সুখ অমৃত পর্ব-০১

0
126

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নিজের বাবার বন্ধুর থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে চমকে উঠল মানতাশা। ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে উঠল। ভিন্নদিকে থাকা আবু সুফিয়ানের উপর যেন এর কোন প্রভাব পড়ছে না। তিনি বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন,
“যেই প্রস্তাবটা দিলাম সেটা একটু ভেবে দেখতে পারো। আমার কাছে থাকলে তুমি খারাপ থাকবে না।”

মানতাশার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল এই পাজি লোকটার মাথা মেরে ফাটিয়ে দিতে কিন্তু পারল না। কারণ তার নিজের মা এই লোকটার প্রস্তাবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেছে। অথচ সে চাইছে ব্যাপারটা কোন ভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে। মানতাশার মা মঞ্জুয়ারা বেগম আবু সুফিয়ানের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার প্রস্তাবটা শুনে অনেক খুশি হলাম। মানতাশার বাবার মৃত্যুর পর কি অকুল পাথারেই না পড়েছি। আপনি না থাকলে আমরা দুই মা মেয়ে যে কোথায় ভেসে যেতাম।”

বুদ্ধিমতী মানতাশা বুঝল এখন ব্যাপারটা তাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নচেত তার মা বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলবে। এমন ভাবনা থেকেই সে মঞ্জুয়ারা বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“মা, এদিকে আসো। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”

“তোর আবার কি কথা? দেখছিস না আমি তোর আঙ্কেল..না মানে হবু বরের সাথে জরুরি কথা বলছি।”

আবু সুফিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“যান, শুনে আসুন আপনার মেয়ে কি বলবে।”

মঞ্জুয়ারা বেগম মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। মানতাশা নিজের মাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে এসে বলে,
“এই বিয়ে আমি করতে পারবো না মা?”

মঞ্জুয়ারা বেগম খানিক রাগী সুরে বলেন,
“কেন? কি সমস্যা তোর এই বিয়ে করতে?”

“সুফিয়ান আঙ্কেল আব্বুর বন্ধু, মা।”

“তাতে কি? বন্ধু বলে তো আর লোকটা তোর বাবার বয়সী না। মাত্র ৩৩ বছর বয়স। জানি না, কিভাবে এই লোকের সাথে তোর বাবার বন্ধুত্ব হলো। এমন আভিজাত্যপূর্ণ, ধনী বন্ধু পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। দেখলি না, তোর বাবার মৃত্যুর পর কিভাবে লোকটা আমাদের সব দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছেন।”

“উনি আমার থেকে অনেক বড়, মা!”

“এমন ভাব করছিস যেন তুই কচি খুকি? ১৯ বছর তো হলো তোর, এখন বলিসনা যে বিয়ের বয়স হয়নি।”

মানতাশা কিছুতেই তার মাকে বোঝাতে পারল না যে এই বিয়েতে তার মোটেও মত নেই। মঞ্জুয়ারা বেগম নিজের মতো অদ্ভুত যুক্তি দাঁড় করাতে লাগলেন। মানতাশা বুঝল তার মাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই মঞ্জুয়ারা বেগম বেশ লোভী স্বভাবের মহিলা। তার উপর আবু সুফিয়ান যেভাবে টাকা পয়সা এবং দামী উপহার দিয়ে তার মন জয় করেছে তাতে তিনি সম্পূর্ণরূপেই তার কৃতদাসীতে পরিণত হয়েছেন। এসব কিছু বজায় রাখতে মানতাশাকে কোরবানি দিতে তিনি দুবার ভাববেন না। তাই মানতাশাকে এখন নিজের পথ নিজেকেই বেছে নিতে হবে।

মঞ্জুয়ারা বেগম মানতাশাকে ফেলে রেখে আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেশ আলাপ জমালেন দুজনে। মানতাশার কাছে তো এই আবু সুফিয়ান লোকটাকে আগে থেকেই সুবিধার লাগত না। এখন তো আরো বেশি অসুবিধার লাগছে।

মানতাশা কিছুক্ষণ বিরক্তি ভরে তাকিয়ে নিজের কক্ষে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো।

মানতাশা ঘরে বসে ভাবতে লাগলো তার সাজানো গোছানো জীবনটা কি করে হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেলো। বাবার অতি আদরের মেয়ে ছিল মানতাশা। এককথায় পাপা কি পারি। বাবা বেঁচে থাকতে ভীষণ আড়ম্বতার সাথে জীবন কাঁটিয়েছে। জীবনে দুঃখ কষ্টের কোন ছিটেফোঁটা ছিল না। কিন্তু বাবার অকালমৃত্যুতে তার জীবনে যেন আমাবস্যা নেমে এসেছে। মৃত্যুর পূর্বেই মানতাশার বাবা আরিফুল হক বিপুল দেনায় ডুবে ছিলেন। তার মৃত্যুর পূর্বেই তার গড়ে তোলা হক এন্টারপ্রাইজ দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সেই শোকেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় আরিফুল হকের। এরপর মানতাশা ও তার মায়ের পথে বসার জোগাড় হয়। কিন্তু এমন সময় আবু সুফিয়ান নামক লোকটা তাদের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। হক এন্টারপ্রাইজকে দেউলিয়া অবস্থা থেকে টেনে তোলেন। বর্তমানে তিনিই এর হর্তাকর্তা। লোকমুখে গুঞ্জন তিনি এই কোম্পানির নামও পাল্টে নিজের নামে রাখবেন। মানতাশার ভীষণ রাগ হয় এসব শুনে।

কারণ তার মনে হয় এই আবু সুফিয়ান লোকটা একদম সুবিধার নয়। নাহলে কি এই লোকটার সাথে দেখা হওয়ার পরই তাদের অধঃপতন শুরু হয়? এই তো দুই বছর আগেও হক এন্টারপ্রাইজ রাজত্ব করেছে পুরো ঢাকা শহরে। তাদের শেয়ারের ধারের কাছে কেউ ছিল না। অথচ এই আবু সুফিয়ান যখন থেকে তার বাবার বিজনেস পার্টনার হয়েছে তখন থেকেই কোম্পানির ডাউনফল শুরু। মাত্র এক বছরেই অর্ধেকের বেশি শেয়ার হাতছাড়া হয় আর দুই বছরের মাথায় তো পুরোপুরি দেউলিয়া। মানতাশার মনে হয় এই লোকটাই পরিকল্পনা করে তার বাবাকে সর্বসান্ত করেছে। অথচ তার বাবা অন্ধের মতো বিশ্বাস করত এই লোককে। মানতাশা আজও বুঝতে পারে না মাত্র ২ বছরের পরিচয়ে কিভাবে এই লোকটা তার বাবার এত প্রাণপ্রিয় বন্ধু হয়ে উঠল। শেষ দিন পর্যন্ত তার বাবা এই লোকটাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত!

★★★
মঞ্জুয়ারা বেগম অনেকক্ষণ যাবৎ আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করছেন। লোকটা চুপচাপ কি যেন ভাবছে। মঞ্জুয়ারা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কিছু বলছেন কিন্তু এই লোকের কোন ভাব বোঝা দায়। আবু সুফিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাই হালকা কেশে উঠলেন মঞ্জুয়ারা বেগম। আবু সুফিয়ান মঞ্জুয়ারা বেগমের দিকে পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠেন,
“এই নিন, পানি খান।”

মঞ্জুয়ারা বেগম এক ঢোক পানি খেয়ে বলেন,
“তো কি ঠিক করলেন?”

আবু সুফিয়ান সন্দিহান স্বরে বলল,
“কোন ব্যাপারে?”

“বিয়ের ব্যাপারে!”

আবু সুফিয়ান এবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
“আপনি আপনার মেয়েকে বোঝান। ওর মত না থাকলে এই বিয়েটা সম্ভব না। আর এতে আপনার কতটা লস, নিশ্চয়ই বুঝছেন।”

মঞ্জুয়ারা বেগম কেপে উঠলেন। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। জন্ম থেকে অভাব অনটন দেখে বড় হয়েছেন। বিয়েও হয়েছিল একজন সাধারণ শ্রমিকের সাথে। তবে তার ভাগ্যে বুঝি রাজযোগ ছিল। তাই তো বিয়ের দুই বছরের মাথায় তার শ্রমিক স্বামী রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। যাকে বলা যায়, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, আরিফুল হকের জীবনে সমৃদ্ধি রাতারাতিই চলে এসেছিল। যদিও সেটা কিভাবে এসেছিল তা মঞ্জুয়ারা বেগমের অজানা। তবে তিনি এটা খুব ভালো করেই জানেন, তার স্বামী হক এন্টারপ্রাইজ গড়ে তোলার পর তাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর তাদের মেয়ে মানতাশার জন্মও তো হলো সোনার চামচ মুখে দিয়ে। মঞ্জুয়ারা বেগম ছোট থেকেই ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী। আর ভাগ্যের ফেরে বিয়ের পরপরই এমন উচ্চতায় পৌঁছেও গেলেন। সারাটা জীবন যেই বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন, বিয়ের পর তার পূর্ণ হলো। এরপর জীবন তার সুখেই কেটেছে। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর আবার যেন তার জীবনে সিঁদূরে মেঘের আগমন ঘটেছে। মঞ্জুয়ারা বেগম খুব ভালো করেই জানেন, এখন যা অবস্থা তাতে যদি আবু সুফিয়ান তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে তাকে আবার আগের সেই অভাবের দিনে ফিরে যেতে হবে। এখনো তার মনে পড়ে ৫ ভাইবোনের সংসারে কতবেলা না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। মঞ্জুয়ারা বেগম কিছুতেই সেই দিনে ফিরে যেতে চান না। তার জন্য যদি নিজের মেয়েকে কোরবানিও দিতে হয় তাও তিনি দুবার ভাববেন না। সেখানে তো শুধু এই লোকের সাথে বিয়ে দিতে হবে। এটা করা কোন বড় ব্যাপার না। কিন্তু সমস্যাটা হলো তার মেয়েকে নিয়ে। এই মানতাশা যে তার বাধ্য মেয়ে এমনটা নয়। চূড়ান্ত পর্যায়ের জেদি একটা মেয়ে। বাপ তো আদর দিয়ে মাথায় তুলেছে। এখন পরিস্থিতির জন্য তাকে নমনীয় হতে হয়েছে। কিন্তু নিজের জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত যে মেয়েটা মুখ বুজে মেনে নেবে না এটা মঞ্জুয়ারা বেগম বেশ ভালো করেই জানেন। তাই এবার তাকে অন্য ছক কষতে হবে। তবে যে করেই হোক, তিনি এই বিয়েটা দেবেনই। এজন্য তাকে যা করতে হয়, করবেন। যতটা নিচে নামতে হয়, নামবেন। প্রয়োজনে এই দুনিয়ার সবথেকে নিকৃষ্ট মা হবেন তবুও তিনি মানতাশার বিয়ে এই আবু সুফিয়ানের সাথেই দেবেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨