সুখের নেশায় পর্ব-৪৮+৪৯

0
509

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪৮

মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হচ্ছে আজ সুদূর জার্মানিতে। চারটে লাগেজ টেনে বাহিরে নিয়ে গেল সার্ভেন্টরা। চৈত্রিকা আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো। ধীরস্থির চোখ বুলালো বাড়িটার চারদিকে। আনাচে-কানাচেতে, দেয়ালে নিজের গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বাড়িতে হইচই নেই। আছে কেবল নিস্তব্ধ, নীরবতা। এ যেন পরিণত হয়েছে এক মৃ’ত বাড়িতে। সুফিয়া বেগমের মৃ’ত্যুর প্রায় একটা মাস ফুরিয়ে এসেছে। বদলে গেছে সবকিছু। একেকটা সেকেন্ড ছিল পরিবর্তনের। উন্মোচিত হয়েছে অনেক অপ্রকাশিত সত্য, যা শুধু সীমাবদ্ধ চৈত্রিকা অবধি। মিনা কাঁদো কাঁদো মুখে দৌড়ে এলো। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। চৈত্রিকা হাত বাড়াতেই আহ্লাদে কেঁদে উঠল ও। জড়িয়ে ধরে বললো,

‘ একেবারে চলে যাইতেছেন ভাবী। আর আইবেন না?এত বড় বাড়িতে কেমনে থাকমু একা একা? মা’ও মই’রা গেল। শাস্তি পাইল নিজের পাপ কর্মের। চাচীও পাগল হইয়া গেছে। চাচা জেলে। ‘

‘ একেবারে যাচ্ছি কে বললো?আপাতত এমনি যাচ্ছি। হয়ত আবারও ফিরে আসব। চাচী কে নিয়ে এসেছেন উনারা?আর মৌসুমি ফুপি,জেরিন ওরা এসেছে? কাউকে দেখছি না যে?’

‘ চাচীরে ফুপু প্রিয়ন্তী আফার রুমে লইয়া গেছে। মাইয়াডা তো কথা কই না। যদি শেষ বেলা মা’র লগে কথা কইয়া দেশ ছাড়ে আরকি!এ বয়সে কি হইল আফার লগে?বাবা-মার পাপ কর্ম সন্তানের উপর দিয়া গেল। একটা গেল ম’ইরা। আরেকটা ধ*র্ষ’ণ হইল। ‘

চৈত্রিকার সারা মুখশ্রী মলিন বিবর্ণ হয়ে এলো। এমনিতেই যার জীবনে বসন্ত এলেও রং ছুঁয়ে দিতে পারে না,গায়ে আবির মাখিয়ে দিয়ে যেতে হয় অক্ষম তার জন্য বিবর্ণ তা-ই শ্রেয়। বাবা-মা’র অপকর্মের ফল কি-না জানে না চৈত্রিকা তবে খুবই অন্যায় হয়েছে প্রিয়ন্তীর সাথে। কারণ মেয়েটা সদ্য ফোঁটা কোমল,নিষ্পাপ একটা গোলাপ ছিল। মিনা কে ছেড়ে দিয়ে গুটি গুটি পায়ে প্রিয়ন্তীর রুমের সামনে আসল ও। দরজায় করাঘাত করতেই ভিতর থেকে আওয়াজ এলো –‘ কে?’
মৌসুমির গলা শুনে চৈত্রিকা ছোট্ট করে জবাব দিল–‘ আমি ফুপি।’
মৌসুমি দরজার এক পার্ট মেলে দিলেন। চৈত্রিকা ঘরে ঢুকেই দেখে প্রিয়ন্তী রেডি হয়ে জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। অপরদিকে ওর মা মেঝেতে বসে আঙ্গুল গুণছে,বিড়বিড় করছে। এগুলো এখন উনার নিত্যকার অভ্যেস। চৈত্রিকা সেদিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে প্রিয়ন্তীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকল ক্ষীণ স্বরে।

‘ প্রিয়ন্তী!’
প্রিয়ন্তী ফিরে তাকালো। ছোট্ট চঞ্চল মেয়েটা আজ নিস্তেজ। চোখের নিচে কাজল লেপ্টে আছে। এই কাজল ধুয়ে ফেললে উঠবে না। কবে উঠবে তা-ও জানা নেই। ভয়াবহ সেই দিনের পর হতে প্রতি রাতে নির্ঘুমের ফলস্বরূপ এই কাজল চোখের নিম্ন অংশের অনেকখানি জায়গা দখল করেছে। হালকা গোলাপি রঙের একটা হিজাব বেঁধেছে মেয়েটা। মিষ্টি লাগছে বেশ। গলার কাছে অজস্র দাগগুলো লুকায়িত হয়েছে। আলতো হাতে প্রিয়ন্তীর এক হাত আঁকড়ে ধরল চৈত্রিকা। রিনঝিনে কন্ঠ। জিজ্ঞেস করলো,

‘ তোমার মা’য়ের সাথে কথা বলেছো?’
প্রিয়ন্তী মৌন মুখে রইল। ঘাড় নাড়ালো। চৈত্রিকা মৃদু হেসে বললো,
‘ ঠিক আছে। কথা শেষ করে নিচে আসো। ফ্লাইটের সময় হয়ে যাবে। ‘
‘ ভাইয়া? ‘
‘ উনি অফিসের কাজগুলো গুছিয়ে আসছেন। রাস্তায় আছেন। ‘
‘ আচ্ছা। ‘

চৈত্রিকা নিজের রুমে ঢুকল। বিছানায় বসে নত মস্তকে সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়ল। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে একটা বার স্মরণ করে নিল বিগত একটা মাসের দিন গুলো। ঘটে যাওয়া একেকটা ঘটনা।
দাদির মৃ’ত্যু’র পনেরো দিনের মাথায় চাচা অবৈধ ব্যবসার কারণে গ্রেফতার হন। সিয়াকে মারার পিছনে উনার কোনো হাত নেই। কিন্তু তিনি ও পৃথক দু’জনে মিলে অবৈধ, মাদক/দ্রব্যের বিজনেস করতেন যার কারণে উনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এতে অবশ্য সাফারাতের হাত আছে। বহুদিন ধরে চাচার কর্ম সম্মুখে আনার চেষ্টা করছিল সে ও দিহান। পরিবারের ঝামেলায় সবাই এতটাই মগ্ন ছিল প্রিয়ন্তীর চলাচলের বিষয় টা নিয়ে মাথা ঘামায় নি কেউ। প্রিয়ন্তী খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যায়। যার ফলে জীবনের রঙ বিলীন হয়ে যায় পঞ্চদশেই। গোলাপের সকল পাপড়ি ঝরে পড়ে মৃত্তিকায়। গ্যাং রে*পড হয় মেয়েটা। সেই সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে তবুও প্রিয়ন্তী বাড়ি ফিরে নি। তখনই সর্বপ্রথম টনক নড়ে সাফারাতের। উম্মাদ,উদভ্রান্ত ছুটে যায় স্কুলে,কিন্তু সেখানেও গিয়ে দেখে স্কুল বন্ধ। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলে জানায় স্কুল সেই দুপুরেই ছুটি হয়ে গিয়েছে। পুরো শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ পর্যন্ত বিধস্ত, বস্ত্রহীন অবস্থায় মিলে প্রিয়ন্তীকে এক পরিত্যক্ত, জনপূর্ণহীন স্থানে। প্রিয়ন্তীর তখন শ্বাস চলছিল অল্প স্বল্প। সাফারাত সেদিনও কাঁদে নি। চাচী নিজের ছেলেমেয়ে,স্বামীর পরিণতি,পরিবারের বিচ্ছিন্নতা সইতে না পেরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। উনাকে বাড়িতে রাখা হয় না। ট্রিটমেন্টের জন্য মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চৈত্রিকা অবাক হয় সাফারাতকে দেখে যেই মানুষগুলো ওকে ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদেরই ট্রিটমেন্ট করাচ্ছে। মা’য়ের এক আদেশে, চাওয়ায় এত গুরুত্ব?

রুমে কারো পায়ের শব্দে চৈত্রিকার সকল ভাবনা দূর হয়ে গেল। কল্পনার, চিন্তার সুতোঁতে টান পড়ল। সাফারাত গায়ের জ্যাকেট খুলে এক নজর তাকালো চৈত্রিকার দিকে। চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অবলোকন করে উঠে আসতে নিলে সাফারাত গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

‘ আপনি বসুন চৈত্র। আমি আমার কাপড় বের করে নিব। প্রিয়ন্তী রেডি?’
‘ হুম। আপনার জন্য আমি লেবুর শরবত নিয়ে আসছি। বাহিরে গরম ছিল আজ। একটু পরেই আবারও জার্নি করতে হবে। ‘

সাফারাত হাতের তোয়ালে রেখে চৈত্রিকার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। গরমে ঘাম ঝরছে ললাট বেয়ে। চৈত্রিকার দু’হাতের ভাঁজে চুমু খেল। গাঢ়, গভীর ছিল উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া। দৈবাৎ কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ আপনি আমাকে খু*নি মানেন?’
ভড়কে গেল চৈত্রিকা। হকচকালো তৎক্ষনাৎ। বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। মাথা দুলিয়ে ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,
‘ না। আমি আপনার উপর সেদিন সন্দেহ করি নি। আপনার জায়গায় থাকলে আমি এর চেয়েও কঠিন হতাম। আরো কঠোর শা*স্তি দিতাম। আগুনে পুড়িয়ে মারতাম। যেমন করে পুড়েছিল সিয়া মা’র দেহ টা। ‘

সাফারাত তুখোড় দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো চৈত্রিকার চেহারার দিকে। দুই কপোল ফুলে আছে। চিকনচাকন গড়নের মেয়েটার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শরীরের পরিবর্তন হয়েছে। মোটা হয়েছে একটুখানি। গালে লালের আস্তরণ। সাফারাত সরব করে বলে উঠল,

‘ এত উত্তেজিত হবেন না। রক্তিম রূপে আপনাকে দারুণ লাগে চৈত্র মাস। তবে আমি যে চাই আমার সন্তান গম্ভীর হোক,শান্ত হোক। তাই আপনার রক্তিম হওয়া বারণ। ‘

চৈত্রিকা বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আরো একটা সাফারাত? না,না। এরকম গম্ভীর মানুষ আর সহ্য করতে পারবে না ও। এবার একটা চঞ্চল মানুষ আসুক। ওর বাচ্চা টা অস্থির,চঞ্চল স্বভাবের যেন হয়।
_______________

জার্মানির রাজধানী বার্লিন। বৃহত্তম একটা নগরী। হাজারো রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্রিকা ও প্রিয়ন্তী। এয়ারপোর্টে মানুষের সমাগম অত্যাধিক। তবে সবই দু’জন থেকে ভিন্ন। তাদের চেহারার গঠন,গায়ের রঙ,ড্রেসআপ, ধর্ম,ভাষা সবকিছুই ভিন্ন। তবে অচেনা এ দেশে চৈত্রিকার চেনা মানুষ বলতে এই মুহুর্তে শুধু সাফারাত ও প্রিয়ন্তী। এয়ারপোর্টের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। সাফারাত এই শহরেরই একজন পরিচিত জার্মান ড্রাইভারের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত।

জার্মানির আবহাওয়া পূর্বাভাস পাওয়া যায় না সহজে। প্রায়শই এখানে ঝরঝরে বৃষ্টি হয়। ঝড়ও হয়। এমনকি বজ্রধ্বনি সিজনের প্রারম্ভে ঘনঘন সংঘর্ষ হয়। এমনই এক পরিবেশ, আবহাওয়ার দেখা মিলছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে পিচ ঢালা রাস্তায়। ঠান্ডা,হিমেল হাওয়া বইছে। চৈত্রিকা গায়ের জ্যাকেট টা ভালো করে টেনে নিল। চেনা সুবাসে মুগ্ধ হয়ে গেল মন। গা থেকে খুলে অতি যত্নসহকারে প্রিয় মানুষ টা জড়িয়ে দিয় গেছে ওর অঙ্গে।

বাংলাদেশ ছেড়ে আসার মুহুর্তে চৈত্রিকার মনে হচ্ছিল মিম,মাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যে ব্যতিক্রম। তাদের নিজস্ব জীবন আছে,সংসার আছে। তবে সাফারাত বলেছে ফাহমিদাকে খুব শীগ্রই এখানে নিয়ে আসবে। সাফারাত এখানকার নাগরিকত্ব পেলেও চৈত্রিকা ও প্রিয়ন্তীর পাওয়া এখনও অনিশ্চিত। বিজনেস আগে থেকে এখানে সেট থাকায় সাফারাত আবারও এখানে ফিরে আসে। এখানে থেকেই বিজনেস সামলাবে। বাংলাদেশ ফিরে গেলেও সবসময় থাকার মন মানসিকতা আর নেই তার। চৈত্রিকাও চায় সাফারাত সকল প্রতা/রণা, কষ্ট ভুলে যাক। নতুন করে বাঁচুক। হয়ত এজন্যই এদেশে থাকার চিন্তা ভাবনা।

আলো বেগম, সিনথিয়া,আয়ান,আয়মান সবাই সুফিয়া বেগমের মৃ’ত্যুর পর পরই জার্মানি চলে আসে। আলো কাল রাতেও ফোন করেছিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো সাফারাত ফোন টা ধরতে দেয় নি। প্রথমে ব্যপক চমকায় চৈত্রিকা পরমুহূর্তে এটা শুনে খুশি হয় আলো জানেন না ওদের ফ্লাইট কবে, উনি হঠাৎ দেখলে সারপ্রাইজড হবেন।

সাফারাত ফিরে আসে গাড়ি নিয়ে। তবে তার পড়নের গেঞ্জি টা হালকা ভিজে গেছে বৃষ্টির ফোঁটায়। চুল লেপ্টে কপালে পড়ে আছে। চৈত্রিকার বুক টা ধ্বক করে উঠল। কি করে বুঝাবে সে এই পুরুষকে ঠিক কতটা মোহনীয় লাগছে এই অভ্যন্তর বেসামাল করা রূপে?প্রিয়ন্তী গাড়িতে বসে পড়লে সাফারাত চৈত্রিকাকে ইশারা করল বসতে। চৈত্রিকা বসল না। বরং বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শরীরের ওড়না টা খুলে সাফারাতের মাথায় দিয়ে দিল। কপালে ভাঁজ পড়ল সাফারাতের। ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি। চৈত্রিকা চারপাশে নজর বুলিয়ে চট করে গাড়িতে বসে পড়ল। গায়ে বড়সড় একটা জ্যাকেট থাকার কারণে ওড়নার প্রয়োজন নেই। জার্মানির এই বার্লিন শহরে এসে এক অজানা সুখে সিক্ত হয়ে পড়ল ওর মন, অন্তর। নিঃশ্বাস ফেলেও যেন শান্তি মিলছে। সাফারাত পাশে বসে সিটে মাথা রেখে চোখ বুঁজল। অনেক ধকল গেছে এই একটা মাস। চৈত্রিকার কাগজপত্র রেডি করা এবং শেষ সময়ে এসে প্রিয়ন্তীর ভিসা রেডি করতে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে।

প্রিয়ন্তী বাহিরের দিকে চেয়ে নতুন দেশ,নতুন পরিবেশ,বার্লিনের সৌন্দর্য দেখতে বিভোর,অন্তঃপ্রবিষ্ট। এই সুযোগ টা লুফে নিল চৈত্রিকা। সাফারাতের বুকে মাথা রাখল। চক্ষুদ্বয় বুঁজে রেখেই ওকে শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল সাফারাত। শ্রবণগ্রন্থির নিকটস্থে দু ঠোঁট ছুঁয়ে ফিচেল স্বরে বললো,

‘ নতুন দেশে রোমাঞ্চকর হাওয়া লেগেছে?আহ্!এখন তো আমার লাভ-ই লাভ। ডজন ডজন বাচ্চার বাপ হবো। জার্মানির চ্যান্সেলর আমাকে এওয়ার্ড দিবেন ডজন বাচ্চা-কাচ্চার বাপ হওয়ার জন্য। ‘

চৈত্রিকার কর্ণ গহ্বর গরম,তপ্ত হয়ে আসলো। রাঙা হয়ে উঠল মুখ। তবুও সাফারাতের বুকে মাথা রেখে উপলব্ধি করতে থাকে এক আকাশ সমান সুখ।
______________

জনবহুল শহুরে এলাকা হলেও গাড়ি টা এমন একটা বাড়ির সামনে থামল যেখানে আশেপাশে মাত্র দু’টো বাড়ি। তাছাড়া খোলা রাস্তা ছাড়া কিছুই নেই। চৈত্রিকা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সামনের দিকে দৃষ্টি মেলতেই দেখে সিনথিয়া, আলো,আয়মান ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসছে। আয়মান মাঝ পথেই দৌড় দিল। ঝাপটে ধরল চৈত্রিকাকে। হঠাৎ আক্রমণে চৈত্রিকা বেসামাল হয়ে পড়ে যেতে নিলে আঁতকে উঠে সকলে। আতংকিত চোখে তাকায়। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সাফারাত পিছন থেকে চৈত্রিকাকে জড়িয়ে ধরলো। আয়মান অপরাধী দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সিনথিয়া অনবরত বকছে ওকে। চুপচাপ গম্ভীর মুখে ছেলেটা মা’য়ের বকবকানি হজম করছে নয়ত বা এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছে অপর কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। আলো চৈত্রিকার কপালে চুমু খেল। খুশিতে কেঁদে দিলেন উনি। আয়মানের মাথায় হাত বুলিয়ে চৈত্রিকা আদুরে কন্ঠে বললো,

‘ চলো আয়মান। ‘

আয়মান এক পাও নড়লো না। সাফারাত ওর চুলে আঙ্গুল চালনা করলো। মায়াময় কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ কি হলো স্মার্ট বয়?মামি মণি ব্যাথা পায় নি। তাহলে আপসেট কেন?মাম্মা বকেছে বলে?’
আয়মান শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
‘ নো। আমার কারণে সুখ ব্যাথা পেতে যাচ্ছিল তাই। ‘
চৈত্রিকা,প্রিয়ন্তী, সাফারাত অবাক চাহনি নিক্ষেপ করলো। আলো বেগম আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ সুখ?সে কে?’
আয়মান ব্যথিত চক্ষে তাকালো। কন্ঠনালিতে গম্ভীরতার ছাপ রেখেই প্রতুত্তর করে,
‘ মামি মণির পেটে যে আছে তার নাম-ই তো সুখ। মাম্মা বলেছে ও আমার সুখ। তাই আমি ওকে সুখ বলে ডাকব। ‘

সিনথিয়া জিভ কাটল। ছেলে ওকে এভাবে ফাঁসিয়ে দিবে ভাবতেই পারে নি। এত গম্ভীর, বজ্জাত ছেলে ওর পেটে কেমনে হলো!সাফারাত শান্ত শিষ্ট আয়মানের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ছেলে হবে নাকি মেয়ে তা জানা হলো না,তার আগেই তুমি সুখে ভাগ বসিয়ে দিলে স্মার্ট বয়। নামটা পছন্দ হয়েছে। আসলেই ও সুখ নিয়েই আসবে এই ধরণীতে। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪৯

আয়ানদের বাড়িটা দু’তলা। বাড়ির একপাশে ছোট খাটো একটা প্রাচীর। উচ্চতায় অনেক কম। প্রাচীরের অপর পাশে আরেকটা দু’তলা বাড়ি। এখান থেকে স্বল্প উচ্চতার সেই দেয়াল ডিঙিয়ে চলে যাওয়া যাবে অনায়সে। এমনকি দু’টো মানুষ মাথা উঁচিয়ে কথা বলতে পারবে একে অপরের সাথে। চৈত্রিকা সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাগানের দিকে তাকালো। বড় একটা দোলনা টানানো বাগানে,যা বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাচ্ছে। তারই উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা চেরি গাছ। আপাতত পুষ্পহীনতায় ভুগছে গাছ টা। মূলত গাছের পাতা বেয়ে পানি এসে ঝরে পড়ছে শূণ্য দোলনা টায়। চৈত্রিকার বেশ মন কাড়লো দৃশ্য টা। মনপাজর জুড়িয়ে গেল। জার্মানির এই বৃষ্টি যেন চৈত্র মাসের খরা কাটিয়ে তুমুল সুখের বন্যা সৃষ্টি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সাফারাতের এক হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ চৈত্রিকার এক হাত। দু’জনে এগিয়ে চলেছে সমান তালে। ক্ষীণ সময় পর পর চৈত্রিকা সাফারাতের বুকের কাছ থেকে সরে দৃষ্টি বুলাচ্ছে আশেপাশে। এই মুহুর্তের পরিবেশ টা ভয়ংকর, মারাত্মক।

সবার সাথে বাড়ির মধ্যে ঢুকল ওরা। প্রথমেই চৈত্রিকার নজর গিয়ে ঠেকে ড্রইং রুমের বিশাল দেয়ালের একাংশ জুড়ে বড় এক ফ্রেমে বন্দী সুঠাম দেহের, সুদর্শন এক যুবকের ছবির দিকে। চৈত্রিকার বুক টা তরতর করে কাঁপলো। হৃদয় নাড়ানো অনুভূতি হলো বুঝি!ছবিতে সাফারাত যেন ঠিক ওর দিকেই চেয়ে আছে। কে বলবে এটা ওর খালামণির বাড়ি?এ যেন সাফারাতেরই নিজস্ব বাড়ি৷ সত্যি অনুভূতি টা বেশ আপন আপন। চৈত্রিকার কোনো খালা নেই, আলোকে দেখলে ওর মনে হয় সাফারাত এদিক থেকে লাকি। ভীষণ লাকি। আলো বেগমের মাঝে সিয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় চৈত্রিকা,যদিও সে সিয়াকে দেখে নি। আচ্ছা সাফারাতও কি ওর মতো করে মা’য়ের প্রতিচ্ছবি, মা মা গন্ধ খুঁজে পায় ওদের সামনে চোখ আনন্দপূর্ণ অশ্রু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আধবয়স্ক মহিলাটা কে দেখে?হয়ত পায়।

দীর্ঘ ভ্রমণ প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় বেশ কষ্টজনক ছিল চৈত্রিকার ক্ষেত্রে। সাফারাত ওকে সোফায় বসিয়ে দিল। বছর খানেক আগে যখন সিনথিয়াকে নিয়ে আসে এখানে তখন তার জন্য একটা রুম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যে রুমের প্রত্যেক টা আসবাব, জিনিস আলো নিজ হাতে সাজিয়েছেন। নির্দিষ্ট সেই রুমে জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে সাফারাতের। পার্থক্য এতকাল সেই কক্ষে একা থাকত,এখন থেকে ওর জীবনের দ্বিতীয় নারী থাকবে। রুমের অর্ধাংশ দখল করে রাজত্ব চালাবে। একটা মেয়ে সার্ভেন্ট এগিয়ে এলো। চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকালো চৈত্রিকা। পড়নে হাটুর নিচ অব্দি স্কার্ট,উপরের অংশে শার্ট। সাদা ধবধবে পায়ের উন্মুক্ত অংশ। চেহারার আকৃতিও বেশ সুন্দর। চুলগুলো কালো রঙের। চৈত্রিকা বুঝতে পারে অপরুপ সুন্দর মেয়েটা জার্মানির স্থায়ী বাসিন্দা। আলো বেগম আদেশ করলেন মেয়েটা কে লাগেজ গুলো রুমে পাঠাতে। মেয়েটা ইয়েস ম্যাম বলে লাগেজ গুলো টেনে নিয়ে যায়। অতি সূক্ষ্ম এবং মিহি ছিল সেই কন্ঠস্বর। মেয়েটার নাম টা স্পষ্ট শুনে নি চৈত্রিকা। হয়ত শুনেছে কিন্তু এরকম নাম শুনতে কিংবা উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত নয় বলে ঠিক মনে করতে পারছে না। ‘ ক্যাথরিন’ ছিল বোধ হয় নাম টা।

ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত হওয়ার কারণে চৈত্রিকাকে নিয়ে রুমে এলো সিনথিয়া। ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। বার্লিন শহরে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। ঘড়িতে তখন ৬.৪৭। চৈত্রিকা লাগেজ থেকে একটা ড্রেস নিয়ে গোসল সেড়ে এলো। রুমে আসতেই দেখে সাফারাত ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে আছে বিছানায় সটানভাবে। হয়ত ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। চুল থেকে তোয়ালে সরিয়ে চেয়ারের উপর মেলে দিল। সাফারাত দুই চোখ বুঁজে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। চৈত্রিকা খানিক উঁচু পেট টা নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে পাশে বসল। সাফারাতের মুখের দিকে চেয়ে থাকল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। কি সুন্দর এই মানুষ টা!এতো মায়াময় মানুষটার জীবন কেন এত বিষাক্ত ছিল?চৈত্রিকা হাত উঠালো চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পরক্ষণেই সাফারাত বিরক্ত হয় যদি তা ভেবে সরিয়ে আনল। পাশ থেকে উঠতে নিলে সুড়সুড় করে কর্ণগহ্বরে পৌঁছাল,

‘ চৈত্র উঠছেন কেন?’

ব্যস আর উঠা হলো না। এক বাক্যে সারা অঙ্গ স্থির। সাফারাত চক্ষু মেলল,তবে শোয়া হতে উঠল না। বরং চৈত্রিকার এক হাত টেনে সম্পূর্ণ দেহ টা বুকের উপর এনে জড়িয়ে ধরল ওকে। হঠাৎ কান্ডে চৈত্রিকার হৃদস্পন্দন চক্রাকারে বৃদ্ধি পেয়ে গেল যেন। নিঃশ্বাস কেমন থমকে গেল। বুকে উথাল-পাথাল ঢেউ গর্জে উঠল। এক গাছি ভেজা চুল সাফারাতের নাকের কাছে গিয়ে ঠেকল। প্রাণ, মন ভরে সেই ভেজা সিক্ত ঘ্রাণ নাসারন্ধ্র দ্বারা টেনে নিতে শুরু করে সাফারাত। চৈত্রিকার কোমর জরিয়ে ধরে খুবই আলতো বাঁধনে।
চৈত্রিকা হতবাক, বিস্মিত নেত্রে চেয়ে রইল। হুট করেই, সেকেন্ডের ব্যবধানেই ওর সেই চাউনি বদলে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। পরিণত হয় লজ্জিত দৃষ্টিতে। সাফারাত মাদকময় চাহনিতে চেয়ে আছে। দু চক্ষে নেশা। কন্ঠ গাঢ়,শীতল। বলল,

‘ ভালো আছেন আপনারা?’

চৈত্রিকা তব্দা খেয়ে গেল। হুটহাট এই এক প্রশ্ন কাঁপিয়ে তুলে ওকে। প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। বলতে ইচ্ছে করে এভাবে জিজ্ঞেস করলে খারাপ থাকা যায়?উল্টো বুকে ঢোল বাজে। ছোট্ট করে বললো,

‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
এটুকু বলে থামল। ক্ষীণ সময় পরে জিজ্ঞেস করে উঠল,
‘ আপনার কি ক্লান্তি লাগছে?’
সাফারাত ঠোঁটের কোণ বাঁকালো। টুপ করে গালে চুমু খেয়ে বলে,

‘ ছিলাম। আপনার শরীরের স্পর্শ, ঘ্রাণ, আপনার মিষ্টি প্রশ্ন, কন্ঠস্বর,স্নিগ্ধ চেহারা,আপনি সবকিছু আমার সকল ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে। নিজেকে স্ট্রং স্ট্রং ফিল হচ্ছে। আপনি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেন না চৈত্র। আপনার ঘ্রাণ, স্পর্শ, আপনি না থাকলে এই পৃথিবীতে থাকার জন্য কোনো কারণ থাকবে না আমার নিকট। থাকতে পারব না আপনাকে ছাড়া। ‘

চৈত্রিকা দু হাতে ঝাপটে ধরল সাফারাতকে। শক্ত করে। সাফারাত মাথায় ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বলে উঠল,

‘ কি করছেন?আমাকে এতো জোরে জড়িয়ে ধরলে সুখ ব্যাথা পাবে তো। ‘
বুক থেকে মুখ তুলে চোখের পল্লব ঝাঁকিয়ে মিটমিট করে চাইল চৈত্রিকা সাফারাতের হাসোজ্জল মুখের দিকে। হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করে বসল,
‘ আপনিও আয়মানের মতো বলছেন?’
‘ হু। সুখ তো। সুখকে আপনি দুঃখ দিতে চান?’
চৈত্রিকা এক গাল হেসে বললো,
‘ সুখ কে কখনও দুঃখ দেওয়া যায় না। ‘
‘ আচ্ছা সুখের আম্মুকে আদর করা যায়?’
লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল চৈত্রিকা। মাথা উপর নিচ করে বললো,
‘ নির্দ্বিধায় করা যায়। ‘
‘ নির্দ্বিধায় করি সবসময়। তাই বলেই তো সুখ এ পৃথিবীতে আসার ভিসা পেয়ে গেল। অধৈর্য হয়েছি,আদরে কিপ্টামি করি নি। ‘

চৈত্রিকা আর মুখ তুলতে পারল না। নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল শক্তপোক্ত প্রশস্ত বুক টায়। লুকিয়ে রাখল লাল মুখশ্রী।
________________

গতকাল পুরো একটা বৃষ্টিমুখর দিন,রাত পার হবার পর একটা সুন্দর সকালের দেখা মিলে বার্লিন নগরীতে। চৈত্রিকা বিছানা ছেড়ে রুমের একপাশে দেয়ালের পরিবর্তে দেয়া বড় কাঁচ টার সমুখে এসে দাঁড়াল। এখনও কাঁচে পানি লেগে আছে। গত রাতে আয়ান ও আলো বেগমের হাসবেন্ডের সাথে দেখা হয় ডিনার টাইমে। রাতে আলো বেগম নিজ হাতে ওদের জন্য কয়েক ধরনের বাঙালি খাবার রান্না করে। সবাই তৃপ্তি করে খেলেও চৈত্রিকা একটা বিষয় খেয়াল করে। অন্য কেউ করেছে কি-না জানে না। তবে সাফারাত আলো বেগমের রান্না করা একটা জিনিসও খায় নি। সিনথিয়া ডাল রান্না করেছিল সেটাই খেয়েছিল শুধু। আলো বেগম,খালু,আয়ান অনেক সাধলেও সাফারাত জানায় তার শুধু এখন ডাল দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে,কোনো প্রকার ভারী খাবার খেতে চাচ্ছে না। আলো বেগমের একটু মন খারাপ হয়েছে তা ওনার মুখ দেখেই চৈত্রিকা বুঝে ফেলে। কিন্তু সবার সামনে সাফারাতের মুখের উপর কিছু বলতে পারছিল না। হয়ত সত্যিই শরীর খারাপ লাগছিল তার। সন্ধ্যে হতেই তো ক্লান্ত ছিল।

বিশাল কাঁচে একটা অবয়ব দেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল চৈত্রিকা। পিছন হতে এক জোড়া ঠোঁট উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিল ওর কানে। নিমিষেই চোখ বুঁজে আসল। কন্ঠনালির ঠিক বা পাশে দীর্ঘ,গভীর চুমু খেয়ে বলে উঠল সাফারাত,

‘ রেডি হয়ে নিন। প্রিয়ন্তীকেও বলুন। আমরা বের হবো। ব্রেকফাস্ট বাহিরে করবো। ‘

চৈত্রিকার কন্ঠে অবাকতার দেখা মিলে,– ‘ কোথায় যাবো?’
সাফারাত কাঁচের দেয়ালের উপর রাখা চৈত্রিকার হাত টার উপর হাত রাখে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
‘ সুখের আম্মার জন্য সারপ্রাইজ আছে। ‘
নিরবে হাসল চৈত্রিকা। মনে মনে আওড়ালো,– ‘ সাফারাতের চৈত্র মাস, সুখের আম্মা। উফ!এত সুখ! ‘
_______________

বড় একটা রাউন্ড ড্রেস পড়েছে চৈত্রিকা। গলায় স্কার্ফ পেঁচানো। পাশেই প্রিয়ন্তী হাঁটছে। মেয়েটা আজকাল কথা বলে না। প্রয়োজনে দু ঠোঁট আলগা হয় ওর। সাফারাত গাড়ি পার্ক করে ওদের পাশে এসে হাঁটতে থাকে। গাড়িটা ওর নিজের। এদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তার। অফিসের কাজও আবার স্টার্ট হয়ে গিয়েছে। হাঁটার তালে তালে সে নিরব প্রিয়ন্তীর হাত টা ধরল। প্রিয়ন্তী ভাইয়ের স্পর্শে চমকালো না। সাফারাত ওর জীবনে যে সুখ আনার চেষ্টা করছে ও তা ভালো করে বুঝতে পারছে। যার সাথে বাবা- মা এত অন্যায় করেছে সেই মানুষ টা কি সুন্দর আগলে রাখছে ওকে। সমাজের তুচ্ছ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়েছে। মৃ*ত্যু না বেছে লড়াই করতে শিখিয়েছে। প্রিয়ন্তী জানে বাবা-মার সাফারাতের উপর করা অত্যাচারের কথা। কম বয়সে মেয়েটা জীবনের সকল ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। চঞ্চলতা ভুলে গুমরে জীবনযাপন করা শিখেছে। তবুও ভাই নামক মানুষটার জন্য, তার দিকে চেয়ে হাসল সে মৃদু। চৈত্রিকার হৃদয় জুড়িয়ে গেল ওদের দেখে। জার্মানির বাতাসে বাতাসে সুখ মিশে আছে কি!নয়ত এত শান্তি অনুূভূত হচ্ছে কেন!

আজ বৃষ্টি নেই, পরিবেশ আদ্র। ওরা এসেছে বার্লিন প্রাসাদ ও পার্কে। বার্লিনে মূলত তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো এ জায়গাটা। চৈত্রিকা অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছে। একপাশে ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে। চৈত্রিকার মনে হলো,ইশ!আয়মানকে নিয়ে আসলে ভালো হতো। এই বৈচিত্র্যময় দেশে চৈত্রিকার বৈচিত্র্যময় মনে হয় এদেশের মানুষগুলো কে। অকস্মাৎ একটা সাদা চামড়ার,ব্রাউন চুলের ছেলে সাফারাতকে জড়িয়ে ধরল। হতভম্ব হয়ে পড়ল চৈত্রিকা ও প্রিয়ন্তী দু’জনেই। কিন্তু সাফারাতের অভিব্যক্তি বুঝা গেল না। ছেলেটাকে ওকে ছেড়ে দিয়ে ইংরেজিতে গটগট করে বললো,
‘ হাউ আর ইউ শাফারাত?’
সাফারাত চোখ রাঙালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ ফাইন। এন্ড শাফারাত নই ইট’স সাফারাত। ‘
‘ হ্যাঁ। ইয়াহ!শাফারাত। ‘
সাফারাত সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়ল। একে বুঝিয়ে লাভ নেই। ছেলেটা চৈত্রিকার চমকপ্রদ দৃষ্টি দেখে সাফারাতের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
‘ হু ইজ শি?’
সাফারাত চৈত্রিকাকে দেখিয়ে বললো,
‘ শি ইজ মাই ওয়াইফ,চৈত্রিকা এহমাদ। ‘
চৈত্রিকা ছেলেটাকে সালাম দিল। নিমেষে ছেলেটা ওকে অবাক করে দিয়ে বললো,
‘ ওয়ালাইকুমুস সালাম৷ আমি ফাইয়াদ। সাফারাত ও আমি একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। ‘
প্রিয়ন্তী ও চৈত্রিকা উভয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পাক্কা বিদেশি, সাদা চামড়াওয়ালা ছেলেটা কেমন শুদ্ধ বাংলা ভাষা উচ্চারণ করছে। একটু আগেই তো সে ইংরেজি বলছিল,সাফারাতের নামটা বিগড়ে দিয়েছিল। চৈত্রিকার মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এলো,
‘ আপনি বাংলা বলতে পারেন?’
‘ হুম। আমার বাবা বেঙ্গলি। মা জার্মানির হলেও শকের বশে বাংলা শিকেছি। আপনার হাসবেন্ডই শিকিয়েছে। ভালোভাবে বলতে পারি না। ‘
প্রিয়ন্তী মুখ চেপে হাসল ‘শক’ শব্দ শুনে। শক,শিকেছি বাহ্ কি দারুণ শব্দ জার্মানি পোলার মুখে। প্রিয়ন্তীর এরকম কথা শুনলে হাসতে হাসতেই কেঁদে দিবে মনে হচ্ছে। চৈত্রিকার হাসি পেলেও বললো,
‘ আপনি অনেক সুন্দর বাংলা বলেন ভাইয়া। ‘
ফাইয়াদ মাথা চুলকে বলে,–‘ ধন্যবাদ। ‘

সাফারাত থেকে চোখ সরিয়ে ফাইয়াদ অপর পাশে তাকাতেই দেখে ফর্সা, কম বয়সী একটা মেয়ে মুখ চেপে হাসছে। আবার হাত সরিয়ে ঠোঁট দুটো চেপে ধরছে হাসি আটকাতে। ফাইয়াদ থমকে যায়। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে হাসিমাখা মুখ খানায়। সাফারাত প্রিয়ন্তীকে দেখিয়ে বললো,
‘ আমার বোন,প্রিয়ন্তী। ‘
ফাইয়াদ হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করতে। প্রিয়ন্তী ভাইয়ের দিক তাকালো। সাফারাতের সম্মতি পেয়ে হাত মিলিয়ে দিল ফাইয়াদের হাতে। ফাইয়াদ হাসল। স্মিত সেই হাসি। বলল,
‘ ওয়েলকাম প্রিয়ন। ওয়েলকাম ইন আওয়ার কান্ট্রি। ‘
প্রিয়ন্তী ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। হাত টা ছাড়িয়ে নিল ঝটপট। মনে মনে রাগে আওড়ালো, –‘ জার্মানির বাচ্চা, আমি প্রিয়ন না প্রিয়ন্তী। ‘

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর যা রহস্য বাকি আছে আমি পরবর্তী পর্বগুলোতে ক্লিয়ার করে দিব।)