সুখের নেশায় পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
600

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৬

চৈত্রিকা টলমল পা দুটো নিয়ে ফ্লোর আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। রুমে যেন ঝড় তান্ডব বয়ে গেছে। আসবাবপত্র ছড়ানো ছিটানো। ফ্লোর জুড়ে কাঁচের ছড়াছড়ি। এতো বড় ঝড় বয়ে গেল অথচ সাফারাত সটান হয়ে শুয়ে আছে চোখের উপর হাত রেখে। মুখভঙ্গি এমন যেন কিছুই হয় নি। দুরুদুরু বুক নিয়ে আস্তেধীরে রুমে প্রবেশ করল চৈত্রিকা। কাঁচের জন্য সঠিকভাবে হাঁটা যাচ্ছে না পাছে যদি পায়ে বিঁধে যায় সেই ভয়ে। অতি সাবধানে পা ফেলেও একটা কাঠের টবের সাথে পা বেজিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে সাফারাতের শরীরের উপর। পুরুষালি শক্ত দেহে হুমড়ি খেয়ে পড়ার কারণে ব্যাথায় মৃদু চিৎকার করে উঠল চৈত্রিকা। ঘটনার আকস্মিকতায় সাফারাত হতভম্ব হয়ে গেল। দু হাতে নিজের সাথে ঝাপটে ধরল চৈত্রিকাকে। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে উত্তেজিত সুরে বলে উঠল,
– ‘চৈত্র ঠিক আছেন আপনি?ব্যাথা পেয়েছেন? বেশি লেগেছে?কোথায় পেয়েছেন আমায় বলুন জান। ‘
ক্রমাগত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সুযোগ পেল না চৈত্রিকা। ভালো হাতে সাফারাতের শার্ট আঁকড়ে ধরল। মুঠোয় পুরে মলিন,নিস্তেজ স্বরে বললো,
-‘ ঠিক আছি আমি। আপনি কি হাল করেছেন রুমের? ‘
-‘ সার্ভেন্ট এসে গুছিয়ে দিয়ে যাবে। ‘
-‘ আর আপনার রাগ?সেটাও কি সার্ভেন্ট কমিয়ে দিয়ে যাবে?’
সাফারাত ভ্রুঁ উঁচু করে তাকালো। চৈত্রিকাও মায়াময়,ভয়ার্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ করল তার রক্তিম দু চোখে। চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে সে নিষ্পলক জবাবের প্রতীক্ষায়।

বলিষ্ঠ দু’হাতে টেনে ওকে উপরে তুলে নেয় সাফারাত। শাড়ি ভেদ করে কোমরে রাখা শক্তপোক্ত হাতের বাঁধন ঢিল হওয়ার বদলে আরো শক্ত হলো। চক্ষুদ্বয় মেলে রাখতে পারছে না চৈত্রিকা। মুখের একদম নিকটে ভাসমান সাফারাতের চেহারা খানি। হুট করে মাদকতাময় হয়ে উঠেছে চোখ দুটো। নেশাতুর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফারাত। চৈত্রিকার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সাফারাতের দৃষ্টি যেন ওর শ্বাস চেপে ধরছে। মাতালের ন্যায় টালমাটাল করছে অনুভূতিরা। বুক কাঁপছে দ্রিমদ্রিম শব্দ তুলে। সাফারাত মুখ অল্প পরিমাণ কাছাকাছি আনতেই চৈত্রিকা ছটফট করতে শুরু করলো। শক্ত করে চেপে ধরে ঠোঁট এগিয়ে এনেও সাফারাত ঠেলে সরিয়ে দিল চৈত্রিকাকে। থতমত খেয়ে গেল চৈত্রিকা। বিছানায় বসে চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে রইল। এটা কি হলো?সাফারাতের দমে যাওয়া রাগ কি আবারো মাথা চারা দিয়ে উঠল নাকি চৈত্রিকার কান্ডে বিরক্ত হলো?

সাফারাত বিছানা থেকে উঠে হাট করে খুলে রাখা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসে। চৈত্রিকা হতবাক হয়ে দেখে যাচ্ছে কেবল। দরজা বন্ধ করে এসে সাফারাত শক্ত হাতে চৈত্রিকার এক হাত টেনে কাছে নিয়ে এলো৷ চৈত্রিকা কিছু ঠাহর করবার আগেই সাফারাত কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিচেল স্বরে বলে উঠল,
-‘ দরজা খোলা ছিল বলেই ছটফট করছিলেন। আপনার সমস্যা সমাধান করে দিলাম তবুও কাঁপছেন কেন? ‘
-‘ কই না তো। ‘
লজ্জা মিইয়ে গেল চৈত্রিকা। সাফারাত টুপ করে ওর গালে চুমু খেয়ে নেয়। চৈত্রিকা লাল আকার ধারণ করা চেহারা নিমিষেই যেন নীল হয়ে গেল। চোখের পল্লব ঝুঁকিয়ে ফেলল ঝটপট। সাফারাত কপালে চুমু খেয়ে সরে যায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বলে,
-‘ অস্থির হবার টাইমিং টা ভুল। দমিয়ে নিলাম নিজেকে। তবে আপনি চাইলে আমায় এক দুটো কিস করতে পারেন চৈত্র। ‘

সাফারাতের কথায় চৈত্রিকার মাথা ঘুরে গেল। যেখানে নিজেই সাফারাতের সান্নিধ্যে চুপসে যায়,মিইয়ে যায় সেখানে নাকি ও নিজ থেকে কিস দিবে!এটা এভারেস্ট জয় করার মতো কঠিন বিষয় তার নিকট। সাফারাত স্মিত হেসে চৈত্রিকাকে অবাক করে দিয়ে বললো,
‘ আপনাকে আমি আদরে কৃপণতা করি নি চৈত্র অথচ আপনি সামান্য চুমুতে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ‘

পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর সম্বোধন বুঝি ‘আপনি ‘ সম্বোধন টা। সাফারাতের কন্ঠে যতবার এই শব্দ টা শুনে ততবারই চৈত্রিকা সুখময় নেশায় ডুবে যায়। কতটা ভালোবাসা, সম্মান লুকায়িত এই আপনি নামক শব্দে চৈত্রিকার নিকট প্রকাশ করা অসম্ভব। হাঁটুতে ভর করে শাড়ি সামলে এগিয়ে গেল ও সাফারাতের কাছে। রিনঝিনে স্বরে আওড়ায়,
-‘ আপনি কি চোখ বন্ধ করবেন সাফারাত? ‘
-‘ কেন?আপনি কি চুমু খাবেন?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ালো। রাঙা হয়ে উঠেছে দু’গাল ইতোমধ্যে। সাফারাত চোখ বন্ধ করে অধর কোণ বাঁকিয়ে বললো,
-‘ শুরু করুন চৈত্র মাস। ‘
চৈত্রিকা লজ্জা মাখা চেহারা নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল সাফারাত এর কপালে। গালেও চুমু খায়। ঠোঁটের কাছে ওষ্ঠদ্বয় আনতেই চৈত্রিকার শিরা উপশিরায় কাঁপুনি ধরে যায়। এই জীবনে হয়ত ওর দ্বারা লিপ কিস করা হবে না। সরে আসতেই নিলেই সাফারাত চোখ বুঁজে থেকেই মাথার পিছনে হাত গলিয়ে কাছে টেনে নেয়। নিজের শুষ্ক ওষ্ঠযুগল চেপে ধরে চৈত্রিকার ঠোঁটে। চৈত্রিকা হকচকিয়ে গেল। সামনের মানুষ টা গভীরভাবে মত্ত হয়ে পড়ে ওর নরম অধর জোড়ায়। মিনিট খানেক পর সাফারাত ঠোঁট ছেড়ে দিতেই চৈত্রিকা থম মেরে রইল। জমে রইল বরফের ন্যায়। সাফারাত ঠোঁট মুছতে মুছতে বলে,
-‘ আপনি আমার রাগ প্রশমনের মেডিসিন। ‘
_______________

মিম নাস্তা করে রেডি হয়ে নেয় কলেজের জন্য। আজ মডেল টেস্ট আছে। কলেজে যাওয়া জরুরি। নয়ত বিয়ের এতো তোরজোরের মধ্যে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ফাহমিদা ব্যস্ত হাতে সব গুছিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘ চৈত্রর সাথে তো কথা হলো না। একটু পর ফোন দিব। আমার মেয়েটা যে কেমন আছে। আর নিচে থেকে তো আজ গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে না। দিহান আসে নি হয়ত তোকে আজ নিতে। গাড়ি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। হেঁটে যাস না আবার। ‘

মায়ের কথা শুনে হু হা কিছুই বলল না মিম। তবে বেশ অবাক হলো দিহান আসে নি শুনে। অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। হুট করে সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছে। বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। নিচে এসে দেখে সত্যিই আসে নি দিহান। মোবাইল তো উপরে রেখে এসেছে। দারোয়ানের কাছ থেকে চেয়ে ওনার মোবাইলটা নিয়ে দিহানের নম্বরে ফোন দিল। এ কদিনে নাম্বার টা একদম মুখস্থ তটস্থ করে নিয়েছে মিম। কেন নিয়েছে নিজেও জানে না। কিন্তু মাঝে মাঝে অনুভব হয় দিহান ছাড়া ভীষণ অচল ও। এই যে এই মুহুর্তেও ঠিক এমন অনুভূতি হচ্ছে। পরপর কয়েকবার কল দিল মিম। অপরপাশ থেকে প্রত্যেক বার বিজি শুনালো। ওয়েটিং দেখাচ্ছে। সাত সকালে কার সাথে এতো কথায় ব্যস্ত দিহান? ওকে নিতে পর্যন্ত এলো না। ভুলে গেল?প্রায় আধাঘন্টা ধরে ফোন করেও ব্যস্ত পেয়ে এবার মিমের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। চারপাশের সবকিছু বিষ মনে হচ্ছে ওর। কেন গা ভাসাতে গেল আবেগে?কেন পারলো না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে?শেষমেশ ভালো বাসতেই হলো দিহানকে?অন্য কাউকে বাসা যেত না?হাবিজাবি প্রশ্নে মন ব্যাকুল। দারোয়ান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
-‘ কি হইছে মিম?’
-‘ কিছু না চাচা। এই নিন আপনার মোবাইলটা। ‘

গেট দিয়ে বের হয়ে একটা সিএনজি ডেকে উঠে যায় মিম। পরীক্ষা দিবে না সে আজ। মনের উচাটন নিয়ে কোনোভাবেই পরীক্ষা দেওয়ার সম্ভব না ওর পক্ষে। দিহানের অল্প পরিমাণ অবহেলা সহ্য করবার শক্তি নেই তার। নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামতেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল মিম। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। ১০ টা বেজে গেছে। এমন সময় অফিসে থাকে দিহান। তাই সোজা এখানেই আসে। লিফটের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে ফোর্থ ফ্লোরে উঠে যায়। ক্লান্তিতে বড় বড় শ্বাস ফেলছে মেয়েটা। কলেজ ড্রেস টা ঘামে অল্পসল্প ভিজে গেছে। রিসিপশনে চাকরিরত মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল,
-‘ মিস্টার দিহান আছেন?’
মেয়েটা তুখোড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে মিমকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-‘ আছেন ম্যাম। তবে স্যার এই মুহুর্তে মিটিংয়ে আছেন। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ‘
-‘ কতক্ষণ লাগবে?’
-‘ এই ধরুন দুই থেকে তিন ঘন্টা। ‘
-‘ এতো দেরি?আপনি উনাকে একটু ইনফর্ম করবেন যে মিম এসেছে। ‘
-‘ স্যরি ম্যাম। আই কান্ট ডু দিস। অপেক্ষা করুন। ‘
এতো সময় অপেক্ষা কি পসিবল?মিনিট পাঁচেক কথা বলেই তো চলে যাবে ও। মিম নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
-‘ আপনি একবার ইনফর্ম করুন। ‘
মেয়েটা রাজ্যের বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
-‘ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না জব রিলেটেড কোনো কাজে এখানে এসেছেন। আমার জানামতে আপনি স্যারের রিলেটিভও না। তাই মিটিংয়ের মাঝে আপনার জন্য আমি স্যার কে ডিস্টার্ব করতে পারব না। চাইলে ওয়েট করতে পারেন আদারওয়াইজ ইউ ক্যান গো। ‘

মিমের মেজাজ গরম হয়ে গেল মেয়েটার ব্যবহারে। কিন্তু একদিক থেকে মনে হলো মেয়েটা সঠিক। নিজের কর্তব্যই তো পালন করছে। মিম দিহানের কেবিনের সামনের সিটে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। অফিসের সকল কর্মচারীরা অদ্ভুত চোখে দেখছে ওকে। সবার দৃষ্টি এমন হয়ত মিম কোনো চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা প্রাণী নয়ত পাবনা ফেরত পাগল। এতো করে দেখার কি আছে?বসে থাকতে থাকতে মাথা ব্যাথা করছে। এবার অস্বস্তি লাগছেও ভীষণ। মিমের ইচ্ছে করছে কেবিনের দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে যেতে। এতো অপেক্ষা সে কখনও করে নি। তবে দিহান কে অপেক্ষা করিয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। একদিন তো ইচ্ছে করে কলেজ ছুটির টাইম ভুল বলেছে মিম। দিহানের ধৈর্য্যশক্তি পরীক্ষার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই বলেছে ছুটি জলদি দিবে। এমন বলে দিহান কে পুরো একঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছিল। দিহান জিতেছিল সেদিন ধৈর্য্য পরীক্ষায় নয়ত ভালোবাসায়। একটুও বিরক্তি কিংবা জেদের দেখা মেলে নি তার চেহারায়। উল্টো বলেছিল দীর্ঘ অপেক্ষার পর তোমার ঘর্মাক্ত মুখশ্রী দেখে হৃদয়ে শীতল স্রোত অনুভব করছি আমি মিম-ডিম।

অধিক ক্লান্তির মাঝেও মিমের অধর দু’টো প্রসারিত হয়ে এলো দিহানের সেদিনকার কথা মনে করে। আহা!কতই না মোহনীয় ছিল দিহানের উচ্চারিত সেই বাক্য টুকু। সময়ের স্রোতে মিম এখন বড্ড অবিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। দেয়ালে আটকানো বিশাল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে প্রায় দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। এবার খুবই কষ্ট অনুভব করছে মিম। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রইল ও। আজ কিছুতেই ফিরে যাবে না সে দিহানের সাথে দেখা করা ব্যতীত। কেন থাকবে দিহানের ফোন ব্যস্ত? কেন ভুলে যাবে সে নিজ থেকে নেওয়া দায়িত্ব টুকু?নানান চিন্তায় বিভোর মিমের চক্ষুদ্বয় লেগে আসে একটা সময়। শত চেষ্টা করেও খোলা রাখতে পারলো না সে। ঘড়ির কাঁটার ঘূর্ণনের সাথে চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার মুহুর্তেই গালে শীতল হাতের স্পর্শে পুরো দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। বিস্ফোরিত নয়নে সামনে তাকাতেই দেখে দিহান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রঁ যুগল কুঁচকানো তার। দিহান কে দেখেই সব জমে থাকা রাগ, অভিমান মাথা চারা দিয়ে উঠল। ঝড়ের বেগে দিক বিদিক ভুলে দিহানের কলার আঁকড়ে ধরল মিম। হতভম্ব, হতবাক দিহান। পাশাপাশি অফিসের সকল স্টাফ। দিহান চারদিকে চোখ বুলায়। পরক্ষণেই স্মিত হেসে কোমর জরিয়ে শূণ্যে তুলে নিল মিম কে। সবার উদ্দেশ্যে কড়া সুরে বলে উঠল,

‘ সবাই যে যার কাজে যান। ‘

অফিসের সকলের মাঝে কানাঘুঁষা শুরু হয়ে যায়। দিহান নিজেও বেক্কল বনে গেল মিমের কর্মকাণ্ডে। শূণ্যে তুলে কেবিনে নিয়ে এলো। মিমের কোমরে বলিষ্ঠ হাত জোড়া পেঁচিয়ে রেখেই প্রশ্ন করে,

-‘ কি হয়েছে মিম-ডিম?এতো রাগ?আজ কি কলেজ ছিল তোমার?’
-‘ খু/ন করবো আমি আপনাকে। এই আপনার দায়িত্ব? আমার পরীক্ষা ছিল আজ। অথচ আপনি ফোন টাও ধরেছিলেন না। মাত্র দুয়েক দিনে অবহেলা করা শুরু করে দিলেন আমাকে?ভালোবাসা শেষ? আমি অবহেলা একদম সহ্য করতে পারি না। ফেইক আপনার ভালোবাসা। ‘

রাগের চোটে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মিমের। দিহানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। দিহানের ঠোঁটের কোণে সুপ্ত বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। মিমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিচেল স্বরে বললো,

‘ আমি কি কখনও তোমায় ভালোবাসি বলেছি?’

#চলবে,,!

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৭

দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল মিম দিহানের বক্ষস্থলের ঠিক বা পাশে। ব্যাথায় নাক মুখ কুঁচকে ফেলল দিহান। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল ব্যাথাতুর আর্তনাদ। মিম প্রথমত নিজের কান্ডে হতবাক হলেও পরমুহূর্তে দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার, ভাবলেশহীন হয়ে। তার মুখ টা একদম দিহানের বুক ছুঁই ছুঁই। চিকন চাকন হাত দুটো গলিয়ে দিল দিহানের দুই বাহুর নিচ দিয়ে। পিঠ জড়িয়ে ধরল দু হস্তে। আরেকটু মিলেমিশে, চেপে গেল সে দিহানের বুকের মধ্যিখানে। দিহান কোমর শক্ত করে চেপে ধরে চাপা গর্জন করে। রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
‘ এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না আমাকে মেরে আবার আমার বুকেই ঢুকে পড়ছো?’
মিমের সহজ সরল সগতোক্তি- ‘ মিথ্যে বললে এমন হাজার টা কিল ঘু’ষি পড়বে আপনার বুকে।’
দিহান ভ্রুঁ কুঁচকালো। মিমের নরম দেহখানি শক্ত করে চেপে ধরে বললো-‘ আমি কখন মিথ্যে বললাম?আমি তো ঠিকি বলেছি। তোমাকে ভালোবাসি বলেছি আমি একটা বারও?’
মিম রোষপূর্ণ স্বরে বলে উঠল-‘ বলেন নি কেন?ভালো তো ঠিকি বাসেন। বলেন নি তাই আমি আপনাকে আরেকটা শাস্তি দিব?’
অধর যুগল প্রসারিত করল দিহান। ঠোঁট উল্টে বললো,
– ‘ বুকে আর কিল দিও না মিম-ডিম। ম’রে যাবো একদম। ‘
মিম চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। ধীরস্থির ভঙ্গিতে ভাবে। দিহানের কষ্টের কথা চিন্তা করে অন্য একটা বুদ্ধি আঁটে মাথায়। বিলম্বিত না করে অকস্মাৎ নিজের ধারালো দাঁত বসিয়ে দিল দিহানের ঘাড়ে। আউচ শব্দ সৃষ্ট করে ঘাড়ে এক হাত চেপে ধরে দিহান। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,
‘ কামড় টা ঠোঁটে দিতে পারতে। শাস্তি স্বরূপ হলেও তোমার ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া তো পেতাম। ‘

এই যাত্রায় লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে মিমের গাল,মুখ। জোশের ঠ্যালায় হুঁশ হারিয়ে এতো সময় কি কি করল সে?লজ্জায় ধুপধাপ কাঁপছে অন্তস্থল। সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিরা পাল তুলছে। শিরায় উপশিরায় কেমন নিত্য নতুন ছন্দ বয়ে চলেছে। ভালোবাসার ছন্দ। দিহানের বাঁধন হতে সরে আসতে নিলেই দিহান বাঁধ সাধে। কাছে টেনে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে থাকে কয়েক পল মিমের লজ্জা মাখা আঁখিদ্বয়,চিকন তিরতির করা ঠোঁট দুটোতে। মৃদু হাসল সে। ঘোর লাগা স্বরে আওড়ালো,

‘ ভালোবাসি তো মিম-ডিম। ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমায়। আমার জীবনের নতুন সুখ তুমি। যেই সুখ হারাতে রাজি নয় আমার মন। আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তুমি নামক সুখ, অসুখ আমার প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। ‘

মিমের হৃদস্পন্দন থমকে গেল কি?মেয়েটা নড়তে ভুলে গেল। শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। অস্বাভাবিক ভাবে কিছু একটা ছুটতে শুরু করল হৃদপিণ্ডে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পরক্ষণেই ভারী এবং বড় বড় নিঃশ্বাস বের হয়ে আসতে থাকে। ও তো জানত, দিহানের চোখের ভাষা পড়তে পারত। বুঝতে পারত দিহানের অব্যক্ত, অপ্রকাশিত ভালোবাসা, প্রেম,অনুরাগ। তাহলে এই মুহুর্তে মনটা এমন করছে কেন?নিজেকে পাগল পাগল লাগছে কেন?ভালোবাসা প্রকাশ হলেই কি এমন হয়?এমন দমবন্ধ করা অনুভূতির সৃষ্টি হয় হৃদয়ের গহীনে? আর সহ্য করতে পারল না মিম। ঝাপটে ধরল দিহান কে। এলোমেলো, অবিন্যস্তভাবে বললো,
‘ আমিও ভালো,ভালোবাসি আপনাকে। ‘

দিহানের শূন্য বক্ষপিঞ্জর আজ পরিপূর্ণ হলো। তৃপ্তিদায়ক হাসি খেলে গেল অধরে। এই পিচ্চি মেয়েটাকে অল্প কয়েকদিনে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলেছে ও। ফেলেছে বললে ভুল হয়ে যাবে। বড্ড বড় ভুল। কারণ এই মেয়েই বাধ্য করেছে ওকে ভালোবাসতে। নিজের রাগ,কর্কশ ব্যবহারে রাতের পর রাত নির্ঘুম রেখেছে দিহানকে এই পিচ্চি মেয়েটা। মানুষ নাকি সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়ে। সুন্দরে বিমোহিত হয়। অথচ প্রথমবার চৈত্রিকাকে দেখতে গিয়ে মায়ের মিম কে পছন্দ হলেও দিহানের কোনো অনুভূতি জাগে নি মিমের প্রতি। মা যখন দিনের পর দিন কানের কাছে প্যান প্যান করে জ্বালিয়ে মেরেছে মিমকে বউ করে আনার জন্য তখন দিহান বাধ্য হয় মিমের মুখোমুখি হতে। তখনও সাফারাতের হবু শালী হিসেবে হালকা মজা করে সে। কিন্তু মিমের রাগ,ব্যবহারে প্রেমে মত্ত হয় দিহান। ডুবে যায় এক প্রকার। যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় মেলে নি আর। এখন তার মিম কেই চায়। সারাজীবনের জন্য চায়। মিমের চুলের ভাঁজে গাঢ় চুম্বন আঁকল। নড়েচড়ে উঠল মিম। খামচে ধরে তাকে। দিহান আলতো হেসে বলে উঠল,

‘ আমি কিন্তু প্রেম করতে পারব না মিম। ভালোবাসি বললেও আমার দ্বারা প্রেম সম্ভব নই। ‘

মিম হকচকিয়ে যায়। ভড়কে যায়। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। মুখে আওড়ায়- ‘ মানে?’

দিহান ওর কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল গুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিল। চক্ষু বুঁজে আসে মিমের প্রগাঢ় স্পর্শে। একটুখানি ঝুঁকে আসে দিহান ওর পানে। বক্ষস্পন্দন বেড়ে যায় তার। গরম, তপ্ত নিঃশ্বাস চোখে মুখে উপচে পড়ছে দু’জনের। উভয়পক্ষের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার। মিমের পা দুটো টলছে। হুটহাট নতুন অনুভূতিতে অভ্যন্তর বেসামাল হয়ে পড়ছে। গালে গভীর স্পর্শ পেতেই আরো কেঁপে উঠে দেহখানি। দিহান থামল না। এক হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পরপর তিনটে চুমু খেল গালে। সরে এসে বললো,
‘ ঠিক এজন্যই প্রেম সম্ভব নই আমার দ্বারা। তোমার যত কাছাকাছি থাকব আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসব। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব না আমি। প্রেম করলেই ভুল হবে। তোমাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে হবে। ‘

মিম ধপ করে নেত্রযুগল মেলে ধরল। চোখে তার একটাই প্রশ্ন – ‘তাহলে?’
দিহান যেন তা পড়ে ফেলল। বললো,
‘ বিয়ে করব পুচকি। তোমায় বউ বানিয়ে দিনরাত কন্ট্রোললেস হলেও ক্যারাক্টারলেস উপাধি তো পেতে হবে না। আজই মা’কে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। ‘

মিমের সারা মুখশ্রী নিমিষেই লাল হয়ে উঠল। বিয়ে?এই শব্দ যে তার মনপ্রাণে ছুটে চলেছে উদভ্রান্তের মতোন। বান্ধবীদের মুখে কত যে লাভ স্টোরি শুনে। সাথে ব্রেকআপ এর গল্প’ও। কেউ কেউ বলে বয়ফ্রেন্ড চিট করেছে। বিয়ের নাম করে এটা সেটা করে ঠকিয়েছে। বিয়ের কথায় বেঁকে গিয়েছে। মিম কল্পনাও করে নি ভালোবাসা প্রকাশ হতে না হতেই বিয়ে নামক শব্দ তার শ্রবণগ্রন্থি দিয়ে সোজা কলিজায় এসে বিধঁবে। সাথে একরাশ মুগ্ধতা, বিস্ময় নিয়ে। মনে মনে যখন খুশির জোয়ার তখনই মায়ের নিঃসঙ্গতার কথা মনে পড়তেই আঁতকে উঠে ও। আমতাআমতা করে,রয়ে সয়ে বলে,

‘ আমাকে ছাড়া আমার মা একা হয়ে যাবে দিহান। আম্মু কে ছাড়া থাকতে পারব না আমি। আপু তো এই ভয়েই আমাদের ছেড়ে থাকতে রাজি হয় নি। ‘

দিহান ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ক্ষীণ সময় ভাবে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

‘ বউ আনতে পারব, সাথে একটা মা আনতে পারব না?’

চকিতে মুখ তুলে তাকালো মিম। চোখে মুগ্ধতা। সে কেমন মানুষকে ভালোবাসল?সবসময় বোন কে বলে আসল তুমি খুব লাকি আপু। কিন্তু আজ,এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে সে নিজেও খুব ভাগ্যবতী। খুব বেশি। চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ,
‘ কিন্তু আপনার পরিবার? ‘
‘ আমার পরিবারের আমি ও আমার মা ব্যতীত কেউ নেই। আর আম্মু তুমি বলতে পাগল। আশায় বসে আছেন কবে উনার পুত্রবধূ হয়ে পায়ের পদলি ফেলবে তার বাড়িতে। আম্মুকে আমি ম্যানেজ করবো। একদিন তুমি দেখবে আমার দুই মা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে উঠবেন। ‘
মিম পাশের সোফায় বসল। দিহান পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। কন্ঠে তার উৎকন্ঠা -‘ খারাপ লাগছে তোমার?’
-‘ উঁহু! ক্লান্তি। ‘
দিহান অপরাধী স্বরে বললো,-‘ আমি ভেবেছিলাম বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলে তাই আজ কলেজে যাবে না। তোমার পরীক্ষা ছিল সেটা জানতাম না আমি। আ’ম রিয়েলি স্যরি। ‘
-‘ ইট’স ওকে। প্রবলেম নেই। ‘

দিহান রিসিপশনের মেয়েটাকে ফোন দিল। সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলো মেয়েটা। চোখ ঘুরিয়ে এক পলক তাকালো অবসন্ন, মায়া যুক্ত ফর্সা মুখের মেয়েটার দিক। মিম’ও একবার তাকালো। দিহান কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে,

‘ আপনি আমাকে জানান নি কেন যে কেউ আমার সাথে দেখা করতে এসেছে? কেন বসিয়ে রাখলেন মিম কে এতো সময়?’

মেয়েটা মাথা নত করে জবাব দিল,

‘ স্যরি স্যার। আজকের মিটিং টা খুব জরুরি ছিল। তাই ডিস্টার্ব করতে চাই নি। ‘

দিহানের মাথার রগ দপদপ করে উঠল। তবুও মেয়েটার সাথে চেঁচাল না সে। মেয়েটা তো নিজের কর্তব্য, কাজ করেছে।

‘ ঠিক আছে। নেক্সট টাইম কেউ ইমারজেন্সি দেখা করতে চাইলে আমাকে বলবেন। আর ইনি আপনাদের ম্যাম। অফিসে আসলে ওর যেন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। ‘

মেয়েটা বিস্ফোরিত নয়নে মিমের দিকে তাকায়। মিম লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ফিরে যায়। কারণ বয়সে মেয়েটা চৈত্রিকার সমান হবে। এতো বড় একটা মেয়ের সামনে দিহান ওকে ম্যাম সম্বোধন করায় জড়তা কাজ করছে। ‘ ওকে স্যার’ বলে দ্রুত বেগে প্রস্থান করে মেয়েটা। যাওয়ার আগে দিহান বলে দিল মিমের জন্য ক্যান্টিন থেকে বার্গার পাঠাতে।
_______________

শান্তশিষ্ট, নম্র,ভদ্র হয়ে খাবার টেবিলে বসে আছে চৈত্রিকা সবার সাথে। সকালে যে এই বাড়িতে কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে তার ছিটেফোঁটাও নেই আনাচে কানাচে। সাফারাত নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিল। চৈত্রিকার সামনে প্লেট দেওয়া হয় নি। কেন দেওয়া হয় নি তা লজ্জায় আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছে না ও। সুফিয়া,প্রিয়ন্তী,চাচা-চাচী নিজেদের মতো করে খাবার খেয়ে যাচ্ছেন। দুপুরের সময় চলছে। ঘড়ির কাঁটায় দু’টো ছুঁই ছুঁই। মৌসুমি বেগম সেই সকালে নিজের ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে বিদায় নিয়েছেন। চৈত্রিকার এতে বেশ খারাপ লাগে। কিন্তু সাফারাতের কড়া নির্দেশে মৌসুমির সাথে ক্ষমা চাওয়া বা কথার বলার সুযোগ টুকুও মিলে নি। আর না এই বাড়ির কোনো সদস্যের সাথে। এই প্রাচুর্যে ভরপুর বাড়িটায় যেন মানুষ নয়। যতসব যান্ত্রিকতার ছড়াছড়ি। কারো সাথে কারো মিল বন্ধন নেই। আন্তরিকভাবে কথা পর্যন্ত বলে না। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে এতো আত্মীয় স্বজনদের ভিড়ের মাঝেও সাফারাত একা। ভীষণ একা। এখন কথা হলো সবাই গ্রোগাসে খেয়ে যাচ্ছে অথচ মিনা ওর সামনে প্লেট দিল না,খাবার দূরে থাক!সাফারাত নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে এক লোকমা মুখে পুড়ে বললো,
‘ আপনি খেতে পারবেন না চৈত্র। আপনার হাত পুড়ে গেছে। ‘

চৈত্রিকা বোকা বনে গেল। কতটা দায়সারাভাব মিশ্রিত বাক্য সাফারাতের! যদি না-ই খেতে পারে তাহলে তাকে ডাইনিং টেবিলে এনে বসিয়ে রাখার মানে টা কি?এটা ঠিক কোন জাতের মানুষ? অভিমানে কতগুলো অভিমান্য শব্দমালা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে পোষণ করল চৈত্রিকা। মুখ গোমড়া করে বসে রইল। অপরদিকে মিনা, প্রিয়ন্তী মিটমিট করে হাসছে। সুফিয়া বেগম, চাচা-চাচী নিরবে খেয়ে উঠে গেলেন। কারো যেন কারো খাওয়া বা না খাওয়া নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। একটা বার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না চৈত্রিকাকে খাবার কেন দেওয়া হচ্ছে না। ফিরলেনও না। চৈত্রিকার বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। সাফারাত এর দিকে ছলছল চোখ তাকালো ও। এই মানুষগুলোর সাথে কেমন করে থাকত সাফারাত? এক একজন স্বার্থপর, যান্ত্রিক মানব। বড়রা উঠে যেতেই সাফারাত নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত চৈত্রিকার মুখের সামনে ধরল। অবাক হলো চৈত্রিকা। সঙ্গে সঙ্গে নত মস্তকে মুখে নিয়ে নিল। প্রিয়ন্তী সুর টেনে বললো,
‘ বেশি করে খেয়ো ভাবী। কিপ্টামি করো না। ‘
সাফারাত চোখ রাঙ্গাতেই প্রিয়ন্তী, মিনা কেটে পড়ে। চৈত্রিকা মুখে খাবার নিয়ে মৃদু হাসে। পরক্ষণেই শ্রবণ হলো নরম স্বরের ডাক।
‘ চৈত্র! ‘
– ‘জ্বি। ‘
– ‘ খারাপ লাগছে আপনার?’
চৈত্রিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বললো,
– ‘ খারাপ লাগবে কেন?’
– ‘ আমার জীবনে এসে?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ালো। কন্ঠনালি হতে বেরিয়ে আসা বাক্যে অগাধ বিশ্বাস মিশ্রিত।
– ‘ চৈত্র ম*রে যাবে। তবুও আপনাকে নিয়ে আফসোস জাগবে না৷ আপনি আমার সুখের আরেক নাম সাফারাত। ‘
সাফারাত এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো ,
– ‘ আপনি কি জানেন চৈত্র সুখ হাওয়ায় মিঠাই?’
চৈত্রিকা চমকালো না। বরং সাদা-মাটা উত্তর দিল,
– ‘ জানি। সুখ কখনও চিরস্থায়ী হয় না। হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতো চুপসে যায়। ‘
প্রগাঢ় চাহনি নিক্ষেপ করল সাফারাত চৈত্রিকার দিক। নিমিষেই এক হয় চার চোখ। হৃদযন্ত্রের গতি হয় নিয়ন্ত্রণ হারা। সাফারাত তেজি স্বরে বললো,
– ‘ সুখ কে আমি অসুখ বানিয়ে বেঁধে রাখব চৈত্র। এই অসুখ কখনও সাড়বে না। তবে তার মেয়াদ আপনাতেই সীমাবদ্ধ। আপনি আছেন মানে কারো সাধ্যি হবে না আমাদের সুখ কেঁড়ে নেবার। ‘

চৈত্রিকা নিঃশব্দে হাসে। বলতে চায় আমার সুখ’ও আপনাতে সীমাবদ্ধ সাফারাত। কিন্তু বলতে পারল না। প্রশান্তি অনুভব করল কেবল।
____________

‘ আমি পারব না সাফারাত কে কন্ট্রোল করতে। এবার জার্মানি থেকে ফেরার পর ছেলেটা আরো জেদি হয়ে উঠেছে। কথা বলতেও অনেক মেপে মেপে বলে। আমার সাথেও আজকাল কথা বলে না। ওর জীবনের ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারছি না। আমি যদি বিয়েতে না করে দিতাম তাহলে কি সাফারাত শুনত?আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি জেরিনকে এই বাড়ির বউ করে আনতে। তোরা তো কানাডা বসে আছিস। পারলে ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়া। এই সাহস নেই তোদের। আমার জন্যই পারলি এহমাদ পরিবারের বউ হতে। নাহলে কবেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতি। আমার ছেলেকেও পাওয়া হতো না তোর। দেখি আমি ওই মেয়েকে নিয়ে কি করা যায়। ছেলেটার মাথা একদম খেয়ে ফেলেছে ওই ছোট ঘরের মেয়েটা। ফোন রাখ এখন। ‘

সুফিয়া বেগমের সাথে কথা বলতে এসেছিল চৈত্রিকা। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে এসব শুনে প্রচন্ড অবাক হলো। সুফিয়া বেগমের কথাগুলো কিছু কিছু ঠাহর করতে পারলেও পুরোপুরি বোধগম্য হলো না ওর।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেক করা হয় নি।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৮

সুফিয়া বেগম পিছন ফিরে চৈত্রিকাকে দেখলেন। কোনো প্রকার রিয়েক্ট করলেন না তিনি। উনার চোখে মুখে বিস্ময় দেখতে পেল না চৈত্রিকা। মুখভঙ্গি একদম সরল,স্বাভাবিক। চেহারায় ভয়ের কিংবা হকচকানোর লেশ মাত্র নেই। চৈত্রিকা বুঝতে পারছে না উনার এতো স্বাভাবিক থাকার কারণ। কেননা উনি কিছুক্ষণ পূর্বেই তাকে নিয়ে কার সাথে কি যেন বলা বলি করছিলেন। সাফারাতকে কন্ট্রোল করার কথা আওড়াচ্ছিলেন। কার সাথে বলছিলেন এসব?খটকা লাগছে চৈত্রিকার। দ্বিধান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
‘ দাদি আসব?’
সুফিয়া বেগম থমথমে মুখে অনুমতি দিলেন,
‘ আসো। ‘
ধীর স্থির গতিতে রুমে ঢুকল চৈত্রিকা। সুফিয়া বেগম বিছানায় বসতেই সে মলিন মুখে বলে উঠল,
‘ দাদি আপনি কি রাগ করে আছেন আমার সাথে?আমি সকালের জন্য দুঃখিত দাদি। ফুপুর সাথে আমি তর্ক করি নি। উনিই ইচ্ছে করে আমার সাথে লেগেছেন। তবুও আমি নিজেকে দোষী মানি। ‘

সুফিয়া বেগম হাঁটু গেড়ে সম্মুখে বসে থাকা মেয়েটার দিকে
তাকালেন এক পলক। রুষ্ট স্বরে বললেন,
‘ তোমার কারণেই আমার মেয়েকে এভাবে অপমানিত হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। আমি তো মা। নিজের মেয়ের অপমান কি করে সহ্য করি বলো?’
চৈত্রিকার চোখে বিষন্নতা ভর করল। আনতস্বরে বললো,
‘ আমি বুঝতে পারি নি সাফারাত এমন করবেন। আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি ফুপিকে ফিরিয়ে আনব। ‘
‘ তার প্রয়োজন নেই। আমি মা হয়েছি বলে অন্যায় সহ্য করব না। ‘

চৈত্রিকা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সুফিয়া বেগমের কথার আগামাথা বুঝতে অক্ষম ও। মাথা নেড়ে বলে উঠল,
‘ বুঝি নি দাদি। ‘
তৎক্ষনাৎ ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন সুফিয়া বেগম। চৈত্রিকার মাথায় ভালোবেসে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ মৌসুমি তোমার সাথে অন্যায় করেছে। প্রথমে আমার কষ্ট হলেও তোমার দিক টা ভেবে দেখলাম। তোমাকে একটা কথা বলি চৈত্রিকা। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ‘
চৈত্রিকা কন্ঠে নম্রতা এঁটে বললো,
‘ বলুন দাদি। ‘
সুফিয়া বেগম এবার শক্ত হলেন। বললেন,
‘ এই পরিবারে তোমার চলাচল ও সাফারাতের জীবনে স্বাভাবিক ভাবে থাকা অসম্ভব। আমি নিজেই বরাবরই ব্যর্থ সাফারাতকে কন্ট্রোল করতে। হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের মন থেকে হিংসা,বিদ্বেষ সরিয়ে ভালোবাসা জাগাতে। স্ট্রং থেকো। অনেক কিছু সয়ে যেতে হবে। সামলে নাও নিজের জীবন। ‘

চৈত্রিকা উঠে দাঁড়াল। সুফিয়া বেগমের কথা এখনও ঠাহর করতে পারল না সে। কোনগুলো সত্য?দরজার অভিমুখে দাঁড়িয়ে যেগুলো শুনল? নাকি এখন যেই পরামর্শ গুলো দিল?সুফিয়া বেগম ঠিক কেমন মনের মানুষ? ভালো নাকি খারাপ?কোন রূপ টা সত্য?চৈত্রিকার মাথায় এই বাড়িতে ঘটে যাওয়া শুরু থেকে সবকিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর স্বস্তি মিলবে না যতক্ষণ না সবকিছুর জট খুলে। তার জন্য সবার আগে সাফারাত এর মায়ের মৃ’ত্যু,বাবাকে ঘৃণা করার কারণ, পরিবারের সবার সাথে দূরত্বের কারণ জানতে হবে ওকে। কার কাছ থেকে জানবে?চট করে মনে পড়ে গেল মিনার কথা। হ্যাঁ! মিনা তো একদিন আবছা আবছা বলেছিল সাফারাতের বাবা মা’র ব্যাপারে। পা বাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে সুফিয়া বেগম ডেকে উঠলেন। থমকে গেল চৈত্রিকা ডাক কর্নপাত হওয়া মাত্র। পা দু’টো আটকা পড়ল মেঝেতে। সুফিয়া বেগম দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। এগিয়ে এসে ওর হাত দু’টো কাঁপা কাঁপা হাতে মুঠোয় পুড়ে বললেন,

‘ কারো কাছে ভালো,কারো কাছে খারাপ সাজতে হয় আমার এই পরিবার টা’কে এক করার জন্য। কিন্তু আজও পারলাম না। ম’রে যাওয়ার আগেও দেখা হবে না আমার সুন্দর একটা পরিবার। নিজের পেটে ধরা ছেলেটার সাথে দু’দন্ড কথা বলার সুযোগ নেই। সাফারাত দেখতে পারে না ওকে। ঘৃণা করে সে নিজের জন্মদাতা কে। আমার কথা শুনে না। ছেলেটার সুখ,শান্তি তোমার মাঝে চৈত্রিকা। আমি জানি ও ম’রে গেলেও তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। তুমিই পারবে সব অশান্তি দূর করে বাপ ছেলেকে এক করতে। আমার পরিবার টাকে এক করতে। ‘

চৈত্রিকা ঘাবড়ে গেল। থমকালো ও। বুঝতে পারল আত্মীয়তা রক্ষার্থে সুফিয়া বেগম ভালো /খারাপ দু’টো রূপ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনটা আসল?বৃদ্ধার চোখে ভর্তি টলমল করা জল?
এটাই আসল,সত্যি। কন্ঠে সুন্দর পরিবার দেখার কাতরতা,চক্ষে জল মিথ্যে হতে পারে না। চৈত্রিকা নিজেও সুন্দর একটা পরিবার দেখতে চায়। ও নিজে কখনও বাবার আদর পায় নি। তাই চায় সাফারাত বঞ্চিত না হোক। তার বাবা তো এখনও জীবিত আছে। আর ভালোবাসার মানুষটার সুখের জন্য একটুখানি লড়াই করতে কষ্ট কিসের!মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘ বাবা দেশে আসেন দাদি?’
‘ আসবে কয়েকদিন পর। ওর এই বাড়িতে ঢুকার পারমিশন নেই তাই আসলেও হোটেলে থাকে নয়ত আমার বাপের বাড়িতে। ‘
চৈত্রিকার কন্ঠে অবাকতা,বিস্ময়।
‘ আপনার বাপের বাড়িতে? ‘
সুফিয়া প্রতিউত্তর করলেন। কন্ঠস্বর নিষ্প্রভ, মলিন।
‘ ওটা ওর শশুর বাড়িও। সাফারাতের মায়ের মৃত্যুর পর আমার ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করে সে। ‘
চৈত্রিকা ঠোঁট গোল করে বললো,
‘ ওহ্। ‘

সুফিয়া বেগমের রুম থেকে বেরিয়ে নিজেদের রুমে এলো চৈত্রিকা। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথাও সাফারাতের দেখা মিলল না। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। মস্তিষ্ক টা অচল ঠেকছে ওর নিকট। সাফারাতের বয়স ঠিক কত বছর ছিল ওর মায়ের মৃত্যুর সময়?ওকে কোনো প্রশ্নই করতে পারবে না চৈত্রিকা। এতে সাফারাত কষ্ট পাবে। রেগে যাবে। সিলেটে থাকতে বলে দিয়েছিল তার বাবা মায়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা বারণ। ভয়ংকর রক্তিম ছিল সেদিন, সেই মুহুর্তে চক্ষুদ্বয়। চৈত্রিকা মানুষটা কে কষ্ট দিতে চায় না বরং সুখ বিলীন করে দিতে চায়।

ওয়াশরুমের দরজা মেলার শব্দে ধ্যান, ভাবনা ভঙ্গ হয়ে যায় চৈত্রিকার। বাঁক ফিরে তাকালো ও। সাফারাত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। ফিরেও তাকালো না একটা বার। এই লোকের এটিটিউড দেখলে চৈত্রিকার ম’রি ম’রি অবস্থা। নিজের বউকে দেখতেও হয়ত হিসেব করে দেখে গম্ভীর স্বভাবের এই মানুষ। কাবার্ড থেকে একটা শার্ট বের করে বোতাম ছাড়িয়ে পড়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোতাম লাগাতে গিয়েও লাগালো না। গুটিয়ে ফেলল দু’হাত। মাথা কিঞ্চিৎ এলিয়ে দিতেই চৈত্রিকা ভড়কে গেল। কারণ আয়নার মাধ্যমে স্পষ্ট অবলোকন করে যাচ্ছিল ও সাফারাতকে নিষ্পলক,স্থির। থতমত খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতেই শোনা গেল সাফারাতের ভরাট,গম্ভীর কন্ঠস্বর।

‘ এদিকে আসুন। ‘
চৈত্রিকা হকচকানো স্বরে প্রশ্ন করে,
‘ আমি?’
‘ রুমে অন্য কেউ আছে?আমার বউ একটাই। উঠে আসুন। ‘

চৈত্রিকা উঠে কাছে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে হাত টেনে সামনে এনে দাঁড় করাল সাফারাত তাকে। কোমরে শক্তপোক্ত হাত রেখে চেপে নিয়ে আসল বুকের কাছাকাছি, অতি নিকটস্থে। আচানক কান্ডে চৈত্রিকা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। শরীর খানাতে ছুঁয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ সমীরণ। সাফারাত ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা ললাট ছুঁয়ে দিল। আদেশের সুরে বললো,
‘ শার্টের বোতাম গুলো লাগিয়ে দিন। আজ থেকে এটা আপনার দায়িত্ব। শার্টের বোতাম খোলার অধিকার আপনার হলে লাগানোর অধিকারও আপনার মিসেস চৈত্র মাস। ‘

চৈত্রিকা বোতাম লাগাতে সবেমাত্র হাত রেখেছিল শার্টের উপর। সাফারাতের শেষোক্ত উচ্চারিত বাক্য শুনে দু’হাত কেঁপে উঠল। সহসা ধরাস করে উঠল বুক,হৃদপিণ্ড। সরে যেতে নিলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সাফারাত। চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল,

‘ ডু ইট ফাস্ট। একটা কিছু বললেই লজ্জা আপনার। কই আমার লজ্জা হয় না কেন?’

চৈত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে বলে ইচ্ছে করল – ‘ আপনি তো বেহায়া। বেহায়াদের আবার কিসের লজ্জা?’
কিন্তু হায় বেচারি মুখ দিয়ে এই কথা বের করতে পারল না। এই বাক্য কন্ঠনালি গলিয়ে বেরিয়ে আসা মানে আজ আর রেহাই নেই। চুপচাপ বোতাম গুলো লাগিয়েও চৈত্রিকা সরে এলো না সাফারাতের নিকট হতে। সে বাঁধা পড়েছে পুরুষালি শরীরের ঘ্রাণে। সেই চেনা পরিচিত ঘ্রাণ। নিশ্চয়ই আজও সেই পারফিউম টা লাগিয়েছে সাফারাত। নেশা লেগে আসছে চৈত্রিকার। ইচ্ছে করছে সাফারাতের বুকে মুখ গুঁজে দিতে। মনটা বাঁধ মানছে না। সীমা অতিক্রম করতে চাইছে। অধরযুগল স্পর্শ করতে চাইছে প্রশস্ত বুক খানা। অতিশয়,অত্যাধিক আঁকুপাঁকু করছে হৃদয়স্থল,মন। সাফারাত একদৃষ্টে, তুখোড় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,

‘ নড়বেন না?আজ স্থির থাকবেন?পা ব্যাথা করবে তো। নাকি উম্মাদ করে তুলতে চাইছেন আমাকে এই মুহুর্তে। মাত্র ফ্রেশ হয়ে এলাম চৈত্র। শশুড় বাড়ি যেতে হবে। শালী সাহেবা ওয়েট করছেন। ইট ইজ নট রাইট টাইম। ‘

চৈত্রিকা দ্রুত গতিতে সরে গেল। লালের আস্তরণ, প্রলেপ পড়েছে দুই গালে। ও তো শুধু ঘ্রাণ নিচ্ছিল আর সাফারাত কি থেকে কি ভাবল?কিঞ্চিৎ দূরত্ব হলেও নাসারন্ধ্রে হুড়হুড় করে প্রবেশ করছে নেশা ধরানো সেই ঘ্রাণ। চৈত্রিকার ইচ্ছে জাগল একবার হলেও সেই পারফিউম টা ইউস করার। কিছু একটা মনে পড়তেই শঙ্কাভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ বাসায় কেন?মা,মিমু ঠিক আছে? ওদের কিছু হয় নি তো?’

ইতিমধ্যে বড় বড় শ্বাস ফেলা শুরু করেছে মেয়েটা অজানা ভয়ে। সাফারাতের হ্যাঁচকা টানে বুকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল ও। পেশিবহুল হাত জোড়া দিয়ে চৈত্রিকাকে নিজের বুকে শক্ত, কঠিনভাবে জড়িয়ে ধরল সাফারাত। হাসল ম্লান। লহু স্বরে বলে উঠল,
‘ রিলেক্স। আমি থাকতে কারো কিছু হবে না। আমার চৈত্র মাসের সকল অশান্তি, দুঃখ, সুখ, আপনজন সবকিছুই আমার। একান্তই আমার। আজ থেকে আপনি শুধু মিষ্টি করে মৃদু মৃদু হাসবেন চৈত্র। ঠিক আট বছর আগের সেই কলেজ জীবনের কিশোরী মেয়েটার মতো করে। ‘
চৈত্রিকা নিরবে,নিস্তব্ধ হয়ে মুখ গুঁজে রাখল সাফারাতের বুকে। হৃদস্পন্দন বিনা বাঁধায় শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছে যাচ্ছে। ভালোবাসার তীর হয়ে বর্শার ফলার ন্যায় বিঁধছে হৃদয়ের গহীনে।
______________

বাসায় এসে চৈত্রিকা স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু শোনার পর। বোন যে এভাবে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল চৈত্রিকা তা মোটেও আন্দাজ করতে পারে নি। দিহানের মা, ফাহমিদা, সাফারাত, দিহান বসে আছে সোফায়। টুকটাক কথা বার্তা বলছেন সবাই। খাবারের টেবিলের উপর উঁচু করে মিষ্টির প্যাকেট সাজানো। সাথে রসমালাই’ও। মিম অস্থির হয়ে পুরো ঘরময় পায়চারি করছে। পড়নে ওর কালো একটা রাউন্ড ড্রেস। চৈত্রিকা কোমরে এক হাত রেখে বললো,

‘ বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে। এতো অস্থির হবার কারণ? ‘
‘ উফ!আপু নার্ভাস হবো না?জীবনে প্রথমবার বিয়ে বলে কথা। ‘

মিমের কথা শুনে চৈত্রিকা বিস্তর হাসল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে মিম। বিয়ে একবারই হয়। আর সে কি-না অস্থির হয়ে কি বলে ফেলল। চৈত্রিকার মুখ দু’হাতে চেপে ধরে বলে,

‘ আপু হাসবে না একদম। ছোট বোনের সাথে জু/লুম করলে খারাপ হবে কিন্তু। বাই দ্যা ওয়ে আন্টি কথা বলেছে তোমার সাথে?’

‘ না। আমায় দেখে উনি হয়ত অনুশোচনায় ভুগবেন। ‘

‘ আমি কিন্তু উনার কাছে ভালো হতে পারব না আপু যতক্ষণ না উনি আমার বোনের কাছে সেদিনের জন্য মাফ চাইবেন। উনি কষ্ট দিয়েছেন তোমাকে। কথার আ’ঘা’ত যে হৃদয়ে ঠিক কতটুকু রক্তক্ষরণ করে আমি জানি আপু। ‘

‘ মিম বাদ দে। দিহান অনেকবার এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তাছাড়া উনি তোর হবু শাশুড়ি। এই ব্যাপারে মনে ক্ষোভ রাখিস না প্লিজ। মা’র কাছে বলেছেন আন্টি অনুতপ্ত নিজের সেদিনকার ব্যবহারে। প্লিজ তুই,, ‘

চৈত্রিকার গলায় কথা আঁটকে গেল মোবাইলের মেসেজ টিউন কর্ণে আসতেই। সাফারাত মেসেজ পাঠিয়েছে। এখান থেকে এখানে মেসেজ পাঠানোর ব্যাপারটা অদ্ভুত ও চিন্তিত ঠেকল চৈত্রিকার নিকট। ‘ ড্রইং রুমে আসুন চৈত্র। তাড়াতাড়ি আসবেন। ‘
মেসেজ টা পড়েই ইতস্ততভাবে ছুটে এল চৈত্রিকা। সাফারাত মোবাইল থেকে মুখ উঠিয়ে চৈত্রিকার দিকে তাকালো। সাথে তাকালো বাকি সকলে। দিহানের মা’কে সালাম দেয় চৈত্রিকা। সাফারাত সাথে সাথে দুর্বোধ্য হেসে দিহানের মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

‘ আন্টি মিট মাই ছাব্বিশ বছর বয়সী বউ চৈত্রিকা। ‘

চৈত্রিকা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চোখ বড় বড় করে তাকালো সাফারাতের দিকে। দিহানের মায়ের মুখ কালো আঁধারে ছেয়ে গেল নিমেষে। তবুও আলতো করে হাসলেন তিনি। ফাহমিদা হা করে তাকিয়ে রইলেন কেবল। সাফারাত এক বাক্যে সেদিনের কথাগুলোর চৈত্রিকাকে অপমানের জবাব দিয়ে দিল যেন। দিহান নত মস্তকে বিড়বিড় করে,
‘ শা’লা আমার মা’কেও ছাড় দিলি না। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)