#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_২৮
#জান্নাত_সুলতানা
সকালে ঘুম ভেঙে ফিজা অবাক নিজের বিছানার অর্ধেকটা জুড়ে শুধু ঝুমকো জোড়া। বাহারি রঙের থেকে শুরু করে স্বর্ণ সাথে কিছু ডায়মন্ড ও চকচক করছে। ফিজা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে ভাবলো হয়তো সে স্বপ্ন দেখছে। চোখ বন্ধ করে নিলো সে। তখন কানে আসে মোলায়েম স্বর,
-“স্বপ্ন নয় সব বাস্তব। তুমি চোখ খুলো সুগন্ধি ফুল।”
আবরাজ এর কণ্ঠ কানে আসতে ফিজা চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টি স্থির হলো ওয়াশ রুমের দরজায় দাঁড়ানো কোমড়ে টাওয়াল পেঁচানো আবরাজ খান কে। সে বিস্ময় ঘোর থেকে বলে উঠলো,
-“এসব কি আবরাজ? এতো গুলো? আমি এতো জোড়া দুল দিয়ে কি করবো?”
-“পড়বে।”
-“এদিকে শাড়ী গুলো রাখায় আপনার কাপড় রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। আপনি আবার? উফ পাগল করে দিবেন আমায়।”
ফিজা মন খারাপ সাথে হতাশ হয়ে বলে। আবরাজ কিছু ভেবে বললো,
-“সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে অপেক্ষা করো।”
এরপর রেডি হয়ে বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলো। ফিজা তখনও বিছানায় আধশোয়া হয়ে ভাবে কিছু।
——–
সকালে ফিজা নিচে এসে শাশুড়ী কে হাতে হাতে রান্না ঘরে সাহায্য করলো। ইলা বেগম যদিও না করলেন তবুও খুশিই তিনি পুত্রবধূ তারই মতো রান্নাবান্না নিজে করতে ভালোবাসে। নাশতা তৈরি করে ফিজা শ্বশুর মশাই কে ডেকে আনলো। মেহরিন সকাল সকাল বেরিয়েছে। আব্রাহাম, তৃণা আগে থেকে নাশতার টেবিলে ছিলো। আব্রাহাম নাশতা করে চলে গেলো। ইলা বেগম মোহিতা বেগম কে নিয়ে বসলেন। মিলন খান এসে নিজেও বসলো। ফিজা কে ডেকে পাশে বসালো। প্লেটে নিজে নাশতা তুলে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“দীর্ঘ দিন বাঁচো।”
ফিজা হাসলো। মিলন খান এর এই কথার মানে ফিজা বুঝতে পেরেছে। আবরাজ এর জন্যেই তো এই কথা বলেছেন। ঘরের ছেলে যে ঘরে ফিরেছে।
——–
একটা রুম। ছোট খাটো একটা শাড়ী শপিং মল বলা চলে। শাড়ী গুলো কি সুন্দর করে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা। কয়েক জোড়া মেয়েলি জুতো একটা র্যাকে সুন্দর করে সাজানো। ছোট খাটো একটা ড্রেসিং টেবিল। যার সবটা জুড়ে রয়েছে হরেকরকমের চুড়ি, কানের দুল বিভিন্ন হাতের রিং। ম্যাচিং ম্যাচিং লিপস্টিক। কয়েকটা দামী ব্র্যান্ডের পারফিউম এর কাঁচের কারুকাজের বোতল।
রুমের ভেতর একটা ছোট রুম। আবরাজ সব দিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটা কানের দুল হাতে তুলে নিলো। সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
-“পারফেক্ট সাব্বির।”
সাব্বির দরজায় দাঁড়িয়ে। ফিজা বাড়ি নেই। মোহিতা বেগম এর সঙ্গে বিকেলে গিয়েছে।
আবরাজ এর জন্য অবশ্য সুবিধা হয়েছে। আবরাজ সাব্বির কে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সাব্বির অল্পস্বল্প আঁড়চোখে রুম ত্যাগ করার আগে একবার দেখলো। আবরাজ খান এর রুমে আসার সৌভাগ্য তার হয়েই থাকে। তবে কোনো দিকে ভালো করে লক্ষ্য করা মতো দুঃসাহস নেই। আবরাজ পছন্দ করে না ব্যাপার টা। সেখানে ফিজা নামের রমণীর চার বছর এই রুম ছিলো। তার জন্য অনায়াসে আসাযাওয়া পানির মতো সহজ ছিলো। আবরাজ খান কিছুই বলে নি এব্যাপারে। বলবে কি? নিজের বউ হয় মেয়ে টা তার।
——-
ইলা বেগম রাতের রান্নার প্রস্তুতি করছে। লিভিং রুম থেকে আবরাজ মাকে ডেকে পাঠালো। তৃণা বসে আছে একটা সিঙ্গেল সোফায়। হাতে ফোন। ইলা বেগম একটা ট্রে বুয়ার হাতে দিয়ে সাথে এলো। বুয়া ট্রে রেখে চলে গেলো। ট্রেতে একটা গ্লাসে জোশ আর একটা মগে কফি রয়েছে।
আবরাজ কফির মগ টা তুলে চুমুক দিলো। আশেপাশে যে কেউ আছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গেলো আবরাজ। তৃণাও নিজের উপস্থিতি জানান দেয় না। ইলা বেগম ছেলের পাশে বসে ছেলের কপালের আশেপাশের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলেন। মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। আবরাজ গম্ভীর বললো,
-“ও বাড়ি ফিরবে কখন আম্মু?”
-“কাল সকালে চলে আসবে আব্বা। অনেকবার করে বলে গিয়েছে।”
ইলা বেগম হাসি হাসি মুখে বলে। আবরাজ মায়ের সরল মুখের দিকে তাকিয়ে এরপর বসা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ানো সাব্বির স্যার এর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। আবরাজ ব্লেজার টেনে হাঁটা ধরে সদর দরজার দিকে। সাব্বির পেছনে দৌড়য়। ইলা বেগম পেছন থেকে ছেলে কে ডাকতে গিয়েও থেমে যায়। এরপর তৃণার দিকে একবার তাকিয়ে ফের রান্না ঘরে গেলো।
তৃণা টলমল চোখে আবরাজ এর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।
———
আব্রাহাম আর জুনায়েদ এর বয়সের বেশ তফাৎ রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিলো জার্মানি থাকতে। কিন্তু গতকাল জুনায়েদ আসার পর আব্রাহাম একবার ও কথা বলে নি তার সাথে নিজ থেকে। সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলছে। জুনায়েদ এর অবশ্য এতে কিছু যায়-আসে না। সে নিজ থেকে ঘুরতে বেরিয়েছে আজ। তৃণা কে বলেছিল। তবে তৃণা আসে নি। জুনায়েদ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আওড়াল,
-“সাইকো মেয়ে মানুষ।”
গাড়ি থেকে নেমে আগে জুনায়েদ একটা ক্যাফেতে বসলো। রাতের পরিবেশ বেশ দারুণ দেখতে ক্যাফে টা। তখন নজরে পড়লো ওর সামনের একটা টেবিলে আব্রাহাম বসা। সাথে একটা মেয়ে। মেয়ে টার পেছন টা দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে চিনার উপায় নেই। তবে জুনায়েদ এর বিচক্ষণ দৃষ্টি ঠিকই চিনে ফেলে সেই রমণী কে। বাঁকা হেঁসে টেবিল ছেড়ে ওঠে গেলো। হাত দিয়ে ইশারা করে ওয়েটার কে কফি দিতে বলে নিজে গিয়ে বসলো আব্রাহাম এর পাশে। আচমকাই কেউ পাশে বসায় আব্রাহাম সহ উলটো দিকে বসে থাকা রমণী কিছু টা চমকে উঠলেও নিজেদের ধাতস্থ করতে বেশি সময় নিলো না। আব্রাহাম গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“তুমি এখানে?”
-“কি করবো বলো তোমরা তো ডোন্ট কেয়ারে রেখে দিয়েছ আমায়।”
জুনায়েদ সামনের টেবিলে বসা রমণীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। আব্রাহাম গুরুগম্ভীর। জুনায়েদ এর রসিকতার সুর ভালো লাগে না তার। সে সামনের রমণী কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“ভাবি বাড়ি যান। আমার ড্রাইভার আপনায় পৌঁছে দিবে।”
ফিজা সাথে সাথে ওঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ টা কাঁধে তুলে কিছু না বলে বেরিয়ে এলো দ্রুত পায়ে। গতকাল এর করা আবরাজ এর বিহেভিয়ার ছিলো অদ্ভুত। সে চায় না ফিজা জুনায়েদ এর সাথে কথা বলে। ফিজা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো যেন তা। জুনায়েদ ফিজার পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। আব্রাহাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“অন্য কারোর ব্যাক্তিগত নারী কে এভাবে নজর দিতে হয় না।”
-“আমি অন্য কারোর ব্যাক্তিগত নারীর দিকে নজর দিচ্ছি। তুমি তো নিজের ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দাও।”
আব্রাহাম এর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ঘৃণিত এই কথায়। আব্রাহাম ঘাড় কাত করে বলে উঠলো,
-“আমি ভাইয়ের বউ কে নিজের বোনের নজরে দেখছি। তোমার মতো জঘন্য দৃষ্টিতে দেখি না।”
-“আগে দেখতে।”
-“এখন দেখি না। আমার পার্সোনালিটি এতো টাও খারাপ নয় যে, সে অন্য কারোর বউ এটা জানার পরে-ও পেছনে পরে থাকবো। হ্যাঁ এক সময় আমি তাকে ভালোবাসতাম। বাট সেটা শুধু আমার তরফ থেকে ছিলো।”
আব্রাহাম এর কড়া জবাব। জুনায়েদ কিছু বলে না আর। ভাবার বিষয় আছে এখানে। কিন্তু মেয়ে টার মধ্যে কিছু একটা আছে। জুনায়েদ জানে না কি আছে। তবে মেয়ে টাকে এক রাতের জন্য হলেও তার চাই, চাই।
———-
ফিজা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আব্রাহাম এর গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। রাত আনুমানিক সাড়ে ন’টা। ফিজা একবার ভাবলো বাড়িতে সে উবার কিংবা অন্য কোনো কিছু দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু রাত বেড়েছে। একা যাওয়ার সাহস করে না। আব্রাহাম তার এক সময়ের খুব নিকটবর্তী বন্ধু। এখন আবার দেবর। বেশি কিছু না ভেবে গাড়িতে উঠার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। তবে গাড়িতে সিটে বসতে পারলো না। গাড়ির দরজা গাড়ির ড্রাইভার খুলে দেওয়া মাত্র কেউ ঝড়ের বেগে যেনো উড়ে এলো। হেঁচকা টানে গাড়ি থেকে দুই হাত দূরে টেনে নিয়ে এলো। গাড়ি চেক করার প্রয়োজন মনে করলো না। নিজের দানবীয় হাতের সাহায্যে কোমড় জড়িয়ে ধরলো মেয়ে টার। লম্বা চওড়া কাঁধে তুলে হাঁটা ধরে উলটো ঘুরে। ড্রাইভার মাথা নত করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। গম্ভীর স্বরে পুরুষ টা সালামের জবাব নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-“আপনি আপনার স্যার কে নিয়ে চলুন। আমার বউয়ের জন্য আমি আছি।”
গাড়ির দরজা খুলে ব্যাক সিটে বসাতে ফিজা নিজের এলোমেলো চুল ঠিকঠাক করে বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো,
-“এসব কি আবরাজ? রাস্তাঘাটে উফ মুখ দেখানোর পথ বন্ধ করে দিচ্ছেন। ড্রাইভার আঙ্কেল কি ভাবছেন ইশ!”
আবরাজ ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে ফিজার সিট বেল্ট বেঁধে দিতে দিতে বললো,
-“আই ডোন্ট কেয়ার।”
-“আপনার কাছে এসব আই ডোন্ট কেয়ার হলেও বাট আই ডু।”
ফিজার এই কথায় যেন আগুনে ঘি ঢালে। আবরাজ নিজের সিট বেল্ট বাঁধলো না। ফিজার দিকে ঝুঁকে এসে ঘাড়ের ওপর থেকে চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ভাসে গভীর ক্ষত। গোল গোল চিহ্ন। আবরাজ আবার সেগুলোর ওপর ঠোঁট বসালো। নিজের রক্ষ সিগারেটে পোড়া ওষ্ঠদ্বয়ের সাহায্যে আবার তাজা করে ক্ষতস্থান। ফিজার দম বন্ধ হয়ে আসে। কলিজায় চিনচিন ব্যাথা আর বুকে অসহ্য এক যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে সে। আবরাজ ব্যাথাতুর শব্দে আরো উন্মাদ হলো। গাড়ির ভেতর জ্বলতে থাকা লাইট অফ করে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয় আঁকড়ে ধরলো। ফিজা ফুঁপিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাসের শব্দ বলছে সে আহত। আবরাজ এর কর্মে সে মর্মাহত। আবরাজ বউ কে সময় নিয়ে গাঢ় হতে প্রগাঢ় এক চুমু খেলো। অন্ধকারে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের বাঁ পাশে ফিজার ডান হাত টা চেপে ধরে বলে উঠলো,
-“এই-যে এখানে, এখানে এসে একদম ঠিক করো নি তুমি। এরজন্য তোমার শাস্তি প্রাপ্য সুগন্ধি ফুল।”
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]