সুগন্ধি ফুল পর্ব-৩৫

0
288

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৩৫
#জান্নাত_সুলতানা

আব্রাহাম মাত্রই আবরাজ এর কাছে এসছিলো। দরজায় দাঁড়ানো মাত্র রুহু অব্ধি কেঁপে উঠলো পুরুষ টার। ভাইয়ার আর্তনাদ তার কানে বিস্ফোরণ ঘটালো। আবরাজ এর করুণ কণ্ঠে আব্রাহাম স্তব্ধ। ফিজা ছটফট করছে। আবরাজ কোলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আব্রাহাম কিছু জিজ্ঞেস করলো না। মোহিতা বেগম মেহরিন দৌড়ে এলো। মেয়ের অবস্থা দেখে কেঁপে উঠলো মোহিতা। চিৎকার করে কেঁদে ফেললো তিনি। মেহরিন মা’কে ধরবে না-কি বোনের কাছে যাবে? দিশেহারা মেহরিন বোনের কাছে এলো। অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপু এমন করছে কেনো ভইয়া?”

কি জবাব দিবে আবরাজ? সে নিজেও তো জানে না বউ কেনো হঠাৎ করে এতো কাঁপছে। আব্রাহাম ফোন বের করে নিজে আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। কাউ কে কল করে সে গাড়ি বের করলো। আবরাজ সেদিকে ছুটে। মেহরিন নিজেও মা’কে নিয়ে পেছনে ছুটতে লাগলো।

—–

সাব্বির সব রেডি করে রেখেছিল আগে থেকে। ওরা হসপিটাল পৌঁছানোর পর ডক্টর সাথে সাথে ওটিতে নিয়ে গেলো ফিজা কে। আবরাজ সাথে যাবে। কিন্তু মহিলা ডক্টর টা যেতে দিলো না। দরজা টা দ্রুত লাগিয়ে দিলো। আবরাজ মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসা পড়লো। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণায় সে হাসফাস করতে লাগলো। হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো মেয়ে টার সে বুঝতে পারে না। সাথেই তো ছিলো। ভালো ছিলো। ঘুম থেকে হঠাৎ ছটফট করে উঠলো। আবরাজ চোখ জ্বলে। এতো মায়া মেয়ে টার প্রতি তার। কিছু হলেই সে পাগল হচ্ছে।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে মহিলা ডক্টর টা বেরিয়ে এলো। সকালের সেই মহিলা। আবরাজ উনার দিকে চোখ তুলে চাইলো। ডক্টর সার্জিক্যাল মাস্ক মুখ থেকে খুলে বলে উঠলো,

-“পেশেন্ট ইজ নাউ আউট অফ ডেঞ্জার। আমার কেবিনে আসুন। সব জানা আপনার জরুরি।”

আবরাজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বউ ভালো আছে। কিন্তু কষ্ট তো পাচ্ছে। সে ডক্টর এর পেছনে এলো। কি বলবে ডক্টর? তার বুক টা দুরদুর করছে। আবরাজ কেবিনে এসে চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসতে ডক্টর বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এলো। চেয়ারে বসে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

-“নিজে কে মানসিকভাবে স্থির রাখবেন। জানি হার্ট টাচিং এসব কেস। তারপর আমাদের কিছু করার নেই।”

আবরাজ অবাক হচ্ছে। কি এমন বলবে ডক্টর যে এতো টা পরামর্শ দিচ্ছেন! বউ ঠিক আছে তো? কিছু হবে না তো মেয়ে টার? আবরাজ ঘোর থেকে মাথা কাত করে সম্মতি দিলো।

-“স্লো-পয়েজন যেটা গর্ভাবস্থায় খেলেও মিসক্যারেজ ঘটায় কিন্তু মায়ের খুব একটা ক্ষতি করে না। এমন বিষ খুঁজে পাওয়া বেশ জটিল। কারণ অধিকাংশ বিষই মায়ের শরীরেও ক্ষতি করে। তবে কিছু পদার্থ আছে যেগুলো প্রজনন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এবং গর্ভপাত ঘটাতে পারে। বিশেষত যদি সেগুলো স্বল্প মাত্রায় দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়ানো হয়।
ধীরে ধীরে ইউটেরাস কন্ট্রাকশন ঘটায়। ফলে মিসক্যারেজ ঘটে।
মায়ের ওপর অতটা দ্রুত প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বাচ্চার জন্য মারাত্মক।
এই বিষ কোনো মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে মারে না। বরং নীরবে, নিঃশব্দে শরীরের ভেতরে গড়ে তোলে এক শূন্যতা।
প্রথমে ক্লান্তি আসে, ক্ষুধা কমে যায়, শরীর অকারণে দুর্বল লাগে। কেউ সন্দেহও করে না।
তবে দিন গড়ায়। আর এক সময় শিশুর হৃৎস্পন্দন মিলিয়ে যেতে থাকে। নিঃশব্দে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে,
তাহলে কি এ ধরণের কেসে পরবর্তীতে আর মা হওয়া যায় না? সঠিক মাত্রায় ও একবারের ব্যবহারে সাধারণত ভবিষ্যতে মা হওয়া সম্ভব থাকে।
বারবার ব্যবহারে বা অতিরিক্ত ডোজে গর্ভাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থায়ীভাবে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে। তবে সেটা কতটুকু কেমন মাত্রায় দেওয়া হয়েছে সেটার ওপর ভিত্তি করে।
অনেক সময় এর প্রভাবে প্লাসেন্টা ছিঁড়ে যায় বা ইনফেকশন হয়। যা ভবিষ্যতের গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। কিন্তু আপনার স্ত্রী তেমন কিছু হয় নি। খারাপ হবে না আমরা আশাবাদী। তবে সময় লাগবে সে সুস্থ হতে। নিজেদের মধ্যে আপাতত অবশ্যই ডিস্টেন্স মেইনটেইন করতে হবে। আমি সকালে এমন কিছু হয়েছে বুঝতে পারলে কখনোই এতোটা নরমালি নিতাম না বিষয় টা। নরমাল মিস ক্যারেজ ভেবেছিলাম। এখন আপনার সিদ্ধান্ত আপনি কি করবেন।”

ডাক্তার এতটুকু বলেই থামলো। কত সহজ সরল উক্তি।
আবরাজ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ডক্টর এর দিকে। শরীরে কোনো ক্ষত নেই। কিন্তু বুকের ভেতরে এক অদৃশ্য আগুন পুড়ছে।
কোনো কিছু না বলে সে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। সাব্বির দাঁড়িয়ে বাহিরে। আবরাজ দুই কদম এগিয়ে যেতে আব্রাহাম কোত্থেকে এসে ভাই কে জড়িয়ে ধরলো। সাব্বির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। এই একটা মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তা আর কতো টা খেলবে কে জানে।

——

ফিজা কে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। খিঁচুনি আর আসবে না। ঔষধ দেওয়া হয়েছে। আবরাজ বউ কে কোলে তুলে গাড়ি অব্ধি নিয়ে এলো। পেছনে স্যালাইন এর বোতল আব্রাহাম ধরে রেখেছে। আবরাজ সাবধানে গাড়িতে বসলো। আব্রাহাম মেহরিন আর মোহিতা বেগম কে নিয়ে অন্য একটা গাড়িতে বসলো। সাব্বির আবরাজ এর গাড়ির ড্রাইভ করছে। খান বাড়িতে এসে গাড়ি থামলো। ইলা বেগম মিলন খান অস্থির পায়ে পায়চারী করছেন সদর দরজায়। গাড়ির শব্দে দুজনেই বেরিয়ে এলো। ফিজার অবস্থা দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। রাত দেড় টা। আবরাজ বউ নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। একজন সার্ভেন্ট গেলো ফিজার ড্রেস চেঞ্জ করতে। আবরাজ নিষেধ করে দিলো। ইলা বেগম করতে চাইলেও দিলো না। খাবার রেখে সবাই কে পাঠিয়ে দিলো।
দীর্ঘক্ষণ সময় পর সে বউ কে ফ্রেশ করে স্যালাইন খুলে দিলো।
স্যালাইন শেষ হলে খাবার দিলো। খুব স্বল্প পরিমাণে খেলো ফিজা। ক্লান্ত শরীর খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো সে।
আবরাজ বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে ফোন টা নিয়ে বেরিয়ে এলো। একদম নিচে গার্ডেনে এসে থামলো। সাব্বির তখনও অপেক্ষা করছে স্যার এর জন্য। আবরাজ আসার পরপরই তাদের মধ্যকার কিছু কথোপকথন হলো। কে করেছে এই জঘন্য কাজ? উত্তর নেই। আবরাজ পাগলপ্রায়। যেভাবে হউক খুঁজে বেড় করতে হবে। এরপর প্রায় আধাঘন্টা পর আবরাজ এর ফোন বাজলো।
আবরাজ বিরক্ত হলো বড্ডো। তৃণা মেয়ে টা আবার কেনো কল করেছে? সে তো চিকিৎসার জন্য বলেছে, তাহলে? আবরাজ কল রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বলে উঠলো,

-“আবরাজ কেমন লাগলো নিজের অস্তিত্ব হারানোর বেদনা? হার্টে পেইন হচ্ছে? ডু ইউ নো তুমি আমার অস্তিত্ব। আমারও বুকের ভেতর বড্ডো জ্বলে। আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছো তুমি।”

আবরাজ নিজের হাতের ফোন টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো দূরে। ফ্লোরে পড়ে থেঁতলে গেলো সেটা। সাব্বির চমকে উঠলো। চিন্তিত ভয়ার্ত দেখালো তাকে। তৃণা কল করেছে। কি এমন বললো যে আবরাজ রেগে গেলো? সাব্বির এর গলা শুঁকিয়ে আসে। স্যার তার ভীষণ আপসেট আজ। সকালের পর থেকে সে নিশ্চুপ। সাব্বির সাহস সঞ্চয় করলো৷ কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আবরাজ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো,

-“ওর সাহস কি করে হয় আমার অস্তিত্বের দিকে হাত বাড়ায়? জানে মেরে ফেলবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী।”

সাব্বির ফের চমকে উঠলো। বিস্ময় হতভম্ব হয়ে গেলো। মানুষ এমন হয়? হয়। তৃণার মতো সাইকোরা হয়। আবরাজ এর চোখ লাল হয়েছে। চোয়াল শক্ত করে আবরাজ সাব্বির কে বললো,

-“টিকিট রেডি করো। ফাস্ট জার্মান ব্যাক করতে চাই আমি।”

আবরাজ বাড়ির ভেতর চলে গেলো। সাব্বির তপ্ত শ্বাস ফেললো। নিসন্দেহে তৃণার জন্য ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে। এবার মিস্টার জি ও কিছু করতে পারবে না।

——–

ঘুমিয়ে আছে ফিজা। বড্ডো দুর্বল মেয়ে টা। দুর্বল হওয়া টা খুব কি অস্বাভাবিক? গত তিন দিন নাগাদ মেয়ে টা কে একটু একটু করে বিশ দেওয়া হয়েছে। এমন ভয়ংকর কাজ টা তৃণার ধারা সম্ভব একা হয়েছে? এটার সাথে কি কেউ সামিল নেই? আবরাজ চোয়াল শক্ত করে রাখে। কিছু মানুষরূপী অমানুষ থাকে। এরা যে থালে খাবে সেই থালই ফুটো করবে। আবরাজ আলতো করে বউয়ের শরীর থেকে কম্ফর্টার সরিয়ে দিলো। সাধারণ পোশাক পড়ে আছে মেয়ে টা। পাতলা একটা গেঞ্জি আর প্লাজু। আবরাজ গেঞ্জি সরিয়ে আলতো করে বউয়ের পেটের ওপর হাত রাখলো।
নিষ্পাপ এই অস্তিত্ব টা তাদের ধরা দেওয়ার আগেই ঝরে গেলো। কি ভয়ংকর সেই অনুভূতি। আবরাজ চুপচাপ বউয়ের পেটে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। আলতো করে জড়িয়ে ধরে পাশে শুয়ে রইলো। ক্রোধিত হয়ে পুরুষ টা আওড়াল,

-“তুই শুধু আমার সন্তানকে মেরেছিস না,আমার কোলকে, আমার ভবিষ্যৎকে, আমার স্বপ্নগুলোকে বিষ খাইয়েছিস। এখন তুই দেখবি এই আবরাজ খান কতোটা ভয়ংকর।”

মূহুর্তে যেনো রূপ বদলে নিলো সে। রাগান্বিত স্বর কোমল হয়ে এলো। মোলায়েম স্বরে বলে উঠলো,

-“আমি তোমায় ভালোবাসায় যতোটা অবুঝ। ঠিক তোমার দুঃখে ততটা ভয়ংকর বেপরোয়া হতে প্রস্তুত।”

——

মেহরিন এই প্রথম আব্রাহাম এর রুমে। অস্বস্তি নেই তেমন একটা মেয়ে টার মধ্যে। ইলা বেগম নিজেই পাঠিয়েছে মেহরিন কে। সে নিঃসংকোচে এসছে। তারমধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই বরং সে অস্থির। বোনের এমন অবস্থা হবে হয়তো সে কোনো দিন কল্পনা করে নি। ফ্রেশ হয়ে এসে সে শুয়ে পড়লো। আব্রাহাম বসে আছে। চিন্তিত দেখাচ্ছে। মেহরিন এর মনের অবস্থা খুব খারাপ। বোন কে সে মায়ের পরে অনেক বেশি ভালোবাসে। বোন তাকে সেই ছোট্ট থেকে আদরে যত্নে ভালোবেসে আগলে রেখেছে। আজ বোনের এমন অসহায়ত্ব সত্যি দুঃখজনক। তারউপর ইচ্ছে করে কেউ এমন করে মেহরিন এর কল্পনার বাইরে ছিলো। কে দিলো পয়েজন? কেনো করলো ছোট এই প্রাণ টার সাথে এমন নির্মম অন্যায়? মেহরিন এর শ্বাস দীর্ঘ হয়। আঁখি কোঠর ছলছল করে ওঠে।
আব্রাহাম খেয়াল করলো মেহরিন এর গায়ে বাইরের সেই পোশাক। যার অবস্থা এমন এ-সব পড়ে রাতে ঘুম অসম্ভব। লং কারুকাজ এর একটা গাউন। আব্রাহাম বিছানা ছাড়লো। নিজের আলমারি খুলে একটা শার্ট নিয়ে ফিরে এলো। এরপর মেহরিন কে ডাকলো নিজের হাতের শার্ট টা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“এটা পড়ে এসো। কম্ফোর্ট পাবা। নয়তো ঘুম হবে না।”

মেহরিন হাসার চেষ্টা করে। বললো,

-“সমস্যা হবে না আমার। রাত তো প্রায় শেষ।”

মুখের ওপর অকপট এমন কথা আব্রাহাম অস্বস্তিতে পড়লো। কিছু না বলে শার্ট টা আগের স্থানে গিয়ে রেখে এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।

মেহরিন ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। এমন বিহেভিয়ার কেনো করলো? আব্রাহাম কি কোনো ভাবে এক্সেপ্টেশন রেখে ছিলো মেহরিন তার কথা শুনবে? মেহরিন এর খারাপ লাগলো। আব্রাহাম তো তার ভালোর জন্যে বলে ছিলো। কিন্তু আরেকবার জোর করতে পারতো।

#চলবে…

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আগামীকাল বড়ো পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।]