সুগন্ধি ফুল পর্ব-১১

0
1995

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_১১
#জান্নাত_সুলতানা

-“এতোগুলা টাকা!”

ফিজা বিস্ময় নিয়ে শুধালো। আবরাজ সিকিউরিটি গার্ড কে ইশারা করে। একজন গার্ড সাথে সাথে ফোন হাতে কিছু করলো। আবরাজ এর ফোনে শব্দ হয়। আবরাজ ফোন চেক করে। সেখানে কিছু দেখে মেজাজ খারাপ হয়। মূহুর্তে রাগে চোয়াল শক্ত হয়। ফোন টা উলটো করে শরীর এর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে নিচে। নিচে পরে বরফ ছিটকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে কিছু টা বরফ ফিজার উপর পরে। ফিজা অবাক হয়। এভাবে হঠাৎ রেগে গেলো কেনো পুরুষ টা? আর এতোগুলা টাকা কে-ই বা দিলো? কি কারণে দিয়েছে? কতরকম প্রশ্ন। আবরাজ ফিজার হাত টেনে ধরে আচমকাই। বাড়ির ভেতর যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে সাব্বির কে আদেশ করলো,

-“গাড়ি রেডি করো। টেন মিনিটস তারমধ্যে মিস্টার জি এর সাথে আমি মিট করতে চাই।”

এরপর ফিজা কে টেনে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। ফিজা পুরো হতভম্ব। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তারমধ্যে আবরাজ এর রেগে যাওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
আবরাজ মাস্টার বেডরুমে নিয়ে ফিজা কে সেটায় লক করে দিলো। সার্ভেন্ট তিনজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রুমের বাহিরে। আবরাজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে মহিলা গুলো কে সাবধান করে এলো কোনো ভাবে যেন ফিজা রুম থেকে বেরুতে না পারে।

বেশ রাত হয়েছে। বিদেশের বাড়িতে সে-সব বোঝার জো নেই। লাইটিং মানুষ এর আনাগোনা কোনো টার কমতি নেই। যে যার মতো এনজয় করছে। সাব্বির এর মন চায় এভাবে বউ নিয়ে ইচ্ছে মতো অনেক রাত অব্ধি ঘুরাঘুরি করতে। কিন্তু হায় আফসোস এটা বোধহয় এ জন্মে আর সম্ভব হবে না। তার স্যার নিজে বিয়ে করলো তিন বছর হলো। না স্যার বাসর করলো। আর না তার বিয়ের একবছরে তাকে বাসর করার মতো ছুটি দিলো। সাব্বির এর এমন সিরিয়াস মোমেন্টে এসেও এমন চিন্তাভাবনার জন্য সে নিজেই তাজ্জব বনে গেলো। কিছু সময় পূর্বে ঘটনা পুনরায় মনে পড়লো। তারা ক্লাব থেকে কিছু সময় পূর্বে ফিরেছিল। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার আগেই আবরাজ এর ঘুম ভেঙেছে। আর গেইট থেকে বাড়ির ভেতর যাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নামার পর-ই দু’জন গার্ড একটা পার্সেল নিয়ে হাজির হয় সেখানে। সেটা চেকিং করাই ছিলো। কোনো রকম বিপদজনক কিছু ছিলো না। অগত্যা প্যাকিং খুলতে আদেশ করে আবরাজ। কিন্তু পার্সেলে এমন কিছু থাকবে আশা করে নি কেউ। টাকা! টাকা আবার পার্সেল করে পাঠায় না-কি কেউ? কিন্তু কেউ একজন পাঠিয়েছিলো। আর একখানা ম্যাসেজ ও ছিলো আবরাজ এরজন্য। ম্যাসেজ টা দেখে সাব্বির এর মাথা খারাপ হচ্ছিল। সেখানে আবরাজ খান এর রেগে আগুন হওয়া টা সাব্বির এর নিকট অস্বাভাবিক কিছু মনে হলো না। গাড়ি গুলো সব একটা নিরিবিলি রাস্তায় এসে থামলো। চারদিকে সাদা বরফে ঢাকা। শুধু রাস্তা টাই কালো। কিছু সময় পূর্বে হয়তো এটা পরিষ্কার করা হয়েছে। চার চার টা কালো গাড়ি থেকে চারজন করে গার্ড বেরিয়ে এলো। পাঁচ নম্বর গাড়ি টা থেকে বেরুলো প্রথমে সাব্বির তারপর ঘুরে গিয়ে ওপাশের দরজা খুলে দিলো। গার্ড গুলো এসে সবাই সিরিয়ালে বেশ দক্ষতার সাথে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রশিক্ষনরত কি না। রাস্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিন টা গাড়ি আর পাঁচ ছয়জন গার্ড। আর মিস্টার জি। সবার চোখে কালো চশমা। গাড়ি গুলোর লাইট এর আলোতে চারপাশ আলোকিত। আবরাজ এর সৈন্য সংখ্যা তুলনায় মিস্টার জি এর সৈন্য সংখ্যা নগন্য বটে। আবরাজ নিজের রিভলবার টা বের করে লাফিয়ে নিজের গাড়ি টার উপর উঠে বসলো। একজন গার্ড এসে একটা জলন্ত সিগারেট আবরাজ এর ঠোঁটের ভাঁজে খুঁজে দিয়ে গেলো। আবরাজ এক টান দিয়ে কালো মোটা সিগারেট টা নিজের আঙুলের ভাঁজে নিয়ে আচমকাই মিস্টার জি এর পাশে দাঁড়ানো একজন গার্ড এর উপর শুট করে দিলো। মিস্টার জি এর হাতে ও সিগারেট। তিনি শুধু আঁড়চোখে তাকালো একবার নিচে নিথর দেহের গার্ড টার দিকে। ভ্রুক্ষেপহীন তিনি। আবরাজ এক এক করে সবগুলো গার্ড কে মেরে ফেললো। এরা আসলেই কি জীবিত ছিলো!

-“আপনি মানুষ হবেন না? সবগুলো কে আগে থেকে মেরে দিয়েছেন? এরা তো আপনার লোক ছিলো।”

-“আমাকে শিখাতে এসো না। আমি জানি এরা তোমার লোক। এনিওয়ে, ডিসিশন কি চেঞ্জ হয়েছে? না-কি আর কিছু ট্রেইলার প্রয়োজন?”

আবরাজ শান্ত। সিগারেট টানে। মিস্টার জি আবার বলে,

-“ক্লাবে একজন বেশ চড়া দাম দিবেন বলেছে। পছন্দ করেছে মেয়ে টাক,,,,

আবরাজ কি এতো ভালো মানুষ? বউয়ের নামে সে এমন কথা বসে বসে শোনার পাত্র? উঁহু। মোটেও নয়। আবরাজ সাথে সাথে আবার টিগার চাপে। শব্দ হয় না কোনো। শুধু মিস্টার জি নিজের হাত চেপে ধরে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেন। আবরাজ লাফিয়ে নামে গাড়ির সামনের ডিঁকির উপর থেকে। সিগারেট অদূরে ফেলে দেয় ছুঁড়ে। এরপর শান্ত স্বরে বলে উঠে,

-“এতোদিন ছেড়ে দিয়েছি বলে সব সময় ছেড়ে দেবো এটা ভাবা বোকামি। আমার ফুলের দিকে আরেকবার নজর দিলে পৃথিবীতে থেকে অস্তিত্ব মুছে ফেলবো আপনার। আপনি কি ট্রেইলার দিয়েছেন আমায়! আমি আপনাকে দিয়ে গেলাম।”

আবরাজ দু’জন গার্ড কে কিছু ইশারা করে দিলো। এরপর নিজের রিভলবার টা আবার কোমড়ে খুঁজে নিলো। পেছনে বাকি গার্ড রা সাথে এলো। সাব্বির আবরাজ এর পাশে হাঁটে। তবে দূরত্ব রয়েছে যথেষ্ট। সে বিড়বিড় করে আওড়াল,

-“ম্যাডাম এসব জানতে পারলে কি হবে ইয়া মাবুদ আমার তো এখন থেকে টেনশন হচ্ছে।”

আবরাজ আচমকাই সাব্বির এর কলার টেনে ধরলো। বেচারা আবরাজ এরচেয়ে বডি ফিটনেস কিছু টা দুর্বল। আবরাজ এর মতো বলিষ্ঠ শরীর এর তাগড়া পুরুষ এমন ভাবে কলার ধরলে জান টা বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করবে এটাই স্বাভাবিক। আবরাজ সাব্বির এর কলার ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,

-“সুগন্ধি ফুল যদি এসব জানতে পারে, আই সয়্যার তোমার আর এই জীবনে বাসর করা হবে না।”

সাব্বির এর ভয়ে আত্মা টা এতো সময় ছটফট করলেও আবরাজ এর হুমকিতে একদম শান্ত হয়ে গেলো সেটা। সাব্বির অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো, “বিয়ের পর যদি বাসর করতে না পারি, তাহলে ব্যাটাছেলে হয়ে জন্মানো টা যে বৃথা যাবে স্যার।”

ভাগ্য ভালো আবরাজ এটা শুনতে পায় নি। নয়তো তাকে নির্ঘাত এই রাতের অন্ধকারে এখানে একা ফেলে চলে যেতো এই পাষাণ পুরুষ আবরাজ খান। সাব্বির পেছনে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে দেখলো দু’জন গার্ড মিস্টার জি কে ধরাধরি করে গাড়িতে বসাচ্ছে। এবং মিনিটের ব্যবধানে তারা চলেও গেলো।
সাব্বির চারদিকে তটস্থ নয়নে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,

“স্যার পাক্কা প্রমিজ আপনার কসম ম্যাডাম কে কোনো দিন আমি এসব বলবো না। কিন্তু যদি জেনে যায়?”

-“তাহলে ও তুমি বাসর এর কথা ভুলে যাও।”

আবরাজ সাথে সাথে জবাব দেয়। সাব্বির এর মুখখানা একদম চুপসে গেলো। আবরাজ সাব্বির কে ছেড়ে দিয়ে ব্লেজার এর ভেতর শার্টে ঝুলানো কালো সানগ্লাস টা চোখে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো। সাব্বির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকে, এতো সুদর্শন একজন পুরুষ। সে ছেলে হয়েও এই বেডার উপর রোজ চৌদ্দ বার ক্রাশ খায়। কতশত মেয়ে একবার পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। আর এই বেডা একটা সাইকো। সাব্বির এর বাসর এর কথা মনে পড়ে কান্না পেলো। তবে আবরাজ এর কণ্ঠ স্বরে শুনে কান্না গুলো যেন ভয়ে বেরিয়ে এলো না। সাব্বির নিজে কে সামলে গাড়িতে গিয়ে বসে।

——-

-“আমার চব্বিশ বছর শেষ হতে আর চার মাস বাকি আছে। আমি বাচ্চা না।”

কোনো মেয়ে যে নিজের বয়স এতো ইজিলি বলে দেয় বা বলতে পারে এমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই আব্রাহাম এর। তাহার আটাশ বছরের জীবনে এমন কারোর সাথে পরিচয় হয় নি। আব্রাহাম থমথমে স্বরে বলে উঠলো,

-“দেখে বোঝা যায় না। এনিওয়ে। আমার খাবার টা একটু সার্ভ করে দিতে হবে। আমার এসিস্ট্যান্ট একটা কাজে আঁটকে গিয়েছে।”

মেহরিন কে ইশারা করে নিজের সাথে আসতে বলে আগে আগে হাঁটা ধরে আব্রাহাম।
মেহরিন কোনো কিছু না ভেবে আব্রাহাম এর পেছনে হাঁটে। আব্রাহাম অবাক হয়। একবার বলার পরপরই তাকে খাবার সার্ভ করে দিতে রাজি হয়ে গেলো? মেয়ে মানুষ তো একটু এটিটিউট ওয়ালা হবে। এমন সাদাসিধে টাইপ কেনো হবে? এর কি মাথায় ঘিলু নেই? একটা প্রাইভেট কেবিনে একজন পুরুষের সাথে একা যেতে রাজি হয়ে গেলো? অদ্ভুত মেয়ে মানুষ।

——–

-“আমার এই মূহুর্তে তোমাকে এভাবে দেখে যতোটা মাতাল মাতাল লাগছে, সন্ধ্যায় তোমার দেওয়া কড়া ডোজের অ্যালকোহলেও এতো মাতাল করতে পারে নি আমায়।।”

ফিজা পেছন থেকে আচমকাই এরূপ কথায় চমকে উঠল। রাতের পোশাক পড়ছিল মেয়ে টা। বিস্ময় নয়ন জোড়া বেশ বড়ো বড়ো আকৃতি ধারণ করলো। টাওয়াল টা দ্রুত নিজের গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো। অতঃপর ঘুরে আবরাজ এর দিকে তাকালো। দৃষ্টি মিলিত হলো। আবরাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফিজা ওয়াশরুমের কাচের দেয়াল টার দিকে তাকালো। তৎক্ষনাৎ মেয়ে টা চোখ বন্ধ করে। ইশ ওদিকে ও দেয়াল। তারমানে আবরাজ! ভাবতে পারে না আর। রাগে দুঃখে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,

-“এটা কোন ধরণের ভদ্রতা আবরাজ?”

-“ভদ্র নই আমি?”

-“ড্রেস চেঞ্জ করছি আমি।”

-“করো।”

-“আপনি বাহিরে যান।”

ফিজা নিজের রাগ সংবরণ করে কোনো রকম বলে। আবরাজ নড়ে না। বরং বাথটবে বসে। পানি নেই সেখানে। কয়েকটা গোলাপ ফুল রয়েছে। বেশ তরতাজা। হয়তো কিছু সময় পূর্বে এগুলো সার্ভেন্ট রেখেছে। আবরাজ সেখান থেকে একটা ফুল হাতে তুলে নিলো। এরপর সেটা থেকে একটা একটা পাপড়ি ছিঁড়ে ফিজার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বলে,

-“শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট করো না। আমি যাচ্ছি না।”

ফিজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আবরাজ এর দিকে। গায়ে বাহিরের পোশাক। গা থেকে কেমন ভোঁটকা একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফিজা বুঝতে পারে এটা সিগারেট এর গন্ধ। ফিজা সে-সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে চারদিকে দৃষ্টি ঘুরালো। ওয়াশরুম টা যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে যেতে হলে আবরাজ এর পাশ দিয়ে যেতে হবে। ফিজা ধীরে পায়ে একদম আবরাজ এর কাছে গেলো। সামন্য ঝুঁকে আবরাজ এর বুকে বাঁ হাত রাখলো। আবরাজ এর দ্বিতীয় বারের ন্যায় এই রমণীর অদ্ভুত ছোঁয়ায় শরীর মন শিহরিত বিস্মিত হতে লাগলো। এক দৃষ্টিতে বউয়ের বুকের খাঁজের টাওয়াল টার দিকে একবার তো চোখের দিকে একবার তাকায়। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

-“এভাবে মনোরঞ্জনের চেষ্টা! পরবর্তীতে আমাকে আবার অসভ্য বলবে। এটা কিন্তু অন্যায়।”

ফিজা মুচকি হাসলো। মনে মনে প্রচুর বিরক্ত মেয়ে টা। কিন্তু প্রকাশ্যে সেটা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সে নিজেও কিছু টা এলোমেলো। শ্বাস-প্রশ্বাস দূরত্ব চলছে। হঠাৎ আবরাজ অনুভব করলো বউ তাকে ধোঁকা দিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজা টা অদ্ভুত শব্দ করে বাইরে থেকে আঁটকে দেওয়া হয়েছে। রুমের ভেতর কি হচ্ছে সেটা ওয়াশরুম থেকে স্পষ্ট দেখা গেলেও রুম থেকে ওয়াশরুম দেখার উপায় নেই। ফিজা রুমের ভেতর থেকে আন্দাজে সাদা রঙের পর্দা টা টেনে দিলো। আবরাজ তখন ও বসে আছে বাথটবে। বউ তাকে বারবার ধোঁকা দিচ্ছে। বেচারার এটা ভেবেই যেন আসমান জমিন এক হচ্ছে। কি সাঙ্ঘাতিক মহিলা। আবরাজ বিড়বিড় করে আওড়াল,

-“আই লাইক ইট বউ। ভালোবাসি বলতে পারছি না। এটা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে। তবে তোমার এটিটিউট আমার হৃদয়ে ঝড় তুলতে সক্ষম।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#জান্নাত_সুলতানা