সুখের সন্ধানে পর্ব-৩৪+৩৫

0
357

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৪

মিথিলার চোখজোড়া পুরো হলজুড়ে শুধু একজনকেই খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। সে যদিও জানে প্রিয় কখনই আসবে না এখানে তারপরেও একটু আশা যদি আসে। মন চাচ্ছে সব ছেড়েছুড়ে দু’চোখ যেদিকে সেদিকে ছুটে যায়। চারপাশে এত এত মানুষ এত এত আলোর ঝলমলানি কিছুই ভালো লাগছে না। ভারি পোশাক আর ভারি গয়নায় দম আটকে আসছে। ভাবনায় কত কথা চলছে তারপরেও কিছুই পারছে না সে। নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করছে । এত ভীতু কেন সে? কেন সে মনের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে পারছে না? ছোটবেলা থেকেই এই স্বভাবের জন্য বহুভাবে তাকে ঠকতে হয়েছে। এই স্বভাবের কারণেই সৎ মায়ের সংসারে নিজের অধিকার বজায় রেখে চলতে পারেনি। কেউ দশটা বকা দিলে মুখ বুজে সব হজম করা তার একটা রোগে পরিণত হয়েছে। নিজেই বোঝে এটা থেকে মুক্তি পাওয়া দরকার কিন্তু মুক্তির পথ তার জানা নেই। কেউ কষ্ট পাবে এমন কথা বলার কথা সে চিন্তাও করতে পারে না । তাতে নিজের যত কষ্ট সহ্য করতে হোক না কেন! এই স্বভাবের জন্যই আজ সে নিজ হাতে গলা চেপে তার আর প্রিয়র ভালোবাসাকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই খুন করছে। হয়ত সাজিদের সাথেও সে অন্যায় করছে। অন্তরে একজনকে রেখে আরেক জনের সাথে সংসার করা কতটা দুর্বিষহ সে যেন এখন থেকেই অনুভব করতে পারছে।
সাজিদ তার পাশেই বসা। মিথিলার বান্ধবীরা যেই আসছে ওর কানে কানে শুধু সাজিদের বলিষ্ঠ পৌরুষ্যের প্রশংসাই করছে। সত্যিই আজ সাজিদকে অপূর্ব লাগছে। তাকে নিজেকে কেমন লাগছে সে জানে না। পার্লারে সাজগোজ শেষ হবার পর কতবার মেয়েরা বলল, “ আয়নায় দেখুন কেমন লাগছে? আপনার কথামতোই ন্যাচারাল লুক দিয়েই সাজিয়েছি আপনাকে। “
মিথিলা ওদেরকে শুরুতেই বলেছিল , আপনারা যেভাবেই সাজান শুধু অনুরোধ মেক আপের আড়ালে আমার গায়ের শ্যাম বর্ণ লুকাতে যাবেন না, প্লিজ! আমি একটা ন্যাচারাল লুক চাই। দ্যাটস ইট!
নিপুণহাতে মিথিলাকে সাজিয়েছে অথচ ওর যেন একবারের জন্যও আয়নায় মুখ দেখতে মন চাইল না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই নিজেকে টানতে টানতে সে এখানে নিয়ে এসেছে। সাজিদ আসার পর ওর কত প্রশংসা করল অথচ মিথিলা ওকে একটিবারের জন্যও বলল না, তোমাকেও চমৎকার লাগছে বরের বেশে। সাজিদ মিথিলার কাছে এতটুকু আশা করতেই পারে। মিথিলা শুকনো একটা হাসি দিয়ে ঐ থ্যাংকস পর্যন্তই আটকে ছিল।
যেই আসছে নতুন বউ আর বরের সাথে একের পর এক ছবি তুলেই যাচ্ছে । মিথিলা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে একের পর পোজ দিয়েই যাচ্ছে । হলভর্তি এত মানুষের মধ্যে কেউই জানতে পারছে না তার বুকের ভেতর কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

কাজি এসে পড়েছে। কাজিকে দেখামাত্রই মিথিলার হুশ উড়ে গেল যেন। একবার মন চাচ্ছে এখান থেকে একছুট দিয়ে পালিয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে নিজের হাতে জীবনটাকে কী এক অজানার পথে সঁপে দিচ্ছে সে জানে না। তার চোখজোড়া চারদিকে শুধু প্রিয়কেই খুঁজে যাচ্ছে। নাহ, কোথাও নেই। এই পাগলটা যে আসবে না এটা মিথিলা জানে তারপরেও তার কেন যেন মনে হচ্ছে হয়ত কোনো মিরাকল হবে। প্রিয়র প্রতি খুব অভিমান হচ্ছে । তার শুধু মনে হচ্ছে “ আমি না হয় কিছু বলতে পারছি না কারণ আমি আজন্ম ভীতু। আমি রূম্পা মায়ের সংসারে অশান্তির বীজবপণ করতে চাই না। তাই বলেও তুমিও কি পারো না আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে তোমার জীবনে টেনে নিতে? তুমি না খুব সাহসী? তুমি না বলেছ , তুমি কাউকে পরোয়া করো না। তবে কী হলো সেই বড় বড় কথার? নাকি সবই শুধু ওই কথা পর্যন্তই? “ দু’চোখ ফেটে নোনাজল উপচে পড়ছে তার। হার্টবিট বেড়েই চলছে। আশেপাশে সবাই কী ভাবছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সাজিদ মিথিলার একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই তার। প্রিয়র প্রতি রাগ বেড়েই চলছে তার?
কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল , কেন প্রিয় আসবে তাকে নিতে? কেন মিরাকল হবে? সে তো প্রিয়র মুখের উপর বলে এসেছে, সে তাকে ভালোবাসে না। সে তাকে শুধু বড় ভাইয়ের চোখেই দেখে। তাহলে কীসের অধিকারে তাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে আসবে প্রিয়?
চোখের নোনাজলে চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই আর ভাবতে পারছে না।
নাহ, কোনো মিরাকল এল না তার জীবনে। কাজির কথায় বিনা বাক্যে “কবুল” শব্দটি বলতেও একফোঁটা দ্বিধা হলো না তার। পাশ থেকে তাকে যা করতে বলা হচ্ছে সেও রোবটের মত সেই ডিরেকশান অনুসরণ করেই যাচ্ছে। গল্প সিনেমার নায়িকাদের মতো কবুল বলার আগ মুহূর্তে তার নায়ক তাকে এসে বাঁধা দিলো না একদমই।

আমি কিছুটা দূরে বসে আছি মিথিলার থেকে। ওর পাশে যাবার সাহস হচ্ছে না। মিথিলা আমার থেকে যেন ওই তিনটি শব্দ বলার সাথে সাথেই অনেক দূরে চলে গেল। সকালের ক্লান্তি এখন অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি আমি। কিন্তু বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ এসে বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু। গেস্টদের দিকেও ঠিকঠাক খেয়াল করতে পারছি না। মিথিলার থেকে দূরে দূরে থাকছি। কাছে গেলেই দু’জনেই এই হলভর্তি মানুষের মধ্যেই সকালের মতো গলা ধরে কান্না শুরু করব নিশ্চিত। দূর থেকেই একজোড়া ঝাপসা চোখে আরেক জোড়া ঝাপসা চোখকে অনুভব করছি। ওই ঝাপসা চোখজোড়ায় বেদনার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। নিজের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল যেন। আমিও এমন স্টেজে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে আমার মা আর ছোট বোন টুম্পার ঝাপসা চোখগুলিকে ছুঁয়ে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। বাবা কঠিন মানুষ ছিলেন । সহজে কারো সামনে চোখ দিয়ে পানি পড়ত না। কিন্তু সেদিন বিদায় বেলায় সেও পারেনি তার সেই কাঠিন্যকে ধারণ করে থাকতে। স্মৃতির পাতা যেন আজ চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।
সেদিনের বউবেশে দাঁড়িয়ে থাকা রুম্পার মাঝে আর এই মেয়েটার মাঝে আমি কোনো তফাৎই খুঁজে পাচ্ছি না। মিথিলাও হয়ত আমাদেরকে ছেড়ে যাবার কষ্ট মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডায় কে?
আমার পাঁজর ভেঙ্গে কান্না আসছে। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সাগরের ঢেউয়ের মত গর্জন করে নোনাবাণ শুধু জানান দিয়ে যাচ্ছে এখনই হয়ত তীর ছুঁয়ে উছলে পড়বে অবাধ্য ঢেউয়ের মতো।
আমার এমন একটা কষ্টের মুহূর্তে আমার আপন মানুষেরা আমার সাথে নেই। সেলিম কোনোরকম একবার ঢু মারলেও প্রিয়র তো নামগন্ধই নেই। এতবার কল দিচ্ছি রিংও হচ্ছে কিন্তু সে ফোন তুলছে না। আমাকে অবশ্য একবার মেসেজ করে জানিয়েছে , সে এখানে আসবে না। গতরাতে হলুদের প্রোগ্রামের পর সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । ভীড়বাট্টা তার পছন্দ না। এটাই তার অজুহাত।
এসব সামাজিকতা, এত মানুষের ভীড় তুই পছন্দ করিস না আমি জানি। তাই বলে নিজের বোনের বিয়েতেও থাকবি না। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে বুঝি না। ওকি শেষ পর্যন্ত বাপের ছায়াই অনুসরণ করছে কি না কে জানে! ওর বাবাও অনেকটা এ রকম । শুধুমাত্র বিজনেস রিলেটেড প্রোগ্রাম ছাড়া কোথাও যেতে তার বড্ড এলার্জী। ওর বাবাকে আমি আর রাগ করে কলই দেইনি। তোমার মেয়ে না হোক এত এত আত্মীয় স্বজনের সামনে অন্তত সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেও তো তার এখানে থাকা উচিত ছিল। অথচ আমাকে কিছু না বলেই সে হাওয়া। কতজনকে আমি মিথ্যে বলব? জরুরী প্রয়োজনে হলিডেতেও তার বিজনেস মিটিং এটেন্ড করতে হয়েছে এই একই অজুহাত বলতে বলতেও ক্লান্ত আমি। অথচ এই বিয়ে অনুষ্ঠানের তিনের দুই গেস্টই তার সাইডের। সেই পরোয়াটুকুও করল না একবার। আমার শাশুড়িও তার এমন আচরণে মর্মাহত। তাকেও তো কম জনকে সামলাতে হচ্ছে না।
এদিকে প্রিয়কে এতবার কল দিচ্ছি অন্ততপক্ষে একবার রিসিভ করে কথা তো বলবি। শুনবি তো আমি কী বলতে চাই। আমার এমন মুহূর্তে তোর পাশে থাকাটা কি নৈতিকবোধের মধ্যেও পড়ে না? বাপের মতো ভালো লাগে না তাই করব না বলেই খালাস। আরে ভালো তো আমারও কতকিছু লাগে না। তাও কি আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখি? এটাই হচ্ছে ওদের আর আমার মাঝে পার্থক্য।
বেশিরভাগ মেহমানই এতক্ষণে চলে গেছে। মিথিলা এমনিতেও শান্ত আর আজ তো যেন শান্ত নদীর মতো হয়ে গেছে। আমি কাছে গেলেই যে এই শান্ত নদীতেই একটা বড়সড় বাণ ডাকবে সে আমি ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। সেই ভয়ে একদমই যাচ্ছি না। আমার শাশুড়ি অবশ্য ওর পাশেই বসে আছে। আমার শাশুড়িও মিথিলা চলে যাবে সেই কষ্টে ব্যাথিত। ওনার এত এত সেবা মেয়েটা করেছে! কি করে ভুলবেন ওর এই শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার কথা! আমি এতবছরেও যতটুকু স্থান ওনার কাছে করতে পারিনি সেটুকু মিথিলা পেরেছে। এটুকুই আমার প্রশান্তি।
প্রিয়র বন্ধু অনিকেত এসে হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিলো। বেশ কিছুদিন পরে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল বলে প্রথমে আমি চিনতে না পারলেও পরিচয় দিতেই চিনে ফেললাম। অবাক হলাম প্রিয়র আক্কেলের কথা ভেবে। বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছে অথচ নিজের খোঁজ নেই।
– আন্টি , আপনি এখানে?
– ও মা! আমার মেয়ের বিয়ে আমি থাকব না?
– প্রিয়র বোন আছে জানা ছিল না তো!
– মিথিলা আসলে আমার বোনের মেয়ে । আমার কাছেই আছে ওর মা মারা যাবার পর থেকে। তোমাকে ইনভাইট প্রিয় করেনি? তাহলে তো জানার কথা।
– অনিকেত একটু কি যেন ভবে বলল, আমাকে সাজিদ কার্ড পাঠিয়েছিল । তবে ও যে প্রিয়র কাজিনকে বিয়ে করেছে এটা বলেনি। আচ্ছা, প্রিয়কে দেখছি না?
– কই যে গেছে আমিও জানি না। ছেলেটা এত একগুঁয়ে ! আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে বলে দিয়েছে, সে আসবে না। ব্যাস শেষ। ভিড় নাকি তার পছন্দ না। এতবার ফোন দিলাম । আমাকে বোঝানোরও সুযোগ দিলো না। নিজের বোনের বিয়েতেও থাকবি না! কেমন মানুষ বলো তো! কম করে হলেও পঞ্চাশবার কল দিয়েছি। মেসেজ দিয়েছি কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই। আচ্ছা, বাবা! তুমি খাওয়া দাওয়া শেষ করেছ তো? কোনো অসুবিধা হয়নি তো? তুমি এসেছ আমি তো জানিই না।
– জি আন্টি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি খেয়েছি। সব ঠিক ঠাক আছে। আমাদের আরো কয়েকজন ফ্রেন্ড এসেছিল । একসাথে খেয়েছি। ওরা প্রিয়রও ফ্রেন্ড। ওরা চলে গেছে সবাই সাজিদের সাথে দেখা করে। ওরা তো জানেই না সাজিদ প্রিয়র কাজিনকে বিয়ে করছে। প্রিয় থাকলে অবশ্য মজা হতো ।
– যাও ,সাজিদের সাথে দেখা করে আসো তবে। আমি একটু এদিকটা দেখছি। বাসায় এসো বাবা। তোমরা তো বাসায় আসোই না এখন আর। সবাই বড় হয়ে গিয়েছ তাই আন্টিকে ভুলে গেছ।
– না , না । আন্টি। তেমনটা না। ব্যস্ততা বাড়ছে বোঝেনই তো । আসব একদিন।
আমি অনিকেতকে রেখে অনেকটা দূরে চলে এসেছি আবার কী মনে করে পেছনে ফিরে দেখলাম অনিকেত আমার দিকে তাকিয়ে এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমি ওর দিকে ফিরতেই দ্রুতপায়ে আমার কাছে এসে বলল, আন্টি ব্যস্ত বুঝতে পারছি কিন্তু আমাকে মিনিট দুয়েক সময় দিবেন? একটু কথা বলতাম!
– হ্যা , বলো বাবা। কিছু কী ভুলে গিয়েছিলে বলতে?
– এখানে না। একটু বাইরে আসেন।

আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওর পিছুপিছু কিছুটা নিরিবিলি জায়গা যেয়ে দাঁড়ালাম ।

– আন্টি, আমি প্রিয়র ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
– হ্যা, বলো বাবা।
– কিছুটা ইতস্তভাবে অনিকেত বলল, আসলে কিভাবে বলি!
– বলো বাবা। এত হেজিটেশানের দরকার নেই।
– আসলে এই মুহূর্তে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা জানি না। তবুও প্রিয়র জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাই না বলে পারলাম না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে প্রিয় কোনো প্রবলেম করেছে । না হলে এখানে ঠিকই আসত । ওকে তো চিনি আমি। আর একজন সাইকাট্রিস্ট হিসেবে একটু মনে হয় বেশিই চিনি ওকে। ও যে পাগল! খুব বেশি আবেগী জানেনই তো!
– আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম , মানে! কী হয়েছে? খুলে বলো তো ! কী হয়েছে প্রিয়র? অনিকেতের কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠল আমার।
– আপনি কিছুই জানেন না?
– কী জানব? আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । কীসব বলছ তুমি? তাড়াতাড়ি বলো। কী হয়েছে আমার ছেলের?
– আপনি সত্যিই জানেনা না। প্রিয় তাহলে আপনার সাথে শেয়ারই করেনি? মাই গড! ছেলেটাও পারেও।
– মানে? কী শেয়ার করবে? এত ধাঁধা রেখে সোজাভাবে বলো। রেগে গিয়ে বললাম আমি।
– আন্টি । প্রিয় তো মিথিলাকে পছন্দ করে। মাত্র ক’দিন আগেই আমার কাছে কত কথা শেয়ার করল। ও মিথিলাকে সাজিদের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো কী করে? আর আমার তো মনে হয় মিথিলাও পছন্দ করে প্রিয়কে। ওর চোখেও আমি বিষণ্ণতা দেখে এলাম। একজন নববধূর চোখে এত বিষণ্ণতা থাকার কথা না ।
– হোয়াট? তোমার মাথা ঠিক আছে? কী বলছ?
– ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলছি , আন্টি। এরমধ্যে এক বর্ণ মিথ্যে নেই। উফ, ছেলেটা এত বেশি পাগল। এত বড় ব্যবসায় সামলায় অথচ নিজের জীবনের সাথে এমন ?

আমার এবার গলা শুকিয়ে এল। আমি সবকিছু মেলাতে লাগলাম । অনিকেত তো মিথ্যে বলবে না। সত্যিই কী তবে ওরা? না, না। এটা কী শুনছি আমি?

– বাবা, এসব কী বলছ? আমি তো ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেলাম না। ও তো বিন্দু না কাকে যেন পছন্দ করত! কিছুই তো বলেনি ওরা আমাকে? ওহ আল্লাহ!
– আন্টি , প্রিয় নিজের মুখে স্বীকার করেছে। আর বিন্দুর ব্যাপারটা বোধ হয় এখন ক্লোজ হয়ে গেছে । মেয়েটা ফ্রড। জানি না ও মিথিলাকে পছন্দ করে এ ব্যাপারে ওকেও কিছু বলেছে কি না!
– কিন্তু মিথিলা যে বলল, সে সাজিদকে পছন্দ করে। এজন্যই তো তড়িঘড়ি করে বিয়েটা হচ্ছে।
– আমি আন্টি জানিনা আসলে কী হয়েছে?
– এজন্যই কী তবে প্রিয় এ ক’দিন ধরে এত আপসেট? ওহ মাই গড! ও আমাকে কিছুই তো বলেনি। আমি তো এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। ও আমাকে একবার বলত!
আমি যে করে হোক মিথিলা রাজী না থাকলেও রাজী করাতাম । মিথিলা আমাকে না করতে পারত না আমার বিশ্বাস। এটা কী হয়ে গেল আমার বাচ্চাটার সাথে? আল্লাহ, রক্ষা করো।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। আমার ছেলেটার ভেতরে এসব চলছে অথচ আমি একবারের জন্যও টের পেলাম না। এজন্যই কি ও মিথিলাকে পার্লারে রেখেই ওভাবে চলে এসেছিল? আগের রাতে নেশা করে পড়েছিল চিলেকোঠায়? আর মিথিলা ? ও যে সকালে কান্না করে বলেছিল , “ ভেবেছিলাম সারাজীবন তোমার কাছে থেকে যাব” । মিথিলা কি আমাকে কোনো মেসেজ দিতে চেয়েছিল? আমার অগোচরে কী ওদের মাঝে কিছু চলছিল? মিথিলা আর সাজিদের ব্যাপারটা বোঝায় কি আমি ভুল করে ফেলেছিলাম? আর মিথিলাই বা কেন বিয়ের জন্য এত তড়িঘড়ি করেছিল? কী ঘটেছিল আসলে? আমি এতটা উদাসীন কী করে হলাম ? আমি এতটা ব্যর্থ মা ?
আমার ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে ? সে কোথায় ? কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসেনি তো?
প্রশ্নের পর প্রশ্ন আমার কলিজায় এসে তীরের মতো বিঁধছিল । আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। চারপাশে এত মানুষ কিন্তু আমি কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছি না। হতাশায় ঘিরে রেখেছে চারপাশ আমার।
অনিকেত আমার হাত ধরে টেনে তুলল।
– আন্টি , আমি বুঝতে পারছি আপনার মাঝে কী ঘটছে। আমাকে ক্ষমা করবেন । এমনটা হতে পারে ভেবেই আমি প্রথমে বলতে চাইনি। আসলে এখন তো করারও কিছু নেই। বলে লাভও নেই। কিন্তু প্রিয়র কথা ভেবে না বলে থাকতে পারলাম না। আপনার স্ট্রং হতে হবে। আশেপাশে সবাই দেখছে। কী ভাববে সবাই? আপনার কোনো ভুল স্টেপ মিথিলার নতুন জীবনকে হ্যাম্পার করবে। প্লিজ, এখন প্রিয়র কথা ভাবতে হবে। ও কোথায় থাকতে পারে আন্দাজ আছে কিছু?

– আমি কিছু জানি না , বাবা। কাঁপা গলায় বললাম আমি।
– বাসায় একটু কল করে দেখবেন কি?

আমি দ্রুত বাসায় কল দিলাম টিএন্ডটি নাম্বারে। একটা কাজের মেয়ে ফোন ধরলে ওকে জিজ্ঞেস করলে জানাল, প্রিয় বাসায় যায়নি। ভালো করে ছাদে আর ওর রুমে খোঁজ নিয়ে দেখতে বললাম। কিন্তু উত্তর একই। প্রিয় কথাও নেই। পরিচিত যেসব জায়গা থাকতে পারে সেসব জায়গায় খোঁজ করলাম , অফিসে কল দিলাম কিন্তু নাহ, প্রিয় নেই।
হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আমার। কোথায় আছে ছেলেটা? এতবার রিংয়ের পর রিং হয়ে যাচ্ছে ফোনই ধরছে না। অনিকেতও বারবার ট্রাই করছে কিন্তু কোনো খোঁজ নেই।
– আন্টি, আংকেলকে কল দিন। আর মনে হয় অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। আর আমাদের এখান থেকে এখনই বের হতে হবে। আপনি যেভাবে হোক ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি বের হন। ওর কল যেহেতু বাজছে ওকে ট্রেস করা যাবে। আমার পরিচিত সোর্স আছে। কুইক করেন। আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। না হলে আরো ঝামেলা শুরু হবে।
আমি আর কিছু না ভেবে আমার শাশুড়ি আর মিথিলার কাছে বলার জন্য স্টেজের দিকে পা বাড়ালাম। স্টেজ এখন কিছুটা ফাঁকা । সাজিদের মাকেও কিছু একটা এমার্জেন্সীর কথা বলে বেরুতে হবে নইলে ওনারা আবার অন্যভাবে নিবে।

আইমানকে স্টেজের দিকে আসতে দেখে মিথিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। বেয়াদবটা ওকে অনেকক্ষণ ধরেই এটাসেটা বলে জ্বালাচ্ছিল। এখন আবার কেন আসছে কে জানে! ছোট চাচার আত্মীয় হিসেবে দাওয়াত পেয়েছে। খুব রাগ লাগছে ওকে আসতে দেখে।

– আমাকে দেখে বিরক্ত হচ্ছো বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। কিউরিয়াস মাইন্ড অনেকক্ষণ ধরে একটা ব্যাপারে জানতে চাইছে। তাই বাধ্য হয়ে আসা। নইলে আসতাম না।
– কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
– সারাবছর প্রেম করলে কাজিনের সাথে আর এখন মালা পড়ালে অন্যজনকে। মানেটা কী? নাকি কাজিন একদম ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া করে ছুঁড়ে ফেলেছে? তাই এখন এই মদনের গলায় ঝুলে পড়লে? এটা অবশ্য আমি শুরুতেই বুঝেছিলাম। আমাকে বলতে পারতে। আমি কিন্তু সব জেনেশুনেও আপত্তি করতাম না। ব্যাড লাক ! আমার ভাগ্যে নেই। সেই ছোটবেলা থেকে পিছে পিছে ঘুরলাম অথচ দুধের সর কারা কারা খেয়ে গেল। আমি কাঙ্গাল কাঙ্গালই রয়ে গেলাম।

শ্লেষ টেনে কথাগুলি বলতে বলতেই সাজিদকে দেখে মিথিলার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই স্টেজ ছেড়ে নেমে গেল । মিথিলা কিছু বলতে যাবে তাকিয়ে দেখে পাশেই সাজিদ দাঁড়ানো । সাজিদ বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মিথিলার দিকে। তার চোখে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্পষ্ট। পেছন থেকে এসে সাজিদ যে সবকিছু শুনে ফেলেছে এটা মিথিলা নিশ্চিত ।

সাজিদ কিছু বলার আগেই মিথিলা বলল,
– প্লিজ, ওই বেয়াদবটার কথায় কান দিও না। এমন আজেবাজে কথা বলাই ওর স্বভাব। প্লিজ!
– রূম্পা আন্টি আসছে । মুখ বন্ধ করো। পরে কথা বলছি। আমি এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না, প্লিজ। তাছাড়া এখানে আমার অনেক রিলেটিভস আছে ।

কথাগুলি চাপাস্বরে বললেও সাজিদের ভয়েস টোন শুনে মিথিলার মনে হচ্ছে এখন সত্যি সত্যি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। এত লোড নেওয়া আর তার পক্ষে সম্ভব না। কী হচ্ছে তার সাথে এসব? সে তো কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি, কারো ক্ষতি করেনি। তবে তার সাথে এতসব খারাপ হচ্ছে কি অপরাধে?

চলবে……

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৩৫

উদ্বিগ্ন হয়ে থানার বারান্দায় পায়চারি করছি আমি। সেই কখন থেকে সেলিম শুধু আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ছেলেটা হাজতের ভেতর গরমে হাঁসফাঁস করছে দেখে এলাম। ওর মনের ভেতর কী চলছে সে আমি ভালো করেই টের পাচ্ছি। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। মা হয়ে ছেলের মনের খবর টের পেলাম না। চোখের সামনে ছেলেটার সুখের পায়রা আমি উড়িয়ে দিলাম নিজের হাতে? মা হয়ে দু’দুটো সন্তানের চোখের ভাষা আর মনের আকুতি আমি বুঝলাম না। কেমন মা আমি? কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারছি না।

ছেলেটা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে এক সবজি বিক্রেতার সবজির ভ্যানের উপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে। লোকটার অবস্থা খারাপ। একটা পা মনে হয় কাটা পড়বে। ভাগ্য ভালো যে উনাকে জানে মারেনি। বেচারার অবস্থা দেখে আমারও খারাপ লেগেছে। দোষ আসলে ভাগ্যের। প্রিয় তো ইচ্ছা করে ওনার এমন হাল করেনি। আমি হাসপাতালে যেয়ে ওনার খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। একটা পায়ের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ । ডাক্তার বলেছে ওই পা দিয়ে আর হাঁটতে পারবে বলে ভরসা নেই। ওনার মা আর বউ আমাকে দেখে কত যে শাপ শাপান্ত শুরু করল সে আর বলতে পারছি না। ওনারা ওনাদের জায়গায় ঠিক আছে। ছোট ছোট দু’ তিনটা বাচ্চা লোকটার। নিজেদের ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম আর প্রিয় মানুষটির এমন অবস্থা দেখলে কারোরই মাথা ঠিক থাকবার কথা না। আমি দু’ হাত জোর করে ক্ষমা চেয়েছি। ওনার সুস্থতার জন্য যা কিছু করতে হয় করব বলে আশস্ত করে এসেছি।

প্রিয়র মানসিক অবস্থা সেলিম হয়ত বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি। মিথিলাকে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে সেখান থেকে মাত্র কিছুদূর এগুতেই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নিজেই ওই আহত সবজি বিক্রেতাকে ঢাকা মেডিকেলে এডমিট করেছে। ওখানে যাবার সাথে সাথেই এরেস্ট করেছে প্রিয়কে। প্রথমে নিজের মতো করে সলভ করার চেষ্টা করছিল । কাউকে জানাতে চায়নি। পরে যখন সম্ভব হয়নি তখন বাধ্য হয়ে সেলিমকে ফোন দেয়। আর মিথিলার বিয়েতে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে তাই আমাকে বা অন্য কাউকে কিছু জানাতে নিষেধ করে প্রিয়। ওর ফোন থানায় জব্দ হয়েছে। তাই আমার এতবার ফোন দেবার পরেও ও রিসিভ করতে পারেনি। ফোন তো ওর কাছে ছিলই না। আর আমি কিনা ওকে নিয়ে কিসব উল্টাপাল্টা ভেবে বসেছিলাম। সেলিমকে নিয়েও কত ভালোমন্দ ভেবেছি। খুব লজ্জা হচ্ছে নিজের উপর।
আমার শাশুড়িকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম এতক্ষণে মিথিলার বিদায় শেষ। আমি না থাকায় খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। যদিও আমি আসার আগে ওকে বলে এসেছি অফিসে বেশ বড়সড় একটা ঝামেলা বেঁধেছে যেখানে না গেলেই না। সেলিম একা সামাল দিতে পারছে না। আমার যাওয়াটা খুব জরুরী । না হলে কী মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান রেখে আসতে হয়! সাজিদের মা খুব আফসোস করলেও উনি আমার সমস্যা বুঝেছিলেন। মিথিলা শুধু ফ্যালফ্যাল করে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারিনি। সেখান থেকে বিদ্যুত্বেগে ছুটে এসেছি থানায়।

সেলিমকে ফোন দিতেই সবকথা বলে দেয় আমাকে। ছেলের এমন বেহাল দশ দেখে সেও ঘাবড়ে যায়। তাই আমি ফোন করতেই আর কিছু গোপণ করতে পারেনি আমার কাছে। আমি তখনই অনিকেতকে নিয়ে ছুটে আসি এখানে। প্রিয় সারাদিন কিছু খায়নি। সেলিমেরও একই হাল। ছেলের এমন অবস্থায় খাওয়া দাওয়া কী করে হবে। ঘণ্টা দেড়েক বাদেই অফিস আওয়ার শেষ হয়ে যাবে। আজ যদি প্রিয়কে কোনোভাবে বের করা না যায় তবে রাতটা এখানেই পার করতে হবে । সকালে ওর কোর্টে চালান হয়ে যাবে। আমি ভাবতেও পারছি না। আর কোর্ট থেকে জামিন পাওয়া যে কী ঝামেলা! দীর্ঘ একটা প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হবে!

সেলিম উপর মহলের কাউকে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করেছে। এখন উত্তরের অপেক্ষায়! হাত পা অবশ হয়ে আসছে। প্রিয়র মনের কথা ভেবেই আমি আরো অস্থির হচ্ছি। পাগল ছেলেটা আমার। একদিকে মিথিলাকে হারানোর কষ্ট আরেকদিকে নিজের এমন বেহাল দশা। এত সমস্যার মধ্যেও সে অনিকেতের কাছে মিথিলার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছে। অনিকেতই জানাল আমাকে । অনিকেত আছে তাই কিছুটা সাহস পাচ্ছি। আমাকে আর সেলিমকে মানসিকভাবে খুব সাপোর্ট করছে। আর প্রিয়র জন্যও খুব ভালো হয়েছে ও থাকাতে। আমাদের কাছে কোনো মনের কথা শেয়ার করতে না পারলেও অনিকেতের সাথে মন খুলে কথা বলছে। অবশ্য ও নিজে থেকে কিছুই বলছে না। অনিকেত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করে ওর মন হালকা করার চেষ্টা করছে। আমি ওর সামনে যেতেই ভয় পাচ্ছি।

মনে হচ্ছে নিজের হাতে ছেলের জীবনটাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিলাম। কেন যে মিথিলার বিয়েতে এত তড়িঘড়ি করলাম? এমনটা তো আমার সাথে যায় না। আমি সবকিছু ধীর স্থিরভাবে করতে পছন্দ করি অথচ সাজিদের পরিবারের আবদার রক্ষা করতে যেয়ে এতটা তড়িঘড়ি না করলেই পারতাম। কী যে হয়েছিল নিজের সাথে বুঝতে পারছি না। নাকি সবই বিধির বিধান! ছোটবেলা থেকে শুনেছি জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিন আল্লাহর হাতে! আল্লাহ কী তবে এটাই চেয়েছিলেন? মিথিলার জন্য সাজিদই লেখা ছিল তাই হয়ত সবকিছু এমন করে হয়েছে। নয়ত আমিই বা কেন আমার ছেলেটার মনের খবর ঘুণাক্ষরেও টের পেলাম না। প্রিয়ও তো আমার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করতে পারত! ওর সাথে আমি সব বিষয়ে খুব ফ্রী। অথচ!

যাক সব বিধির বিধান! যা হয়ে গিয়েছে সে তো আর খণ্ডাতে পারব না। এখন মিথিলা সুখে থাকলেই আমার শান্তি কিছুটা । আর ছেলেটাকে যে করে হোক স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে!

সারাদিন আমার পেটেও আজ দানাপানি পড়েনি। শরীরটাও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সেদিকে মন দেয়ার সময় আমার নেই। মাথা ফেটে যেন ঘিলু বেরিয়ে যাবে এত পেইন হচ্ছে । কিন্তু চিন্তার বেড়াজালে আমি বন্দি । আমি হাজার চিন্তায় বুঁদ হয়ে ডান হাতে কপাল চেপে ধরে বারান্দার একটা টুলের উপর মাথা নিচু করে বসে আছি। তখনই অনিকেত হাসিমুখে দৌড়ে এসে আমাকে ডাক দিলো।

– আন্টি, সুখবর আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কল দিয়ে কাজে এসেছে। গ্রীণ সিগনাল পেয়েছি। আঙ্কেলের অপরিচিত লোক বুদ্ধি দিয়েছেন যে ওই পরিবারের সাথে কথা বলে যেভাবে হোক মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে। ওই লোকের পরিবারের সাথেও কথা বলেছে আংকেল। তারা মামলা তুলে নিতে রাজিও হয়েছে।

বিনিময়ে আংকেল কথা দিয়েছেন উনার সমস্ত চিকিৎসা ব্যয় বহন করবেন। দেশের চিকিৎসায় কাজ না হলে প্রয়োজনে ইন্ডিয়া বা অন্য কোনো দেশে নিয়ে ওনার কৃত্রিম পা সংযোজনের ব্যবস্থা করে হবে। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত উনার চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের সমস্ত ভরণপোষণও করবেন। আর সুস্থ হবার পর উনার কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। উনারা প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলে পরে স্টাম্প পেপারে এগুলো উল্লেখ করে একটা দলিলের মতো করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওসি সাহেবই দায়িত্ব নিয়ে সব করছেন।
ড্রাইভার আজাদ অলরেডি মামলার বাদী মানে ওনার স্ত্রীকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। ঈশ্বরের কৃপায় প্রিয় মুক্ত হয়ে যাবে। চিন্তা করেন না , প্লিজ।

অনিকেতের মুখে সবকিছু শুনে আমার হাউমাউ করে কান্না আসছে। সেলিমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে যাচ্ছি আমি। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য সে কি না করেছে!

সাজিদরা বাসায় পৌঁছেছে ঘণ্টাখানেক হলো। মিথিলার যদিও এ বাসা আগে থেকেই পরিচিত। তারপরেও কেন যেন আজ খুব অপরিচিত লাগছে তার। সাজিদকে আসার পর আর এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও দেখেনি সে। নানান ধরণের ফর্মালিটিতে ব্যস্ত সবাই। মিথিলা মুখ ভার করে বসে আছে। একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে ঘোমটা খুলে তাকে দেখছে। এতবড় ঘোমটা টেনে বসে আছে বলে সবাই হাসাহাসি করছে। সবার একই কথা এমন ঘোমটা টেনে বসে থাকার যুগ কি আর এখন আছে?
মিথিলা ইচ্ছে করেই নিজেকে আড়াল করে ওড়নাটা টেনে মুখ ঢেকে বসে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন তার। মনের মধ্যে কত কথা ঘুরপাক খাচ্ছে । প্রিয়কে ভীষণ মনে পড়ছে। সেই যে সকাল বেলা গেল এখনো পর্যন্ত তার খবর জানে না। আর রূম্পা মাই বা অমন করে হাওয়া হয়ে গেল কেন? ছুটির দিনে কী এমন এমার্জেন্সী কাজ হতে পারে অফিসে? এমন তো আগে কোনোদিন হয়নি। নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে তার মনের কোণে।

মিথিলাকে সন্ধ্যার দিকে নিজের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ফুল দিয়ে ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারপাশটা ভালো করে দেখল মিথিলা। তার পছন্দের গন্ধরাজ আর কামিনিও আছে। এটা যে সাজিদের প্লান সে বুঝতে পারল কারণ সেই বলেছিল গন্ধরাজ আর কামিনীর খান তার খুব প্রিয়। পুরো রুমে ফুলের গন্ধে এক ধরণের মাদকতা সৃষ্টিকারী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মিথিলা ফুলের গন্ধে যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে যাচ্ছিল।

সাজিদের বোন শান্তা আর আরো কয়েকজন মেয়ে মে বি ওরা সাজিদদের কাজিন হবে ওরা এসেছে ওর সাথে। ওরা নানা ধরণের মজার মজার কথা বলে মিথিলাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। মিথিলাও হাসিমুখে ওদের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। শান্তা মিথিলার লাগেজ বের করে নিজের হাতে মিথিলার কাপড়চোপড় আলমারীতে গুছিয়ে রাখছে। সাথে অন্য কাজিনরাও হাত লাগাচ্ছে। ওদের আন্তরিকতা দেখে মিথিলা মুগ্ধ।

বিশেষ করে শান্তা! শান্তা বয়সে বা একাডেমিক ক্যারিয়ারে সবদিক থেকেই মিথিলার থেকে বড় হয়েও মিথিলার সাথে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলছে। আর ওর ব্যবহার এতটা আন্তরিক যে মিথিলার মনেই হলো না শান্তার সাথে মাত্র দু একদিনের পরিচয়। যদিও এর আগে একদিন বাসায় এসে কিছু সময়ের জন্য কথা হয়েছি ওর সাথে।

মিথিলার চোখ চারপাশে শুধু সাজিদকে খুঁজছে । না জানি সে তাকে ভুল বুঝে কী না কী ভেবে বসে আছে! খুব কান্না আসছে তার। এক সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে না জানি কোন নতুন সমস্যার জালে আবার জড়িয়ে যাচ্ছে সে । সৎ মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে এসেছিল খালার বাসায় আবার সেখান থেকে নতুন সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে এসেছে স্বামীর ঘরে। নিজের জীবনটাকে তার কচুরিপনার মতো মনে হচ্ছে। ভাসতে ভাসতে একবার এ ঘাটে তো আরেকবার ও ঘাটে। কেন যে অন্য মেয়েদের মতো সাহসী না সে?

মিথিলার বিচলিত মুখখানা শান্তার দৃষ্টিগোচর হতেই পাশে বসে বলল,

– কী ভাবি! ভাইয়াকে খুঁজছ ?

– না মানে?

– লুকোচুরি করার কিছু নেই। তোমার চোখে স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি।

– আসলে আপু!

– আপু? হা হা হা! আমাকে তুমি নাম ধরে ডাকলেই খুশি হব। আমি তোমার ননদ হলেও বয়সে বড় তাই আপু ডাকছ বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা কিন্তু বেশ বেমানান দেখাচ্ছে। আমাকে ননদ ভাবারই দরকার নেই । তুমি বন্ধু মনে করে নাম ধরে মিষ্টি করে ডাক দিলেই বেশি খুশি হই এই অধম। এতদিন আমার কোনো বোন ছিল না। আজ একটা বোন পেয়েছি। আর বোন মানেই তো বন্ধু। তাই প্লিজ! শুধু শান্তা, ওকে?

– মিথিলার চোখ ভিজে এল শান্তার আন্তরিকতায়। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, হুম।

– এ বাসাতে তোমার যেকোনো সমস্যা তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করো ভাবি। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব তোমার পাশে থাকার। কখনো মনে করবে না আপন জন ছেড়ে এসেছ। আমাদের আম্মাও খুব ভালো মানুষ। তোমার মনেই হবে না তুমি নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছ। কিছুদিন গেলেই বুঝবে এক মায়ের বুক খালি করে আরেক মায়ের বুকে এসেছ।

– আমিও একজন মা’ই যে চাই। শাশুড়ি চাই না। আবেগের সাথে ভেজাকণ্ঠে বলল, মিথিলা।

– তোমার আশা পূর্ণ হয়েছে ভাবি! আচ্ছা, এসব আবেগি কথাবার্তা ছাড়ো। এখন বলো কি করবে ভাইয়া আসা পর্যন্ত এই আধামণ ওজন পড়ে বসে থাকবে নাকি হালকা কিছু দিব, চেঞ্জ করবে? তুমি তো বহু সময় ওয়াশ রুমেও যাওনি। ওই পাশে তোমার ওয়াশ রুম। একটু ফ্রেশ হয়ে এসো। ভালো লাগবে। আমি হলে সব এতক্ষণে খুলে রিলাক্স হতাম আগে। মাই গড ! সারাদিন কী করে থেকেছ তুমি? আমারই কষ্ট হচ্ছে তোমাকে দেখে। মেয়ে হয়ে জন্মালে কত যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! ছেলেদের শান্তির অভাব নেই। ভাইয়াকে দেখো! এসেই সব খুলেটুলে নর্মাল ড্রেস পরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সাব্বিরের রুমে।

মিথিলা বুঝতে পারল সাজিদ তাহলে ঘুমাচ্ছে এজন্যই তার সাথে এতক্ষণ দেখা নেই।
সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তার কি শাড়ি পরেই সাজিদের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নাকি চেঞ্জ করবে সে কনফিউজড।

– শান্তা বুঝতে পেরে বলল, ভাইয়া সারাদিন বহু দেখেছে তোমাকে এই সাজে। তার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকার দরকার নেই। আর ভাইয়া যে ঘুম পাগল। এই ক’দিনের ব্যস্ততায় ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি। এই রুমে ঢোকার অনুমতি না পেয়ে নাক ডেকে সাব্বিরের রুমে যেয়ে ঘুমাচ্ছে। কতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গবে খবর আছে? তুমি এগুলো চেঞ্জ করে আসো । আমি তোমাকে হালকা করে একটু মেকওভার করে দিচ্ছি। যাও।

শান্তার আন্তরিকতায় মিথিলায় সাহস পায়। সে ফ্রেশ হবার জন্য গেল। আধাঘণ্টা পরে মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরল। একটা টকটকে লাল কালারের জামদানী নিয়ে অপেক্ষা করছে শান্তা। মিথিলাকে খুব সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিলো। হালকা প্রসাধনী আর গয়নায় চমৎকার লাগছে। চুলগুলি ছাড়া রেখে একপাশে ক্লিপ দিয়ে একটা কাঁচা ফুলের মালা পরিয়ে দিলো। একটা টিপ পরাতে গেলে মিথিলা একটু আপত্তি জানায়। সে বলল, আমি তো টিপ পরি না।

– টিপ পরলে তোমাকে কিন্তু চমৎকার লাগবে। ছোট একটা পরিয়ে দেই।

– সরি, শান্তা! আমি ছোটবেলা থেকেই টিপ পরি না, তাই ববলছিলাম কি!

– কেন পরো না? শান্তা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

– আমার দাদি পছন্দ করতেন না। আম্মু মাঝেমাঝে পরিয়ে দিলে দাদি আম্মুকে বকাঝকা করতেন। এটা নাকি আমাদের ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। দাদি আমাকে সেই নবীদের আমলের ঘটনা খুলে বলেছিলেন। পরে ভেবে দেখলাম শুধুশুধু উনাকে কষ্ট দিয়ে এই একটা টিপ না পরলেই বা কি! তাছাড়া আম্মুও আর বকাঝকা শুনতে হবে না। তাই টিপ পরতে গেলেই দাদির কথা মনে পড়ে।

– উনি বেঁচে আছেন?

– না , গতবছর মারা গেছেন দাদি।

– দাদি বেঁচে নেই অথচ সে কষ্ট পাবে ভেবে তুমি তার আদেশ এখনো ফলো করছ। বাহ! তুমি খুব ভালো মেয়ে তুমি জানো, ভাবি?

– হা হা হা! এই তো জানলাম। তুমি বললে যে!

– এর আগে কেউ বলেনি? আমার ভাইয়াও না? এমনিই কি পটে গেল তোমার প্রেমে নাকি কোনো যাদুমন্ত্র করেছ ? বিয়ের জন্য যে পাগল হলো ।

– কি যে বলো! যাও!

বেশ কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করতেই শান্তার সাথে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল মিথিলা। রাতের খাওয়ার সময়ও সাজিদের দেখা মিলল না। মিথিলার বুকের মাঝে ধুকপুক করছে। না জানি তাকে নিয়ে কী ভেবে বসে আছে সাজিদ। আইমানের উপর রাগে ফেটে যাচ্ছে সে। কি দরকার ছিল আজেবাজে কথা গুলো বলার?

রাত সাড়ে বারোটার দিকে সাব্বির ঠেলেঠুলে সাজিদকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রুমে পাঠিয়েছে। সাজিদের কাজিনরা এ নিয়ে কী হাসাহাসি! নতুন বউ রেখে ভাইয়ের রুমে এসে ঘুমাচ্ছে!

সাজিদ রুমে ঢুকে দেখে মিথিলা তখনো জেগে আছে। সাজিদকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল । মিথিলা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?

– সাব্বিরের রুমে। খুব ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ো। নিরুত্তাপ উত্তর সাজিদের।

– তোমার সাথে কথা ছিল আমার। প্লিজ, একটু যদি শুনতে!

– কথা বলার সময় সারাজীবন পড়ে আছে। সারাদিন তো অনেক ধকল গেছে। খুব ক্লান্ত তুমি। শুয়ে পড়ো, প্লিজ। আমিও শুয়ে পড়ছি। লাইট টা অফ করে দিলাম। আগামীকাল আবার রিসেপশানের ঝামেলা পোহাতে হবে। বোঝই তো ! বাবা বেঁচে নেই। সব দায়িত্ব আমাকেই পোহাতে হয়।

মিথিলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইট অফ করে একটা কোলবালিশ টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সাজিদ।

সাজিদের ব্যবহারে মিথিলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কী আজব এক ভাগ্য নিয়ে সে পৃথিবীতে এসেছে।

“যেদিন তার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সেদিনই কী সে সাথে করে ওরে সৌভাগ্যটুকুও নিয়ে গেল? ”
নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন তার।

চলবে…