#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৩৯
#জান্নাত_সুলতানা
-“আবরাজ কোথায় তুমি? ভয় করছে আমার। প্লিজ ডোন্ট গেইম উইথ মি।”
তৃণা দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলছে। নেই কেউ এখানে।
হ্যালুসিনেশন হলো এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে কেউ বাস্তবে না থাকা কিছু দেখে, শোনে, গন্ধ পায় বা অনুভব করে, যেটা কেবল তার নিজের মস্তিষ্কে ঘটে, কিন্তু অন্য কেউ সেটা অনুভব করতে পারে না। একটু আগে তাকে আবরাজ এখানে নিয়ে এসে কোথাও একটা চলে গিয়েছে। অথচ তৃণা নিজের রোগের বশবর্তী হয়ে এসব ভাবছে।
তৃণা শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ কেউ যেনো ফিসফিস করে বলছে,
-“তুমি মূল্যহীন, নিজেকে শেষ করো।”
কোনো পুরুষালী সুর। তৃণা পাগলের মতো এদিকে ওদিক ছুটে।
এটা ঘটে যখন মস্তিষ্কের সেন্সরি প্রসেসিং এলাকা, যা দেখে, শোনে, ছোঁয়ার অনুভব করে অতিরিক্ত উত্তেজিত বা ভুলভাবে সক্রিয় হয়। যেমন তৃণা একটু আগে কল্পনা করেছে আবরাজ তাকে মেরে ফেলতে চাইছে। ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। আসলেই কিন্তু আবরাজ ঘটনা টা ঘটিয়েছে। শুধু তার সাথে নয়। এটা তৃণা নিজের সাথে কল্পনা করে হ্যালুসিনেশন করছে।
আতঙ্ক, অবসাদ, সন্দেহ, রাগে মেয়ে টার বাস্তবতা খুঁজে পাচ্ছে না। অসুস্থতার জন্য আরো বিগড়ে গিয়েছে পরিস্থিতি।
যেহেতু তৃণার মানসিক সমস্যা আছে। সে আগে পাপ, অন্যায় করেছে। এখন সে নিজেই হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়ে মনে করছে তার শাস্তি হচ্ছে।
ঘরটা অন্ধকার। জানালার পর্দা বাতাসে হালকা দুলছে। টিকটিকির ডাকে এক অদ্ভুত থমথমে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। সব সময় সুন্দর করে মাশকারা লাগিয়ে আর্ট করে রাখা চোখ লাল হয়ে খুব বিশ্রী লাগছে। সদা সর্বদা নিজের ঠোঁট গুলো কে লিপস্টিকে রাঙিয়ে রঙিন সুন্দর আকর্ষণীয় করে রাখা ঠোঁটের অবস্থা করুণ। লিপস্টিক এবড়োখেবড়ো হয়ে শুকিয়ে গেছে। সিল্কি সোজা কোমর সমান লম্বা চুল এলোমেলো। যেই কপালের দিকের ছোট ছোট বেবি কার্ট করা চুল গুলো দিয়ে সে নিজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছিলো। পুরুষদের এটেনশন নিয়ে নিতো সেই সুন্দর লোভনীয় চুল ঘামে ভিজে কপালে লেপ্টে আছে। সুন্দরী রমণী। বাবার প্রিন্সেস। টাকা পয়সা কোনো অর্থাভাব নেই বাবার বিশাল ধনসম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারীর খুব করুণ অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে টা নিচে হাঁটু গেঁড়ে বসে গিয়েছে। নিশ্চয়ই মিস্টার জি মেয়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না, এখানে উপস্থিত থাকলে। আবরাজ কাঁচের দেয়ালের ওপাশে বাঁকা হাসলো। জন কে কিছু ইশারা করতেই সে চলে এলো এদিকে। তৃণা হঠাৎ দেয়ালের ওপাশ থেকে পুরুষালী গলা আবার শুনতে পায়,
-“তুই পাপ করেছিস তৃণা। এই শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”
তৃণা চোখ বড় হয়ে যায়। কাঁপতে কাঁপতে সে উঠে দাঁড়ায়।
-“কে? কে বলছে এসব?”
-“তোর রক্ত চাই তোকে মুক্তি দিতে হবে। তুই মরলেই এই পাপ ঘুচবে।”
চারদিক থেকে সব পুরুষালী গলায় একই কথা ভেসে আসছে।
কাঁচের দেয়ালের আয়নার ভেতর তার প্রতিচ্ছবি কথা বলছে,
-“তুই নোংরা। তুই পচে গেছিস তৃণা। মর! মর!”
তৃণা কানে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-“থামো! প্লিজ থামো। আমি আর পারছি না!”
সে কাঁচের দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে। কাঁদে। হাঁটে। দরজা বন্ধ, জানালা বন্ধ। তবুও সেই গলা থামে না।
শেষমেষ পাশ থেকে রক্ত মাখা ছুরি তুলে নেয়। যেটা দিয়ে আবরাজ তাকে আঘাত করেছে। পেটটা যেন ব্যাথায় টনটন করছে।
শেষবারের মতো আয়নার দিকে তাকায়।
আয়নায় তার নিজের রক্তমাখা শরীর দেখতে পায়ে। সাথে সাথে নিজের শরীর আঘাত করে। একবার দু’বার বহুবার। রক্তে ভেসে যায় জলপাই রঙের লেডিস্ শার্ট। এরপর সে নিচে পড়ে গেলো। আস্তে আস্তে তারই আঘাতের কারণে শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে সাদা ফ্লোর রক্তে রঞ্জিত হয়। চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হয়। তবুও পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে সে। একটু আশায়। বাবা আসবে। কিন্তু আসে না বাবা। আসে নিজের সন্তান কে ছুঁতে না পারা এক বাবা। খটখট শব্দ হয় সু জুতার। তৃণা আবছা দেখে। যাকে সে জেদে চাইতো। ভালোবেসে নয়। কিন্তু আর পাওয়া হলো না। নিজের জেদ সে রাখতে পারে নি হেরে গিয়েছে। ঘরের চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসে সকল সিকিউরিটি। যারা এতো সময় তৃণা কে হ্যালুসিনেশেন করতে বাধ্য করেছে।
আবরাজ হাঁটু গেঁড়ে বসলো। খুব দূরে। রক্ত যে চারপাশে। মানুষের মৃত্যু মানুষ কে কাঁদায়। কিন্তু আবরাজ খান কে কাঁদাচ্ছে না। মানুষ যতোই পাপ করুক। মৃত্যু সময় এসব কেউ মনে করতে চায় না। কিন্তু আবরাজ ভুলতে চাচ্ছে না সে। সেই হয়তো পৃথিবীতে একমাত্র প্রাণী যে হাজার বার নিজে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইলো নিজের এই কাজের জন্য। ক্ষমা না করতে পারার জন্য। এই একটা মানুষ তার জীবন টা জাহান্নাম করে রেখেছিল। অসুস্থ অসুস্থ। আর আজ এই অসুস্থতাই তার মৃত্যুর কারণ হলো। আবরাজ স্লো ভয়সে বলে,
-“জেদ ভালো। তবে এমন জেদ ভালো নয়, যা নিজের সর্বনাশ বয়ে আনে।”
——–
সারাদিন আব্রাহাম এর কোনো খবর বা দেখা-সাক্ষাৎ পেলো না মেহরিন। মন টা কেমন ছটফট করে। একটু জানতে ইচ্ছে করে তার সরলতার জন্যেই কি আব্রাহাম তার সাথে এমন বিহেভিয়ার করে না-কি অন্য কারণ রয়েছে? সামন্য একটু দেরি করেই তো সে রাতে রুমে গিয়েছিল। এর বাহিরে তো সে কিছু ই করে নি। না আব্রাহাম এর খারাপ লাগে কিংবা অপছন্দ এমন কোনো কাজ করে। তাহলে? বিয়ের পনেরো দিন হলো না এখনো। আর এরমধ্যে একদিন রাগও দেখালো। অদ্ভুত। তবে এতগুলো প্রশ্ন অথচ বোকা মেহরিন একটা ও আব্রাহাম এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে করতে পারবে না। অতোটা মুখ চলিত তো সে নয়। এসব ভেবেই হয়তো ভেতরে থেকে মেয়ে টা আরও গুমোট হবে।
যা এবাড়িতে ছিলো তাই সব নিজের কাঁধ ব্যাগ টায় নিয়ে নিলো। এটাতে করে দু’টো থ্রি-পিস কিংবা একটা টিফিন বক্স অথবা বিভিন্ন সাজগোজের সরঞ্জাম সবই নেওয়া যাবে। কালো এই ব্যাগ টা সে বছর এক আগেই নিয়েছে। এখনো এটা ব্যবহার করছে। মাঝেমধ্যে অবশ্যই বদলে অন্য টাও নেওয়া হয়। তবে এটাই বেশি নেওয়া হয়। মেহরিন ব্যাগ টার দিকে তাকিয়ে ভাবলো এবার ব্যাগ একটা নিতে হবে। এখন তো এবাড়ি ওবাড়ি আসা-যাওয়া হয়। একটা লোকচক্ষুেরও ব্যাপার আছে।
যখন মেহরিন হিজাব টা বেঁধে ব্যাগ নিয়ে রুমে থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্যত হলো তখনই রুমে আগমন হলো কাঙ্খিত সেই পুরুষের। আজ এতো দ্রুত ফিরেছে মেহরিন আচমকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। বোকা মেয়ে সব ভুলে, সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকা অবাক ভ্রু কুঁচকে ক্লান্তি তো মানুষ টার দিকে সে-ও একপলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নুইয়ে বলে উঠলো,
-“বাড়ি যাই। আম্মু যেতে বলেছে।”
আব্রাহাম এর এমনিতেই মেজাজ খারাপ। ভাই দে-শে নেই। ডিল একটা বেরিয়ে গিয়েছে হাত থেকে তারউপর এই মেয়ের কর্ম। কিভাবে বোঝাবে সে এর বোকা-সোকা কাজেই রাগ ঝাড়ে সে। স্বামী কে ঘরে রেখে বাইরে চ্যাটাং চ্যাটাং করে ঘুরে কোন মেয়ে? আব্রাহাম শার্ট এর বাটনে হাত রাখলো। ব্লেজার টা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে শার্ট খুলতে খুলতে আওড়াল,
-“স্টুপিট, গাধা কোথাকার।”
এরপর রাগ থাকলে-ও মনে রাগ চেপে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। দাঁত কিছু টা খিঁচে বললো,
-“আচ্ছা।”
মেহরিন আর কিছু ভাবলো না। চলে গেলো বেরিয়ে। তবে সহজ সরল মনে আরো একটু অভিমান হলো। একটু কি বলা যেতো না “আমি গিয়ে দিয়ে আসবো।”
মেহরিন এর ভাবনার মাঝে ই আব্রাহাম পেছন থেকে বলে উঠলো,
-“এই মেয়ে। একা কোথায় যাচ্ছো? ওয়েট করো ফাইভ মিনিটস।”
মেহরিন দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথে। এরপর দাঁড়িয়ে রইলো আব্রাহাম কেনো ডাকলো। তবে ভেতর থেকে আর কোনো উত্তর আসে না। পাক্কা সাত মিনিট এর মাথায় আব্রাহাম বেরিয়ে এলো। ভেজা চুল। আধ ভেজা টি-শার্ট। আর ট্রাউজার পড়নে। মেহরিন অবাক হলো। এভাবে হন্তদন্ত হয়ে গোসল করে কেনো এলো? আব্রাহাম ওয়েলট টা ট্রাউজার এর পকেটে নিয়ে হাঁটা ধরলো। মেহরিন তখনও দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারছে না বেচারি কিছু।
আব্রাহাম মেহরিন কে আসতে না দেখে বললো,
-“আসছো না কেনো? ফাস্ট, ফলো মি।”
মেহরিন গুটিগুটি পায়ে হাঁটে। কাঁধে ঝুলানো ওড়না টা হাতে নিয়ে পেচায়। আব্রাহাম নিচে এসে কারোর দেখা পেলো না। তাই সোজা বেরিয়ে এলো। গাড়ি বের করাই ছিলো। নিজে গাড়িতে বসে মেহরিন কে বসতে ইশারা করে। মেহরিন বসলো। যাক অন্তত তাকে নিয়ে দিয়ে আসবে। যতোটা খারাপ ভেবেছিলো ততটা খারাপ নয়। গাড়ি স্টার্ট করার আগেই আব্রাহাম অকল্পনীয় এক কান্ড ঘটালো। মেহরিন এর ওড়নার একপ্রান্ত টেনে নিলো। মেহরিন চমকে উঠলো। যখন আব্রাহাম ওড়না দিয়ে ভেজা চুল মুছে নিতে লাগলো তখন মেয়ে টার আশ্চর্যের আর সীমা রইলো না। তবে ভালো লাগলো। আব্রাহাম চুল মুছা শেষ হতে আবার ওড়না ফিরে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো।
বিশাল বড়ো একটা বিল্ডিংয়ের সামনে যখন গাড়ি রাখলো তখন মেহরিন ভাবুক। চিন্তিত হয়ে কিছু জানতে চাইবে আব্রাহাম সেই সুযোগ দিলো না। টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলো তাকে। লিফট করে তিন তলায় গিয়ে থামলো। ব্যাগের রাজ্যে সরি শো-রুমে চলে এসছে তারা। মেহরিন অবাক। দুই টা ব্যাগ আব্রাহাম নিজেই পছন্দ করলো। বিল পে করলো কার্ড দিয়ে। এরপর আবার জুতোর দোকানে গেলো। জুতোর সাইজ জিজ্ঞেস করলো শুধু মেহরিন কে। এরপর এটাতেও নিজের পছন্দ মতো নিলো। চার জোড়া জুতো। মেহরিন এর মাথা ঘুরে। সে দুই বছরে চার জোড়া জুতো নিয়েছে কি-না সন্দেহ। যখন থ্রি-পিস দোকানে গেলো সেখানে জুতোর ডাবল নিলো থ্রি-পিস। রাতের জন্য বেশ দুই তিন টা রাতের পোশাক। মেহরিন লজ্জায় অস্বস্তিতে কিছু বলতেও পারছে না। শাড়ী দোকানে গিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না। আব্রাহাম নিজের মতো দুই টা জর্জেট এর শাড়ী নিয়ে নিলো। কসমেটিকক মেয়েদের ইনার থেকে সব নিলো। একটু আগে পর্যন্ত অস্বস্তিতে পড়লো মেহরিন এপর্যায়ে এসে লজ্জায় ঘিরে ধরলো। পুরো টা সময় মেহরিন স্বভাবগত চুপ করে রইলো। পুরো তিন ঘন্টা আব্রাহাম তাকে নিয়ে তিন তলা চারতলা ঘুরলো। একজন কর্মচারী দিয়ে সব শপিং ব্যাগ গাড়িতে রাখতে পাঠালো। আর নিজে লাস্ট সেকেন্ড ফ্লোরে এসে থামলো। রাত তখন। সাতটা প্রায়। রাতের ডিনার নিজের মতো অর্ডার দিলো। গরুর কলিজা ভুনা। মেহরিন এর বেশ পছন্দ। আব্রাহাম জানে না। খাবার খেতে বসে মেহরিন খাবে না। এই তিন ঘন্টায় সে স্বেচ্ছায় আব্রাহাম এর সাথে কথা বললো,
-“আমি বাড়ি যাব। আম্মু চিন্তা করছে।”
-“করছে না। খাবার শেষ করো দ্রুত।”
আব্রাহাম এর স্বাভাবিক গম্ভীর স্বর। মেহরিন তা-ও খাবে না। বসে রইলো। আব্রাহাম নিজের প্লেট টা নিয়ে এসে মেহরিন এর পাশে বসলো। মাথার কানের ওপর আঁটকে রাখা পিন টা খুলে দিতে মুখের হিজাব খুলে গেলো। এরপর নিজেই মুখে খাবার তুলে দিলো। একটা প্রাইভেট রুম। কেউ আসবে না এখানে। আব্রাহাম সাথে নিজেও খেলো। মেহরিন তখনও ঘোরে। লাইফে ফার্স্ট টাইম এমন হলো। নিজের সাথে নিজের অনুভূতির কোনো মিল পেলো না মেহরিন। ভাবনার থেকে বাস্তবতা ভিন্ন আসলেই।
মেহরিন এর ভাবনার মাঝে ই আব্রাহাম বলে উঠলো,
-“আপাতত এগুলো দিয়ে চালিয়ে নাও। বিয়ের সময় বাইরে থেকে মার্কেট আনিয়ে নেবো আমি।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]