সুখ অমৃত পর্ব-০৬

0
94

#সুখ_অমৃত
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি

গাড়ি এসে থামলো বিশাল এক বাড়ির সামনে। বাড়ি কম এটাকে রাজপ্রাসাদ বলা যায় বেশি। হুসনেয়ারা বেগম সর্বপ্রথম গাড়ি থেকে নেমে এলেন। অতঃপর তাকালেন গাড়ির দিকে। ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো মানতাশা। তার দৃষ্টি মাটিতে স্থির। হুসনেয়ারা বেগম বুঝলেন নতুন যায়গায় এসে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধা হচ্ছে মানতাশার। তাই তিনি অভয় বানী দিয়ে বললেন,
“ভয় পাস না। এখানে তুই একদম নিরাপদ।”

মানতাশা হাসার চেষ্টা করলো। হুসনেয়ারা বেগম তাকে নিজের পিছন পিছন আসার জন্য ইশারা করলো। মানতাশা বাধ্য মেয়ের মতো হুসনেয়ারা বেগমের পেছন পেছন যেতে লাগলেন। হঠাৎ করেই হর্ষধ্বনি তাকে বিরক্ত করলো। ডান পাশে তাকাতেই সে হতবাক হয়ে গেলো। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। একটা ঘোড়া তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মানতাশা ভয়ে চোখ বন্দ করে চেচিয়ে উঠল। ঘোড়াটা তার কাছে আসার পূর্বেই কেউ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলো। সময়টা একদম উপযুক্ত ছিল। আরেকটু হলেই ঘোড়ার নিচে পড়তে হতো মানতাশাকে। হুসনেয়ারা বেগমও চকিতে পেছনে ফিরে তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। মানতাশার কাছে এসে তার কাধে হাত রেখে বললেন,
“চোখ খোল এখন। ঘোড়া থেমে গেছে।”

মানতাশা ধীরে ধীরে আঁখি পল্লব মেনে চাইলো। ভয়ে তার প্রাণ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে সে তাকালো অশ্বারোহীর দিকে। লোকটা কি অন্ধ নাকি? আরেকটু হলেই তো বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটে যেত। উল্টোদিকে ঘোড়ার উপর থেকে বিরক্তি নিয়ে নেমে এলো যুবকটি। দৃষ্টি তার মানতাশার দিকে স্থির। নেমেই সে কঠিন চোখে তাকালো মানতাশার দিকে। বলে উঠল,
“চোখে দেখতে পাওনা? আমি কখন থেকে সতর্ক বার্তা দিয়ে চলেছি।”

পুরো কথাটাই আরবিতে বলল যুবকটি। মানতাশা ছোট থেকে আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান সহ বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ। আগ্রহ থেকেই সব ভাষা রপ্ত করেছে। তাই যুবকটির কথা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না। আর কথাটা বুঝতেই তেতে উঠলো। নিজে দোষ করে নিজেই চোখ রাঙাচ্ছে! মানতাশা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই হুসনেয়ারা বেগম বলে উঠলেন,
“তুমি কিছু মনে করো না জাদ, ও এখানে নতুন তো তাই বুঝে উঠতে পারে নি।”

মানতাশা ফুফুর কথায় চমকালো। জাদ, নামটা তার কাছে পরিচিত নয়। সে যতদূর জানে তার ফুফুর দুই সন্তান। বড় সন্তান এক মেয়ে উমায়রা, যে তার সমবয়সী আর ছেলে ওমরের বয়স ১২, থলে এই জাদ আবার কে?

মানতাশাকে এটা ভেবে বেশি সময় নষ্ট করতে হলো না। হুসনেয়ারা বেগম নিজে থেকেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন,
“মানতাশা,ও হলো জাদ, আমার ভাসুরের ছোট ছেলে। আর জাদ, ও হলো মানতাশা আমার ভাইয়ের মেয়ে।”

জাদকে বিশেষ বিচলিত লাগলো না। মানতাশার সাথে পরিচিত হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে সে দাম্ভিকের ন্যায় নিজের প্রিয় ঘোড়াটিকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলো৷ জাদের এমন আচরণ মোটেই ভালো লাগল না মানতাশার। হতে পারে দুবাইয়ের ধনী শেখের ছেলে, তাই বলে এত দম্ভ!

হুসনেয়ারা বেগম মানতাশার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“জাদের ব্যবহারে কিছু মনে করিস না, ও একটু অন্যরকম। খুব একটা সামাজিক নয়।”

মানতাশা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো৷ কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে চলে যাচ্ছে।


ফুফুর হাত ধরে বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটিতে প্রবেশ করলো মানতাশা। যতদূর শুনেছে তার ফুফুর ভাসুর মোহাম্মদ বিন জাফর দুবাইয়ের একজন ধনী শেখ। যার এখানে নিজস্ব তেলের ব্যবসা রয়েছে। যার দরুণ সম্পদ, প্রতিপত্তির কোন অভাব নেই। চারিদিকে তার নিদর্শনও বিদ্যমান। তাদের সংগ্রহশালায় রয়েছে দামী দামী সব ব্রান্ডের গাড়ি, দামী সব ঘোড়া, উট। বাড়িতে প্রবেশ করেও মানতাশার নজরে এলো তার আভিজাত্য। পুরো বাড়ি সাজানো সব দামী আসবাপত্র ও শোপিচ দিয়ে। সব কিছুতেই রাজকীয় ভাব।

হুসনেয়ারা বেগম মানতাশাকে নিয়ে যান গেস্টরুমে। সেখানে গিয়ে মানতাশাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। অতঃপর একটা পোশাক এনে তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন,
“আসার সময় তো তাড়াহুড়ায় কোন কিছুই আনতে পারিস নি। এখন এই পোশাকটা পড়ে নে। বাথরুম ওদিকে, ফ্রেশ হয়ে থাকিস। আমি একটু খবর তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। আসলে বাড়িতে একটা নিয়ম আছে। তিনবেলা একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের সদস্যরা খেতে বসি। সকালের নাশতা তো হয়ে গেছে….দুপুরে কখন খাওয়া হবে ততক্ষণ তো তোকে অভুক্ত রাখতে পারি না। তাই আমি তোর খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

মানতাশা বলে,
“আমার জন্য তোমাকে এতো বিচলিত হতে হবে না ফুফু। আচ্ছা, উমায়রা আপু, ওমর ওরা কোথায়? এসেছি থেকে তো ওদের দেখছি না।”

“ওমর স্কুলে গেছে আর উমায়রা বাড়িতেই আছে তবে একটু ব্যস্ত আছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। ওর ব্যস্ততা কাটলেই তোর সাথে দেখা করতে আসবে।”

মানতাশা শুনেছিল দুবছর আগেই উমায়রার বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে তারা আমন্ত্রিত ছিল, যদিও ব্যস্ততার জন্য আসতে পারে নি। যতদূর জানে উমায়রার বিয়ে তার চাচাতো ভাইয়ের সাথেই হয়েছে। তবে কি তখন যেই যুবককে দেখল সেই উমায়রার স্বামী? মানতাশা আর বেশি ভাবলো না। বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হয়ে নিতে।

ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখলো হুসনেয়ারা বেগম খাবার হাতে নিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। মানতাশাকে দেখেই মৃদু হেসে বললেন,”তোর জন্য খাবার এনেছি, খেয়ে নে।”

মানতাশা খেতে বসে পড়ে। খাওয়া শেষ হতে না হতেই উমায়রার আগমন ঘটে। এসেই মানতাশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ওহে প্রিয়, মানতাশা। তোমাকে দেখে অনেক খুশি হলাম। আজ কতদিন পর তোমার মুখোমুখি হলাম।”

মানতাশাও খুশি হলো উমায়রাকে দেখে। দুইবোন ভালোই গল্প জমিয়ে দিলো। হুসনেয়ারা বেগম তাদের মাঝে আর থাকতে চাইলেন না। তারও কিছু কাজ ছিল৷ তাই তিনি চলে গেলেন। উমায়রা কথায় কথায় বললেন,
“তোমার সাহসের প্রশংসা না করে পাচ্ছি না। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি তোমার উপর। তোমার মতো সাহসিকতা যদি সব মেয়েই দেখাতে পারত তাহলে কোন মেয়ের কপালে আর কষ্ট নেমে আসত না।”

কথাটা বলে মনের অজান্তেই উমায়রার মন বিষাদে ছেয়ে গেল। চেহারাতেও ফুটে উঠলো বিষাদ। মানতাশা বুঝল না এই বিষাদের কারণ। এরমধ্যেই গেস্ট রুমের বাইরে থেকে কারো কন্ঠ ভেসে এলো,
“উমায়রা, তুমি কি এখানে? তাড়াতাড়ি বাইরে এসো। আমার তোমাকে বিশেষ দরকার।”

উমায়রা বলে,
“মনে হয় জাইন আমাকে ডাকছেন। আমাকে যেতে হবে।”

মানতাশা আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
“জাইন কে?”

উমায়রা মলিন হেসে বলে,
“আমার স্বামী, তোমার দুলাভাই।”

এরইমধ্যে জাইন ভেতরে প্রবেশ করল। এসেই উমায়রার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“কতক্ষণ থেকে ডাকছি, তোমার কানে যাচ্ছে না?”

জাইনকে হঠাৎ এভাবে ভেতরে আসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো মানতাশা। মাথা নামিয়ে নিলো। এদিকে জাইনের দৃষ্টি মানতাশার দিকে স্থির। মনে মনে বলে উঠলো,
“অপরূপা রমণী!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨