সুগন্ধি ফুল পর্ব-২২

0
124

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_২২
#জান্নাত_সুলতানা

-“পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি তৃণা। এটা করা একদম ঠিক হয় নি মাই প্রিন্সেস। আবরাজ জানতে পারলে খুব খারাপ হবে।”

মিস্টার জি এর কথায় কোনো ভাবান্তর ঘটেনা না তৃণার সে এক মনে কিছু একটা খেয়ে চলছে। মনে হচ্ছে যা করেছে এই নিয়ে সে একটু চিন্তিত কিংবা ভয়ার্ত নয়। বরং বিরক্ত বাবা-র এ-সব কথায়। তৃণা বিরক্তিকর বিরস মুখে বলে উঠলো,

-“ওহ প্লিজ পাপা তুমি প্লিজ আমায় বিরক্ত করো না এখন। এমনিতেই আমার মুড খারাপ আছে।”

জুনায়েদ কবির এবার তৃণার খাপছাড়া গোছের ভাব দেখে রাগে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ে। মেয়ে টা এবার বাড়াবাড়ি করেছে। কি দরকার ছিলো আগুন নিয়ে খেলার বাঘের কারণে বাঘিনী কে আঘাত। এবার বাঘ ক্ষেপলে এপার-ওপার সব হাত ছাড়া হবে। তাই সে কিছু টা গম্ভীর রাগী স্বরে বলে,

-“এটা ঠিক হয় নি। আবরাজ জানতে পারলে ঝামেলা করবে। তৃণা তোমার ধারণা নেই আবরাজ এটার জন্য কতো টা ভয়ংকর হতে পারে।”

-“আমি আবরাজ কে চাই। আই ওয়ান্ট আবরাজ। তোমার কেনো এতো রাগ হচ্ছে জুনায়েদ? ওই থার্ডক্লাশ মেয়ে টার জন্য? ভুলে গিয়েছো তোমার ওই গুপ্ত ঘরের নিউজ পুলিশ কে আবরাজ দিয়েছে।”

তৃণা কিছু টা উচ্চস্বরে কথা গুলো বলে উঠলো। জুনায়েদ জানে তার ওই বেআইনি অস্ত্রের খবর টা আবরাজ পুলিশ কে দিয়েছে। এতে তার বিরাট লস হয়েছে। কিন্তু আফসোস নেই এতে। তারপরও সে আবরাজ এর সাথে মুখোমুখি হয়েও খারাপ ব্যবহার করে নি। কারণ একটাই। হ্যাঁ সেই কারণ। তৃণার কথাই সত্যি। ফিজার জন্য সে তৃণার ওপর ক্ষেপেছে। যদি আগুনে ফিজা নামের রমণীর কিছু হয়ে যেতো তাহলে জুনায়েদ নিশ্চয়ই তৃণার একটা কিছু করে ফেলতো।
মিস্টার জি মেয়ে কে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে বুঝতে পারছে না। অসুস্থতা আর নিজের জেদ মেয়ে টা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য আপাতত। এটার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। যেটা নিতে তৃণা নারাজ। তার ভাষ্যমতে আবরাজ কে সে পেয়ে গেলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মিস্টার জি জানে তৃণা কোনো দিন আবরাজ কে পাবে না। আর না কোনো দিন সুস্থ হবে সে।
মিস্টার জি হঠাৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি জানতে না ওরা আজ বাংলাদেশ যাচ্ছে?”

-“নো পাপা। জানলে রাতে দিতাম যখন আবরাজ বাসায় ছিলো না। বাট আমি তো খবর নিয়েছিলাম। আবরাজ আজ সকালে বাড়িতে থাকার কথা ছিলো না। তাহলে কিভাবে কি? উফ্ পাগল করে দিচ্ছে আমায় এই আবরাজ খান।”

তৃণা মর্মাহত হয়ে বলে। জুনায়েদ ভ্রু কুঁচকে নেয়। সে নিজেও খবর যতোটা পেয়েছে আবরাজ আজ সপ্তাহ হবে ফিজার সাথে নেই। তাহলে কিভাবে সম্ভব এটা? তবে কি আবরাজ বাড়িতে থেকেও বাহিরে মিথ্যা বলেছে সবার কাছে? কিন্তু সে তো মিস্টার জি এর পার্টনার কিম এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল। আবরাজ এর সাক্ষাৎ মানেই লাইফ হেল। জুনায়েদ মিস্টার জি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“আবরাজ ডেনমার্ক গিয়েছিল!”

-“যায় নি। আমি জানতাম এটা। শোনে নি আমার কথা।”

জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে নিলো। অতিরিক্ত রাগে চোয়াল শক্ত হচ্ছে। সে এতোদিন ছিলো না এখানে। থাকলে নিশ্চয়ই এই সুযোগ কাজে লাগাতো। তবে কিছু ভেবে বাঁকা হাসলো। ততক্ষণে তৃণা নিজের ফোনে আবরাজ এর ছবি দেখতে ব্যাস্ত। মিস্টার জি তপ্ত শ্বাস ফেলে মেয়ের পাগলামি দেখে।

———-

ফিজা ঘুমিয়ে আছে। সাব্বির এর সাথে ফোনে কথা বলছে আবরাজ।
সাব্বির অন্য গাড়িতে। জরুরি কথা আছে বিধায় আবরাজ ফিজা ঘুমানোর পর পরই কল করেছে সাব্বির কে। সাব্বির ফোনের ওপাশ থেকে বলে,

-“স্যার আপনার ইনফরমেশন ঠিক ছিলো। আমাদের আরো আগে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।”

-“আরো আগে বেরিয়ে এলে ওদের এমন আফসোস এর দাবানলে জ্বালাতে পারতাম না-কি! উঁহু। এখন জ্বলবে। ও নিজেই জ্বলবে।”

সাব্বির বুঝে ফেললো তার স্যার আসলে ইচ্ছে করে এমন টা করেছে তৃণা কে মানসিক ভাবে আরো বিধস্ত করতে।
আবরাজ আরো কিছু কথা বলে কল কাটে। ফিজা গভীর ঘুমে। আবরাজ ফোঁস করে দম ছাড়ে। মেয়ে টা লম্বা সময় জার্নি করে একদম নেতিয়ে পড়েছে। বুকে চেপে রেখেছে আবরাজ বউ কে। মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় আনমনে। পরপর থমথম খেলো। বুকের ভেতর অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলো। নিজের সিগারেটে পোড়া ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

-“সিগারেট খেলে ভালো লাগে। তবে বউকে চুমু খেলে শান্তি লাগে।”

আবরাজ খান চিন্তিত হলো সিগারেট কি তবে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ! নিয়ম করে বউয়ের ঠোঁটে চুমু খেলে কি সিগারেট এর নেশা পরিবর্তন হয়ে বউ কে চুমু খাওয়ার নেশাতে পরিবর্তন হবে!

——

বাড়িতে ফিরে ফিজার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। রাত অনেক হয়েছে। তবুও সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ফিজার মা বোন এসছে। বাড়িতে সবাই ওদের নিয়ে ব্যাস্ত হলো। আবরাজ আজ সবার সাথে প্রায় টুকটাক কথা বললো। যা আগে কখনোই করতে দেখা যায় নি। রাতের খাবার এর জন্য তাড়া দিতে আবরাজ আর ফিজা গেলো ফ্রেশ হতে। সাব্বির আর ফাতিহা ও আছে। সবাই যে যার মতো রুমে গেলো। মোহিতা বেগম বেয়াইন এর সাথে রান্না ঘরে গেলো। ইলা বেগম বেশ সৌখিন মানুষ। বাড়িতে বেশ কিছু কাজের লোক থাকলে-ও রান্না তিনি নিজেই করে। এখন রান্না ঘরে গিয়ে সব গুছিয়ে নিবে। মোহিতা বেগম ও তাই ওনাকে সাহায্য করতে গেলো। মিষ্টি ঘুমে ঢুলঢুল করছে। বাচ্চা মেয়ে। কিছু দিন আগেই পরীক্ষা দিয়েছে সে। এখন ফ্রী টাইম কাটাচ্ছে। ভাই ভাবির সাথে সাক্ষাৎ করে রুমে চলে গেলো ঘুমতে। পুরুষ বলতে আবরাজ এর বাবা আছে এখন। মিলন খান ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো। মেহরিন সোফায় বসা। বাড়িতে আব্রাহাম নেই। মেহরিন তাই আপাতত নিশ্চিন্তে আরাম করছে। কোনো অজানা কারণেই আব্রাহাম কে দেখলে কিংবা আশেপাশে থাকলে মেয়ে টা অস্থির হয়ে যায়। যা নিয়ে সে বড়োই বিরক্ত। এই পুরুষ আশেপাশে থাকলে ওর কেনো নিজে কে এমন এলোমেলো লাগে? অতিরিক্ত টেনশনে তো প্রেসার বেড়ে যায়। কি এক যন্ত্রণা। মেহরিন এসব ভেবে উঠে দাঁড়ালো। তখন সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আব্রাহাম। ফর্মাল ড্রেসআপ। লম্বাচওড়া পুরুষ টা বক্ষ টানটান করে হাঁটে। হাঁটার স্টাইলে কেমন আভিজাত্য ফুটে উঠে। মেহরিন নিজের চক্ষুদ্বয়ের পর্যবেক্ষণে নিজেই থতমত খেলো। মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত রান্না ঘরে মায়ের কাছে চলে গেলো। এদিকে আব্রাহাম ওর এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেদিকে। মেয়ে টা একদম চুপচাপ শান্তশিষ্ট স্বভাবের। যেখানে তাকে দেখলে অফিসে কিছু মেয়ে উঁকিঝুঁকি মারে৷ রাস্তাঘাটেও মেয়েরা তাকে আঁড়চোখে দেখে। স্কুল কলেজ ভার্সিটি থাকতে প্রায় প্রেমের প্রস্তাব পেতো। সেখানে এই মেয়ে তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলে। পরপরই দৃষ্টি ঘুরিয়ে সিঁড়িতে তাকাতে দৃষ্টি স্থির হয় ফিজার নামের রমণীর ওপর। নর্মাল একটা সাদা রঙের থ্রি-পিস পড়া। মাথায় ঘোমটা টানা। কিছু এলোমেলো চুল ওড়না ফাঁকফোকড় দিয়ে বাহিরে অবস্থান করছে। আব্রাহাম এর কয়েক সেকেন্ড এর জন্য বোধহয় স্থানকাল মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে পরক্ষণেই স্বয়ং আবরাজ খান কে ফিজার পেছন পেছন নিচে আসতে দেখে দৃষ্টি সংবরণ করে। মানিয়েছে চমৎকার দু’জন কে। সুঠাম দেহের চমৎকার সুদর্শন পুরুষ আবরাজ খান কে যেকোনো রমণীর নজরে লাগবে। ঠিক তারই বিপরীতে তারই স্ত্রী ফিজা সিদ্দিকী পুষ্প। আব্রাহাম নিজের কিছু সময় পূর্বে কর্মে নিজেই লজ্জিত। আবরাজ ফিজা নিচে আসতেই সে নিজে কে সামলে নিলো। ভাইয়ের সাথে তার কথা হলো। ফিজা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে দ্রুত প্রস্থান করে সেখান থেকে। চোখে পড়লো আবরাজ এর সেটা। ভালো লাগলো।
খাবার-দাবার আড্ডা শেষ হলো খুশগল্প করে। এরপর আবরাজ আগে নিজের রুমে চলে গেলো। ফিজা গাড়িতে ঘুমিয়েছে বিধায় তেমন সমস্যা হলো না। রাত অনেক করে সে রুমে এলো। ততক্ষণে রুমে লাইট অফ করে আবরাজ বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। ফিজা রাতের প্রয়োজনীয় সব শেষ করে বিছানায় গিয়ে লাফাতে লাফাতে একদম আবরাজ এর গা ঘেঁষে বসলো। আবরাজ সাথে সাথে বউ কে নিজের কোলের উপর তুলে বসালো।

আবরাজ এর গলা জড়িয়ে ধরে বসলো ফিজা। এখনো ল্যাপটপ স্ক্রিনে তাকায় নি মেয়ে টা। আবরাজ এর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

-“কি দেখছেন?”

-“তুমি দেখো।”

ফিজা কে ইশারা করে ল্যাপটপ এর দিকে তাকাতে বলে আবরাজ। ফিজা তাকায় সেদিকে। একটা ফুটেজ চলছে। কয়েক সেকেন্ড সেটা অবলোকন করার পর ফিজার চক্ষু কপালে উঠে। সাথে সাথে বলে উঠলো,

-“অসভ্য আবরাজ খান বাজে পুরুষ। ইউ,,,

বলতে বলতে ফিজা আবরাজ এর গলায় পেঁচানো হাত ছাড়াতে যাচ্ছিলো। আবরাজ সেটা হতে দিলো না। বউয়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ফিজা চোখ বন্ধ করে নিলো সাথে সাথে। যা দেখে আবরাজ বললো,

-“আমার দিকে দেখো।”

-“আপনি এটা বন্ধ করুন। প্লিজ আবরাজ।”

ফিজা চোখ বন্ধ রেখে অনুরোধ স্বরে বলে। আবরাজ স্থির কণ্ঠে বললো,

-“কখনোই না। তুমি আমাকে দেখো।”

-“আপনি বাজে। রুমে কেউ সিসি ক্যামেরা লাগায়!”

-“আমি লাগিয়েছি।”

-“আল্লাহ। রক্ষা করো। প্লিজ এটা ডিলিট করুন।”

-“করবো। শর্ত আছে।”

এটা কেমন কথা? ফিজা চোখ বন্ধরত অবস্থায় ভ্রু কুঁচকে নিলো। মুখে আওড়াল,

-“এটা কেমন কথা?”

-“এমন কথা। মানবে কি-না বলো।”

-“আগে বলুন।”

ফিজা তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো। আবরাজ ল্যাপটপ স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“তুমি ওই স্ক্রিনে দেখানো ভিডিওতে যা করেছো তা আমার সামনে ও করতে হবে।”

ফিজা চমকে উঠলো। অসম্ভব এটা। কিভাবে করবে সে এটা? আবরাজ খান এর সামনে শাড়ী পড়তে হবে? সে নিজের অনুভূতি সামলাতে পারবে তো? পারবে না। আবরাজ বউয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। কোনো রকম জবাব না পেয়ে হেয়ালি স্বরে বললো,

-“না পড়লেও সমস্যা নেই। ওখানে থাকতে যতোদিন শাড়ী পড়েছো সব গুলো ভিডিও আমি দেখবো রোজ। আর আমার সাথে তোমাকে ও দেখতে হবে।”

-“আবরাজ এটা ঠিক না।”

ফিজা অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো। আবরাজ গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো,

-“কি ঠিক না? বউ তুমি আমার। পরনারী না।”

“বউ” এই শব্দ টা ফিজার মনে প্রতিবার গভীর দাগ কাটে। আর এবারেও কাটলো। চিন্তিত হলো সে। ব্যাপার টা ভাবাভাবি থেকে সোজা একটা সিদ্ধান্তে চলে এলো। খুব বেশি তো চাচ্ছে না। তবে আবরাজ এর চাওয়ার পথ টা ভিন্ন রকম। ফিজা আবরাজ এর চোখের দিকে তাকালো এবার। বললো,

-“আপনার চাওয়া পূরণ হবে। তবে ভালোবেসে নয়। আপনার কামনাবাসনার চাওয়া আমিও কামনাবাসনা থেকে পূরণ করবো।”

#চলবে….

[বড়ো পর্ব দিয়েছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#জান্নাত_সুলতানা