#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৪২
#জান্নাত_সুলতানা
আব্রাহাম অপেক্ষায় বসে। মেহরিন এলেই সে-ও শাওয়ার নিতে যাবে। কিন্তু এদিকে মেয়ে টার আসার নামগন্ধ নেই। আব্রাহাম এর সিগারেট সেই কখন শেষ হয়েছে। আরও একটু ধরাতে ইচ্ছে করছে না।
ফোন হাতে নিতে যাবে তখনই বেরিয়ে এলো মেহরিন। একদম ভেজা কাপড় ধুয়ে বালতি ভরে বেরিয়ে এসছে। গামছা মাথায় পেঁচানো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
-“শুনুন!”
-“হুম!”
আব্রাহাম আনমনে জবাব দিলো। মেহরিন মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-“যান। সকালে না অফিস যাবেন।”
মেয়ে টার কণ্ঠস্বর নিভে আসে যেনো। আব্রাহাম নড়েচড়ে ওঠে দাঁড়ালো। উদোম শরীর বুকের লোম বড়ই আকর্ষণীয় দেখায়। মেহরিন দৃষ্টি নত করে।
আব্রাহাম এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওয়াশ রুম চলে গেলো। মেহরিন বালতি রেখে চুল মুছে গামছা টা ঘরেই পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে মেলা দিলো। বিছানা ঠিকঠাক করে একদম পরিপাটি করে নিলো৷ এরপর এক পাশে গুটি-শুটি মেরে শুয়ে পরলো। আব্রাহাম কখন এসছে সেটা মেহরিন টের পেলো না। কেননা আব্রাহাম আসার আগেই বেচারি ঘুমিয়ে পরেছে। আব্রাহাম বেরিয়ে এসে সন্ধ্যায় মেহরিন এর আনিয়ে রাখা লুঙ্গি পরে নিলো। অদ্ভুত লাগলো। এটা পরে কিভাবে ঘুমবে বুঝতে পারে না। কিছু সময় বসে থেকে পায়ের ফাঁকে গিটঠু লাগিয়ে নিলো। এরপর লাইট অফ করে রিলাক্সে শুয়ে পড়লো।
——-
সকালে সাত টা বাজে তন্দ্রা ছুটে গেলো আব্রাহাম। ফোন করেছে মিলন খান। অফিস যেতে বলেছেন দ্রুত। আব্রাহাম আস্তে করে বিছানা ছাড়ে। বাবা-র সাথে কথা বলে। মিলন খান অফিস আসবে না। বাড়ি থাকবে। আব্রাহাম কৌতূহল নিয়ে বাবা-র চিন্তার কারণ জানতে চাইলো। এমনি এমনি তো বাবা বাড়ি থাকার পাত্র নয়। তারউপর চিন্তিত৷ মিলন খান বললেন,
-“গতকাল রাতে জুনায়েদ কি সব কান্ড করেছে। বাড়ি ফিরলে বলবো। এখন এ-সব নিয়ে তুমি টেনশন করো না।”
আব্রাহাম জোর করতে পারলো না। তবে মিলন খান আশ্বস্ত করলো তেমন ক্ষতি কিছু হয় নি। তাই আর বেশি কথা বাড়ালো না আব্রাহাম। ফোন রেখে মেহরিন এর দিকে তাকালো। ডাকতে ইচ্ছে করলো না। রেডি হয়ে নিলো। এরপর ঘুমন্ত বউয়ের পাশে গিয়ে বসলো। বড্ডো আদুরে মেহরিন। নাদুস-নুদুস মুখখানা মায়ায় ভরপুর। আব্রাহাম আনমনে ঘোর থেকে মেহরিন এর ডান হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নিলো। এলোমেলো চুল গুলো ঠিকঠাক করে দিলো আলতো করে। নাকে ছোট একটা স্বর্নের নাক ফুল। সেটাই জ্বলজ্বল করছে। কানে ও ছোট এক জোড়া দুল।
পর্যবেক্ষণ শেষ সময় এর কথা মনে পরত-ই আব্রাহাম দ্রুত বিছানা ছাড়লো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েও কি মনে করে আবার ফিরে এলো। মেহরিন এর একটা হাতে টুপ করে ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে এলো। মেহরিন অবশ্যই একটু কেঁপে উঠেছিল। তবে পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক ভাবে ঘুমে তলিয়ে গেলো।
আব্রাহাম বেরিয়ে এসে দেখলো খাবার ঘরে শাশুড়ী তার টেবিলে নাশতা দিচ্ছে। আব্রাহাম কে দেখে তিনি হাসলো। চেয়ার টেনে দিয়ে দূরে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলেন,
-“মেহরিন ওঠে নি?”
-“আমি ডাকি নি। থাকুক ঘুমিয়ে।”
মোহিতা বেগম আর কিছু বললো না। মেয়ে জামাই কে বেশ যত্নে করে আদরের সঙ্গে নাশতা দিলো। আপ্যায়ন এর ত্রুটি রাখলো না। নাশতা শেষ করে আব্রাহাম মোহিতা বেগম কে বলে বেরিয়ে পরলো অফিসের উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যে কল করলো সাব্বির কে। বাবার কথায় সে চিন্তামুক্ত হতে পারে নি। টেনশন তার অস্থির লাগছে। এতোটা অস্থির সে হতো না যদি না এখানে জুনায়েদ এর নাম টা আসতো। কেননা জুনায়েদ এর স্বভাব সম্পর্কে তার ধারণা আছে। তারউপর জুনায়েদ এর নজর যে ফিজার ওপর আছে সেটা সম্পর্কে ও সে আগে থেকে অবগত। সাব্বির কল ধরেই গতকাল রাতের সব বলে দিলো। রাগে আব্রাহাম এর শরীর এর রক্ত শিরা-উপশিরায় শিরশির করতে লাগলো।
——-
-“স্যার স্যার প্লিজ আপনি শান্ত হোন। স্যার আমার কথা শুনুন।”
আব্রাহাম শুনে না। মানে না সাব্বির এর বাঁধা। বেহুঁশ হয়ে পরে থাকা জুনায়েদ এর পেটে লাত্থি মারতেই থাকে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত চুইয়ে পরে। কোনো রকম পেঁচিয়ে রাখা ব্যান্ডেজ। আব্রাহাম সেটা থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“ওর ট্রিটমেন্ট কে করতে বলেছে? ওর কলিজা বের করবো আমি। খান বাড়ির বউয়ের দিকে নজর? ওর কলিজা কত বড়ো দেখতে চাই আমি।”
সাথে থাকা গার্ড সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সাব্বির আব্রাহাম এর হাত টেনে ধরলো। আব্রাহাম রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। সাব্বির ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। তার স্যার এর নিষেধ আছে যে। জুনায়েদ কে অক্ষত রাখতে বলেছে। তাই মিনমিন করে বললো,
-“আবরাজ স্যার নিষেধ করেছেন ওর কিছু করতে। স্যার ওর ব্যবস্থা করবে।”
আব্রাহাম ভাইয়ের কথা শুনে একটু শান্ত হলো। এরপর গায়ের শার্ট ঠিকঠাক করে বেরিয়ে গেলো। সাব্বির তপ্ত শ্বাস ফেললো। দুই ভাইয়ের কেউ রাগী কম নয়৷ প্রতিযোগিতা দিলে যদিও আবরাজ খান বিজয়ী হবে। তবে আব্রাহাম খান ও কম নয়।
———-
মিস্টার জি পাগলপ্রায়। একমাত্র মেয়ের ভয়াবহ মৃত্যু তিনি মানতে নারাজ। মেয়ে তার অসুস্থ। মানসিক ভাবে বিধস্ত ছিলো। কিন্তু নিজে নিজে কে মেরে ফেলার মতো কাজ করবে? করেছে। এটা কিভাবে বিশ্বাস করবে মেনে নিবেন তিনি। একদিকে নিজের বিজনেস এর খুব বেহাল দশা। জুতোর যে বিজনেস ছিলো। সেটা নামেমাত্র শো। এর পেছনে তো ছিলো অস্ত্র পাচার। এটা নিয়ে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। আবরাজ কনটেইনার শিপ না দেওয়াতে বিশাল ক্ষতির মুখে কোম্পানি। তারউপর মেয়ের মৃত্যুর শোক। কোন টা রেখে কোন টা পালন করবে এ নিয়ে যেনো চিন্তায় তিনি অসুস্থ হয়ে গেলো। শক্ত ধাঁচের এই মানুষ হসপিটাল ভর্তি হলো। নিজের ব্যাক্তিগত সহচারী এরমধ্যে এসে জানালো জুনায়েদ দেশে আবরাজ এর হাতে বন্দী। এ-ই যেন নিজের পতনের এক একটা ধাপ। মিস্টার জি চোখ বন্ধ করে রেস্ট করেন। মেয়ের সব কাজেও তিনি অনুপস্থিত। কি মারাত্মক যন্ত্রণা এটা যেনো ক্ষণেক্ষণে উপলব্ধি করছেন তিনি। তেইশ টা বছর এই মেয়ের জন্য কি-না করেছেন তিনি? খুনখারাপি যতরকম দুই নাম্বারি কর্ম। আর সেই মেয়ে তাকে ফাঁকি দিলো! উঁহু দিলো না-কি ইচ্ছে করে দেওয়ানো হলো? চোখ বন্ধ করে তিনি শুনতে পায়। কেউ ক্যাবিনে এসছে। চোখের ওপর ফেলে রাখা হাত না সরিও তিনি মানুষ টার উপস্থিত তিনি চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে। এই মানুষ টা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হলে-ও তাকে যে নতুন করে গড়ে তুলেছিল সে। নিজের মতো করে। হাতের পুতুল বানিয়ে রেখে ছিলো। রাগ উনার শরীর জ্বলছে। কাপছে সর্বাঙ্গ। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরলেন। আবরাজ যখন উনার কাছাকাছি এলো। তখনই তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
-“চলো যাও। খুব ভুল করলে। প্রস্তাবে এরজন্য। রিগ্রেট ফিল করবে। আই ওয়ার্ন ইউ।”
আবরাজ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো শুধু। সেই হাসিতে গা ছাড়া ভাব। বললেন,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে? আমার ও হয়েছে। এখন আমরা দু’জনে সন্তান হারা বাবা। আমি যা অনুভব করলাম সেটা আপনি ও করুন। কারোর দোষ নেই এতে।”
মিস্টার জি এর কোনো কথার অপেক্ষা না করে আবরাজ চলে গেলো। মিস্টার জি অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আবরাজ এর যাওয়ার পথে। কি বলে গেলো? বুঝতে পারলো না কথার অর্থ।
——–
আবরাজ চলে যাবে। কতদিন হলো সে বউ ছাড়া। এ যেনো এক যুদ্ধ ক্ষেত্র। নিজের সাথে নিজের লড়াই। আবরাজ এর এমন অস্থিরতা জন কে খুব করে ভাবায়। এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? সে তো আবরাজ এলে বউ ছাড়া থাকে। নিজের ফ্ল্যাটে যায় না। আবরাজ এর সাথে সাথে থাকে। কই সে তো এমন করে না। জন আবরাজ এর লাগেজ গোছাতে গোছাতে বলে,
-“স্যার আরও কটা দিন থেকে যান। এখন তো ঝামেলা নেই।”
আবরাজ ল্যাপটপে কিছু করতে করতে শুধু মৃদু হাসলো। জন একটু অপ্রস্তুত হলো। বিস্ময় ঠোঁট আপনা-আপনি প্রসারিত হলো। আবরাজ খান এর মুখে হাসি আমাবস্যা চাঁদের মতোই। মাসে একবার দেখা পাওয়া যায়। আমাবস্যার চাঁদ তো তা-ও মাসে একবার দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আবরাজ খান এর হাসি সেটা দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও আবরাজ কে ইদানীং একটু অন্য রকম লাগে। তবুও জন এর সত্যি টা সহ্য হলো না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আবরাজ জন এর ভাবনার মধ্যেই বলে উঠলো,
-“বিয়ের পরে-ও যদি বউয়ের থেকে দূরে থাকি তাহলে বিয়ের কি প্রয়োজন ছিলো? ব্যাচেলার লাইফ বিয়ের আগে ভালো। বিয়ের পর এটা অভিশাপ।”
আবরাজ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো। চোখ মুখও গম্ভীর দেখাচ্ছে। এদিকে জন থতমত খেলো। অভিশাপ? এটা কেমন কথা? তার তো অভিশাপ মনে হয় না। বরং ভালো লাগে। কিছু দিন রিলাক্স করা যায়। বউয়ের প্যান প্যান সহ্য করতে হয় না। সে সে-সব ভেবেই কথার প্রেক্ষিতে বললো,
-“স্যার আমার তো বেশ লাগে।”
-“তাহলে তোমার প্রবলেম আছে। ডক্টর দেখাতে হবে ইমিডিয়েটলি।”
আবরাজ এর কথায় জন কিছু বুঝলো না। এটার সাথে ডক্টর এর কি সম্পর্ক? আবরাজ কে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই দেখলো মহাশয় ওয়াশ রুম চলে গিয়েছে। জন দাঁড়িয়ে থেকে ভাবুক হলো। মাথা চুলকে কিছু সময় কথা খানা নিয়ে রিসার্চ করে চমকে উঠলো। দুই গালে হাত ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“তওবা, তওবা। স্যার আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। দুই বাচ্চার বাপ এমনি এমনি হয়েছি না-কি!”
-“টাওয়াল দাও।
সাব্বির চমকে উঠলো। ওয়াশ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আবরাজ। পরনে তার শুধু একটা টাওয়াল। সাব্বির থতমত খেলো। শুনে ফেললো কি তার কথা! পরপরই ভাবলো শুনলেই বা কি? সে কি মিথ্যা বলেছে নাকি!
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]