#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৪৪
#জান্নাত_সুলতানা
আবরাজ এর এক এক টা কথা যেনো বুকের ভেতর ঝড় তুলে ফিজার। শুধু চোখ বন্ধ করে আবরাজের বুকের মধ্যে আরও একটু সেঁধিয়ে গেল। আবরাজের বুকের স্পন্দনে নিজের প্রাণ মিশিয়ে দিচ্ছিলো। চোখ বন্ধ করে শুধু অনুভব করছিলো। তারপর খুব আস্তে, আব্রাজের বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“আমার জন্য আপনার হৃদয়ে এতটুকু যায়গা এনাফ আবরাজ।”
আবরাজ ফিজার একটা হাত টেনে নিজের শার্ট এর ভেতর দিয়ে বুকের ওপর নিয়ে রাখলো। অস্বাভাবিক ভাবে পুরুষ টার হার্ট টা ফাস্ট চলছে। ফিজা এবার মাথা তুলে আবরাজ এর দিকে চাইলো। মানুষ টার চোখে কিছু পাওয়ার তীব্র এক নেশা। ফিজা নিজের হাত টা আলগোছে সরিয়ে আনলো। দুই কদম পেছনে চলে এলো। পেছনে দেয়ালের সাথে লাগানো ছোট্ট একটা বুকশেলফ। সেটাতে আর একটুর জন্য ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচে। আবরাজ এগিয়ে আসে। ফিজা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। অনেক সময় হয়েছে তারা ওপরে এসছে। নিচে যেতে হবে। তবে আবরাজ এর মতিগতি যেনো ভিন্ন। ফিজা বুঝতে পারে।
এরমধ্যে আবরাজ একদম ফিজার নিকটে এসে দাঁড়ালো। নিজের বাঁ হাত ফিজার ঘাড় সহ গালে রাখলো। নিজের মুখ এগিয়ে অধর এর দিকে অগ্রসর হয়। এক টানে মেয়ে টাকে ঘনিষ্ঠ করে নিজের সঙ্গে। একটা হাতের অবাধ্য বিচরণ চলে ফিজার পিঠে। ক্ষণেক্ষণে কেঁপে ওঠে মেয়ে টা। যখনই দুই জোড়া ওষ্ঠদ্বয় ছুঁই ছুঁই করে তৎক্ষনাৎ ফিজা মুখ টা ঘুরিয়ে নিলো। অবাক হতভম্ব হয় সামনের পুরুষ। বাঁকা হয়ে শান্ত দৃষ্টিতে চাইলো ফিজার মুখের দিকে। ফিজা নিজের ওষ্ঠদ্বয় মুখের ভেতর পুরে নিয়েছে। যা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে আবরাজের। ফিজা জানে আবরাজ খান কে একটু আশকারা দেওয়া মানে এই মূহুর্তে দিনদুনিয়া ভুলে যাওয়া। যেই একরোখা জেদি মানুষ। দেখা গেলো যতক্ষণ না নিজের খায়েশ মিটবে ততক্ষণে সে ছাড়া পাবে না। এদিকে নিচে যেতে হবে। ফিজার ভাবনার মাঝে ই আবরাজ জিজ্ঞেস করলো,
-“হোয়াট’স রং?”
-“নিচে যেতে হবে।”
-“আই ওয়ান্ট অ্যা কিস। রাইট নাউ।”
বলতে বলতে ফিজার মুখ টা দুই হাতে নিজের হাতের আঁজল নিয়ে নিলো। ফিজা এবার যেনো হতভম্ব। একটু আগের আবরাজ খানের সাথে যেনো এই আবরাজের কোনো মিল নেই। ফিজা বাঁধা দেওয়ার আগেই একজন সার্ভেন্ট রুমের বাইরে থেকে ডেকে উঠলো। আবরাজ রক্ত চক্ষু নিয়ে ব্যালকনি থেকে রুমের দিকে তাকালো। পরপরই ফিজা কে ছেড়ে দিয়ে পেছনের বুকশেলফ টা হঠাৎ খুব জোরে হাতে ধাক্কা দিলো। বইগুলো কিছু নিচে পরলো তো কিছু নড়েচড়ে আবার স্থান বসে রইলো। ফিজা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো আবরাজ এর দিকে। আবরাজ টাই টা কোনো রকম গলা থেকে প্যাচ খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো। ফিজা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাগে পুরুষ টার চোখ লাল হয়েছে। ভীষণ অসন্তুষ্ট দেখালো মানুষ টাকে। ফিজার ওপর রাগ যেনো বুকশেলফে ঝেড়ে গেলো। আবরাজ রুমে এসে ওয়াশ রুম চলে গেলো। ফিজা তখন দাঁড়িয়ে। সার্ভেন্ট এর দ্বিতীয় বার ডাক পড়তে সে বই গুলো শেলফে গুছিয়ে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মেয়ে টার চোখে পানি টলমল করছে।
বাথটবে বসে আছে আবরাজ সাদা রঙের শার্ট টা ভিজে জুবুথুবু অবস্থা। গোছানো চুল এলোমেলো। তবুও কি ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে এই পুরুষ কে। আবরাজ পাশের ছোট একটা পাত্র থেকে কিছু গোলাপের পাপড়ি তুলে নেয়। মুঠোয় করে নাকের সামনে ধরতেই নাসারন্ধ্র পৌঁছাল ফুলের তীব্র সুগন্ধি। আবরাজ চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস টানলো। আগে যে মানুষ টার ফুলের ঘ্রাণ ছিলো অপছন্দ সেই ফুলের গন্ধই এখন তার অতি প্রিয়।
আবরাজ ফুল গুলো পানিতে ফেলতে লাগলো আস্তে আস্তে। আর স্লো ভয়সে বলতে লাগলো,
-“আবরাজ খানের ফুল এবং ফুলের গন্ধ অপ্রিয়। বাট তুমি এবং তোমার শরীর থেকে আসা স্মেল আবরাজ খানের অতি প্রিয়, সুগন্ধি ফুল।”
—–
আব্রাহাম নেই ডিনার টেবিলে। ভ্রু কুঁচকে এলো ফিজার। ইলা বেগম জানালো সে কোথাও একটা গিয়েছে। রাতে ফিরবে না। ব্যাপার টা তেমন কেউই পাত্তা দিলো না। খাবার শেষ যখন আবরাজ ফিজা দু’জন রুমে ফিরে এলো আবরাজ তখন নিজের একটা লাগেজ থেকে কিছু বের করছে। ফিজা রাতের কিছু প্রসাধনী হাতে পায়ে লাগাতে ব্যাস্ত। আবরাজ কি করছে মেয়ে টার সেদিকে একদম খেয়াল নেই। শাড়ির জন্য তার মন খারাপ প্রচন্ড। সেখানে আবরাজ এর ব্যবহার বরাবরই তাকে অনেক নেগেটিভ কিছু ভাবত বাধ্য করে। তবুও কথা বলতে হবে। জানাতে হবে শাড়ি গুলো নেই। তাই মিনমিন করে বললো,
-“শুনুন না,শাড়ী গুলো কম আছে। কোথায় গেলো বুঝতে পারছি না।”
আবরাজ এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। ফিজা কিছু সময় অপেক্ষা করলো। ভাবলো আবরাজ বুঝি কিছু বলবে। কিন্তু কিছু ই হলো না। আবরাজ নিজের মতো করে কাজে ব্যাস্ত। ফিজা বেশ অবাক হলো। মনে মনে কষ্ট ও পেলো। এভাবে এমন কেনো করছে? তাহলে কি শুধু ফিজা এই মানুষ টার চোখে সৌন্দর্যের মধ্যে রয়ে গেলো। মনে কি যায়গা পায় নি? ফিজা নিজের ওপর বিরক্ত হলো। এতো টা এক্সপেকটেশন সে কিভাবে রাখে? চোখের জল আড়াল করে মেয়ে টা তপ্ত শ্বাস ফেললো। এরপর বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। যে মানুষ টা নিজের সন্তান হারানোর একদিন পর স্ত্রী কে ফেলে কাজের জন্য ছুটতে পারে সেই সুদূর জার্মানিতে সেই পুরুষ কিভাবে মনের কথা বুঝবে? ফিজার হিসাব মিলছে না। একবার খারাপ টা মনে পরছে তো আরেকবার ভালো টা। সে কোন টা ধরবে? মেয়ে টা ভাবনায় এতোটাই বিভোর যে কখন যে আবরাজ এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে টেরও পেলো না। বালিশ টা ঠিক করে যখন শোয়ার জন্য বিছানায় বসবে তখনই নিজে কে শূন্যে অনুভব করলো। চমকে উঠে হাত দিয়ে খামচে ধরলো সামনের মানুষ টাকে। সামনের মানুষের ঘাড়ে আঁচড় পরলো সেই খামচিতে। আবরাজ নিচের ঠোঁটের একপাশ দাঁত দ্বারা চেপে ধরলো। বললো,
-“আমার টি-শার্ট নষ্ট করবে না সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা আবরাজ এর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ঘাড়ের দিকে তাকালো। গলার দিকে সে খামচে ধরে আছে। টি-শার্ট মুচড়ে গিয়েছে। যা থেকে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। আবরাজ আস্তে-ধীরে হাঁটে। ফিজা চুপ করে থাকে। আবরাজ সোফা টার ডান দিকে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের বাঁ দিকে দাঁড়ালো। যেখানে সামনে রয়েছে দেয়াল। ভাবুক হলো ফিজা। দেয়ালের সামনে এসে কেনো দাঁড়াল? ফিজা ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে উঠলো,
-“এগারো দিনের সব অ্যালকোহলের নেশা কি আজ ধরলো!”
আবরাজ অদ্ভুত ভাবে মুচকি হাসলো। পা টা সামন্য একটু উঁচু করে দেয়ালে লাগাতে এটা খুলে দু’পাশে চলে গেলো। দরজা দেখে ফিজা হতভম্ব হয়ে গেলো। আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে বেচারি। ঠোঁট টা অটোমেটিক প্রসারিত হলো। আবরাজ আঁড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে রুমের ভেতর চলে এলো। রুমের ভেতর এর সৌন্দর্য দেখে ফিজা মুগ্ধ হলো। আবরাজ ওকে কোল থেকে নামিয়ে নিজে একপাশে দাঁড়িয়ে পরলো। ফিজা মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। থতমত খেয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রইলো। তার শাড়ী রয়েছে এখানে। পুরো একটা শাড়ির দোকান যেনো। আবার নতুন কিন্তু এড হয়েছে। শাড়ী, জুতো, ব্যাগ, চুড়ি, কানের দুল সব রকম কসমেটিকস মেয়েদের। পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা কিছু একটা দেখে ফিজা একটু এগিয়ে এলো। সাদা পর্দা টা সরিয়ে দিতে ড্রেসিং টেবিলটায় আবরাজ খান এর প্রতিবিম্ব একপাশে দেখা গেলো। অন্য পাশে ফিজা। আবরাজ এর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ফিজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
-“এসব কখন করলেন?”
-“অনেকদিন আগে।”
আবরাজ কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসে। ফিজার পেছনে এসে থামলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর কালো কাপড়ে ঢাকা একটা বক্স। কিসের বক্স হতে পারে! কাপড় সরাতে চোখে পরলো নেকলেসের বক্স এটা। ফিজা এবার নিজের বিস্ময় প্রকাশ করেই ফেললো। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
-“আবরাজ।”
-“ইয়েস মিসেস আবরাজ।”
আবরাজ ফিজার কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে স্লো ভয়সে জবাব দিলো। দুই হাতে মেয়ে টার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ছিলো। ডান হাত টা বাড়িয়ে বক্স টা থেকে আগে নেকলেস টা তুলে নিলো। ফিজা এটার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলো। কি সুন্দর ছোট ছোট ডায়মন্ড বসিয়ে কাজ করা নরমাল একটা নেকলেস। ফিজা জানে এটার দাম অনেক। তবুও আবার বললো,
-“এটার দাম তো অনেক।”
আবরাজ বউয়ের চুল গুলো কাঁধ থেকে সরিয়ে দিলো। খুব সাবধানে গলায় পড়িয়ে দিলো নেকলেস টা। জ্বলজ্বল করে ফিজার ফরসা চামড়ায়। সুন্দরী রমণীর গলা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আরও কয়েকগুণ। আবরাজ পেছনের দিকে টপস এর চেইন খুলে পিঠের দিকে চুমু খেলো বউয়ের। ফিজা চোখ বন্ধ করে নিলো। আবরাজ পেছনে থেকে মেয়ে টার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো দুই হাতে। পেটের ওপর হাত রাখলো আড়াআড়ি ভাবে। নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করলো সম্পূর্ণ। গলার দিকে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বললো,
-“মানি ডজেন্ট ম্যাটার। বাট ইউর হ্যাপিনেস ইজ দ্য মোস্ট প্রিসিয়াস থিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু মি।”
ফিজা সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে আবরাজ এর দিকে চাইলো। ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো পুরুষ টাকে। বুকের ভেতর অশান্তি, মাথায় চলতে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব উবে গেলো। প্রশান্তি ভরে গেলো মন। দুঃখ ভুলতে সময় লাগে কিংবা কখনো সেটাও সম্ভব হয় না। কিন্তু অভিমান ভোলাতে প্রিয় মানুষ টার একটু ভালোবাসা, একটু যত্ন, একটু আদর, আর একটুখানিক প্রায়োরিটি। আর কি চাই! ভালোবাসার পাগল মানুষ গুলো এতেই ভীষণ খুশি।
#চলবে….