#সুখ_অমৃত
#পর্ব_২৫(অন্তিম)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
জাদের আজকে মন ভালো নেই। সকাল থেকে নানা দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করছে। তাই সে উদাস মনে ঘরে বসে আছে। এমন সময় জাইন হাফাতে হাফাতে তার রুমে আসলো। জাইন জাদের রুমে এসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে ভাই।”
“হ্যাঁ, ভাইয়া বল।”
এরপর জাইন জাদকে কিছু একটা বলে যা শুনে জাদ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর ক্রোধমিশ্রিত স্বরে বলে,
” এত কিছু হয়ে গেল অথচ তুই আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না!”
“আমাকে ক্ষমা করে দিস, ভাই। আমি তোকে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু..”
“এখনই আমাকে সেই অনাথ আশ্রমে নিয়ে চল। হাফসা বেগম আমাদের সাথে অনেক খেলা খেলেছে এবার আমরা তার সাথে খেলব। তার সকল অপকর্মের জন্য তাকে যথাযথ শাস্তি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা আমি করে দেব।”
জাইন দুঃখের সহিত বলে,
“কিন্তু আফসোস! কোন কিছু আর আগের মতো হবে না। আমি তো এটাও জানি না যে মানতাশা এখন কোথায় আছে। যতদূর শুনেছি ও আমেরিকায় আছে। তোর সম্পর্কে ওর মনে নেতিবাচক ধারণা জমে আছে। ও ঘৃণা করে তোকে। এত কিছু কিভাবে ঠিক হবে?!”
“আমি মানতাশাকে চিনি। ও বেশিদিন আমার উপর রাগ করে থাকতে পারবে না। ও কিছুতেই আমাকে ভুল বুঝে থাকতে পারবে না। ওকে আমি সবটা বোঝালেই ও বুঝবে। কিন্তু তার আগে আমাকে এখনই অনাথ আশ্রমে যেতে হবে..আমার সন্তানের কাছে। ও যে এত গুলো দিন ওর মা-বাবাকে ছাড়াই পার করেছে। এখন ওর আমার সঙ্গের প্রয়োজন। ওর মাকেও ওর প্রয়োজন। আমি জানি একবার ওর কাছে পৌঁছাতে পারলেই ওর মার ভুল ভাঙানো সম্ভব হবে।”
জাইন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-বোধক ইশারা করে। জাদ দ্রুত তৈরি হয় বের হওয়ার জন্য। তাকে এখন অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাকে প্রথমে নিজের সন্তানের কাছে পোস্টে যেতে হবে। তারপর আমেরিকায় মানতাশার কাছে যেতে হবে। এসব ভেবেই জাদ ঘর থেকে বের হয়।
★★
হাফসা বেগম নিজের মনে মনে নিজের নোংরা পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল। তিনি ইতিমধ্যে জেনে গেছেন যে, মানতাশা আমেরিকা থেকে দুবাইতে চলে এসেছে। এটা জেনে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছেন। কারণ তিনি ভাবছেন এখন জাদ এবং হাফসার প্রতিশোধ প্রতিশোধ খেলা চলবে। হাফসা বেগম এসব ভেবেই বলেন,
“এবার হবে আসল মজা, দুজন স্বামী-স্ত্রী যারা একে অপরকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসত আজ তারা মহাবিশ্বের সবথেকে বেশি ঘৃণা করে একে অপরকে। এবার দেখা যাক, তাদের প্রতিশোধের আগুন কতটা জ্বলে। তাদের একে অপরের প্রতি ঘৃণার পরিণাম কি হয়! আমি তো সবথেকে চরম পরিণতি দেখার অপেক্ষায় আছি। যা দেখে আমি চরম আত্মা শান্তি পাব।”
★★
সকালে নিউজ চ্যানেল দেখে হাফসা ভীষণ আনন্দ পেল। নিউজে দেখাচ্ছে জাদ নামক একজনকে তার স্ত্রী মানতাশা হত্যা করেছে। এই নিউজটা দেখে হাফসা বেগম তো পারলে খুশিতে নাচতে শুরু করে দেন। অনেক কষ্টে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বলেন,
“অবশেষে তাহলে এই আপদ টা দূর হলো। যাই হোক, এখন তো শুধুই আমার আনন্দের পালা।”
হুসনেয়ারা বেগম সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন,
“খুশি তো তুমি? তুমি যা চেয়েছিল তাই পেয়েছ। তোমার জন্য আমাদের সাজানো গোছানো সংসার টা তছনছ হয়ে গেল।”
“হ্যাঁ, আমি সত্যি অনেক খুশি। আমি চেয়েছিলাম সবার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে। আজ আমি তা করতে সমর্থ হয়েছি। আমার থেকে বেশি খুশি আর কে হবে।”
এই বলে সে হাসতে হাসতে একে একে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের সব অপরাধের বর্ণনা দিতে থাকে। যা শুনে হুসনেয়ারা বেগম হতবিহ্বল হয়ে যান। হাফসার সব কথা বলা শেষ হলে হঠাৎ করেই হুসনেয়ারা বেগম হাসতে শুরু করেন। তাকে এভাবে হাসতে দেখে হাফসা হতবাক হয়ে বলে,
“এভাবে হাসছেন কেন?”
হুসনেয়ারা বেগম বলেন,
“তুমি নিজেও জানো না, তুমি নিজের কত বড় সর্বনাশ করলে। ঐদিকে তাকিয়ে দেখ কারা যেন তোমার আপ্যায়নের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।”
এমন সময় পুলিশরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। মানতাশাও আসে, তার কোলে একটা মেয়ে। একটু পর হাফসা চরম পর্যায়ের অবাক করে জাদও সেখানে চলে আসে। হাফসা বেগম হতবাক হয়ে বলে,
“জাদ! তুমি বেঁচে আছ?”
“হ্যাঁ। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“কিন্তু নিউজে যে দেখলাম।”
“ওটা একটা ফেক রেকর্ডিং ছিল যা আমরা আপনাকে বোকা বানানোর জন্য চালিয়েছিলাম।”
মানতাশার কথায় হাফসা বেগম চরম পর্যায়ের অবাক। এরমধ্যে পুলিশ এগিয়ে এসে তার হাতে হাতকড়া পড়ায়। জাদ বলে,
“আপনি কি ভেবেছিলেন? আমার আর মানতাশার মাঝে এত সহজে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারবেন? এটা এতটাও সহজ না। এবার দেখুন আপনার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হয়।”
এদিকে মানতাশা বলে,
“আপনি সারাজীবন যা, যা অন্যায় করছেন তার শাস্তি পেতে হবে। আপনি এতটা নির্দয় যে আমার এই ছোট মেয়েটাকে অনাথ আশ্রমে রেখেছিলেন। আপনার জন্য ও এতদিন নিজের মা-বাবার ভালোবাসা পায়নি।”
হাফসা একবার বাচ্চাটার দিকে তাকায়। কারো প্রতি কখনো তার মায়া হয়নি কিন্তু এই বাচ্চাটার প্রতি হচ্ছে। বাচ্চাটা কি মিষ্টি দেখতে। হাফসা বেগম এই প্রথম নিজের কোন কাজের জন্য আফসোস করছেন।
এদিকে জাদ বলে,
“কাকে কি বলছ মানতাশা? ওনার কি কোন মায়া-দয়া আছে। পুলিশ অফিসার আপনারা জলদি ওনাকে নিয়ে যান।”
পুলিশ হাফসা বেগমকে নিয়ে যায়। এদিকে মানতাশা জাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সব ভুল বোঝাবুঝির বাঁধা অতিক্রম করে আজ আমরা এক হতে পেরেছি।”
জাদ হালকা হাসে। মনে করে আজ সকালের ঘটনা। যখন সে প্রথমে অনাথ আশ্রমে গিয়ে নিজের মেয়েকে দেখেছিল। মেয়েটাকে দেখেই সে বুঝেছিল এটা তারই সন্তান। কারণ মেয়েটা যেন তারই প্রতিচ্ছবি। এরপর জাদ জানতে পারে মানতাশা দুবাইতে আসে। এটা জানতে পেরে সে ছুটে যায় মানতাশার কাছে। মানতাশা প্রথমে জাদকে দেখে অনেক রেগে যায়। তার সাথে কথা বলতেও প্রস্তুত ছিল না। জাদ অনেক অনুনয় বিনয় করে তার সাথে কথা বলে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলে। নিজের মেয়েকে কাছে পেয়ে মানতাশা তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। এরপর দুজনে পরিকল্পনা করে এত কিছু করে। যাতে হাফসা বেগমকে উচিত শিক্ষা দিতে পারে। আর হুসনেয়ারা বেগমও তাদের একাজে সাহায্য করেন। অতঃপর তাদের সব পরিকল্পনা সফল হয়।
জাদ মানতাশার হাত ধরে বলে,
“আমি তোমাকে আর আমার মেয়েকে নিয়েই বাকি জীবন থাকব।”
“আমি চাই, আমাদের জীবন যেন এবার সত্যি সুখে ভরে যায়। সুখ নামক অমৃতের ছোয়া যেন আমরা পাই।”
জাইন নিজের ছেলে উসমানকে কোলে নিয়ে বলে,
“এই বাড়ি হাফসার নামে ছিল। সব সম্পত্তিও ওর নামে। তাই হয়তো আমরা আর এখানে থাকতে পারব না।”
মানতাশা বলে,
“কোন ব্যাপার না৷ আমি এখানে একটা বাড়ি কিনেছি। আমরা সবাই এখান থেকে সেখানেই থাকব।”
মিস্টার স্মিথও সেখানে উপস্থিত হন। তাকে দেখে জাদ বলে,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার মানতাশাকে এত ভালো রাখার জন্য। আমি শুনেছি আপনি ওকে নিজের বোনের মতো আগলে রেখেছিলেন।”
“ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। ওকে আমি সবসময় নিজের বোনই ভেবেছি।”
★★
হাফসার জেলখানায় দিন গুলো খুব কষ্টে যাচ্ছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার উপর দিনে মাত্র এক বেলা খেতে দেয়৷ তাও অল্প পরিমাণে। খিদার চোটে হাফসাকে ইঁদূর আর তেলাপোকা ধরে খেতে হয়। এছাড়া ইদুর, ছারপোকার কামড় তো আছেই। এখন হাফসা বেগম অনেক বেশি আফসোস করে নিজের কৃতকর্মের জন্য। সে এটাই ভাবে কিভাবে নিজের কৃতকর্মের জন্য এতগুলো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে৷ এসব ভেবে দীর্ঘ শ্বাস পড়ে তার জীবন যায়।
★★
এদিকে জাদ, মানতাশা এবং তাদের মেয়ে জান্নাতের জীবন সুখ অমৃতে ভড়ে গেছে। হুসনেয়ারা বেগম ও জাইনও উসমানের মধ্যে নিজেদের সুখ খুঁজে নিয়েছে। মিস্টার স্মিথ আমেরিকায় ফিরে গেছেন। তবে মানতাশাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। এভাবেই যাচ্ছে সবার জীবন।
★শুভ সমাপ্তি★