সুগন্ধি ফুল পর্ব-৪০

0
562

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৪০
#জান্নাত_সুলতানা

[পর্ব টা একটু রোমান্টিক, পড়তে না চাইলে স্কিপ করতে পারেন।]

আব্রাহাম রাত দশ টা বাজে মেহরিন কে রেখে চলে যাওয়ার জন্য শাশুড়ী কে বলে। অবাক হয় মোহিতা। এভাবে যেতে দেওয়া যায়? নতুন জামাই কোনো আপ্যায়ন তো আব্রাহাম এর ঠিকঠাক হলো না। একটার পর একটা বিপদ শেষ ই হচ্ছে না। সেদিন এলো। খাবার ও খেতো পারলো না। ভাইয়ের সাথে হসপিটাল চলে গেলো। এর পর তো আর আসে নি। তিনি বাহিরে তাকালো। ঝুম বৃষ্টি তখন। ওর এখানে বৃষ্টি মাথায় এসছে। মোহিতা বেগম বললে,

-“আজকের রাত টা থেকো যাও বাবা৷ সকালের নাশতা টা করে যাও।”

এতো সুন্দর করে আবদার করলো আব্রাহাম কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না যদিও তার-ও ইচ্ছে হচ্ছে থাকার। তবে বোকা-সোকা মেয়ে টা তাকে একবার ও থাকতে বলছে না। এদিকে মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে। মা মেয়ে জামাই এর কান্ড দেখে সে। কিছু সময় পর সে মিনমিন করে বললো,

-“বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। সকালে চলে যাবেন না-হয়।”

থাকতেই হবে এমন একটু জোর করলে কি ক্ষতি হয় বেয়াদব মেয়ে টার। আব্রাহাম অনেক ভেবে রাজি হলো। মোহিতা বেগম বেশ খুশি হলেন। মেহরিন এই কথা শোনামাত্র গিয়ে একটা গামছা নিয়ে এলো। নতুন গামছা হয়তবা আব্রাহাম এর জন্যই এনে রেখেছে। আব্রাহাম সেটা নিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। কলপাড়ে যাওয়া যাবে না। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে যে। আব্রাহাম হাত মুখ ধুয়ে এরপর এলো। গামছা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসছে। মেহরিন তখন বিছানার চাদর পরিবর্তন করছে। বালিশের কভার লাগিয়ে আব্রাহাম কে ডেকে মিনমিন করে বললো,

-“আসুন। বিছানা রেডি। শুয়ে পড়ুন।”

আব্রাহাম এর মন ফুরফুরে। ঠোঁট কামড়ে ধরে আচমকাই প্রশ্ন করলো,

-“তুমি রেডি?”

-“কি?”

মেহরিন অবুঝ চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো। আব্রাহাম এর বড্ড অসহায় লাগে নিজে কে। ভেতরে ভেতরে রাগও হচ্ছে। দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাভাবিক হতে চাইলেও এই মেয়ে হতে দিচ্ছে না। আজব প্রশ্ন। ইঙ্গিত বুঝে না বেয়াদব মার্কা মেয়ে। আব্রাহাম বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-“স্টুপিট। একটু রোমান্টিক হতে পারে, না তা কেনো হবে! শুধু চুপচাপ থাকবে আর নিজের মনে খিচুড়ি পাকাবে। গাধা মেয়ে।”

মেহরিন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে যে কথার ইঙ্গিত একবারই বুঝে নি তেমন নয়। লজ্জা ও পাচ্ছে মেয়ে টা। তবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আব্রাহাম বিড়বিড় করে বিছানার কাছে গেলো। বাহিরের ওয়েদার আজ বেশ রোমান্টিক। হিমেল হাওয়ায় চারদিকে ঝুম বৃষ্টির সাথে অল্প ঝড়। টিন সেট বিল্ডিংয়ের চালার ওপর রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ। আব্রাহাম এর আগে কখনো এমন আবহাওয়ার সম্মুখীন হয় নি৷ সুর বেশ মধুময় শোনাচ্ছে। মেহরিন আব্রাহাম এর থেকে দূরত্ব রেখে শুয়ে। একই বিছানায় স্ত্রীর সাথে শুয়ে থেকে ও এমন ওয়েদারে একটা পুরুষ নিজে কে কিভাবে স্থির রাখতে পারে! স্বাভাবিক ভাবে বিপরীতে প্রান্তে শুয়ে থাকা রমণীর দিকে আকর্ষিত হবে। আর যদি রমণী নিজে থেকে সেই পুরুষের মনোরঞ্জন এর চেষ্টা করে। যদিও মেহরিন এমন কিছু ই করছে না। ভুলবশত কিংবা অপ্রত্যাশিত ভাবে মেয়ে টার হাত আব্রাহাম এর হাতের ওপর রেখে দিয়েছে। অন্ধকারে একদম এটা ভাবতে পারে নি এমন কিছু হবে। মেহরিন নিজেও ঘুমায় নি৷ আব্রাহাম খপ করে মেয়ে টার সেই হাত টা ধরে নিলো। ভালোবাসা থাকলেই যে সংসার হয় এমন নয়। ভালোবাসা ছাড়া-ও এমন অসংখ্য কাপল রয়েছে ভালোবাসাহীন সংসার করে যাচ্ছে। এটা খুব বেশি অপরাধ নয়। তবুও আব্রাহাম দোটানায় ভুগতে লাগলো। যদিও মনে এটার চেয়ে নিজের পাশে শুয়ে থাকা রমণীর কে একান্তই নিজের করে পাওয়ার তীব্র বাসনা হচ্ছে। আব্রাহাম যখন মেহরিন এর হাত টা টেনে নিয়ে আলতো করে হাতের পিঠে নিজের রক্ষ সিগারেটে পোড়া ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো তখন টের পেলো সে, ভীতু স্বভাবের মেয়ে টা কেঁপে উঠছে ক্ষণেক্ষণে। সাহস বাড়ল বৈ কমলো না পুরুষ টার। দূরত্ব ঘুচিয়ে বউয়ের সাথে আরো একটু ঘনিষ্ঠ হলো নিজে থেকে। ঠান্ডার কবল থেকে বাঁচতে গরম উষ্ণ বস্তু জড়িয়ে দু’জনেই। সেটার নিচে থেকে মেয়ে টার উদরে হাত রাখলো আব্রাহাম। আলতো করে নিজের দিকে টেনে নিলো। বালিশ থেকে মাথা তুলে মেয়ে টার গলায় রাখলো মুখ। রক্ষ পুরুষালী ঠোঁটের ছোঁয়া লাগলো গলায়। উষ্ণ নিঃশ্বাসে শরীর শিরশির করে। চোখ বন্ধ করে মেহরিন। তখন শুনতে পায় পুরুষ টার নেশাক্ত স্বরে এক অদ্ভুত আবদার।

-“আই নিড সামথিং।”

মেহরিন বরফের অনুরূপ জমে গেলো। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না মেয়ে টা। আব্রাহাম এবার শক্ত করে দুই হাতে মেহরিন কে একদম নিজের দিকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। স্লো ভয়সে বলে উঠলো,

-“একটা শাড়ী পড়বে?”

মেহরিন অবাক হলো। এতো আবেগ নিয়ে আবদার করার কি আছে? বললেই হতো। অন্ধকারে মেয়ে টা মাথা নাড়ে। আব্রাহাম টের পেলো। আলগা করে দিলো হাতের বাঁধন, ছাড়া পেতে মেহরিন ওঠে গেলো৷ লাইট অন করে ওয়ারড্রব খুললো। শপিং ব্যাগ গুলো এখনো খোলা হয় নি। শাড়ির ব্যাগ টা খুঁজে বের করে দু’টো শাড়ী হাতে নিয়ে আব্রাহাম এর দিকে ফিরে তাকালো। চোখে চোখে যেন জিজ্ঞেস করলো কোন টা পড়বে। আব্রাহাম দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আছে। মেহরিন এর হাতের শাড়ী দু’টো একপলক দেখে বললো,

-“নীল টা।”

নীল রঙের শাড়ী টার সাথে সাদা ব্লাউজ রয়েছে। মেহরিন সেগুলো নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো। আব্রাহাম ওঠে বসলো। প্যান্ট এর পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ভাঁজে চেপে ধরলো। দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। কিসের যে একটা তেষ্টা পাচ্ছে। সিগারেট এর না। আব্রাহাম দুই একবার টানলেও এই মূহুর্তে কোনো সুখ পেলো না। তবুও শেষ করলো সময় নিয়ে। কিন্তু তখনও রমণীর আসার নামগন্ধ নেই। আব্রাহাম বিছানা ছাড়লো। ওয়াশ রুমের দিকে যাওয়ার আগেই দরজা খুলে মেহরিন বেরিয়ে এলো। খুব সুন্দর করে পড়েছে শাড়ী। চুল বিনুনি করা। এলোমেলো আছে সেই বেণী। ঘন দীর্ঘ কালো চুল। আব্রাহাম কখন যে মেয়ে টা তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে টেরও পেলো না।
মেহরিন ওর দিকে পিঠ করে দেয়ালে লাগানো ছোট আয়না টার সামনে দাঁড়ালো। ওয়ারড্রব এর ওপর থেকে কাজল নিয়ে চোখে লাগালো। আব্রাহাম মেহরিন এর থেকে দেড় দুই ফিট্ লম্বা তো অনায়াসে হবে। তাই খুব বেশি অসুবিধা হলো না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগী রমণী কে দেখতে। মেহরিন কাজল লাগিয়ে যখন চুল আঁচড়াতে যাবে তখন বাঁধ সাধিল আব্রাহাম। পেছন থেকে হাত ধরে নিলো। মেহরিন আবারও চাইলো অবুঝ চোখে। আব্রাহাম একবার দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফের বউয়ের দিকে চাইলো। বললো,

-“চু বেঁধো না। এভাবে থাক।”

এরপর বিছানায় গিয়ে বসলো। মেহরিন কে বসালো নিজের সামনে। গভীর চোখে তাকিয়ে অবলোকন করে কাচুমাচু করিতে থাকা মেহরিন কে। আচ্ছা ওর কি মনে প্রশ্ন জাগে নিয়ে কেনো আব্রাহাম তাকে শাড়ী পড়তে বললো? হয়তো এসছে। এটা খুব বেশি অবাক হওয়ার নয়। তবুও আব্রাহাম এর এই বোকা রাণী কে কেনো জানি ভালবাসাহীন ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো না। কিছু সময় আগের জাগা কামনা বাসনা উবে গেলো। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে-ও যেনো আজ এই রমণী কে দেখার তৃষ্ণা মিটলো না। রাতের অর্ধ প্রহর হতেই মেহরিন এর চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। এতো সময় আব্রাহাম এর এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে লজ্জা পেলো ও এখন ঘুমে শরীর ঢুলঢুল করছে। আব্রাহাম ওকে এক হাতে নিজের বাহুর ওপর নিতেই ঘুম হওয়া হয়ে গেলো। চট করে সরতে নিলেই আব্রাহাম বলে উঠলো,

-“সরি মেহু রাণী। তোমার ঘুম দেখে হিংসে হচ্ছে আমার। নাউ আইএম জেলাস।”

কি বলবে মেহরিন। ড্যাবড্যাব চোখ জোড়া আরও বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো। মেহরিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্রাহাম মেয়ে টার অধরে আলতো করে চুমু খেলো। মেহরিন এর কি যে হলো। চোখ বন্ধ করে মানুষ টার পাগলামো মেনে নিলো। অস্বাভাবিক তো নয়। খুব স্বাভাবিক এটা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এমন টা হওয়ারই। মনের মধ্যে এই পুরুষ কে নিয়ে একটা অনুভূতি মেহরিন এর রয়েছে। সেটা বিয়ের আগে থেকে। এখন প্রশ্ন আব্রাহাম এর মনে আছে তো মেহরিন কে নিয়ে কোনো অনুভূতি! মেহরিন জানে না। তবুও নিজের মনে ছক কষে। অনুভূতি না থাকলে এতো কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে নিশ্চয়ই করতো না।

——–

তিন দিন হলো আজ আবরাজ কল করে না ফিজা কে। আজ আবার জুনায়েদ এসছে এ বাড়ি। ফিজা নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে শুয়েছে রাতে। মেয়ে টার আচমকাই আজ কোনো অজানা কারণে ভয় হচ্ছে। আব্রাহাম বাড়ি নেই। ইলা বেগম মিলন খান নিচের রুমে। জুনায়েদ নিচতলার দক্ষিণ করিডরের সেই গেস্ট রুমে। তবুও ভয় হচ্ছে বেচারির। বিশাল বড়ো এই বাড়িতে কোনো এক রুমে কেউ চিৎকার করে গলা ফাটালেও কেউ শুনবে না। ফিজা ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষায় একটা কল আসবে। ফোন করবে সেই মানুষ টা। একটু আশা অপেক্ষা। “সময় ফুরায় কিন্তু আমাদের অপেক্ষা ফুরায় না।” তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে মেয়ে টা। কি এমন রাজকার্যে ব্যাস্ত এই পুরুষ? একটা ফোনকল এর সময় নেই তার? আগে তো এমন হয় নি৷ চোখে তার অবহেলায় জল জমে নি। তবে আজ কেনো জমছে? উত্তর খুঁজে পায় না সে। ফোনের রিংটোন এর শব্দে চোখ মেলে চাইলো। গম্ভীর পুরুষের একখানা ছবি সাথে সাথে স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। কালো স্যুট পড়ে চশমা হাতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে নিজের কালো রঙের রোলস রয়েস কার টার দিকে। এটা ফিজা বাংলাদেশে দেখে নি। জার্মানিতে দেখা পেয়েছিলো এটার। নজরকাঁড়া এই কারে বসার মতো সৌভাগ্য তার হয়েছে। তর্জনী আঙুল ছুঁয়ে চোখের কোটর থেকে চোখের জল মুছে নিলো খুব সাবধানে। এরপর কল রিসিভ করলো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি সর্বপ্রথম নজরে এলো। বলেছিল তার দাড়ি ভালো লাগে। এরপর হঠাৎ হয়ে ওঠা প্রেমিক পুরুষ আর দাড়ি ফেলে দেয় নি। ক্লিন শেইভ করে নি আর। যার ফলস্বরূপ সুন্দর খোঁচা খোঁচা এই দাড়ি হয়েছে এখন।
আবরাজ ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির রেখে তাকিয়ে আছে। সাব্বির কল করে ছিলো তাকে৷ সে জানিয়েছে বউ তার আপসেট। দু’বার করে সাব্বির কেও কল করে ফেলেছে। অগত্যা যোগাযোগ করতেই হলো। নয়তো কাজ সম্পূর্ণ শেষ করে কথা বলে নিতো। এখনো তো মিস্টার জি এর সাথে সাক্ষাৎ বাকি।
ফিজার দুর্বলতা অনেক টা দূর হয়েছে। ঠিকঠাক সেবা আর খাবারের ফলে সম্ভব হয়েছে এটা। চোখ মুখ এখনো ফোলা। বেশ দারুণ দেখতে লাগছে। গলার লকেট টা এক পাশে গিয়ে ঘাড়ে পড়ে আছে। পড়েন লেডিস্ টি-শার্ট। বৃষ্টির সাথে বাইরে থেকে আসা ঝড় বাতাস এলোমেলো করছে খোঁপাবিহীন চুল। চুলের ভাজ করে রাখতে রাখতে বলে উঠলো,

-“বৃষ্টি হচ্ছে আবরাজ।”

আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে। তাদের মধ্যে বৃষ্টি নিয়ে স্মৃতি নেই। মৃদু স্বরে ডাকলো,

-“সুগন্ধি ফুল।”

-“উম।”

-“তোমায় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।

ফিজা চোখ বন্ধ করে নিলো সাথে সাথে। দূরে থেকে-ও এই পুরুষ তাহার সর্বস্তরে বিচরণ করছে। কোনো কথা হয় না দুজনের মধ্যে। নিরবতা ভেঙে ফিজার রুমের দরজায় আচমকাই কেউ কড়া নাড়ছে শব্দ হলো। শক্ত ধাঁচের ফিজা ভয় পেলো না-কি কে জানে। অল্প কেঁপে উঠলো মেয়ে টা।

#চলবে……