ট স্বরে বলল,”ক্যাম্পাসে যখন থাকবে তখন লিয়া আপনার ছাত্রী । আবার ক্যাম্পাসের বাইরে থাকলেও লিয়া আপনার ছাত্রীই থাকবে।তবে যখন আমার দিক হতে লিয়াকে ধরবেন তখন আমার পরিচয়েই লিয়া পরিচিত হবে।”

একটু থেমে জারিফ বলল,”আচ্ছা।আপনাদের অনেক সময় লস করালাম।এবার অর্ডার দেওয়া যাক।”

সবাই মিলে একসাথে খাবার খেতে থাকে।লিয়ার সামনে চিংড়ি মাছ ভুনা ছিলো। জারিফ চিংড়ি ভুনার বাটি টা সরিয়ে রাখল।আর লিয়াকে বলল,”তোমার না চিংড়িতে এলার্জি।কখন ভুলে প্লেটে নিয়ে নিবে।ভুল করে খেয়ে ফেলবে।আর অসুস্থ হয়ে পরবে।সাথে আমাকে টেনশনে ফেলবে।”

লিয়া অবাক হয় জারিফের এখনো মনে আছে সেদিনের কথা। ফারহান আড়চোখে জারিফের কেয়ারগুলো দেখতে থাকে।খাওয়ার সময় জারিফের লিয়ার প্রতি কেয়ার দেখে ফারহানের বুকের মাঝে হালকা ব্যাথা অনুভব হয় ।কিছুটা কষ্ট হলেও ভালোও লাগল।যাক লিয়া একজন ভালো মনের মানুষকেই জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে মেইড ফর ইচ আদার।ফারহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাস্তবতা মানতে হবে। এখানে একজনকে ভালো লাগতেই পারে।তবে তারমানে এই নয় যে,আমাকে তাকে পেতেই হবে।ডু অর ডাই এমন নয়।এসব গল্প সিনেমায়ই মানায়।তবে প্রাথমিকভাবে একটু কষ্ট হয়। এটা অস্বীকার করার নয়।সেটাও সময়ের সাথে সাথে সয়ে যায়।

খাওয়া দাওয়া শেষে জারিফ বিল পে করে। লাঞ্চের পরের ক্লাসের সময় অরিন লিয়াকে এটাসেটা বলতেই থাকে,”তোর বর চোখের সামনে থাকতেও আমি কিকরে টের পেলাম না।তোরা দু’জনে কীভাবে ঘোল খাওয়ালি বলতো।স্যার যখন তোকে বউ বলে পরিচয় দিলো,তখন আমি তো জোরেশোরে একটা ঝটকা খেয়েছি।”অরিনের এসব কথায় লিয়া ঠোঁট চেপে শব্দহীন চমৎকার হাসল।
.
জারিফ অন্যান্য আরো কয়েকজন কলিগকে ইনভাইট করেছে।এগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টির বেশ কয়েকজন টিচারসহ অনেক স্টুডেন্টসরাই জারিফ-লিয়ার সম্পর্কের কথা এখন জানে।কোনো কোনো স্টুডেন্টস তো জেলাসি ফিল করে ব্যাকা চোখে লিয়ার দিকে তাকায়।তবে মুখে কিছু বলার সাহস পায় না।
.
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।আপন গতিতে চলতে থাকে।দেখতে দেখতে বিয়ের ডেট ঘনিয়ে এসেছে।আজ বৃহস্পতিবার। আগামী শুক্রবার জারিফ-লিয়ার বিয়ে।ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর ছুঁইছুঁই।জারিফ লিয়াদের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে।রাজিয়া সুলতানা সিঙ্গেল সোফায় বসে ভালোমন্দ কথাবার্তা বলছেন।রাজিয়া সুলতানা শুধালেন,

“তোমার বাবা মা কেমন আছেন?বাসার সবাই ভালো আছে তো?নাতাশাকে আনতে পারতে।”

জারিফ নম্র স্বরে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।আসলে আন্টি নাতাশা নীল আর জারার সাথে সরাসরি মলে আসবে।ও’কে আর এদিকে আনলাম না।”

“ওহ্। আচ্ছা বাবা।লিয়া রেডি হচ্ছে ততক্ষণে তুমি অল্প করে হলেও কিছু খাও।আমি খাবার রেডি করছি।তুমি বসো।বেশি দেরি হবে না।”

এই বলে রাজিয়া সুলতানা উঠে দাঁড়ালেন। জারিফ আসার পরপরই খাওয়ার কথা বললে না করে।রাজিয়া সুলতানা ফের বললেন।জারিফ অমায়িক হাসল।বলল,”আন্টি ব্যস্ত হবেন না, প্লিজ।আমি মাত্রই খেয়ে আসছি।এখন কিছুই খেতে পারব না।”

রাজিয়া সুলতানা আর জোর করলেন না।জারিফ বলল,”আঙ্কেল কে দেখছি না। বাসায় নেই। আঙ্কেলের শরীর স্বাস্থ্য এখন কেমন আছে?”

“তোমার আঙ্কেল অফিসে।শরীর স্বাস্থ্য আছে আলহামদুলিল্লাহ মোটামুটি।এই ভালো তো এই খা’রাপ। এইভাবে চলছে। ঠিকমতো সব কিছু মেইনটেইন করে না জন্য প্রবলেম গুলো একটু বেশিই হয়।”

এরকম ভালোমন্দ কথাবার্তা চলতে থাকে।এমন সময় লিয়া এসে বলল,”আমি রেডি। চলুন।”

জারিফ লিয়ার দিকে একপল চাইল। কিয়ৎক্ষন পরে রাজিয়া সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে ভদ্রভাবে বলল,
“আন্টি রাহবারকেও বলুন রেডি হতে।রাহবারও আমাদের সাথে যাবে।”

“তোমরা যাও বাবা। রাহবারের কোচিংএ পরিক্ষা আছে।ও একটু পরই কোচিং এ যাবে।”

“এই রে ভুল হয়ে গেলো। ফোনে আগে থেকেই বলে রাখা লাগত।তাহলে ভালো হতো।রাহবারের এক্সামের কথা জানলে ডেটটা আজ ফিক্সড না করে কাল করলে ভালো হতো।”

রাজিয়া সুলতানা আদূরে গলায় বললেন,”সমস্যা নেই বাবা।তোমরা যাও। রাহবার এমনিতেও মার্কেটে যেতে তেমন চায় না।ওর জন্য পোশাক কেনার সময়ই জোর করে নিয়ে যেতে হয়। বেশিরভাগ সময় আমি আর লিয়াই ওর পোশাক কিনে আনি।ওর তো সারাদিন দাও বন্ধুদের সাথে খেলতে। ক্রিকেট,ফুটবল হাবিজাবি আরো যত খেলা আছে।সেখানে রাহবার আছে।”
.
রাজিয়া সুলতানার থেকে বিদায় নিয়ে এসে গাড়িতে বসল লিয়া-জারিফ।গাড়িতে বসে লিয়া শুধালো,
“আপনি না ফোনে বললেন নীল,জারা ওরাও থাকবে।তাহলে ওদের আনলেন না যে।”

জারিফ ড্রাইভ করতে করতে বলল,”ওরাও থাকবে বলেছি যখন। নিশ্চয় থাকবে।”

জারিফের হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে লিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,”আমরা যাচ্ছি তো।ওরা তাহলে কই?ওরা কি মলে ওয়েট করছে?”

“না।আমি নীলের কাছে ফোন করার পর,নীল নিয়ে আসবে জারা আর নাতাশাকে।”

“এখনই ফোন করে নিন।”

“আরেকটু পরে করবো।আগে একটা কাজ আছে।”

“কী কাজ?”

জারিফের থেকে উত্তর পাওয়ার আগেই লিয়া চঞ্চল কণ্ঠে বলল,”এই আপনি এই রাস্তা দিয়ে কোথায় যাচ্ছেন বলুন তো। শর্টকাট দিয়ে গাঙ্গিনাপাড়ে না গিয়ে।কোথা দিয়ে যাচ্ছেন,হ্যা।”

জারিফ নির্বিকার গলায় বলল,”গাঙ্গিনাপাড়ে এখন যাচ্ছি না। বললাম না আগে কাজ আছে। কাজটা শেষ করে,দেন গাঙ্গিনাপাড়ে যাবো।এখন তোমার বোনের বাসায় যাচ্ছি।”

লিয়া কপাল কুচকালো। ঠোঁট উল্টে বলল,”বোনের বাসা মানে? মানে আপুদের ওখানে।এখন! কিন্তু কেনো?”

লিয়া একটু জোরে বলল।জারিফ লিয়ার দিকে একবার তাকাল।ফের দৃষ্টি সামনে রেখে বলল,”আমি কানে শুনতে পাই।সো এতো জোরে তোমাকে কথা বলতে হবে না। হ্যাঁ, তোমার আপুর বাসায় যাচ্ছি। ডক্টর খাঁনের পুরো পরিবারকে ইনভাইট করতে।”

লিয়া সরু চোখে চাইল।অবাক হয়েই ফের বলল,
“আমার আপু আমাদের বাড়িতে না গিয়ে আপনাদের ওখানে দাওয়াত খেতে যাবে কখনো?আপনিই বলুন এও সম্ভব! আপনার মাথা ঠিক আছে তো।”

জারিফ বলল,”ও লিয়া।তুমি এতো বেশি কথা কেনো বল? ডক্টর খাঁনের ফ্যামেলিকে ইনভাইট করতে যাচ্ছি।সেখানে যাবে কি যাবে না,সেটা বড় কথা নয়। ডক্টর খাঁন আমার আগে থেকেই পরিচিত।সেইজন্য হলেও ওনার ফ্যামেলিকে ইনভাইট করতে হবে।বুঝেছো?”

লিয়া বিষয়টা বুঝল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল।কিছু মনে হতেই ফের বলল,”আমাকে কেনো সাথে নিচ্ছেন?আপনি একাই তো গিয়ে কার্ড দিয়ে আসতে পারতেন।”

“হুম পারতাম।তবে ভাবলাম ডক্টর খাঁন তো এখন আর একা থাকেন না। ওখানে ওনার বউ,মা এককথায় পরিবারের লোকজন আছেন।একটু লজ্জা লাগছিলো।তাই ভাবলাম তুমি সাথে গেলে ভালো হবে।আর এও ভাবলাম তোমার তো অনেক দিন তোমার আপুর সাথে দেখা হয় না।তাই দেখা করাও হবে।ভালো আইডিয়া না।”

লিয়া জারিফের কাঁধে মাথা রাখল।একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,”থেংকিউ। অনেক অনেক থ্যাংকস।সত্যিই অনেক দিন দেখা হয় না আপুর সাথে।আপুকে অনেক মিস করি।”

“খুশিতে মিষ্টি মুখ করাও। রিটার্ন গিফট হিসেবে এটা তো পেতেই পারি।কি বলো?”

লিয়া জারিফকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। ঠোঁটের দিকে এক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,”এখন মিষ্টি টিষ্টি কিছুই পাবেন না।আমার লিপিস্টিক ন’ষ্ট হয়ে যাবে।”

জারিফ দুষ্টুমির স্বরে বলল,”আমার থেকে তোমার কাছে লিপিস্টিক বড় হয়ে দাঁড়াল। ভেরি ব্যাড। আচ্ছা এখন বাদ দিলাম।তবে শেষে মিষ্টি টা যেনো না চাইতে হয়।নিজ থেকেই দিবে,কেমন?”
.
কলিংবেলের শব্দ হওয়ায় তাসনিম দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলে লিয়াকে দেখে অবাক হয়।লিয়া তাসনিমকে জড়িয়ে ধরল। তাসনিম অবাক গলায় বলল,”লিয়া তুই।এই সময়। হঠাৎ আসলি।কার সাথে এসেছিস?একাই?”

লিয়া তাসনিমকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একহাত দিয়ে ইশারা করে বলল,”উঁহু,একা নয়।জারিফ নিয়ে এসেছে।”

জারিফের হাতে ফলমূল আর মিষ্টির প্যাকেট।জারিফ কয়েক কদম এগিয়ে আসল।জারিফ প্রথমে সালাম দেয়। তাসনিম ভেতরে আসতে বলল।জারিফ লিয়া সোফায় পাশাপাশি বসে আছে। এরমধ্যে আতিকা বেগম এসে ভালোমন্দ কথাবার্তা বলতে থাকেন।জারিফ তাসনিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আলিফ ভাই বাসায় নেই?”

“হ্যা আছে।আলিফ রুমে আছে ।তোমরা কথা বলো।আমি ডেকে দিচ্ছি।”

আলিফ ঘুমাচ্ছিল। তাসনিম ডেকে দেয়।আলিফ ফ্রেশ হয়ে এসে কুশলাদি বিনিময় করতে থাকে। জারিফ আলিফের হাতে বিয়ের কার্ড দেয়। অতঃপর জারিফ তাড়া দিতে থাকে। তাসনিম নাস্তা নিয়ে আসে।জারিফ ইতস্তত গলায় বলল,

“আসলে ভাই আমাদেরকে এখন উঠতে হবে।হাতে অনেক কাজ আছে।”

সবার জোড়াজুড়িতে হালকা নাস্তা করল ওরা। অবশেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বের হয়। তাসনিম আর আলিফ দু’জনে নিচে নামে।ওদের সাথে গাড়ি অব্দি আসে।লিয়া গাড়িতে উঠার আগে তাসনিমকে ফের জড়িয়ে ধরল। তাসনিম লিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“তোরা বাড়ি যাচ্ছিস কবে?”

“আগামীকাল যাবো।আপু তুমি কবে যাবে? তুমিও আমাদের সাথেই বাড়িতে চলো না।”

তাসনিম মৃদু হাসল।আলিফের দিকে একপলক চাইল।বলল,”কাল নয়। মেডিকেল থেকে ছুটি নিতে হবে।তবে তাড়াতাড়িই যাবো।সোনা বোন আমার মন খা’রাপ করিস না, কেমন। পাক্কা প্রমিজ দ্রুতই যাবো।”

বিদায় নিয়ে জারিফ লিয়া গাড়িতে বসল।মূহূর্তেই গাড়ি চোখের আড়ালে চলে যায়।এতক্ষণ ছোট বোনকে পাশে পেয়ে তাসনিমের ভীষণ আনন্দ লাগছিলো।চলে যেতেই মনটা খা’রাপ হতে থাকে। অজান্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে তরল কিছু গড়িয়ে পরল।আলিফ একহাতে তাসনিমের গাল বেয়ে পরা পানিটুকু মুছে দিতে দিতে বলল,”মন খা’রাপ করো না।আর ক’দিন পরেই তো যাচ্ছো।যাও এবার বেশিদিন থাকবে।তোমার যতদিন খুশি ততদিন।তোমার একটাই অভিযোগ আমি নাকি থাকতে দেইনি। বারবার ফোনে আসার কথা বলি। এবার আর বলবো না।”

তাসনিম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,”ড্রামাবাজ একটা।একটা রাত যেতে না যেতেই আপনার ফোন কলের জন্য থাকা দায় হয়ে পরে। তাসনিম কখন আসবে?কবে আসবে?এই প্রবলেম হচ্ছে সেই প্রবলেম হচ্ছে।এরকম অজুহাত দিতেই থাকে।সে কিনা এখন এরকম বলছে।এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
.
নীল পালসার বাইকটা বের করে গেটের সামনে দাঁড় করাল।পাশে নাতাশা আর জারা দাঁড়িয়ে।বাইকের আয়নায় মুখ দেখে একহাতে চুলগুলো ঠিক করছে আর শিষ বাজাচ্ছে নীল।জারা বি’র’ক্তি’ক’র কণ্ঠে বলল,”এই নীল ভাইয়া এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি।যাবি না?”

নীল কটমট চোখে জারার দিকে চাইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”এইযে দুই ভাই বোন সমান হয়েছে।এর ভাই যেমন আমাকে বেকায়দায় ফেলে।ঠিক তেমনি এও আজকে আমাকে বেকায়দায় ফেলতে যাচ্ছে।আর এই সব দোষ তোর গুনধর ভাইয়ের।”

জারা নাক মুখ কুঁচকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,”খবরদার আমার ভাইয়াকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবি না।একদম বলবি না।আমার ভাইয়া তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে,তুই এরকম বলছিস।”

নীল প্রত্যুত্তরে বলল,”তোর ভাই কোন পাকা ধানে মই দেয়নি তাই বল রে,তাই বল।তোর ভাইয়ের জন্য উঠতে বসতে আম্মুর কাছে ব’কু’নি খেতে হয়। আম্মুর মুখে তোর ভাইয়ের ফুলচন্দন ঝরে।আর নিজের ছেলেকে আচ্ছা মতো ব’কে।ঠিক করলা আর নিম পাতার মতো তেতো ওয়ার্ড গুলো আমার জন্য থাকে।আমার আম্মুর ডিকশনারিতে।”

জারা এতক্ষণে বুঝল।ভাব নিয়ে বলল,”তা তো হবেই।ছোট আম্মু আমার ভাইয়ার সুনাম করবেই তো।সুনামের মতো কাজ কর্ম করতে হয়।আর ব’কু’নি খাওয়ার মতো কাজ কর্ম করলে ব’কু’নি শুনতেই হয়, হুঁ। অ’ক’র্মা’র ঢেকি।সে আবার গুনগান আশা করে।ভাবা যায়!”

নীল ধমক দিলো।জারা নির্বিকার রইল।নীল দাঁতে দাঁত পিষে ফের বলল,”বাসায় যতক্ষণ থাকি আম্মু সারাক্ষণ কানের পাশে একই ভা’ঙ্গা টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে যাবে, বাড়ির একটা ছেলে কীরকম?আরেকটা কীরকম বাউন্ডুলে।নীল জারিফকে দেখেও তো শিখতে পারিস।বড় হয়েছিস।এবার একটু সিরিয়াস হবি তো।”

নীল নিরুপমা বেগমকে কপি করে এরকম বলতে থাকে।জারা এসব শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।সাথে নাতাশাও।নীল ধমক দিলো।জারা হাসি থামাল।নীল বলল,

“এতদিনের বিষয়গুলো বাড়িতে ছিলো মানা যাচ্ছিল। কিন্তু আজকের বিষয়টা আর মানা যাচ্ছে না। উফ।এখন আমার শখের বাইকটায় কিনা এই শাকচুন্নীটাকে বসাতে হবে।ও নো!”

জারা ছোট ছোট চোখ করে চাইল।বোঝার চেষ্টা করল।কি বলতে চাইছে নীল।জারা কিছু ভেবে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পারলাম।আমাকে বাইকে চড়ালে।এই দৃশ্য তোর ডজন খানেক গার্লফ্রেন্ড দেখলে ব্রেক আপ হয়ে যাবে।তাই তোর এত চিন্তা হচ্ছে।তোর তো পাড়ার,এই অলিতে,ঐ গলিতে, মোড়ের এপাশে , ওপাশে, এখানে , সেখানে ডজন খানেক গার্লফ্রেন্ড।কেউ না কেউ তো আমাকে বাইকে দেখবে।আর ভুলভাল ভাববে।আর সোজা ব্রেক আপ করিয়ে দেবে এই জন্য তোর চিন্তা হচ্ছে।তাইতো?”

“যেমনি উদ্ভট এলিয়েন একটা।তেমনি তার চিন্তা-ভাবনা।যা কথা বলা বাদ দিয়ে উঠে বস।”

কথাটা বলতে বলতে নীল বাইকে বসলো।জারা মুখ বাকালো। নাতাশাকে বাইকের মাঝে বসালো। অতঃপর জারা বসলো।জারা বসে নড়াচড়া করতে থাকে।নীল পিছনে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে বলল,”এই এভাবে নড়াচড়া করছিস কেনো?কি সমস্যা তোর,হ্যা?”

জারা মুখটা শুকনো করল।ঢোক গিলে নিয়ে একটু কম্পিত স্বরে বলল,”এই রে আমার ভীষণ ভ’য় হচ্ছে।তোর বাইকে চড়া মোটেও উচিত হয়নি আমার।নাতাশাকে নিয়ে রিকশা করে গেলে তাও সেফটি থাকতাম। ভ’য় হচ্ছে। তোর চালানোর সাইজ আমার ভালো ঠেকছে না। মনে হচ্ছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাচ্ছিস।কোনো খালে -টালে নামিয়ে দিস না,ভাই। দোহাই তোর। জীবনটা শুরু করার আগেই শেষ করে ফেললাম আজ বুঝি। শ্বশুরের ছেলে মাফ করে দিও। তোমার সাথে সাক্ষাৎ টা আর হলো না আমার।”

জারা এর আগে কখনো বাইকে চড়েনি।এই প্রথম বাইকে চড়েছে।তাই কেমন জানি মাথা ঘুরছে।নীল ধমক দিয়ে বলল,”নাতাশা এইটুকু বাচ্চা কত সুন্দর চুপচাপ বসে আছে।আর এত বড় মেয়ে কিনা বাচ্চাদের মতো ভ’য় পাচ্ছে।লাইক সিরিয়াসলি?”

শেষের কথা বলে নীল হাসতে থাকে।জারা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,”নীল ভাইয়া সত্যি আমার মাথাটা কেমন ঘুরছে।”

নীল বাইক থামালো। নিজের মাথার হেলমেট খুলে
জারাকে পড়িয়ে দিলো।নাতাশার পাশ দিয়ে হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরতে বলল।জারা তাই করল। নাতাশার পাশ ঘেঁষে হাত দিয়ে নীলের কোমড় জড়িয়ে ধরলো।নীল স্লো গতিতে বাইক চালালো।
.
জারিফ লিয়া মলের সামনে ওয়েট করছিলো। অবশেষে ওরা আসল। প্রথমে ওরা শাড়ির দোকানে ঢোকে।জারিফ বিয়েতে লিয়াকে শাড়ি নিতে বলে। লেহেঙ্গার থেকে শাড়িতেই নাকি লিয়াকে ভালো লাগে।তাই লিয়াও দ্বিমত না করে জারিফের পছন্দকে ফাস্ট প্রায়োরিটি দিলো। গোল্ডেন কালারের ভারী শাড়ি নেয়।জারিফের জন্য সাদা শেরওয়ানি। সাদা শেরওয়ানির গলার দিকে গোল্ডেন কালারের সুতির দারুণ কারুকার্য করা। অতঃপর একএক করে কসমেটিকস থেকে শুরু করে সব কেনাকাটা শেষ করতে করতে রাত হয়ে যায়।জারিফ রাহবারের জন্যও পোশাক কিনে।জারিফ জারিফদের বাসার সবার জন্য পোশাক কিনলো।নীল,জারা ওদের পছন্দমতো পোশাক নেয়।রাতে ওরা একটা রেস্তোরাঁয় ঢোকে ডিনার করতে।

নীল,জারা পাশাপাশি বসেছে।লিয়ার একপাশে নাতাশা আরেক পাশে জারিফ।জারা মেন্যু কার্ডটা নিয়ে দেখছে কি অর্ডার দিবে।নীল বসে ফোন স্ক্রল করতে করতে বলল,”এই জারা। তাড়াতাড়ি অর্ডার দে। কতক্ষন ধরে এভাবে দেখেই যাচ্ছিস।এমনিতেই রাত হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি কর।”

অবশেষে ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করা হয়।নাতাশা বড় করে হামি দেয়।লিয়া তা দেখে নাতাশার দিকে চেয়ে বলল,”ঘুম পাচ্ছে সোনা।”

নাতাশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।নাতাশার কপালে ঘাম জমেছে।লিয়া নিজের ওড়না দিয়ে নাতাশার কপালের ঘাম মুছে দিতে থাকে।এমন সময় অপর পাশ থেকে ওড়নায় টান লাগে।লিয়া ঘাড় ফিরাল। জারিফ লিয়ার ওড়না দিয়ে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে থাকে।লিয়া ভ্রু যুগল কুঁচকে চাইল।জারিফ ফিসফিসিয়ে বলল,”আমার দিকে তোমার তো নজর নেই।আমাকে তো কেউ আদর করে মুছে দিবে না।তাই নিজেই মুছে নিলাম।”

লিয়া নিজের মুখের সামনে এক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে থামতে বলল জারিফকে। সামনে নীল জারা আছে।নীল এমন কিছু শুনলে টিপ্পনি কাটতে দু সেকেন্ড দেরি করবে না।এরমধ্যে ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে।খাবার শেষে জারিফ বিল পে করতে যায়।আর ওরা বাইরে বের হতে থাকে।জারিফ বিল পে করে বাইরে এসে নীলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“নীল তুই গাড়ি নিয়ে যা।নাতাশা আর জারাকে নিয়ে এখন রাতে বাইকে যাওয়া ঠিক হবে না।এমনিতেই নাতাশার ঘুম পাচ্ছে।আমি লিয়াকে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরছি।”

“ঠিক আছে ব্রো।তুই তাহলে বাইক নিয়ে যা।এমনিতেও জারার অভ্যাস নেই বাইকে বসার।খালি নড়াচড়া করে।”

নীল ড্রাইভিং সিটে বসলো।জারা সামনের সিটে বসে নাতাশাকে পাশে বসালো।জারিফ জারার পাশের ডোর আটকিয়ে দিতে দিতে বলল,”এই নীল দেখে ড্রাইভ করিস।আর কোথাও কিন্তু নামিস না।এমনিতেই অনেক রাত হয়েছে।সোজা বাসায় যাবি।”

“ঠিক আছে ব্রো।ভাবী ভালো থাকবেন আসি।সামনের সপ্তাহে দেখা হচ্ছে।”

লিয়া বিনিময় মৃদু হাসলো।জারিফ বাইকে বসলো।লিয়াকে ইশারা করল বসতে।লিয়া উঠে বসল। প্রায় রাত দশটা বাজে ।শহুরের যানজট পূর্ণ রাস্তাটা এখন একটু ফাঁকা।দিনের মতো কোলাহলপূর্ণ নয়।লোকজনের চলাচলও কম। শহুরে রাস্তা ছেড়ে বাইক যত হাইয়ে দিয়ে যেতে থাকল। বাতাসের গতি তত বাড়তে থাকল।রাতে বাইরের বাতাসটা বেশ সুন্দর ঠান্ডা ঠান্ডা। আকাশের বুকে নক্ষত্ররাজি মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায় শো শো করে বাইক চলছে।লিয়া জারিফ দু’জনের কাছেই সময়টা বেশ এনজয়েবল।লিয়া একহাতে জারিফের কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে।জারিফ লিয়াকে উদ্দেশ্য করে মৃদুস্বরে বলল,
“লিয়া।”

“হুম।”

“কালকেই বাড়ি যাবে?বাড়ি গেলে এরমধ্যে তো তোমার সাথে আর দেখা হবে না।এখানে থাকলে তাও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।”

লিয়া জারিফের কাঁধে থুতনি রাখল।চোখ বন্ধ করে বলল,”এক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার।দেখতে দেখতে চলে যাবে।”

“ইশশ্!বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে।এই শুক্রবার বিয়ের ডেট হলে ভালো হতো।”

বাইক এসে বাসার সামনে থামল।লিয়া নামল।বলল,”নামতে বলেও নামবেন না জানি।তাই আজ আর বললাম না। যেহেতু নামবেন না।আর বেশি রাত হয়ে গিয়েছে তাই বলছি দেখেশুনে যাবেন।বাসায় গিয়েই কল করবেন।আমি আপনার কলের অপেক্ষায় থাকব।”

“নিশ্চয় জানাবো।তবে এখন যাওয়ার সময় অন্তত মিষ্টি করে একটা কিস তো দাও।”

লিয়া লজ্জা পেলো।আমতা আমতা করে বলল,”এভাবে বাইরে।কেউ দেখবে।”

জারিফের সোজাসাপ্টা উত্তর,”রাত এগারোটা বাজতে চললো।এতো রাতে তোমার আমার রোমান্স দেখার জন্য কেউ হয়তো বেলকনিতে বসে নেই।সো ফাস্ট।”

লিয়া ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল।জারিফের গালে আলতোকরে ঠোঁট ছোয়ালো।জারিফ এক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে অপর গাল দেখালো।লিয়া ফের ঠোঁট ছোয়ালো।জারিফ এবার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারা করল।লিয়া দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে না করল।লিয়া জারিফের দিকে ঝুকেই ছিলো।আচমকা জারিফ লিয়ার ঠোঁটে কিস করল।লিয়া চোখ বড় বড় করে চাইল। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে জারিফ বলল,

“সরি।একেবারে সাতদিনের টা আজকে নিলাম।তাই টাইমটা একটু বেশি।”

এতক্ষণ লিয়ার দম আঁটকে ছিলো যেনো।লিয়া বড়করে শ্বাস টেনে নিলো। অতঃপর বিদায় নিয়ে লিয়া বাসায় আসে।
.
আজ বৃহস্পতিবার। আজকে লিয়া জারিফের হলুদ আর মেহেন্দি। কমিউনিটি সেন্টারে একসাথে দু’জনের হলুদ, মেহেন্দি হবে।এটার মূল প্ল্যানে ছিলো নীল,জারা।ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ আগেই। লিয়ার ঘুম ভাঙ্গে ফোনের ভো ভো শব্দে। ঘুমঘুম চোখে লিয়া ফোনটা বালিশের পাশ থেকে হাতে নিলো। ঘনপল্লব দ্বয় টেনে তুলে স্ক্রিনে জারিফের নাম দেখে,এক চিলতে হাসি ফুটল লিয়ার ঠোঁটের কোণে।লিয়া রিসিভ করে ঘুমঘুম কন্ঠস্বরে বলল,

“হ্যা,বলুন।”

চলবে,,,

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৪১

মেঘলা আকাশ।সাথে মৃদু শীতল বাতাস বইছে। আজকে সকালের আবহাওয়াটা নাতিশীতোষ্ণ।গত কয়েকদিনের তাপদাহের পরে আজকের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার। চমৎকার আবহাওয়ার মতই জারিফের মন মেজাজও বেশ চমৎকার আছে। ব্যালকনিতে বসে একহাতে কফির মগ ।অপর হাতে ফোনটা কানে ধরে আছে। ঠান্ডা বাতাস একটু পরপর জারিফের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে।এমন সময় ব্যক্তিগত নারীটির ঘুমঘুম মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে জারিফের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা প্রশস্ত হয়।জারিফ ঝলমলে গলায় বলল,

“শুভ সকাল,ম্যাম।”

লিয়া কাৎ হয়ে শুয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করে একহাতে ফোনটা কানের সাথে ধরে আছে।জারিফের গলা শুনে মনটা পুলকিত হলো।সকাল সকাল মনটা ভালো লাগায় শিহরিত হলো।লিয়া বলল,

“শুভ সকাল,জনাব।”

একটু সময় নিয়ে লিয়া ফের বলল,”তা আজ হঠাৎ এত সকাল সকাল ফোন।কি মনে করে?”

জারিফ কফির মগে ঠোঁট ছোয়ালো।গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে মায়াময় স্বরে বলল,”তোমায় মনে করে।তোমার কথা ভাবছিলাম।তাই।”

“তা এত সকাল সকাল কি কারনে আমার কথা ভাবছিলেন, জানতে পারি?”

জারিফ চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।দুই পা টানটান করলো।আলসেমি ছাড়ানোর ভঙ্গিমা করল। অতঃপর বলল,”তোমাকে ভাবার জন্য আমার কোনো কারনের দরকার পরে না।তুমি আমার এমন এক ভাবনা,যা সব সময় আমার মনমস্তিষ্কে গেঁথে আছো।তুমি আমার সেই ভাবনা,যেটা আমার থেকে কখনোই যায় না।আর ইউ ক্লিয়ার?মাই ডিয়ার বউ।”

লিয়া নিঃশব্দে চমৎকার হাসল।লিয়া উঠে বসল।একহাতের সাহায্যে একটা বালিশ নিয়ে কোলের উপর রাখল।বালিশের উপর কনুই ভর দিয়ে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে ছোট করে বলল,”হুমম।”

“আজ এক সপ্তাহ হতে চলছে তোমাকে দেখি না। মনটা খুব ব্যাকুল হয়েছে তোমাকে দেখার জন্য।সময় যেনো কাটতেই চাইছে না।আমার দুচোখ তৃষ্ণার্ত তোমাকে কাছ থেকে দেখার জন্য।”

লিয়া মৃদু হাসল।বলল,”ওয়েট মিস্টার,ওয়েট।এতো ব্যাকুল হওয়ার কারন নেই।আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই আমাদের দেখা হচ্ছে।”

জারিফ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,”অপেক্ষায়ই তো আছি।অপেক্ষার প্রহর যে শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। ইশশ্! কবে আসবে সেদিন।যেদিন তোমার বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির সাথে ঘুমাবো।ঘুম ভেঙ্গে তোমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ পাবো। প্রতিটা সকাল শুরু হবে তোমার মিষ্টি আদরে।”

লিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,”আজ বাদে আর মাত্র একদিন।তার পরেই আপনার সব ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, মিস্টার।”

“আ’ম এগারলি ওয়েটিং ফর

লিয়ার কথায় জারিফ থেমে যায়।কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।দরজায় নক করার শব্দ হয়।সাথে রাজিয়া সুলতানার গলার আওয়াজ আসল।জারিফের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে লিয়া তড়িৎ বলল,”আম্মু ডাকছে।এখন রাখছি।পরে কথা বলবো।”

“ওকে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

লিয়া ফোন কাটল।ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল,”আম্মু।দরজা লক করা নেই। এমনি চাপিয়ে দিয়ে রাখা।তুমি ভেতরে আসো।”

রাজিয়া সুলতানা ভেতরে আসলেন। টেবিলের উপর দেওয়ালের সাথে সুইচ বোর্ডের সাথে ফোনের চার্জার লাগানো ছিলো।হাতে থাকা ফোনটা চার্জে দিয়ে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ব্যস্ত গলায় বললেন,”আমার ফোনের চার্জার তো আনা হয়নি।এদিকে ব্যস্ততার মাঝে আজ কদিন ফোনে চার্জ দেওয়াও হয়নি। বিভিন্ন সময় দরকারে ফোন হাতে নিলেও খেয়াল করা হয়নি।এখন তোর মামার সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্যাটারি একদম লো দেখাচ্ছে।”

লিয়া বিছানা ছেড়ে নামছিলো।মায়ের শেষ কথাশুনে কপাল কুঁচকে পা ঝুলিয়ে বসল। উৎসুকভাবে শুধালো,”ও আম্মু!মামা কি বলল?কখন আসবে?নানুভাই আসবে কি?”

“হ্যা।তোর নানুভাই,মামা-মামীসহ সবাই আসছেন। রাস্তায় কোনো সমস্যা না হলে।বারোটা নাগাদ চলে আসবে।”

“ওহ্।”বলে স্যান্ডেলের ভেতর পা দিতে গিয়ে লিয়ার কিছু মনে হতেই ফের বলল,”আম্মু।তোমার কাছে না আমার পায়েল ঠিক করতে দিয়েছিলাম।পায়েলটা কর্মকারের শপ থেকে এখনো আনোনি নাকি।আজ কতদিন হয়েছে আমার পা টা খালি।”

রাজিয়া সুলতানা লিয়ার দিকে এগিয়ে আসলেন।এমন সময় লিয়ার মুখে পায়েলের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন,”এই রে!পায়েলটা তো বাসায়ই আছে।সেরে এনেছি তো।তোকে দেবো ভুলে গিয়েছিলাম।আসার আগের দিনই ঠিক করে এনেছিলাম। ইদানিং সব কিছু ভুলো মন হয়েছে আমার দেখছি। আচ্ছা ঠিক আছে।আমি দেখছি কাউকে দিয়ে বাসা থেকে আনানো যায় কিনা।তুষারের সাথে রাহবার কে পাঠাবো। রাহবারকে বলে দিবো কোথায় রাখা আছে। রাহবার তাহলে খুঁজে পাবে।”

লিয়া রাজিয়া সুলতানার কোমড় দুইহাতে জড়িয়ে ধরল।পেটে মুখগুজে আহ্লাদি স্বরে বলল,”ও আম্মু।তোমাকে এতো ব্যস্ত হতে হবে না।থাক লাগবে না এখন।ও বাড়ি থেকে যখন বাসায় যাবো তখন নেবো।”

‘ও বাড়ি’ কথাটা শুনে রাজিয়া সুলতানার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।এত আদরের মেয়ে কালকে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে।এরপর বাবার বাড়ি নাইওরে আসবে। যেখানে বেঁধে দেওয়া থাকে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ।এরপর আবার স্বামীর ঘরেই ফিরতে হবে।মেয়েটা ছাড়া পুরো বাসাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা নিষ্প্রাণ মনে হবে তা ভাবতেই, দুচোখ ছলছল করে উঠল।চোখের কার্নিশ গড়িয়ে দুফোঁটা নোনাজল গাল বেয়ে পরতেই মেয়ের অলক্ষ্যে সন্তর্পণে মুছে নিলেন।মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন।নিজেকে কোনো রকমে স্বাভাবিক রাখলেন। মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদূরে গলায় বললেন,

“লিয়া সোনা মা আমার।যা ফ্রেশ নে। ব্রেকফাস্টে কি খাবি বল।যা খেতে মন চায় ,আমাকে বল।আমি নিজে রান্না করবো।”

লিয়া মাথাটা উপরের দিকে তুলে চাইল।মাথা ঘুরিয়ে বলল,”উঁহুম!লাগবে না আম্মু।এমনিতেই তুমি খুব ব্যস্ত।সব মেহমানদের আ্যপায়ন করতে গিয়ে এক দন্ড জিরানোর সময় পাচ্ছো না। সেখানে এখন তোমাকে কষ্ট করে কিছুই রান্না করতে হবে না।আর সত্যি বলতে আমার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না, আম্মু।দেখা গেলো তুমি কষ্ট করে রান্না করলে,অথচ আমি খেতেই পারলাম না।”
.
বিকাল চারটে বাজতে চলছে। এতক্ষণে হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা।আর সন্ধ্যায় মেহেন্দি পর্ব হবে।দুই পরিবারের লোকেরাই কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।একসাথে এসব করার পেছনে দুইবাড়ির বাচ্চা পার্টিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।মূলত এরকম ডিসিশনের মূল উদ্যোক্তা তারাই।লিয়াকে একটা রুমে পার্লারের দুইজন মেয়ে সাজাচ্ছে।লিয়ার সাথে জারিফের এখনো দেখা হয়নি। জারিফ বাইরে ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।সবুজ পার বিশিষ্ট হলুদ শাড়ি লিয়াকে পড়ানো হয়। কাঁচা ফুলের গহনা লিয়ার গায়ে।হলুদ গোলাপ আর হলুদ গাঁদা ফুল দিয়ে সুন্দর করে লিয়াকে সাজানো হয়েছে। সিঁথি ছাড়া চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা। খোঁপায় শোভা পাচ্ছে কাঁচা ফুলের মালাটা।লিয়ার চুলগুলো বাঁধতে গিয়ে আর্টিস্ট মেয়ে দুইটা সে কি লিয়ার চুলের প্রশংসা করা।’ম্যামের চুলগুলো খুব ঘন আর স্লিকি।আমার তো ম্যামের চুলগুলো দেখে ভীষণ হিংসে হচ্ছে।”আরো হেনোতোনো কথা বলতে থাকে মেয়ে দুইটা।লিয়া নিঃশব্দে হাসল। দীর্ঘ সময় নিয়ে লিয়াকে সাজানো হয়।দক্ষ হাতে লিয়াকে সাজানো হয়েছে। ধবধবে সাদা গায়ে হলুদ শাড়ি, ঠোঁটে খয়েরি রঙের গাঢ় লিপস্টিক র’ক্ত জবার ন্যায় দেখাচ্ছে ।পাতলা চিকন ওষ্ঠজোড়া বেশ নজর কাড়ছে।চোখে মোটা করে কাজল দেওয়া।শাড়ির আঁচলটা চুলের খোঁপার সাথে পিন দিয়ে সেট করে দেওয়া হয়।এবার একদম পরিপূর্ণ সাজ।মেয়ে দুইটার একজন বলল,

“ম্যামকে একদম হলুদ পরী লাগছে।ম্যাম আয়নায় দেখুন একবার। দেখুন।”

লিয়া চোখ তুলে চাইল।উঠে দাঁড়াল।আয়নার সামনে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে লিয়া লজ্জা পেলো।জারিফ নিশ্চয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে।আর উল্টাপাল্টা বেফাঁস কথা বলবে।এই ভেবে লিয়া লজ্জায় লাল,নীল হলো।
.
লিয়াকে স্টেজে বসানো হয়। লিয়ার পাশে বাচ্চা পার্টি মেয়েরা বসে খোশ গল্প করছে।বড়রা এখানে তেমন কেউ নেই। আলাদা স্পেসে তারা কথাবার্তা বলছে হয়তো।লিয়ার ক্লোজ দুই ফ্রেন্ড আজ এসেছে। অনেকদিন পর আজ রুপন্তীর সাথে লিয়ার দেখা হলো। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীকে দেখে লিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পরে। রুপন্তীকে জড়িয়ে ধরে। হরিণী আঁখিযুগল টলমল করে উঠে লিয়ার। রুপন্তী একটা পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।অন্য জেলায় থাকার সুবাদে লিয়ার সাথে অনেকদিন দেখা হয় না।তবে ফোনে সব সময়ই যোগাযোগ হয়।অরিনকে রুপন্তীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় লিয়া।অরিন সাদা আর হলুদের কম্বিনেশনের চুড়িদার পরেছে।গায়ে সাদা কামিজ, হলুদ ওড়না,হলুদ চুড়িদার ফর্সা গায়ে দারুণ লাগছে। চুলগুলো ঝুঁটি করে উপরে বাধা। কাঁধের একপাশ দিয়ে চুলগুলো সামনে রেখে দেওয়া।বেশিরভাগ মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরেছে।আর ছেলেদের কেউ কেউ হলুদ পাঞ্জাবী। ছোট্ট নাতাশাও আজকে হলুদ শাড়ি পরেছে,ফুল দিয়ে সেজেছে। লিয়ার পাশে বসে আছে।

হালকা ভলিউমে মিউজিক চলছে।অরিন মুচকি হেসে টিপ্পনি কে’টে বলল,”এই লিয়া স্যার কই রে?স্যারকে এখনো দেখছি না যে।স্যার তার ছাত্রীর এহেন হলুদ সাজে সজ্জিত অনিন্দ্য রূপসী রুপে দেখেছে কি? মনে তো হচ্ছে এখনো তোকে দেখেনি।স্যার তোকে এই মারাত্মক লুকে দেখলে বেহুঁশ হয়ে না পরে।

আমি জ্ঞান হারাবো ম’রে’ই যাবো বাঁচাতে পারবে না কেউ।”

এক্টিং করে লিয়ার গায়ে ঢলে পরে সুর করে গাইল অরিন।লিয়া কটমট চোখে চাইল।অরিন সোজা হয়ে বসে ঠোঁট টিপে ফের বলল,”এটা আমার কথা ছিলো না, দোস্ত।আমি তো স্যারের কথা বলছি।স্যার হয়তো এরকম রিয়াকশন দেবে।তার সুন্দরী ছাত্রী প্লাস বউকে দেখে।”

লিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”স্যার হয় না তোর।তাই এভাবে বলা সাজে না তোর।”

“আজকে নো স্যার।আজকে শুধুই বান্ধবীর বর হিসেবে স্যারকে টিট করবো।”

এরমধ্যে রুপন্তী বলল,”জারিফ ভাইয়াকে তো বাইরে দেখলাম।রোহান ভাইয়া সহ আরো কয়েকজনের সাথে গল্প করতে দেখলাম।আমাকে ভেতরে দিয়ে আমার ভাইয়াও তো সেখানে যোগ দিলো।ওনারা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এখনো লিয়াকে দেখেনি বোধহয়।”

এরমধ্যে জারা হাতে করে মিষ্টির ট্রে এনে রাখল।লিয়ার সামনে কয়েক রকমের মিষ্টি, ফলমূলের ট্রে রাখল।তুলি জারাকে হাতে হাতে হেল্প করল সব কিছু সাজিয়ে রাখতে।সবশেষে হলুদের তত্ব এনে রাখতে রাখতে জারা নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এই নাতাশা যাও তো বাইরে থেকে তোমার মামাকে ডেকে আনো।মামাকে গিয়ে বলো,নানুমনি ডেকেছে।হলুদ অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে।মা তাড়া দিচ্ছে।এদিকে ভাইয়ার কোনো হেলদোল নেই নাকি।আ’জ’ব! সন্ধ্যার পর আরেক প্রোগ্রাম আছে।তারপর ভাবীদেরকে আবার ওতটা পথ যেতে হবে।”

নাতাশা উঠে যাবে এমন সময় সামনে তাকিয়ে জারিফকে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,”ঐতো মামা চলে এসেছে।”

জারিফের সাথে ওর ফ্রেন্ডরা। লিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য জারিফ আসছিলো।যদিও সবাই লিয়াকে আগে থেকেই দেখেছে এবং জারিফের বউ তা জানেও।তবে কখনো সামনাসামনি পরিচয় হয়নি।রুপমের বিয়ের মধ্যে যতটুকু জেনেছিলো এই। স্টেজের দিকে আসতেই সবার মাঝে জারিফের শান্ত নজরজোড়া থমকে যায় লিয়াকে দেখে।জারিফ সুগভীর নিষ্পলক চাহুনিতে লিয়ার দিকে ঠাঁই তাকিয়ে রয়।হলুদ শাড়িতে ব্যক্তিগত রমণীকে একদম অপ্সরা লাগছে।জারিফের একহাত আপনাআপনি বুকের উপর চলে যায়। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে যায়।হরিণী আঁখিযুগলে গাঢ় কাজল। দারুণ আকর্ষণীয় লাগছে। অনেক আগেই ঐ মায়াবী চোখে নিজেকে হারিয়েছে জারিফ।ঐচোখে তাকিয়ে জারিফের চোখে নে’শা ধরে যাচ্ছে। মা’তাল হাওয়া বইছে যেনো হৃদয় কুঠরিতে। উফ্! নিজেকে বড্ড বেসামাল ঠেকছে জারিফের।নাতাশার মুখে মামা আসছে শুনে লিয়া সামনে তাকাল।খানিকটা দূরে জারিফকে দেখতে পায়।জারিফের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি উপরে হলুদ কটি। পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। ফর্সা হাতে কালো ব্রান্ডের ঘড়ি।জারিফকে ভীষণ আকর্ষণীয়, হ্যান্ডসাম লাগছে। লিয়া তাকাতেই জারিফের সাথে চোখাচোখি হয়। জারিফ থ্যাম্বলস আপ দেখিয়ে ইশারায় বোঝাল, “দারুণ লাগছে।”লিয়া লজ্জা পেলো।মাথাটা নুইয়ে নিলো।পেছন থেকে রোহান দুষ্টুমির স্বরে বলল,

“আরে জারিফ দোস্ত।ভাবীকে পরে মন ভরে দেখিস।ভাবীকে দেখার জন্য সামনে পুরো জীবনটাই পরে আছে তোর।এখন আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে।সাথে তোর যত শালিকা আছে তাদের সাথেও।আমাদেরও তো এবার সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হতে হবে নাকি?”

জারিফ রোহানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো।রোহান থামল। অবশেষে জারিফ লিয়ার সাথে ওর ফ্রেন্ডদের পরিচয় করিয়ে দেয়। লিয়া নম্রস্বরে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল।রোহান,শাওন এটাসেটা কথা বলল।লিয়া কার্টেসি মেইনটেইন করতে হ্যা, হুঁ দুই একটা কথা বলল।

জারা জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,”এই ভাইয়া ভাবীর পাশে বস।মা, আন্টিরা এক্ষুনি চলে আসবে। এখন হলুদ ছোঁয়ানো হবে।”

জারিফের নজর হলুদের বাটির দিকে যায়।জারিফ জারার কথার উত্তর না দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলো।সামনে থেকে একটা ট্রে একটু সরিয়ে রাখল।সেখানে বসল।জারা হইচই করে উঠে বলল,”ওখানে বসছিস কেনো? এখানে ভাবীর পাশে বস।”

জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,”ওয়েট।দেখ।”

জারা ঠোঁট উল্টে চুপচাপ রইল।সবাই জারিফের দিকে উৎসুক চোখে চেয়ে।জারিফ দুই আঙ্গুলে হলুদের গাঢ় প্রলেপ জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,”সবার আগে আমিই শুরুটা করি।”

“হাওয়া কেনো আজ হয়েছে মাতাল কানে কানে বলে..”গানটা চলছিলো। চমৎকার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে।এমন সময় জারিফ দুই আঙ্গুলে হলুদ জড়িয়ে নিলো। অতঃপর লিয়ার ফর্সা গালে ছুঁইয়ে দিলো।গালে ঠান্ডা অনুভব হতেই লিয়ার সর্বাঙ্গে শিরশিরানি বয়ে যায়। অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হয়।লিয়ার হরিণী টানাটানা নজরজোড়া জারিফের শান্ত চাহনিতে আবদ্ধ হয়।নীল ওর আইফোনে সুন্দর এইদৃশ্যের ফটাফট পিক তুলতে থাকে।নীল ছবি তুলতে তুলতে বলল,

“ওয়াও! গ্রেটস ব্রো!”

সবার মাঝে জারিফের এহেন কাজে লিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়।লিয়ার ভীষণ লজ্জা লাগতে থাকে।তবে জারিফ নির্লিপ্ত আছে।জারিফ লিয়ার অপর গালেও হলুদ ছুঁইয়ে দেয়।জারিফ টিস্যু দিয়ে হাতটা মুছে নেয়। কাঁটা চামুচটা ডান হাতে নিয়ে একটা কালো জাম তুলল।লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।লিয়া লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হয়েছে। এখন সবার মাঝে জারিফের হাত থেকে খেতে হবে। উফ্!জারিফ নিশ্চয় তাকে আজ লজ্জায় পি’ষ্ট করার পণ করেছে। লিয়ার দুইগালে লাল আভা ছড়িয়ে পরল।লিয়া অবশেষে মুখটা সামান্য হা করল। মিষ্টির একপাশ থেকে সামান্য একটু বাইট দেয়।হাতের বাকি মিষ্টিটুকু জারিফ নিজের গালে পুরে নিলো।নীল, অরিন অনেকে মজা নিতে ভুললো না।তবে জারিফ সেসবে পাত্তা দিলো না। জারিফ পকেট থেকে একটা লাল রঙের বক্স বের করল। বক্স থেকে স্বর্নের একটা ব্রেসলেট বের করল। লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

“আমার তরফ থেকে এটা তোমার হলুদের গিফট। এই সামান্য গিফটটা গ্রহণ করলে খুশি হবো।”

লিয়ার ভীষণ ভালো লাগলো। আনন্দে লিয়ার দুচোখ ছলছল করে উঠল।লিয়া ওর হাতটা জারিফের সামনে বাড়িয়ে দিলো।জারিফ মৃদু হাসল।জারিফ ব্রেসলেটটা লিয়ার হাতে পরিয়ে দিলো।লিয়ার ফর্সা হাতে সোনালি রঙের ব্রেসলেট ঝলমল করছে। দারুণ দেখাচ্ছে ।জারিফের প্রচন্ড ইচ্ছে করছিলো লিয়ার হাতে ঠোঁট ছোঁয়াতে।এখানে ফ্রেন্ডরাসহ,ছোটো অনেকে আছে বিধায় ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল।লিয়া একবার হাতের দিকে চাইল। আরেকবার জারিফের দিকে চেয়ে কোমল স্বরে বলল,

“থ্যাংকস।খুব সুন্দর হয়েছে।”

জারিফ ফিসফিসিয়ে বলল,”শুধু থ্যাংকস শুনে আমি স্যাটিসফাইড নই।এরজন্য কড়া মিষ্টি পাওনা রইলো।”

এইটুকু বলে জারিফ সোজা হয়ে বসল।তারপর বলল,”আমার কাজ আপাতত শেষ।তোমরা ইনজয় করো।আমি বাইরে আছি।”

জারা কপাল কুঁচকে তড়িৎ বলল,”বাইরে আছি মানে।তোকেও তো হলুদ দিতে হবে।”

“ছেলেরা আবার হলুদ টলুদ মাখে নাকি।যাইহোক আমাকে বাদ দে বোন।তোরা ইনজয় কর।আমি আসছি।”

“এই জারিফ তাই বললে হয় নাকি।যদিও এটার বাধ্যবাধকতা নেই।তবুও সাধারণত বিয়েতে এসকল রিচুয়াল হয়ে থাকে।”

কথাটা বলতে বলতে জাহানারা বেগম জারিফের কাছে এগিয়ে আসলেন।সাথে রাজিয়া সুলতানা, নিরুপমা বেগমসহ লিয়ার চাচিমারা।জারিফ বেকায়দায় পরল।এসব হলুদে জারিফের কোনো ইন্টারেস্ট নেই।তবে মা যখন বলল তাই আর সরাসরি না করতে পারল না।তাই বলল,
“আচ্ছা।বাধ্যবাধকতা যখন নেই বলছো।আর সাধারনত সবাই করেই থাকে।তাই বলছি হালকা করে একবার ছুঁইয়ে দাও।তাহলেই তো হবে।”

জাহানারা বেগম স্মিত হাসলেন।একপাশে বসলেন বললেন,”আচ্ছা তোকে জোর করবো না।তবে অল্প করেই দিচ্ছি।”

জাহানারা বেগম জারিফের দুইগালে হালকা করে হলুদ ছোয়ালেন।ছেলেকে মিষ্টি মুখ করালেন। অতঃপর লিয়াকে।জারিফ ওর বন্ধুদের সাথে ওখান থেকে বাইরে চলে আসে। প্রথমে বড়রা অতঃপর ছোটরা লিয়াকে হলুদ ছোঁয়ায়।তবে হলুদের স্পেসে শুধু মেয়েরাই আছে।ছেলে মানুষরা আলাদা জায়গায় নাস্তা পানি খাচ্ছে আর গল্প গুজব করছে।জারিফ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ছেলে মানুষ লিয়াকে হলুদ ছোঁয়ায়নি।লিয়ার দুই গাল কপালে হাতে হলুদে মাখামাখি।হলুদে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশটা।হলুদ শেষে লিয়াকে গোসল করানোর কথা বললে লিয়া বলে একাই করবে।ভেতরের বড়সড় ওয়াশরুমে লিয়া একাই গোসল সেরে নেয়।জারা একটা নামিদামি শপিং ব্যাগ নিয়ে আসল। আর্টিস্ট মেয়ে দুইটার হাতে দিয়ে এটা পরাতে বলল।ব্যাগের ভেতর স্লিকের সবুজ শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ,পেটিকোট।হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লিয়ার চুল শুকাচ্ছে পার্লারের মেয়েরা।তাসনিম একটা চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রল করছে আর লিয়ার সাথে এটাসেটা কথা বলছে।আলিফের সন্ধ্যার দিকে আসার কথা আছে।এখান থেকে একসাথে শ্বশুর বাড়ি যাবে।

বড়রা পাশের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়তে যায়।আর মহিলারা ভেতরে নামাজের জন্য জায়গা আছে সেখানে নামাজ আদায় করে নেয়।কিছু আত্বীয় সন্ধ্যার আগেই চলে যায়।এখন দুই পরিবারের নিকট আত্মীয়রা আছে।

সন্ধ্যার পর চতুর্থদিক ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে।সব কিছু ঝকঝকা ফকফকা লাগছে।অরিন ফোন কানে ধরে কথা বলতে বলতে হাটছিলো।ওদিকে নীল শরবতের ট্রে হাতে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে হাটছিলো।বড়মা নীলকে বলেছে,ওদিকে লিয়ার নানুভাই আর মামাসহ বড়রা আছেন বেশ গরম পরছে।তাই শরবত টা দিতে।নীল নিয়ে যাচ্ছিল।এমন সময় বেখেয়াল বশত কারো সাথে ধা’ক্কা লাগল।সাথে সাথেই মেয়েলি ঝাঁঝালো গলার আওয়াজ আসল,

“এটা কি করলেন?চোখে দেখেন না নাকি?চোখ কোথায় রেখে ঘোরাফেরা করেন, হ্যা।”

ধা’ক্কা লাগার ফলে গ্লাসে থাকা শরবত কিছুটা উপচে অরিনের গায়ে পরে।নীল এমন কর্কশ গলা শুনে থতমত খায়। অরিনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আমতা আমতা করে বলল,”সরি, ম্যাম।খেয়াল করিনি।”

অরিন ধমক দিয়ে বলল,”রাখেন আপনার সস্তা সরি।দিলেন তো আমার এত সাধের জামাটা ন’ষ্ট করে।”

এই বলে অরিন একহাতে সাদা জামায় লাগা শরবতে ভেজা অংশটা ঝাড়তে থাকল।নীল মুখটা কাচুমাচু করে বিড়বিড় করে বলল,”শুনেছি মেয়ে মানুষের মন খুব নরম হয়।বাপরে বাপ এতো নরম মনের, এতো গরম মেজাজ আমি আগে দেখিনি কখনো। উফ্ফ!জানা ছিলো না।”

অরিন চোখমুখ কুঁচকে বলল,”এই যে হ্যালো।কি বিড়বিড় করছেন,হ্যা?”

হলুদের সময় অরিনকে লিয়ার পাশে দেখেছিলো। আলাপ হয়নি। তবে অনুমান করেছিলো লিয়ার রিলেটিভ হবে হয়তো।লিয়ার রিলেটিভ এটা ভেবে নীল বিষয়টা এড়িয়ে গেল।আর এখন আগে কাজটা করা লাগবে।তাই অরিনের সাথে খামোখা কথা বাড়াল না।নীল কিছু না বলে বড় কদম ফেলে চলে যায়। নীলের এভাবে চলে যাওয়াতে অরিন বেশ অবাক হল।অরিনের ইগোতেও লাগল।ছেলেটা তাকে কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলো। স্ট্রেইন্জ!অরিন ভেবেছিলো।ছেলেটা ইচ্ছে করে ধা’ক্কা দিয়েছে। কোনো খা’রাপ ইন্টেনশন ছিলো হয়তো।তবে নীলের এহেন ভদ্র চিত্ত দেখে অরিন নিজেকে ভুল ভাবে।নীল কিছুই বলল না,এতে অরিন মনেমনে অপমানিত বোধ করল।ঘাড় ফিরিয়ে নীলের যাওয়ার দিকে একপল চাইল।মুখটা বেঁকিয়ে ফের ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। কাঁধের উপর দিয়ে সামনে থাকা চুলগুলো একহাত দিয়ে পিছনে উড়িয়ে দিয়ে,’মেরে পিছে জামানা ছারা..’গাইতে গাইতে হিলে খটখট আওয়াজ তুলে যেতে থাকল।নীল কৌতুহল বশত ঘাড় ফিরিয়ে চাইল।অরিনের এহেন ভাব দেখে মনেমনে আওড়ালো,”মাথায় গন্ডগল আছে নিশ্চয়। ধাক্কা আমার একার দোষে লাগেনি ।সেও তো আমারই মতো বেখেয়াল হয়ে চলছিলো।তাই তো এক্সিডেন্টটা হলো।আর হুদাই কিনা আমাকে ঝা’ড়ি খেতে হলো।যাগগে,পরে দেখে নিবো।”এই ভেবে নীল ঠোঁট গোল করে শিষ বাজাতে বাজাতে যেতে থাকল।
.

মিউজিক বাজছে,
মেহেন্দি লাগাকে রাখনা ঢোলি সাজাকে রাখনা,
লে নে তু’ঝে ও গোরি আয়েংগে তেরে সাজনা….

লিয়ার হাতে মেহেদী দিয়ে আর্ট করা হচ্ছে। পার্লারের একটা মেয়ে আর্ট করে দিচ্ছে। সুনিপুণতার সহিত খুব সুন্দর নজরকাড়া ডিজাইন করছে।লিয়া মনোযোগ দিয়ে দেখছে।এমন সময় জারিফ এসে বলল,

” এসকিউজমি আপু।”

আর্টিস্ট মেয়েটা মাথা তুলে চাইল।জারিফের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,”জ্বি বলুন।”

জারিফ মেহেদি টিউবটা ইশারায় চাইল। মেয়েটা হাসিমুখে জারিফের দিকে বাড়িয়ে দিলো।লিয়া জারিফের ভাব বোঝার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে অরিন বলল,”স্যার নিজে ডিজাইন করে দেবেন। ওয়াও!ভেরি ইন্টারেস্টিং বিষয়টা!”

জারিফ লিয়ার পাশে বসল। ইশারায় হাতটা বাড়িয়ে দিতে বলল।লিয়া ঠোঁট উল্টাল।হাত বাড়িয়ে দিলো।জারিফের হাতটা মৃদু কাঁপছিল। কখনো এসব হাতে ধরা হয়নি।কলম হলে দক্ষ হাতে কিছু লেখা বা আঁকা কোনো ব্যাপার ছিলো না।তবে টিউব হাতে নিয়ে বুঝল,আসলে এসবের জন্য দক্ষ হতে হয়।তবুও জারিফ থামল না।লিয়ার হাতের মাঝে জারিফ আর লিয়া দু’জনের নামটা লিখে দিলো।একটু সময় লাগল বটে।কলমের মতো অতটা গোটাগোটা অক্ষর না হলেও বেশ ভালোই হয়।নিজের কাজ সেরে জারিফ উঠে দাঁড়াল। টিউবটা মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“সরি। সময় লস করালাম।”

মেয়েটা তড়িৎ হাসিমুখে বলল,”ব্যাপার না স্যার।ঠিক আছে।”

লিয়া নিষ্পলক চাহুনিতে নিজের হাতের দিকে চেয়ে থাকল।মেয়েটা ফের তার কাজে মনোযোগ দিলো।
.
জারিফ লিয়া পাশাপাশি বসে আছে।বাকিরা আড্ডা দিচ্ছে সাথে এটাসেটা খাচ্ছে।আবার অনেকে হাতে মেহেদি পড়ছে।জারা জারিফকে মেহেদি লাগানোর কথা বলতেই জারিফ ধমক দিয়ে বলে,”ছেলেদের রঙ লাগাতে হয় না।”জারা আর কিছু বলে না।এখন জারা হাতে মেহেদি নিচ্ছে। তাসনিম নাতাশার হাতে দিয়ে দিচ্ছে।লিয়া দুইহাত টানটান করে বসে আছে।রঙ গাঢ় করার জন্য।সবাই বলেছে আরেকটু সময় পর হাত ধুতে। হঠাৎ লিয়ার ঘাড়ের পাশে চুলকাতে থাকে।হাত জোড়া থাকলে এসব চুলকানি বিষয় যেনো আরো তীব্র বেগে ক্ষেপে উঠে।দুইহাত ভর্তি মেহেদিতে ।ঠিক এমন সময় লিয়ার চুলকানি বাড়তে থাকল।লিয়া বসে উসখুস করছে।লিয়ার নড়াচড়া আর মুখাবয়ব দেখে জারিফ কিছু আন্দাজ করে বলল,

“এ্যনি প্রবলেম লিয়া।”

লিয়া ইশারা করে দেখিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,”চুলকাচ্ছে।হাতে তো মেহেদী।এবার বরং ধুয়ে ফেলি।”

জারিফ তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“এই না না।এখনই ধুয়ে ফেলার দরকার নেই।আমি আছি তো।দেখি কোথায়?”

এই বলে জারিফ লিয়ার পিঠের দিকে ঘাড়ে হাত দিয়ে চুলকিয়ে দিতে থাকল।এমন সময় জারিফের দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করল।লিয়া হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল।চোখ কটমট করে জারিফের দিকে তাকিয়ে বলল,

“জারিফ।”

জারিফ লিয়ার মুখশ্রীতে শান্ত চাহনিতে চাইল। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বোঝাল,”কী?”ফের জারিফ দুষ্টুমি করতে থাকে।লিয়া নড়েচড়ে বসল।চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বলল,”সুড়সুড়ি লাগছে তো।জানি ইচ্ছে করে ফা’জ’লা’মো করছেন।থামুন এবার।আর লাগবে না আপনার হেল্প।থামুন প্লিজ। থামুন।”

জারিফ দুষ্টুমির স্বরে বলল,”এখনো তো তেমন ভাবে ছুইইনি।তাই এভাবে কাঁপাকাপি শুরু করে দিলে। গভীরভাবে স্পর্শ করলে কি হবে!”

লিয়া জারিফের সামনে দুইহাত মেলে ধরে বলল,”বেশি দুষ্টামি করলে কিন্তু এই মেহেদী লাগানো হাত আপনার সারা মুখে লেপ্টে দেবো। মুহুর্তেই আপনার সাদা মুখ লাল হয়ে যাবে।হাজার বার সাবান দিয়ে ঘষলেও দুই দিনের আগে রঙ যাবে না।আর রঙ মুখ নিয়ে বাইরে কীকরে বের হবেন?আর বিয়ে করতে কাল কীকরে আসবেন?”

এই বলে লিয়া ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।জারিফ একহাত দিয়ে লিয়াকে নিজের দিকে একটু টেনে নিলো। লিয়ার পিছন হতে একহাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরল।লিয়া বড়বড় চোখ করে চাইল। ফিসফিসিয়ে বলল,”কী করছেন কি?কেউ দেখবে তো।ছাড়ুন।”

লিয়ার শাড়ির আঁচল ভেদ করে জারিফের হাত লিয়ার উন্মুক্ত পেট স্পর্শ করতেই লিয়া কেঁপে উঠল।জারিফ দুই আঙ্গুল দিয়ে পেটে স্লাইড করতে করতে বলল,”কালকে বরের ঘরে আসছো। সংসার শুরু করবে।এখনও কিনা তোমার বাচ্চামো স্বভাব গেলো না। বাচ্চাদের মতো ভ’য় দেখাচ্ছো।লাইক সিরিয়াসলি!আমার তো ভীষণ হাসি পাচ্ছে।তোমার শিশুসুলভ কথাবার্তা শুনে।”

লিয়া ছোট ছোট চোখ করে চাইল। জারিফের হাসি দেখে গা জ্বালা দিয়ে উঠল। উফ্!জারিফ তার কথা নিয়ে হাসছে।এইভেবে লিয়া গাল ফুলিয়ে রাখল।
.
রাত নয়টা বেজে যায় লিয়াদের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে। ফ্রেশ হয়ে লিয়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। লিয়ার পাশে রুপন্তী,অরিন বসে এটাসেটা গল্প করছে। লিয়ার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো।ওদের সাথে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পরে।
.
বিয়ে বাড়ি চারিদিকে সাজসাজ রব।লোকে মুখরিত চারিপাশ।লিয়াকে সাজানো হচ্ছে। এরমধ্যে ছোটরা হৈ-চৈ শুরু করে দিলো,”এই বর এসেছে।বর এসেছে বলে।”

চলবে,,,