সুখের ঠিকানা পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
332

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৪৩

ভোরের আলো ফোটেনি এখনো।দূর হতে আজানের মিষ্টি ধ্বনি ভেসে আসছে।সাথে দু’একটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।লিয়ার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসে কেমন জানি ব্যাঘাত হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে দম আঁটকে আসছে মনে হচ্ছে।লিয়ার ঘুম হালকা হলো। ঘুমুঘুমু চোখে ঘন পল্লব টেনে তুলার চেষ্টা করল।একটু নড়ার চেষ্টা করল। নিজের উপর ভারী অনুভব হলো।লিয়া চোখের পাতা পিটপিট করে তুলে তাকাল।জারিফ আষ্টেপৃষ্ঠে লিয়াকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তির সাথে ঘুমোচ্ছে। লিয়া জারিফের বাহু বন্ধনে থেকেই একটু নড়েচড়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলল,

“জারিফ। সরুন।এভাবে শোয় নাকি কেউ! ছাড়ুন।”

লিয়ার আওয়াজে জারিফের ঘুম হালকা হলো।জারিফ কিঞ্চিৎ বি’র’ক্ত হলো।জারিফ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।চোখ বন্ধ রেখেই ঘুমুঘুমু কণ্ঠস্বরে বলল,”উঁহুম।”

লিয়া বি’র’ক্তি’ক’র কণ্ঠে বলল,”কি উঁহুম উঁহুম করছেন।এভাবে কেউ ঘুমোয় নাকি! আশ্চর্য।আমার তো দম আঁটকে আসছে।আমার ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না।সো, প্লিজ ছাড়ুন।”

“ও লিয়া ঘুমোতে দাও তো।ভীষণ ঘুম দু’চোখে।সো আর ডিস্টার্ব করো না তো।”

লিয়া অবাক হয়ে বলল,”আপনার ঘুমে আমি ডিস্টার্ব করছি!কখন!আর আপনি ঘুমান না।কে আপনাকে বারণ করছে ঘুমোতে!”

জারিফ লিয়াকে ছেড়ে দিলো। বালিশের উপর কনুই ভর দিয়ে হাতের উপর মাথা রাখল।লিয়ার মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,”এই লিয়া তুমি এত নড়াচড়া করো কেনো বলো তো।সারারাত ধরে সাপের মতো নড়ছো।ঘুমের মধ্যে শুধু এপাশ -ওপাশ।নিজেও শান্তিমতো ঘুমাচ্ছিলে না। আবার আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছিলে না।হাত-পা ছুড়াছুড়ি করছিলে। উফ্!ঘুমের মধ্যেও তোমার ছটফটানি স্বভাব!আগে জানা ছিলো না।”

লিয়া দৃষ্টি নুইয়ে নিলো।খানিকটা লজ্জা পেলো।রিনরিনে গলায় বলল,”আসলে এভাবে ঘুমোতে আমি অভ্যস্ত নই।এভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোতে আমার অভ্যাস নেই।তাই হয়তো।”

জারিফ লিয়ার কথায় মৃদু হাসল।লিয়ার গলায় মুখ ডুবালো।গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বলল,”ব্যাপার না।আমি তো মজা করে বলছিলাম।আর কিযেনো বলছিলে, অভ্যাস নেই।অভ্যাস হয়ে যাবে। দ্রুত অভ্যাস করে ফেলো।”

.
দু সপ্তাহ খানেক পর,,,

মেঘে ঢাকা আকাশ। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।সাথে হালকা দমকা বাতাস বইছে।ঘড়ির কাঁ’টা বিকেল পাঁচটার ঘরে।জারিফ একহাতে মেইন দরজাটা খুলল।পাশে লিয়া চিন্তিত মুখশ্রীতে দাঁড়িয়ে।কিছু ভেবে লিয়া কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে ঠোঁট আওড়ালো,

“বৃষ্টি হচ্ছে তো।আরেকটু ওয়েট করতেন। বৃষ্টি থামলে তারপর নাহয় যাবেন।”

জারিফ লিয়ার দিকে তাকাল।স্মিত হেসে বলল,
“মোটেই এখন বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া।ওয়েদারটা দারুণ রোমান্টিক।এই ওয়েদারে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।বাট আজকে আর ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারছি না। সবগুলো যেভাবে ফোন শুরু করে দিয়েছে।ফোনের পর ফোন দিয়ে ঝ’ড় বইয়ে দিচ্ছে। আর হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।এটা কোনো ব্যাপার নয়।আসি।”

লিয়ার হাতে থাকা মেডিকেল রেকর্ড ফাইলটা জারিফের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,”নাতাশার ফাইল।এর ভেতর নিউ টেস্টের রিপোর্টসহ পুরোনো সব কিছুই আছে।”

জারিফ হাতে নিলো।লিয়া ফের শুধালো,”কখন আসবেন? আলিফ ভাইয়ার চেম্বারে যাবেন?নাকি বাসায়।”

জারিফ ইতস্তত গলায় বলল,
“বাসায় না।চেম্বারে যাবো। আচ্ছা লিয়া থাকো।ও হ্যা আমার আসতে দেরি হতে পারে। তুমি সবার সাথে ডিনার করে নিও,কেমন।আমার জন্য অপেক্ষা করো না।তুমি খেয়ে নিও।”

লিয়া ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক বলল।এমন সময় জারিফ লিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।লিয়া কপাল কুঁচকে ছোটছোট চোখ করে চাইল‌।জারিফ ফট করে লিয়ার ঠোঁটে চুমু খেলো। অতঃপর লিয়ার নাকে এক আঙ্গুল আলতোকরে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,”আসি।”

লিয়া বিনিময় মিষ্টি করে হাসল।জারিফ চলে যেতেই লিয়া দরজাটা বন্ধ করে দিলো।লিয়া একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে ড্রয়িংরুম দিয়ে হেঁটে আসছিলো।এমন সময় জারার গলার স্বর আসলো।জারা বলল,”এইতো ভাবী এখানে।”

জারার সাথে কথা-ও ছিলো। দু’জনে একসাথে এগিয়ে আসলো।লিয়া হাসিমুখে দাঁড়াল।জারা গমগমে স্বরে বলল,”ভাবী তুমি এখানে।আমরা তোমার রুমে গিয়েছিলাম। রুমে তোমাকে পেলাম না।না পেয়ে এদিকেই আসছিলাম।”

লিয়া মিষ্টি করে হাসল।নরম গলায় বলল,”ও তাই! তোমার ভাইয়া বাইরে গেলো।দরজা লক করতে আসছিলাম।”

কথা সোফায় বসল।জারা আবদারের সুরে বলতে লাগল,”বৃষ্টির দিনে এইসময় ভালো লাগছিলো না। বৃষ্টির কারনে ছাদেও যেতে পারছি না।আমি আর কথা আপু ভাবলাম লুডু খেলি। দু’জনে খেলে মজা পাচ্ছিলাম না।তাই ভাবলাম তোমাকেও সাথে নিই। ভাবী তুমি আমাদের সাথে খেলবে কি?”

লিয়া উৎফুল্ল স্বরে বলল,
“শিওর।হুয়াই নট?চলো,চলো।”

কথা,জারা আর লিয়া তিনজনে ফোনে লুডু খেলছে আর রাজ্যের গল্প করছে।এমন সময় নীল রুম থেকে বের হয়ে সোজা ড্রয়িংরুমে আসলো।জানালা দিয়ে বাইরে একবার দেখলে।আকাশের অবস্থা দেখে বি’র’ক্ত হলো। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।থামার নামই নেই যেনো। বৃষ্টির জন্য নীল বেচারা বাইরে যেতে পারছে না।তাই তো সে বেজায় বি’র’ক্ত হচ্ছে।ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নীল সিঙ্গেল সোফায় বসল। কপাল কুঁচকে ওদের দিকে চাইল। রিমোট হাতে টিভি অন করতে থাকল।

এমন সময় লিয়া নীলকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আজ এই সময় নীল বাসায়।তা নীল আজ বাইরে যাওনি। নাকি বৃষ্টির জন্য বাইরে যাওয়ার স্কোপ পাচ্ছো না।”

নীল বিরস কণ্ঠে বলল,”ধূর বৃষ্টি থামার নামই নিচ্ছে না।
বৃষ্টির কারনে তো বাইরে যেতেও পারছি না।”

এমন সময় জাহানারা বেগম আসলেন।হাতে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ।কিচেন থেকে বের হয়ে এখানেই আসলেন।সোফায় বসে লুডু খেলা তিন সদস্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।কিছু ভেবে বললেন,”লিয়া।”

লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে জাহানারা বেগমকে দেখে উঠে দাঁড়াল। নম্রস্বরে বলল,”হ্যা,মা।”

জাহানারা বেগম আদূরে গলায় বলেন,”আরে উঠলে কেনো।খেলো।জারিফ বাইরে গেলো মনে হলো। কিচেন থেকে রুমে যাচ্ছিলাম , তোমাদের গলার আওয়াজ ড্রয়িংরুম থেকে আসছিলো।তাই ভাবলাম দেখি শুনে আসি।তা বৃষ্টির মধ্যে জারিফ এখন কোথায় গেলো?কোনো দরকারি কাজ ছিলো কী?”

“না মানে।তেমন কিছু না।রুপম ভাইয়া নাকি আর দুদিন বাদেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন।সব কিছু ওকে হয়েছে। দু’দিন পরই উনার ফ্লাইট। সেইজন্য ওনারা সব বন্ধুরা একসাথে হবে। তাই আজকে ‘হিমু আড্ডা’ রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন।ভাইয়ারা ফোন করেছিলো তাই।আর নাতাশার ইউরিন টেস্টের রিপোর্টটাও নিয়ে গিয়েছে।ফেরার পথে আলিফ ভাইয়াকে দেখিয়ে আনবে বলল।”

জাহানারা বেগম ছোট করে বললেন,”ওহ্”

লিয়া বলল,”মা কিছু লাগবে।আমি করে দেবো।”

জাহানারা বেগম অমায়িক হাসলেন। মায়াময় স্বরে ফের বললেন,”নাহ্।তোমার বাবা চা চাইলেন। আমি বানিয়ে নিয়েছি। তোমরা গল্প করো।”

এই বলে জাহানারা বেগম প্রস্থান করতে থাকেন। এমন সময় কথা বলল,”নাতাশার কী নতুন করে আবার প্রবলেম হয়েছে?ইউরিন টেস্ট করা হয়েছে যে!”

লিয়া বসতে বসতে বলল,”নাহ্। আলহামদুলিল্লাহ কোনো প্রবলেম হয়নি।আসলে এটা রুটিন টেস্ট।মাঝে মাঝে করতে হয়।”

“ওহ্।”

এরমধ্যে জারা বলল,”ভাইয়া তাহলে আজকে তাসনিম আপুদের বাসায় যাবে।ভাবী, তাসনিম আপুদেরকে একদিন আমাদের বাসায় দাওয়াত করো।”

লিয়া বলল,”তোমার ভাইয়া বাসায় যাবে না।আলিফ ভাইয়ার চেম্বারে যাবে। বাসায় যেতে নাকি তোমার ভাইয়ার লজ্জা লাগে।তাই চেম্বারে যান উনি।”

একটু থেমে লিয়া ফের বলল,”আপু ভাইয়া ওরা দুজনে ব্যস্ত মানুষ। কতবার ফোনে বলেছি। তাদের নাকি সময়ই হয় না।”

শেষের কথাটা লিয়া অভিমানের সুরে বলল। ওরা ফের খেলায় মন দিলো। এমন সময় জারা বলে উঠল,”খালি মুখে খেলতে ভালো লাগছে না।সাথে কিছু খাবার হলে ভালো হতো।উমম!মুড়ি মাখা হলে কেমন হয়।! ঝালমুড়ি।”

জারা এক্সাইটেড হয়ে বলল।কেউ কিছু বলার আগেই নীল ফোড়ন কে’টে বলল,”এই জারা কি খাই খাই স্বভাব তোর হ্যা। সারাক্ষণ খাই খাই করিস। তোর শ্বশুরের ছেলের কপালে দুঃখ আছে।যা পে’টু’ক তুই। তোকে খাওয়াতে গিয়ে বেচারা ফ’কি’র না হয়ে যায়।”

লিয়া আর কথা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।জারা মুখ বাকালো।বলল,”ফ’কি’র হয় আমার শ্বশুরের ছেলে হবে।তোর সমস্যা কোথায়,হ্যা।তোকে এতো ভাবতে হবে না।”

“আমি একজন সচেতন নাগরিক।কারো সমস্যা হলে সে বিষয়টা দেখবো না।বেচারা তোর ফিউচার বরের কপালে শনি আছে।তাই বলছি এই খাই খাই স্বভাবটা এখন থেকেই একটু কমিয়ে দে।”

জারা ভেংচি কা’ট’ল।নীলের কথা গাঁয়ে না মেখে ফের বলল,”তোমরা থাকো আমি এক দৌড়ে গিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”

নীল সোফায় গা এলিয়ে ছিলো। এমন সময় সোজা হয়ে বসল। তড়িঘড়ি করে বলল,”ভাবী জারাকে দিয়ে ঝালমুড়ি বানাবেন না।জারা প্রচন্ড ঝাল দেয়।এতো পরিমাণ ঝাল দিবে যে একবারের জায়গায় দুইবার মুখে দিতে পারবেন না।এই জারার মুখের কথা যেমনি ঝাঁঝালো।ঠিক তেমনি ওর বানানো খাবার।সেদিন ওর বানানো পেয়ারা মাখা খেয়ে ঝালে আমি পুরাই শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত জারা মুড়ি মাখালে একগাদা মরিচ দিবে।আর ঝালে মুখেই দেওয়া যাবে না।”

জারা দুইহাত কোমড়ে রাখল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“মুড়ির মধ্যে ঝাল বেশি দেই এই সমস্যা তোর।এটা তো আমার না।তোর সমস্যা তুই কিভাবে সমাধান করবি কর।খেয়ে সমাধান করবি। না না খেয়ে সমাধান করবি।সেটা একান্তই তোর ব্যাপার, হুঁ।”

নীল নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,”তোর মাখানো মুড়ির মধ্যে ঝাল কমানোর জন্য আমি পানি ঢেলে দেবো।”

জারা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,”তুই জানিস ঝাল কেনো লাগে?মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন উপাদান থাকার জন্য ঝাল লাগে। কোনো কিছু তো জানিস না।পানি ঢালা সে তো সহজ কাজ।”

“মুড়ির ভেতর পানি দিলে ক্যাপসাইসিন ডাইলুট হয়ে ক্যাপসাইসিনের শক্তিমাত্রা কমিয়ে দেবে।তখন ঝালও কম লাগবে।এইভাবেই আমি সমাধান করবো।একটু আগে তুই নিজেই না সমাধান করতে বললি।ঝাল কমানোর এটাই বেস্ট সলিউশন।”

এই বলে নীল বাঁকা হাসল।লিয়া বলল,”ভাই এই কাজটা অন্তত করো না। আমাদের খাওয়াটা মাটি হয়ে যাবে।”

নীল কিছু বলার আগেই কথা বলল,”লিয়া। ওহ্ সরি,ভাবী। ভাবী নীল কিন্তু ভুল কিছু বলেনি।জারা খুব ঝাল খায়। সেদিন ওর পেয়ারা মাখা খেয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল হয়েছিলো।আজ মুড়িতে যে এক্সেস ঝাল দিবে না।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

জারা মুখভার করে দাঁড়িয়ে রইলো।লিয়া বলল,”আচ্ছা আমি ঝালমুড়ি বানিয়ে আনছি।তোমরা বসো। এতএত ঝ’গ’ড়া বাদ দাও।এই জারা তুমি বসো।আমি আনছি। নাকি আমার উপরও রা’গ হচ্ছে?”

জারা তড়িৎ দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,”উঁহু। একদম নয়।”

এইবলে জারা চমৎকার হাসল।লিয়া ঝালমুড়ি বানিয়ে আনে।সবাই মিলে খায় আর গল্প করতে থাকে। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান পড়তেই ওরা উঠে যার যার রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর লিয়া রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে যায়। সেখানে নিরুপমা বেগমকে দেখতে পায়।লিয়া কাছে এগিয়ে গেলো।বলল,”ছোটোমা কি রান্না করছো?আমাকে কী করতে হবে বলো।আমি তোমাকে হেল্প করছি।”

নিরুপমা বেগম প্যানে মোগলাই ভাজছিলেন।এমন সময় লিয়ার কথা শুনে ঘাড় ফিরালেন।পাশে লিয়াকে দেখে মৃদু হাসলেন।বললেন,”মোগলাই বানাচ্ছি।তোমাকে কিছু করতে হবে না,লিয়া।আগে বলো মোগলাই খাও তো?”

“হ্যা খাইতো।”

“নীল বলছিলো ওর নাকি মোগলাই খেতে ইচ্ছে করছে।তাই ভাবলাম বসেই আছি।সবার জন্যই বেশি করে বানাই।”

লিয়া ফের বললো,”আমাকে কি করতে হবে তাই বলো তো।তুমি কাজ করছো,আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না।”

“কিছু করতে হবে না সোনা।এই তো এইটুকু বাকি আছে।এখনই হয়ে যাবে।”

একটু থেমে কিছু ভেবে নিরুপমা বেগম ফের বললেন,
“আচ্ছা লিয়া তুমি তাহলে মোগলাইগুলো পিস করো।”

লিয়া এবার খুশি হলো।নাইফ দিয়ে সুন্দর করে পিস করতে থাকল।লিয়া ফের শুধালো,”আচ্ছা ছোটোমা এখন কি রান্না হবে।না মানে রাতে কি কিছু রান্না করতে হবে?”

“নাহ্। দুপুরে কয়েকপদ রান্না করা হয়েছিল।সেসব ফ্রিজে আছে।সেগুলো গরম করে নিলেই হবে।আর চারু খানিক পরে চাল ধুয়ে দিবে।তাই হয়ে যাবে।”

লিয়া পরিবারের সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে মোগলাই খায়।নিজে হাতে নাতাশাকে খাইয়ে দেয়।
.
রাত সাড়ে নয়টা বাজে।লিয়া পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে আছে।একটু আগে জারিফ ফোন করেছিলো।বলেছে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।লিয়া যেনো ডিনার করে নেয়।লিয়া পেনটা হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছিলো।পড়ায় মনোযোগ ছিলো না। শরীরটা একটু খা’রা’প লাগছিলো।মনে হচ্ছে এসিডিটি হয়েছে।লিয়া কিছু ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।ভাবল,সবাই খাবার টেবিলে অপেক্ষা করবে।মা’কে বলে আসি।আজ আর ডিনার করবো না।এইভেবে লিয়া রুম থেকে বের হলো।

খাবার টেবিলে সবাই বসেছে। রাতের খাবারটা বেশিরভাগ সময় সবাই একসাথেই খায়। জাহানারা বেগম লিয়াকে এখনো আসতে না দেখে জারাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”জারা যা তো লিয়াকে ডেকে আন‌।জারিফ ফোন করে বলল।ওর নাকি ফিরতে দেরি হবে।এতসময় লিয়া অপেক্ষা করবে নাকি। বাচ্চা মেয়ে খেয়ে নিক।আবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।যা লিয়াকে ডেকে আন।”

জাহানারা বেগমের কথার মাঝেই জারা বলল,”ঐতো ভাবী এসে গিয়েছে। যেতে হবে না।”

জাহানারা বেগম লিয়ার দিকে তাকালেন।আদূরে স্বরে বললেন,”লিয়া বসো।খেয়ে নাও।জারিফ কখন আসবে তার ঠিক নেই।তুমি খেয়ে নাও।”

লিয়া জাহানারা বেগমের কাছে এসে বলল,”মা।আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যার আগে মুড়ি মাখা খেয়েছি।আবার তখন মোগলাই খেলাম।কেমন জানি পেট ভরাভরা লাগছে। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”

জাহানারা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,”সেকি খেতে ইচ্ছে করছে না।শরীর খা’রাপ হয়নি তো।কি এমন খেয়েছো।যে একটু মুখে দিলে।দেখলামই তো।”

লিয়া বলল,”এসিডিটি হয়েছে ।ভাজিপুড়া খেলে এরকম হয়ে থাকে আমার।”

“ওহ্। আচ্ছা। গ্যাসের ঔষধ খেয়ে নাও তাহলে।আমার রুমে ঔষধ আছে দেখ। ওয়ারড্রবের উপর একটা বক্স আছে সেখানে পাবে যাও।”

লিয়া মৃদু হেসে বলল,”আমাদের রুমে ঔষধ আছে। আপনার ছেলে তো এসকল ঔষধ সব সময় রেখে দেয়।আমাদের রুমে ফাস্ট এইড বক্সে আছে দেখলাম।”

জাহানারা বেগম অমায়িক হেসে বললেন,”আচ্ছা।ঔষধ খেয়ে বিশ্রাম নাও।আর বেশি সমস্যা হলে সাথে সাথেই বলো কিন্তু।”

লিয়া ‘ঠিক আছে।”বলে রুমের দিকে পা বাড়ায়।
.

রাত সাড়ে দশটা পার হয়েছে ।জারিফ মাত্রই বাসায় ফিরল। কলিংবেলের শব্দ শুনে জাহানারা বেগম দরজা খুলে দেন।জারিফ ভেতরে আসতে আসতে বলল,
“সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি।কাউকে দেখছি না।”

জাহানারা বেগম বললেন,”সবাই যার যার রুমে আছে।শুয়ে পড়েছে মনেহয়।”

একটু থেমে জাহানারা বেগম শুধালেন,”জারিফ।আলিফ কি বললো?নাতাশার মেডিসিন চেঞ্জ করে দিয়েছে।”

জারিফ হাতের ফাইলটা মা’য়ের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল,”না।আলিফ ভাই বলেছেন,কয়েকমাস ধরে ইউরিন হিট যেহেতু ভালো আছে।আর টেস্টের রিপোর্টও আলহামদুলিল্লাহ ইমপ্রুভ হয়েছে ‌।তাই আপাতত স্ট্রোয়েড বাদ রাখতে বলেছেন। তবে খাবারে যেসব নিষেধাজ্ঞা ছিলো।ওগুলো মেইনটেইন করতে বলেছেন।সাথে বাসায় রেগুলার ইউরিন হিটের মাধ্যমে আ্যলবুমিন টেস্ট করতে বলেছেন।”

“ওহ্। আচ্ছা ঠিক আছে বাবা।যা ফ্রেশ হয়ে নে।লিয়া রাতে কিছুই খায়নি। এসিডিটির প্রবলেম হয়েছে।আমি একটু আগে গিয়েছিলাম। দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছে।লিয়া জাগলে। লিয়াকে নিয়ে খাবার খেতে আয়।আমি খাবার রেডি করছি।”

“ঠিক আছে।”বলে জারিফ রুমে চলে যায়।রুমে গিয়ে প্রথমে বিছানায় চোখ যায়।লিয়াকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।জারিফ সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ব্লাক টিশার্ট আর এ্যশ কালারের টাউজার পড়েছে।টাওয়েল দিয়ে হাতমুখ মুছতে থাকে। টাওয়েলটা ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসে বিছানায় বসল।ঘুমের মধ্যে লিয়া একটু নড়ল।লিয়া নিজের দুইহাত মাথার নিচে রাখল।জারিফ আন্দাজ করল।লিয়ার বোধহয় শীতশীত অনুভব হচ্ছে।বাইরে এখনো টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়াটা বেশ শীতল।জারিফ লিয়ার গায়ে কাঁথা টেনে দিলো।লিয়ার মুখের উপর এলোমেলো হয়ে কিছু চুল পড়েছিলো।জারিফ একহাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলো।লিয়ার ঘুমন্ত ফেসটা একদম নিষ্পাপ লাগছে।জারিফ লিয়ার দিকে ঝুঁকে লিয়ার গালে ঠোঁটে ছোঁয়ালো।জারিফের স্পর্শে লিয়া নড়ল। পিটপিট করে চোখ তুলে চাইল।
জারিফকে দেখে মৃদু হাসল।বলল,

“কখন আসলেন?”

“এইতো একটু আগেই।তোমার শরীর খা’রাপ লাগছে?বেশি সমস্যা?বেশি প্রবলেম হলে বলো। ডক্টরের কাছে ফোন করে জানাই।”

লিয়া বলল,”উঁহুম!লাগবে না।ঔষধ খেয়েছিলাম ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
.
জাহানারা বেগম খাবার গরম করে টেবিলে রাখছিলেন।জারিফ এসে চেয়ার টেনে বসল। জাহানারা বেগম শুধালেন,”লিয়া আসলো না।বেশি খা’রা’প লাগছে কি ওর?”

” ঠিক হয়ে গিয়েছে বলল।ঝাল মুড়ি,মোগলাই খেয়েছে নাকি।ক্ষুধা নেই বলল।তাই জোর করে বললাম না।”

জারিফ খাবার খেতে খেতে বলল,”সবাই খাবার খেয়েছে?বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে কী?”

জাহানারা বেগম একটা চেয়ার টেনে বসলেন।বললেন,
“হ‌্যা ,সবাই খেয়েছে। তোর বাবা ঘুমায়নি।কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে দেখলাম।সামনের মাসেই তো তোর রিটায়ার্ড করবেন। কী দরকারে যেনো আবার কিছু কাগজ নাকি জমা দিতে হবে। সেগুলো ঠিকঠাক করছে দেখলাম‌।”

“ওহ্।বাবার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক আছে । কোনো সমস্যা নেই তো।কোনো প্রবলেম হলে সাথে সাথেই বলো কিন্তু।যেকোন অসুখই পুষে রাখতে নেই। অল্প থেকেই ট্রিটমেন্ট নিতে হয়।”

জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,”শরীর স্বাস্থ্য আলহামদুলিল্লাহ আছে মোটামুটি। তবে মানুষটা ইদানিং সর্বক্ষণ টেনশন করেন।কয়দিন বাদেই অবসর নিবেন। সংসারের সব দায়িত্ব এতোদিন উনিই পালন করে আসছেন।আবার বয়স বাড়ছে জারা,নাতাশাকে নিয়ে চিন্তাও করেন।আর তোর বাবা চান,উনার জীবদ্দশা পর্যন্ত হলেও যেনো এই সংসারটা এভাবেই জয়েন থাকে।সবাই মিলেমিশে হাসিখুশিতে থাকে যেনো।”

জারিফ তৎক্ষনাৎ বলল,”বাবাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করো। আল্লাহর রহমতে আমি আছি তো।আমি বাবার সাথে একসময় এই ব্যাপারে কথা বলবো।এসব নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করবো।”

জাহানারা বেগম ইতস্তত গলায় বললেন,”তোর বাবা তো কদিন বাদেই অবসরে যাচ্ছেন।দেখ বাবা সংসারের হাল টা তোকে ধরতে হবে।আগের থেকে একটু বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে।”

জারিফ মা’য়ের দিকে তাকাল। ঠান্ডা গলায় বলল,
“দেখ মা। সংসারের হালটা যে ধরতে হবে।আমাকে কি তোমাকে বলে দিতে হবে। আমার এমন কোনো ভুল হয়েছে।যে এইটা আমাকে বলতে হবে।তুমি আমাকে আদর করে বলো,আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?আমি শুধরে নিবো।আমি কি কোনো বে’য়া’দ’বি আচরণ করেছি মা?”

জাহানারা বেগম সহসাই বললেন,
”বাবা আমি এরকম করে বলছি না।হয়েছে কি।আমার চিন্তা তো শুধু একটাই। আমাদের অসম্ভবে ।আ…..আ

জাহানারা বেগম আমতাআমতা করতে থাকেন। এরমধ্যে জারিফ বলে উঠল,”মা তুমি নাতাশার কথা বলতে চাইছো তো?”

জাহানারা বেগম ছোট করে শ্বাস ফেলে হাসিমুখে বললেন,””এই না আমার ছেলে।”

জারিফ দৃঢ় চিত্তে বলল,”মা এইটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।নাতাশার ক্ষেত্রে তোমার থেকে আমার রেসপনসিবিলিটি বেশি। কারন নাতাশার মাঝে আমি জেরিনকে দেখি।আমি জারা জেরিনের জন্য তো কিছুই করতে পারিনি।এ পর্যন্ত শুধু নিয়েইছি। আল্লাহর রহমতে আমার এখন দায়িত্বের পালা।এসব নিয়ে মা তুমি চিন্তা করো না। আল্লাহর রহমতে নাতাশাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার।”

জাহানারা বেগম প্রশান্তির হাসি নিয়ে ঠোঁট আওড়ালেন,
“আমার ছেলের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে।জারিফ বাবা আমি জানি তুই নাতাশাকে কতটা ভালোবাসিস।এও জানি নাতাশাকে আগলে রাখবি।আর লিয়ার উপরও আমার পূর্ণ আস্থা আছে।লিয়া নাতাশাকে ভীষণ আদর করে।যা দেখে সত্যিই আমার মনটা ভরে যায়। লিয়াকে নিয়ে আমি গর্ব বোধ করি।এমন ভালো মনের, দায়িত্ব কর্তব্য সম্পন্ন একটা মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে।সবার জন্য একটাই দোয়া থাকবে,তোরা সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস কর। আল্লাহ পাক তোদের দীর্ঘ আয়ু দান করুন।”

.
আলিফ তাসনিম তাদের দাম্পত্য জীবনে সুখ ও শান্তিতে দিন যাপন করছে। দু’জন দু’জনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভালোবাসা, সত্যিকারের ট্রু ভালোবাসায় তারা তাদের জীবনটাকে ভরে রেখেছে। সংসারের সকল কাজ আগলে রেখে, স্বামীর প্রতি দায় দায়িত্ব পালন করেও আল্লাহর রহমতে বিসিএসের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বিসিএস ডাক্তারি পরীক্ষায় বিসিএস (স্বাস্থ্য) এ উর্ত্তীণ হয়েছে। পড়ন্ত বিকেল।পিচের রাস্তায় শা শা করে গাড়ি ছুটছে।আলিফ একমনে ড্রাইভ করছে।পাশে বসা তাসনিম আলিফের দিকে চেয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

“তা ডক্টর সাহেব। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি শুনি।এটা তো বাসার রাস্তা নয়।”

আলিফ ভাব নিয়ে বলল,”বউকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাচ্ছি। নির্দিষ্ট কোনো জায়গার নাম বলতে পারছি না।আজ দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে হারিয়ে যাবো।একা নয়।আমার একমাত্র বউকে নিয়ে।”

তাসনিম ফের প্রশ্ন করল,”তা আজ হঠাৎ লং ড্রাইভে!এমনিই! না স্পেশাল কোনো কারন টারন আছে?”

আলিফ তড়িৎ বেগে বলল,”অবিয়েসলি স্পেশাল কজ আছে। ডক্টর আলিফের বউ বিসিএস স্বাস্থ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। এটা সেলিব্রেট করতে হবে না। তাই ভেবেছি লং ড্রাইভে যাবো।তারপর রাতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবো। দু’জন মিলে সেলিব্রেট করবো আর এনজয় করবো।”

তাসনিম মিষ্টি হাসলো।আলিফের কাঁধে মাথা রাখল।আলিফ তাসনিমের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।ফের ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলো।
.
সুন্দর রোদঝলমলে একটা দিন।রোজকার মতো লিয়া জারিফের সাথে ভার্সিটিতে এসেছে। লাঞ্চের পরের ক্লাসগুলো শেষ হতেহতে চারটা বেজে যায়। ক্লাস শেষ করে লিয়া অরিনের থেকে বিদায় নিয়ে সোজা জারিফের চেম্বারে আসলো।লিয়া দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে হালকা কেশে বলল,”আসবো।”

জারিফ কিছু কাজ করছিলো।লিয়ার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে জারিফের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল।জারিফ না তাকিয়েই বলল,”শিওর ম্যাডাম।”

লিয়া নিঃশব্দে ঠোঁট চওড়া করে হাসল।লিয়া এগিয়ে গিয়ে সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে বসল।জারিফ মাথাটা কিঞ্চিৎ উঁচু করে লিয়ার দিকে চাইল।লিয়া টেবিলের উপর দুইহাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল,

”দেরি হবে আপনার।”

জারিফ শান্ত নজরে চেয়ে বলল,
“হুম। কিছুক্ষণ বসো।হাতের কাজটা কমপ্লিট করেই যাবো।”

“ওকে।”বলে লিয়া ফোন বের করে স্ক্রল করতে থাকল।জারিফের হাতের কাজটা শেষ করতে করতে ঘন্টা খানেক সময় লেগে যায়। অবশেষে ওরা বের হয়।জারিফের সাথে পা মিলিয়ে লিয়া গাড়ির কাছে আসলো।জারিফের সাথে আসার সময় স্টুডেন্টরা যখন জারিফকে সালাম দেয়। পাশে থাকা লিয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।তখন লিয়ার কেমন কেমন যেনো লাগে।বেশ লজ্জা লজ্জা অনুভব হয় লিয়ার।ভার্সিটি থেকে অল্প একটু দূরে এসেই জারিফ গাড়ি ব্রেক কষলো।লিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে ইশারায় বুঝালো”এখানে কেনো!”

জারিফ নির্বিকার ভাবে বলল,”ঘুরবো দু’জনে তাই।”

বিকেল পাঁচটা পার হয়েছে। ঝলমলে সুন্দর বিকেল। জারিফের মনটাও আজ ঝলমলে আছে।জারিফের ইচ্ছে করল,লিয়াকে সাথে নিয়ে এই সুন্দর বিকেলটা উপভোগ করবে।ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে আসলো দু’জন।একটু নিরিবিলি ফাঁকা স্থান দেখে দু’জনে বসল।এদিকটায় ভীড় একটু কম। দু’জনে ঘাসের উপর বসে গল্প করতে লাগল।

আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে ।আজকের আকাশটা ঝকঝকে তকতকে। সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘমালা হাওয়ায় উড়ছে মনে হচ্ছে।বিকালের নরম রোদ।সূর্যের প্রখরতা কমে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।ধীরে ধীরে সূর্য মামা পশ্চিম আকাশের দিকে যাচ্ছে। নদের পানিতে গাছপালা সহ সবকিছুর প্রতিবিম্ব বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ।লিয়া চেয়ে চেয়ে দেখছে আর উপভোগ করছে।লিয়া এক আঙ্গুল দিয়ে পায়ে থাকা পায়েলটা একটু নাড়ল।হালকা বাতাস বইছে।বিকেলের নরম রোদ সাথে হালকা বাতাস। ঝিরিঝিরি বাতাস একটু পরপর লিয়া জারিফের গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। চমৎকার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে।জারিফ বলল,

“কি খাবে বলল।”

লিয়া বলল,”এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। এভাবেই ভালো লাগছে।সময়টা উপভোগ করছি। ভীষণ ভালো লাগছে।”

দু’জনে বসে এটাসেটা কথা বলতে থাকল।বাতাসে লিয়ার কিছু চুল উড়ে এসে জারিফের মুখে পড়ল।জারিফ একহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিলো।লিয়া চুলগুলো হাতখোপা করতে যাবে।জারিফ ইশারায় বারণ করল।বলল,”এভাবেই ভালো লাগছে।তোমার চুল থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি গন্ধটা আমি উপভোগ করি। মা’তা’ল করা সুবাস একটা। মা’রা’ত্ম’ক ভালো লাগে আমার। উফ্!তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না।”

লিয়া জারিফের এহেন কথা শুনে ঠোঁট চওড়া করে হাসল।জারিফ সুগভীর শান্তনজরে চেয়েচেয়ে মুগ্ধ হয়ে লিয়ার হাসি দেখল।কালো রঙের থ্রি পিস পড়েছে লিয়া। ফর্সা গায়ে কালো রঙে লিয়াকে দারুণ দেখাচ্ছে।হরিণী আঁখিযুগল, গোলাপি পাতলা ওষ্ঠ,দীঘল কালো চুল।এই নরম রোদের সোনালী বিকেলে লিয়াকে মায়াময় লাগছে। সৃষ্টিকর্তার সুনিপুণ সৃষ্টি যেনো।কোনো কৃত্রিমার ছোঁয়া নেই লিয়ার মুখে।অথচ কি মায়ামায়া ফেস আর সুন্দর-ই না লাগছে।জারিফ নিষ্পলক চাহুনিতে লিয়াকে দেখতে থাকল। জারিফ কিছু ভেবে হুট করে বলল,

“লিয়া।”

“হুম।”

“লিয়া তুমি তো আমার থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করতে বা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বেটার সুযোগ আসে।”

এত সুন্দর রোমাঞ্চকর পরিবেশে জারিফের এহেন কথায় লিয়া বি’র’ক্ত হলো।একটু ত্যাড়া করে বলল,

“বেটার সে আবার কি! বুঝলাম না তো!”

“তুমি সহজ কথাটা বুঝলে না।সহজ কথা যায় না বলা সহজে। আচ্ছা তাহলে শোনো,যেমন ধরো অনেকে আমার থেকে হ্যান্ডসাম, অবৈধ প্রচুর টাকা,অবৈধ সাধারণ জনগণের মাঝে ক্ষমতার প্রভাব, প্রতিমাসে নামিদামি হোটেলে পার্টি করার ক্ষমতাসম্পন্ন এরকম জাতীয় কেউ কেউ। আমার থেকেও অঢেল ধন সম্পদ আছে এ ।”

জারিফের কথার মাঝেই লিয়া বলল,”ও বেটার বলতে আপনি এই বৈশিষ্ট্যগুলো বলছেন।আসলে তো এগুলো বেটার নয়। এগুলো তো আপনার এ্যগেনেস্ট বৈশিষ্ট্য।এটা আবার বেটার হয় কীকরে!এত দিনের জানাশোনার সম্পর্কে আপনার আমার সম্পর্কে তাই মনেহয়।”

জারিফ তড়িৎ বলল,””আসলে আমার তো তোমার সম্পর্কে একটা ধারণা আছে। এবং এই ধারণা থেকে বিশ্বাসও আছে।যে বিশ্বাসে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস চলে। তবুও আজকের এই সুন্দর পরিবেশে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।”

লিয়া দৃঢ় চিত্তে বলল,”তাহলে শুনুন, আসলে আমি যেটা মনেকরি,আমার বয়স অল্প হলেও এই পৃথিবীর আসল সুখ ও শান্তি আমি ভালো করে জানি। সেটা হলো, অল্পে তুষ্টি। এছাড়াও ‘ভালো’র মধ্যেই প্রকৃত সুখ ও শান্তি নিহিত রয়েছে। ছোট্ট আমার এই জীবনে আমি কোনো মতেই অশান্তিদায়ক পরিস্থিতে পরতে চাই না। যেভাবেই বলা হোক রং এবং অপসংস্কৃতির মধ্যে অশান্তি নিহিত থাকে। এটা আমি খুব ভালো করে বুঝি। ফ্রি মিক্সিং, রং এক্টিভিটিস, ফ্রড এক্টিভিটিস,ইলিগেল মানি,ইলিগেল পাওয়ার অল আর কজ ফর আনপিস সিচুয়েশন।”

লিয়া একটু থামল।লিয়া জারিফের চোখে চোখ রেখে শীতল চাহনিতে চেয়ে ফের বলল,

“আই নো ইউ ভেরি ওয়েলি।সো,আমি আমার প্রকৃত শান্তির জন্য তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থাকে ঘৃনা করে আমি আমার মতো আপনাতেই আ’স’ক্ত।আপনি আমার নজরে আসার পর,অন্য কেউ আসেনি আমার নজরে।আমার জন্য আমি আপনাকেই।শুধু আপনাকেই বেস্ট মনেকরি।শুধু মনেই করি না।বিলিভ করি।আমি বিশ্বাস করি আপনিই হবেন আমার #সুখের_ঠিকানা।”

এই বলে লিয়া জারিফের বুকে মাথা রাখল। প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো।জারিফের ঠোঁটের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠল হৃদয়।জারিফ লিয়ার পিঠের পাশ দিয়ে একহাত দিয়ে আলতোকরে জড়িয়ে নিলো। জারিফ প্রফুল্ল চিত্তে প্রশান্তিময় কণ্ঠে বলল,

“ও লিয়া ইউ আর গ্রেট। আল্লাহ গিফট মি ইউ হুইস আই ডিজার্ভ। আলহামদুলিল্লাহ।তুমিই আমার জন্য সেরা আর সর্বোত্তম। উফ্!থ্যাংকস টু আল্লাহ থ্যাংকস টু লর্ড।”

#সমাপ্ত