সুগন্ধি ফুল পর্ব-২১

0
513

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_২১
#জান্নাত_সুলতানা

-“এগুলো আপনি কোত্থেকে কখন নিলেন আবরাজ? আমি দেখি নি!”

ফিজা বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো। আবরাজ শান্ত স্বরে বললো,

-“এগুলো অনলাইন থেকে নিয়েছি।”

আবরাজ বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ফিজা সবগুলো শাড়ী নেড়েচেড়ে দেখছে। বারো টা শাড়ী আছে এখানে। সব গুলো এক্সক্লুসিভ। ফিজা জানে এগুলো অতিরিক্ত প্রাইস। এতে তার সমস্যা নেই। শাড়ী তার ভালো লাগে। আবরাজ কে গতকাল মার্কেট গিয়ে কথায় কথায় বলেছিলো এটা। যদিও ফিজা কোথাও ভালো মানের শাড়ী খুঁজে পায় নি। যা পাচ্ছিলো সেগুলো নিজের মনমতো হচ্ছিল না। অগত্যা ফিরে আসতে হয়েছিল শাড়ী ছাড়াই। বাংলাদেশ থেকে যেগুলো নিয়ে এসছিলো সেগুলোও পড়া হয়েছে দুই একবার করে। ভেবেছিলো ফিরে গিয়ে আবার নিবে নতুন করে। ফিজা শাড়ি জিনিস টা সব সময় না পড়লে এটা তার ভালো লাগে। সংগ্রহ করে সে আনন্দ নিয়ে। কিন্তু ভাবে নি আবরাজ তাকে শাড়ী দিবে। তাও এতগুলো। পছন্দের জিনিস পেলে কার না ভালো লাগে! ফিজারও ভালো লাগছে। উৎসাহ নিয়ে মেয়ে টা সব গুলো শাড়ী নিজের গায়ের ওপর বিছিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। আবরাজ বউয়ের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফিজা কালো রঙের একটা চমৎকার সুন্দর শাড়ী নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাও গায়ে বিছিয়ে দেখতে লাগলো। এটা একটু বেশি সুন্দর। ফিজা হাত বুলিয়ে নিলো শাড়ী টার ওপর। কাল সকালে এটা পড়ে সে বাংলাদেশ যাবে। তবে হঠাৎ করে কিছু মনে পড়তে মুখ টা মলিন করে নিলো। আয়নায় আবরাজ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। বউয়ের মলিন মুখ দেখে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জানতে চায় কি হয়েছে। ফিজা বললো,

-“আমরা কাল দেশে যাচ্ছি। এগুলো!”

আবরাজ বউয়ের অহেতুক চিন্তার কথা শুনে ফিক করে হেঁসে উঠলো। বোকা না-কি মেয়ে টা? সামন্য একটা বিষয় নিয়ে মন খারাপ করছে অদ্ভুত। আবরাজ ফিজার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। কিছু টা ঝুঁকে বলে,

-“আমাদের সাথে যাবে তারা।”

-“ধন্যবাদ মিস্টার মাফিয়া।”

আচমকাই এমন কথা বলবে ফিজা আবরাজ ভাবে নি। খুশি হয়েছে মেয়ে টা। আবরাজ হাসে। জিজ্ঞেস করলো,

-“শাড়ী পছন্দ হয়েছে?”

-“অনেক।”

-“আমাকেও একটু করতে পারো। এখন তো আমার এই শাড়ী ওপর হিংসে হচ্ছে। জেলাস।”

আবরাজ এর এমন উদ্ভট কথায় ফিজা না হেঁসে পারলো না। শব্দ করে হাসলো। আবরাজ বউয়ের হাসি মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ হলো। এই প্রথম মায়ের পর কোনো নারীর হাসি তাকে মুগ্ধ করলো। বুকে চিনচিন ব্যাথা করে। ডান হাত বুকের বা পাশে রাখে। অস্ফুটে বলে,

-“আমার বুকে পেইন হচ্ছে সুগন্ধি ফুল।”

-“ওমা সে কি কথা? হঠাৎ করে বুকে কেনো ব্যাথা হচ্ছে?”

-“জানি না।”

-“ডক্টর ডাকতে বলবো সাব্বির সাহেব কে?”

-“না। তুমি একটু এদিকে এসো।”

ফিজা হাতের শাড়ী বিছানায় ফেলে দ্রুত এগিয়ে এলো। আবরারজ বউয়ের হাত টেনে নিজের বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। ফিজা ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা কি। আবরাজ মুখ গোল করে শ্বাস ফেলে বেশ কয়েকবার। এরপর ফিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“এখন ঠিক আছে। চলো ঘুমিয়ে পড়ি।”

ফিজা ব্যাপার টা বুঝতে পারে। কিন্তু কি বলবে খুঁজে পায় না। বরং অল্পস্বল্প লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরলো। আবরাজ এর বাচ্চাদের মতো কান্ড দেখে আবার হাসিও পেলো।

———

-“দারুণ মানিয়েছে তোমায় এই শাড়ীতে সুগন্ধি ফুল।”

গতকাল এর সেই কালো শাড়ী। সব সময় এর মতো অল্পস্বল্প সাজ। মূলত সুন্দর লাগছে তো মেয়ে টাকে। আবরাজ এর চোখে এই রমণী কে সব সময় সব রকম ড্রেসে ভালো লাগে। তাই তো প্রতিদিন ফিজার ড্রেসআপ নিয়ে তার একটা মন্তব্য করাই চাই। বউয়ের সৌন্দর্যে প্রশংসা ও করা চাই। ফিজা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে। লাগানো শেষ আবরাজ এর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বললো,

-“এসব বলে বলে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেন।”

-“আবরাজ খান স্বেচ্ছায় কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে না।”

আবরাজ গম্ভীর স্বরে বলে। ফিজা ভ্রু টানটান করে কাঁধ উঁচিয়ে বললো,

-“ইন্টারেস্টিং। তাহলে আমি এক মাত্র মেয়ে যার সঙ্গে আবরাজ খান বেহায়াপানা করে?”

-“তুমি মেয়ে নয়। তুমি আমার বউ। মিসেস আবরাজ খান।”

আবরাজ বসে ছিলো সোফায়। ফিজার কথা ঝড়ের বেগে এসে আবরাজ মেয়ে টার একদম নিকটে দাঁড়াল। এক হাতে আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে।
ফিজার ভালো লাগে। চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবরাজ ধীরস্থিরে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয় এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। হাত দুই টা ফিজার কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে। বাহিরে কোনো কিছুর মড়মড় শব্দ হচ্ছে। অথচ কারোর খেয়াল নেই সেদিকে। দরজা চাপিয়ে রাখা। হঠাৎ সাব্বির হন্তদন্ত হয়ে সেটা দিয়ে প্রবেশ করে। সাথে ফাতিহা। মেয়ে টার হাত শক্ত করে ধরে আছে সাব্বির। আবরাজ ফিজা দু’জনেই ওদের দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। চার দিক থেকে ধোঁয়া এসে অন্ধকার হচ্ছে আশপাশ। সাব্বির আতংকিত স্বরে বলে উঠলো,

-“পেছনের আমাদের গ্যারেজে আগুন লেগেছে স্যার। দ্রুত আমাদের এখান থেকে বেরুতে হবে।”

কথা গুলো যেনো বিস্ফোরণ ঘটালো আবরাজ ফিজার কানে। ফিজা সাথে সাথে আবরাজ এর বাহু জড়িয়ে ধরলো। আবরাজ ফিজার হাতের ওপর হাত রেখে সাব্বির কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,

-“হোয়াট? কিভাবে হলো এটা? গার্ডরা কোথায়?”

সাব্বির কিছু বলার আগে বেশ জোরে শব্দ হলো। ফিজা চমকে উঠে আবরাজ কে জড়িয়ে ধরলো। আবরাজ বউয়ের হাত শক্ত করে ধরে বাহিরের দিকে পা বাড়ালো। সাব্বির ফাতিহা কে নিয়ে পেছনে এলো।
বাহিরে আগুন লাগা সম্ভব নয়। তুষারপাত হয় রাতে। কিন্তু এরমধ্যেও আগুন। সকাল এখন। পেছনের গ্যারেজ এর আগুন এর ধোঁয়া অন্ধকার চারপাশ। গেইট অনেক টা দূর। ওরা দ্রুত পা ফেলে সেদিকে। অর্ধেক যাওয়ার পর ফিজা থেমে গেলো। হঠাৎ কিছু মনে পড়লো ওর। ফিজা আবরাজ এর হাত ছাড়িয়ে নিলো। আগুন এখনো এদিকে আসে নি। আবরাজ অবাক হয়ে বউয়ের মুখের দিকে তাকায়। ফিজা বলে,

-“আপনি অপেক্ষা করুন বাহিরে আমি দুই মিনিটে আসছি।”

বলে শাড়ীর কুঁচি সামলে দৌড়ে বাড়ির ভেতর যেতে লাগলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো আবরাজ যেন কিছু বুঝতে পারছে না। যখন বুঝলো ফিজা এখানে নেই তখন মাথায় এলো ওকে আটকাতে হবে। আবরাজ ঝড়ের বেগে গিয়ে ফিজার হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে। কোনো কথা না বলে কোলে তুলে নিলো মেয়ে টাকে। ফিজা ছুটাছুটি করতে লাগলো। আবরাজ সাব্বির এর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“গাড়ির ব্যবস্থা করো। ফাস্ট।”

-“আবরাজ প্লিজ। দুই মিনিট সময় দিন আমাকে। ভেতরে লাগেজ টা।”

ফিজা আকুতিভরা টলটলে চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো। আবরাজ এর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মেয়ে টা পাগল হয়েছে? এক মিনিট পর এখানে কি হবে কেউ জানে না। আর ও দুই মিনিট সময় চাইছে!
আবরাজ রেগে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,

-“ইউ ম্যাড! তুমি দেখতে পাচ্ছো না। আগুন এদিকে চলে এসছে?”

-“আমি এতোক্ষণে চলে আসতে পারতাম। প্লিজ যেতে দিন।”

ফিজা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবদার করে। আবরাজ ফিজা কে কোল থেকে ও নামাচ্ছে না। ফিজা ছুটাছুটি করছে। আবরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

-“বাট হোয়াই?”

“-আপনার দেওয়া শাড়ির লাগেজ টা আমি সকালে সাব্বির সাহেব কে দেই নি। এটা ভেতরে রয়েছে। আনতে হবে ওটা। প্লিজ যেতে দিন।”

আবরাজ এর এবার নিচে বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইলো। ফিজা টলমল চোখে তাকিয়ে আছে আবরাজ এর দিকে। এই প্রথম আবরাজ তাকে ভালোবাসে তারই পছন্দের জিনিস দিয়েছে। আর সেটাও এখন আগুনে পুড়বে। সকালে যখন ওদের লাগেজ নিয়েছে সাব্বির তখন ফিজা ইচ্ছে করে শাড়ির মিনি লাগেজ টা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। কিন্তু কে জানতো এই প্রথম ভালোবাসার মানুষ টার দেওয়া গিফট্ এভাবে আগুনে পুড়ে ছাই হবে? ফিজা আনমনে বাড়ি টার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো আগুন এদিকে আসে নি পুরোপুরি। আবরাজ ওকে নামিয়ে দিতে ও সেদিকে দৌড়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ আবার ওর হাত ধরে ফেললো। এবার আর কোনো দিকে না তাকিয়ে এক টানে নিজের সামনে এনে গালে দুই হাত রেখে নিজের ওষ্ঠদ্বয় বউয়ের ওষ্ঠদ্বয় আবদ্ধ করলো। এই মূহুর্তে এই রমণী কে শান্ত করার এরচেয়ে উত্তম থেরাপি আর কিছু হতে পারে বলে মনে হলো না আবরাজ এর। আর হলোও তাই। ফিজা সাথে সাথে নিশ্চুপ শান্ত হয়ে গেলো। সাব্বির ফাতিহা ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিহার চোখের ওপর সাব্বির সাথে সাথে হাত ঠেকালো। ফাতিহা নিজেও সাব্বির এর চোখের ওপর হাত রাখলো। সাব্বির বউয়ের কান্ডে জিজ্ঞেস করলো,

-“এটা কি হলো?”

-“আপনি যা চাইছিলেন তাই তো হলো।”

সাব্বির হাত সরিয়ে নেয়। ফাতিহা নিজেও সরিয়ে নেয়। ততক্ষণে গাড়ি আর পুলিশের গাড়িও এসে পড়েছে।
আবরাজ ও বউ কে ছেড়ে দিয়েছে। ফিজা নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে উঠলো,

-“শাড়ী গুলো।”

-“আমি তোমায় হাজার টা শাড়ী কিনে দিতে পারবো৷ কিন্তু তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজে কে নিজে হারিয়ে ফেলবো।”

এই প্রথম আবরাজ খান এর কণ্ঠে আবেগের আবেশ অনুভব করলো ফিজা। কোনো দিকে না তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলো আবরাজ কে। আবরাজ নিজেও জড়িয়ে ধরে বউ কে। তবে পুরুষ টার মনে চলছে অন্য প্রশ্ন, আগুন টা কিভাবে লাগলো! স্বেচ্ছায় না-কি দুর্ঘটনাবশত হয়েছে এই অগ্নিকাণ্ড!

#চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]