সুগন্ধি ফুল পর্ব-৪৯

0
392

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৪৯
#জান্নাত_সুলতানা

আবরাজ আটটার দিকে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো। ফিজা বিছানায় শুয়ে তখনও শরীর দুর্বল। উঠতে ইচ্ছে করে না। তবে অফিস যাওয়ার জন্য যে আবরাজ বলে গেলো সেটাও বা অমান্য কিভাবে করবে? তাছাড়া তার যোগ্যতা আছে। লেখাপড়া করিয়েছে মা অনেক কষ্ট। তাহলে সে কেনো বসে বসে খাবে? বিছানা ছাড়তে বেশ কষ্ট হলো। শরীর জুড়ে ব্যথায় টনটনি ওঠে। তবুও শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নিলো। নিচে এসে নাশতার টেবিলে আবরাজের দেখা পেলো। সাথে মিলন খান, মিষ্টি, ইলা বেগম, সাব্বির কিছু নিয়ে তাদের মধ্যে পুরোদমে আলোচনা চলছে। ফিজার কথার টোন শুনে একটু দেরি হলো না সবাই কি নিয়ে আলোচনায় মেতেছে। মন টা বেশ ফুরফুরে হলো। মিলন খান ওকে ও কিছু বিষয় জানালো। শুধুমাত্র তো অনুষ্ঠান। খান বাড়িতেই করতে যাচ্ছে তিনি। ফিজা এমনিতেই কিছু বললো না। তবে নিজের বাবা-র রেখে যাওয়া আর মায়ের সাধ্য অনুযায়ী যা পারে তিনি করবেন এমন ইঙ্গিত দিলো। মিলন খান বুঝলেন। মেনে নিলেন। মোহিতা বেগমের সাথে কথা হয়েছে। ব্যাস এখন শুধু বউ নিয়ে আসতে পারলেই হয়। এরমধ্যে ফিজা নাশতা প্রায় খাওয়া শেষ। তখনই মিলন খান হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

-“তুমি কি বাড়িতে যাবে?”

-“না তো বাবা। আমি অফিস যাচ্ছি।”

-“বাট হোয়াই?”

মিলন খান ভ্রু জোড়া টানটান করে বলে উঠলো। চশমার ওপর দিয়ে ভ্রু জোড়া কপালে ওঠে গেলো। ফিজা আবরাজের দিকে এক পলক দেখলো। পুরুষ টা মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। দিন দুনিয়া যেনো ভুলে গিয়েছে সে। ফিজা সেদিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা দুলিয়ে বললো,

-“বাড়িতে বসে থেকে কি লাভ অফিস গেলে তো একটু সাহায্য করা যাবে আপনাদের।”

-“আমরা মরে যাই নি। বাড়িতে থাকো। রেস্ট করো।”

কিছু দিন আগেই না কত বড়ো এক্সিডেন্ট হলো। মেয়ে টার ওপর দিয়ে কি ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেলো। এখন আবার অফিস করবে? তাছাড়া এটার প্রয়োজন নেই। এখন তারা তিন বাপ-বেটা রয়েছে। পুত্রবধূকে দিয়ে কাজ করাতে তিনি নারাজ। ইলা বেগম ও চায় না ফিজা অফিস করে। যদি প্রয়োজন পড়ে অবশ্যই করবে তবে এখন আর না। সবার অমত। আবরাজ কিছু ই বললো না এখানে। নাশতা শেষ হতে পা চালিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। ফিজা পুরুষ টার যাওয়ার পথে অপলক তাকিয়ে রইলো।

——-

মেহরিনের অসুস্থতা জানার পর আব্রাহাম আর একটু ও জোড়াজুড়ি করে নি। এটা ভাবলেই দেহ মন পুলকিত হচ্ছে মেহরিন নামের ভাগ্যবতী রমণীর। সত্যি সে ভাগ্যবতী? হয়তো। অতো কিছু ভাবছে না কিছু নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে না। যা সে দেখছে, দেখেছে সেটাই গলাধঃকরণ করছে। এ যেনো এক বিচিত্র দৃশ্য। এমন “সাধাসিধে মানুষ কতোটা ভালোবাসা পায় জানা নেই। তবে যা পায় তা কল্পনার বাইরে থাকে। সেটা এতোটাই বিস্ময়কর হতে পারে হয় জীবন বদলে দেয় না-হয় জীবন বদলা নেয়।” এখানে দু’টো হতে পারে জীবনে চলার পথে। মেহরিনের ভবিষ্যত জীবন কি হবে সেটা ভাবে না মেয়ে টা। আব্রাহাম যখন চলে গেলো তখন মেহরিন কে বলে গেলো,

-“আজ কে রেখে গেলাম। এটাই লাস্ট। এরপর একা-একা মায়ের কাছে থাকার কথা ভুলেও মাথায় এনো না, মেহুরানী।”

এ যেনো ওয়ার্নিং। কণ্ঠে অধিকারবোধ। মেহরিনের নাজুক নরম মন গলে পানি। কিছু ভাবে না। নেগেটিভ কিছু ভাবতে ও ভালো লাগে না। হোক না হচ্ছে যখন সবকিছু পজিটিভ।

———

খেয়ে মাত্র ঘুমিয়েছিল ফিজা। বিয়ের শপিং করা নিয়ে ঝামেলা নেই। আব্রাহাম বাইরে থেকে বউয়ের জন্য সব আনিয়েছে। আর আবরাজ বাড়ির সবার জন্য সেদিন আসার সময় শপিং করে এনেছে। মিষ্টি কে নিয়ে আজ সব প্যাকিং আনবক্সিং করেছে। এরপর দুপুরে খাবার খেয়ে শুয়েছে একটু আগে। চোখ লেগেই এসছিলো। তখন ফোন টা বেজে উঠলো। ফিজা বড্ডো বিরক্ত হলো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফোন রিসিভ করলো। অচেনা বিদেশি নাম্বার দেখে বিরক্ত চলে গেলো। যখন ওপ্রান্তের ব্যাক্তি কথা বলতে শুরু করলো ফিজার মুখ শুঁকিয়ে এলো। ফ্যাকাসে দেখালো সুশ্রী সুদর্শনা চেহারা। ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। ফোন ঠাঁই কানে চেপে ধরে চুপ করে রইলো। কিন্তু ফোন ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। সেদিকে মেয়ে টার খেয়াল নেই। যখন হুঁশ এলো ফোন হাত থেকে আলগোছে নিচে পড়ে গেলো। ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। হাঁটুর ভাজে মুখ গুঁজে এক সময় ডুকরে কেঁদে ফেললো মেয়ে টা। নিঃশব্দ সেই কান্না। কোনো আওয়াজ নেই। বুক ফাটা আর্তনাদ যেনো। হৃদয় ভাঙার শব্দ যে শুনতে পাওয়া যায় না। বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার শব্দ যে শুনতে পাওয়া যায় না। তবুও তার হৃদয় শান্ত হতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে পিপাসা পেলো। ঠোঁট শুঁকিয়ে আসে। ঘন্টাখানেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সে চোখের জল মুছে নিলো। এরপর ফোন টা হাতে নিয়ে খুব দ্রুত হাতে কিছু খুঁজতে শুরু করলো। ইনস্টাগ্রাম অ্যাপে হন্নে হয়ে কিছু খুঁজে খুঁজে হয়রান হলো। জুনায়েদ কবির একাউন্ট টা অনেক খোঁজা-খুঁজি করে পেলো। গত তেরো দিনে কোনো পোস্ট স্টোরি আসে নি এই আইডি থেকে। শেষ ঘুরতে গিয়ে যে পিকচার আপলোড করেছে এ-সবই। ফিজার কপালে ঘাম জমতে শুরু করে। সব মিথ্যা হোক। মনপ্রাণ দিয়ে চাইলো। হায় মানুষ যা চায় তাই যদি হতো তাহলে এরচেয়ে ভালো আর কি বা হতো! ফিজা “তৃণাচ্ছন্ন জি” নামের একাউন্ট টাও খুব সহজে পেলো। বেশ কিছু পোস্টে জুনায়েদ তৃণা কে মেনশন করে রেখেছে। সেখানে গিয়ে বিগত পনেরো দিনে তৃণার কোনো আপডেট পেলো না। সে তপ্ত শ্বাস ফেললো। সে যা কখনো কল্পনা ও করে নি তাই হয়েছে। কিন্তু কেনো হলো এমন? সে তো এমন চায় নি। “মানুষ যা ভাবে তা কখনোই হয় না। আর যা কখনোই কল্পনা ও করে না। সেটাই হয়।” ফিজা ফোন টা রেখে গায়ের ওড়না ঠিক করে জড়িয়ে নিলো। তখন বিকেল। চুল গুলো হাতে খোঁপা বেঁধে পানির গ্লাস টা হাতে তুলে নিলো। ঢকঢক করে পানি খেলো। পুরো গ্লাস খালি করে তবেই ক্ষান্ত হলো মেয়ে টা। আয়নার দিকে নিজের বিধস্ত বিবরণ মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। ভেতর থেকে কেউ যেনো বলে উঠলো, “তোর ভালোবাসায় ভুল ছিলো না। কিন্তু যাকে ভালোবেসেছিস সেই মানুষ টা ভুল।” ফিজা এই কথায় সহমত।

-“আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙেছেন বলে আমার একটু ও কষ্ট হচ্ছে না। আমার আপসোস হচ্ছে এটা ভেবে, যে আমি আপনার মতো কাউ কে ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি।”

ফিজার চোখ দিয়ে তখন জল গড়িয়ে পড়ে না। চোখে-মুখে মেয়ে টার এক আক্রোশ, ঘৃণা। এ দৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হলে আবরাজ খান নিশ্চয়ই দুঃখে মরবে পুরো জিন্দিগি। এটা চায় না ফিজা। ভালোবাসার মানুষ টার জন্য নিজের চোখে ঘৃণা কয়জন আনতে পারে! উঁহু পারে না। ফিজা পারলো। তবে চাইলো না এতো সহজ মানুষ টার শাস্তি হয়। কঠিন ভয়ংকর শাস্তি এই মানুষ টার প্রাপ্য।

——-

অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে আবরাজের ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে। ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবে। বউ কোথায়? রাত অনেক হয়েছে। প্রায় দশ টা। নিচে সবাই খাবার খেয়ে বসে আছে। বউ সেখানে নেই। খেতে যায় নি। তাহলে কোথায় আছে? আবরাজ গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলো,

-“সুগন্ধি ফুল। হোয়্যার আর ইউ? প্লিজ কাম বেইবি।”

দৃষ্টিতে পুরুষ টা কেমন অস্থিরতা। কোনো সাড়াশব্দ নেই বউয়ের। এদিক-ওদিক দৃষ্টি বুলিয়ে দেয়ালে সুইচ চেপে লাইট অন করলো। তৎক্ষনাৎ নজরে এলো ভেতরের ছোট রুমের দরজা খোলা। আবরাজ কৌতূহলবশে কদম ফেলে সেদিকে। কালো সু জোড়ার খটখট শব্দ হয়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতর ঘরে উঁকি মারতেই চোখ জোড়া শীতল হলো। নিষ্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে রইলো শাড়ী পড়ায় মনোযোগী বউয়ের উন্মুক্ত বাঁকানো কটিদেশ। ফরসা চিকন আঙুল দিয়ে সেথায় গুঁজে দিচ্ছে শাড়ী। ভেতর থেকে এলোমেলো হতে আবরাজ খানের জন্য বউয়ের এতোটুকু আবেদনময়ী রূপ যথেষ্ট ছিলো। স্থির পা জোড়া চলমান হলো। ভয়াবহ এক ইচ্ছেশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। চোখের অতলে সব সময়ের মতো গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেলো। তবে শব্দে নয়। এই এক রমণী যার জন্য আবরাজ খান সবকিছু ছেড়ে দিলো। কিন্তু তা কি কখনো জানবে এই রমণী? জানার চেষ্টা করবে! না-কি মস্ত এক প্রাচীরের আড়ালে থাকা সত্যি সে কখনোই জানতে পারবে না!

#চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]