সুগন্ধি ফুল পর্ব-৩৬

0
231

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৩৬
#জান্নাত_সুলতানা

বহুদিন পর আবরাজ নিজের গোডাউনে এলো৷ রাতের শেষ প্রহর। সাব্বির ভাবে নি আবরাজ খবর পাওয়া মাত্র আবার ছুটে আসবে। তার বিশাল এই গোডাউনে তিনশো এর অধিক কর্মচারী এবং একশো এর অধিক গার্ড রয়েছে। পুরো টা এরিয়া জুড়ে মানুষ। বলিষ্ঠ সুঠাম দেহের মানুষ টার পেছনে দশ থেকে বারো জন গার্ড। সাব্বির একজন কে ইশারা করতেই দু’জন গিয়ে কালো মুখোশ পরিহিত একজন কে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো। আবছা অন্ধকার। তবে স্পষ্ট সব। আবরাজ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে এটা একজন মহিলা। আবরাজ চোয়াল শক্ত করে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো সে। সামনের মানুষ টার মুখের ওপর থেকে কালো মুখোশ টা সরিয়ে দেওয়া হলো। সাব্বির একটু চমকায় না। সে নিজেই তো ধরেছে এই মানুষ টাকে। আবরাজ খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে সামনে এগিয়ে এলো। আবরাজ কে দেখে মহিলা টা খুব জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। খুব বেশি বয়স না। ত্রিশ প্লাস হবে। খান বাড়িতে কাজ করে আজ বছর পাঁচ হবে। বিশ্বস্ত হয়ে উঠে ছিল মাত্র। কেউ হয়তো কল্পনাও করে নি এমন কিছু করবে এই সার্ভেন্ট। আবরাজ স্বযত্নে উনার ডান হাতের কবজি বরাবর রিভলবার তাক করে ট্রিগার চাপলো৷ সাথে সাথে আর্তনাদ ভরে উঠলো পরিবেশ। আবরাজ মেঝেতে পরে থাকা একটা পাটের বস্তা তুলে সেটার একটা কোণ মুখে ঠেসে দিলো মহিলার। এক হাত ধরে রেখেছে গার্ড। আরেক হাতে গুলি। মুখে বস্তা। কি ভয়ংকর সেই দৃশ্য। নিঃশব্দে আর্তনাদ। কেউ শুনে না। দেখে না। টের পায় না কেউ। যেমন টের পায় নি সে নিজের অস্তিত্ব একটু একটু করে নিঃশ্বাস নীরবে নিভে আসা।
আবরাজ ফিরে আসে সেখান থেকে। এই হাত দিয়ে দ্বিতীয় বার কারোর ক্ষতি করা তো দূর চিন্তাও করবে না। আবরাজ গেইট থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে গেইট বন্ধ করে দেওয়া হলো। গেইটের বাহিরে কোনো গার্ড এলো না। সাব্বির আবরাজ এর গা থেকে ওভার কোট খুলে নিজের হাতে নেয়। আবরাজ নিজের শার্ট ঠিকঠাক করে নেয়। নরমাল ড্রেসআপ। শার্ট এর হাতা ফোল্ড করে কনুইয়ের ওপর ভাজ করে রাখলো। স্বাভাবিক ভাবে বললো,

-“জন এর সাথে কথা বলো। মিস্টার জি এর সাথে সব ডিল ক্যান্সেল ফাইনাল করে দাও। আজ থেকে কোনো কনটেইনার শিপ আবরাজ খান তাকে দিবে না। আজীবনের জন্য এটা নিষিদ্ধ করলো আবরাজ খান।”

সাব্বির প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে ঠিকই নিজে কে সামলে নিলো। কিন্তু এতে শুধু মিস্টার জি এর ক্ষতি হবে না। আবরাজ এর ও হবে। এতো এতো শ্রমিক এর দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। সে যখন এসব ভাবনায় মত্ত। আবরাজ তখন আবার বললো,

-“এখানে সকল শ্রমিকদের বলে দিবে আজ থেকে কোনো পন্য সামগ্রি বাহিরে যাবে না। এখানে যা পণ্য আগে বাহিরে যেতো তা সব দেশে থাকবে। নতুন কোম্পানি স্টার্ট এর ফার্স্ট স্টেপ।”

———–

ফিজা ঘুম ভেঙে আবরাজ কে নিজের পাশে পেলো। বসে আছে পুরুষ টা। ফিজা আবরাজ এর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে যে প্রশ্ন টা মাথায় এলো সেটা হচ্ছে আবরার কি ঘুমায় নি? চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? ফিজা উঠতে নিলে আবরাজ সাহায্য করলো। মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,

-“এতো দ্রুত উঠে গেলো আমার ফুল?”

-“গত পরশু থেকে শুয়ে-বসে দিন কাটছে আমার আবরাজ।”

ফিজা উঠে বসতে বসতে বললো। আবরাজ মাথা নেড়ে বলে,

-“আই সী। তো কি করা যায় এখন?”

-“আপাতত কিছু না। ফ্রেশ হবো আমি।”

আবরাজ বউ কে একা ছাড়ার পাত্র না-কি? উঁহু। নিজেই খুব সাবধানে কোলে তুলে নিয়ে এলো ওয়াশ রুমে। ফিজা একটুও অবাক হয় না। অস্বস্তি লাগে না। স্বাভাবিক এটা। আবরাজ কাল থেকে তাকে নিচে হাঁটতে দিচ্ছে না-কি? মনে হচ্ছে যেনো মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে ধরবে মাথায় নিলে উঁকুন। ফিজার মন গহীনে ফাঁকা লাগে। বুক হাহাকার করে। ইশ আবরাজ নিশ্চয়ই নিজের অস্তিত্ব আসছে শোনার খুশিতে পাগল হতো? এখন এমন করছে তখন নিশ্চয়ই আরো পাগলামো করতো। ফিজার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। কেনো যে হলো এমন।

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে ফিজা কে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। চুল শুঁকানোর আগেই ইলা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো খাবার হাতে। আরেকজন সার্ভেন্ট ও আছে। তবে প্রতিদিন যে মহিলা ফিজা কে খাবার দিতো সে না। ফিজা তেমন পাত্তা দিলো না বিষয় টা। নর্মালি নিলো। যেহেতু বাড়িতে সার্ভেন্ট রয়েছে ঢের সেইজন্য এটা তেমন ভাবার বিষয় ও না। ইলা বেগম খাবার দিয়ে ফিজার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে চলে গেলো। আবরাজ ফিজা কে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খুব দ্রুত খাবার শেষ করলো। রেডি হয়ে ফিজার সামনে এসে দাঁড়ালো। বউয়ের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

-“অফিস যেতে হবে সুগন্ধি ফুল। তিন দিন হয় যাই না।”

-“আপনি টেনশন করবেন না। আমি এখন সুস্থ আছি।”

ফিজার কথায় আবরাজ স্বস্তি পায়। আজ তিন পর বউ তার সাথে এমন স্বাভাবিক ভাবে কথা বললো। তার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। গম্ভীর মুখে রসাত্মক কথা শোনা গেলো,

-“হু। বাট আমাকে সামলানোর মতো না।”

বলতে বলতে হাত রাখে মেয়ে টার ঘাড়ে। ফিজা বাঁকা চোখে সেদিকে এক পলক তাকালো। পুরুষ টার মতিগতি সুবিধার ঠেকাচ্ছে না৷ যখনই আবরাজ কাঁধের দিকে গাউন এর ফিতা সরাতে যাবে ফিজা গম্ভীর স্বরে ডাকলো,

-“আবরাজ।”

-“বলো সুগন্ধি ফুল।”

শান্ত মাদকাসক্ত স্বরে বললো আবরাজ। ফিজা শরীর দুর্বল। তবুও ব্যাক্তিগত পুরুষের ছোঁয়ায় মন টা যেনো কেমন চনমনে হয়ে উঠলো। কিছু আর বলার জন্য মুখ খুলতে পারে না। শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। আবরাজ বউয়ের কাঁধ বরাবর বেশ কয়েকবার গভীর করে ঠোঁট বসিয়ে সরে এলো। তিন দিনের অসুস্থতায় বউয়ের ঠোঁট জোড়া ফ্যাকাসে হয়েছে। কেমন নির্জীব নিষ্ক্রিয় দেখাচ্ছে। আবরাজ থুঁতনিতে হাত রেখে ঠোঁটের ওপর আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। ফিজা বড্ডো লজ্জায় পড়লো। কত দিন সে নিজের যত্ন করছে না। নিজের কেমন লাগলো। যেখানে সর্বদা আবরাজ পরিপাটি চকচকে জিনিস পছন্দ সেখানে তার ঠোঁটে চুমু খাওয়া পুরুষ নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে চুমু খেলো। কিন্তু ফিজার ভুল ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগলো না। আবরাজ পরপরই দীর্ঘ এক চুম্বন করে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়ে। ফিজা মুখের ভেতর ঠোঁট পুরে নিতে আবরাজ বিরক্ত হয়ে সরে এলো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

-“হোয়াট?”

-“রাতে আমি নিজে গুছিয়ে রাখবো।”

ফিজা মিনমিন করে বলে। আবরাজ সাথে সাথে প্রশ্ন করে,

-“এখন কি?”

ফিজা কিছু বলে না। আবরাজ বউয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না সে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবে। পরপরই আবার আঁকড়ে ধরলো বউয়ের অধর। ফিজা এবার ও ছোটাছুটি করলো। আবরাজ এবার ছাড়লো না। নিজের কাজ শেষ হতে সরে এলো। দুই হাতে মেয়ে টার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠলো,

-“তুমি আবরাজ খানের চোখে এমনিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নারী। এর বাইরে গিয়ে তোমার কোনো সৌন্দর্যের প্রয়োজন নেই সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা বিস্ময় চরম পর্যায়ে পৌঁছাল বোধহয়। সে কি তবে এতো দিন ভুল ধারণা পোষণ করে এসছে মনে? আবরাজ খান তার রূপের মোহ নয় তাকে সত্যি ভালোবাসে? উত্তর নেই। দেই নি এই পুরুষ উত্তর। আবরাজ এরপর গাঢ় চুমু খেয়ে বউয়ের কপালে বেরিয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। ফিজা চিন্তায় মগ্ন। সত্যি টা কি? সত্যি আবরাজ খান তাকে ভালোবাসে না-কি শুধুমাত্র অভিনয়।

——

মেহরিন এর ঘুম ভাঙলো সকালে সাড়ে আটটায়। তা-ও আবার শাশুড়ির ডাকে। খাওয়ার জন্য তিনি মেয়ে টাকে ডেকে চলেছে অস্থির হয়ে। মেহরিন ওঠে বসলো দ্রুত। ঘুম ভেঙে বোঝার চেষ্টা করলো এটা ওর শাশুড়ি। অস্থিরতা বাড়লো বৈ কমলো না। অপরাধ লজ্জায় মেয়ে টার মাথা নুইয়ে আসে। ইলা বেগম ভালো মানুষ। মেহরিন জানে। তবুও স্বল্পভাষী ভীতু স্বভাবের মেহরিন একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। শাশুড়ি ছেলের বউ কে ঘুম থেকে ডেকে তুলছে। লজ্জার ব্যাপার এটা মেহরিন এর দৃষ্টিতে। মিনমিন করে বললো,

-“সরি আন্টি।”

-“কেনো?”

ইলা বেগম ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো। মেহরিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ইলা বেগম তাগাদা দিতে মেহরিন ওয়াশ রুম গেলো। ইলা বেগম মুচকি হেঁসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

—–

ফিজা সারাদিন নিচে আসতে পারে নি। রুমে শুয়ে-বসে দিন কেটেছে। মেহরিন ইলা বেগম সঙ্গ দিয়েছে। আবরাজ সময় সময় ফোন করেছে। মোহিতা বেগম দুপুরে চলে গিয়েছে। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকা টা তিনি ভালো মনে করেন না। ফিজা সন্ধ্যায় মেহরিন কে বলেকয়ে নিচে আসার জন্য রাজি করালো। ধীরেধীরে হেঁটে এসে সোফায় বসলো। রোজকার ন্যায় সন্ধ্যায় কলিং বেল বাজলো। সার্ভেন্ট দরজা খুলে দিলো। মিলন খান এসছে। হাতে করে সব সময় এর মতো পুত্রবধূর জন্য বাইরে থেকে ভাজাপোড়া নিয়ে এলো। এসেই পলিথিন খুলে নিয়ে বসলো। মেহরিন বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে। গরম গরম পাকোড়া নিজে হাতে তুলো ফিজা কে দিলো। ফিজা মুচকি হেঁসে হাতে নিলো সেটা। মিলন খান দেরি করে না। টুপ করে ফিজার কপালে স্নেহের চুমু খেলো। এরপর মেহরিন এর হাতেও দিলো। মেহরিন একটু অপ্রস্তুত হলো। আজ মিলন খান ই তাকে সকালে বাড়ি যেতে নিষেধ করে গিয়েছে। মেহরিন এর অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পেরে মিলন খান বললো,

-“আমার দুই টা আম্মা।”

মেহরিন এর বড্ডো প্রশান্তি এলো মনে। সে বাবা-র আদর স্নেহ মমতা কিছুই পায় নি। এখন মনে হচ্ছে সেটা পুষিয়ে যাবে শ্বশুর নামক মানুষ টাকে দিয়ে।

মিলন খান যেতে একজন সার্ভেন্ট এলো। ইলা বেগমও এলো। তিনজন চা হাতে আড্ডায় বসলো। ফিজা বেশ অবাক হলো। প্রতিদিন তাদের যে চা দেয়। তাকে যে সার্ভেন্ট রুমে খাবার দিতো সেই মহিলা কে আজ একবার ও দেখলো না সে। ফিজা ইলা বেগম কে জিজ্ঞেস করলো,

-“আম্মু সুমি আপাকে দেখলাম না আজ। উনি কি ছুটিতে?”

-“আর বলিস না। কাল রাতেই না-কি ও গ্রামে চলে গিয়েছে। আর কাজ করবে না।”

ফিজা ছোট করে জবাবে বললো “ওহ” এরপর আর কোনো কথা হলো না এব্যাপারে।

——

গাড়ি চলে। আব্রাহাম আবরাজ দু’জনে ই বসে গাড়িতে। আবরাজ এর কোলের ওপর ল্যাপটপ। আবরাজ কিছু দেখছে। তবে ভদ্রতার খাতিরে আব্রাহাম সেদিকে তাকায় না। আব্রাহাম সিটে মাথা এলিয়ে রাখা অবস্থায় বলে উঠলো,

-“ভাইয়া!”

-“হ্যাঁ বলো।”

আবরাজ ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে। আব্রাহাম বললো,

-“তুমি ওখানে না যাও।”

-“যেতে হবে।”

আবরাজ এর সোজাসাপটা জবাব। আব্রাহাম চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,

-“জুনায়েদ এখনো এখানে রয়েছে।”

আবরাজ ল্যাপটপ এর শাটার বন্ধ করলো এবার। ঘাড় বাঁকিয়ে আব্রাহাম এর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,

-“আমার সুগন্ধি ফুল নিজে কে সেইভ করতে জানে। আমার জন্য আমার সুগন্ধি ফুল নিজে কে আগলে রাখবে।”

#চলবে….

[বড়ো পর্ব দিয়েছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]