সুখ অমৃত পর্ব-১৭+১৮

0
77

#সুখ_অমৃত
#পর্ব_১৭/১৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মানতাশা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উমায়রার কক্ষে গেল। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কক্ষেই সময় কাটালো। নানারকম গল্প করল। নানান কথার মাঝে মানতাশা হঠাৎ করে উমায়রাকে বলে ফেলল,
“জানো আপু, কয়দিন থেকেই আমার শরীরটা কেন জানি ভালো যাচ্ছে না।”

“কেন? তোমার আবার কি হলো?”

“আসলে আমার মাথা-ব্যাথা, বমি হচ্ছে কয়েকদিন যাবৎ। বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে।”

উমায়রা অধর প্রসারিত করে হেসে বলল,
“কোন খুশির খবর নাকি?”

উমায়রার কথা শুনে মানতাশার শরীরে এক অনন্য আবেশ বয়ে গেলো। সে মৃদু হেসে বলল,
“সত্যি কি এমন হতে পারে?”

“তোমার লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল?”

“এক মাস আগে।”

“তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। প্রেগ্যান্সি কিট কি আছে?”

“হুম।”

“তাহলে যাও, পরীক্ষা করে দেখো। লক্ষণ দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট। যদি এমনটা হয় আর তুমি যদি কোন মেয়ে সন্তানের জন্ম দাও। তাহলে কিন্তু তোমার মেয়েকেই আমি আমার ছেলের সাথে বিয়ে দিব।”

মানতাশা হালকা হাসে উমায়রার কথা শুনে। অতঃপর সে উমায়রাকে বলে,
“তুমি তাহলে এখন বিশ্রাম নেও। আমি উপরে নিজের কক্ষে গিয়ে চেক করে আসছি।”

“আচ্ছা।”

মানতাশা খুশি খুশি মনে নিজের কক্ষের দিকে হাত বাড়ায়। অতঃপর প্রেগ্ন্যাসির কিটটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বহু প্রত্যাশিত ফলাফল দেখার পর মানতাশার মুখে খুশির ঝলক। সে প্রেগ্যান্সি কিটটা আরেকবার ভালো করে দেখে। রিপোর্ট পজেটিভ বলছে। তার মানে সে সত্যিই মা হতে চলেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই মুখে খুশির ঝলক খেয়ে গেলো।

মানতাশা ভাবলো প্রথমে এই সুখবরটা সে জাদকেই দেবে। জাদ নিশ্চয়ই নিজের সন্তান হবার কথা শুনলে ভীষণ খুশি হবে। যেই ভাবা সেই কাজ মানতাশা বাইরে এসে জাদকে ফোন দেয়। কিন্তু জাদ ফোনটা রিসিভ করে না। মানতাশা কপাল চাপড়ে বলে,
“উফ! আমিও না। জাদ তো এখন প্লেনে আছে। ওর ফোন তো এখন এরোপ্লেন মুডে রয়েছে।”

মানতাশা নিজের পেটে হাত রেখে বলে,
“আমি খুব শীঘ্রই তোমার বাবাকে তোমার আগমনের খবর জানাবো। সে এই খবর শুনে অনেক আনন্দিত হবে দেখে নিও।”

★★
রাত তখন ৮ টা। মানতাশা তার শ্বাশুড়ি সালমা বেগমের কক্ষে রাতের খাবার নিয়ে যায়। সালমা বেগম মানতাশাকে দেখে খুশি হয়ে যান। হেসে বলেন,
“এসো। একসাথে খাই আমরা।”

মানতাশা সালমা বেগমকে খুশির খবরটা জানিয়ে দেয়। সালমা বেগমের খুশি আর দেখে কে। একেই নিজের বড় ছেলের সন্তান আগমনের খুশি তার উপর এখন তার পারলেন তার ছোট ছেলের বউও মা হতে চলেছে। সালমা বেগম নিজের গলার সোনার চেইন খুলে মানতাশাকে পড়িয়ে দিয়ে বলেন,
“আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ইস, আজ বাড়িতেও কেউ নেই৷ কাল তোমার শ্বশুর মশাই এলে বলব, এই উপলক্ষে অনাথ আশ্রমে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে এবং কয়েকটা উট কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা কর‍তে। জাদকে এই খুশির খবরটা জানিয়ে দিয়েছ তো?”

“উনি তো এখন প্লেনে রয়েছেন। ওনার ল্যান্ড করতে এখনো টাইম লাগবে।”

“ওহ,আচ্ছা। ওকে তাহলে দ্রুত খুশির খবরটা জানিয়ে দিও। দেখবে ও এই খবরটা পেয়ে সবকিছু ফেলে ছুটে আসবে তোমার কাছে।”

মানতাশা লাজুক হাসে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ পাওয়া যায়। সালমা বেগম বলেন,
“কি হলো?”

মানতাশাও চিন্তিত হয়। এরমধ্যেই বাড়ির একজন কর্মচারী ছুটে এসে বলেন,
“বিপদ হয়ে গেছে, ম্যাডাম। কয়েকজন বন্দুকধারী বাড়িতে প্রবেশ করে সবাইকে জিম্মি করে রাখছে।”

মানতাশা এবং সালমা দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। আজ বাড়িতে মানতাশা, সালমা ও উমায়রা ছাড়া কেউ নেই। যারা আছে সবাই বাড়ির কর্মচারী। সালমা বেগমের হঠাৎ উমায়রার কথা ভেবে চিন্তা হলো। তিনি মানতাশাকে বললেন,
“উমায়রা ঠিক আছে তো?”

মানতাশারও উমায়রার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। তাই সে বলে,
“আমি গিয়ে দেখছি আপু ঠিক আছে কিনা।”

বলে যেই না মানতাশা বাড়ি থেকে বের হতে যাবে তার পূর্বেই কক্ষের দরজার কাছে তার পথ আটকে দাঁড়ায় আবু সুফিয়ান। মানতাশা এত দিন পর এই লোকটাকে দেখে থমকে যায়। পুরাতন দিনের সব ভয় যেন গ্রাস করে তাকে। সুফিয়ান মানতাশাকে দেখে বাকা হেঁসে বলে,
“এত তাড়া কিসের সুইটহার্ট? তোমাকে কষ্ট করে নিচে যেতে হবে না। আমিই চলে এপাম তোমার কাছে।”

আবু সুফিয়ান মানতাশার দিকে এগোতে থাকে। মানতাশা দুপা দুপা করে পিছাতে থাকে। সালমা বেগম বলে ওঠেন,
“তুমি? তুমি এখানে কিভাবে এলে? সিকিউরিটি কোথায়?”

“রিল্যাক্স আন্টি। সিকিউরিটি ডেকে লাভ নেই। ওদেরকে ইতিমধ্যেই জাহান্নামে পৌঁছে দিয়েছি৷ এখন আপনিও যদি জাহান্নামে যেতে না চান তো চুপ করে থাকুন।”

বলেই মানতাশার কাছে এগিয়ে এসে তার হাতটা শক্ত করে ধরে সুফিয়ান। মানতাশা হাত মোচড়া-মোচড়ি কর‍তে থাকে কিন্তু কোন লাভ হয়না। আবু সুফিয়ান বলে,
“বলেছিলাম না, তোমাকে আমি আমার বন্দিনী বানিয়েই ছাড়ব। সেই কথা পূরণ করতে চলে এসেছি।”

বলেই মানতাশাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সালমা বেগম হুইলচেয়ার নিয়ে তাকে আটকানোর জন্য সামনে এগোতে থাকে। মানতাশা নিজের সব শক্তি দিয়ে সুফিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে সুফিয়ান রেগে গিয়ে মানতাশার চুলের মুঠি ধরে টান দেয়। মানতাশা ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মানতাশা কেঁদে ওঠে। সালমা বেগমও সেই মুহুর্তে হুইল চেয়ারে করে সেখানে চলে এসে সুফিয়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“ছাড়, ছেড়ে দে আমার ছেলের বৌকে।”

সুফিয়ান মানতাশাকে তবু ছাড়ে না। সালমা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনি এখানে এসে ভালো করলেন না, আন্টি। যদি আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তো আমি কিন্তু আপনাকেও সরিয়ে দেব নিজের পথ থেকে।”

“কি করবে তুমি? তোমার বাবার জন্য আমি হাটাচলার ক্ষমতা হারিয়েছে। আর এখন তুমি আমার ছেলের বউদের দিকে হাত বাড়াচ্ছ। আমি বেঁচে থাকতে আমার ছেলের বউয়ের কোন অসম্মান হতে দিবো না।”

“তো মরুন।”

বলেই সালমা বেগমের হুইল চেয়ার এগিয়ে নিয়ে এসে তাকে সিঁড়ির সামনে নিয়ে এসে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। মানতাশা “আম্মু” বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। সালমা বেগম গড়িয়ে গড়িয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান। মানতাশার কান্নার গতি বাড়ে। আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বলে,
“চুপ। তোমার এত ভ্যা ভ্যা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

“তুই একটা শয়তান। জানোয়ার তুই। নিজের মায়ের বয়সী এক মহিলার সাথে এমন করলি। আল্লাহ তোকে কখনো মাফ করবে না।”

সুফিয়ান মানতাশাকে নিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে থাকে। সিঁড়ি জুড়ে সালমা বেগমের রক্তে রঞ্জিত। সিঁড়ি থেকে নেমে মানতাশা দেখতে পায় সালমা বেগম তখনো থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। সে সালমা বেগমের কাছে যেতে নিবে এমন সময় সুফিয়ান তাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের এসিট্যান্ট রাশেদের কাছে দিয়ে বলে “সামলাও একে।”

পুরো বাড়ি জুড়ে আবু সুফিয়ানের গ্যাং এর লোকে ভর্তি। আবু সুফিয়ান সালমা বেগমের সামনে ঝুঁকে বসে বলে,
“বলেছিলাম আমার পথে না আসতে। শুনলেন না তো৷ এখন দেখুন, আমার মাথা গরম হয়ে গিয়ে এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেললাম। যাইহোক, মরার আগে একটা কথা শুনে যান। আপনার এই পরিণতির জন্য শুধু আমার বাবা একা দায়ী নয়। আপনার স্বামী মানে আমার প্রাণপ্রিয় আঙ্কেল, মোহাম্মদ জাফরও দায়ী। তার নির্দেশেই আমার বাবা আপনাকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তবে সেই সময় আপনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন, যদিও হারিয়েছিলেন হাটা চলা করার ক্ষমতা। আজ আমি আমার বাবার অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করলাম।”

সালমা বেগম গোঙাতে গোঙাতে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার অবস্থা এত খারাপ ছিল যে কিছু বলতেই পারলেন না। আবু সুফিয়ান বলল,
“এটা ভাবছেন তো যে,আপনার প্রাণপ্রিয় স্বামী কেন আপনার সাথে এমন করল? লোভ, লোভ। সম্পত্তির লোভ। আজ মোহাম্মদ জাফরের যা কিছু আছে সবই তো তার শ্বশুর মানে আপনার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি। সেসব আত্মসাৎ করার জন্যই উনি আপনাকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ আপনার বাবা যে তার সবকিছু আপনার নামে করে দিয়েছিল। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আর আপনিও ব্যবসা সামলাতে আগ্রহী ছিলেন। তাই আঙ্কেল আপনাকে পথ থেকে সরাতে চাইছিল। তবে সেটা না পারলেও আপনি পঙ্গু হবার পর ঠিকই সবকিছুতে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করেছে। মাঝখান থেকে ফেসে গেল আমার বাবা।”

সালমা বেগমের চোখে শেষ মুহুর্তে জল এলো। যেই লোকটাকে সারাজীবন তিনি এত ভালোবেসেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন, সেই নাকি তাকে মে*রে ফেলতে চেয়েছেন। এই বুকভরা কষ্ট নিয়েই সালমা বেগম এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। থেমে যায় তার নিঃশ্বাস। মানতাশা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সারাজীবন সে মায়ের ভালোবাসা পায়নি। এই বাড়িতে আসার পরে, এই সালমা বেগমই তাকে মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। অথচ আজ এই অমায়িক নারীর জীবন প্রদীপ নিভে গেলো তাকে রক্ষা করতে গিয়ে। মানতাশা এই সত্যিটা মেনে নিতে পারল না।

আবু সুফিয়ান রাশেদকে নির্দেশ দিলো,
“নিয়ে যাও মানতাশাকে। ওর এত ন্যাকাকান্না আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

রাশেদ মানতাশাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এমন সময় উমায়রা উপস্থিত হয় সেখানে। এতক্ষণ সে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ হট্টগোলের আওয়াজে ছুটে এসে দেখে এই পরিস্থিতি। পুরো বাড়ি একদল বন্দুকধারী দখল করে রেখেছে। ফ্লোরে পড়ে থাকা সালমা বেগমের নিথর দেহ নজরে আসতেই সে চিৎকার করে উঠল। সালমা বেগমের শিয়রের কাছে বসে কাঁদতে লাগল। এরমধ্যেই খেয়াল করল মানতাশাকে একটা লোক টেনে নিয়ে যাচ্ছে। উমায়রা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কে আপনারা? ছেড়ে দিন আমার বোনকে।”

মানতাশা উমায়রার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপু, তুমি চলে যাও এখান থেকে। এখানে থাকলে ওরা তোমারও ক্ষতি করবে। প্লিজ, যাও তুমি।”

উমায়রা বলে,
“তোমাকে এই বিপদে একা ফেলে আমি কোথাও যাব না। আপনারা ছেড়ে দিন ওকে।”

আবু সুফিয়ান এগিয়ে এসে বলে,
“আজ যেই আমার এবং মানতাশার মধ্যে আসার চেষ্টা করবে তাকে বেঘোরে মরতে হবে। তাই নিজের ভালো চাইলে চলে যান এখান থেকে।”

উমায়রা আবু সুফিয়ানের মুখে থু থু ছিটিয়ে দেয়। আবু সুফিয়ান ভীষণ রেগে যায়। উমায়রা বলে ওঠে,
“তাহলে আপনিই আমার শ্বাশুড়িকে খু*ন করেছেন আর এখন আমার বোনকে অপহরণ করতে চাইছেন। আমি এক্ষুনি পুলিশকে ফোন করছি। আপনার মতো মানুষের তো শাস্তি হওয়া উচিৎ। কত নিকৃষ্ট আপনি।”

বলেই সে টেলিফোনের কাছে যায় পুলিশকে ফোন করার উদ্দ্যেশ্যে। নাম্বারটা ডায়াল করে কল করতে যাবে তার পূর্বেই একটা গুলি এসে ভেদ করে যায় তার শরীরে।

মুহুর্তের মাঝে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে সময় নেয় মানতাশা। অতঃপর নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে রাশেদের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় উমায়রার কাছে। উমায়রার শিয়রের কাছে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুমি কেন এসবের মাঝে ঢুকলে আপু? আমি তো তোমাকে চলে যেতে বলেছিলাম। তোমার বা তোমার সন্তানের কিছু হয়ে গেলে যে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না।”

উমায়রা নিভু নিভু কন্ঠে বলল,
“আমার বাচ্চা..আমার বাচ্চাকে বাঁচাও দয়া করে…আমি নিজের পরোয়া করি না..কিন্তু আমি চাই..আমি সন্তান এই পৃথিবীর আলো দেখুক।”

মানতাশা উঠে গিয়ে আবু সুফিয়ানের পায়ের কাছে বসে পড়ে। তার পা ধরে বলে,
“আপনি যা বলবেন, আমি তাই করবো। আজীবনের জন্য আপনার দাসী হয়ে থাকব। শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখুন। আমার আপুকে বাঁচান দয়া করে। ও..ও মা হতে চলেছে।”

সুফিয়ান মানতাশাকে টেনে তুলে বলে,
“সে তুমি চাও বা না চাও তোমাকে এমনিতেও আমার দাসী হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমি কাউকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে ঝুঁকি নিতে পারব না।”

“দয়া করে এত নিষ্ঠুর হবেন না। বাঁচান আমার উমায়রা আপুকে।”

বলেই আরেকবার উমায়রার দিকে তাকায়। তার শরীর থেকে তরল রক্তের স্রোত বেয়ে যাচ্ছে। পাষণ্ড সুফিয়ানের মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না মানতাশার এমন অসহায় আবেদন। সুফিয়ান মানতাশাকে টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে বসায়। অতঃপর অট্টহাসি দিয়ে বলে,
“আজ থেকে তুমি আমার বন্দিনী হলে।”

এদিকে মানতাশাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়, সে এসব কিছুর জন্য চরম প্রতিশোধ নেবে।

★★★
জাইনের মন ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল উমায়রার জন্য। তাই দুবাই রাজমহলে আজ রাতটা তাদের কাটানোর কথা থাকলেও সে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি ফেরার উদ্দ্যেশ্যে। হাফসা বেগম তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। অগত্যা, তাকে সাথে নিয়ে রওনা দিলো বাড়ির দিকে। এদিকে মনে মনে বলছে,
“এতক্ষণে বোধহয় আবু সুফিয়ান নিজের কাজ করে নিয়েছে। আমার পথের সব কাটাই বোধহয় উপড়ে ফেলেছে!”

বাড়িতে পৌঁছে জাইনের মন কু ডেকে ওঠে। চারিদিকের পরিবেশ কতটা নিস্তব্ধ। এমনকি বাড়ির বাইরে সিকিউরিটি গার্ডদেরও দেখা নেই। অজানা শঙ্কায় কেপে উঠল জাইনের বুক। সে দ্রুত গাড়ি থামিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। হাফসা গেলো তার পিছু পিছু। গেটের কাছে সিকিউরিটি গার্ডদের লাশ পড়ে থাকতে দেখে জাইন থমকে উঠল৷ এরপর বাড়িতে প্রবেশ করেই তার হৃদস্পন্দন যেন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলো। রক্তাক্ত অবস্থায় নিজের মা ও স্ত্রীকে পড়ে থাকতে দেখে সে চেচিয়ে উঠল। উমায়রার কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“উমায়রা, এই উমায়রা তাকাও আমার দিকে। কথা বলো আমার সাথে।”

কিন্তু উমায়রা কোন সাড়া দিলো না। হাফসা বাড়িতে প্রবেশ করে নিজের কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে দুঃখের ভান করে বলল,
“হায় আল্লাহ! এসব কি হয়ে গেল!”

জাইন কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
“উমায়রা কোন সাড়া দিচ্ছে না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। আম্মুও এভাবে পড়ে আছে। ওদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত।”

“হ্যাঁ, চলো জলদি।”

★★★
পুরো রাস্তায় জাইন কান্না করতে করতে ড্রাইভ করেছে। বিয়ের আগে বা পরে কখনো সে উমায়রাকে সেভাবে পছন্দ করত না। কিন্তু যবে থেকে উমায়রা তাদের সন্তানকে গর্ভ ধারণ করেছে তবে থেকে উমায়রার খেয়াল রাখতে রাখতে কবে যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে বুঝে উঠতে পারে নি। তাই উমায়রাকে হারানোর শঙ্কায় তার শরীর ঝিম হয়ে আসছে।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই উমায়রা ও সালমা বেগমকে ডাক্তার দেখানো হয়। ডাক্তার সামলা বেগমকে মৃত ঘোষণা করে তবে উমায়রা তখনো জীবিত ছিল। তাই তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়।

জাইন পুরো নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মাতৃবিয়োগের শোক এবং স্ত্রীর এমন অবস্থা তাকে ভেঙে দিয়েছে।

এরমধ্যে একজন ডাক্তার বেরিয়ে বললেন,
“আপনার স্ত্রীর বুকের পাশ দিয়ে গুলি গেছে৷ আমাদের অপারেশন করতে হবে। ওনার বাঁচার চান্স কম।”

জাইন কিছু বলে না। মনে মনে আল্লাহর কাছে উমায়রার জীবন ভিক্ষা চায়। কিন্তু তার এই প্রার্থনা বিফলে যায়। এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়ে উমায়রাও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। পিছনে রেখে যায় এক বুকভাঙা প্রেমিককে। যে সবেমাত্র তাকে ভালোবেসে নতুন স্বপ্ন সাজাচ্ছিল।

চলবে….