সুগন্ধি ফুল পর্ব-৩৮

0
139

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৩৮
#জান্নাত_সুলতানা

আবরাজ দাঁড়িয়ে বিশাল রাজপ্রাসাদ এর ন্যায় দেখতে বাড়ি টার সামনে। গেইট থেকে শুরু করে গার্ড দিয়ে পুরো বাড়ি টা ঘিরে আছে। এই বাড়ি টাতে এক সময় তার রাজত্ব চলিত। সে-ও থাকতো এখানে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে নিজে কে যথাসাধ্য এটা থেকে দূরে নিয়ে নিলো। ছোট একটা সুখ নীড় বাঁধল। স্বপ্ন দেখলো। বিয়ে করা স্ত্রী কে নিয়ে সংসার ও করলো। তবে খুব বেশি দিন নয়। এটাও শেষ করে দিলো। এ-সব তো তার বাঁ হাতের খেল তৈরী করা। কিন্তু তার সন্তান? এটা সে কিভাবে মেনে নিবে প্রশ্রয় দিবে? কখনো না। প্রয়োজনে আবারও আগের রূপে ফিরবে আবরাজ খান। তবুও সন্তান হত্যার বিচার সে নিজে করবে। গাড়ি থেকে নামার আগেই জন আবরাজ এর হাত ধরলো। এই প্রথম আবরাজ এর কোনো কাজে সে অমত পোষণ করলো। ভয় পেলো। বাঁধা দিলো। বললো,

-“স্যার আর একবার ভাবুন। এখানে যাওয়া মানে আপনি আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া।”

-“প্রয়োজনে সেটাই হবে।”

কথা টা বলেই আবরাজ জন এর হাত ছাড়িয়ে নিলো। রোলস রয়েস কার টা থেকে নেমে সে গেইট এর দিকে এগিয়ে এলো। আসতে আসতে গায়ের ব্লেজার টা খুলতে শুরু করলো। গার্ড ক’জন সামনে এলো। আবরাজ ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকাতেই সবাই সরে দাঁড়াল। একটা সময় এই আবরাজ খান এর কথাতেই উঠত-বসত তারা। পুরোনো খাতিরে শুধু বললো,

-“ইউ’লল বি ফাইন। গো ব্যাক। টু গুড।”

-“ডোন্ট স্টপ মি।”

ব্যাস এটুকু কথাই। গার্ড মাথা নিচু করে নিলো। আবরাজ ব্লেজার টা হাতের ভাঁজে নিয়ে হাঁটা ধরলো বাড়ির ভেতর এর উদ্দেশ্যে। গার্ড পেছন থেকে কাউ কে কল দিলো সাথে সাথে।

বাড়ির ভেতরে রয়েছে সাত থেকে আটজন সার্ভেন্ট। আবরাজ কে দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। সাথে সাথে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে কিচেনের দিকে ছুটলো। আবরাজ গিয়ে তুলতুলে নরম গদির সোফায় আয়েশ করে বসলো। সার্ভেন্ট সবাই ফিরে এলো মনে হয় দুই মিনিট এর মাথায়। সবার হাতে রয়েছে কিছু না কিছু। হট কফি, কুল কফি, কুল ড্রিংকস। শরবত। কারোর হাতে বা টাওয়াল কেউ বা পানির গ্লাস। আবরাজ সেদিকে একবার ও তাকালো না। নিজের হাতের ফোন টায় দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞেস করলো,

-“হোয়্যার ইজ তৃণা?”

-“ম্যাম ইজ ইন দ্য গেম রুম স্যার।”

একজন সার্ভেন্ট বললো। আবরাজ সাথে সাথে ওঠে দাঁড়ালো। দোতলার সিঁড়ির সাথে তাদের গেম রুম। মুখস্থ আবরাজ এর এই বাড়ির প্রতি টা কোণা। হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। কাঁচের দরজা টা ঠেলে নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে কোনো দিকে না তাকিয়ে দেয়ালের সাথে সেট করা সোফায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো হাতের ব্লেজার টা। সাদা শার্ট টার হাতা ফোল্ড করতে করতে একদম গিয়ে বিলিয়ার্ড টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। তৃণা কিউ স্টিক দিয়ে সবেমাত্র একটা বল ফেলতে যাচ্ছিলো পকেটে। তখন আচমকাই কেউ সামনে চলে আসায় চমকে উঠলো সে। মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। বল টা গড়িয়ে গিয়ে বিলিয়ার্ড টেবিলের সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তি টার বরাবর সামনে স্টপ হলো। তৃণা বিরক্ত হয়ে নিচের দিয়ে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠলো,

-“হু আর ইউ?”

-“ইট’স মি। আবরাজ খান।”

তৃণা কল্পনাও করে নি, কখনোই ভাবনায় আসে নি এটা আবরাজ হবে। ভেবেছিলো খুব বেশি হলে জুনায়েদ হবে নয়তো কোনো গার্ড। কিন্তু আবরাজ গম্ভীর রাশভারী কণ্ঠ মেয়ে টার আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। কিউ স্টিক টা হাত থেকে টেবিলে গড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ কে অবিশ্বাস করতে পারলো না। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,

-“আবরাজ!”

-“ইয়েস।”

আবরাজ ঠোঁট চেপে ধরে অদ্ভুত হাসলো। তৃণার শরীর এর প্রতি টা লোমকূপ শিরশিরানি হলো। সে নিজে কে যথাসাধ্য সামলে রাখার চেষ্টা করলো। আবরাজ নিশ্চয়ই জানে না তার বউ কে স্লো পয়েজন দেওয়া হয়েছে। অবশ্য জানার কথাও না। না জানার জন্য ই তো এই পন্থা অবলম্বন করেছে সে। তবে কি অন্য কোনো কারণ? সে নিজে কে স্বাভাবিক দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি এখানে?”

-“আসতে তো হতোই।”

তার পাগল মন আবরাজ খান এর একটু আহ্লাদী স্বরে গেলে উঠলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে সে বলে উঠলো,

-“আমি জানতাম আবরাজ ওই মেয়েতে তুমি বেশি দিন আটকাবে না।”

আবরাজ ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ঝুলিয়ে ধীরে পায়ে এগিয়ে এলো। তৃণা দ্রুত পা ফেলে বিলিয়ার্ড টেবিলের মাঝামাঝি এসে আবরাজ এর কোমর জড়িয়ে ধরলো। নেশাতুর ভঙ্গিতে এক হাত ছুঁয়ে দিলো পুরুষ টার উন্মুক্ত বুকে। আবরাজ চোখ বন্ধ করলো। তার চোয়াল অনুমান করা গেলো খুব কঠিন। তৃণা কে সে দ্রুত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। হাত একটা আলগোছে ধরে বললো,

-“এখানে না।”

তৃণা অস্থির। বহুদিন হয় সে পুরুষের ছোঁয়া পাচ্ছে না। জুনায়েদ নেই। তারউপর মিস্টার জি তাকে বাইরে যেতে দিচ্ছে না। একপ্রকার আঁটকে রেখেছে তাকে। অসুস্থতার নাম করে। তাই বাইরে যাওয়ার সুযোগ সে হাত ছাড়া করলো না। তাছাড়া আবরাজ খান এর মতিগতি কখন আবার ঘুরে যায় তার ঠিক নেই। একবার এর জন্য হলে-ও তার এই পুরুষ কে চাই। যেখানে আবরাজ খান নিজে তার সঙ্গ দিতে এসছে। সেখানে এই সুযোগ হাত ছাড়া করার মানেই হয় না। কে বলতে পারে হয়তো এটাকেই সে কাজে লাগিয়ে আবরাজ খান কে আজীবন এর জন্য নিজের করতে পারে। চালাক নারী বুঝলোই না আবরাজ কেনো এলো। কিছুই মেয়ে টার মাথায় এলো না। আবরাজ এর হাত টেনে ধরে বেরিয়ে এলো। আবরাজ বাঁকা হাসলো। মেয়ে টা আসলেই পাগল। তার অস্তিত্ব কে মেরেও কি অবলীলায় তার সাথে কথা বলছে। বাইরে যাচ্ছে। একটু ভয় হচ্ছে না? ভাবছে না কিছু? গাড়ির নিকটে আসার আগেই গেইটে তাদের আঁটকে দিলো গার্ড। আবরাজ তৎক্ষনাৎ জন কে ব্লুটুথ এর সাহায্য সচেতন করলো। তৃণা একজন গার্ড কে ততক্ষণে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে। তারই বাবার খেয়ে তার সাথে ঘাড় উঁচু করে কথা হচ্ছে মেয়ে টার সহ্য হলো না। সামন্য একটা ব্যাপারে মেয়ে টা কত টা ডেস্পারেট। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে প্যান্ট এর পকেটে হাত গুঁজে এগিয়ে এলো। তারপর নিজ দায়িত্বে বেরিয়ে এলো তৃণা কে নিয়ে।
গাড়ি ফাঁকা। তৃণা চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো। আবরাজ ড্রাইভিং করবে। তাহলে তো গাড়িতে কিছু করা যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে। তৃণা অন্য সকল বিষয়ে অধৈর্য হলেও আবরাজ খান এর জন্য সে ধৈর্য ধরে সব করতে রাজি। চুপচাপ বসে গেলো গাড়িতে। আবরাজ গাড়ির চাবি ঘোরাল। চোখে কালো সানগ্লাস টা পড়ে স্টিয়ারিং ধরলো।
আবরাজ এর প্রতি টা কাজে তৃণা আকর্ষিত হয়। আবরাজ খান এর প্রতি তার দুর্বলতা এটাই প্রমাণ করে সে এই পুরুষ টার জন্য সব করতে পারে।

——-

ফিজার মন খারাপ। শরীর দুর্বল। তবুও সারাদিন অপেক্ষা করে আবরাজ একটা কল দিবে। ঘুমাল পর্যন্ত না মেয়ে টা কল মিস হবে ভেবে। মেহরিন ও সাথেই আছে। চলে যাবে মেয়ে টা। আজ সারাদিন বোনের সাথে ছিলো সে। আব্রাহাম গতরাতের পর আর খোঁজ করে নি মেহরিন এর। এতে আরও অভিমান জমেছে মেয়ে টার মনে। ফিজা বোন কে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলে না। বলার অধিকার ও নেই। এখন তো শুধু মেহরিন তার বোন না। এ বাড়ির বউ। যা ইচ্ছে করতে পারে।
তবে মন খারাপ দেখে মেহরিন কে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি হয়েছে তোর? আপু কে বল।”

-“কিছু না আপু।”

ভাবনায় বিভোর থাকা মেহরিন অপ্রস্তুত হয়ে সাথে সাথে জবাব দিলো। কথার টোন কেমন লাগলো ফিজার। বোন তার সহজে মন খারাপ করে না। চুপচাপ থাকে। তবে মলিন হয়ে না। বিচক্ষণ রমণী ফিজা ছোট থেকে বোন কে চিনে। তাচ্ছিল্য হেঁসে বলে উঠলো,

-“আপু কে মিথ্যা বলতে শিখেছি এখন?”

-“আপু উনি, উনি আমায় মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে নি তো? জানো একটু কিছু হলেই কেমন রাগ দেখায়।”

সহজ সরল তো মেহরিন। একদম সাদাসিধা টাইপ। যেখানে ফিজা চার বছর হাসবেন্ড এর অবহেলা পেয়েও কখনো মুখ ফুটে কাউ কে কিছুই বলে নি। সেখানে মেহরিন বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় বোন এর সাথে কত সুন্দর কথা বলছে। এমন সহজ সরল বোনের অসহায় কণ্ঠ ফিজার বুকে বিঁধল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। বললো,

-“তেমন কোনো ব্যাপার না। ঠিক হয়ে যাবে সব। চিন্তা করিস না। আব্রাহাম ভালো ছেলে।”

বোন কে বলে তো দিলো। তবে সে নিজেও চিন্তিত হলো এব্যাপারে। সত্যি ভাবার বিষয়। জোর করে বিয়ে করে এখন তারই বোনের সাথে রাগ দেখায়!

——–

সবে মাত্র হাত রেখেছিলো পুরুষ টার শক্ত-পোক্ত লম্বা চওড়া লোমহীন বক্ষে। সাথে সাথে তীব্র যন্ত্রণা উদর জর্জরিত হলো। চোখ দু’টো বেশ বড়ো বড়ো আকৃতি ধারণ করলো। হেঁচকি উঠলো একবার। পরপরই দুই তিন কদম পিছিয়ে গেলো রমণী। অবাক হয়ে সামনের পুরুষ টার দিকে তাকিয়ে নিজের বাঁ হাত টা চোখের সামনে ধরলো। হতবিহ্বল দুর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়ে টা। সামনের পুরুষের চোখে-মুখে আনন্দ। তার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম সে। সে মার্ডার করেছে। তবে আজকের মতো শান্তি বুকে কখনোই আসে নি। নিজের অস্তিত্ব দুনিয়া দেখার আগে তার থেকে কেঁড়ে নেওয়া হয়েছে। সে অনুভব করতে পারে নি। ছুঁতে পারে নি। ভাগ্যের জোরে অর্ধাঙ্গিনী বেঁচে গেলো। তবুও সন্তান হত্যার প্রতিশোধের আগুন যে নেভার নয়। তার জীবন থেকে চার টা বছর নিয়ে নিলো। প্রাণে মারতে চাইলো। একটা বছর কোমায় রাখলো। ড্রাগসে, স্মাগলিং যতরকম বেআইনি কাজ তাকে দিয়ে সেরে নেওয়া যায় নেওয়া হলো। যদিও এ-সব নিয়ে তার আক্ষেপ নেই কোনো। কিন্তু এতো এতো ছাড় দেওয়ার পরে-ও সে কি পেলো? নিজের অস্তিত্ব টা পর্যন্ত কেঁড়ে নিলো। যার শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দিলো। একটা ছোট হার্টবিট হওয়া মাত্র দুমড়েমুচড়ে নীরবে নিভিয়ে দেওয়া হলো। মায়ের মাতৃত্ব সাধ উপভোগ করার আগেই সমাপ্ত করে দিলো। বাবা হওয়ার সংবাদ সে পেলো না। উপভোগ করতে পারলো না। তার আগেই সব শেষ। একটা কোল খালি করে দিলো। যাদের কষ্ট দিলো তাদের তো কোনো দোষ নেই। তাহলে? সে কি করে এটা মানবে? পাপ তো বহু করলো। এবার না হয় আরও একটু করে নেওয়া যাক। গার্ড কে ইশারা করে বলে উঠলো,

-“এর বডি টা এতোটা টুকরো করবে। ঠিক যতোটা টুকরো হলে ছুঁয়ে দেখা অসম্ভব। যেমন টা আমি পারি নি আমার সন্তান কে ছুঁতে।”

#চলবে…..

[আমি আগেই বলেছি আবরাজ খান চরিত্র টা সাইকো। যারা পড়বেন অবশ্যই বুঝেশুনে পড়েন। পরে আমাকে গাল-মন্দ করিয়েন না আবার।🥹 আর আর, ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]