সুখ অমৃত পর্ব-১২

0
84

#সুখ_অমৃত
#পর্ব_১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

জাদ মানতাশার হার শক্ত করে ধরে বলিষ্ঠ কন্ঠে সবার সামনে বলে,
“আমি মানতাশাকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছি। ও এখন আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব। যেই দায়িত্বকে আমি অবহেলা করতে পারবো না। আপনারা কেউ যদি এই বিয়েটা মেনে না নেন, তো আমার কিছু করার নেই। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে আলাদা সংসার পাততেও রাজি আছি। এখন বাকিটা আপনাদের উপর।”

মোহাম্মদ জাফর হতাশ হয়ে উঠলেন। জায়িন প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠল। সে যেই মেয়েটিকে পছন্দ করলো সে কিনা তার ভাইয়ের বউ হলো। এটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু জায়িন এত সহজে সবটা মেনে নেয়ার মানুষ নয়। সে জাদের উপর প্রতিশোধ নিতেই বলল,
“আব্বু তুমি তোমার ছোট ছেলের ইচ্ছা পূরণ করে দাও। ওকে ওর স্ত্রীকে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।”

হাফসার কাছেও জাদের প্রস্তাবটা মন্দ লাগে না। এমনিতেই এই মানতাশা নামের মেয়েটিকে তার সহ্য হয়না। তাই এই মেয়েটা বিদায় হলে তারই লাভ। এজন্য সেও বলল,
“হ্যাঁ, জায়িন ঠিকই বলেছে। আপনি জাদকে বের করে দিন এই বাড়ি থেকে।”

মোহাম্মদ জাফর কিছু বলবেন তার পূর্বেই সালমা বেগম বলে উঠলেন,
“যদি কেউ আমার ছেলেকে এবং তার নব বিবাহিত স্ত্রীকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চিন্তা করে তাহলে আমিও এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।”

সালমা বেগমের এহেন কথায় সবাই তাজ্জব বনে গেলেন। তিনি সাধারণত পরিবারের কোন বিষয়ে মাথা ঘামান না। ১০ বছর আগে ঘটা এক সড়ক দূর্ঘটনার তিনি হাটাচলা করার ক্ষমতা হারানোর পরেই নিজেকে চার দেয়ালে বন্দি করে নিয়েছেন। আজ বহুদিন পর যেন সালমা বেগমের আসল রূপ দেখলো সবাই। মোহাম্মদ জাফর বললেন,
“আমার ছেলে কিছু অন্যায় করেছে তার মানে এই না যে তাকে আমি এই বাড়ি থেকে আলাদা করে দেব। জাদ এখানেই থাকবে। কিন্তু এই মেয়েকে আমি বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেব না।”

জাদ হেসে বলে,
“আমি মানতাশাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি। এটাই আমার কাছে যথেষ্ট। আপনি মেনে নিন বা না নিন, সেটাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

এই কথা বলে জাদ সবার সামনে থেকে মানতাশার হাত ধরে তাকে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে যায়। মোহাম্মদ জাফর, জাইন এবং হাফসা রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকে তাদের যাওয়ার পানে।

★★★
আজ রাতটা মানতাশা ও জাদ দুজনের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আজ তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাত। জাদ একাধারে তাকিয়ে আছে তার সুন্দরী বধূর দিকে। মানতাশার রূপের ঝলকে তার পলকই পড়ছে না। মানতাশার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে জাদ বলে,
“আজ থেকে তুমি শুধুই আমার। অতীতের কোন ছায়া আমি তোমার উপর পড়তে দেব না।”

বলেই মানতাশাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। তার অধরে অধর ছোয়ায়। মানতাশাকে পরম আবেশের সাথে নিজের মধ্যে মিলিয়ে নেয়৷ আজকের রাতটা সাক্ষী হয় তাদের ভালোবাসার!

★★★
নতুন প্রভাতের সাথে যেন এক নতুন মানতাশার আগমন ঘটে। সে আর এখন এই বাড়ির আশ্রিতা নয় বরং এই বাড়ির একজন বউ৷ তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার এখন অনেক মনোবল পেয়েছে। প্রভাতে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে মানতাশা। অতঃপর সকালে আবার উঠেই রুম থেকে বের হতে গিয়ে দেখতে পায় হাফসা বেগম উমায়রার উপর চোটপাট করছে। উমায়রার গায়ে হাত তুলতে যাবে তার আগেই মানতাশা গিয়ে হাফসার হাত ধরে ফেলে। হাফসা বেগম রাগী চোখে তাকাতেই মানতাশা বলে,
“আমাকে চোখ রাঙাতে আসবেন না। আমি আপনার এই চোখ রাঙানিতে বিন্দুমাত্র ভয় পাই না।”

হাফসা বেগম দাঁত কটমট করে বলেন,
“এক দিনেই এত পাওয়ার বেড়ে গেল?! জাদকে বিয়ে করে কি আকাশে উড়ছ নালি?!”

মানতাশা হেসে বলে,
“ধরে নিন সেটাই। কিন্তু দ্বিতীয় বার যেন আপনাকে আর উমায়রা আপুর গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা দেখাতে না দেখি।”

“নাহলে কি করবে তুমি?”

মানতাশা বলে,
“সেটাই করব, যেটা আপনি হয়তো ভাবতেও পারছেন না।”

“আমি কে চেনো তুমি?”

“হতে পারেন আপনি দুবাই রাজ পরিবারের একজন সদস্যা কিন্তু এই পরিচয়ের জন্য আপনি পার পেয়ে যাবেন না। এই বাড়িতে আমার এবং আপনার দুজনের মর্যাদাই একি! এখানে আপনিও পুত্রবধূ এবং আমিও।”

হাফসা উমায়রাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
“তোমাকে তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি।”

অতঃপর মানতাশার দিকে ঘুরে বলে,
“আর তোমার তো আমি এমন অবস্থা করব যে তোমায় আমার পায়ের কাছে এসে পড়তে হবে। শুধু অপেক্ষা করতে থাকো নিজের ডাউনফলের জন্য। আমার সাথে পাঙ্গা নেয়ার ফল মোটেই ভালো হবে না। খুব আফসোস করতে হবে তোমায়, খুব।”

বলেই হাফসা বেগম হিসহিসিয়ে চলে যায়। উমায়রা মানতাশার কাছে এসে বলে,
“তুমি এভাবে হাফসা আপুকে খেপিয়ে দিতে গেলে কেন? উনি নিশ্চয়ই এবার তোমার সাথে খারাপ কিছু করতে চাইবেন।”

মানতাশা উমায়রার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“কতদিন আর এভাবে ভয়ে গুটিয়ে থাকবে উমায়রা আপু? ভয়কে জয় করতে হবে। একটা কথা মনে রেখো, মানুষ হলো শক্তের ভক্ত এবং নরমের যম।”

উমায়রা বলে,
“তুমি বুঝতে পারছ না। হাফসা আপুর অনেক ক্ষমতা।”

“আমিও দেখতে চাই কত ক্ষমতা ওনার এবং উনি কি করতে পারেন।”

উমায়রা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।

দূর থেকে জাদ সব ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করে। নিজের স্ত্রীর এই রূপই তো দেখতে চেয়েছিল সে। অবশেষে তেমনটাই হলো। মানতাশা নিজের প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে। এভাবেই মানতাশার হাত ধরে হয়তো হাফসা বেগমের একক আধিপত্যের পতন ঘটবে।

এদিকে হাফসা বেগম কিছুটা দূরে চলে এসে বলেন,
“আমাকে তুমি চেনো না মানতাশা। তোমার মতো কত মানতাশা এলো আর গেলো! তোমার সাথে কি ঘটবে সেটা তুমি জানো না। হাফসার লেজে পা দিয়েছ তাইনা?! যত পারো উড়ে নাও। খুব শীঘ্রই তোমার ডানা ছাটার ব্যবস্থা করছি।”

★★★
আবু সুফিয়ান পা রাখলো দুবাইয়ের মাটিতে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই সে গা জ্বালানি হাসি দিয়ে বলল,
“আমি এসে গেছি মানতাশা। তোমার পালানোর সব রাস্তা এবার বন্ধ৷ এবার তোমাকে আমি এমন ভাবে নিজের খাঁচায় বন্ধ করব যে তুমি আর পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।”

বলেই সে একটি মার্সিডিজ গাড়িতে উঠে বসে৷ সুফিয়ানের গন্তব্য এখন জাফর প্যালেস। সুফিয়ান শীষ বাজাতে বাজাতে বলে,
“আজ অনেক দিন পর তোমার মুখোমুখি হবো জাফর। তোমার আমার সাথে শত্রুতা করার মানসিকতা এখনো গেলো না। তাই আমার চিড়িয়াকে নিজের খাঁচায় আশ্রয় দিয়ে রাখলে। তুমি হয়ত ভুলে গেছ, যেটা আমার সেটাকে আমি নিজের করে রাখতে পছন্দ করি। তোমার সব রহস্য আমি জানি। তাই তোমাকে এবার নিজের ভালোর জন্য হলেও মানতাশাকে আমার হাতে তুলে দিতে হবে। তারপর আমি মানতাশাকে সম্পূর্ণ রূপে নিজের করে নিবো। আর কেউ আমাদের মাঝে বাধা হয়ে দাড়াতে পাবে না।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুফিয়ান জাফর প্যালেসের সামনে এসে উপস্থিত হলো। গাড়ি থেকে নেমে বিদঘুটে হেসে বলল,
“আ’ম কামিং সুইটহার্ট।”

বলেই সামনে এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল বাজায়৷ কিছুক্ষণ পর উমায়রা এসে দরজা খুলে দেয়। নিজের চোখের সামনে এক অচেনা ব্যক্তিকে দেখে বলে,
“কে আপনি?”

“মোহাম্মদ জাফর আছেন?”

“জ্বি, উনি আমার শ্বশুর হন। কিন্তু আপনি কে?”

“ওনাকে গিয়ে বলুন, ওনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু তায়ৈবের ছেলে আবু সুফিয়ান এসেছে। এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে।”

উমায়রা আবু সুফিয়ানকে চেনে, তার নামও জানে না। এজন্য সে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং ভদ্রতার সহিত বলল,
“আপনি ভেতরে আসুন। আমি ওনাকে ডেকে দিচ্ছি।”

সুফিয়ান বাড়ির ভেতরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে। উমায়রা মোহাম্মদ জাফরকে ডাকতে চলে যায়। হঠাৎ করেই পিছন থেকে কেউ বলে ওঠে,
“তুমি!”

আবু সুফিয়ান পিছনে তাকিয়ে সালমা বেগমকে দেখে হেসে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। অনেক দিন পর আবার দেখা হলো।”

সালমা বেগমের চেহারায় ভয় এসে ধরা দিলো। মনে পড়ে গেলো অতীতের কিছু বিষাক্ত স্মৃতি। এই আবু সুফিয়ানের বাবা আবু তায়ৈবের জন্যই আজ সে হাটাচলা করার ক্ষমতা হারিয়েছে। আজ এতগুলো দিন পর আবু সুফিয়ানকে নিজের চোখের সামনে দেখে সেই পুরাতন ক্ষত যেন তাজা হয়ে উঠল। এরমধ্যে মোহাম্মদ জাফরও সেখানে উপস্থিত হলো। সুফিয়ান তাকে দেখামাত্রই কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি চলে এসেছি আঙ্কেল, আপনার কাল হয়ে। এতদিন সবকিছু আপনার ইচ্ছেতে হয়েছে এবার সবকিছু হবে আমার ইচ্ছায়।”

চলবে….