সুখের সন্ধানে পর্ব-৩২+৩৩

0
381

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩২

মিথিলা ভালো করেই জানে এই সমাজে একটা মেয়েকে কতটা যুদ্ধ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখতে হয়। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে পদে পদে হোঁচট খেয়ে খেয়ে তাকে পথ চলতে হবে। রূম্পা মায়ের বাসায় থাকলে সে ধীরেধীরে আরো বেশি প্রিয়র প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এ বাসা থেকে এখন বের হতে চাইলে রূম্পা মা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন। সে তার প্রবলেমের কথা জানতে চাইবে যার কোনো সদুত্তর তার কাছে নেই। তাছাড়া মেহরাবের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে তাকেই। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে সাজিদকেই বিয়ে করবে। যুদ্ধ করে সে এই প্রতিকূল পরিবেশ পারি দিতে অপারগ । এত বেশি মানসিক শক্তি তার নেই। বাপের ঘরে ঠাই হয়নি। খালার বাড়িতেও তারা অনাহুত। মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে আজ হলেও বিয়ে হবে, কাল হলেও হবে। তাই দু’দিন আগে হলেই বা সমস্যা কী?

ওদিকে আইমান পাগলের মত তাকে যেখানে সেখানে যার তার সামনে ডিস্টার্ব করে। ইদানিং প্রিয়কে নিয়েও আজেবাজে কথা বলে। আইমান ছাত্র রাজনীতি করে তাই কিছুতেই তার পরোয়া নেই। ধরাকে সরাজ্ঞান মনে করতেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে না। যদিও মিথিলার সাথে কোনো ধরণের অশোভনীয় আচরণ এখনো সে করেনি । কিন্তু করতে কতক্ষণ? কারো সাথে তর্কে জড়ানো মিথিলার একদমই ধাঁতে নেই। কিছুতেই প্রতিবাদ করতে পারে না আইমানের । নিরবে সবই সহ্য করছে। একবার ভেবেছে তার বাবার কাছে নালিশ করবে। তার বাবা হয়ত তার পরিবারকে জানাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এতে হিতে বিপরীত না হয়। আইমানের পরিবার আমাকে পছন্দ করে না। তাই তারাও আমার জন্য আইমানের এই পাগলামি সোজাভাবে নিবে না। আইমানকে শাসন করতে যাবে আর সেই শাসনের কুপ্রভাব পড়বে আমার উপর। আইমান আগের থেকে বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়বে।

সে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই অন্ধকার মনে হচ্ছে। এই অন্ধকারের মাঝে কেন যেন তার কাছে মনে হচ্ছে সাজিদ হয়ত তার জন্য আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
গতরাতে মিথিলা তার মাকে স্বপ্ন দেখেছে। মায়ের কোলের উপর মাথা রেখে কেঁদে কেদে এই সমস্যার সমাধান খুঁজছে সে । তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, “ তোর তো অনেক বুদ্ধিরে, মা। নিজের বুদ্ধিতে যা আসে সেটাই কর। তোর সাথে সবসময় আমি আছি। একদমই ভয় পাবি না। “ মাকে জড়িয়ে ধরে আরো কীসব বলছিল এমন সময় ফজরের আযানের শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় বসে মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে সেই হুশ নেই। চারদিকে যখন আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে তখন তাড়াতাড়ি উঠে ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসেও মায়ের জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছিল। একদম নাক চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল কাঁদতে কাঁদতে ।

মেহরাবটাকে নিয়েও তার যত চিন্তা। একদমই পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। খুব বেশি জিদ করে আজকাল। ছোটবেলা থেকেই এই স্বভাবের জন্য কত যে মার খেয়েছে তার মায়ের হাতে। রূম্পা মা তাদের খুব আদর করেন। কিন্তু সেই আদরে মেহরাব যেন আরো বাদর হচ্ছে। দামী ফোন , দামী ব্যাগ, জুতা আরো কত কী! রূম্পা মাও কিছু এনে দিতে ক্লান্ত হয় না। মেহরাব চাইতেই সে সব দিচ্ছে । তাকে এত নিষেধ করছি মেহরাবের এসব বায়না পূরণ করতে। রূম্পা মায়ের অঢেল আছে তাই বলে এভাবে তার থেকে নেওয়া একদমই বেমানান। মিথিলা বোঝে কেন রূম্পা মা এমন করে। মা বাবাকে কাছে না পাবার কষ্টটা সে সবসময় ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু মেহরাবই বা কেমন ? এত ছোটো তো তুই এখন না। মিথিলা বোঝাতে বোঝাতে এখন ক্লান্ত। তার যে করেই হোক মেহরাবকেও এখান থেকে বের করতে হবে। এই অঢেল সম্পদের মাঝে সুখ খুঁজতে খুঁজতে নয়ত একসময় সে ভুলেই যাবে সে এ বাড়ির একজন আশ্রিত বৈকি আর কিছুই না।

সাজিদকে সে এভাবে সেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাকে বিয়ে করবে তার সাথে মেহরাবকেও সে বাড়িতে থাকার অনুমতি দিতে হবে অনন্তপক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত। সে তার ছোট ভাইটাকে রেখে কোথাও থেকে শান্তি পাবে না। সাজিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছে। সাজিদ মিথিলাকে আশ্বস্ত করেছে এ নিয়ে তার পরিবার থেকেও কোনো আপত্তি করবে না হয়ত। তার নিজের দুই মামাও তার মায়ের কাছে থেকে মানুষ হয়েছে। তার মা নিশ্চয়ই বুঝবেন। সে এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত থাকতে বলে মিথিলাকে। মিথিলা সাজিদের চোখে তার জন্য বিশ্বাস দেখেছে, সম্মান দেখেছে, ভালোবাসা দেখেছে। সে না হয় এখন সাজিদের জন্য কোনোকিছুই অনুভব করছে না তাতে কি! নিশ্চয়ই বিয়ের পরে ধীরে ধীরে সাজিদের ভালোবাসার কাছে সে নিজেকে সমর্পণ করবে এটা তার বিশ্বাস। প্রিয়র সাথে তার এমন কিছু হয়নি যে সে তা ভুলতে পারবে না। সে খুব চেষ্টা করবে নিজেকে সাজিদের রঙে রাঙিয়ে নিতে।

তবে তার রূম্পা মা এই মুহূর্তে তাকে বিয়ে দিতে রাজি হবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। সাজিদকে দেখে মনে হয়েছে খুব ভালো মনের একজন মানুষ। তার বিশ্বাস সাজিদ তাকে নিশ্চয়ই বুঝবে। যদিও মেয়েদের স্বামীর ঘর একটা ঘর যেখানে সবাই তাকে আপন ভাববে এমনটা আশা করা একটু বেশিই হয়ে যায়। তবুও আশা করতে দোষ কোথায়? আশায়ই তো মানুষ বাঁচে।
এমন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে যখন মিথিলা ঘুমিয়ে পড়ছিল তখন প্রিয় এসে দরজায় নক করল।

ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলল সে। চোখের সামনে প্রিয়কে দেখে তার ঘুম উধাও।

– কিরে এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরেছিস?

– হুম। মাথাটা ধরেছে খুব। তাই ভাবলাম ঘুম আসলে ঠিক হয়ে যাবে , তাই। কিছু কি বলবে?

– ছাদে যাবি চল। খানিকক্ষণ খোলা বাতাসে ঘুরে আসবি। ভালো লাগবে।

– সরি, ভাইয়া। এতক্ষণ ধরে ঘুমাতে চেষ্টা করে এখন প্রচুর ঘুম আসছে। আজ না হয় না যাই। এমনি কিছু কি বলবে তুমি? ঘুমালে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।

প্রিয় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। আজ বিকেলে সে যখন বাইরে বেরিয়েছিল তখন সাজিদ আর মিথিলাকে একসাথে বসা দেখেছে বাসার কাছাকাছি ছোটো পার্কটির একপাশে। তখন থেকেই তাঁর মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। তার অবুঝ মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে ওরা দু’জন দু’জনকে খুব ভালোবাসে। কেন যেন তার মনটা বারবার তাকে তাগাদা দিচ্ছে তার মনের খবর মিথিলাকে জানানোর জন্য। কিন্তু সেটা বোধ হয় একটু বেশিই বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। মিথিলা তাকে বড় ভাইয়ের চোখে দেখে । আর সে কি না! ছিঃ ছিঃ!

সকালবেলা মিথিলার ঘুম ভাঙ্গার সাথেসাথেই আমি যেয়ে ওর পাশে বসলাম। ওর চোখগুলি কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম;

– কি রে চোখমুখ ফোলা কেন? শরীর খারাপ লাগছে? আমাকে কিছু বলিস নি কেন? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম । কী হাল করেছিস নিজের? আমি এ ক’দিন কীসব কাজে ব্যস্ত থাকায় তোর একদমই খোঁজখবর নিতে পারিনি তাই বলে তুইও কি আসতে পারলি না?

– উহ, রূম্পা মা। আগে দম নাও। একের পর এক প্রশ্ন বাণে তুমি সুস্থ একটা মানুষকে এবার অসুস্থ করে দিবে দেখছি। আমার কিছুই হয়নি। আজ আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অন্য দিনের চাইতে। ঘুম বেশি হয়েছে তাই হয়ত নাক চোখ ফোলা লাগছে।

– ওহ! তাই বল। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।

– এবার বলো সাত সকালে কিছু তো বলার জন্য এসেছ।

– হুম, বলবো কিছু একটা । সত্যি সত্যি উত্তর দিবি।

– মিথ্যে কোনোদিন বলেছি তোমাকে?

– তা বলিস নি। কিন্তু! কিভাবে যে বলি!

– আচ্ছা কী বলবে বলে ফেল। ঘুরানো প্যাঁচানোর দরকার নেই। অন্ততপক্ষে তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক না।

– হুম, ঠিক বলেছিস। আচ্ছা , সাহস যখন দিলিই তখন জিজ্ঞেস করেই ফেলি। তুই কি সাজিদকে পছন্দ করিস?

– মিথিলা কিছুটা লজ্জাবনত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, না …মানে…হ্যা!

– না আবার হ্যা বুঝলাম না।

– মিথিলা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানাল।

– আমি অবশ্য ব্যাপারটা অনুমান করেছিলাম বেশ আগেই।

– আমি কি ভুল করেছি ,মা? তুমি না চাইলে না হয় ফিরে আসব ও পথ ছেড়ে!

– ভুল না সঠিক সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। তবে ছেলেটাকে আমারও পছন্দ। মনে হচ্ছে তোকে খুব সুখে রাখবে।

– তুমি কি করে জানলে আমাদের ব্যাপারে?

– গত রাতে সাজিদের মা কল করেছিল। সেও তোকে খুব পছন্দ করে। উনি শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। তাই ছেলে বিয়ে করিয়ে সংসারের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিতে চায়; তাছাড়া উনার মেয়েটাকেও বিয়ে দিতে হবে। মেয়ের বিয়ের এত দায়িত্ব উনি একা সামলাতে পারবেন না এজন্য ঘরে বউ আনতে চান আগে। উনি তোর কথা বলল। এবং এই মাসের মধ্যেই ছেলেকে বিয়ে করাতে চায়। আমি অবশ্য এতে রাজি না। এত দ্রুত সবকিছু করা যায়? তাছাড়া তোর ইয়ার ফাইনাল দু’মাস বাদে। তবে উনি তোর পড়াশুনার ব্যাপারে দেখলাম খুব পজিটিভ। বিয়ের পরেও পড়াশুনা করাবে এমনটাই বলল।

– সাজিদ ভাই জানে এসব কথা?

– সাজিদ ভাই? হুম! মেয়ে আমার বড় হয়েছে তবে! ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছে আর আমি কিছুই টের পেলাম না।

– না … মা …মানে…।

– হয়েছে … হয়েছে। এত তোতলাতে হবে না। হুম, সাজিদ জানে। সেও চাচ্ছে এ মাসেই বিয়ের কাজ সারতে। আমি উনাকে বলে দিয়েছি তোর কাছ থেকে আগে মতামত নিব সাজিদকে পছন্দ করিস কি না তারপরে বিয়ের ডেট নিয়ে কথা। এত তাড়াতাড়ি আমি তো রাজি হবো না।

মিথিলার মনে পড়ল দাদীর কথা। আগামী পনেরো দিনের মধ্যে এ বাড়ি থেকে তাকে বিদায় হতে বলেছে তার খালু। তাছাড়া এখানে যতদিন থাকবে ততই প্রিয়র প্রতি দুর্বলতা বাড়তেই থাকবে। এখান থেকে তাকে বের হতে হবে। এই যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি চাই। যে করেই হোক। সে নিজের লাজলজ্জা ভুলে যেয়ে বলল,

– রূম্পা মা। আমার এক্সাম শুরু হতে হতে আরো মাস তিনেক তো লেগে যাবে। তাই এক্সাম নিয়ে চিন্তা নেই ! আমি ম্যানেজ করতে পারব। তুমি এত চিন্তা করছ কেন?

– ও মা! তার মানে তলে তলে এতকিছু! আমি আছি ওর এক্সামের চিন্তায় আর ও আছে ওর বিয়ে নিয়ে। বেশ তো এডভান্স হয়েছে আমার লাজুকলতা মেয়েটা। তার মানে কি তর সইছে না , তাই না? হা হা হা! এ গল্প আমি কাকে বলি ? তোর মায়ের এখন বেঁচে থাকবার দরকার ছিল। হা হা!

– মিথিলা লজ্জায় যেন মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। মুখ দিয়ে আর শব্দ বেরুচ্ছে না।

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে চিন্তা করতে করতে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। একবার মন চায় এই নরক থেকে মেয়েটাকে বের করি। সেলিমের বাজে আচরণ আর সহ্য হচ্ছে না। আরেকবার মন চায় মেয়েটার লেখাপড়া শেষ করিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করাই। একটা ভালো বুদ্ধির জন্য কারো সাথে পরামর্শ করব সেই মানুষটিও নেই। খুব মিস করছি টুম্পাকে। এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলিরে বোন?
ন ‘মাস যাকে পেটে ধরে এত কষ্ট করে বড় করলি তার এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভার আমার উপর ফেলে চলে গেলি! খুব ভয় হচ্ছে কী সিদ্ধান্ত নিব সেটা ভাবতেই। আমি ভাইয়াকে কল দিলাম। সব শুনে ভাইয়াও সাজিদ এবং তার পরিবারকে পছন্দ করল। তাছাড়া সাজিদদের বাসা ভাইয়ার বাসা থেকে বেশ কাছাকাছি তাই ভাইয়া খুব পছন্দ করলেন। সে আমাকে বললেন, সাজিদের মাকে হ্যা করে দিতে। আমি ফাইনাল কিছু জানানোর আগে মিথিলার বাবাকে যেন কল দেই সেটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন ভাইয়া।

আমার প্রথমে কিছুটা মেজাজ গরম হলেও পরে ভেবে দেখলাম আমরা মিথিলার জন্য যাই কিছু করি না কেন দিনশেষে মিথিলার বাবাই এই পৃথিবীর তার এখন সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাকে না জানিয়ে আমি এমন অন্যায় করতে পারি না।

মিথিলার বাবা সবকিছু শুনে সাজিদকে পছন্দ করল বলে মনে হলো। সে মিথিলার সুখের দায়িত্ব আমার হাতে সঁপে দিয়ে নিজেকে যেন দায়মুক্ত করল। আমি বুঝলাম সেও রাজি।

আম্মার কাছে যেয়ে সবকিছু খুলে বললাম । মিথিলার এতবড় ঘর থেকে সম্মন্ধ বলছে শুনে আমার শ্বাশুরির চোখ কিছুটা ছানাবড়া।

– সাজিদের মা ভালো করে জানে তো যে মিথিলা কেন আমাদের বাড়িতে থাকে? না মানে বোঝাচ্ছি যে ওর বাবা যে সেকেন্ডবার বিয়ে করেছে সেটা কি ওনারা জানেন?

– জি মা। সাজিদ তো আর দূরের কেউ না। সে তো আমাদের ঘরের অল্পবিস্তর অনেক কিছুই জানে।

– আমি সাজিদের কথা বলছি না। আমি বলছি সাজিদের মায়ের কথা আর ওর পরিবারের বাকি সবার কথা। সাজিদ মিথিলাকে পছন্দ করে। মিথিলার অনেক কিছুই সে দেখেও না দেখার ভান করবে কিন্তু তার পরিবার কিন্তু সেটা করবে না।

– এটা একদম ঠিক বলেছেন। এজন্যই আমি সবকিছুই জানিয়েছি সাজিদের মাকে। উনি সবকিছু নাকি আগে থেকেই জানে। সেসব বললেন।

– জানলে তো ভালো। তাহলে দিয়ে দাও দুই হাত এক করে। দেরি করছ কেন? আর ওর বাবাকে জানিয়েছ? পরে না আবার উল্টাপাল্টা কিছু হলে তোমাকে এসে দোষের ভাগিদার করে।

– উল্টোপাল্টা আবার কি হবে মা? ভালো চিন্তা করেন, নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। হ্যাঁ, আমি ওর বাবাকে জানিয়েছি, আমার ভাইয়াকেও জানিয়েছে। ভাইয়াও মোটামুটি রাজি । আর মিথিলার বাবা আসাদ তো আমার উপরেই সব দায়িত্ব দিয়েছে। মেয়ের কিসে ভালো মন্দ সব চিন্তা নাকি আমার।

– চালাক মানুষ তো! তাই তোমাকে বড় করতে যেয়ে নিজে দায়িত্ব থেকে পালাল। না হলে কি আর বাপ বেঁচে থাকতে ছেলেমেয়েদের অন্যের বাড়িতে মানুষ হতে হয়। তাও আবার মিথিলার মত একটা লক্ষী মেয়েকে।
তারা যেহেতু এ মাসেই বিয়ে চাচ্ছে তবে ব্যবস্থা করো। মিথিলা এত বছর এ বাড়িতে থাকল, তাই বিয়েটাও এখান থেকেই দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

– কি জানি! কে দায়িত্ব থেকে পালালো আর কে দায়িত্বভার তুলে নিল নিলো। আমার দরকার অভাগা মেয়েটাকে একটা ভাল পাত্র দেখে পাত্রস্থ করা। যাতে ওর মায়ের কাছে যে আমাকে জবাবদিহি করতে না হয়। আমার মনে হয় সাজিদই সেই ছেলে আর ওর পরিবারও খুবই ভালো।

– দেখো তাহলে আর অপেক্ষা কিসের? আয়োজন শুরু করো। ও হ্যা, সেলিমকে জানিয়েছ?

– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, না এখন অবধি জানাইনি। অবশ্য তাকে এ খবর জানানো আর না জানানোর মধ্যে কি ফারাক?

– এসব কি বলছ? সেলিম এ সংসারের কর্তা। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত ওকে জানাবে না?

আমি মনে মনে হাসছি…. কর্তা! ভালই বলেছেন। এমন কর্তা যে কোনদিন এসবের একটা কোনো দায়িত্ব পালন করেছে কিনা সন্দেহ! মেয়েটাকে তো দেখতেই পারে না। এই বাড়ি থেকে ওকে বিদায় করতে পারলেই যেন বাঁচে।

আমার শাশুড়ি আর এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বললেন না দেখে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম।

রাতে প্রিয়কে রুমে না পেয়ে আমি ছাদে গেলাম। আমি দূর থেকেই ঘ্রাণ পেয়ে বুঝলাম প্রিয় হয়ত সিগারেট টানছে। আমাকে দেখে যাতে লজ্জা না পায় তাই গলাখাকারি দিলাম। প্রিয় সিগারেট খায় বেশ আগে থেকে এটা আমি জানি তবে আমার সামনে কখনো সে খায়নি। এটা ওকে আমি কত না নিষেধ করেছি কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি। এই অভ্যাস ওর রক্তে মিশে আছে। আমার শ্বশুর ছিলেন একজন চেইন স্মোকার।
প্রিয়র বাপ চাচাও তার বিকল্প নয়। তবে সান্তনা এইটুকু যে ওর বাপ চাচার মতো ড্রয়িংরুমে বসে আয়েশ করে অ্যাস্ট্রেতে ছাই ফেলতে ফেলতে সিগারেটের টানে না।

হয়ত সামনে গেলে ভবিষ্যতে এমনটা করতেও পারে। তবে এখনো পর্যন্ত যে এতটুকু আমাকে মানছে সেটাও আমার জন্য অনেক বড় পাওনা। শুধু সিগারেটই না এই পরিবারের বাকি সবার মত প্রিয়রও যে একটু আধটু অন্য নিষিদ্ধ নেশাদায়ক ড্রিংকসের দিকে নজর আছে সেটাও আমি জানি। যে ছেলে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে এ বাড়ির যে কোন পার্টির আয়োজন হলেই এ ধরনের বস্তুর উপস্থিতি একান্ত কাম্য সে ছেলেটার এসবের প্রতি নেশা হবে এটা অবাস্তব ভাবার কিছু নেই।

প্রিয় যখন খুব দুশ্চিন্তায় থাকে তখন একের পর এক সিগারেট ফুঁকতেই থাকে। আজও ওর আশেপাশে বেশ কয়েকটা আধা খাওয়া সিগারেটের পোড়া অংশ ফেলা দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কী এমন চিন্তায় পড়ল ছেলেটা? অফিসে তো সব ঠিকঠাকই আছে। তাহলে কি ওর ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যা? বিন্দু?

বিন্দুর সাথে ওর যোগাযোগ কেমন ইদানিং সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ও আমাকে কিছু বলছেও না। কতবার বললাম, মেয়েটাকে আমার সাথে দেখা করিয়ে দিতে। নাহ, ওর সময়ই হলো না। অবশ্য আমিও ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। সিলেটে গেলাম আবার ঢাকায় এসে আরো নানান ধরনের ব্যস্ততা। যে কারণে এ বিষয়ে ওর সাথে কোন কথাই বলা হয়নি আর । ছেলেটা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে। খানিকটা অপরাধবোধে ভুগলাম প্রিয়র খোঁজখবর না নেয়ার জন্য।

চলবে….

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৩

পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব। আজ মিথিলার বিয়ে। একটু পরেই মিথিলাকে বিউটি পার্লারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে সরাসরি কমিউনিটি হলে। এ বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্ত যত কাছে আসছে ততই আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েই চলছে। জানিনা মেয়েটার ভালো করতে যেয়ে মন্দ করছি কি না। মেয়েদের ভাগ্য এমন কেন? এক খাঁচাতে বড় হয়ে অন্য খাঁচায় যেয়ে আবার পোষ মানতে হয়। সব আপন সম্পর্কগুলি কলমের এক খোঁচায় পর করে নতুন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে সব পর মানুষগুলিকে আপন করে নিতে হয়। আর সেই আপন করার প্রক্রিয়ার মাঝে তাকে যে কতটা কাঠখড় পুড়াতে হয় সেটা কোনো পুরুষ মানুষের কোনোদিনই বুঝে আসেনি আর আসবেও না।

মেয়েটা আমার বুকের ভেতর কতটা অংশ জুড়ে ছিল সে আমি এখন অনুভব করছি। নিজের পেটে মেয়ে না থাকার যন্ত্রণা আমি মিটিয়েছি মিথিলাকে পেয়ে। শুধু মেয়েই না ও আমার মাও। মাকে হারিয়েছি বহুবছর। মায়ের আদর শাসন খুব মিস করি প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু সেই ক্ষতটাকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলাম এই লক্ষী মেয়েটাকে পেয়ে।

সকাল থেকে কোনো কাজেই মন বসাতে পারছি না। যেটাই করতে যাচ্ছি কোনো না কোনো ভুল হচ্ছে। আমার শাশুড়ি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে খানিকক্ষণ বোঝলেন।

আমার মেয়ের বিয়ে । কত কত দায়িত্ব অথচ আমার হাত পা যেন চলছেই না। মন চাচ্ছে ওকে বুকের মাঝে কোথাও লুকিয়ে রাখি। চোখের পানি কিছুতেই বাঁধ মানছে না। আমার মতো একই অবস্থা মিথিলারও । সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে । কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছে “ আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাই না মা, আমি যেতে চাইনিও। ভেবেছিলাম সারাজীবন তোমার কাছে থেকে যাব। কেন এমন হলো, মা ? আমি তো এক মাকে হারিয়ে নতুন করে তোমার মাঝে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই তোমার থেকেও আমাকে দূরে থাকতে হবে কখনো ভাবিনি। চলে যাচ্ছি , মা। আমাকে তুমি ভুলে যেও না। আমার কষ্টটা তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম! ”

মা মেয়ে মিলে কত যে কেঁদেছি ! আমার মা যেদিন চলে গিয়েছিল সেদিনের মতো আজো আমার গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল। নিজেই ভেবে পাচ্ছি না মায়েরা কী করে তার মেয়ের চলে যাওয়াকে সহ্য করে? আদরের ধনকে পর করে দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিতে কতটা কষ্ট সে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
সেলিমও হয়ত আমার মনের খবর টের পেয়েছিল তাইতো পাষাণ দিলের মানুষটাও এসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে বাধ্য হয়েছিল। কারো সান্ত্বনাই আমার মনটাকে শান্ত করতে পারছে না। ভোর থেকে প্রিয়কে দেখছি না কোথাও। ওর তো আজ তাড়াতাড়ি ওঠার কথা ছিল। কমিউনিটি হলে যাবে দেখভালের জন্য। ছেলেটার ইদানিং কি যে হলো! মিথিলার বড় ভাই হিসেবে ওরও কি কম দায়িত্ব? গতকাল হলুদের প্রোগ্রামেও কেমন গা ছাড়া ভাব করে কাজকর্ম দেখছিল। মেজাজ খুব গরম হয়ে গিয়েছিল কাল। তাই ইচ্ছেমত খানিকক্ষণ বকাও দিয়েছি। মিথিলা না হোক ওর নিজের মায়ের পেটের বোন তাতে কি ? মিথিলা ওর ফার্স্ট কাজিন। মায়ের পেটের বোনের চেয়ে কম কীসে? তাছাড়া মিথিলার আমরা ছাড়া আছেই বা কে? শহরের কত কত বড় মানুষেরা আসছে বিয়েতে। প্রায় দু’হাজার মানুষের এরেঞ্জমেন্ট। মুখের কথা তো না। ওর বাপের না হয় মিথিলা কিছু হয় না তাই বলে তোরও কি কিছু দায়িত্ব নেই।

মিথিলার ছোট মা তো মেহমান। সে সেজেগুজে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েই দায়িত্ব শেষ করে। আসাদ অবশ্য অনেক দৌড়ঝাঁপ মেয়ের জন্য করছে। আসাদেরও আমার মতো ভীষণ মন খারাপ। গতকাল হলুদের প্রোগ্রামের শেষে আমার সামনে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে মেয়েটার জন্য । এতদিন আমার কাছে ছিল সে নিশ্চিন্তে ছিল কিন্তু এখন পরের ঘরে যাচ্ছে। সেখানে কেমন না কেমন ঘর হয় মা মরা মেয়েটার তা নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই তার। ভাইয়া ভাবি কিছু দায়িত্ব নিয়েছে তাই একটু হলেও উপকার হচ্ছে। মেহরাব ছোট মানুষ হলেও অনেকটাই করছে বোনের জন্য। অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে সে ।

পার্লারে মিথিলার এপয়েন্টমেন্ট সাড়ে দশটায়। আমিই নিয়ে যাব ভেবে রেখেছি। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে প্রেসার আপ ডাউন করছে খুব । একদিকে মানসিক চাপ, আরেকদিকে শারিরীক অবস্থাও ভালো মনে হচ্ছে না। মানসিক আর শারীরিক দুইয়ে মিলে এত বাজে অবস্থা মনে হচ্ছে । বিশ্রাম না নিলে এক পাও সামনে ফেলতে পারব কি না সন্দেহ।

গতরাতে হলুদ পার্টিতে কিছু খেতে পারিনি। আর সকালে তো মুখে দিতে যেয়েই বমি আসছে। বয়স তো কম হলো না। এত স্ট্রেস আর লোড শরীর আর নিতে পারছে না। ভয় পেয়ে গেলাম। এখনো কত কাজ বাকী! অথচ আমি এভাবে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি তবে কীভাবে কী হবে? এ ক’দিনের দৌড়াদৌড়িতে আমার শরীরের বেহাল দশা। কিছুতেই পা টেনে আর সামনে নিতে পারছি না। এখন বিশ্রাম নিতে না পারলে মনে হয় না যে বিয়েতে এটেন্ড করতে পারব।

কিন্তু বিশ্রাম নিলে মিথিলাকে কে নিয়ে যাবে? মনে মনে প্রিয়কে খুঁজছি । যদিও আমার ভাইয়ের মেয়েটা যাবে সাথে। কিন্তু ও একা বুঝবে কী? এ সময়ে আমার থাকাটা জরুরী। প্রিয় গেলেও হয়ত তবু মিথিলার ভালো লাগত। ওর মনেরও যে বেহাল দশা সেটা ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারছি। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করছে অথচ চেহারায় খুশির ছিটেফোঁটাও দেখছি না।
রুমে না পেয়ে কোনোরকম টলতে টলতে ছাদের দিকে গেলাম। যা ভেবেছি তাই। চিলেকোঠার রুমটাতে রোদ্দুরে ভরে গেছে। অথচ এখনও প্রিয় সেখানে ঘুমাচ্ছে। ওকে ডেকে তোলার জন্য কাছাকাছি যেয়ে কী এক উৎকট গন্ধে বমি চলে আসল। দেখলাম খাটের পাশেই হুইস্কির বোতল। মাথায় কিছুই কাজ করছে না আমার। প্রিয় তবে এসবও শুরু করেছে? এত অধঃপতন ? সেদিন রাতে ওর মনের খোঁজ নিতে যেয়ে যেটুকু বুঝতে পেরেছি ছেলে আমার বিরহের অনলে পুড়ছে। বিন্দু নামের ওই মেয়ে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিবি? মিথিলার ঝামেলা শেষ হলেই ওর বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে। এতবড় ছেলে এখন যদি এমন টিনেজদের মত বিহেভ করে চলবে কী করে? সেলিমের সাথে কথা বলতে হবে। আহারে! কী কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা।

পাশে থাকা পানির বোতলটা নিয়ে ওর নাকমুখে পানির ঝাপটা দিলাম। ও চোখ খুলে আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। যাক, ওর নেশা তবে কেটেছে। আমার চিন্তা কমলো।

– কীরে বাবা! খুব মন খারাপ? কী হয়েছে তোমার?

– কিছু না, আম্মু। তুমি এখানে? চোর ধরা পড়ার মতো উঠে বসল সে।

– রুমে না পেয়ে ভাবলাম এখানে আছ, তাই ! কথাগুলি বেশ কষ্ট করে টেনে টেনে বললাম আমি।

– আম্মু, তোমার কী হয়েছে? খুব সিক লাগছে তোমাকে! ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রিয়।

– তেমন কিছু না। ক’দিনের দৌড়ঝাঁপে একটু ক্লান্ত রেস্ট নিলে বোধ হয় ঠিক হয়ে যাব। বাবা, মিথিলাকে একটু পার্লারে নিয়ে যাবে? আমি পারছি না। আমি একটু রেস্ট নিয়ে সরাসরি হলে আসব। প্লিজ, বাবা।

– আমি? আমি এসবের কী বুঝি?

– তোমাকে বুঝতে হবে না। ওরাই সব করবে। তুমি সাথে গেলে মিথিলা সাহস পাবে। সকাল থেকে খুব কান্নাকাটি করছে। বোঝই তো! আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

– প্রিয় খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ঠিক আছে। তুমি আগে রুমে চলো। আমি ডাক্তার ডাকছি। তোমার চেক আপের দরকার সবকিছুর আগে।

– তোমার বাবাকে বলেছি সে অলরেডি কল করেছে ডাক্তারকে। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। মিথিলার যাবার সময় হয়ে গেছে।

– ঠিক আছে।

– আর বাবা, একটা কথা না বলে পারছি না। তোমার কষ্টটা কি এতই গভীর যে এসবে সে কষ্টের ক্ষত মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে নিজের ক্ষতি করে যাচ্ছ?

কথাটা আমি বলতে চাইনি। ভেবেছি আজকে এসব কথা তুলব না। আমি যে ওর এসব বুঝতে পেরেছি সেটাও ওকে বুঝতে দিব না। আজকে মিথিলার বিয়েটা ভালোয় ভালোয় শেষ হোক তারপরে না হয় ওকে ধরব। কিন্তু মায়ের মন তো! নিজের অসুস্থতার কথা যেন ভুলে গেলাম। ছেলেটার এমন দশা দেখে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে কষ্টে।

প্রিয় ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল, আম্মু সরি! গতরাতে পার্টি শেষে বন্ধুরা মিলে একটু …। এমন আর হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে ভেব না। আমি রেডি হচ্ছি।

প্রিয়কে দায়িত্ব দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমি রুমে যেয়ে রেস্ট নিচ্ছি। ডাক্তার এসে কিছু মেডিসিন দিয়ে গেল যাতে দ্রুত রিকভার করতে পারি। প্রিয়কে নিষেধ করলাম মিথিলাকে এসব জানাতে। তাহলে মেয়েটা কিছুতেই পার্লারে যাবে না। এখানে আমার পাশে বসে থাকবে। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে মিথিলাকে খবর পাঠালাম মিথিলাকে এটা বলতে যে আমি একটা এমারজেন্সী কাজে কমিউনিটি হলে গিয়েছি। সেখানেই দেখা হবে তার সাথে আমার। প্রিয়র সাথে তাকে যেতে বলেছি। হয়ত ওর মন খারাপ হবে। তাও এর থেকে ভালো কোনো সমাধান আপাতত পেলাম না।

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে মিথিলা। পাশেই প্রিয় ড্রাইভ করছে। মিথিলার বুকের মাঝে কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। সে কিছুতেই প্রিয়র মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে সে এখনই কেঁদে ফেলবে ।

– কি রে আম্মু আসেনি দেখে তোর মন খারাপ?

– হুম!

– মন খারাপের কি আছে? ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার তোর স্বপ্ন সফলতার পথে। আর তো কয়েক ঘন্টা মাত্র। খুব ভালো করে সাজিস যাতে সাজিদ তোকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে যায়। সাজিদ শালাটা বড় ভাগ্যবান রে! ওর ভাগ্য দেখে খুব হিংসে হয়। ভালোবাসার এমন সফল পরিণতি ক’জনের কপালে জোটে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, প্রিয়।

– বিন্দুকে খুব মিস করছ , ভাইয়া? আস্তে করে বলল মিথিলা।

– উহু। মোটেই না । বিন্দু ছিল আমার চলতি পথে পাওয়া দমকা হাওয়ার মতো। ভালোলাগা হয়ে আমাকে শিহরিত করেছে আবার একরাশ বিরক্তি হয়ে চলেও গিয়েছে। এখন আর ওসব মানুষের জন্য মন খারাপ হয় না। আসল নকলের ফারাকটা বুঝতে পেরেছি । হয়ত দেরি করেই বুঝেছি। কী আর করা । ভাগ্য যেদিকে নিতে চায় সেদিকেই যেতে হবে।

আর কোনো কথা বলল না প্রিয়। মিথিলা খানিকসময় চুপচাপ থেকে প্রসঙ্গ বদলাতে বলল, আচ্ছা তুমি ওভাবে নাবিলাকে রেখে এলে কেন? মামা মামি জানলে খুব মন খারাপ করবে।

– আই ডোন্ট কেয়ার! আমার যাকে পছন্দ না তাকে আমার গাড়িতে তুলি না। আর রেখে এলাম কোথায় ? অন্য গাড়িতে ড্রাইভার নিয়ে আসবে ওকে।

– ওকে পছন্দ না হবার কারণ জানতে পারি?

– কারণ সিম্পল! মামাতো বোন হলেও ওর সাথে আমার খুব বেশি পরিচয় নেই। জাস্ট দেখা হলে হাই হ্যালো রিলেশান। অথচ আমার সাথে এমন গায়ে পড়ে ঢলে ঢলে কথা বলে যেন আমাকে কত বছর ধরে চিনে । আর ওর চোখের নজরও আমার পছন্দ না। কেমন আনকম্ফোর্টেবল।

– হা হা হা! ভয় পেয়েছ যদি গলায় ঝুলে পড়ে?

– ভয় পাবো কেন? বোরিং লেগেছে আমার কাছে। ও তোর সমবয়সী তাই না?

– হুম। ও একটু এমনই। যাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। আর তোমার মত হ্যান্ডসামের প্রেমে না পড়ে এমন সাধ্য কোন মেয়ের আছে বলো!

মিথিলা কথা শেষ করতে করতেই প্রিয় ঘ্যাচাং করে জোরে ব্রেক কষল। সীট বেল্ট পড়া না থাকলে মিথিলার মাথা কপাল যে নিশ্চিত ফাটতো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে খুব ঘাবড়ে যেয়ে বলল, কী হয়েছে ? তুমি ঠিক আছ, ভাইয়া?

– গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছি । তুই ব্যাক সীটে যাতো!

– মিথিলা অবাক হয়ে বলল, ব্যাক সীটে কেন?

– যা বলেছি তাই কর।

মিথিলা কথা না বাড়িয়ে ব্যাক সীটে যেয়ে বসল। কী এমন অন্যায় করে ফেলল সে বুঝতে পারছে না। প্রিয়কে মাঝে মাঝে সে বোঝে না। কেমন যেন আনপ্রেডিক্টাবেল মানুষটা। কখন যে কী করে বোঝার উপায় নেই।
প্রিয় খানিকটা সামনে যেয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় সাইড করল। নিজে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাক সীটে চলে আসলো। মিথিলা কিছুই বুঝতে পারছে না। প্রিয় আসলে করতেটা চাচ্ছে কী?

– ভাইয়া , তুমি এখানে? কিছু বলবে? গাড়ি থামালে কেন?

– হুম, বলব। কী বললি তখন তুই?

– কখন? ভয়ার্ত গলায় বলল মিথিলা। মিথিলা কিছুই বুঝতে পারছে না। ব্যাক সীটের গ্লাস থেকে বাইরের কেউ কিছু দেখতে পায় না । এজন্য প্রিয় তাকে এখানে পাঠায়নি তো! নাবিলাকে নিয়ে না আসা, তাকে ব্যাক সীটে পাঠানো, গাড়ি এমন নির্জন জায়গায় পার্ক করানো, প্রিয়র পেছনে আসা ! কিছুই ভাবতে পারছে না মিথিলা। খুব ভয়ে হাত পা হিম হয়ে এল। কীসব আজেবাজে ভাবছে সে। প্রিয়কে সে অবিশ্বাস করছে ভাবতেই নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হলো তার।

– ওই যে বললি আমাকে কোনো মেয়ে ভালো না বেসে পারবেই না।

– ও তাই ? হ্যা ঠিকই তো বলেছি। আমাকে তুমি যে মাঝেমাঝে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আসতে আমার কয়েক ফ্রেন্ড তো আমার কাছে কতবার তোমার নাম্বার চেয়েছে। ফেইসবুক আইডি চেয়েছে। তাই বললাম। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, মিথিলা।

– এত মেয়ের খোঁজখবর জেনে লাভ নেই। একটা সত্যি কথা বলবি। তুই আমাকে পছন্দ করিস না?

– মিথিলার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় । কোনোরকম ঢোক গিলে ছলছল চোখে কাঁপা ঠোটে বলল, করি তো! খুব করি।

– সত্যি ! তাহলে এতদিন বলিসনি কেন রে পাগলী !

প্রিয়র ততক্ষণে আর কিছু জানাবোঝার মতো অবস্থা নেই। সে এমন ভাবে মিথিলাকে বুকের সাথে চেপে ধরল যেন মিথিলার পাজরের সাথে নিজের পাজর মিশিয়ে ফেলে। মিথিলাও যেন মিশে যেতে চায় প্রিয়র বুকের মাঝে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নোনা পানি ঝড়ছে তার। প্রিয়ও নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল মিথিলার মাঝে। সে কান্না চাপিয়ে রাখতে পারছে না। এই মুহূর্তে সে যেন ভুলে গেছে মিথিলা সাজিদের বাগদত্তা । একটু বাদেই তাদের বিয়ে। মিথিলা সাজিদকে পছন্দ করে। সে নিজে এটার স্বাক্ষী। আবেগে সে ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে গেল। মিথিলাকে কিছুতেই সে আর ছাড়বে না। মিথিলাকে সারাজীবনের জন্য বুকের খাঁচায় শেকল পরিয়ে রাখবে সে। কাউকে নিয়ে যেতে দিবে না। কাউকে না। কাউকে পরোয়া করে না সে। যে করেই হোক এতদিনের না বলা কথাগুলি আজ সে বলবে। কাল সারারাত পাগলের মতো কেঁদেছে মিথিলার জন্য।

“আমি তোকে অনেক ভালোবাসিরে, পাগলী। বলতে সাহস পাইনি। যদি ফিরিয়ে দিস! যদি ভুল বুঝিস! আমি তোকে আমার ভাবনার চাইতেও বেশি ভালোবাসি। কাউকে নিয়ে যেতে দিব না তোকে , কাউকে না। তুই আমার ছিলি , আমারই থাকবি। ”

কান্নার দমকে যেন প্রিয় আর কিছু বলতে পারছে না।
মিথিলা এতক্ষণ দিকভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল অন্য জগতে। নিজেকে সমর্পণ করেছিল প্রিয়র মাঝে। হঠাৎ তার হুশ ফিরল। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল। খুব অবাক হলো এটা ভেবে যে প্রিয়ও তবে তাকে তার মত করে ভালোবাসে। অথচ সে কত না ভয়ে ছিল। কখনো বলতে পারেনি নিজেদের মনের কথা একে অন্যকে। কিন্তু আজ কোন প্রান্তে এসে তারা ভালোবাসা জাহির করছে। ছিঃ ছিঃ! এটা সে কী করছে? প্রিয়র পিঠ খামচে ধরা হাতদুটির বন্ধন শীতল হলো তার। প্রিয়র টি শার্টে নিজের চোখের পানি মুছল। কত বড় ভুল সে করতে যাচ্ছে ভেবে নিজেকে মনে মনে ভর্তসনা করতে লাগল। রূম্পা মায়ের মুখখানা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। সাজিদের মুখখানা জ্বলজ্বল করছে । এই মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে, বিশ্বাস করে আর সে কি না! ছিহ! আর একটু পরেই সে তার বউ হবে অথচ সে এসব ভাবছে? অন্য পুরুষের বুকে আছড়ে পড়ে সুখ খুঁজছে ? লজ্জায় যেন মাথা তুলতে পারছে না মিথিলা। তাও নিজেকে সামলাল প্রাণপণ চেষ্টা করে।

– ভাইয়া, এসব কী বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার? প্লিজ, শান্ত হও। আমার পার্লারে দেরি হয়ে যাবে।
সাজিদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

সাজিদের নাম প্রিয়র কানে যাবার সাথে সাথে সে সতর্ক হলো। এতক্ষণে হুশে এল সে। মিথিলাকে বুক থেকে টেনে তুলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যে বললি তবে?

– তোমাকে পছন্দ করি এখনও বলছি। তোমাকে পছন্দ করি , ভালোবাসি। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, মিথিলা।

– তবে সেখানে সাজিদের নাম কেন? তেজের সাথে বলল প্রিয়।

– সাজিদের প্রতি ভালোবাসা আর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে তুমি গুলিয়ে ফেলছ মনে হয়। তুমি আমার বড় ভাই। তোমাকে আমি ভালোবাসি। আজীবন বাসব। তোমার সব বিপদে আপদে আমি ছুটে আসব কারণ তুমি আমার বড় ভাই।
বারবার বড়ভাই কথাটা বলে মিথিলা প্রিয়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের যে আরেকটি সম্পর্ক আছে সেটির কথা। প্রিয় এই মুহূর্তে ট্রমার মধ্যে আছে এটা ভালো করেই বুঝতে পারছে মিথিলা। সেও ছিল খানিকক্ষণ আগে। সে চাচ্ছে প্রিয়কে বাস্তব অনুধাবন করাতে।

প্রিয়র বিশ্বাস হচ্ছে না মিথিলার কথা। তার কাছে মনে হচ্ছে মিথিলার চোখের ভাষা আর মনের ভাষা এক না। মিথিলা মুখে বলছে এক কথা আর তার চোখ বলছে অন্য কথা। মিথিলার চোখের মাঝে বেদনার ছাপ স্পষ্ট । নাকি সে মিথিলাকে পড়তে ভুল করে ফেলছে?

– আমি তোকে কিছুতেই ছাড়ছি না। সাজিদের সাথে তোর বিয়ে অসম্ভব। আমি তোর চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুই আমাকেই পছন্দ করিস। একদম মিথ্যে বলবি না। একবার সত্যি বলে দেখ। আমি তোকে এমন করে আমার বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখব কেউ তোকে খুঁজে পাবে না। কোনো কিছুর পরোয়া নেই আমার।
মিথিলাকে কিছুতেই ছাড়ছে না সে। দু’হাতে আরো শক্ত করে চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

মিথিলা ভীষণ ঘাবড়ে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ধীরে ধীরে সে। ভয় হচ্ছে সে না আবার প্রিয়র মতো পাগলামী শুরু করে। কোনোমতেই সে প্রিয়র কাছে ধরা দিতে চায় না। পালিয়ে বেঁচেছে এতটা দিন। এখন তীরে এসে সে তরী ডোবাতে চায় না। নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে বড় তার কাছে কিছুই না। ও ঘরের বউ সে কোনোদিনই হতে চায় না। রূম্পা মায়ের জীবনটাকে নরক যন্ত্রণায় ডোবাতে চায় না সে। সে যদি কোনোভাবেই স্বীকার করে সেও প্রিয়কে ভালোবাসে তবে কেউই প্রিয়কে থামাতে পারবে না আর। এই বিয়ে সে কোনোদিনই হতে দিবে না।প্রিয়র পাগলামী যে কোন লেভেলের সে জানে। খুব বেশি আবেগী প্রিয়। তাকে এখনই থামাতে হবে না হলে আরো বড় বিপদ আছে সামনে।

নিজেকে নিজেই শাসন করল মিথিলা। নিজের বোকামীর খেসারত দিচ্ছে এখন । খুব সাহস করে কিছুটা ধমকের সুরে বলল,

– ভাইয়া , তুমি কি আমার হাত ছাড়বে নাকি আমি চিৎকার দিব। এসব পাগলামীর কোনো মানে হয়? আমি তোমাকে একজন বড় ভাইয়ের জায়গায় বসিয়ে সম্মান করেছি , ভালোবেসেছি। আর তুমি কি না । ছিহ! রূম্পা মা জানলে আমি মুখ দেখাতে পারব না তার সামনে। সাজিদকেই বা কী জবাব দিব? পাগলের মতো ভালোবাসে সে আমাকে। আর আমিও ।

– হঠাৎ হাতের বাঁধন যেন ঢিলে হলো। প্রিয় মিথিলাকে ছেড়ে নিজের চোখের পানি মুছল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তার। এটা সে কী করল? এই ভয়েই সে এতদিন মিথিলার সামনে ধরা দেয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না ? কি যে হয়েছে তার? সকালে তার মা বলার সাথেই মাথায় এসেছে আজ মিথিলাকে সে জানাবেই তার অনুভূতির কথা। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না একদম। হঠাৎ নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে না পেরে কীসব করে বসল?

আর একটা কথাও না বাড়িয়ে ব্যাক সীট থেকে সামনে চলে আসলো। এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে যে মিথিলার নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। শুক্রবার তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা বলে কথা। মিথিলা পেছনের সীটে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলছে। সে বুঝতে পারছে কত ঝড় বয়ে যাচ্ছে প্রিয়র বুকে।

কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রিয় পার্লারের সামনে এসে হার্ড ব্রেক কষল। মিথিলা সবই বুঝতে পারছে । পেছনের ডোর খুলে প্রিয় মিথিলাকে বলল, পৌঁছে গেছি। নেমে পড়।
মিথিলা নামতে যাবে কিন্তু পারছে না। প্রিয় নামতে বলেছে ঠিকই কিন্তু নিজে মাথা নিচু করে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

– কিছুটা ইতস্তত করে মিথিলা বলল, আমি নামব ,ভাইয়া।

– ও হ্যা । সরি! ভুলেই গিয়েছিলাম । তোর তো আবার যাবার অনেক তাড়া। সরি ফর এভ্রিথিং। নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা। ভালো থাকিস সবসময়।

– এভাবে বিদায় জানাচ্ছে দেখে মিথিলা বলল, তুমি কি চলে যাচ্ছ? অপেক্ষা করবে না?

– অপেক্ষার প্রহর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। হা হা হা। ডোন্ট টেইক ইট আদারওয়াইজ, ডিয়ার। ফান করলাম। নাবিলা এসে পড়বে এখনি। আমি ড্রাইভারকে কল দিচ্ছি। ওই তোকে হলে নিয়ে যাবে।

মিথিলা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে প্রিয় ড্রাইভিং সিটে বসে একটানে গাড়ি নিয়ে নিমিষেই মিথিলার চোখের সামনে থেকে উধাও হলো। মিথিলার দিকে একবার ফিরলও না। মিথিলাকে একবার বাই বলারও সুযোগ দিলো না।

মিথিলা বুঝতে পারছে তার ভেতরের যন্ত্রণা। সেও যে এমন যন্ত্রণায় পুড়ছে। এখন যন্ত্রণা বুঝি আগের থেকে আরো বেড়েছে। আগে তো সে জানত সে একাই ভালোবাসে প্রিয়কে। কিন্তু এখন যখন সে জানল প্রিয়ও তাকে ভালোবাসে সে কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না। মন যেন মানছেই না। এটুকু সে ভালো করেই বুঝে গেছে প্রিয় হলে আসছে না। প্রিয়কে এতটুকু তো সে চিনেছে এ ক’বছরে।

চোখের পানি টিস্যুতে মুছতে মুছতে লিফটে উঠল তখনই সাজিদের ফোন।
একবার ভাবল রিসিভ করবে না । কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল সাজিদ তো কোনো অন্যায় করেনি ।

– হ্যালো, পার্লারে পৌঁছেছ ?

– হুম।

– খুব মন খারাপ?

– হুম!

– বুঝতে পারছি। আপন জনকে ছেড়ে আসার সময় যত ঘনিয়ে আসছে তোমার কষ্টও ততো বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই নিয়তির বিধান। নিজেকে কন্ট্রোল করো। রূম্পা আন্টি যেতে পারেন নি শুনলাম।

– হুম।
– প্রিয় তোমাকে নিয়ে গেছে । আন্টিকে কল দিয়েছিল আম্মা।

– হুম।

– কী হুম হুম শুরু করছ। মন কী বেশি খারাপ? ভয় পেও না । একবার আমার বউ হয়ে আসোই না। দেখবে এত এত আদর করব যে সব ব্যাথাকে জয় করার জন্য টাইগার বামের মত তোমার কাজে আসব। হা হা হা।

– মিথিলা জোর করেই হাসির অভিনয় করে বলল, তাই! অপেক্ষায় থাকব। আচ্ছা , রাখি । আমি এসে গেছি।

– আর শোনো ! তোমাদের ওই আটা , ময়দা , বেসন এসব একটু কম মাখবে। তুমি এমনিতেই আমার চোখে অপ্সরি। তাই আর্টিফিসিয়াল লুক এনে নিজেকে হারিয়ে ফেল না যেন। নয়ত দেখা যাবে তোমার আটা ময়দা তুলতে তুলতে আমি বাসর ঘরেই ঘুমিয়ে গেছি । ময়দার নিচের তোমাকে আর ছুঁয়ে দেখা হবে না।

– যাহ, বাজে বকো না। মুখে কিছুই আটকায় না। রাখলাম। বলেই কল কেটে দিলো মিথিলা।

চলবে।