#সুখের_পাখি
৫৭
পেছন থেকে কারো আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আহান হকচকিয়ে গেল। নরম কোমল দু’টা হাত শক্ত করে ওকে ধরে আছে। আহান পেছন ফিরতে গিয়েও পারল না। কে হতে পারে এটা ভেবেই আহান দিশেহারা। সে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
–‘কে? এসবের মানে কি?’
তনু স্তম্ভিত হয়ে গেল। এটা তো ইহান ভাইয়ের গলা না। কে তাহলে এটা! সে ইহান ভাই ভেবে কাকে জড়িয়ে ধরে আছে? তনু সাথে সাথে মানুষটাকে ছেড়ে দিল। বুক ধড়ফড় করছে তার। বাড়ি ফিরেই এ কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে ও! আহান তনুকে দেখেই চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
–‘তনু! তুমি?’
তনু এই লোককে কোনোদিনও দেখেনি। কিন্তু লোকটা তার নাম জানে! তাকে চেনে নাকি?
তনুর এখন কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না সে।
তনুর ভাগ্য ওর এতটাই সহায়, ওকে অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে নেওয়ার জন্য একটা ফন্দি এঁটেছে। তনু কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময় ওর পা ঘেঁষে একটা ইঁদুর দৌড় দিল। তনু এক মুহূর্তের জন্য ইঁদুরটাকে দেখে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল।
–‘ইঁদুর! ইঁদুর! ওরে বাবা রে! কত বড় ইঁদুর!’
আহানও ওটাকে দেখেছে। তার চোখ তনুর উপর পড়তে হেসে ফেলল সে। মেয়েটা একটা ইঁদুর দেখে ওভাবে ভয় পেয়েছে! আহান আরও কী না কি ভেবে বসেছিল। হাসতে হাসতেই ও বলল,
–‘ইঁদুর দেখে ভয় পেয়েছ তুমি?’
ভয় না কাটলেও তনু বুঝল এই যাত্রায় বেঁচে যাওয়ার এটাই একমাত্র পথ। তনু ভেবেছিল এটা ইহান ভাই। ওর জায়গায় যে অন্য কেউ থাকবে কল্পনাও করেনি তনু। একটু আগের কথা মনে করতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর।
ইঁদুরটা ঠিক সময় এসে ওকে বাঁচিয়ে দেওয়ায় মনে মনে ইঁদুরের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ দিচ্ছে তনু। নইলে তার যে কী হতো! আল্লাহই জানেন।
–‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই তো ইঁদুর। আমার ভীষণ ভয় লাগে। ওটাকে সরান।’
আহান হাসতে হাসতেই বলল।
–‘আরে পাগল ওটা কিছু করবে না। শুধু শুধু বেচারাকে ভয় পাইয়ে দিলে তুমি।’
তনু এখনও আহানকে চিনতে পারেনি। চিনবে কীভাবে? ও কি কখনও আহানকে দেখেছে!
আহানই বলল,
–‘কখন এলে তুমি? আজ আসবে মা আমাকে বলেনি তো!’
মা! তার মানে এটা আহান ভাই! ফুপু আম্মার কাছে শুনেছিল তার যাওয়ার কয়েকদিন পরই আহান ভাই ফিরে এসেছে। এ কথাটা তনুর মনেই ছিল না। ইহান ভাই ছাড়াও আহান ভাইও যে বাড়িতে আছে এটা খেয়ালই ছিল না। নইলে আজ এই ঘটনা ঘটত না।
আহান ভাই যদি ফুপু আম্মাকে বলে দেয়! ইহান ভাই জানলে মেরেই ফেলবে তাকে। কোনটা ভালোবাসার মানুষ, কোনটা তার ভাই এটাও চিনলো না গাধী।
ইশশ! কী ভয়ংকর কেলেঙ্কারির হাত থেকে বেঁচে গেছে ও। তনুর মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো।
–‘আপনি আহান ভাই!’
–‘হুম। আমাকে চিনো না তুমি?’
তনু তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,
–‘চিনি।’
–‘আমিও তোমাকে প্রথম দেখাতেই চিনেছি। আমি এখানে আছি মা বলেছে তোমাকে?’
–‘হু।’
–‘ঘরটা অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল। তাই ভাবলাম একটু দেখে আসি। এখানে এসে দেখি এটা এখন ইঁদুর তেলাপোকার বাসা। দেখলে না ওরা কেমন বিরক্ত হয়ে ছুটাছুটি শুরু করে দিয়েছে।’
ইহান ভাইয়ের ঘর ইঁদুর তেলাপোকার বাসা! কথাটা ভাবতেও তনুর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেন? ইহান ভাই কি এখন এই ঘরে থাকে না? এই ঘরে ইহান ভাইকে নিয়ে ওর কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রথম দিন ইহান ভাইয়ের সাথে ভাব জমাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিল। দৌড়ে যাবার সময় দরজায় মাথা ঠুকে গিয়েছিল। ইহান ভাই এখানেই তাকে পড়াত। ইহান ভাই না থাকলে তনু ঘন্টার পর ঘন্টা এ ঘরে এসে কাটিয়ে দিত। আজ এই ঘরের এরকম হাল দেখতেও বুকে খোঁচা লাগছে। জিনিসপত্রে ধুলোর প্রলেপ পড়ে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের বসবাস নেই। দরজা, জানালা বন্ধ থাকায় ভেতরে আলো বাতাস আসতে পারছে না। যার কারণে একটা গুমট ভাব ঘরটাতে ছেয়ে আছে।
–‘তুমি কি মাত্রই ফিরেছ তনু?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘অহো, তাহলে এখানে চলে এলে কেন? আমি কি নিচে যেতাম না! বুঝেছি, তুমি তো আমাকে কোনোদিনও দেখোনি। তাই একটু বেশিই এক্সাইটেড ছিলে। চলো, চলো। নয়তো ইঁদুরটা আবার চলে আসবে। এসো, দরজায় তালা দিয়ে দেই।’
পাঁচ বছর পর ফিরে এই বাড়ির কোনোকিছুই তনুর মাথায় ঢুকছে না। সবকিছু এরকম অচেনা হয়ে গেল কীভাবে? ইহান ভাই ঘরেও নেই। এখানেও থাকে না। তাহলে কোথায় গেল ও। আহান ভাই তার ওই কাণ্ডে কিছু মনে করেনি তো?
খেতে বসে তনু ফুপুর থেকে এক এক করে অনেক কথাই জানতে পারল। আহান ভাইও তার সাথেই খেতে বসেছে। তনু ভেতরে ভেতরে ভয়ে, লজ্জায়, অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। আহান ভাই ভদ্র মানুষ বলে ওরকম কিছু ঘটনার পরও নিরুত্তাপ রয়েছে। ফুলি আপার বিয়ে হয়ে গেছে এটা তনু জানত। কিন্তু ইহান ভাই যে এতবড় সিঙ্গার হয়ে গেছে এটা তার জানা ছিল না। বাড়ির সামনে প্রেস, গার্ড ইহান ভাইয়ের জন্য শুনে তনুর মাথা চক্কর দিল। এয়ারপোর্টে শান্তি এরকম কিছুই বলছিল। তখন তনু বুঝেনি। ইহান ভাই যে শুধু স্বপ্নই দেখত তেমনটা না। সে এখন সাফল্যের সাথে তার স্বপ্নের পথে হাঁটছে। ইহান ভাইকে দেখার জন্য তনু মনে মনে উতলা হচ্ছিল।
ইহান কক্সবাজারে কনসার্ট শেষ করে সে রাতেই ঢাকাগামী প্লেন ধরে। হারুন চিন্তিত। স্যার যেখানেই প্রোগ্রাম করুক, প্রোগ্রাম শেষ করে একটা দিন ওখানেই রেস্ট নেয়। আজ কী এমন হলো যে শো শেষ করেই ঢাকা ফেরার জন্য পাগল হয়ে গেল। এয়ারপোর্টে নেমে হারুন প্রথম কথা বলল,
–‘স্যার, কিছু কি হয়েছে?’
–‘কী হবে?’
–‘কিছু না। সরি স্যার।’
–‘হারুন কথায় কথায় সরি বলার জন্য আমি তোমাকে একদিন সত্যিই শাস্তি দিব।’
–‘স… বলতে গিয়েও থেমে গেল হারুন। ইহান বলল,
–‘যেভাবে পারো মিডিয়ার নজর এড়িয়ে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও।’
–‘আজ সমস্যা হবে না স্যার। কেউ জানে না আপনি আজ ফিরবেন।’
–‘তুমি ওই বেহায়া মৌমাছি গুলোকে চেনো না।’
সাবধানের মার নেই। ইহান মুখ লুকিয়ে গাড়িতে এসে বসল। হারুন জানতে চাইল,
–‘কোন বাসায় যাবেন স্যার?’
–‘যেখানে সবা… না। আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে চলো।’
–‘আপনি তো বলেছিলেন এবার ফিরে বাড়ি উঠবেন।’
–‘আজ না।’
হারুন আর কোন কথা বলল না। আজ কেন নয়? এই কথা জিজ্ঞেস করার সাহস তার নেই।
ইহান ভাই এই বাড়িতে থাকে না শুনে তনুর মন ভেঙে গেল। ইহান ভাই তাহলে অনেকটাই পাল্টেছে। নিজের বাড়ি ছাড়া থাকতে পারত না ও। ফুপু আম্মার রান্না ছাড়া অন্য কারো রান্না খেতে পারত না। এই বাড়িটা আগের মত নেই। আগের সেই প্রাণোচ্ছল পরিবেশ এখন প্রাণহীন হয়ে গেছে। ফুপু আম্মা হাতের সবকাজ শেষ করে তনুর সাথে গল্প করতে এসেছে।
–‘এতদিন বিদেশ ছিলি। ওখানে কোনো ছেলের সাথে কিছু হয়নি? কাউকে তোর পছন্দ হয়নি?’
তনু হেসে ফেলল। সে যদি বলতে পারত, আমার পছন্দ তো এখানেই ফেলে গিয়েছিলাম।
–‘উঁহু। ওসব সাদা চামড়ার ছেলেগুলো বয়ফ্রেন্ড হিসেবে মোটেও সুবিধার না।’
–‘ইশ, আমি আরও চিন্তায় মরি। ছেলেমেয়ে বড় হলে কি আর বাপ মা’র কথা শুনে। আমি তো ভেবেই বসেছিলাম, তুই কোনো সাদা চামড়াকেই বিয়ে করবি। যাক, বাঁচালি তুই আমাকে। আমি তোর জন্য মনের মত বর আনব।’
–‘ফুপু আম্মা, আমি যাওয়ার পরেই তো আহান ভাই এসেছে। ওকে এখনও বিয়ে করাওনি কেন?’
সাবিনা উদাস গলায় বলল,
–‘চেষ্টা কি কম করেছি? আমার ছেলেরা বিয়েশাদি করবে না। ওদের সংসার দেখে আমি মরতে পারব না।’
তনু জানত ইহান ভাই তার পরে আর কাউকে ভালোবাসবে না। এমনটাই তো কথা দিয়েছিল সে।
পরের দিনেও ইহান বাড়ি ফিরল না। এদিকে তনুর ধৈর্য শেষ হয়ে এসেছে। সে ফুপুকে বাহানা দিয়ে ইহানের সাথে দেখা করার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ছলেবলে ইহান ভাইয়ের ফ্ল্যাটের ঠিকানা জেনে নিয়েছে তনু। সে সিএনজি নিয়ে ইহানের ফ্ল্যাটের সামনে এসে থ মেরে গেল। ইহান ভাই এখন তার কাছে আকাশের চাঁদ মনে হচ্ছে। এত এত মানুষের ভিড়ে ইহান ভাই তাকে দেখবে? তার থেকেও বড় কথা, ইহান ভাই তাকে দেখলেও কথা বলতে চাইবে?
গেট দিয়ে ইহানের গাড়ি ঢোকার সময় সবাই ওদিকে ছুটল। ইহানের এই মুহূর্তে সত্যিই ক্লান্ত লাগছে। তাই সে গাড়ি থেকে বেরুলো না। চার জন গার্ড গাড়ির সামনে থেকে মানুষ সরিয়ে গাড়ি যাবার পথ করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সিটে পড়ে রইল ইহান। মাথাটা ধরেছে ভীষণ। গাড়ি তখন গেটের ভেতর ঢুকে গেছে। ইহান এক পলক বাইরে দেখে নিচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে তার চোখ এক জোড়া চোখের উপর আটকে যায়। সেই চাহনি! বুকটা ফালাফালা হয়ে যায় ওর। গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলে দারোয়ান গেট লাগিয়ে দেয়। ওই চোখের মালিক কে হতে পারে তা চেনার জন্য ইহানের এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট। ভীড়ের মধ্যে সে মানুষটাকে দেখতে পেল না। কিন্তু এটা যে তনু তাতে কোন সন্দেহ নেই।
–‘যাহ! চলে গেল। ইহান ভাই আমাকে দেখলোও না। এত ভীড়ের মাঝে দেখার কথাও না।’
তনু মানুষগুলোকে দেখে ফোঁস করে দম ফেলল।
–‘এখন কি ইহান ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে? টিকিট কেটে আমার ইহান ভাইকে দেখতে হবে?’
তনু দারোয়ানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর ভীড় কিছুটা কমলে তনু দারোয়ানকে গিয়ে বলল।
–‘ভাই আমি একটু ইহান ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাই। আপনি কি কোন ব্যবস্থা করতে দিবেন?’
দারোয়ান তনুর মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত মানুষই তো স্যারের সাথে দেখা করতে আসে। কেউ স্যারকে ভাই ডাকে না। এই মেয়ে ভাই ডাকছে!
–‘স্যারের সাথে কী দরকার?’
–‘অনেক দরকার। আপনি ভেতরে গিয়ে ইহান ভাইকে বলবেন তনু এসেছে। তাহলেই ইহান ভাই আমাকে ডেকে নিবে।’
–‘আপনি উনার কে হোন?’
–‘কে হই!’ তনু কী বলবে? বলবে এককালে প্রেমিকা হতাম। নিজের ভুলেই সেই জায়গা হারিয়েছি। এখন ওর মনে আমার জন্য কোন জায়গা খালি আছে আমি জানি না।
–‘উনার মা আমার ফুপু হোন।’
–‘আপনি স্যারের বোন লাগেন?’
লোকটা মনে হয় তনুর কথায় বিশ্বাস করতে পারছে না। সব লোকই এরকম বলে। সবাই স্যারের আত্মীয় হয়।
–‘স্যার এই সময় কারো সাথে দেখা করে না।’
–‘কারো সাথে না করলেও আমার সাথে করবে।’
তনু কথাটা এতটা বিশ্বাসের সাথে বলল যে ও নিজেই অবাক হলো। সে জানে না ইহান ভাই তাকে দেখতে চায় কি-না।
–‘না আপা। আমার উপর অর্ডার দেওয়া আছে। স্যারের অনুমতি ছাড়া কাউকে ভেতরে যেতে না দিতে।’
–‘আপনি তাহলে উনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।’
–‘না। এই সময় আমার নিজেরও ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। আপনি কাল আসুন।’
তনুর বুঝতে বাকি রইল না লোকটা ইচ্ছে করে তাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। শুধু শুধু ঘুরাচ্ছে। তনুর কান্না পেয়ে গেল। ইহান ভাইয়ের এত কাছে এসে ওকে না দেখে চলে যাবে?
–‘ইহান ভাই, আপনি আমার যোগ্যতার অনেক উপরে চলে গেছেন। আপনাকে ধরার সাধ্য আমার নেই। আপনার হাজারো ভক্তদের মাঝে আমি এভাবেই হারিয়ে যাব।’
চোখের জল মুছে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগল তনু।
চলবে 🍂
#সুখের_পাখি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
#বোনাস_পার্ট
–‘তনু।’
আহান ভাইয়ের গলা শুনে ওড়না গায়ে চাপাল তনু। বসতে বসতে বলল,
–‘আসুন আহান ভাই।’
আহান ঘরে এসে বলল,
–‘ঘরে বসে আছো যে। এতদিন পর দেশে ফিরলে ঘুরে টুরে দেখবে না?’
–‘ভালো লাগে না আহান ভাই।’
আহান কপালে ভাঁজ ফেলে তনুকে দেখল। ভালো লাগে না!
–‘আচ্ছা। আজ কোথাও বেরুবে?’
–‘ভাবছিলাম ফুলি আপার সাথে দেখা করতে যাব। আপনি ফুলি আপার বাড়ি চিনেন?’
আহান চিনে না। তবুও বলল,
–‘হ্যাঁ। আমার সাথে গেলে বিকেলে তৈরি হয়ো। আমারও কিছু কাজ আছে। এমনিতেও বেরুতে হবে। তোমাকেও ঘুরিয়ে আনব।’
–‘আচ্ছা।’
ফুলি আপাকে দেখে ওকে চিনতে কয়েক মিনিট সময় নিতে হলো তনুকে। ফুলি আপাকে চেনাই যায় না! এতটা পাল্টে গেছে। ফুলি তনুকে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলছে। দরজার সামনে থেকেই তনুকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,
–‘ও মা! তনু! তনু তুমি আমার বাড়িতে এসেছ! আমাকে দেখতে এসেছ! আমার কথা তোমার মনে আছে?’
তনু হাসল। বলল,
–‘মনে থাকবে না কেন ফুলি আপা? তোমাকে আমি কীভাবে ভুলব বলো তো? তুমি তো বেশ গুলুমুলু হয়েছ।’
ফুলি লজ্জা পেল। তনুর সাথে আহানকে দেখে বলল,
–‘এসো এসো। ভাইজান ভেতরে আসুন। আহা তনু! কতদিন পর তোমাকে দেখছি। তোমাকে যে কী সুন্দর লাগছে!’
তনু ফুলি আপার সাথে অনেক গল্প করল। ফুলি ওকে আজ থেকে যেতে বলছে। আহানকে একা বসিয়ে রেখে ওরা নানান গল্পে মেতেছে।
–‘আমি জানতাম না তুমি ফিরেছ। জানলে আমি নিজেই তোমাকে দেখতে চলে যেতাম।’
দেশে এসে তিন দিন হয়ে গেলেও তনু ইহান ভাইয়ের কথা কারো কাছে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। ফুলি আপার কাছে রেখেঢেকে তনু ইহান ভাইয়ের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে।
–‘ইহান ভাই তোমার দেখতে আসে না ফুলি আপা?’
–‘ভাইজানের কী সেই কপাল আছে! আসতে তো চায়। কিন্তু ওইযে টিভির লোকগুলোর জন্য পারে না। ভাইজান না এলেও আমি যাই। ভাইজান আমাকে নিতে গাড়ি পাঠায়, জানো তুমি! এই ফ্ল্যাট বাড়িটা, এটা ভাইজান আমাকে দিয়েছে।’
বলতে বলতে ফুলির চোখ টলমল করে উঠল। তনু জানে ইহান ভাই কেমন মানুষ। ফুলি আপাকে সত্যিই স্নেহ করে সে। তনু ভাবছে, ইহান ভাই এত বড় নামি-দামি মানুষ হয়েও ফুলি আপাকে মনে রেখেছে। তাহলে ইহান ভাই তাকেও ভুলেনি।
–‘তোমার ছেলে কোথায় ফুলি আপা?’
তনু বিদেশ বসেই ফুপু আম্মার কাছে জেনেছিল, ফুলি আপার ছেলে হয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ার মত করে ফুলি ব্যস্ত হয়ে উঠল।
–‘তুমি তো আমার ছেলেকে দেখো নাই, না?’
–‘কীভাবে দেখব? দেশেই তো ছিলাম না।’
–‘অহহো। তুমি আমাকে জানিয়ে কেন এলে না তনু? তানভীর তো ওর বাবার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। তুমি আজ থাকবে। আমি ওকে ফোন দিয়ে আসতে বলছি।’
–‘না,না ফুলি আপা। আমি আজ থাকব না। অন্য একদিন আসব আবার। তোমার ছেলের নাম তানভীর?’
–‘হুম। নামটা কার দেওয়া বলো তো? ভাইজানের।’
–‘তানভীর নামটা ইহান ভাই রেখেছে!’
–‘হুম। ও যেদিন জন্ম নিল, ভাইজান হাসপাতালে এসে কী এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। ওকে কোলে নিয়ে খুশিতে ঝলমল করছিল। হাসপাতাল থেকে নিজে আমাদেরকে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। নিজে ওর নাম রাখল। আমার কপালটা অনেক ভালো গো তনু। নিজের ভাই নেই বলে এখন আর আফসোস করি না। ভাইজানের মত একজন মানুষকে ভাই রূপে পেয়েছি আমি। আমার আর কী লাগে বলো তো?’
তনু মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
–‘আমার কপালটা তোমার মতন না গো ফুলি আপা। আমি নিজেই নিজের কপাল পুড়েছি। যে মানুষটা বাকি সবার এত খেয়াল রাখে। সে নিজের ভালোবাসার মানুষটার কত খেয়াল রাখত! আমি মানুষটাকে বুঝতে ভুল করেছি। তাই তো এখন তার নাগাল পাচ্ছি না। সে আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।’
আরও তিন দিন পর ইহান বাড়ি এসেছে। তনু ইহানের গলা পেয়ে ঘর থেকে ছুটে আসার সময় কিসের সাথে যেন হোঁচট খেয়ে পায়ের নখ উলটে ফেলেছে। কলকল করে রক্ত ঝরছে। তনু সেদিকে খেয়াল না করে ইহানকে দেখার জন্য হলরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। এতগুলো বছর পর ইহান ভাইকে চোখের সামনে দেখে তনুর ভেতরটা উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ইহান তনুর উপস্থিতির কোন পরোয়াই করল না। সে মা’র সাথে কথা বলছে,
–‘তুই কথা দিয়েছিলি কক্সবাজার থেকে ফিরে বাড়ি ফিরে আসবি।’
–‘এসেছি তো মা।’
–‘আর যাবি না বল।’
–‘যাব না। তবে আমাকে সারাদিনই বাইরেই কাটাতে হয়।’
–‘তা কাটাবি। আমি বারণ করব না। কিন্তু কাজ শেষ করে তুই আমার কাছে ফিরে আসবি।’
তনু মনে মনে প্রার্থনা করছে। ইহান ভাই একটা বার তার দিকে তাকাক। তাকে এক নজর দেখুক। তনুর উপর সাবিনার নজর গেলে বলল,
–‘তনু ফিরে এসেছে ইহান। তুই জানিস না?’
–‘না।’
–‘তোকে বলা হয়নি। ছয়দিন হয়েছে ফিরেছে।’
–‘ওহ। মা আমি ঘরে যাই। একটু পরেই আবার বেরুতে হবে। গানের রেকর্ডিং আছে।’
–‘আচ্ছা যা।’
ইহান চলে যাচ্ছে। সে তনুকে দেখলও না। তনুর পক্ষে চোখের জল আটকানো কঠিন হচ্ছিল। সাবিনা তনুর পায়ের দিকে দেখে চিৎকার করে উঠল,
–‘ও আল্লাহ! এই তনু, কী হয়েছে তোর? তোর পা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে কেন?’
তনু তখনও ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফুপু কথাটা এত জোরে বলেছে ইহান ভাইয়ের কানে নিশ্চয় গেছে। তনুর মন বলছিল ইহান ভাই দাঁড়াতে। কিন্তু না। ইহান শুনেও সোজা উপরে চলে গেল। তনু এবার কেঁদেই ফেলল। সাবিনা চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে।
–‘কীভাবে চোট পেলি? কখন লেগেছে? আহা কীভাবে রক্ত বেরুচ্ছে। এই আহান, এদিকে আয় না। দেখ না তনুটা কী করেছে। কী যে করিস তুই!’
তনু চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শুধু বলল,
–‘পায়ে লাগেনি ফুপু। যেখানে লেগেছে ওখানের রক্তক্ষরণ কেউ বন্ধ করতে পারবে না। ইহান ভাই আমাকে ভুলে গেছে। আমি মরে গেলেও ওর কিচ্ছু আসে যাবে না।’
সাবিনা আহানকে ডাকাডাকি করতে ব্যস্ত থাকায় তনুর কথা শুনতে পেল না। আহান ফাস্টএইড বক্স এনে ঔষধ লাগিয়ে তনুর পা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। ইহান এখানে এসে না দেখলেও ঘরে বসে সবই শুনেছি। তনু বসার ঘরে থাকতে থাকতেই ইহান রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো।
সাবিনাকে দেখে বলল,
–‘মা যাচ্ছি।’
–‘দেখ না তনু কেমন ব্যথা পেল।’
–‘আমার সময় নেই মা। তোমরা তো আছো। আমি যাই।’
আহান ইহানের এই আচরণে রেগে গিয়ে বলল,
–‘তোর থেকে সামান্য ভদ্রতা আশা করাও বোকামি ছাড়া কিচ্ছু না।’
–‘জি ধন্যবাদ। তুই ডাক্তার মানুষ। তোর কাজই মানুষের সেবা করা। আমি তো আর তোর মত ডাক্তার না। আমাকে দিয়ে আর যাই হোক কারো সেবা আত্তি হবে না। তুই তোর দায়িত্ব পালন কর।’
তখনই তনু ডুকরে কেঁদে ফেলল। আহান ব্যস্ত গলায় বলল,
–‘কী হয়েছে তনু?’
–‘কষ্ট হচ্ছে।’
–‘দেখি। মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছি তো। ব্যথা হবার কথা না।’
তনু ইহানের দিকে চেয়ে নিজে নিজে বলল,
–‘এই ব্যথা কোন ঔষধে সারবে না আহান ভাই। এই ব্যথার ঔষধ আপনার কাছে নেইও। যার কাছে আছে তার মনটা ভীষণ কঠিন হয়ে গেছে। এখন তার কাছে চাইলেও সে আমাকে ঔষধ দিবে না। আমার কষ্টে সে স্বস্তি পায় হয়তো।’
ইহান দাঁড়াল না। তার কাজে চলে গেল সে। তার মুখ দেখে তনু বুঝে নিয়েছে ইহান ভাইয়ের ক্ষমা পাবে না সে।
চলবে…
বিঃদ্রঃ এডিট ছাড়া পর্ব। অসংখ্য ভুল থাকতে পারে।